গল্প-ষষ্ঠীর বাহন- কল্যান সেনগুপ্ত-বর্ষা ২০২২

এই লেখকের আগের গল্প – বংশীধরের বিপদ

golposhoshthir bahon

“মা, একটা পুষি না?”

“কতবার বলেছি ফ্ল্যাটবাড়িতে বেড়াল পোষা যায় না! বাজে কথা ছেড়ে সন্ধে হয়ে আসছে, পড়তে বসো।”

রিনি ঝোলাঝুলি করতে থাকে।—“মা, মা, কী হবে? পুষি না? কীরকম নীচে সিঁড়ির ধারে কুঁকড়ে বসে আছে। তোমার দেখলে মায়া হবে। ওর খুব খিদে পেয়েছে। আমাকে দেখলেই এগিয়ে আসছে। মাথা ঘষছে।”

মেয়ের আবদার পাথরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। দূরে বসে কাগজ পড়তে পড়তে শুনছি, ‘ঘরে দুটো পোষ্য তো আছেই, আর নয়। এতেই আমার হাড়মাস ভাজা ভাজা হয়ে গেল।’

মেয়ে চুপ। এরপর আর কিছু বলবার নেই। মার মাথা গরম আছে। বেশ কয়েকবার স্কুল থেকে ফেরার পথে বেড়ালছানা দেখে তুলে নিয়ে এসেছে। তাকে দু-দিন বাড়িতে রাখার পরে তাদেরই উৎপাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গঙ্গার ধারে রেখে আসতে হয়েছে। দু-দিনেই ঘরে বমি, পায়খানা, আঁচড়ে-কামড়ে জিনিসপত্রের যা তা অবস্থা, বাড়িতে অশান্তির ঝড়।

মেয়ে চুপ হয়ে যাওয়াতে বরফ কিছুটা গলে।—“যাও, রান্নাঘর থেকে দুধ নিয়ে খাইয়ে আসতে পারো। এর বেশি কিছু করা যাবে না। আর ফিরে এসেই হোমটাস্ক নিয়ে বসবে।”

প্রথম দিন এইটুকুই। কিন্তু দু-দিনের মধ্যেই সে ওপরে চলে এল মেয়ের কোলে চড়ে। দেখলাম, একেবারেই ছোটো একটা সাদা বলের মতো। আবার দু-দিন শুধু বাইরের ঘর অবধি। ওখানেই দুধ খাইয়ে নীচে রেখে আসা। শেষে আমিই বললাম, “এইভাবে চলে কী করে? পড়াশুনা তো গোল্লায় যাবে যদি বার বার নীচ-ওপর করে খাওয়ানোর জন্যে।”

সে চলে এল। ঘরের মধ্যে একদম ভিতরে। কী যে হল কে জানে। রিনি ওকে মাটিতে ছেড়ে দিতেই গুটগুট করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল। ঘুরঘুর করতে করতে গিন্নির পায়ের তলায় চাপা পড়ে গেল। ব্যস, মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল—গেল গেল। শেষে দেখা গেল বেচারা এ-যাত্রা বেঁচে গেছে, কিন্তু হাতে লেগেছে। কিঁউ কিঁউ করছে। কোথায় লেগেছে, কোথায় লেগেছে? সে সামনের হাতটা সামনে তুলে দেখায়। গিন্নি আচমকা অবোলা জীব খুনের হাত থেকে বেঁচে যাওয়াতে কেমন নরম হয়ে গেলেন। দেখি, দেখি কী হল? গিন্নি নিজেই নিয়ে এলেন বরফ, ভলিনি স্প্রে, আর্নিকা সব। সেও ব্যাটা উঠে বসল গিন্নির কোলে; উঠেই যত্নের আতিশয্যে আস্তে করে মিঁউ মিঁউ করে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ল। ব্যস, গিন্নি কাত। ক’দিন চলল সারাদিন বাড়িতে আর রাত্রে বাইরে রেখে আসা। প্রথম চলল ক’দিন শুধু দুধ খাওয়া আর ঘুমানো। আস্তে আস্তে এদিকওদিক, এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে বেড়ানো। গিন্নি ভীষণ কড়া, মিলিটারি মেজাজ—যদি পুষতে হয়, ভালো করে মানুষের মতন পোষো। মেয়ের এতে উৎসাহ তিনগুণ বেড়ে পড়াশুনো শূন্যতে চলে গেল। এ-বেলা ও-বেলা মেয়ের বন্ধুরা আসছে তাকে দেখতে। বাড়িতে যেন কোনও গুরুদেব এসেছেন। সবসময় দরজা খোলা। মেয়ে কোলে করে নীচে নিয়ে যাচ্ছে বেরু করতে। গুগল দেখে তার শুকনো খাবার, শ্যাম্পু, ভিটামিন, ব্রাশ চলে এল। ডাক্তার দেখানো হল রাতারাতি। তাকে কত কিছু ইঞ্জেকশন, ওষুধ খাওয়ানো হল। আমি একবার মুখ ফস্কে বলেছিলাম, মুখে ভাতটা হলে হত না? তাতে শত্রুপক্ষ এই মারে কি সেই মারে। রাত্রে মেয়ের সঙ্গে সে শুতে যায়। সে এক বেড়ালে মানুষে আদিখ্যেতার শতরূপ। সে রান্না ঘরে যায় না, খিদে পেলে ম্যাও ম্যাও-ও করে না। খিদে পেলে খাবারের বাটির সামনে এসে চুপ করে বসে থাকে। বুঝে নিতে হবে তোমাকে, তাকে দেখে। গিন্নি বেশ খুশি যে রাস্তার বেড়ালের মতন পায়ে পায়ে ঘোরে না, সারাক্ষণ ম্যাও ম্যাও করে না। ওর আভিজাত্য দেখবার মতো। এসেছিল বেশ ছোটো, দেখতে দেখতে খেয়েদেয়ে চেহারায় বেশ জৌলুস এসে গেল।

