উপন্যাস প্রজেক্ট সিনার্জি রাজীব কুমার সাহা শীত ২০১৬

uponyassynergy

রাজীবকুমার সাহা

।।এক।।

বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম নয়। নিকষ কালো অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে আরও নামছে ঘড়ির কাঁটা ধরে। চারদিকের পাহাড় পর্বতে ঘুরপাক খেয়ে কনকনে বাতাস ঠিক কোনদিক থেকে এসে হাত পা কামড়ে ধরছে ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। রাত মাত্র দশটা। মঠের প্রধান রিনপুচে নিজের কক্ষের একটা জানালা খুলে দিয়ে অপলক তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে। মুখের রেখায় তাঁর বজ্রকঠিন এক সঙ্কল্প। সাদা সাদা বরফগুঁড়ো বাতাসের ঝাপটায় তীক্ষ্ণ সূচের মতো এসে যেন বিঁধছে চোখেমুখে। এই শৈত্যপ্রবাহের দাপটে গোটা মঠ-পাহাড়টা নিঝুম এক মায়াপুরীর মতো হয়ে আছে। রিনপুচে এইমাত্র উঠে এসেছেন ভগবান বুদ্ধের সামনে থেকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে নতুন করে শুরু করতে হবে নিজের জীবনটাকে। সঁপে দিতে হবে এক অজানা ভবিষ্যতের হাতে নিজেকে। পাড়ি দিতে হবে শ্বাপদসঙ্কুল ঘন বনে ঢাকা অচেনা বন্ধুর গিরিপথ, অস্পষ্ট এক ঠিকানার উদ্দেশ্যে। ইয়ারলুং জেংবো নদীটাই সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় এই যাত্রাপথে। সদ্যস্নাতা রমণীর পৃষ্ঠদেশের বিক্ষিপ্ত সিক্ত কেশরাশির মতো ছড়িয়ে আছে এই নদী বিস্তীর্ণ উপত্যকা জুড়ে। কিনারায় পৌঁছতে পৌঁছতে তাপমাত্রা নিশ্চিতরূপে আরও ডিগ্রি তিনেক নেমে যাবে। তখন নদী পেরোনো আর যমের হাতে নিজেকে তুলে দেওয়া এক জিনিস। আবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে এই নদীটাই একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে তাঁকে পৌঁছে দিতে পারে তাঁর ঈপ্সিত লক্ষ্যে। একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে রিনপুচে প্রস্তুতি শুরু করলেন যাত্রার। পাথেয় বলতে তেমন কিছুই নেই সাথে। সঙ্গে নিচ্ছেন শুধু শক্ত কাঠের তৈরি একটা বাক্সে মহামূল্যবান এক বস্তু। আর উপাসনার টুকিটাকি জিনিসপত্র, অল্প খাবারদাবার ও একপাত্র জল গাঁঠরি বেঁধে কাঁধে নেবেন।

খুব সন্তর্পণে দরজা ফাঁক করে ঢুকল তাশি। সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে সে। রিনপুচের কক্ষে একমাত্র তাশিরই অবাধ যাতায়াতের অনুমতি আছে। তাশির দু’হাতের আঙুলগুলো সামনে বাঁধা, দৃষ্টি পায়ের আঙুলে। মুখ ফুটে মৃদু অথচ দৃঢ় একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল, “আমি আপনার সঙ্গে যাবই মহামান্য রিনপুচে। আমায় আর বাধা দেবেন না। এই দুর্যোগে আপনাকে একা আমি ছেড়ে দেব না কিছুতেই।”

এ নিয়ে গত দু’দিন ধরে অবিরাম এক দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলছে দু’জনের মধ্যে। রিনপুচের একান্ত গোপন এই যাত্রার কথা তাশিই জানে একমাত্র। আর কাকপক্ষিতেও টের পাওয়ার কথা নয়। তিনি মনে মনে তাশিকে এই মঠের ভবিষ্যৎ মঠপ্রধান হিসেবে স্থির করে রেখেছেন। কিন্তু তাশিকে তাঁর সহযাত্রী হিসেবে নিরস্ত করতে পারছেন না কিছুতেই। ভালোবাসার পাত্রকে কপট গাম্ভীর্যে তিরস্কার করা যায়, কঠোর হয়ে আঘাত করা যায় না।

আর মাত্র ক্রোশ তিনেক পেরোতে পারলেই ইয়ারলুং জেংবো নদীর তট। অনভ্যস্ত পায়ে বেশ কয়েকটা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে দু’জনেই বেশ ক্লান্ত। শিথিল হয়ে আসছে পায়ের পেশি। চামড়ায় এখন শীতের কামড়টা আর নেই অবশ্য। বদলে নিঃশ্বাসে তপ্ত হলকা। অন্ধকারের নিজস্ব আবছা আলোয় প্রিয় শিষ্যের অবসন্ন অবয়ব পানে বারবার তাকাতে তাকাতে নিঃশব্দে পাহাড় ভাঙছেন রিনপুচে। তিন চারহাত সামনে ভারি কাঠের বাক্সটা কাঁধে ফেলে পা ঘষটে ঘষটে চলেছে তাশি। একটু পর পরই আবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিচ্ছে ভগবান বুদ্ধের জীবিত রূপটিকে। রিনপুচের স্মিত হাস্যের আভায় যেন অভয়ের বাণী।

অরুণোদয় আসন্ন। অন্ধকার যেন তার সমস্ত শক্তি একত্র করে জমাট বেঁধে অবশিষ্ট রাত্রিটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছে এবার। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। সমস্ত দুশ্চিন্তা আশঙ্কাকে সত্যি করে দিয়ে আচমকা নদীতটের গাছপালা আর আশেপাশের বিক্ষিপ্ত বড়ো বড়ো পাথরের ফাঁক ফোঁকর থেকে বেরিয়ে এসে নিঃশব্দে দু’জনকে ঘিরে দাঁড়াল বেয়নেট তাক করা জনাদশেক লালসৈন্য। ক্যাপ্টেনের হিসহিসে হিংস্র উল্লাসে কেঁপে উঠল তাশির অন্তরাত্মা।

।।দুই।।

কখনও ঝিম ধরা ঘন পার্বত্য বনাঞ্চল, সর্পিল পাকদণ্ডী, কখনও বা ঘিঞ্জি শহর, গ্রাম্য জনবসতি, কখনও নদ-নদীর সমতট কখনও বা পাথুরে এবড়োখেবড়ো রাস্তা – একটা সাদা রঙের জিপসি ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে। সামনে পেছনে মিলিয়ে মোট চারজন আরোহীর মধ্যে তিনজন সীটে গা এলিয়ে খোশগল্পে মেতে চলেছেন। একজন মন দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। সময়ে সময়ে আবার পালটে পালটে একজন করে এসে স্টিয়ারিংয়ে বসছেন। পাড়ি দিতে হবে কমপক্ষে এগারশো কিলোমিটার পথ। যাত্রার শুরু আর গন্তব্য ধরলে গাড়িটা সফর করবে চার চারটা রাজ্য। গাড়ির পেছনে দু’দিকের সীটের পায়ার সাথে শক্ত করে বেঁধে বিছিয়ে রাখা হয়েছে চারজনের চারটা লোহার মজবুত সবুজ রঙের ট্রাঙ্ক। যাতে খারাপ রাস্তায় চাকার তালে লাফিয়ে না ওঠে। এগুলোর মধ্যে যেকোনও একটাতে রয়েছে অতি মূল্যবান এক জিনিস। যা খুব গোপনে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে এক গভীর জঙ্গল থেকে আরেক গভীর জঙ্গলে।

অনেকক্ষণ ধরেই চঞ্চলা কিশোরীর মতো একটা খরস্রোতা নদী দৌড়ে চলেছিল জিপসিটার পাশে পাশে। নদীটা আস্তে আস্তে সমতলে গা ভাসিয়ে দিতেই নির্জন বালুতটে একটা হনুমানমন্দির চোখে পড়ল সবার। আরোহীদের মধ্যে একজন গাড়ি থামিয়ে মন্দিরে ঢুকে ইষ্টের শীতল পাদ-প্রস্তরে কপাল ঠেকিয়ে এলেন।

এতটা পথ ছোটোগাড়িতে জার্নির ধকল না সয়ে আকাশপথেই পাড়ি দেওয়া যেত অনায়াসে। কিন্তু তাতে সেই মূল্যবান জিনিসটার গোপনীয়তা রক্ষা হত না। তাই এই চারজন আরোহী জীবন-মৃত্যুর তোয়াক্কা না করে বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি পথকেই বেছে নিতে বাধ্য ছিলেন। এই দীর্ঘ পথে মোট চেকপোস্টের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, একপলক তাদের পরিচয়পত্রে চোখ বুলিয়ে নিয়েই অপরাধীর মতো আচরণ করে তৎক্ষণাৎ পাসিং সাইন দিতে দেরি করছে না কোনও চেকপোস্টই। সে অবশ্য হওয়ারই কথা। কারণ, ভারতবর্ষের হৃৎপিণ্ডটা আরোহীদের মতো লোকদের হাতেই সঁপে দেওয়া আছে।

।।তিন।।

ভাদ্রমাস পড়ে গেছে। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে তা বোঝার উপায় নেই যদিও। ঘন শ্রাবণধারা যেন এবার বিদেয় নেওয়ার নামই নিচ্ছে না। উত্তরপূর্বের এই শ্যামলী রাজ্যটার মহিমাই এই। সন্ধে সাড়ে আটটা নাগাদ সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের সুবেদার মেজর রবিন চট্টরাজ ডাইনিং মেস থেকে বেরিয়ে ছাউনির দিকে পা বাড়াতেই হেড কনস্টেবল এসে গোড়ালি ঠুকল, “কমান্ডেন্টসাব নে অভি কে অভি বুলায়া সাব জি।”

চোখদু’টো একমুহূর্ত সরু করেই ছেড়ে দিলেন রবিন। একটু ভেবে নিয়েই দু’দিকে ঘাড় দুলিয়ে বললেন, “ঠিক হ্যায়।”

ভারি পর্দাটা সরিয়ে পা বাড়াতেই কমান্ডেন্ট সায়েবের গুরু-গম্ভীর অভ্যর্থনা কানে এল, “আইয়ে মেজর। প্লিজ বি সিটেড।”

