বিদেশী গল্প -জাপানি-গোমপাচি ও কোমুরাসাকির গল্প (সপ্তম পর্ব)- বার্ট্রাম ফ্রিম্যান মিটফোর্ড-অনুঃ সংহিতা

 

আগের পর্ব

 bideshigolpojapani02 (Medium)এই দয়ার্দ্র কথা শুনে কোসানজার মনে যে শ্রদ্ধা জেগে উঠল তা তিনি লুকিয়ে রাখতে পারলেন না। আর পতিবিয়োগব্যাথা কাতর সানজাপত্নী উমানোসুকের পায়ে উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদলেন কৃতজ্ঞতায়। দুই যুবক পরস্পরের সহায়তার অঙ্গীকারে তাঁদের অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠলেন এবং অনুমতি নিলেন তাঁদের রাজপুত্রের কাছে যে তাঁরা খুঁজে বার করবেন বিশ্বাসঘাতক বানজায়েমনকে।

তাঁরা বিনা উপদ্রবেই ইয়েডোতে পৌঁছে গেলেন। তারপর একটা সস্তা অতিথিশালায় বাসা নিলেন। শুরু করলেন খোঁজখবর। যদিও তাঁরা অনেক জায়গাতেই খোঁজ করলেন তবু তাঁদের শত্রুর চালচলন হালহকিকত সম্পর্কে কোনো হদিশই লাগাতে পারলেন না। যখন এভাবে তিনমাস কেটে গেল, তখন উপুর্যুপরি ব্যর্থতায় কোসানজা মনোবল হারাতে লাগলেন। কিন্তু উমানোসুকে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে চললেন সমানে, তাঁকে নতুন মনোবল জুগিয়ে যেতে লাগলেন।

কিন্তু অচিরেই তাঁদের জীবনে দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে এলো। কোসানজার চোখ উঠল। উমানোসুকে অকাতরে সেবা করলেন কোসানজার। নিজের সমস্ত পয়সাকড়ি খরচ করলেন চিকিৎসকের জন্যে, ওষুধে, আর পথ্যে। কিন্তু কিছুতেই কোসানজার ব্যারাম সারল না। তাঁর চোখ দুটো পাথরের মতো হয়ে গেল, তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেলেন। নির্বান্ধব, নিঃসহায় দুই যুবক- একজনের চোখে জ্যোতি নেই, আরেকজনের খড়মটুকু সম্বল যখন,তখন তাঁরা নিজেদের বুদ্ধি আর পেশীর ভরসায় এসে পড়লেন পথে। শেষে উমানোসুকে নিজের সম্বলের তলানিতে দাঁড়িয়ে বাধ্য হলেন কোসানজাকে আসাকুসার পথের ধারে ভিক্ষেতে বসাতে। আর ঘুরে বেড়াতে লাগলেন এখানে সেখানে। তাঁর হতদরিদ্র অবস্থা দেখে দয়া করে কেউ কিছু দিলে তা নিয়ে নিতে লাগলেন।

কিন্তু এতদিনেও, একবারের জন্যেও, তিনি ভোলেননি প্রতিশোধ নেওয়ার কথা এবং তিনি প্রায় কৃতজ্ঞতাই জানিয়ে ফেলেন ভাগ্যকে যা তাঁকে ভিখারি করেছে, কারণ এতে তিনি ভবঘুরেবৃত্তির কোটর থেকে শিকার খুঁজে নিয়ে শিকার ধরার স্বাদ পেয়েছেন, যার গভীরে ঢোকা তো দূর, যার মধ্যে উঁকি মারার সুযোগও তাঁর ছিল না তাঁর ফেলে আসা স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনে। তাই তিনি শহরের এমাথা ওমাথা ঘুরে বেড়াতে লাগলেন একটা তাগড়া লাঠিতে ভর করে, যে লাঠির মধ্যে তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁর তরোয়ালখানা, আর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন কবে ভাগ্য তাঁকে এনে ফেলবে বানজায়েমনের মুখোমুখি।

ইয়োসিওয়ারার ঢিবিতে সানজাকে হত্যা করার পর থেকে বানজায়েমন ওটোকাডেটের অভিভাবক, চোবেই-এর বাড়িতে একবারও নিজের মুখ দেখায় নি। কারণ সে নিশ্চিত জানত যে দুই “তরুণ তুর্কি” টোকেন গোম্বেই আর সিরোবেই তার সম্পর্কে সেখানে ভয়ানক সব কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা বানজায়েমনের কাপু্রুষ আচরণে এতটাই রেগেছেন যে এখন তাঁদের হাতে যদি বানজায়েমন পড়ে কোনোমতে তো তাঁরা বানজায়েমনের প্রাণ নিয়ে ছাড়বেন।

