তিতির পাখির গল্প
অনুষ্টুপ শেঠ
প্রকাশক : পলান্ন
মূল্য : ৩০০ টাকা
পাঠকরা হাতে যে কোন বই পেলে প্রথমেই যা তাদের চোখে পড়ে তা হল বইয়ের নাম আর মলাট। “তিতির পাখির গল্প” নামটার মধ্যেই এমন এক অদ্ভুত মিষ্টি কাব্যময়তা আছে যা পড়া মাত্রই পাঠকের মনে এক অনাবিল ভালোলাগা জাগিয়ে তোলে, আর তার পাশাপাশি নামের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাযুজ্য রেখে তৈরি হয়েছে বইটির ভারি মিষ্টি মলাট।
এই মলাটের আরেকটি বিশেষত্ব হল মলাটটি লেখকের স্বহস্তে চিত্রিত, এবং তা এমনভাবেই যে বইটি দৈবাৎ হাতে পেয়ে গেলে পাতা উলটে দেখার লোভ সম্বরণ করতে পারে এমন পাঠক সম্ভবত জন্মায়নি। সুতরাং পাতা উলটে এগোনোর পালা শুরু। শুরুতেই প্রখ্যাত লেখক সৈকত মুখোপাধ্যায়ের লেখা মুখবন্ধ এবং তারপর বইয়ের লেখিকার “লেখার গপ্পো” বইয়ের পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে যাবার আকুতি আরও বেশি বেশি করে বাড়িয়ে দেয়।
বাছাই করা ৬০টি গল্পের সমাহার বইটি, যাদের মধ্যে বেশ কিছুর প্রথম আত্মপ্রকাশ এই বইতেই। মূল পাঁচটি ভাগ বইয়ের – শৈশবের রঙ, ক্ষুদ্র কিন্তু তুচ্ছ নয়, বিগ গার্ল, ফুলুরিকথা ও পুনশ্চ। এই গল্পগুলোর মূল চরিত্র বলাই বাহুল্য তিতির, আর সঙ্গে রয়েছেন তিতিরের মা, যিনি এই গল্পগুলোর কথক, আর এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তিতিরের পোষ্য বেড়াল ফুলুরি, তিতিরের বন্ধুবান্ধবরা, আর তিতিরের দাদু দিম্মা।
গল্পগুলো ডানা মেলেছে অত্যন্ত সাধারণ আমাদের অতি পরিচিত প্রতিদিনের জীবনের পরিবেশে। কিন্তু সেই প্রতিদিনের ঘটনাগুলো আমাদের কাছে আসছে পরপর দুজনের দেখার মধ্যে দিয়ে – প্রথমে তিতিরের চোখে তারা যেভাবে ধরা পড়ছে আর তারপর তিতিরের মায়ের চোখে তিতিরের দেখা যেভাবে ধরা পড়ছে। এই দুই স্তর দেখার মধ্যে দিয়ে খুব সাধারণ ঘটনা এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে যা পাঠকমনে এক অসাধারণ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে। অসাধারণ সাবলীল বাংলায় লেখা গল্পগুলোতে বেশ কিছু “তৈত্তিরীয়” উপস্থাপনা গল্পের মজাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে তোলে।
এক মায়ের চোখ দিয়ে এক ছোট্ট মেয়ের জগত দেখার দৃষ্টির প্রথম বর্ণনা বইয়ের একদম শুরুর “ছবি” গল্পটায়। তিতির একটা ছবি এঁকে তার মাকে দেখায়। মা তাঁর নিজের পরিচিত জগত অনুযায়ী ছবিটাকে বোঝার চেষ্টা করেন কিন্তু অচিরেই উপলব্ধি করেন এ ছবি সঠিক বুঝতে হলে পা রাখতে হবে তিতিরের জগতে। তাঁর প্রয়াস জারি থাকে আর গল্পের শেষে যখন তিনি সত্যিই সেই জগতের সন্ধান পান তখন ছবিতে আঁকা প্রতিটি জিনিসকে তিতির যেভাবে চেনাতে চেয়েছে ঠিক সেইভাবে চিনতে পারেন।
আপাত সাধারণ এই গল্পটার মধ্যে কিন্তু একটা অসাধারণ বার্তা আছে – আমরা কি দেখব তা আমাদের দেখার আঙ্গিক অনেকটা ঠিক করে দেয়, শিশুমনকে সঠিক ভাবে বুঝতে হলে শিশুমনের কল্পনার জগতে নিজেকে ঢুকতে হবে, বাইরে থেকে তার নাগাল পাওয়া সম্ভব নয় মোটেই। সেখানে চেরি হল তে-ঈ, তাকে তেই বলা চলে না কোনোমতেই, ভুল করে বলে ফেললে তিতির সঙ্গে সঙ্গে শুধরে দেয় (গল্প “তে-ঈ”)। তালগাছ থেকে নারকোল পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার (গল্প “ঢেসকুমড়ো”)। মহিষাসুর সেখানে শার্ক পোষে (গল্প “শার্ক”)। এমন কত কী সেখানে ঘটেই চলে! যেমন তিতিরের মায়ের কথায় – “একদল অসীম পরিশ্রমী ‘রাক্কোশ’ এর গল্প শুনি, যারা দল বেঁধে আমাদের বসার ঘরে সোফার পিছনে বসে খুব ‘কাজকম্মো’ করে। তারা