একটু অপেক্ষা করে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন, “ওয়্যারলেস পে মেসেজ আয়া হ্যায় অভি, রাতকো অপারেশন কে লিয়ে নিকল না হ্যায়। আপকো দস জওয়ান সিলেক্ট করকে বারাহ বজনে সে পহেলে হি পুলিস হেডকোয়ার্টার পহুঁচ না হোগা। অ্যান্ড দিস ইজ হাইলি কনফিডেনসিয়াল। ইউ আর ওয়েল পারসিভড অফ দিস আই বিলিভ। ইয়ে লিজিয়ে ফ্যাক্স কি কপি।”

মেজর ঠোঁটে ক্লিষ্ট হাসি ফুটিয়ে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ! ম্যায় ফির নিকলতা হুঁ স্যর। কল সুবহ মোলাকাত হোগি অগর…”

“আরে নহি নহি মেজর! জরুর মুলাকাত হোগি। হোগি কিঁউ নহি?” একচিলতে মলিন হাসি খেলে গেল কমান্ডেন্টের ইয়া গোঁফের আড়ালে।

সাদা পোশাকে এগারোজন জওয়ান ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসতেই রাতের অন্ধকারের বুক চিরে একটা আর্মস বোঝাই ট্র্যাভেলার গাড়ি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে দিয়ে গেল তাদের গোপনে। ওখান থেকে সঙ্গ নিল বাছাই করা আরও জনাকুড়ি সশস্ত্র সৈনিক। সেখান থেকে কুড়ি মিনিটের ভেতর হীরাপুর থানার উদ্দেশ্যে যাত্রা। রাস্তায় টীমে যোগ দেবে ষ্টেট রাইফেলসের কম্যান্ডোবাহিনী। গোটা টিমের দায়িত্বে রয়েছেন মেজর রবিন চট্টরাজ নিজে। রোড ম্যাপ তৈরি করে পথ দেখাবে হীরাপুর থানার পুলিশ।

          বছর খানেক হল ত্রিপুরাতে পোস্টিং হয়েছে রবিন চট্টরাজদের ব্যাটেলিয়নটার। এখানে আসা ইস্তক আরও দু’বার হয়ে গেছে এধরনের অপারেশন। দু’বারই মেজরকে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে। সাফল্যও এসেছে আশানুরূপই। এমনি করেই হঠাৎ ঊর্ধ্বতনের কাছে অর্ডার আসে আর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মিনিট চল্লিশ পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই যার যার আর্মস নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় রক্তমাংসের জীবনটাকে ক্যাম্পে ফেলে রেখে। ফিরে আসা অবধি শুধু রোবটের মতো কাজ করে যেতে হয়। তখন বিস্মৃতির অন্ধকারে বেমালুম তলিয়ে যায় পরিবার পরিজনদের মুখ, নিজের প্রাণের মায়া। নিজের পায়ে ফিরে আসার কোনও গ্যারান্টি থাকে না একদিনও অবশ্য। অনেকেই চার কাঁধে ভর করে ফিরে আসেন। কাজটাই এরকম।

আলাদা একটা রাজ্য গঠন করে সম্পূর্ণ শাসনভার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে বর্তমানে কমপক্ষে তিনটি বৈরীদল নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ত্রিপুরায়। মাঝেমাঝে তাদের অ্যাক্টিভিটি এতটাই চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় যে তখন স্পেশাল ফোর্সের ওপর দায়িত্ব পড়ে ওই বিশেষ দলগুলোকে দমন করার। এতে অবশ্য রাজ্যের নিজস্ব ফোর্সেরও বড়োসড়ো ভূমিকা থাকে। কখনও দু’টো আলাদা ফোর্স, কখনও বা তিন চারটে ফোর্স একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে পড়ে বৈরী বিরোধী অভিযানে। কখনও একদিনের কখনও বা চার-পাঁচ কিংবা ছয়দিনের অপারেশন প্ল্যান করতে হয় প্রয়োজন আর গোপন খবরের ভিত্তিতে। সেনাবাহিনীর এধরনের অভিযানকে বলা হয় ‘সিনার্জি অপারেশন’। এ কাজের জন্যেই মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানিয়ে মেজরদের আনিয়েছেন এ রাজ্যে। আর যারা এসেছেন তারা সবাই বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জওয়ান।

          যে তিনটে বৈরীদল বর্তমানে ত্রিপুরাতে নিজেদের সদম্ভ উপস্থিতি নিরন্তর ঘোষণা করে চলেছে তার মধ্যে তুইপ্রা লিবারেশন ফ্রন্ট অতিমাত্রায় সক্রিয়। এই ফ্রন্টের চীফ দিলমণি রাঙ্খল। মেঘালয়ের কনভেন্টের ছাত্র, পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার দিলমণি তিল তিল করে গড়ে তুলেছে নিজের হাতে টিএলএফ-কে। সুকৌশলী নেতৃত্ব, চাতুর্যের ক্ষিপ্রতা আর হিংস্র মনোভাবের কারণে অন্যসব দলের সুপ্রিমোদের থেকে অনেক এগিয়ে সে। আর দিলমণির তুইপ্রা লিবারেশন ফ্রন্টেরই আজ একটা বড়োসড়ো মিটিং চলবে রাত দু’টো থেকে কালাঝাড়ি পাহাড়ের এক বিশেষ জায়গায়। নেতৃত্বস্থানীয়রা প্রায় সবাই আসছে বলে খবর আছে বিশ্বস্তসূত্রে।

          রাত পৌনে বারোটা নাগাদ প্রায় নিঃশব্দে ‘সিনার্জি অপারেশন’ টীমের তিনটে আলাদা আলাদা অংশ ঢুকে গেল হীরাপুর থানার গোপন কুঠুরিতে। বড়োসড়ো একটা গোল টেবিল ঘিরে জড়ো হল সবাই। কালাঝাড়ির একটা রোড ম্যাপ বিছিয়ে রাখা আছে টেবিলটাতে। কম্যান্ডোবাহিনীর ক্যাপ্টেন জানতে চাইলেন, “প্ল্যান কী হবে মেজর?”

মেজর চট্টরাজ জবাব দিলেন, “স্পটের দুই কিলোমিটার আগে গোটা টীমটা ছয়টা উপদলে ভাগ হয়ে কর্ডন করে এগোবে। তারপর অবস্থা বুঝে সারেন্ডার ডিম্যান্ড। দশমিনিট অপেক্ষা, সাড়া না পেলে চার্জ – আন্ডার নী। আই রিপিট, ছয়টা দল একসাথে তাল রেখে ঘেরাও করবে গোটা স্পটটা।”

“যেহেতু ওপেন ফরেস্ট রেঞ্জে নয়, মিটিংটা স্থানীয় চৌধুরী অর্থাৎ গ্রামের মোড়লের খামারবাড়িতে অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে তাই ও পক্ষে খুব একটা বড়োসড়ো পাল্টা জবাবের সুযোগ থাকবে বলে মনে হয় না মেজর।” হীরাপুর থানার ওসি কথা বলতেই সবাই দৃষ্টি তার ওপর গিয়ে পড়ল।

“উঁহু, অত ক্যাজুয়েলি নেওয়া যাবে না বড়বাবু। দিলমণি শেয়ালের মতো চালাক আর চিতার মতো ক্ষিপ্র। মনে রাখবেন ওদের কনট্যাক্টস, ওয়েপনস আমাদের থেকে বেশ এগিয়ে। তাছাড়া ওরা ভূমিপুত্র, পাহাড়-পর্বতের প্রত্যেকটা বালুকণা নিজের হাতের তালুর মতো চেনে। এরা জন্ম থেকেই গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী হয়। তাই আমাদের চলন হবে বেড়ালের মতো আর সিগন্যালের সাথে সাথেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে বাঘের মতো। ওকে গাইজ, এনি কোশ্চেন?”

সমস্বরে ‘নো স্যার’ আওয়াজ হতেই মেজর বললেন, “ভেরি গুড! বেস্ট অফ লাক অ্যান্ড লেটস স্টার্ট।”

কালাঝাড়ি পাহাড়টাকে আকাশ থেকে বড়ো সুন্দর দেখায়। পাহাড়টা এতটাই ঘন গাছপালায় ঢাকা যে দূর থেকে এটাকে হালকা কুয়াশায় মোড়া গাঢ় নীল রঙের বলেই মনে হয়। আর এই মরসুমে হঠাৎ এক পশলা তুমুল বৃষ্টির পর প্রখর সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণে গাছের পাতাগুলোয় বসে থাকা জলবিন্দুগুলো যেন হিরেকুচির মতো আবছা ঝিকিমিকি করে। একবার হেলিকপ্টার থেকে এই দৃশ্যটা দেখে ভুলতে পারেননি মেজর চট্টরাজ। আজকের অপারেশনটার তিনি নাম দিলেন ‘ব্লু ডায়মন্ড’।

মেইন প্ল্যানের পাশাপাশি মেজর আরেকটা ব্যাক-আপ প্ল্যান তৈরি করে গোটা টীমকে ব্রিফিং করে বেরিয়ে পড়লেন সবাইকে নিয়ে। গাড়ি ছেড়ে দিতে হবে স্পট থেকে কমপক্ষে ছয়-সাত কিলোমিটার আগেই। তারপর উঁচু নিচু পাথর-কাঁকর, ঢাল বেয়ে, খাড়াই চড়ে, ছড়া পেরিয়ে, গাছের ডাল ধরে ঝুলে এবড়োখেবড়ো পথ পাড়ি দিতে হবে ঘড়ির কাঁটায় মুহূর্ত মিলিয়ে।

হীরাপুর থেকে বেরিয়ে প্ল্যান অনুসারে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি ছেড়ে দিয়ে ছয়টা উপদলে ভাগ হয়ে চারদিক থেকে এগোতে লাগল মেজরের দল। কিন্তু বিধি বাম। খানিক এগোতেই ক্ক-কড়াৎ শব্দে চারদিক কাঁপিয়ে বিপজ্জনকভাবে বিদ্যুৎ খেলে গেল বেশ কয়েকটা। বিদ্যুতের ঝলকানির পেছনে পেছনে নামল ঝেঁপে বৃষ্টি। পাহাড়ের বৃষ্টি বড়ো ভয়ানক হয়। একটু অসাবধান হলেই পা হড়কে গিয়ে হয় কোনও গাছের ডালে ঝুলে থাকতে হবে বা দুর্বার কোনও পাহাড়ি ছড়ার তীব্র স্রোতে আছড়ে পড়ে ভেসে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। মেজর প্রমাদ গুনলেন। তিনবারের অপারেশনের মধ্যে এমন অবস্থা এই প্রথম। ওয়্যারলেসে চাপা স্বরে সবার মনোবল চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করতে করতে এগোতে লাগলেন তিনি শ্বাপদের মতো লঘুপায়ে। থেমে থেমে মেঘের গর্জন, পরক্ষণেই কালো আকাশের বুক চিরে আঁকাবাঁকা রুপোলী চিড়িক আর অবিরাম বৃষ্টির বুনো শব্দ ছাড়া চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। ঝিঁঝিঁগুলোও ডাকতে ভুলে গেছে বৃষ্টির তোড়ে।

আর বেশি নয়, মাত্র কিলোমিটার খানেক এগিয়ে যেতে পারলেই চৌধুরীপাড়ার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে ‘ব্লু ডায়মন্ড’। সামনে একটা বাঁক পড়ে গলাচাপা নামে। দু’দিকে দু’টো অনুচ্চ টিলা ঘন হয়ে যেন রাস্তাটার গলা চেপে ধরেছে। জায়গাটা পেরোলেই…

না, বাঁকটা পেরোতে হয়নি মেজরদের। কাছাকাছি আসতেই কোত্থেকে আচমকা একঝাঁক উত্তপ্ত গুলি ছুটে এসে অভ্যর্থনা জানাল ‘ব্লু ডায়মন্ড’ টীমকে। নিঝুম পাহাড়ের রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকেও ছুটে এল আরেক ঝাঁক এলোপাথাড়ি গুলি। নিশ্চয়ই দিলমণি অ্যামবুশে বসে আছে আগাম খবর পেয়ে। মাথার ওপর তুমুল ঝড়বৃষ্টি, পায়ের নীচে ঢালু জমির পিচ্ছিল কাদামাটি আর সামনে পেছনে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে নিচু টিলার ওপর বসে থাকা দিলমণির দু’টো হিংস্র সশস্ত্র হায়েনার দল। ব্যাক-আপ প্ল্যান কাজে লাগানোর সুযোগটুকুও পাওয়া গেল না। মুহূর্তে ছত্রখান হয়ে ‘ব্লু ডায়মন্ড’ নিজেদের সুবিধেমতো পজিশন নেওয়ার আগেই কয়েকটা লাশ পড়ে গেল। মেজর বুঝে গেলেন আজ তার দিন নয়। ক্রলিং করে কোনওমতে একটা গাছের গুঁড়ির পেছনে পজিশন নিলেন। ষ্টেট রাইফেলসের কম্যান্ডোরা ততক্ষণে অন্ধকারের সাথে মিশে গেছে নিঃশব্দে। একটু পরেই গাছে গাছে বাদুড়ঝোলা হয়ে গুলি চালাতে শুরু করল তারা ঘন পাতার আড়াল থেকে। অঝোরে বৃষ্টি চলছে। এরই মধ্যে নিশানা তাক করে দু’পক্ষেরই রাইফেল থেকে ট্যাঁ ট্যাঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে অবিরাম। গাছের ওপর থেকে হঠাৎ হঠাৎ জোরালো সার্চ লাইটের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে দিলমণির দলের লোকদের। সুযোগ বুঝে এক এক করে মাটিতে শুইয়ে দিচ্ছে এদের ষ্টেট রাইফেলসের কম্যান্ডোরা।

খানিক পরে ব্লু ডায়মন্ডের তরফে পাল্টা জবাবে একটু ভাটা পড়তেই দিলমণির ছেলেরা একে একে জলপাইরঙা চিতার মতো লাফিয়ে পড়ল টিলার ওপর থেকে। নেমে এসেই ক্ষিপ্রগতিতে কর্ডন করে ফেলল মেজরদের। আর কয়েকজন অটোম্যাটিক কালাশনিকভ উঁচিয়ে লড়ে যাচ্ছে কম্যান্ডোবাহিনীর সাথে দাঁতে দাঁত চেপে। অন্ধকারের নিজস্ব আবছা আলোয় যেন হাড় হিম করা করাল মৃত্যুর একটা পৈশাচিক খেলা চলেছে অনন্তকাল ধরে।

হঠাৎ মেজরের পাশে কোত্থেকে এক লাফে দিলমণি পৌঁছেই ঝাঁঝরা করে দিল মেজরকে কভার করতে থাকা সিনিয়র ইনস্পেকটর রঘুনাথ সিংকে। ঘাড় বাঁকিয়ে মেজরের দিকে একপলক তাকিয়ে বীভৎস হাসি ছুঁড়ে দিল একটা। মেজর সভয়ে দেখলেন দিলমণির পেছন থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে একটা কালো কাপড়ে বাঁধা মুখ বন্দুক উঁচিয়ে তাক করেছে তার দিকে। বাঁহাতের তর্জনীর ডগা ট্রিগার ছুঁই ছুঁই। হৃৎপিণ্ডটা গলা কাটা মুরগির মতো লাফাতে শুরু করল হঠাৎ। প্রাণটা হাতে করে মেজর একটা ডিগবাজি খাওয়ার আগেই টের পেলেন ডান কাঁধের মাংসটা যেন পুড়ে যাচ্ছে। নিজের বন্দুকটা তুলে সেকেন্ডের মধ্যেই ঝাঁঝরা করে দিলেন দুশমনের কচি বুকটাকে। মুখের কাপড়টা সরে গিয়ে আকাশের দিকে চোখ উলটে ধপ করে পড়ে গেল প্রায় বছর কুড়ির একটা ছেলে। চকিতে মাথা তুলে তাকাতেই মেজর দেখলেন দিলমণি উধাও হয়ে গেছে কখন। পুরো দলটাই এখন বনবাদাড় ভেঙে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে দৌড়ে পালাচ্ছে কম্যান্ডোদের অতর্কিত আক্রমণে।

দুই হাঁটু উঁচু করে মাথাটা বুকে ঝুলিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছেন পাশে কাত হয়ে শুয়ে থাকা লিবারেশন ফ্রন্টের ছেলেটার মুখের দিকে মেজর রবিন চট্টরাজ। এক হাতে কাঁধটা খামচে ধরে আছেন শক্ত করে। সার্ভিস লাইফে মানুষ মারার হাতেখড়ি হল আজ। তাও বাচ্চা একটা ছেলে। যে নিজেকে ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই কৌশলে তার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে কোনও পিশাচ। আগের দু’টো অপারেশনের মধ্যে একটাতে কোনও ক্যাজুয়েলটি ছিল না। গুলি খরচ না করেই সবাইকে সারেন্ডার করাতে পেরেছিলেন সহজেই। আর দ্বিতীয়বার তো স্পটে পৌঁছার আগেই পালিয়েছিল সব। শূন্য হাতে ফিরে এসেছিলেন ক্যাম্পে সেবার। আজ তৃতীয়বারে একেবারে যেন ষোলকলা পূর্ণ হল।

।।চার।।

ইনস্পেক্টর রাউতের ডায়েরি

থানার কেস ডায়েরি নয়, এটা আমার ব্যক্তিগত। রিটায়ারমেন্টের আর বছর দু’য়েক মাত্র বাকি। পঁয়ত্রিশ বছরের এই বিশাল কর্মজীবনে এরকম রহস্যময় কেস আর দু’টো পাইনি। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে পুরী থানা মারফৎ আমাদের খণ্ডগিরি থানায় একটা মিসিং ডায়েরি করা হয় পুরীর স্বর্গদ্বারের এক বিখ্যাত হোটেলের তরফে। রবিন চট্টরাজ নামে কলকাতার একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর দুপুরের পর খণ্ডগিরিতে ঘুরতে এসে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। ভাইপো সোমনাথ চট্টরাজ তার সাথে ছিলেন। বিনা পূর্বাভাসে হঠাৎ এক ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়লে দু’জনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় এবং প্রবল ঝড়জলের মধ্যেই সোমনাথ তার কাকাকে ঘণ্টা দু’য়েক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে পুরী ফিরে যান এবং হোটেলের ম্যানেজারকে জানান। ম্যানেজার তখন স্থানীয় থানা মারফৎ আমাদের খবর পাঠান রাত ন’টার পর। তখন আমি অন্য জায়গায় রেইডে ব্যস্ত।

অন ডিউটি অফিসার হিসেবে জনাপাঁচেক কনস্টেবল সঙ্গে করে ভোর চারটে নাগাদ আমি খণ্ডগিরির দুই কিলোমিটার এরিয়ার মধ্যে প্রত্যেকটা আনাচকানাচ তন্নতন্ন করে খোঁজা শুরু করি। বিশেষ করে খণ্ডগিরির যে চাতালটায় রবিনবাবুকে শেষ দেখা গিয়েছিল সেই এলাকায় চিরুনি তল্লাশি চালাই। কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া তো দূর, ভদ্রলোকের একপাটি জুতোর সন্ধানও মেলেনি। ক্লান্ত শরীর আর বিধ্বস্ত মনে সকাল আটটা নাগাদ থানার কাছাকাছি পৌঁছতেই থানা থেকে ওয়্যারলেসে খবর পেলাম যে পুরীর মেরিন ড্রাইভে একটা লাশ পাওয়া গেছে।

কোনওমতে স্নান খাওয়া সেরেই ছুটলাম পুরী থানায়। সেখান থেকে দুই সাব-ইনস্পেকটরসহ মেরিন ড্রাইভে এসে হাজির হই। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, জেলেরা বঙ্গোপসাগরের প্রায় কিলোমিটার দু’য়েক ভেতরে মানুষের মতো কিছু একটা ভাসতে দেখে তাদের ট্রলারে তুলে পাড়ে এনে নামায়।

ইতিমধ্যে সোমনাথের হোটেলের ম্যানেজার আমার সাথে দেখা করতে এলে তাকে আর দু’য়েকজন সার্ভিস বয়কে দিয়ে সনাক্ত করাই। সবাই একপলকেই চিনতে পারল যে মৃত ব্যক্তি সোমনাথ। রবিন চট্টরাজ নন। হোটেলের তরফে সোমনাথের বাড়ির নম্বরে খবর দেওয়া হয়েছে। এই হোটেলে বোর্ডারদের ব্যক্তিগত ফোন নম্বরের পাশাপাশি তার বাড়ির নম্বরও লিখে দিতে হয়। লাশ মর্গে রওনা করিয়ে দিয়ে ধন্দে পড়ে গেলাম। মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে কাকার নামে। অথচ লাশ মিলল ভাইপোর। এ কোন রহস্য মুখ ঢেকে এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে! দেখলাম, পুরী থানারও আমার মতোই ঘোলাটে অবস্থা। চট করে কিছুই বুঝতে পারছে না কেউই।

