ভ্রমণ-অতীত ভ্রমণের অন্তরালে-ওয়াশিংটন ডিসি-২-রাখী নাথ কর্মকার-বর্ষা ২০১৬

স্কুলে পড়া ইতিহাস ভেসে উঠল ঠুমরির চোখের সামনে – “১৭৯০ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ‘হোয়াইট হাউস’ নির্মাণের জন্য এই স্থানটির নির্বাচন করেছিলেন। ১৭৯২ সালে এর নির্মাণকার্য শুরু হয়ে  ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে তা সম্পূর্ণ হয়।”

মা হাসলেন, “একদম ঠিক বলেছিস!অবশ্য তার পরেও নানা সংযোজন ও সংস্কারসাধন হয়েছে। সেই ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে আজ অবধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রেসিডেন্টেরই (একমাত্র জর্জ ওয়াশিংটন ছাড়া)কিন্তু সরকারি আবাসস্থল এই ‘হোয়াইট হাউস’। ১৯০১ সালে,প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমলে ছয়টি তলায় সমৃদ্ধ ঐতিহ্যমন্ডিত এই ভবনটি ‘হোয়াইট হাউস’নামে তার পোশাকি নামে সরকারি স্বীকৃতি পায়। চল,এবার  এখান থেকে আমরা হাঁটা দেব টাইডাল বেসিনের উদ্দেশ্যে!”

হোয়াইট হাউসের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে তখনও ঠুমরির চোখের ঘোর কাটেনি, বাইরে বসন্ত দুপুরের মিঠে রোদ্দুরে ততক্ষণে চেরিফুলের ঝুরো পাপড়ি ডানা মেলেছে। শীতল উত্তুরে হাওয়ার ফিসফিসানিতে তখন অপার খুশির অতল উচ্ছাস। কাছেই  চেরিফুলের মিছিলে সাজানো বিখ্যাত টাইডাল বেসিনের ধারে ছোটখাটো ফুড স্টলে নানা ধরনের খাবার বিকোচ্ছে। ভারতীয় কোন এক সংস্থার তত্ত্বাবধানে, চেরি ব্লুজম ফেস্টিভ্যালের রঙ গায়ে মেখে, লাগোয়া বিস্তৃত ঘাসজমিনে ঝিনিন ঝিনিন গানের সুরে তাল মিলিয়ে নেচে চলেছে একঝাঁক  রঙিন প্রজাপতির দল! এই প্রবল উত্তুরে হাওয়ার কাঁপুনি অগ্রাহ্য করেও খুদে খুদে মেয়েগুলিকে চুড়িদার,ঘাগরার উচ্ছসিত লহরিতে নেচে উঠতে দেখে কাঁপতে কাঁপতে গায়ের জার্কিনটা আর মাথার টুপিটা আরো ঠিকঠাক করে নিল ঠুমরি। বাপরে বাপ!

বাবা মোবাইলে ঘেঁটে বলে উঠলেন-“গুগল প্রফেসর  বলছে,টেম্পারেচার এখন ৮ ডিগ্রি চলছে। এই ‘ন্যাশনাল চেরি ব্লজম ফেস্টিভ্যালে’র ইতিহাস জানিস ঠুমরি?। তবে বলি শোন,

১৯১২ সালে টোকিও, আমেরিকার সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ জাহাজ ভর্তি করে চেরিগাছের উপহার পাঠিয়ে দিয়েছিল এদেশে, সেই উপহারপ্রাপ্তির ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণেই প্রতি বছর রাজধানীতে বসন্তের আগমনীতে উদযাপিত হয় এই উৎসব।

