জেমস র্যালে সবে দোকানের সামনের জানালার কাচে ‘অবিকল বিপনী’ লেখাটা শেষ করেছে,দুজন লোক ভেতরে ঢুকল। ভারী চেহারা, কাঁচাপাকা চুলের র্যালে মুখে বিনম্র হাসি ফুটিয়ে একটা কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে অভ্যর্থনা করল তাদের। দোকানটা আজই চালু করেছে সে। এখন বেলা প্রায় তিনটে আর এই দুজন লোকই তার দোকানের প্রথম খদ্দের। “বলুন স্যার, কিভাবে আপনাদের সেবা করতে পারি?” বলল সে।
দুজনের কেউই অবশ্য তক্ষুনি কোন উত্তর দিল না। তাদের চোখ ধীরেসুস্থে জরিপ করছিল দোকানের ভেতরটা, যেখানে দেয়ালের গায়ে এবং ডিসপ্লে শেলফে সাজানো রয়েছে রকমারি জিনিসপত্র-সেশুর আঁকা উইন্টার ল্যান্ডস্কেপ,কেলেরমাসের পেকটোরাল অব লাওনেসের রেপ্লিকা,খ্রীষ্টপূর্ব ষোড়শ শতকের নকল সোনা আর হাতির দাঁতের তৈরি ক্রেটান স্নেক গডেস,লাল লাইমস্টোনের তৈরি মিশরীয় ধর্মগুরুর বসে থাকা মূর্তি।
দুজনের মধ্যে দীর্ঘকায় ব্যক্তিটি,পরনে ধূসর শার্কস্কিন স্যুট,মাথায় মুক্তোরঙা টুপি, ধর্মগুরুর মূর্তিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। তার চেহারা শক্তপোক্ত,চিবুকে খাঁজ। ঠান্ডা চোখে মূর্তিটা দেখছিল সে। খানিকক্ষণ বাদে সে বলল,“দারুণ কাজ”।
র্যালে হেসে মাথা নাড়ল। “আসল মূর্তিটা অবশ্য ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের।”
লোকটা অবাক হল, “আসল মূর্তি?”
“হ্যাঁ স্যার। আমার দোকানের সবকিছুই মূল কাজগুলোর নকল। এখানে শুধু প্রতিরূপ পাওয়া যায়। আমি এসব কাজে একজন বিশেষজ্ঞ- এই অবিকল নকল তৈরির করার কাজে- মূর্তি বলুন, ছবি বলুন- সব কিছুতেই।”
“তার মানে এগুলো ফালতু মাল, বুঝলে হ্যারি,” বলল অন্য লোকটা। টাইট একটা স্যুট পরে আছে সে,মাথায় সবুজ টুপি। তাতে একটা ছোটো লাল পালক গোঁজা। এককালে বোধহয় লোকটার নাক ভেঙে গেছিল,সেটা ঠিকমত জোড়া লাগেনি। কানদুটো বড়ো বড়ো আর ছড়ানো।
“অ্যালেক্স”,হ্যারি বলল,“এবার কথাবার্তা শুরু করা যাক।”
“ঠিক,”বলল অ্যালেক্স র্যালের দিকে তাকিয়ে,“তোমার নাম কী হে?”
লোকটার বলার ভঙ্গিটা ভাল না লাগলেও র্যালে সেটা গায়ে না মেখে বলল, “জেমস র্যালে। বলছি যে যদি আপনাদের কোন-”
যে লোকটার নাম হ্যারি,সে তখনো ভুরু কুঁচকে ধর্মগুরুর মূর্তিটা দেখছিল। খানিক বাদে অন্য লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,“কী মনে হচ্ছে?”
অ্যালেক্স কাঁধ ঝাঁকাল।
“এর দাম কত,মিঃ র্যালে?”
“উনপঞ্চাশ পঁচানব্বই।”
“অ্যালেক্স?”
“বড্ড বেশি দাম।”
“ঠিক বলেছ,” হ্যারি বলল। সে ডিসপ্লে শেলফের দিকে ঘুরে হাত বাড়িয়ে মূর্তিটা রাখার ভান করে সেটা ফেলে দিল তার পায়ের সামনে। মেঝের ওপর পড়ে সেটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল একটা ফাঁপা শব্দ করে।
র্যালে তাকিয়েছিল ভাঙা টুকরোগুলোর দিকে, বুঝতে পারছিল,উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তার গাল। দোকানের ভেতরটা একেবারে চুপচাপ। শেষ পর্যন্ত সে মুখ তুলে তাকাল লোকদুটোর দিকে। ওরাও তাকিয়েছিল সোজা তারদিকেই, ভাবলেশহীন মুখে।
“এটা কী হল?” জিজ্ঞেস করল র্যালে।
“দুর্ঘটনা,” হ্যারি বলল,“হাত ফসকে পড়ে গেল।”
“আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না,” র্যালে বলল রুক্ষ গলায়।
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ,আমার মনে হচ্ছে আপনি এটা ইচ্ছা করে ফেলে দিলেন।”
“আমি খামোখা ওরকম করতে যাব কেন?”