খায় না, দায় না, খালি খালি খেলনা বানায় আর সব্বাইকে খেলতে দেয়।” তিতিরের কথা অনুযায়ী এদের বৈশিষ্ট্য হল রাত্তির সাড়ে নটা বাজলেই এরা হাই তুলে মরে যায় আবার পরের দিন সকালে উঠে কাজকম্মো করতে লেগে পড়ে (গল্প “কৌতূহল”)। “গান” গল্পতে তিতির যেভাবে “মুক্তির মন্দির সোপানতলে” গানটা শিখে শিশুমনের অসামান্য সরলতায় তার মাকে বীর বলে স্বীকৃতি দেয় তা বোধহয় বীরগাথায় বন্দিত ঐতিহাসিক বীরদের মনেও ঈর্ষার উদ্রেক করবে। “সাপলুডো” গল্পে বাচ্চা সাপ যে কখনই কাউকে খাবে না কারণ সাপ মা তাকে বাইরের কিছু খেতে বারণ করেছে আর তাই সেই ঘরে তিতিরের ঘুঁটি অবাধে বিচরণ করে নীচের ঘরে নেমে যাওয়ার তোয়াক্কা না করে এটা বোধহয় কেবল তৈত্তিরীয় জগতেই সম্ভব। তৈত্তিরীয় জগতে “রেস্টিং ইন পিস” এর মানে আমাদের পরিচিত মানের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং “পিছনে দুটো বালিশ দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বসে পা নাচাতে নাচাতে” নিজের পছন্দের বই পড়ার চেয়ে আর কত “পিস” নিয়ে “রেস্ট” করার কথা বইপ্রেমীরা কল্পনা করতে পারে (গল্প “চিঠিচাপাটি”)? এই “তৈত্তিরীয় ইঞ্জিরি” বই ভালোবাসা মানুষদের মনের সবচেয়ে আনন্দের ইচ্ছেটাকে কি অবলীলায়, কি অসাধারণ ভাবে প্রকাশ করে ফেলেছে! “যুদ্ধ” গল্পটা কোন থ্রিলারের চেয়ে কোন অংশে কম নয়, এক অদ্ভুত যুদ্ধের বর্ণনার শেষে অভাবনীয় এক ক্লাইম্যাক্স যা বলে দিয়ে পাঠকদের সেই থ্রিলার পড়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা একান্তই অন্যায় হবে, সুতরাং কেবল এটুকু বলাই ভালো যে এ গল্পটি যেন সকলে অবশ্যই পড়েন অর্থাৎ এটি অবশ্যপাঠ্য গোত্রের, নইলে যিনি পড়বেন না তিনি এক অসামান্য অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন। “ফুলুরি” গল্পে যেভাবে তিতির তার পোষ্য বেড়াল ফুলুরির নামকরণ করে ‘আ বিগ লোফ অফ ব্রেড’ আর তিতিরের মা যেভাবে দীর্ঘশ্বস ফেলে বলেন “শেষে কিনা ফুলুরিও! প্রজা হয়েই এ জীবনটা কেটে গেল রে ভাই!” তখন হাসি ধরে রাখার উপায় বিশেষ থাকে না।
এক কথায় “তিতির পাখির গল্প” হল নিজেদের শৈশবকে বারবার খুঁজে পেয়ে তাকে কখনও হারিয়ে যেতে না দেওয়ার এক জাদুকাঠি। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই যে শিশু সারাজীবন বাস করে, কিন্তু সেই ‘রাক্কোশ’গুলোর মত হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়ে, তাদের পরদিন সকালে বারবার জাগানোর জন্য তিতিরের মতো কাউকেই তো দরকার। তিতিরের মা ডারউইনের মত তিতিরের বিবর্তন লক্ষ করতে করতে তা সুনিপুণভাবে লিপিবদ্ধ করে আরও অনেককে তিতিরের জাদুকাঠির স্পর্শ পাওয়ার যে সুযোগ করে দিয়েছেন তার জন্য পাঠকরা তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। এবং এই শিশুজাগানিয়াদের যথার্থভাবে কি করে যত্ন করে রক্ষা করতে হবে তা তিতিরের মা “পুনশ্চ” অংশে “শিশুমঙ্গল” -এ অত্যন্ত দৃঢ়তা অথচ মমতার সঙ্গে তাঁর স্বভাবোচিত সাবলীল ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন অনায়াসে যা বইটিকে আর এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। তিতির ও তার মায়ের অলংকরণ সমস্ত বইয়ের মধ্যে আরও সজীবতার সঞ্চার করে।
সবশেষে একটাই কথা, শৈশব দীর্ঘজীবী হোক, যুগে যুগে বেঁচে থাকুক তিতিররা তাদের জাদুস্পর্শে সমস্ত বয়সের মানুষের শৈশবকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তিতিরের মায়ের ভাষাতেই বলা যাক –
“হইহই দুষ্টুমি, মজাদার গল্প
যত পড়ো, মনে হবে হল বড়ো অল্প।”