bhromonotitbhromon01 (Medium)অবশ্য ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল কিন্তু তার অনেক আগেই। ১৮৮৫ সালে ভূপর্যটক ও  ন্যাশনাল জিওগ্র্যাফিক সোসাইটির প্রথম  মহিলা বোর্ড মেম্বার মিসেস এলিজা সিডমোর যখন জাপান পরিদর্শন শেষে  আমেরিকায় ফেরেন, তখন তাঁর মনপ্রাণ জুড়ে রয়েছে জাপানের চেরি ফুলের মাদকতা। তিনি প্রস্তাব রাখেন পোটোম্যাক রিভারের ওয়াটারফ্রন্টে চেরিগাছ রোপনের, যদিও তাঁর সেই অনুরোধে তখন কেউই কর্ণপাত করেননি। ১৯০৯ সালে সুযোগ বুঝে তিনি  তাঁর ইচ্ছের কথা এবার ফার্স্ট লেডি হেলেন হেরন ট্যাফটকে জানান। ফার্স্ট লেডির বেশ মনে ধরে প্রস্তাবটা!খুব শিগগিরি তাই মিসেস সিডমোর, ইউ এস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচারের  অফিসার ডঃ ফেয়ারচাইল্ড এবং সুবিখ্যাত জাপানী রসায়নবিদ ডঃ ত্যাক্যামিনের সম্মিলত চেষ্টায় ১৯১০ সালের জানুয়ারিতে  টোকিও থেকে ২০০০টি চেরিগাছ এসে পৌঁছয় ওয়াশিংটনে,যদিও দুঃখজনকভাবে তার অধিকাংশই পোকামাকড় দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার কারণে সেগুলিকে নষ্ট করে ফেলা হয়। ১৯১২ সালে টোকিওর তদনীন্তন মেয়র ইয়ুকিও ওজাকি বন্ধুত্বের প্রতীকস্বরূপ   আবার  প্রায় তিন হাজারেরও বেশি ফুলবতী চেরিগাছের উপহার পাঠান। টাইডাল বেসিনের উত্তর কিনারায় দুটি ‘ইয়োশিনো’চেরি গাছ রোপন করেন ফার্স্ট লেডি হেলেন ট্যাফট এবং জাপানী রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী চিন্ডা। ১৯৩৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ন্যাশনাল চেরি ব্লসম ফেস্টিভ্যালের সূচনার মধ্য দিয়ে অচিরেই তা এক অসাধারণ সুন্দর,বাৎসরিক অনুষ্ঠানে পরিণতি লাভ করে।

“তবে সব থেকে বড় ব্যাপার কী জানিস? বসন্ত আগমনে চেরিফুলের এই উৎসবের গতিপ্রকৃতি কিন্তু অনেকটাই নির্ভর করে থাকে প্রকৃতি থুড়ি আবহাওয়ার মতিগতির  ওপর। মোট কয়টি ধাপ অতিক্রম করে তবে এই চেরিকুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটে ওঠে বলতে পারবি? আচ্ছা আচ্ছা –আমিই বলে দিচ্ছি-ছয়টি। ‘গ্রিণ কালার ইন বাডস’,’ফ্লোরেটস  ভিজিবল, এক্সটেনশন অফ ফ্লোরেটস, পেডাঙ্কল ইলঙ্গেশন, পাফি হোয়াইট এবং পিক ব্লুম। প্রায় সত্তর শতাংশ ‘ইয়োশিনো’ চেরিফুলের ফুটে ওঠার দিনটিকে ‘পিক ব্লুম ডেট’বলে ধরে নেওয়া হয়। পিক  ব্লুমের কিছুদিন আগে থেকেই ‘ব্লুমিং পিরিয়ড’অর্থাৎ ফুল ফোটানোর পালা শুরু হয়ে  যায় এবং মাত্র ১৪ দিনের জন্য স্থায়ী হয় এই রূপঢালা ফুলের লালিত্য! সাধারণতঃ মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি  তিন সপ্তাহ ধরে এই উৎসবে মেতে ওঠে দেশবিদেশের হাজারো মানুষ। ঝলমলে ওপেনিং সেরিমনিটা কিন্তু সত্যি দেখার মত। এই সময় অনুষ্ঠিত হয় ব্লসম কাইট ফেস্টিভ্যাল,সাউথওয়েস্ট ওয়াটার ফ্রন্ট ফায়ারওয়ার্কস। এছাড়াও যা দেখার মত তা হল ‘ন্যাশনাল চেরি ব্লুসম ফেস্টিভ্যাল প্যারেড’।”

“এই প্যারেডে কী হয় বাবা?” ঠুমরি উৎসাহী প্রশ্ন করে ওঠে।

বাবা বলতে থাকেন, “এই জাঁকজমকপূর্ণ, বর্ণাঢ্য প্যারেড এপ্রিলের নির্দিষ্ট সকালে অগুণতি দর্শনার্থীর বিস্ফারিত চোখের সামনে সেভেন্থ স্ট্রিট থেকে সেভেন্টিন্থ স্ট্রিট অবধি  কন্সটিটিউশন এভিনিউ জুড়ে  মাতিয়ে তোলে ভুবন। দৈত্যাকার রঙবাহারি হিলিয়াম বেলুনের অবাধ উড়ান, মার্চিং ব্যান্ডের জাঁকালো প্রদর্শন, যুদ্ধের নায়ক, সেলিব্রিটিদের সমাগমে নয়নাভিরাম বিনোদনের সমারোহ সব মিলিয়ে উৎসবের রঙ চড়া হয় রাজধানীর হিমেল সকালে …”

