বিদেশী গল্প ইংরিজি গল্প -একটা লোকে্র গল্প ডাবলিউ ডাবলিউ জ্যকব্‌স্‌অনুবাদ অমিত দেবনাথ শরৎ ২০১৭

অমিত দেবনাথ এর সমস্ত গল্প একত্রে

মশাইরা, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে যাঁরা সমুদ্দুরে যাত্রা-টাত্রা করে থাকেন, তাঁরা আমাদের মতন এই ডাঙার মানুষদের চেয়ে একটু বেশিই ইয়ে-মত হয়ে থাকেন – যাকে বলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন আর কি। আসলে ব্যাপারটা হল কী – চারদিকে যখন সমুদ্দুরের কালো জল ছেয়ে থাকে, হাওয়া দিতে থাকে ঝড়ের মতন, সমুদ্দুরের গভীরতা আর অদ্ভুত সব প্রাণীদের চিন্তায় মন-মাথা সব ভোঁ-ভোঁ করে সারাক্ষণ ধরে, তখন ঐ আধিভৌতিক ব্যাপার-স্যাপারগুলো মনের ভেতরে সেঁধোতে বিশেষ সময় লাগে না, সে আমরা যতই আলোকোজ্জ্বল ডাঙায় বসে এর বিরুদ্ধে গলা ফাটাই না কেন। অলৌকিক বিষয়ে নানা ধরণের গল্প শোনা যায়, যেগুলো খুবই গতানুগতিক, আবার এমন ঘটনাও আছে, যেগুলো সম্বন্ধে হাজার মাথা ঘামিয়েও কোন থই পাওয়া যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, এরকম নানা ধরণের ঘটনার মধ্যে একখানা ঘটেছিল আমার জীবনেই, আর তারপর থেকেই আমি ফট করে কাউকে এ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছি। বলি ঘটনাটা।

আমার বয়স তখন বছর পনের হবে, আমি এক জাহাজে ভেসে পড়েছিলাম, যদিও আমার বাবার এতে একেবারেই মত ছিল না। জাহাজটার নাম ছিল এনডেভার – ছোট জাহাজ, দুই মাস্তুলওলা একটা ব্রিগ – যাচ্ছিল রিগায়, আর এর ক্যাপ্টেন ছিল চমৎকার মানুষ – যে কোন নাবিকই এরকম ক্যাপ্টেনকে খুব পছন্দ করবে। প্রথম সমুদ্রযাত্রা যে কোন ছোট ছেলের পক্ষেই একটু মুশকিলের, তাই আমি প্রথমেই বিল স্মিথ নামের একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেললাম। শক্ত-সমর্থ চেহারার বিল ছিল নরম-সরম স্বভাবের মানুষ, আর কয়েকদিনের মধ্যেই খেয়াল করলাম, আমাকে কেউ থাই-থাপ্পর মারতে গেলে বিল আমাকে আগলে রাখছে। নাবিকদের মধ্যে যে সবাই রুক্ষসুক্ষ আর বদরাগী, তা নয়, তবে ওদের ধারণা ছিল, প্রথম প্রথম ছেলে-ছোকরাদের একটু মারধোরের মধ্যে রাখলে তাদের শরীর-স্বাস্থ্য ভাল থাকে।

একজনই ছিল ওদের মধ্যে তিতকুটে আর রুক্ষ স্বভাবের – তার নাম জেম ডাড। ফ্যাকাশে চেহারার এই লোকটা ছিল ঘোর কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ভূত-প্রেতে তার অগাধ বিশ্বাস আর এই বিশ্বাস অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তার উৎসাহ ছিল আরো বেশি। তার কাছ থেকে এই সব গল্পের কয়েকটা শোনার পর একদিন আমি দেখেছি বিলের হাল খারাপ হয়ে গেছে, এত বেশি ভয় পেয়েছে যে সে তার ডিউটি দিতে রাত্তিরে ডেকে যেতে চাইছে না। সব জাহাজেই কিছু না কিছু ইঁদুর থাকেই, আর এই ইঁদুরেরা ছিল ডাডের প্রিয় জিনিস, সে কিছুতেই ইঁদুর মারতে দিত না, বলত এই ইঁদুরগুলো নাকি যে সব নাবিক জলে ডুবে মরেছে, তাদের আত্মা, ওরা জাহাজে থাকতে বড় ভালবাসে, তাই ওদের থাকতে দিতে হবে, যখন ওরা বুঝবে আর ওদের দরকার নেই, তখন ওরা নিজেরাই চলে যাবে। আত্মার দেহান্তরবাদে তার অচলা বিশ্বাস – প্রাচ্যদেশীয় কোনও বন্দর থেকেই সে এই ধারণাটা পেয়েছিল নির্ঘাত, আর মরার পরে তারও যে ওইরকমই কিছু একটা হবে, এ সব বলেও সে তার শ্রোতাদের হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল।