একদিন অফিস থেকে ফিরে শুনি বাড়িতে বিরাট হইচই। গিন্নির চিৎকার ভেসে আসছে।—“ফের পা না ধুয়ে বিছানায়? যেটা আমি একদম পছন্দ করি না, সেইটাই? এরা সবাই মিলে আমার কাজটুকু দ্বিগুণ তিনগুণ করে দিচ্ছে!”

কাছে গিয়ে দেখি, মেয়ে রিনি দরজায় দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে আর ভিতরে বিল্লুকে চেপে ধরে গিন্নি জল দিয়ে পা-হাত ধুয়ে দিচ্ছেন। আর গজগজ করছেন।—“দ্যাখ, বাবা চলে এল। এমন হলে আমি তো বিছানায় উঠতে দেব না। আমি ভিষণ কড়া এ-ব্যাপারে।”

সে একটু অনিচ্ছা জানাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু গিন্নির প্রবল পরাক্রমে পেরে উঠছে না।

বললাম, “ও কিন্তু গেড়ে বসছে। কথা কিন্তু এমন ছিল না।”

গিন্নি ঝাঁজিয়ে উঠলেন, “কথা তো অনেক কিছুই ছিল না। সব কি তোমরা মানছ? সব বিষয়ে অশান্তি না করলে কি তোমার ভাত হজম হয় না? এই শীতের রাত্রে একটা অবোলা জীবকে বার করে দিলে কি সেটা খুব মানবিক হবে?”

“কিন্তু এরপর যদি সে ঠাকুরঘরে ঠাকুরের বিছানায় ওঠে?”

বিল্লুকে হাত-পা মোছাতে মোছাতে উনি বললেন, “সেটা বিল্লু কিছুতেই করবে না। বলো বিল্লু? তুমি না ভালো মেয়ে?”

সে কিন্তু চুপ। হাত-পা চাটতে ব্যস্ত।

মাঝে কিছুদিন অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল। একদিন দুপুরে ফোন করেছি, উত্তর এল, ‘আমরা তিনজন এখন বউদির বাড়ি এসেছি বেড়াতে।’ শুধু ভাবছি, সব তো হল। নিজের হাতে খাওয়ানো, স্নান করানো, ব্রাশ করানো, ডাক্তার দেখানো, হাত-পা ধুয়ে দেওয়া, কিন্তু যেদিন ঠাকুরের বেদিতে গিয়ে শোবে সেদিনই কি শেষদিন হবে?

শেষদিন এল না এত তাড়াতাড়ি। একদিন কী কারণে ঠাকুরঘরে ঢুকেছি দেখি সর্বনাশ, মূর্তিমান ঠাকুরকে স্নান করানোর পর বাটির জল চুকচুক করে খাচ্ছে। চারদিক তাকিয়ে তাকে তুলে নিয়ে বাইরে আসতেই মালকিনের সঙ্গে দেখা, মুখে মৃদু হাসি। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। বললেন, “নামিয়ে দাও। ও কিছু করবে না।” আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ও সারা বাড়িতে কোনও জলে মুখ দেয় না। শুধু ওর জন্যে রাখা জলেই খায়। আর ঠাকুরের স্নান হবার পরের জল বাটি থেকে খায়। এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে? রান্নাঘরে যায় না। পুজো করার সময় ও এসে বাবু হয়ে বসে থাকে। তারপর সামনে বসে পুজোটা দেখবে।”