কথা বলতে বলতেই কী যেন একটা দেখে একটা স্টলের দিকে তাকিয়ে তড়বড়িয়ে উঠে চলে যান বাবা। ফিরে আসেন হাতে  তিন প্লেট ‘ফানেল কেক’,জিলিপির মত এক ধরনের পাকানো মিষ্টি সঙ্গে করে! মহানন্দে জিভের স্বাদ, মনের সাধ পূর্ণ করে ঠোঁট চাটতে থাকা ঠুমরির দিকে তাকিয়ে বাবা মুচকি হাসেন, “চল। এবার অনেকটা পথ হাঁটতে হবে কিন্তু!”

bhromonotitbhromon02 (Medium)হোয়াইট হাউস থেকে ইউ এস ক্যাপিটলের দূরত্ব অবশ্য খুব একটা বেশি নয়,পায়ে হেঁটে মোটামুটি এক মাইল। তার ওপর আবহাওয়া এতটাই মনোরম,শহর এতটাই সাজানো এবং হেঁটে চলার আনন্দটুকু এতটাই নির্মল যে এইটুকু দূরত্বের জন্য কেউ ক্যাবের কথা ভাবে না, বরঞ্চ হাঁটাটাই শরীরচর্চার অহেতুক ছল হয়ে দাঁড়ায়। খানিক আগেও  ঠুমরি কয়েকজনকে ক্যাপিটলের সুবিশাল মাঠের এপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে অবলীলায়  ঘন্টার পর ঘন্টা জগিং করতে দেখেছে–এই হাড়কাপানো ৭/৮ ডিগ্রির ঠান্ডাতেও তাদের গায়ে স্লিভলেস টিশার্ট,শর্টস!  অবশ্য রাজপথের মিঠে রোদ্দুরে  পা ডুবিয়ে হেঁটে বেড়ানোর মজাই আলাদা,আর সেই ফুরফুরে আনন্দের টুকরোটাকরা কুড়িয়ে তুলতে তুলতে একসময় ঠুমরিদের পথ এসে থেমে গেল পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ইমারতগুলির মধ্যে একটি- ইউ এস ক্যাপিটলের সামনে।

বসন্তমধুর সকালের ঝকমকে রোদ্দুর ঠিকরে পড়ছে গম্ভীর গম্বুজের গা বেয়ে,ঠিক যেমন ঠিকরে ওঠে ঔদ্ধত্যের গর্বিত আভা! বাবা এবার বেশ উদ্দীপিত হয়ে বলে উঠলেন, “দেখ দেখ ঠুমরি, এই হল সেই ইউ এস ক্যাপিটল-ইউ এস কংগ্রেসের অধিবেশনস্থল!যার নর্থ উইঙ ‘সেনেটে’র দখলে আর ‘হাউস অফ রেপ্রেজেন্টেটিভে’র দখলে সাউথ উইং। ক্যাপিটল হিলের ওপর অবস্থিত এই প্রবাদপ্রতিম অট্টালিকার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন স্বয়ং,কত সালে বলতে পারিস?”

ঠুমরির সালটা মনে ছিল। স্কুলেই সোশ্যাল স্টাডিজে কদিন আগেই পড়েছে ও, ছটফটিয়ে বলে উঠল,“১৭৯৩ সালে।”