জাহাজে দিন ছয়-সাতেক যাওয়ার পর একটা ঘটনা ঘটল। সে রাত্তিরে ডাড ছিল সেকেন্ড-ওয়াচ আর বিল ছিল তার বদলি। আবহাওয়া ভাল থাকলে আমাদের জাহাজে খুব একটা কড়াকড়ি করা হত না, কারোর ডিউটির সময় পেরিয়ে গেলে সে খালি হুইলটাকে আরো দ্রুত করে দিত আর জোরে একটা হাঁক দিত তার বদলিকে। একদিন রাত্রে আমার ঘুম আচমকা ভেঙে গেল। দেখলাম বিল তার বাঙ্ক থেকে নেমে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তার ঘুম-ঘুম লাল চোখদুটো কচলাচ্ছে হাত দিয়ে।

    “আমার ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হয়ে গেছে,” আমি জেগেছি দেখে ফিসফিস করে বলল সে, “একঘন্টার বেশি হয়ে গেল। ডাড এখনো ডিউটি দিয়ে যাচ্ছে! এহ্! আমার কপালে দুঃখ আছে আজ!”

    দুদ্দাড় করে সে উঠে গেল ডেকের ওপর। আমি আবার পাশ ফিরে শুলাম। কপাল ভাল, আমার বয়সটা কম বলে এখনও পাহারার কাজ করতে হচ্ছে না। হঠাৎই কার পায়ের শব্দ পেলাম। তাকিয়ে দেখি, বিল নিঃশব্দে নেমে আসছে নিচে, আর আমি কিছু বোঝার আগেই ও আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল।

    “জ্যাক, জ্যাক,” ফিসফিস করে বলল সে, “শুনতে পাচ্ছ?”

    আমি মাথা তুলে ঘরের সেই ধোঁয়াটে আলোয় দেখলাম সে ঠকঠক করে কাঁপছে।

    “ডেকে চল,” ভারি গলায় সে বলল।

    জামাকাপড় পরে আমি নিঃশব্দে তার পিছু নিলাম। বাইরের আবহাওয়া চমৎকার, ঠান্ডা হাওয়া বইছিল, কিন্তু ওর ভাবসাব দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম, ইতিউতি চাইতে লাগলাম এদিক-ওদিক, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। ডেক এক্কেবারে ফাঁকা, শুধু হুইলের সামনের দাঁড়িয়ে থাকা ডাডকে দেখা যাচ্ছে।

    “ওর দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখো তো,” আমার দিকে ঝুঁকে, আমার কানে কানে বলল বিল।

    আমি খানিকটা এগিয়ে গেলাম, আমার পিছু পিছু বিলও। তারপর দেখতে পেলাম জেম ডাড কিরকমভাবে যেন হুইলের ওপর নুইয়ে পড়েছে, আর ওর হাতদুটো শক্ত করে ধরে আছে হুইলের স্পোকগুলো।

    “ও কী? ঘুমিয়ে পড়ল নাকি হে?” আমি দেখতে দেখতে বললাম।

    বিল জোরদার নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। বলল, “ঘোর লেগে গেছে বোধহয়। কাছে গিয়ে দেখা যাক।”

    বিলের একটা আস্তিন আঁকড়ে ধরে দুজনে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। আকাশভরা তারা ছিল সে রাতে। সেই আলোয় মোটামুটি সব কিছুই বোঝা যাচ্ছিল। দেখলাম ডাডের মুখ একেবারে সাদা হয়ে গেছে, বড় বড় ঘোলাটে কালো চোখ মেলে সে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, সে চোখের চাহনি বড় অদ্ভুত –

    “ডাড,” আমি আস্তে আস্তে ডাকলাম, “ডাড!”