“সেটা আমি আপনাকেই জিজ্ঞেস করছি।”
হ্যারি অ্যালেক্সের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর স্যুটের পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে সেখান থেকে একটা সাদা বিজনেস কার্ড বের করে এগিয়ে দিল র্যালের দিকে। সেখানে কালো অক্ষরে লেখা আছে সেন্টিনেল প্রোটেকটিভ অ্যাসোসিয়েশন। তার নিচে একজন সৈনিকের ছবি,রাইফেল হাতে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
হ্যারি বলল,“বুঝলে ভাই, দুর্ঘটনা যখনতখন ঘটতে পারে,বিশেষ করে যারা তোমার মত ছোটোখাটো বিজনেসম্যান তাদের ক্ষেত্রে। সেটা তো তুমি আর রুখতে পারবে না। কিন্তু অন্যান্য ঝামেলা- ভাঙচুর, ডাকাতি, লুটপাট- এসব রোখার ব্যবস্থা তো করাই যায়। চারপাশের অবস্থা তো ভাল নয়,আর পুলিশের যা হাল তুমি তো জানই। এই সেন্টিনেল প্রোটেকটিভ অ্যাসোসিয়েশন এইসব ঝুটঝামেলা আটকে দেবে- অবশ্য ছোটখাটো দুর্ঘটনা বাদ দিয়ে।”
র্যালে ফ্যাকাশে মুখে হাসল, “এর জন্য সেন্টিনাল প্রোটেকটিভ অ্যাসোসিয়েশনকে কত দিতে হবে?”
“মেম্বারশিপ ফি একশো ডলার,” হ্যারি বলল, “তারপর প্রতি শুক্রবার পঁচিশ ডলার করে, সাপ্তাহিক চাঁদা বাবদ।”
“যদি আমি মেম্বার না হই?”
“সেক্ষেত্রে, আমি তো আগেই বলেছি,আশেপাশের অবস্থা ভাল নয়।”
“একদমই ভাল নয়” অ্যালেক্স সায় দিল, “আরে এই তো গত সপ্তাহে পাশের ব্লকের মিঃ হোল্জ্মেয়ারের অত সুন্দর খাবারের দোকানটা মাঝরাত্তিরে কারা যেন ভাঙচুর চালিয়ে একেবারে তছনছ করে দিয়ে গেল। আহা, বেচারা।”
র্যালে জিভ দিয়ে ঠোঁটটা চাটল, “আপনারা বেশ ভালই আছেন,তাই না?”
“অ্যাঁ?”
“বলছি,আমাদের মত লোকের ঘাড় ভেঙে আপনাদের মত অ্যাসোসিয়েশনগুলোর বেশ ভালই চলছে।”
“আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না মিঃ র্যালে। সেন্টিনেল প্রোটেকটিভ অ্যাসোসিয়েশন তৈরিই হয়েছে এই অঞ্চলের ছোটখাটো ব্যবসাদারদের জন্য,তাদের সুরক্ষার জন্য, বুঝলেন না?”
“সে তো বটেই,” র্যালে বলল।
“তাহলে মেম্বারশিপ লিস্টে আপনার নামটা তুলব?”
র্যালে তক্ষুনি কোন উত্তর দিল না। সে তার ছোট্ট দোকানটা দেখছিল। জায়গাটা পুরোন, কিন্তু বেশ ভাল। তার খুব পছন্দ হয়েছিল এটা। ভাড়াও তার সাধ্যের মধ্যেই। ভাবতেই খারাপ লাগছে যে জায়গাটা বোধহয় এবার ছাড়তে হবে।
খানিকক্ষন বাদে সে তাকাল লোকদুটোর দিকে। ধীরে ধীরে বলল, “তুলবেন। এছাড়া তো আর কোন উপায় দেখছি না।”
হ্যারির কোন তাপউত্তাপ দেখা গেল না। “আমি জানতাম, আপনি বুঝদার মানুষ।”
“টাকাটা তো আপনারা নগদে নেবেন?”