হোটেল ম্যানেজার পেশাদার আর বুদ্ধিমান লোক। সকাল সকাল বেড-টি নিয়ে বেয়ারা যখন ফিরে গিয়ে জানাল যে রুমে সোমনাথকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না অথচ দরজা খোলা রয়েছে, সেই মুহূর্তেই ম্যানেজার রুমটা তালাবন্ধ করে দেন। গতকাল থেকে একের পর এক অঘটন ঘটে চলেছে তার হোটেলকে কেন্দ্র করে। আর ব্যাপারটা যেহেতু পুলিশে চলে গেছে তাই উপস্থিত বুদ্ধিতে যা মনে হয়েছে তাই করেছেন ভদ্রলোক।

তালা খুলে সোমনাথের রুম তোলপাড় করেও তেমন কিছুই পেলাম না যা আমার তদন্তে বিশেষ আলো ফেলতে পারে। শেষে ওর লাগেজের গোপন পকেটে হোটেল ম্যানেজারের নামে একটা চিঠি খুঁজে পেলেন আমার পুরী থানার সহকর্মী। উনি বাঙালি হওয়ার সুবাদে চিঠিটা খুলে পড়া শেষ করতেই ক্লান্ত শরীরটার সবটুকু রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল আমার। চিঠিটা নীচে উল্লেখ করলাম।

ম্যানেজারবাবু,

আপনি নিজে বাঙালি বলে চিঠিটা বাংলাতেই লিখছি। এই চিঠি যদি যথাসময়ে হাতে পান তখন হয়তো অনেক কিছুই ঘটে গিয়ে থাকবে। কাকা ফেরেননি। ফেরাও কথাও ছিল না প্রথমে। কিন্তু সেদিন সামুদ্রিক মাছ খেয়ে উনি অসুস্থ হওয়ার পর তাঁর চোখে যে বাঁচার আর্তিটুকু দেখেছিলাম সেটা আমাকে খাদের কিনারা থেকে টেনে এনেছিল। সারারাত ধরে নিজের সাথে অনেক দড়ি টানাটানি শেষে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিলাম। তবে শেষরক্ষা বোধহয় হয়নি। সবই আমার লোভের ফল। একটা খুনি রাক্ষস আমায় গিলে খেয়েছিল। আমি এই কলঙ্ক মাথায় নিয়ে আর ফিরে যেতে পারব না। তাই স্থির করেছি নিজের হাতেই নিজেকে শাস্তি দেব। যদি কিছু পাপক্ষালন হয়।

আর একটা বিশেষ কথা, আপনি আপনার কাস্টমার সার্ভিসের এই ব্যবসা সম্পর্কে নিশ্চয়ই খুব ভালোভাবেই অবগত আছেন। ছোট্ট একটা দুর্নাম বা বদনাম হোটেল ব্যবসাকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে পারে। তাই আপনার হোটেলের ভালোমন্দ সম্পূর্ণভাবে আপনার নিজের হাতেই ন্যস্ত। আপনার সবধরনের কর্মচারীর দায়দায়িত্বও যে আপনারই হাতে তা বলা বাহুল্য। আশা করছি, হঠকারী সিদ্ধান্তের বশীভূত হয়ে এমন কিছু করবেন না যাতে আপনার হোটেলের বিন্দুমাত্রও ক্ষতি হয়।

কেসাংকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাবেন। ও আজ দুপুরে কন্ডাক্টেড ট্যুরে সূর্যমন্দিরের পাশের এক জলার ধার থেকে কাকাকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে এনেছিল। সারাদিন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থেকে অনেক সাহায্য করেছিল।

আর কখনও হয়তো দেখা হবে না আমাদের। নমস্কার জানবেন।

  • সোমনাথ চট্টরাজ

মনে মনে ঠিক করলাম, খুব হিসেব করে সন্তর্পণে এই কেসে এগোতে হবে। একটা ভুল পদক্ষেপ গোটা তদন্তকে বিভ্রান্তির পথে চালিত করার ক্ষমতা রাখে। সার্ভিস বয় কেসাং ভুটিয়াকে একদিন পুরী থানায় তুলে এনেছিলাম। ওয়েস্ট বেঙ্গলের কালিম্পঙের ছেলে। সে সোমনাথের রুমের দায়িত্বে ছিল। তেমন কিছু লাভ হয়নি। ছেলেটা হয় অত্যন্ত চালাক, নয় পুরোপুরিই নির্দোষ। ওকে অন্যভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে। থানার বিনা অনুমতিতে ওকে পুরীর বাইরে যেতে বারণ করেছিলাম। দিন পাঁচেক পর খবর পেলাম পাখি শেকল কেটে উড়ে গেছে। ম্যানেজারকে চাপ দিয়ে জানতে পারলাম, ঘটনার আগেরদিন বিজু নামে রামেশ্বরমের একটা ছেলেও ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে। কেসাংয়ের পালানো আর বিজুর বাড়ি যাওয়ার মধ্যে কোনও যোগসূত্র রয়েছে কি না এখনও যাচাই করার সুযোগ পাইনি। আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি রবিন চট্টরাজের বর্তমান অবস্থানের একটা খবর যোগাড় করতে। পুরো ঘটনাটায় বেশ কয়েকটা খটকা রয়ে গেছে –

একঃ খণ্ডগিরিতে যাই ঘটুক না কেন, সোমনাথ লোকাল থানায় প্রথমে না জানিয়ে সোজা পুরী চলে গেলেন কেন?

দুইঃ যদি সোমনাথের মৃত্যুটা খুন হিসেবেই ধরি তবে সোমনাথ হঠাৎ খুন হতে যাবেন কেন? আর যদি আত্মহত্যা হয় তাহলেও তো এর পেছনে নির্দিষ্ট কারণ থাকা চাই।

তিনঃ রবিন চট্টরাজ জীবিত না মৃত এটা এখনও নিশ্চিত নয়। অবশ্য ঘটনার দিন উপরনিচ কিছু একটা হয়ে গেলে এতদিনে লাশ বেরিয়ে পড়ত। যদি জীবিত থাকেন তবে তিনি সামনে আসছেন না কেন? অপহরণ কেস নয়তো?

চারঃ ম্যানেজার আর অন্যান্য স্টাফদের দাবি যে ঘটনার দিন কেসাং হোটেল থেকে বের হয়নি একবারের জন্যেও। তাই যদি সত্যি হয় তবে সোমনাথ আর রবিনবাবুর সাথে সারাদিন আউটিংয়ে লোকটা কে ছিল?

পাঁচঃ সোমনাথ হঠাৎ হোটেল ব্যবসা নিয়ে ম্যানেজারকে অযাচিত উপদেশ দিতে যাবেন কেন? কীসের সিদ্ধান্তের ইঙ্গিত করে গেলেন চিঠিতে?

ও হ্যাঁ, আজ সোমনাথের প্রাথমিক পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে এসেছে। শরীরের কোথাও কোনও স্পট পাওয়া যায়নি। তবে নাক আর কানের ফুটোর অনেক গভীরে রক্ত লেগে ছিল। কিডনি, হার্ট, লিভার আর স্টমাক ফরেনসিকে পাঠানো হয়েছে। পরদিন সোমনাথের বাবা এসেছিলেন ছেলের সৎকার করতে। পুরী থানায় দেখা হয়েছিল আমাদের। আমার দু’হাত চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।

এরই মধ্যে ট্র্যাভেল এজেন্সির গাইড আর বাস ড্রাইভারকে জেরা করেছি। ওরা কিছুই জানে না। আতঙ্কে জবুথবু হয়ে আছে। ঘটনার সময় ওরা প্রায় পাঁচশো মিটার দূরে বাসের মধ্যে বসেছিল দরজা জানালা আটকে সাইক্লোনের দাপট থেকে বাঁচতে। এতটুকু জানা গেল যে, ফেরার সময় রবিন চট্টরাজ আর সোমনাথ চট্টরাজ সে গাড়িতে ফেরেননি। আর কাকা ভাইপোর সাথে তৃতীয় কোনও ব্যক্তির উপস্থিতি ছিল কি না এ ব্যাপারে কোনও সদুত্তর দিতে পারল না।

কাল লাঞ্চ আওয়ারের পর কমিশনার সায়েব ডেকে পাঠিয়ে একটা ফ্যাক্স হাতে তুলে দিলেন। কলকাতা থেকে অভিমন্যু রক্ষিত নামে একজন ইনভেস্টিগেটর আসছেন। আমার কাছে সহায়তা প্রার্থনা করেছেন। তিনি পুলিশের কেউ নন, কিন্তু পুলিশের উপরমহলে নাকি বেশ নামডাক তাঁর। উনি স্বাধীন এবং স্বতন্ত্রভাবে এই কেসের তদন্ত করবেন। আর অনুরোধ করেছেন, আমার তরফে কোনও সাহায্য না পেলেও কোনও বাধা যেন না আসে।

কাল একবার পুরীর হোটেলে যাব ফের।

।।পাঁচ।।

uponyasoperationsynergy06

ভুটানের এক দুর্গম পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কেটে যত্ন করে তৈরি করা অতি সাধারণ একটা মনাস্ট্রি। উলটোদিকের পাহাড়টার চুড়োয় গিয়ে দাঁড়িয়ে এদিকপানে তাকালে মনে হবে এক মা যেন তাঁর প্রিয় সন্তানকে কোলে করে বসে আছে। এখানে লামাদের সংখ্যা অতি নগণ্য, চার পাঁচজনের বেশি নয়। আসলে এই গোম্পা লামাদের উচ্চ পর্যায়ের সাধনার স্থল। এখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। প্রবেশদ্বারেই স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে সেকথা। তবুও শীতবস্ত্রে আপাদমস্তক ঢাকা এক আগন্তুক ভেতরে ঢুকতে চাইছেন। কিন্তু দ্বাররক্ষী কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দেবে না। শেষে আগন্তুকের মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে কী একটা বেরিয়ে আসতেই সচকিত দ্বাররক্ষী রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল গোম্পার ভেতরে এক অতি গোপন জায়গায়।

জায়গাটাকে একটা সুপরিসর কুঠুরি বলা ভালো। আলো আর বাতাস ঢোকার একটাই মাত্র রাস্তা – তাও সুউচ্চ পাথরের ছাদের ঠিক নীচেই। গোলাকার সেই ফাঁক দিয়ে একফালি আলো এসে ছোটখাটো একটা বুদ্ধমূর্তির মাথায় পড়েছে স্পট লাইটের মতো। ধূপ-ধুনোর একটা ঘোর লাগা সুগন্ধে ঝিম ধরে আছে সারাটা ঘর। ধোঁয়াগুলো এঁকেবেঁকে ওই একফালি আলোয় ভর করে যেন মিলিয়ে যেতে চাইছে বাইরের হাওয়ায়। ঘরটার চারদিকে ছায়া ছায়া অন্ধকার। শুভ্র চাদরে ঢাকা এক তক্তপোষে নিশ্চল বসে আছেন আলখাল্লা জড়ানো মুণ্ডিত মস্তকের এক অবয়ব।

“শুভমস্তু, আপনার ডানদিকে একটা আসন পাতা আছে। ওতে বসুন।” গমগমে কণ্ঠস্বর থেকে শব্দগুলো ছাড়া পেয়ে যেন চারদিকের পাথরের অমসৃণ দেওয়ালগুলোতে বারবার ধাক্কা দিতে লাগল।

“আপনিই কি…”

“হ্যাঁ, আমিই কথা বলেছিলাম সেদিন। আপনাকে আসতে অনুরোধ করেছিলাম। আসলে আমার এক মুহূর্তের জন্যেও এখান থেকে বেরোবার উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে…”

“না না, এতে আমার কিছু অসুবিধে হয়নি। তাছাড়া জীবনে প্রথমবার এমন একটা জায়গায় আসতে পেরে ভালোই লাগছে বরং। তবে, যার হয়ে কাজটা করব বলে ঠিক করেছি তাঁর পরিচয়, নিদেনপক্ষে নামটা অন্তত…”

ওপাশ থেকে জবাব এল, “নিশ্চয়ই। আমি তাশি লামা। গোম্পার বাইরে একমাত্র আপনিই আমার পরিচয়টা জানলেন। বিশ্বাস করি…”

লামার কথা শেষে হওয়ার আগেই আগন্তুকের দৃঢ় কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “নিশ্চয়ই। পেশাগতভাবে তা গোপন রাখতে আমি দায়বদ্ধ।”

লামা স্মিত হেসে বললেন, “নিশ্চিন্ত হলাম। আপনি যদি জিনিসটা খুঁজে পান তবে এই পাহাড়ের নীচে গাঁয়ের একটা গোপন ঠিকানায় ওটা পৌঁছাবার ব্যবস্থাটা কিন্তু আপনাকেই করতে হবে। আমি ঠিকানাটা পরে ফোন করে বা লোক মারফৎ আপনাকে…”

“তার আগে সবকিছু আমি গোড়া থেকে শুনতে চাই আপনার মুখে।”

“বেশ, এতে যদি জিনিসটা খুঁজে পেতে সুবিধে হয় আপনার তবে তাই হোক।”

তাশি লামা একটু সময় নিলেন নিজেকে গুছিয়ে নিতে। আবছা অন্ধকার তাঁর চোখমুখ আড়াল করে রেখেছে। কিন্তু আগন্তুকের দিব্যদৃষ্টি থাকলে নিশ্চয়ই দেখতে পেতেন কেমন ধীরে ধীরে এক অব্যক্ত যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে লামার গোটা চেহারায়। উদাসীন চোখের মণি কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।

“সালটা উনিশশো আটান্ন কি ঊনষাট হবে। এতদিন পর সঠিকভাবে মনে করতে পারছি না। এক দুর্যোগের রাতের সুযোগ নিয়ে আমি আর মহামান্য রিনপুচে রওনা হলাম এক অজ্ঞাতবাসে। ঠিকানা একটা ছিল বটে, তবে এতটাই অস্পষ্ট ছিল যে একে অজ্ঞাতই বলা চলে। আমাদের সাথে শুধু মোটা পলিথিন জড়ানো কেজি চল্লিশের একটা কাঠের বাক্স। উদ্দেশ্য তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বের গিরি-কন্দরের আড়ালের এক গোম্পায় আশ্রয় নেওয়া। কারণ, সেই পঞ্চাশ সাল থেকে চীনা লালবাহিনী যে অকথ্য অত্যাচার তিব্বতিদের ওপর বিশেষত লামাদের টার্গেট করে শুরু করেছিল তাতে ওই বাক্সটা রক্ষা করার আর কোনও উপায় ছিল না।

“আমরা কী করে যে ইয়ারংলু নদীর ধার অবধি পৌঁছেছিলাম তা একমাত্র তথাগতই জানেন। নদীটা তখন দস্তুরমতো জমে গেছে। জল স্পর্শ করা মাত্রই হাত পাগুলো কামড়ে ধরে কেটে নিয়ে যাচ্ছে যেন। তবে কোনওমতে এটা পেরোতে পারলেই আমরা সুরক্ষিত প্রায়। অন্তত লালসৈন্যর হাতের বাইরে চলে যাব। তারপর কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপারে একবার পৌঁছে যেতে পারলে একেবারে নিশ্চিন্ত। কাছাকাছির মধ্যে সবচেয়ে দুর্গম একটা জায়গা বেছে নিয়ে একটু বিশ্রাম করে আমরা নদী পেরোনোর সহজতর রাস্তাটা খুঁজতে লাগলাম। বেশিক্ষণ হয়নি, আধঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ধরা পড়ে গেলাম ওদের হাতে। একটা অপেক্ষাকৃত সমতল জায়গায় পৌঁছতেই অন্ধকার ফুঁড়ে মূর্তিমান দৈত্যের মতো ঘিরে ধরল আমাদের ওরা। এত কষ্ট, এত আত্মপীড়ন সব ইয়ারংলুতেই বিসর্জিত হল।”

আগন্তুক একটু নড়েচড়ে বসলেন। জিগ্যেস করলেন, “এরপর?”

“এরপর চলল জেরা, জিজ্ঞাসাবাদ আর শারীরিক অত্যাচার। ওদের ওই বাক্সটা চাই।”

“বাক্সটা তবে আপনাদের সঙ্গে ছিল না তখন?”

“না, আমরা আগেই ওটা কিছুদূরে মানে যেখানে খানিক বিশ্রাম নিয়েছিলাম সেখানে অনেক কষ্টে নদীতে নেমে পাথর বেঁধে ডুবিয়ে রেখে এসেছিলাম। যাতে নদী পেরোনোর সুবিধেজনক একটা জায়গা পেলেই ওটা আবার তুলে নিয়ে পেরিয়ে যেতে পারি। বড়ো একটা ডুবন্ত পাথরের খাঁজে আটকে রাখা ছিল বাক্সটা। খুঁজে পেতে অসুবিধে যাতে না হয়।

“লালবাহিনী অনেক চেষ্টা করেও যখন বাক্সের হদিস আমাদের মুখ থেকে বের করতে পারছিল না তখন আস্তে আস্তে চোখমুখের ভাষা পালটে যেতে লাগল ওদের। আর ঠিক সেই মুহূর্তে মহামান্য রিনপুচের মুখ থেকে ছিটকে আসা অমোঘ আদেশ পালন করতে আমায় প্রাণ হাতে করে পালিয়ে যেতে হল পাহাড়ের দিকে। ওদের হাত আমার আলখাল্লাটার একটুকরো কাপড় পর্যন্ত পৌঁছেছিল মাত্র। কবজা করতে পারেনি। অবসন্ন শরীরে এই শক্তি আমার কোত্থেকে এসেছিল জানি না, তবে গাছপালা আর পাথর আড়াল করে দৌড়তে দৌড়তে পেছনে গুলির আওয়াজ কানে আসছিল একের পর এক। সারা পৃথিবী যেন কেঁপে উঠছিল একেকটা নৃশংস আওয়াজে। একসময় টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম মুখ থুবড়ে। তারপর গড়াতে গড়াতে কোথায় গিয়ে যে ঠেকেছিলাম তা আর মনে নেই। পরদিন ভোরের আলো চোখে পড়তেই দেখলাম এক অন্ধকার গুহায় শুয়ে আছি আমি। পাথরের দেওয়াল বেয়ে নেমে আসছে চিকচিকে জল অবিরাম। চারদিন অভুক্ত অসুস্থ শরীরে শুধু সেই জল খেয়ে কাটিয়ে শেষে বাইরে বেরিয়ে এলাম এক সন্ধের মুখে।”

“ওরা খুঁজে পায়নি তাহলে!”

“না, তবে খুঁজে পাওয়াটা অসাধ্য কিছু ছিল না। ভগবান বুদ্ধের ইচ্ছে।”

“আর মহামান্য রিনপুচে? তাঁর কী হল?”

“পরে জেনেছি তিনদিন টানা অত্যাচার চালিয়েছিল ওরা তাঁর ওপর। শেষে অসুস্থ শরীরে চিকিৎসার অভাবে ভগবানের শরণে চলে যান তিনি।”

“আপনি?”

“আমি জ্বরের তাড়সে চারদিন পর বেরিয়ে রাতের অন্ধকারে উলটো পথে একটা ছোট্ট গাঁয়ে নেমে এলাম টলোমলো পায়ে। এক বিশ্বস্ত গৃহস্থের আশ্রয়ে আরও দিন সাতেক কাটিয়ে শেষে ফিরে গেলাম ইয়ারংলু নদীর সেই নির্দিষ্ট জায়গায় যেখানে বাক্সটা লুকিয়ে রাখা ছিল। নাহ, বাক্সটা খুঁজে পায়নি ওরা। এতটাই উদ্বিগ্ন ছিলাম যে কখন পেছনে ফেউ লেগেছে টেরও পাইনি। ফেউ অবশ্য সেই প্রথম রাতে মঠ থেকেই লেগেছিল নিশ্চয়ই, দু’জনের কেউই বুঝতে পারিনি সেদিন। প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে নদী পেরিয়ে পার করলাম তিব্বতের সীমানা। জল খেয়ে বাক্সটা ওজনে দ্বিগুণ হয়ে গেছে ততদিনে। কাঁধে তুলতে না পেরে আলখাল্লা খুলে আংটায় বেঁধে হিঁচড়ে নিয়ে চললাম।”

এই পর্যন্ত বলে তাশি লামা চুপ করে গেলেন আচমকা। আগন্তুকও অপেক্ষা করতে লাগলেন। লামা আবার বলতে শুরু করলেন।

uponyasoperationsunergy02“উদভ্রান্তের মতো খুঁজতে খুঁজতে শেষে এক ভোরে পৌঁছলাম সেই আশ্রয়ে, লাচেন মনাস্ট্রি। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ডান পাটা তখন প্রায় অকেজো। আঙুলগুলোসহ পায়ের পাতায় গ্যাংরিন ধরে যাবার উপক্রম। কোনওরকমে ভাগ্যের জোরে রক্ষা পেলাম গোম্পাতে সময়মতো চিকিৎসা শুরু হওয়ায়।”

“মানে? এবার কোনদিক থেকে আক্রমণ এল?”