    ডাডের কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ওকে জাগানোর চেষ্টায় আমি ওর একটা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম, যে পেশিবহুল হাত দিয়ে ও হুইলটা ধরে রেখেছিল। কিন্তু ওকে নাড়ানো গেল না পর্যন্ত। আচমকা আমার সাহস উবে গেল, একটা বিকট চিৎকার ছেড়ে আমি আর বিল দ্রুতবেগে নেমে গেলাম নিচের কেবিনে, জাগিয়ে তুললাম জাহাজের ক্যাপ্টেনকে।

    তারপর আমরা দেখলাম, দুজন শক্তপোক্ত নাবিক কিভাবে জেম ডাডের শক্ত হয়ে যাওয়া আঙুলগুলো হুইলের থেকে ছাড়িয়ে তার শরীরটাকে শুইয়ে দিল জাহাজের ডেকের ওপর, একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দিল তাকে। বাকি রাতটা ওই দু’জনই দায়িত্ব নিল হুইলের, চোরা চোখে ডেকের ওপর চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা ডাডের দেহটার দিকে তাকাতে তাকাতে, সকাল হওয়ার অপেক্ষায়।

    অবশেষে সকাল হল। জলখাবারের পালা সাঙ্গ হলে জেম ডাডের চাদর মোড়া দেহটা সেলাই করা হল। তারপর ক্যাপ্টেন জাহাজের মেটের কাছ থেকে বাইবেল নিয়ে সেখান থেকে কিছু পাঠ করলেন, অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার জন্য। তারপর শবদেহটা জলে ফেলে দেওয়া হল। সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে যে যার কাজে চলে গেল।

    সারাটা দিন সবাই খুব চুপচাপই রইল। মনটা সবার খারাপই ছিল মরে যাওয়া ডাডের কথা ভেবে, কিন্তু রাত্তির আসতেই হুইলের দায়িত্ব কে নেবে ভেবে সবার ধাত ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম হল।

    “ওখানে ভূত আছে, ওই হুইলের ওখানে,” জাহাজের কুক বলল গম্ভীরভাবে, “ওখানে যে যাবে, সে-ই সোজা, হুঁ হুঁ, ডাডের কাছে চলে যাবে। আমার কথা মিলিয়ে নিও।” কুকের অবশ্য, আমার মতই, পাহারার দায়িত্ব ছিল না।

    এর একটা সমাধান অবশ্য বেরোল। সবাই মিলে ঠিক করা হল একজনের বদলে দু’জন করে পাহারা দেবে। এতে কুককেও রাজি করানো হল, তার একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও, আর ওপরওয়ালাকে খুশি করার জন্যই আমি বিলের সঙ্গে থাকতে রাজি হয়ে গেলাম।

    অবশেষে এসে গেল রাত্তিরের সেই সময়টা। আমার চোখটা তখন সবে লেগে এসেছে, বিল এসে গোটা দুয়েক কড়া ঝাঁকুনি দিয়ে ডেকে তুলল আমায়, জানাল সময় হয়ে গেছে ডেকে যাওয়ার। আমি ভেবেছিলাম, যা হোক করে হয়ত পাহারার ব্যাপারটা কাটিয়ে দিতে পারব, কিন্তু বিলের হাবভাব দেখে সে আশা ত্যাগ করতে হল। মানে, ও যেভাবে আমায় পোশাক-আশাক পরতেও সাহায্য করতে শুরু করল, তাতে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, আমাকে ছাড়া ও কোনওক্রমেই একা ডেকে পাহারা দিতে যাবে না। যাই হোক, বিরাট এক হাই তুলে আমি ওর পিছু নিলাম।

    আজকের রাতটা কালকের মত পরিষ্কার ছিল না, বাতাস বইছিল কনকন করে আর তাতে একটা স্যাঁতসেঁতে ভাব। আমি জ্যাকেটের বোতামগুলো আটকে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলাম ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য।

