ভ্রমণ-হাঁটছি-অর্ণব চক্রবর্তী-বর্ষা ২০১৬

bhromonarnab5703 (Medium)

আপন হতে বাহির হয়ে

bhromonarnab5707 (Medium)তিন বন্ধু হাঁটতে বেড়িয়েছি। কিন্তু পথে বিভ্রাট। হরিদ্বার থেকে বাস ব্যাসির দিকে কিছুটা এগিয়েছে, পথে ধ্বস, গাড়ি বাসের লম্বা লাইন। পৌঁছনোর কথা ছিল চামোলি, সন্ধ্যা সাতটায় পৌঁছলাম শ্রীনগর। তারপর এই ঠিক হল ওই ঠিক হল করে দুদিন কেটে গেল। ভাবছি অন্য রাস্তা ধরব অন্য কোন দিকে, ঠিক সেসময় খুলে গেল রাস্তা তিনদিনের মাথায়, আর আমরা পৌঁছলাম চামোলি। চিঠিচাপাটি আগে করা সত্যেও গাইডমশায়  এলেন না, পাঠিয়ে দিলেন আনকোরা একটি ছেলেকে। অগত্যা, সেই ছেলে আর তার গ্রামের আরও দুই সঙ্গীকে সম্বল করে নিজমুলা থেকে হাঁটা শুরু করতেই আবার আমি বিভ্রাটে, চপ্পল bhromonarnab5709 (Medium)সমেত পা গেল ক্ষেতের কাদায় গেঁথে। কী আর করা? টেনে তুলে সেই কর্দমাক্ত অবস্থাতেই হাঁটা লাগালাম আর দিনের শেষে পৌঁছলাম তরাগতালে, রবিনদার [রবিন ব্যানার্জি]  তৈরি স্কুলের দাওয়ায়।

বর্ষায় নাকি দুটি তাল পাশাপাশি জুড়ে গিয়ে অনবদ্য লাগে, কিন্তু আমরা তো সেপ্টেম্বরের শেষে, তাই তরাগতালে মন না বসিয়ে চললাম গান্নেখরক। একখন্ড সবুজে ছাওয়া মাঠ, তাঁবু টাঙানোর জন্য আদর্শ, আর লম্বা রঙিন ছাতাটাকে বিভিন্ন পোজে রেখে ছবি তোলার স্টুডিও যেন। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও হল কিছুক্ষণ। বেশ মনে ধরে গেল জায়গাটা। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে এই এক দোষ, ঠিক হল যাব বহুদুর হেঁটে, কিন্তু মাঝপথে কোন বুগিয়াল বা হ্রদতীর এত্ত ভাল লেগে যায় যে মনে হয় থেকে যাই সেখানে।

bhromonarnab5705 (Medium)যাই হোক পরদিন ধৌলাধারি। অল্প সময়ের হাঁটা – এই চার ঘণ্টার মত। কিন্তু যথারীতি খাসা জায়গা। একটি ছোট জলধারাও রয়েছে জায়গাটিকে রূপের নাগর করে তোলার নিমিত্তে। হাতে অনেক সময় বেঁচে, তাই ভুবন ভরিয়ে আড্ডা আর আড্ডা মাঠে গড়িয়ে।

পরদিন কিন্তু বেশ চাপে পড়া গেল। খাড়াই রাস্তা, কোন কোন জায়গায় ঘাসের ঝুঁটি ধরে প্রায় চার হাতপায়ে ওঠা। তার সাথে যোগ হল জলের অভাব। জিভ কাঠ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু জলের কোন দেখা নেই। অবশেষে সেই ছোকরা একটা রিজের থেকে অনেক নীচে নেমে খানিক জল ভরে নিয়ে আসে। অতএব আবার হাঁটা ওই রিজ ধরে। বেলা পড়ে আসে, পশলা বৃষ্টি হয়, তার মধ্যে পৌঁছোই bhromonarnab5706 (Medium)ধোনিনৌলি। আমি খুব বিষণ্ণ বোধ করি, শরীরে পোয়াটাক শক্তি নেই। মাথা ধরে বসে থাকি। বন্ধুরা তাঁবু টাঙায় আর আমার শোয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। সে রাতে কিছু আর খেতে ভাল লাগে না, তাঁবুর বাইরে বন্ধুদের আলোচনা শুনি, তারা ধন্দে পরেছে আমার শরীর নিয়ে এবং শেষপর্যন্ত আর না এগোনোর সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু পরদিন শরীর আবার তরতাজা। তাতে হবে কী? সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। আর মাত্র দুটি পাড়াও- পাথরকুরি ও সিম্বে। তারপরই পেয়ে যেতাম একটি রিজ, যার উপর থেকে দেখতে পেতাম সাতটি কুন্ড, নন্দাঘুন্টির পায়ের নিচে, পান্না সবুজের বেশে সেজে সাতটি রূপকন্যা, এক অসীম শিখরের পদতল চুম্বন করে জেগে রয়েছে। হল না bhromonarnab5702 (Medium)সেইবার। ফিরে চললাম।