“ওই যে, ফেউ! শেষ উৎরাইটার মাঝামাঝি হঠাৎ পেছন থেকে নির্ভুল নিশানায় একটা কুকরির বেশ অর্ধেকটা গেঁথে গেল হাঁটুর নীচের কাফ মাসলে। সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল একটা। ফিরে তাকাতেই হিংসার আগুনে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা দু’টো চোখ নিয়ে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক যমদূত।”

“চেনা গিয়েছিল?”

“হুম। তিব্বতের গোম্পায় যাকে আমার পরেই বিশ্বাস করতেন মহামান্য রিনপুচে। রক্ষা করতে পারলাম না সেই পবিত্র বাক্স। পারলাম না পূরণ করতে মহামান্য রিনপুচের শেষ ইচ্ছা আজও। অতিকষ্টে প্রাণটুকু হাতে করে দিন পাঁচেক পরে লাচেন অবধি পৌঁছতে পেরেছিলাম এক ভোরে। যথেষ্ট রক্ত সরবরাহ না থাকায় পায়ের নীচের অংশটা তখন পুরোপুরি অবশ হয়ে গেছে। আলখাল্লা ছিঁড়ে যতটুকু কষে বাঁধা যায় বেঁধে রেখেছিলাম হাঁটুর নীচে রক্তপাত বন্ধ করার জন্যে।”

।।ছয়।।

খণ্ডগিরি থানায় ইনস্পেকটর রাউতের সামনে এই মুহূর্তে যে মানুষটি বসে আছেন তাকে দেখতে গড়পড়তা সিভিলিয়ানের মতো মনে হয় না। বছর চল্লিশেক বয়স। ব্যায়ামপুষ্ট ঋজু শরীর। লম্বায় ছ’ফুটের ওদিক ছাড়া এদিকে নয়। মাথায় ছোটো করে ছাঁটা চুল। নাকের নীচে বেশ পুরুষ্টু একটা গোঁফ। চোখে ভয়ংকর অন্তর্ভেদী হিমশীতল দৃষ্টি।

ইনস্পেকটর রাউতের ডায়েরির শেষ লাইনটা পড়ে ফেরত দিলেন অভিমন্যু। চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে মন্তব্য করলেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং! তবে একটা জিনিস মিস করে গেছেন মিঃ রাউত।”

রাউত ভুরু তুলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই অভিমন্যু বললেন, “প্রত্যেকটা সাসপেক্ট আর রিলেটেড লোকগুলোর ডিটেলিংটা করা থাকলে অনেকটা এগিয়ে যেতুম হোমওয়ার্কে। এই যেমন, লোকটা দেখতে কেমন, আপনার অভিজ্ঞ চোখে স্বাভাবিক অস্বাভাবিক কী কী খুঁটিনাটি ধরা পড়েছে কথা বলে, বিশেষ কোনও অভ্যাস বা ঘটনা – এসব আর কী। নেভার মাইন্ড, আয়াম ভেরি গ্রেটফুল টু ইউ ফর এলাউইং মি উইদাউট এনি কাইন্ড অফ কুয়েরি অর হেজিটেশন টু ইনভেস্টিগেট দ্য কেস। থ্যাঙ্কস মিঃ রাউত! আপনার সাহায্য আমার প্রতি মুহূর্তেই দরকার পড়তে পারে। আশা নয় বিশ্বাস করি যে আপনার কাছে তা পাব। পুরী থানা অবশ্য সবদিকেই কো-অপারেট করার আশ্বাস দিয়েছে।”

রাউত খুশি হয়ে ঘাড় কাত করে হাত বাড়িয়ে দিতেই ফোনটা বেজে উঠল।

“নমস্কার, খণ্ডগিরি পুলিশ স্টেশন… অ্যাঁ? তাই নাকি! এগজ্যাক্টলি ঠিক কোনটায়? বত্রিশ নম্বর? ঠিক আছে, কেউ ছোঁবে না আমি না পৌঁছা পর্যন্ত। কাউকে কাছে ঘেঁষতেও দেবে না।”

অভিমন্যু নীরব চোখে প্রশ্ন করতেই রাউত হড়বড় করে উঠলেন, “আমার এক কনস্টেবলের ফোন ছিল মিঃ রক্ষিত। খণ্ডগিরির বত্রিশ নম্বর কেভে নাকি একটা গলিত লাশ পড়ে আছে। বিকট গন্ধে অস্থির হয়ে পাবলিক আমাদের টহলরত কনস্টেবলকে জানায়।”

“মেজর চট্টরাজ!” অস্ফুটে নামটা উচ্চারণ করেই ব্যস্ত গলায় অভিমন্যু বললেন, “কিন্তু সেদিন তো আপনারা কাউকে… চলুন চলুন, দেরি করবেন না। রাস্তা কতটুকু?”

“দেড় কিলোমিটারের কাছাকাছি। ট্রাফিক থাকলে মিনিট পনেরোর মতো লেগে যাবে।”

বত্রিশ নম্বর গুহার সামনে যেতেই একজন কনস্টেবল এগিয়ে এসে ভেতরে নিয়ে গেল। নাকে রুমাল চেপে অভিমন্যু পকেট হাতড়ে কলকাতা থেকে আনা রবিন চট্টরাজের ছবি বের করে মেলালেন। তারপর সজোরে ঘাড় নেড়ে বললেন, “এ মেজর নয়, মিঃ রাউত। অন্য কেউ।”

“হ্যাঁ স্যার, পাবলিক বলছিল মানে যে কয়েকজন আমাকে খবর দেওয়ার আগেই ঢুকে দেখে এসেছিল, তারা বলছিল ভিখিরি। জৈন মন্দিরের বাইরে বসত। এখানেই হয়তো রাতের আস্তানা গেড়েছিল।”

“অথবা শরীর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় এসে ঢুকেছিল। এবার লাশের ব্যবস্থা করুন মিঃ রাউত। বেওয়ারিশ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।” কথাটা বলে অভিমন্যু ইনস্পেকটর রাউতের দিকে তাকালেন।

থানায় পৌঁছে অভিমন্যু মেজরের একটা ছবি এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নিন, আশেপাশের সবক’টা থানায় পাঠিয়ে দিতে পারেন, যদি আগে না পাঠিয়ে থাকেন। তবে আমার ধারণা উনি উড়িষ্যাতেই নেই, যদি বেঁচে থাকেন অফ কোর্স।”

ইনস্পেকটর রাউত হাত উঁচু করে বললেন, “ও আমি আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি হোটেল থেকে আইডেন্টিটি কার্ডের ছবি স্ক্যান করে। বাট নো রেসপন্স সো ফার।”

দু’দিন পর সকাল সকাল ফোনটা বেজে উঠল ইনস্পেকটর রাউতের।

“সুপ্রভাত মিঃ রাউত! রামেশ্বরম যাবেন নাকি? চলুন দু’দিন ছুটি কাটিয়ে আসি। অনেক ঝামেলা করে দু’টো টিকিটের ব্যবস্থা হয়েছে স্লিপার কোচে। সাড়ে বারোটায় ট্রেন। প্ল্যাটফর্মে দেখা হবে আশা রাখছি, নমস্কার।”

রাউতের জবাবের আগেই ফোনটা কেটে দিলেন অভিমন্যু। ভদ্রলোককে দেখে তো এমন তরল রসিকতা করার মানুষ বলে মনে হয়নি। একটু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে রাউত ফোন লাগালেন উপরমহলে।

বারোটা দশেই অভিমন্যুকে খুঁজে পেয়ে মুচকি হেসে এগিয়ে এলেন রাউত ভুবনেশ্বর রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে।

অ্যাভিয়েটর সানগ্লাসটা কপালের ওপর ঠেলে দিয়ে অভিমন্যু বললেন, “বরাত ভালো মশাই, একটাই ডিরেক্ট যায় সপ্তাহে। আর সেটা আজই।”

“হঠাৎ রামেশ্বরম কেন? বিজু ওখানকার ছেলে জেনেছি, তবে এত তাড়াতাড়ি মানে এখানকার কাজকর্ম না গুছিয়েই… তাছাড়া বিজুর ছুটি নিয়ে বাড়ি যাওয়াটা নেহাত কাকতালীয়ও তো হতে পারে। ইন ফ্যাক্ট সম্ভাবনা খুবই প্রবল বলেই আমার ধারণা।”

“হা হা হা… হতেই পারে, হতেই পারে। আর এই হতে পারে নিয়েই তো আমাদের কাজ মিঃ রাউত। নয় কি?” অভিমন্যু মজার সুরে বললেন। পরমুহূর্তেই হাসিঠাট্টার অভিব্যক্তি মুছে গিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তার। রাউতের মুখে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি ফেলে গলাটা খাদে নামিয়ে বললেন, “এটাও হতে পারে এতদিন শুধু চুনোপুঁটি ধরতেই ব্যস্ত ছিলেন। এবার হয়তো সত্যিকারের রাঘব বোয়াল খেলাতে চলেছেন।”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রাউত একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন অভিমন্যুর মুখের দিকে।

।।সাত।।

রামেশ্বরম রেল স্টেশন থেকে একটা কালো রঙের স্করপিও রামেশ্বরম-ধনুশকোডি রোড ধরে উল্কাবেগে প্রায় উনিশ কিলোমিটার দৌড়ে সোজা নিলয়াম্বরী মন্দিরের সামনে গিয়ে থামল। গাড়ি থেকে নেমে কষ্টিপাথরের মতো নিকষ কালো দেবীর চোখে চোখ রেখে ভক্তিভরে প্রণাম সেরে নিলেন প্রথমেই ইনস্পেকটর রাউত। পাশে লিঙ্গরাজের দেখা মিলতেই এগিয়ে গিয়ে সেখানেও কপাল ঠেকালেন। অভিমন্যুর শ্যেনদৃষ্টি ঘুরতে লাগল চরকির মতো চারদিকে। হঠাৎ মন্দিরের গা ঘেঁষে কোত্থেকে বেরিয়ে এলেন এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী। কপাল, বাহুমূল আর বুকে উজ্জ্বল করে আঁচড়ে রেখেছে uponyassynergy07খড়িমাটি আর হলুদ কুমকুমের তিনটে করে স্পষ্ট রেখা। পরনে গাঢ় রঙের গেরুয়া। মুখে প্রশান্তি ফুটিয়ে ইশারায় অভিমন্যুদের পেছনে পেছনে আসতে বলে ঢুকে গেলেন এক নিভৃত কক্ষে।

“কী সংবাদ, কুট্টি?”