“বিলক্ষণ।”
“কাল দুপুরে দেব।”
হ্যারি মাথা নেড়ে বলল, “মিঃ র্যালে, খুবই দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা সদস্যপদের টাকাটা পাচ্ছি, ততক্ষন পর্যন্ত আমাদের পক্ষে আপনাকে কোন সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
অ্যালেক্স এর মধ্যেই ডিসপ্লে শেলফের কাছে গিয়ে একটা দ্বাদশ শতকের দেবতার মূর্তি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছিল। কাল দুপুরের মধ্যে কত কিছু হয়ে যেতে পারে,” বলল সে।
র্যালে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, “আপনারা এখন কত চাল?”
“আপাতত পঞ্চাশ ডলার,” হ্যারি বলল, “আপনার বিশ্বাসের গ্যারান্টি নিচ্ছি।”
র্যালে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল বেশ খানিকক্ষণের জন্য। তারপর আরেকটা শ্বাস ছাড়ল হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে। তারপর বলল,“আমি বরং মেম্বারশিপের সঙ্গে একমাসের টাকাটাও অগ্রিম দিয়ে দিই। আমি চাই না আমার এখানে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটুক।”
লোকদুটো পরস্পরের দিকে তাকাল। হ্যারি চোখ তুলে বলল, “সাবাস মিঃ র্যালে। এই তো চাই। খুব বুদ্ধিমানের কাজ করবেন তাহলে।”
“হ্যাঁ,” র্যালে বলল, “সিন্দুকে কিছু টাকা আছে। আপনারা একটু দাঁড়াবেন, তাহলে ওটা নিয়ে আসতাম?”
“নিশ্চয়ই,” লোকদুটো হাসল।
হ্যারি দোকানের পেছনের দিকের একটা দরজা দিয়ে স্টোররুমে ঢুকে গেল। একটু পরেই বেরিয়ে এল সে, টাকাপয়সা আদান-প্রদানের ছোট কাউন্টারটায় ঢুকে সামনে রাখল দশটা কুড়ি ডলারের নোট। “এই যে আপনাদের দুশো ডলার,” বলল সে।
অ্যালেক্স এগিয়ে এসে টাকাগুলো তুলে গুনে নিল। তারপর সন্তুষ্টিতে মাথা নেড়ে সেগুলো ভরে ফেলল একটা দামি চামড়ার মানিব্যাগে। কোটের পকেট থেকে বের করল একটা রসিদের বই আর পেন। বেশ কষ্ট করে লিখল একটা স্লিপ,এগিয়ে দিল সেটা র্যালের দিকে।
“সেন্টিনেলের সদস্য হওয়ার জন্য আপনাকে আভিনন্দন,মিঃ র্যালে,” বলল হ্যারি, “আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। এবার নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন,আর কোন ঝামেলা হবে না।”
র্যালে মাথা নাড়ল।
“এখনকার মত চলি তাহলে,” প্রশান্ত গলায় বলল হ্যারি। তারপর ধীরেসুস্থে বেরিয়ে গেল দুজনে দোকান ছেড়ে।
ওরা নজরের আড়াল চলে যেতেই র্যালে দ্রুত সামনের গেটটা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে শাটার নামিয়ে দিল। তারপর দ্রুত গতিতে স্টোররুমে ঢুকল।
কাজ শুরু করার আগে সে আরেকটা শ্বাস ফেলল। এই নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য। বেশ চিন্তিতভাবে। এ জায়গাটা খুবই ভাল ছিল। সে নিশ্চিত যে ঠিক এইরকম আরেকটা শান্ত,রাস্তার ধারের জায়গা এখানে তো নয়ই, সম্ভবত অন্য রাজ্যেও পাওয়া মুশকিল হবে,যেখানে সে তার এই ‘অবিকল বিপনী’ আর এই পুরোন হাইডেলবার্গ প্রিন্টিং প্রেস- যেটা সে এখন খুলে ফেলছে, সেটা বসিয়ে আবার চালু করতে পারবে।
মেশিন খোলার কষ্টসাধ্য কাজটা করতে করতে সে একবারই মাত্র হেসে ফেলেছিল, যখন সে ভাবছিল আজ সকালেই মেশিনটা টেস্ট করার জন্য যে ছাপাইয়ের কাজটা করে সেগুলো রেখেছিল ফেলে দেওয়ার জন্য, সেই একেবারে অবিকল – “আসল” নকল কুড়ি ডলারের নোটগুলো চালাবার সময় সেন্টিনেল প্রোটেকটিভ অ্যাসোসিয়েশনের লোকদুটোর কী হাল হবে।
[বিল প্রনজিনি ও জেফ্রি ওয়ালম্যান রচিত ‘দি ফ্যাকসিমিলি শপ’ অবলম্বনে ।