ঝিঝি গ্রামে একটি দিন থেকে, বনতলে পা বাড়ালাম। এসে পৌঁছলাম এক জায়গায়, যাকে নিয়ে বলতে গিয়েই এত কথার অবতারণা। একটি ব্রিটিশ আমলের বাংলো, কিঞ্চিৎ একটি নদীর থেকে কিছুটা উপরে, গভীর আর বিস্তৃত নদীখাত ওপারে গিয়ে ঠেকেছে এক স্পর্ধিত পাথরের গায়ে, সে উঠে গেছে
বহু উচ্চে, যেন মেঘে যেতে চায়, ছুঁতে চায় রাতের তারা। জানতে পারি এটি দুরমি বাংলো। পাশেই দুরমি গ্রাম। পাশের নদীখাতটি আসলে গৌনা তালের ফেলে যাওয়া অবশেষ। এক প্রলয়ের দিনে তালের একটি দিক ভেঙে গিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আশেপাশের বহু গ্রাম, পড়ে থাকে এই বিস্তৃত খাত আর বেঁচে যায় এই শতাব্দী প্রাচীন বাংলোটি।

bhromonarnab5708 (Medium)কিন্তু যথারীতি আমাদের বিধি বাম। চৌকিদার নেই। নেই তো নেই। অগত্যা গরিবের সেই বাংলোর বারান্দাই ভরসা। সেবারের মত ট্রেকের বড়া খানার প্রস্তুতি সেখানেই। রাতে সব পাখি যখন ঘরে ফিরে গেছে, আমরা স্লিপিং ব্যাগটি নিয়ে ম্যাট্রেসে শরীর এলিয়ে দি, আর চমকে উঠে দেখি এক
আকাশভরা তারা, বহু অলৌকিক ছায়াপথ, এক অসীম হিমালয়ের স্পর্শ, ওই উল্টোদিকের পাহাড়ের গায়ে জেগে আছে। জেগে থাকি আমরা তিনজনও, বহুক্ষণ নীরবে, আমাদের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে এক অতিপ্রাকৃত আলোড়ন।

bhromonarnab5701 (Medium)তা এতদিন পরে এসব কথা কেন, তারও একটি কারণ আছে। সেবার যখন চামোলি থেকে ফিরতি জিপে উঠবো উঠবো করছি, সেই গৌনা গ্রামের
ছোকরা এগিয়ে এল। তাকে বুকে টেনে নিলাম, আর বুঝতে পারলাম ব্যাটা অঝোরে কাঁদছে। সত্যি বলতে সেই ছোকরার সাথে আমাদের আজ পরিবারের সম্পর্ক। তার গ্রামে আমরা সুযোগ পেলে যাই, বা তার গ্রামের কাছাকাছি কোথাও হাঁটতে গেলে ডেকে নি। তারপর একসাথে বেশ কয়েকদিন কাটে, মোদ্দা কথা সে এখন আমাদের একজন টিম মেম্বার। কিন্তু এটাও ঠিক এই কথোপকথনের অন্যতম কারণ নয়, আসল কারণটা হল, মনটা আবার সপ্তকুন্ড সপ্তকুন্ড করছে, একটু অন্য পথে, আরও একবার, বেরিয়ে পড়তে চাইছে মনটা। কে কে যাবে হাত তোল।

bhromonarnab5710 (Medium)

[ক্রমশ]

ক্যামেরাঃ অর্ণব