“বলো কী গিন্নি! এমন ধার্মিক বেড়াল তো বাপের জন্মে দেখিনি।” আমার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়।

“ঠাট্টা করছ?” গিন্নি উত্তেজিত হয়ে বলেন, “রোজকার ব্যাপার। তুমি অফিসে থাকো, তাই দেখতে পাওনি। বিল্লু ঠিক বেড়ালের মতো নয়। বাড়িতে কোনও বেড়াল আছে কি না বোঝার উপায় নেই।”

আমি অবাক। কোথায় সংস্কার, কোথায় ছোঁয়াছুঁয়ি? ওর এই জল খাওয়াটা কীসের ইঙ্গিত? দুশ্চিন্তার মেঘ ঘনায়। গিন্নি তো ওকে বেড়াল বলেই মনে করছেন না। আর কিছুদিনের মধ্যেই ওকে স্কুলে ভর্তি করবেন মনে হয়। বাড়িতে কেউ এলেই সব ছেড়ে বিল্লুর কথা। শুনতে চাক বা না চাক। কেউ এলেই সে সামনে এসে বসে থাকবে।

এরপর তিন মাস অফিসের কাজে বাইরে ছিলাম; মেয়েও পুনে গেছে পড়তে। কিন্তু গিন্নি দিব্যি আনন্দে আছে তার আরেক মেয়েকে নিয়ে। ঘর মোছা, রান্না করা, ঠাকুর-পুজো—সবসময় পিছন পিছন বিল্লু ঘুরছে। সিরিয়াল দেখছেন, শুতে যাচ্ছেন—সঙ্গে বিল্লু।

সবকিছুর একদিন শেষ হয়। হঠাৎ করে এসেছিল দু-বছরের মাথায় দুম করে চলে গেল।

সকালে দিব্যি ছিল, বাইরে গিয়ে এসে বমি করল বার দুয়েক, ব্যস ঝিমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে গেল দুম করে। সে-সময় বাড়িতে কেউ ছিল না। গিন্নি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না। বেশ কয়েকদিন টিভি বন্ধ, পুজোর সময় উদাস হয়ে বসে থাকা, বিল্লুর ছবির দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। দিন দিন শরীর খারাপ হতে লাগল। খাওয়া কমে গেল। শেষমেশ অবস্থার অবনতি ঠেকাতে কিছুদিনের জন্যে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বেড়াতে চলে গেলাম। কিন্তু সেখানেও মাঝে মাঝে সেই একই কথা—এমনভাবে চলে গেল? কিছুই করতে পারলাম না।

শেষে রিনি ছুটির সময় বাড়ি এসে কিছু বিল্লুর মতন দেখতে কয়েকটা পুতুল কিনে দিল। সেই পুতুল আসতে যেতে গিন্নি আদর করে যান এ-ঘর ও-ঘর। মাথার কাছে তাকে নিয়ে শুতে যান। রাস্তায় আসতে যেতে সাদা বেড়াল দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়েন। একটু দেখে বার বার বলতে থাকেন, ‘আমার বিল্লুর মতন নয়। আমার বিল্লুর মতন নয়।’ নিজেই হেসে উঠে নিশ্চিন্তে হাঁটতে থাকেন। ওঁর মুখে একটা প্রছন্ন গর্ব।

পাঁচ বছর চলে গেল সারা ঘরে তার স্মৃতি ছড়িয়ে। ছবি, ওষুধ, ব্রাশ, শ্যাম্পু—সব যেমন-কে-তেমনই আছে। ভুল করেও নড়ানো যাবে না। তাহলেই হইচই বেধে যাবে। বিল্লু সম্বন্ধে কোনও কথা শুনতেই চান না।

মেয়ে থাকতে না পেরে একদিন আবার বললে, “মা, আরেকজনকে আনি? আনব?” ঝুলোঝুলি করতে থাকে।

গিন্নি উত্তর দেন, “না, আর নয়। আমি ওকে নিয়েই থাকতে চাই।”

কে জানে কতদিনে সময় এসে মুছে দেবে সেই বিছেদের বেদনা আর বলে দেবে কোনোকিছুই চিরকালীন নয়।

গিন্নি কিন্তু দিব্যি আছেন। মাঝে মাঝেই বলেন, “মনে হয় না ও বাইরে কোথাও গেছে, খিদে পেলেই এখুনি চলে আসবে?”

আমি মাথা নাড়ি।—“হ্যাঁ।”

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে