বিদেশী গল্প -রাশিয়ান গল্প-মোরোজকো- অনুবাদঃ দেবজ্যোতি

 

উৎসঃ নিসবেট বাইন কৃত পোলেভয়-এর মূল স্কাজকির ইংরিজি অনুবাদ। ছবি সি এম গ্যেয়ার)

bideshirussian (Medium)সে ছিল এক সৎমা। তার দুই মেয়ে। এক মেয়ে নিজের মেয়ে। আরেক মেয়ে সৎ মেয়ে। নিজের মেয়ের সে কোন দোষ দেখত না। সে যা-ই করে করে, মা বলে, “বাঃ বাঃ।” আর সৎ মেয়ের সে দোষ ছাড়া কোন গুণ দেখত না। সে যাই করে, সৎ মা বলে , “যাঃ, যাঃ।”

সৎ মেয়ে কিন্তু ছিল লক্ষ্মী মেয়ে। ভালো হাতে পড়লে তার দুধ ক্ষীর ননীতে ডুবে থাকবার কথা। কিন্তু সৎমায়ের পাল্লায় পড়ে কেবল চোখের জলেই ডুবে থাকে সে। এমন যে বদমাশ বরফ ঝড়, সে-ও সবসময় জ্বালায় না। কিন্তু খিটখিটে বুড়িমায়েদের হাত থেকে তো এক মুহূর্তের জন্যেও নিস্তার নেই। একবার যদি মাথায় কিছু ঢুকল তাহলে তার শেষ না দেখে তাদের শান্তি হয় না।

তা এই সৎমায়ের মাথায় একদিন ঢুকল, সৎমেয়েকে ঘরছাড়া করবে সে। আর যায় কোথায়! দিনরাত্রি বুড়োকে জ্বালাতন করে খায় সে, “বিদেয় করো ওটাকে বাড়ি থেকে। যে চুলোয় খুশি দিয়ে এসো। আমার চোখে যেন আর ওর মুখটা কোনদিন না পড়ে, আমার কানে যেন ওর গলা আর কোনদিন না আসে। যে ঘরে চুল্লি জ্বলে সে ঘরে আমার নিজের মেয়ে থাকবে। ওকে কক্ষণো সে ঘরে নিয়ে যাবে না তুমি। ওকে নিয়ে যাও বরফঢাকা ঠান্ডা জঙ্গলের ভেতরে।

কথা শুনে শুনে অস্থির বুড়ো তখন কী আর করে! কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে নিয়ে সে তুলল তার স্লেজ-এ। শীতে ঠকঠকিয়ে কাঁপছে লক্ষ্মী মেয়ে। কিন্তু তাকে যে ঘোড়ার গায়ের চাদরটা দিয়েও ঢেকে দেবে তেমন সাহসও তার নেই। মেয়েকে তুলে নিয়ে স্লেজ ছুটিয়ে দিল সে গ্রাম ছাড়িয়ে বরফের প্রান্তরের দিকে। সেখানে বিরাট এক বরফের টিলার ওপরে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্লেজ ঘুরিয়ে সে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে এল।

বনের ধারে সেই বরফের টিলার ওপরে ছোট্টো মেয়েটা পড়ে রইল একা একা। খানিক দূরে কটা ফার গাছ ঠান্ডায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। দিন যখন শেষ হয়ে আসছে তখন আস্তেআস্তে সে গিয়ে বসল তাদের সামনে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে কোনমতে সন্ধ্যার প্রার্থনা সারল। আর তারপরই শোনে গাছের ডালে খড়মড় শব্দ উঠছে। সেখানে কুয়াশাপরী মোরজকো এসে হাজির হয়েছে। গাছের ডাল থেকে ডালে লাফ খাচ্ছিল সে, আর আঙুল মটকাচ্ছিল। মেয়েকে দেখে এইবার নিচু একটা ডালে এসে দাঁড়িয়ে সে বলল, “ও মেয়ে, দ্যাখো দ্যাখো—আমি—আমি গো! লাল নাক মোরোজকো—”

“এসো মোরোজ। ভগবান বোধ হয় আমার দুঃখ দেখেই তোমায় পাঠিয়েছেন,” মেয়ে জবাব দিল। “তোমার শীত লাগছে না মেয়ে? কষ্ট হচ্ছে না?”

“না গো বন্ধু। আমার কোন কষ্ট নেই। দিব্যি আছি তো!” শীতে কাঁপতে কাঁপতে মেয়ে বলল।

মোরোজকো তখন তাকে ঘিরে খালি লাফায়, আঙুল মটকায় আর বারবার জিজ্ঞেস করে, “শীত লাগছে না তোমার? কষ্ট হচ্ছে না?”

মেয়ে শীতে জমে গেছে তখন প্রায়। তবু কোনমতে ঠোঁটদুটি নাড়িয়ে সে মিঠে গলায় বলে, “লক্ষ্মিসোনা বাবা আমার মোরোজুশকা, আমার কোন কষ্ট নেই।”

তার মিঠে কথা শুনে আর এমন দশা দেখে মোরোজকোর মনটা গলে গেল। তাড়াতাড়ি গরম ফার দিয়ে তাকে জড়িয়ে দিল সে। তারপর তুড়ুক লাফে কোথায় চলে গিয়ে খানিক বাদে ফিরে এল একটা বিরাট সিন্দুক টানতে টানতে। তার ভেতর থেকে সোনারূপোর কাজ করা দারুণ এক রাজরানির পোশাক বের করে তাকে পরিয়ে দিল। মেয়ের রূপ তখন দেখে কে! ভারী আরাম পেয়ে আর ভারী খুশি হয়ে গাছতলাতে বসে সে মিঠে গলায় গানই জুড়ে দিল।

ওদিকে বাড়িতে তার সৎমা ততক্ষণে ভেবেছে সে বুঝি ঠান্ডায় এতক্ষণে মরেই গেছে। হাঁড়ি ভরতি ভরতি পিঠে আর পাটিসাপটা বানাতে বানাতে সে বরকে বলল, “বুড়ো তুই শিগগির গিয়ে তোর মেয়েকে কবর দিয়ে আয়।”

শুনে বুড়ো এক ছুটে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। শুধু টেবিলের তলায় বসে থাকা ছোট্টো কুকুরটা বলে উঠল, “ভৌ-উ-উ- সে মেয়ে এখন সোনার সাজে রানি সেজেছে। তোমার আসল মেয়ের দিকে এখন আর কেউ ফিরেও দেখবে না গিন্নিমা।”

“চুপ কর বদমাশ। এই নে একটা পাটিসাপটা খা। আর বল, ‘বুড়ির নিজের মেয়ের ভালো বর হবে, আর সৎ মেয়েটার হাড্ডি ছাড়া কিচ্ছু পড়ে নেই—বল-বল—”

কুকুর তারিয়ে তারিয়ে পাটিসাপটা খেল আর তারপর ফের বলে, “ভৌ-উ-উ- সে মেয়ে এখন সোনার সাজে রানি সেজেছে। তোমার আসল মেয়ের দিকে এখন আর কেউ ফিরেও দেখবে না গিন্নিমা।”

বুড়ি তাকে তখন কেবল পেটায় আর পাটিসাপটা খেতে দেয় আর কুকুরও সেই এক কথাই বলে চলে বারবার।

এই করতে করতে বুড়ি যখন হাক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছে তখনহঠাৎ দুড়ুম করে তার ঘরের দরজা হাট করে খুলে, তার ঘরের দেয়াল ফুঁড়ে বিরাট বড় সেই সিন্দুক টানতে টানতে লোকজন এসে ঢুকল তার ঘরে। আর তাদের পেছন পেছন রানির মতন সোনারুপোর কাজ করা সাজে—ও কে এল? এ যে তার সেই সৎ মেয়েটা!

দেখে তো বুড়ির মাথা ঘুরে গেল। বুড়োর হাত ধরে তার সে কী ঝুলোঝুলি। বলে “ও বুড়ো আমার নিজের মেয়েটাকেও তুই জোড়াঘোড়ার স্লেজে করে নিয়ে গিয়ে যেখানে একে ফেলেছিলি সেইখানে ফেলে দিয়ে আয়—”

বুড়ো আর কী করে! ছোটো মেয়েকেও স্লেজে তুলে নিয়ে ফেলে দিয়ে এল সেই বরফের টিলার ওপরে। খানিক বাদে মোরোজকো ফের নাচতে নাচতে তার কাছে এসে হাজির। বলে, “শীত লাগছে না তোমার? ও মেয়ে? কষ্ট হচ্ছে না?”

মেয়ে তাইতে বেজায় রেগে উঠে বলে “ভাগ এখান বদমাশ কোথাকার। অন্ধ নাকি? দেখছিস না হাতপাগুলো ঠান্ডায় জমে কালিয়ে গেছে? মশকরা হচ্ছে আমার সঙ্গে?”

গাল খেয়ে মোরোজকো গেল ভারী রেগে। বরফের নিঃশ্বাস ছেড়ে সে মেয়েকে সেইখানেই জমিয়ে দিল একেবারে।

মেয়েকে ছেড়ে বাড়ি আসতে বুড়ি ফের বুড়োর পেছনে লেগেছে। বলে “ও বুড়ো, তোর রাজরানি মেয়েকে আনতে যাবি না? ভালো দেখে ঘোড়া নিস। গয়নাগাঁটির সিন্দুক না উলটে যায় পথে আসতে।”

“পাবি না রে, পাবি না—কিচ্ছু পাবি না—আসবে শুধু একখানা বরফের পুতুল—”

“মিছে বলিস না। এই নে একটা কেক খা। আর বল, “বুড়ির মেয়ে সোনারুপোর বাক্স নিয়ে ফিরে আসবে এক্ষুণি।”

বলতেবলতেই স্লেজ নিয়ে বুড়ো এসে হাজির। সেখানে সিন্দুকটিন্দুক কিচ্ছুটি নেই। তার বদলে বসেছিল একটা বিরাট বরফে গড়া পুতুল!

বুড়ির তখন কেঁদে কেঁদে দুচোখ অন্ধই হয়ে গেল।