কুট্টি ধড়াচুড়ো সযত্নে খুলে রেখে অভিমন্যুর কানের কাছে মুখ এনে কীসব বলে গেল একশ্বাসে। ইনস্পেকটর রাউত শুধুমাত্র দুয়েকটা শব্দ ছাড়া আর কিছুই বুঝলেন না। তবে কথার ফাঁকে কুট্টির মুখে বিজু আর কেসাংয়ের নাম শুনে টানটান হয়ে গেল রাউতের পথক্লান্ত শরীর। আরেকটা ‘গেথংপা’ না ‘গাইথংপা’ বলে কিছু কানে এল বটে কিন্তু মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলেন না। তবে এই শব্দটা শোনা মাত্রই মুহূর্তের মধ্যে অভিমন্যুর চোখেমুখে যে একটা ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে তা কিন্তু চোখ এড়াল না রাউতের। অভিমন্যুর চেহারার অভিব্যক্তি রাউতের দুশ্চিন্তাকে বাড়িয়ে দিল কয়েকগুণ।

চিন্তার সূত্রটা ছিঁড়ে গেল অভিমন্যুর গলার আওয়াজে, “ঠিক আছে কুট্টি, কাল তবে দেখা হচ্ছে স্পটে। দূর থেকে ইশারা করে চিনিয়ে দিয়েই তোমার ছুটি। কেমন? সো মেনি থ্যাঙ্কস! চলুন মিঃ রাউত, একটিবার থানায় যেতে হবে।”

থানা থেকে ফিরে ঘুপচিমতো জায়গায় একটা অতি সাধারণ হোটেলে এসে উঠলেন দু’জনে। স্নানাহার সেরে গাল ফুলিয়ে বসে রইলেন ইনস্পেকটর রাউত। অভিমন্যুর চোখের কোণে দুষ্টু হাসি খেলে গেল। ভুরু নাচিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার মিঃ রাউত, বাড়ির জন্যে মন কেমন করছে নাকি?”

রাউত যেন মুখিয়েই ছিলেন। একরাশ উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, “কাল সকালে এখানে আসার জন্যে ফোন করার পর থেকে আমাকে যেন চিনতেই পারছেন না আপনি, মিঃ রক্ষিত। একটা মানুষ যে আপনার সঙ্গী হয়েছে সেদিকে যেন খেয়ালই নেই আপনার। অফিসিয়ালি কেসের ইনভেস্টিগেশন অফিসার আমি। অথচ কাল থেকে আমায় কিছুই বলছেন না। কী করবেন, কোথায় যাবেন কিছুই জানতে পারছি না আগাম। জিগ্যেস করলেই এড়িয়ে যাচ্ছেন। এটা কি ঠিক হচ্ছে, আপনিই বলুন না!”

এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন অভিমন্যু। সামলে নিয়ে বললেন, “ওহ, এই কথা? আয়াম রিয়েলি ভেরি সরি! আচ্ছা শুনুন তবে। তার আগে বলুন, বৌদ্ধধর্মের পুঁথিটুথিগুলোর সম্বন্ধে কিছু ধারণা আছে আপনার?”

রাউত যেন আকাশ থেকে পড়লেন। চোখমুখ কুঁচকে বললেন, “ধান ভানতে শিবের গীত কেন মশাই! কী আশ্চর্য! এখানে বৌদ্ধধর্মের উদয় হল কোত্থেকে হঠাৎ?”

পরক্ষণেই মুখ গোমড়া করে আবার বললেন, “মাপ করবেন, আমার এক ত্রিপিটক ছাড়া ওসব সম্পর্কে আর কোনও ধারণা নেই।”

বলেই নিরুৎসাহী মুখ করে বসে রইলেন আবার আগের মতো।

অভিমন্যু বলতে শুরু করলেন, “আসলে এ কেসটা হাতে নেওয়ার আগে আরেকটা কেস নিয়ে সাংঘাতিক ব্যস্ত ছিলাম। তবে কোনও সূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না আপ্রাণ চেষ্টা করেও। ভুটানের একজন সম্মানিত তিব্বতি লামার দেওয়া কেস। সপ্তাহে দু’বার তিনবার করে তাড়া দিচ্ছেন। অথচ আমার এদিকে ল্যাজেগোবরে…”

“পুঁথিটুথি নিয়ে কী বলছিলেন, সেটাই বলুন না মশাই!” তড়বড় করে উঠলেন রাউত।

অভিমন্যু একটু হেসে বললেন, “সেটাই বলছি, শুনুন মন দিয়ে।”

রাউত গুছিয়ে বসে কান খাড়া করে রইলেন। অভিমন্যু বলতে শুরু করলেন, “ত্রিপিটক ছাড়াও বেশ কিছু প্রজ্ঞা বিষয়ক গ্রন্থ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা অতি পবিত্র হিসেবে মান্য করে আসছেন। প্রজ্ঞা হচ্ছে বাস্তবকে বা বাস্তবের প্রকৃতিকে সত্যরূপে দেখার ক্ষমতা। তবে দার্শনিক ভাবধারায় কিন্তু প্রভাবিত নয় এই প্রজ্ঞা। তো, এমন অসংখ্য প্রজ্ঞাসূত্র সম্বলিত যে কয়েকটা পুঁথি বৌদ্ধধর্মের অমূল্য সম্পদরূপে পরিগণিত হয় এদের মধ্যে ‘গাইতংপা’ হচ্ছে একটি। অনেকে ‘গেতংপা’ও বলে থাকেন। তিব্বতি ভাষায় প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্র লিপিবদ্ধ করা একধরনের পুঁথি। হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায় মাত্র এই পুঁথি রয়েছে। এর মধ্যে আমাদের নালন্দায় একটি সংরক্ষিত আছে।”

রাউত লাফিয়ে উঠে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, গাইথংপা কথাটা কুট্টির মুখে শুনেছি বটে।”

“নিশ্চয়ই। ওর সাথে আমার এই নিয়েই কাজ। দক্ষিণ ভারতীয়রা ‘ত’কে ‘থ’ উচ্চারণ করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, তা তো জানেনই। তো, প্রায় একহাজার বছরের পুরনো একটা গাইতংপা হঠাৎ উধাও হয়ে যায় ১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে। ১৯৫০ সালে চিনের অকথ্য অত্যাচারে অনেকেই তিব্বত ছেড়ে নিজেদের সুবিধেমতো জায়গায় পালাতে শুরু করেন। এখনও তা অব্যাহত রয়েছে।

“হঠাৎ একদিন বুঝলেন, একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল আমার কাছে। কথা বললেন একজন তিব্বতি লামা যিনি বর্তমানে ভুটানের কোনও এক গোপন আস্তানায় রয়েছেন। তিনি নাকি খবর পেয়েছেন একটা চুরি হয়ে যাওয়া গাইতংপা পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে এবং সেটা বর্তমানে বিদেশে পাচারের চেষ্টা চলছে। লামা চাইছেন আমি যেন এই পুঁথিটা উদ্ধার করে তাঁকে ফিরিয়ে দিই। তিনদিন সময় চেয়ে নিয়ে আমার যা যা জানার গোপনে জেনে নিলাম। তিনদিন পর আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর জানিয়ে লামাকে ফোন করলাম সম্মতি জানিয়ে। তারপর ভুটান গিয়ে সশরীরে দেখা করে এলাম। সেই থেকে শুরু হল আমার অন্বেষণ। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছিল ততই অথৈ জলে ডুবে যাচ্ছিলাম। কিছুতেই কোনও খোঁজখবর যোগাড় করতে পারছিলাম না তখন। যেখানে যতগুলো সোর্স আছে সবাইকে জানিয়ে রাখলাম। এর মধ্যে একদিন হঠাৎ কুট্টির ফোন পেলাম।”

রাউত এতক্ষণ চোখ গোল গোল করে অভিমন্যুর প্রত্যেকটা কথা গিলছিলেন। এবার মুখ খুললেন। মুখে ছাওয়া কালো মেঘের আস্তরণ কেটে গেছে। অপরিমিত আগ্রহ নিয়ে জিগ্যেস করলেন, “কুট্টির সাথে আপনার আগেরই পরিচয় আছে তা মন্দিরে ঢুকেই বুঝেছিলাম। কিন্তু কোন সূত্রে বলুন তো?”

“কুট্টির বেশ বড়োসড়ো ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা। কলকাতায় একবার একটা লরি নিয়ে ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল ও। আমারই বিশেষ পরিচিত একজনকে ধাক্কা মেরেছিল লরিটা। আমি অনেকটা অযাচিতভাবেই সাহায্য করেছিলাম ওকে। সেই থেকেই পরিচয় আর গোটা রামেশ্বরমে ও আমার সবচাইতে বড়ো সোর্স। কুট্টির পরিচয়টা পেশাগত কারণে আশা করি গোপন রাখবেন মিঃ রাউত।”

রাউত তাড়াতাড়ি বললেন, “নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। সে আর বলতে! কিন্তু থানাতে যা প্ল্যান করে এলেন তাতে তো আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। কাল ক’টা নাগাদ যাচ্ছি আমরা মন্দিরে মিঃ রক্ষিত?”