আদুরে চাপড়ে পিঠে পিঠকম্প ধরিয়ে দিয়ে বাবা বেশ উদাত্ত গলায় বলে উঠলেন, “ঠিক ঠিক!এর মূল ভবনটির নির্মাণকার্য শেষ হয়েছিল ১৮২৬ সালে,যদিও তারপরেও নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে সংযোজন, সংস্কারসাধন এবং পুণর্নির্মাণকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ক্যাপিটলের উৎকর্ষসাধনের প্রচেষ্টায় খামতি পড়েনি এখনো।   ১৯ শতাব্দির নিওক্ল্যাসিকাল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই চিত্তাকর্ষক, রাজকীয় বিল্ডিংটির ব্যাপ্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জেনে রাখ -প্রায় ৭৫১ ফুট দীর্ঘ, ৩৫০ ফুট প্রশস্ত এবং ২৮৮ ফুট উঁচু এই সুবিশাল অট্টালিকার ‘কাস্ট আয়রন’ দিয়ে তৈরি বাটির মত উলটানো গম্বুজের ওপর ব্রোঞ্জের স্ট্যাচু অফ ফ্রিডমটি স্থাপিত হয়েছিল ১৮৬৩ সালে। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের আদর্শের মূর্ত প্রতীক এই ইউ এস ক্যাপিটল বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ অট্টালিকা।”  

ক্যাপিটলের সামনের ‘রিফ্লেক্টিং পুলে’র ঝকঝকে আয়নায় তখন আভিজাত্যের বিস্ফোরণ আর বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে মখমলি সবুজের নিবিড় আন্তরিকতা, এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা গোলাপী ফুলের ভারে আকাশ ঢেকেছে দুটি ম্যাগনোলিয়ার শরীর, ফোটা ফুলে মৃদু লেবুর মত গন্ধে মাতোয়ারা বাতাস। ক্যাপিটলের নতু্ন প্রবেশদ্বারটির নাম দ্য ক্যাপিটল ভিজিটর সেন্টার। ঠুমরী শুনেছিল সেটি সোম থেকে শনি পর্যটকদের জন্য খোলা,ভিতরের মিউজিয়ামটিও নাকি দেখার মত। দ্য ক্যাপিটল ভিজিটর সেন্টারের ওরিএন্টেশন থিয়েটারে ১৩ মিনিটের জন্যে একটি ছোট্ট ফিল্ম দেখানো হচ্ছিল-‘আউট অফ মেনি,ওয়ান’!এই মাত্র তেরো মিনিটেই তা ঠুমরির মুগ্ধ চোখের সামনে তুলে ধরল বিশ্বের প্রথম সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এই দেশের সংগ্রাম আর দীর্ঘ আত্মপ্রত্যয়ী যাত্রার কাহিনী।

ফিল্ম দেখে বেরিয়ে এসে এবার একটু এদিকওদিক উঁকি মারার পালা !ইউএস কংগ্রেসের অধিবেশন স্থলের সেই রাজকীয় বাড়ি, সুবিশাল ন্যাশনাল স্ট্যাচুয়ারি হল, বিশাল গোলাকৃতি রোটান্দা-এই সব যেন ঠুমরির বিস্ময়ান্বিত চোখে এঁকে দিয়ে যাচ্ছিল জানাঅজানার আঁকিবুঁকি! ঠুমরি জানে,এই ইউ এস ক্যাপিটল তৈরি হয়েছিল প্রায় তেত্রিশ বছর ধরে। বহু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে। আর এই ইমারত তৈরির দীর্ঘ সময়ে নানা ঘটনার কথা,নানা কিংবদন্তী,নানা ভুতুড়ে,আজগুবি গল্প শুনেছে ঠুমরি। আচ্ছা,তার সবই কি সত্যি? নাকি মনভুলানো গল্প?

ঠুমরি  কিন্তু এত ব্যস্ততার মাঝেও এহসান সুলেমান শাহ সাহেবের দেওয়া সেই আওয়ার গ্লাসটা সঙ্গে আনতে ভোলেনি! নিউ ইয়র্কের সেই উত্তাল ঘটনাটার পর থেকে এতদিন ওটিকে ঠুমরি সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল ওর বইখাতার ক্লসেটে। আচ্ছা,আর একবার আওয়ার গ্লাসটার ক্ষমতা পরখ করে দেখলে কেমন হয়? এতদিনে ওটার গাঁটে গাঁটে জং পড়ে যায়নি তো?

নিশ্চুপে, সবার অলক্ষ্যে পকেটে হাত  ঢোকাল ঠুমরি। পকেটের এক কোণায় লুকিয়ে থাকা আওয়ার গ্লাসটায় হাত ঠেকতেই হঠাৎ কেমন যেন অদ্ভুত এক শিরশিরানি ছড়িয়ে গেল ঠুমরির শরীরের আনাচেকানাচে !

(ক্রমশ)