    “সব ঠিক আছে তো?” হুইলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল বিল।

    “তা আর থাকবে না? হ্যাঁ –” বলে উঠল রবার্টস, “স-অ-ব ঠিক আছে – একেবারে গোরস্থানের মত।” তারপর সে মেটের পেছন পেছন নিচে নেমে গেল।

    ডেকে বিলের পাশেই আমি বসেছিলাম। আলগা করে হাত রেখেছিল সে হুইলের ওপর, জাহাজ এগিয়ে চলছিল আপন গতিতে। খুব বিরক্তিকর কাজ এটা, এই পাহারা দেওয়ার কাজটা। কিছুই করার থাকে না, খালি মনে হতে থাকে নিচের উষ্ণ বিছানার কথা এবং আমার মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় ঘুমিয়েই পড়ব, কিন্তু বিল আমাকে ঢুলতে দেখলেই হাঁটুর গুঁতো মেরে জাগিয়ে দিচ্ছিল।

    প্রায় ঘন্টাখানেক আমি বসে রইলাম সেখানে, ঠান্ডায় কাঁপছিলাম ঠকঠক করে, বড় বড় হাই তুলছিলাম, তারপর কিছুই করার না থাকায় আমি উঠে ডেকের একপাশের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল জাহাজ মসৃণভাবে, সেই জলের আওয়াজ এত শান্ত, এত মধুর লাগছিল যে আমার প্রায় ঝিমুনি এসে গেছিল। আমার সম্বিৎ ফিরল বিলের গলায় একটা অস্ফুট আওয়াজ শুনে। দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখি সে কিরকম অদ্ভুতভাবে পোর্টের দিকে চেয়ে আছে। আমাকে দেখে সে হুইলের থেকে একটা হাত তুলে সেই হাত দিয়ে আমার হাতটাই এমনভাবে চেপে ধরল যে যন্ত্রণায় আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।

    “জ্যাক,” কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল সে, “তুমি ওদিকে যাওয়ার পরই কে যেন জাহাজের এদিক দিয়ে উঁকি মারল।”

    “তুমি ভুল দেখেছ,” বলতে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার গলাটাও প্রায় বিলের মতই ফ্যাসফ্যাস করছে।

    “ভুল! ভুল দেখেছি, তাই না?” বিল বলল, “আচ্ছা, ওদিকে তাকাও!”

    সে আঙুল তুলে দেখাতেই আমি যা দেখলাম, তাতে আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল। সত্যিই ওদিক থেকে কারোর একটা মাথা দেখা যাচ্ছে। খানিকক্ষণ চুপ করে মাথাটা আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর দেখলাম একটা গাঢ় মূর্তি বেড়ালের মতই লাফিয়ে পড়ল ডেকের ওপর, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা আমাদের কাছাকাছি এসে গুড়িসুড়ি মেরে বসল।

    আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম, জড়িয়ে গেল জিভ, কিন্তু বিল পারল। সে এমন বিকট এক চিৎকার ছাড়ল, যেরকম চিৎকার আমি আর কাউকে করতে শুনিনি। তার উত্তরে নিচ থেকেও ভেসে এল আওয়াজ, তারপর লোকজন উঠে এল ওপরে, সবাই ধড়মড়িয়ে উঠেছে বিছানা থেকে।

    “কি হয়েছে?” হেঁকে উঠলেন ক্যাপ্টেন, চারিদিকে তাকাতে তাকাতে।

    কিছু না বলে বিল দেখিয়ে দিল আগন্তুককে, আর তাকে দেখা মাত্তর সবাই হুইলের চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

    “ওটা! সমুদ্দুরের থেকে উঠে এল ভূতের মতন,” বলতে গিয়ে বিল প্রায় হাঁফাচ্ছিল।

    ক্যাপ্টেন একটা ল্যাম্প তুলে নিলেন পাশ থেকে, হাতে ঝুলিয়ে গটগট করে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। হালকা আলোয় আমরা দেখতে পেলাম একটা লোকের মূর্তি, কালো দাড়িগোঁফে বোঝাই মুখ, জল ঝরছে সারা গা থেকে, আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে, ল্যাম্পের আলোয় সে চোখের রঙ লালচে দেখাচ্ছে–