তাই সে একদল সঙের সাথে ভিড়ে তরোয়াল খেলার নানান কসরত দেখিয়ে দিন গুজরান করছিল। আর দাঁতের মাজন বেচছিল আসাকুসার ওকুয়ামাতে। একদিন আসাকুসাতে কাজে যাওয়ার সময় তার নজর পড়ল পথের ধারে বসে থাকা এক ভিখিরির ওপর। ভিখিরির হতদরিদ্র অবস্থা আর চেহারার পরিবর্তন সত্ত্বেও বানজায়েমনের ভুল হল না তার শত্রুকে চিনে নিতে। সে ঠিকই ঠাওরাল, ছেলেটির অসহায় অবস্থা হলেও সে বানজায়েমনের জন্য কোনো কম বিপজ্জনক নয়।

তাই সে কাছাকাছির মধ্যে এক চা-ঘরের ওপরে উঠে নজর রাখতে রাখল যে কোসানজার দেখাশোনা করতে কে আসে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। শিগগিরই সে দেখল যে আরেকজন ভিখিরি এসে কোসানজাকে দয়ার্দ্র উৎসাহ দিয়ে গেল। খুঁটিয়ে দেখে সে চিনতেও পারল যে অপর ভিখিরি আর কেউ নয় উমানোসুকে। এইভাবে তার পিছু কে নিয়েছে টের পেয়েই বানজায়েমন দৌড়ে ফিরে গেল নিজের বাড়িতে আর দুই ভিখিরিকে মেরে ফেলার ফিকির খুঁজতে লাগল। সে তক্কে তক্কে থাকল আর চিনে নিল তাঁরা কোন ঝুপড়িতে থাকেন। তারপর একরাতে যখন উমানোসুকে ঝুপরিতে নেই বলেই নিশ্চিত জানত বানজায়েমন তখন হানা দিল ঝুপরিতে।

bideshigolpojapani (Medium)অন্ধ কোসানজা পায়ের শব্দ শুনে ভাবলেন উমানুসোকে এসেছেন। তাই লাফিয়ে উঠলেন তিনি স্বাগত জানাতে। যেই কোসানজা অসহায়ভাবে হাত বাড়িয়ে দিলেন তাঁর বন্ধুকে ছুঁতে অমনই নির্দয় বানজায়েমন হত্যা করল কোসানজাকে। কিন্তু বানজায়েমনের কাজটা শেষ হওয়ার আগেই উমানোসুকে ফিরে এলেন। ঝুপরির মধ্যে  ধস্তাধস্তির আওয়াজ পেয়ে তিনি নিজের ছড়ির মধ্যে লুকিয়ে রাখা তরোয়ালখানা বের করে নিয়ে একছুটে ঢুকে পড়লেন ঝুপরির মধ্যে। কিন্তু বানজায়েমন অন্ধকারের সুবিধে নিয়ে উমানোসুকেকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে গেল ঝুপরি থেকে। উমানোসুকে তার পিছু নিলেন। যখন তিনি প্রায় ধরেই ফেলেছেন বানজায়েমনকে তখন বানজায়েমন পিছন দিকে তরোয়াল চালিয়ে আঘাত করল উমানোসুকের ঊরুতে, যাতে তিনি হোঁচট খেয়ে পড়েন। আর সেই ফাঁকে দৌড়ে ওস্তাদ খুনি পালিয়ে গেল অনায়াসে।

উমানোসুকে চেষ্টা করলেন তাকে ধাওয়া করার। কিন্তু চোটের জন্য বাধ্য হলেন ধাওয়ায় ক্ষান্ত দিতে। ঝুপরিতে ফিরে তিনি দেখলেন তাঁর অন্ধ বন্ধুটির রক্তাক্ত মৃতদেহ  গড়াগড়ি যাচ্ছে  মাটির উপর। নিজের ভাগ্যকে দুষতে দুষতে তাঁদের দলের অন্যান্য ভিখিরিদের ডেকে এনে তিনি কবর দিলেন কোসানজার মৃতদেহ। আর উমানোসুকে নিজে চূড়ান্ত দরিদ্র অবস্থায় নিজের জন্য কোনো শল্যচিকিৎসার ব্যবস্থা কিংবা সেরে ওঠার ব্যবস্থা করতে না পেরে পঙ্গু হয়ে গেলেন।

এই সময় তাঁর দেখা হলো সিরাই গোমপাচির সাথে, যে তখন চোবেই-এর আশ্রয়ে ছিল। সেই সিরাই গোমপাচি যে কোমুরাসাকি নামে বারনারি, যে নাকি ইয়োসিওয়ারার তিন সমুদ্রের তীরে থাকত, তাকে ভালবাসত। তার যৎসামান্য রসদটুকু তখন ফুরিয়েছিল। আর সে বেঁচেছিল ডাকাতি আর খুন করে, যাতে করে সে আবার যাপন করতে পারে উন্মত্ত আর বেহিসেবি জীবন। একরাতে যখন সে তার গলাকাটার কাজে বের হলো, তখন তার সঙ্গীসাথীরা যারা সন্দেহ করত যে সে কোনো ভালো কাজ করে না, তারা সেইবেই নামে একজনকে পাঠাল সিরাই গোমপাচির ওপর নজর রাখার জন্য। কেউ যে তার পিছু নিতে পারে তেমন কথা ঘুণাক্ষরেও মনে হয় নি গোমপাচির। তাই যতক্ষণ না সে কোনো পেয়াদার মুখোমুখি হলো ততক্ষণ বেশ দেমাকেই চলছিল। পেয়াদাকে বাগে পেয়ে সে পেয়াদার গলা কাটল আর লুঠ করল মৃত পেয়াদার সর্বস্ব। কিন্তু তার লুঠের পরিমান বেশ অল্প হওয়ায় সে আরেকটা সুযোগের অপেক্ষায় রইল।

খানিক বাদে দূরে একটা আলোর চলাচল দেখে সে লুকিয়ে পড়ল বৃষ্টির জল জমা করার গামলার পিছনে। আলোর বাহক কাছে আসতে গোমপাচি দেখল যে লোকটির বেশভূষা পরিব্রাজকের মত আর তার সঙ্গে একটা ছোরা আছে। সে অপেক্ষা ছেড়ে বেরিয়ে এল লোকটিকে মেরে ফেলার জন্য। কিন্তু পরিব্রাজকও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে একপাশে সরে গেল, আর তার ছোরা বাগিয়ে প্রাণ বাঁচানোর লড়াই দেখে বোঝা গেল যে সে মোটেই এলেবেলে প্রতিপক্ষ নয়। কিন্তু সে কোনোমতেই গোমপাচির মতো ওস্তাদ তরোয়াল চালকের সাথে পাল্লা দিতে পারল না। খুব শিগগিরই তাকে মেরে ফেলে তার থলিটি লুটে নিল গোমপাচি।  থলিতে ছিল দুশো রিয়ো। প্রাপ্তির প্রাচুর্যে উল্লসিত হয়ে গোমপাচি চলে যাচ্ছিল ইয়োসিওয়ায়ারার দিকে। এই সময় তার দুই হত্যার সাক্ষী সেইবেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তার কাছে এসে তার পাপাচারের জন্য গোমপাচিকে ভর্ৎসনা করতে লাগল। কিন্তু গোমপাচি এমন বাকপটু ছিল আর তাকে তার সঙ্গীরা এত পছন্দ করত যে অল্পক্ষণের মধ্যেই সে অনায়াসে সেইবেইকে বুঝিয়ে প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে ফেলল। আর তাকে অল্প ভোলাবার জন্য গোমপাচি সেইবেইকে সঙ্গী করে নিল ইয়োসিওয়ারার মনোরঞ্জনে।

রাস্তায় যেতে যেতে তারা যখন কথা বলছিল তখন সেইবেই গোমপাচিকে বলল, “সেদিন আমি একটা ছোরা কিনেছি যেটা এখনও পরখ করা হয় নি। তুমি তরোয়াল সম্বন্ধে এত জানো, তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে যে জিনিসটা কেমন। যদি তুমি একবার দেখ আর আমাকে বলো যে এটা কোনো কাজের জিনিস কিনা তাহলে বেশ হয়।”

“আমরা খুব শিগগির জানতে পারব ওটা কোন ধাতুতে গড়া”, উত্তর দিল গোমপাচি, “পথে যে প্রথম ভিখিরিটা দেখব আমরা তার ওপরেই এটাকে পরখ করব।”

ক্রমশ