    “এই! তুমি কে? কোত্থেকে এলে?” জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।

    লোকটা মাথা নাড়ল।

    “কী হল? কথা কানে যাচ্ছে না? কোত্থেকে এলে তুমি?” ক্যাপ্টেন আরো এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলেন।

    উত্তরে লোকটা কী যেন একটা বলল, কিন্তু তা এমন জড়ানো যে আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। শোনার জন্য আমরা তার কাছে এগিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু সে আবার যখন বলল, আমরা তখনও কিছু বুঝতে পারলাম না।

    “ভিনদেশি লোক,” বলল রবার্টস।

    “নির্ঘাত,” বলল বিল, “ভাষাই তো বোঝা যাচ্ছে না। কেউ বুঝতে পারছ?”

    কেউই না। ক্যাপ্টেন আবার খানিকক্ষণ চেষ্টা করে তারপর ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলেন। প্রথমে লোকটাকে দেখালেন, তারপর দেখালেন সমুদ্রের দিকে। এবার যেন বুঝল লোকটা, তারপর অতিকষ্টে যা বোঝাল, তাতে মনে হল ও খোলা সমুদ্রে কোনও নৌকোয় ছিল, পাশ দিয়ে আমাদের জাহাজটাকে যেতে দেখে অতিকষ্টে এটায় উঠে পড়েছে। বোঝা মাত্রই আমরা সবাই জাহাজের ধারে গিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সেই অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলাম না।

    “হুম,” বিলের দিকে ফিরে একটা বিকট হাই তুলে বললেন ক্যাপ্টেন, “বোঝা গেছে। ওকে নিচে নিয়ে যাও আর কিছু খেতে-টেতে দাও, আর যদি ভবিষ্যতে কোন ভদ্দরলোক তোমাকে ডাকে, তখন যেন আর এরকম চিৎকার করে কোনওরকম গোলমাল পাকাতে না শুনি।”

    তিনি নিচের দিকে হাঁটা লাগালেন, পেছন পেছন মেট, আর তারপর একটু ইতস্তত করে রবার্টস এগিয়ে গেল লোকটার দিকে, ইশারায় বলল তার সঙ্গে আসতে। লোকটা দম দেওয়া পুতুলের মত এল আমাদের সঙ্গে, ডেকের ওপর জলের ধারা ফেলতে ফেলতে। নিচে গিয়ে জামাকাপড় পাল্টানোর পর আমরা ওকে কিছু নোনা মাংস আর বিস্কুট দিলাম বটে, কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারে ওর খুব একটা ইচ্ছে নেই দেখলাম। খেতে খেতে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল লোকটা, সে দৃষ্টি একেবারে নিষ্প্রভ।

    “ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এখনও ও ঘুমিয়ে হাঁটছে,” বলল কুক।

    “ওর তেমন খিদে নেই হে,” একজন বলল, “দেখছ না, খাবার নিয়ে কিরকম নাড়াঘাটা করছে।”

    “তেমন খিদে?” বলল বিল, যে এইমাত্র হুইলের দায়িত্ব ছেড়ে নিচে এসেছে। “কোনও খিদেই নেই। গত রাত্তিরে চা-ও খেয়েছে নিশ্চয়ই।”

    শুনে লোকটা হতবুদ্ধি হয়ে তাকাল বিলের দিকে।

    “কি বলছি তোমরা বুঝতে পারছ না?” বিল খসখসে গলায় ফিসফিস করে বলল, “ কি বলত মনে নেই? আমি জেম ডাডের কথা বলছি। জেম ডাড ফিরে এসেছে। মরে যাওয়ার পরই একটা বডি পেয়ে গেছে, তাতেই ভর করেছে সে। ও তো বলতই এসব কথা।”

    “যত্তসব!” রবার্টস জোর গলায় বলল বটে, কিন্তু তারপরই সে উঠে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও, সবাই মিলে গাদাগাদি করে ঘরের এককোনায় গিয়ে সেখান থেকে তাকাতে লাগল লোকটার দিকে অদ্ভুতভাবে। লোকটা খাওয়া শেষ করে প্লেটটা ঠেলে দিল একপাশে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে ফাঁকা বাঙ্কগুলোর দিকে দেখাল।

      রবার্টস বোধহয় বুঝতে পারল ব্যাপারটা ও কি বলতে চাইছে। ও-ও হাত দিয়ে বাঙ্কগুলোর দিকে দেখিয়ে দিল। লোকটা উঠে দাঁড়াল, এবং একটি কথাও না বলে উঠে পড়ল ওপরের একটা বাঙ্কে।   সে বাঙ্কটা – জেম ডাডের!

    সে রাত্তিরটায় লোকটা জেম ডাডের বাঙ্কেই ঘুমোল, গভীর ঘুম – ঘরের একমাত্র লোক, যে সেই রাত্তিরে ঠিকঠাক ঘুমোতে পেরেছিল। সকালে যখন জলখাবারের সময় হল, তখনও দেখা গেল তার অবস্থা সেই রকম জড়ভরতের মতই – আগের রাত্তিরে যেমন ছিল।

    খাওয়ার পর তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন তাকে নিয়ে পড়লেন বটে খানিকক্ষণ, কিন্তু কিছুই তার কাছ থেকে বার করা গেল না। তিনি যাই বলেন না কেন, তার উত্তরে সে সেই রকম জড়ানো স্বরে কি যে বলল, তার মাথামুন্ডু বোঝা গেল না। আমাদের জাহাজের অনেকেই আছে, যারা বহু দেশের বহু বন্দরে ঘুরেছে এবং তাদের অনেকের সঙ্গেই অন্যান্য ভাষার কিছু শব্দের পরিচয় আছে, কিন্তু তারাও কিছু ধরতে পারল না। ক্যাপ্টেন শেষমেষ হাল ছেড়ে দিয়ে চলেই গেলেন। লোকটা তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ তাঁর দিকে, তারপর বহুক্ষণ জাহাজের একপাশে এমনভাবে হেলান দিয়ে রইল যে আমরা ভাবলাম সে বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছে।

    “ওকে দেখ,” ফিসফিস করে বলল রবার্টস, “জ্যান্ত-মড়া!”

    “শ্ শ্ শ্!” বলল বিল, “হয়ত ও এক-দু সপ্তাহ জলে ডুবে ছিল, তাই ঘোরটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। খালি ওর চাহনিগুলো লক্ষ করে যাও।”

    লোকটা সারাটা দিন ডেকেই রইল, রোদ পোহাল পড়ে পড়ে, কিন্তু রাত নামতেই ঢুকল গিয়ে কেবিনে। খাবার দেওয়া হলেও সে সেগুলো ছুঁয়েও দেখল না। আমাদের দিকেও সে প্রায় তাকাচ্ছিল না বললেই হয়, যদিও আমার মনে হল, আমরা যে ওকে ভয় পাচ্ছি, ও বোধহয় সেটা খেয়াল করেছে। জেম ডাডের বাঙ্কেই ঘুমোল সে, এবং সকাল হওয়ার পরও দেখলাম সে সেখানেই শুয়ে আছে।

    সারাদিন ওর ধারে-পাশে কেউ ঘেঁষল না। তবে ডিনারের সময় যখন এল, তখন রবার্টস অন্যের ঠেলা-ধাক্কা খেয়ে গুটি গুটি পায়ে গেল ওর কাছে খাবারের প্লেট হাতে।  নোংরা, ফুলে ওঠা হাত দিয়ে খাবারটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে লোকটা ইঙ্গিত করল একটু খাবার জল দেওয়ার জন্য। জল দিতেই সে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলল সেটা ঢকঢক করে।

    দু’দিন ধরে সে রইল সেখানেই, ড্যাবডেবে কালো চোখে তাকিয়ে রইল সারাক্ষণ, ফোলা-ফোলা আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে। তিনদিনের দিন সকালবেলা বিল আমাদের ডাকল। এর মধ্যে মাঝে মাঝে লোকটাকে খাবার জল দেওয়ার ফলে বিলের ভয়টা খানিকটা কমেছিল। “একবার এসে ওকে দেখ তো,” বলল বিল, “কি ব্যাপার কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

    “ব্যাটা মরে যাবে!” কুক বলল, কেঁপে উঠে।

    “না না, এখনও মরেনি তো!” বিল বলল ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায়।

    সে এটা বলার সময়ই দেখলাম লোকটার চোখের দৃষ্টি অনেক নরম লাগছে, যেন সে দুটো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের মুখের দিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিল সে, যেন কিছু জানতে চাইছে। তারপর হাত মুঠো করে সে তার বুকে চাপড় মারল, বিড়বিড় করে বলল দুটো শব্দ।

    কিছুই বুঝতে না পেরে আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম বোকার মত। লোকটা আবার উচ্চারণ করল সেই শব্দদুটো ব্যগ্র হয়ে, বুকে আবার হাত ছোঁয়াল।

    “ও নিজের নাম বলছে,” বলে উঠল কুক। আমাদেরও সেটাই মনে হচ্ছিল।

    লোকটার মুখে একটা হাসি দেখা গেল, নিরাশার হাসি। মনে হল সে প্রাণপণে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করছে, তারপর সে তার তর্জনীটা তুলল। আমরা তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে, পুরোটাই হেঁয়ালি মনে হচ্ছিল আমাদের কাছে। তারপর সে নামিয়ে নিল তার আঙুলটা, তারপর আবার আঙুল তুলল, এবার চারটে আঙুল, একবার নয়, দু”বার।

    “পালাও,” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল কুক, “ও নির্ঘাত কিছু তুকতাক করছে।”

    আমরা পিছু হঠে গেলাম বটে, কিন্তু আবার ফিরেও এলাম, কারণ দেখলাম ও সেগুলো করেই যাচ্ছে। আচমকাই বিলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে।

    “ও ওর বউ ছেলেমেয়ের কথা বলছে!” চেঁচিয়ে উঠল সে, “ও মোটেই জেম ডাড নয়!”

    দেখলাম আমার সহকর্মী নাবিকরা সবাই মৃতপ্রায় নাবিকটাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, ওকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে। দেখলাম, বিল যেন ওর সব কথাই বুঝতে পারছে, এরকম ভঙ্গি করে মাথা নাড়াচ্ছে আর তারপর মেঝে থেকে চার রকম উচ্চতায় হাত রাখল। শেষ উচ্চতাটা খুবই নিচু, এতই নিচু যে সেটা দেখে লোকটা তার ঠোঁট দুটো চেপে ধরল, তার বিরাট মাথাটা আমাদের থেকে ঘুরিয়ে নিল।

    “বেচারা!” বলল বিল, “ও বোঝাতে চাইছে ওর বউ আর ছেলেমেয়েরা ওর কাছে কতখানি। সমুদ্রযাত্রায় বেরোনোর পর থেকেই বোধহয় ওর এই অবস্থা হয়েছে। কিন্তু ওর নাম কী?”

    কিন্তু ওর নাম উচ্চারণ করা আমাদের ইংরেজ জিভে সহজ নয়, আর সেই অদ্ভুত উচ্চারণ আমরা ততক্ষণে শুনেও ভুলে গেছি।

    “আরেকবার জিজ্ঞেস কর,” কুক বলল, “আর লিখে রাখো। কারোর কাছে কলম আছে?”

    কলম খোঁজার জন্য কুক সবার দিকে তাকাতে লাগল, আর বিল তাকাল সেই নাবিক লোকটার দিকে, যাতে আবার সে নামটা বলে। তারপর বিল ঘুরে তাকাল আমাদের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে, কারণ নামের মালিক তখন তার নাম চিরদিনের মত ভুলে গিয়ে পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের দেশে।

ডব্লিউ ডব্লিউ জ্যাকবস (W W Jacobs) রচিত “ওভার দ্য সাইড” (Over the Side) অবলম্বনে। প্রথম প্রকাশ- টুডে(Today), ১৮৯৭।   

জয়ঢাকের  সমস্ত গল্প ও উপন্যাস