“দুপুর দু’টোয়।”

।।আট।।

এদিকে কালিম্পঙের এক অভিজাত হোটেলে কলকাতা থেকে এক আলালের ঘরের দুলালের আবির্ভাব ঘটেছে। হোটেলের রেজিস্টারে নিজের নাম লিখিয়েছে তন্ময় রায়চৌধুরী। বয়স চব্বিশ। সে কেবল কথায় কথায় টাকা ছিটোয় হোটেলের সার্ভিস বয়দের মধ্যে। আর গোপনে শুধু জুয়ার ঠিকানার হদিস চায়। দু’দিনের মধ্যেই ব্যাঙ্গালুরুতে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ রয়েছে। সে গোপনে বুকি খুঁজে চলেছে। মাঝে মাঝে আবার সকাল থেকে মাঝরাত অবধি কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়।

একদিন তাকে পেমলিং যাওয়া আসার জন্যে একজন ছোটোগাড়ির ড্রাইভারের সাথে দর কষাকষি করতেও দেখা গেল রাস্তায়। ড্রাইভার নিজের জায়গায় অনড় থাকায় শেষে অগত্যা গাড়িতে উঠে বসল সে। আঁকাবাঁকা সবুজ পাহাড়ি পথ বেয়ে ছুটে চলল গাড়ি। চারদিকের সবুজের সমাহার দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের জন্যে নিজের কাজ, কালিম্পং আসার উদ্দেশ্য সব ভুলে গেল।

পেমলিং ফরেস্টে ঢুকে কেসাং ভুটিয়ার বাড়ি খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেল না তন্ময় রায়চৌধুরী। ঠিকানা আর রোড ম্যাপ পকেটেই ছিল। পুরো গ্রামে হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র বাড়িঘর। তাও একটা বাড়ি থেকে আরেকটা অনেকটা দূরে। পাহাড়ের খাঁজে বাঁশবেতের তৈরি কেসাংয়ের ছোট্ট বাড়িখানা যেন পটে আঁকা ছবি। কেসাং এই বাড়িতেই থাকে বলে বেশ একচোট হিংসে করে নিল মনে মনে তন্ময়। গাড়িটা পাহাড়ের ওপরে বেশ খানিকটা দূরে রেখে ঢাল বেয়ে হেঁটেই ঢুকল কেসাংয়ের বাড়িতে।

কেসাং বাড়িতে নেই। বৃদ্ধ বাবা মা আর ছোটো এক বোন ছাড়া আর কেউ নেই বাড়িতে। তন্ময় ক্যুরিয়ার সার্ভিসের লোক বলে পরিচয় দিয়ে ভাব জমানোর চেষ্টা চালাল কেসাংয়ের বাবার সাথে। কেসাং কালিম্পঙের এক হোটেলে চাকরি করে বলে জানালেন ওর বাবা। তবে হোটেলের নামধাম কিছুই জানেন না। বংশানুক্রমিকভাবে চাষবাস এদের। একমাত্র কেসাংই পরের চাকরি করছে। দুঃখ করলেন বৃদ্ধ। আরও কী কী যেন বলে গেলেন অস্পষ্ট স্বরে নিজস্ব ভাষায়। তন্ময় শুধু কালিম্পঙের হোটেলের কথাটাই বুঝতে পারল ভালো করে। পুরী শব্দটাও কানে এল একবার। কিন্তু বৃদ্ধ ঠিক কী বললেন বোঝা গেল না বিশেষ। তন্ময় কেসাংয়ের ফোন নম্বর চাইল কিন্তু তারা দিতে পারলেন না। এই এলাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই।

কেসাংদের বাড়িতে মোটে দু’খানা মাত্র ঘর। একটায় ওর বাবা মা আর বোন থাকে। অন্যটায় সে বাড়ি এলে থাকে। কেসাংয়ের ঘরেই বসালেন তন্ময়কে ওর বাবা। তন্ময় আড়চোখে দেখে নিল ঘরের বিছানাপত্র বেশ সাজানো গোছানো, আসবাবপত্রগুলোও বেশ দামি দামি। কেসাং বেশ শৌখিন ছেলে বলতে হবে। আলনায় হ্যাঙ্গারে যে দুয়েকটা জামাকাপড় ঝোলানো আছে সেগুলোও বেশ দামি বলেই মনে হয়। জুতোগুলোতেও নামী কোম্পানির লোগো বেশ গর্বের সাথে নিজের পরিচয় দিচ্ছে যেন। কিন্তু তন্ময়ের মেইলে কেসাং সম্পর্কে যে ডিটেল এসেছে তার সাথে এগুলোর কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কেসাংয়ের হাইট পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি থেকে সাড়ে পাঁচ ফুটের মধ্যেই থাকার কথা। কিন্তু এই জুতোগুলোর সাইজ তো… তাছাড়া শার্ট টিশার্টগুলোও সাইজে বেশ বড়ো বড়ো বলেই মনে হল তন্ময়ের।

।।নয়।।

রামেশ্বরম-ধনুশকোডি রোড থেকে বাঁদিকে মোড় নিয়ে প্রায় আটশো মিটার এগোলেই কোডাণ্ডা রামমন্দির। দর্শনার্থীদের বেশ ভিড় হয়েছে আজ। মন্দিরকে পেছনে ফেলে উত্তরপূর্ব কোণে এগিয়ে গেলেই সমুদ্রসৈকত। সেখানেও বেজায় ভিড়। দোকানপাটও মন্দ বসেনি। ডাবওয়ালারা ঘ্যাচাঘ্যাচ করে অসাধারণ দক্ষতায় ডাব কেটে নল ঢুকিয়ে দিচ্ছে হাতে হাতে। কেউ কেউ সামুদ্রিক শঙ্খালঙ্কার আর হরেকরকম জিনিস বোঝাই করে হেঁকে বেড়াচ্ছে ঠেলাগাড়ি করে। আশেপাশে ছড়ানো ছিটনো মাছ ধরার নৌকা মেরামত করছে কয়েকজন জেলে মিলে। বালিতে বড়ো বড়ো রং-বেরঙের ছাতা পুঁতে নীচে ছায়ায় পাতা বীচ-চেয়ারে হেলান দিয়ে সমুদ্রের শোভা দেখছেন অনেকে। সাঁ সাঁ বাতাসে পাশের জনের সাথেও চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে। একজন ঠেলাওয়ালা সামনে দিয়ে চলে যেতেই চেয়ার থেকে এলানো গা তুলে ডানদিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন দু’জন টুরিস্ট। দু’জনই চকিতে একবার করে কোমরে হাত দিয়ে কী যেন পরখ করে নিলেন। খানিক এদিক সেদিক ইতস্তত হাঁটাহাঁটির পর একটা তালপাতায় ছাওয়া ভাঙাচোরা থুত্থুড়ে ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলা তিনজন লোকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন শেষে। লোকগুলো কথা বন্ধ করে এদের দিকে তাকাতেই মুহূর্তের মধ্যে দু’টো রিভলভার চকচক করে উঠল সূর্যের আলোতে। তিনজনের মধ্যে হঠাৎ একজন সুযোগ বুঝে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল একদৌড়ে। বাকি দু’জনের বুকে ততক্ষণে রিভলভার দু’টো ঠেকে যাওয়ায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তারা বিস্ফারিত চোখে। ততক্ষণে নৌকা মেরামত করতে থাকা জেলেরা ঘিরে ফেলেছে এদের। লুঙ্গির ভেতরের বারমুডার পকেট থেকে হাতে উঠে এসেছে যার যার সার্ভিস রিভলভার।

বিজুকে রামেশ্বরম থানায় ঢুকিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই মচকে ফেললেন অভিমন্যু আর থানার ইনচার্জ মিলে। পরের আধঘণ্টায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল বিজু। বিজুর অবস্থা দেখে ওর সঙ্গের লোকটা ভয়ে বোবা হয়ে গেছে। সেও সবকথা খুলে বলতে চায়। ততক্ষণে এসপি সায়েব গাড়ি থেকে নেমে ঢুকে পড়েছেন হন্তদন্ত হয়ে। অভিমন্যু রামেশ্বরমে পৌঁছার আগেই এসপিকে জানিয়ে রেখেছিলেন আদ্যান্ত ঘটনা।

অভিমন্যু সরাসরি পয়েন্টে এলেন, “গাইতংপা এখন কোথায় বিজু? তোমার কাছে?”

বিজুর ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত ঝরছে। কাঁপা গলায় বলল, “না স্যার, আমি জানি না কোথায় আছে।”

“তবে রামমন্দিরের বীচে গেছিলে কেন? ডিল ফিক্স করতে?” এবার এসপি ধমক লাগালেন। ঘরে যেন একটা বাজ পড়ল।

বিজু মাথা নিচু করে রইল। অভিমন্যু আবার জিগ্যেস করলেন, “যদি সবকথা খুলে বল তবে বেঁচে যাবে অনেকটা। নয়তো…। পালিয়ে যাওয়া লোকটা কে ছিল?”

মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই বিজুর পাশে বসে ধুঁকতে থাকা মুশকো লোকটা হাউমাউ করে বলল, “শ্রীলঙ্কার এজেন্ট ছিল স্যার। আমাদের কাজ ছিল শুধু যোগাযোগ করে রাখা। মালসমেত মালিক এসে পৌঁছলেই তবে ডিল হবে।”

“মালিকটা কে? আর মালটাই বা কোথায় এখন?”

বিজু হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসল। মেঝেয় পড়ে থাকা শরীরটাকে হেঁচড়ে টেনে এনে অভিমন্যুর পা খামচে ধরে মাথা কুটতে কুটতে বলল, “আমার দেড় বছরের মেয়েটার দিব্যি স্যার, যা যা জানি সব বলেছি আপনাকে।”

“হুম, তবে ওই মালিকের নামটা বাদে।”

“বিশ্বাস করুন স্যার, মালিক কে আমরা জানি না। পুরীর হোটেলে কেসাং একদিন টাকার লোভ দেখিয়ে বলেছিল শুধু ডিলটা পাকা করে দিলেই হবে। নগদ পঞ্চাশ হাজার। হাতে গুঁজেও দিয়েছিল হাজার দশেক অগ্রিম।”

“বিদেশের এজেন্টের সাথে কেসাং বা আর কারও যোগাযোগ আছে?”

“না স্যার। এজেন্ট ঠিক করার দায়িত্ব আমাদের ছিল।”

“ঠিক আছে, মানলাম। যদি এর মধ্যে আরও কিছু মনে পড়ে জানিও। তোমাদেরই মঙ্গল। এখন কেসাংকে ফোন করে স্মার্টলি বলো যে পার্টির সাথে যোগাযোগ হয়েছে। দিন পনেরো বাদের একটা তারিখ বলো ডিলের জন্যে। কোনওরকম চালাকি করার চেষ্টা কোরো না একদম। কেসাং যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায় যে তোমরা ধরা পড়েছ। বুঝলে? নাও, ফোনটা করো এবার।”

বিজু অভিমন্যুর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল।

এসপি সায়েবের দিকে তাকিয়ে, “ওকে স্যার, উঠলাম তবে। গুড ডে!” বলে অভিমন্যু ইনচার্জের সাথে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন।

“বিজুর মোবাইলটা অন করে রেখে দেবেন আপনার কাছে। কেসাং নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবে ফের। বিজুকে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা বলাবেন। দেখবেন বিন্দুমাত্রও যাতে এদিক সেদিক না হয়। আমি ভেবে দেখছি কেসাংয়ের নম্বরটা ট্র্যাক করার প্রয়োজন আছে কি না। আসছি, নমস্কার। চলুন মিঃ রাউত।”

ইনস্পেকটর রাউত এতক্ষণ চুপচাপ একটা চেয়ারে বসেছিলেন এককোণে। একটা রাও কাড়েননি। বোধহয় স্বয়ং এসপি সায়েব উপস্থিত ছিলেন বলেই একটু কুঁকড়ে ছিলেন। শত হলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। হলেনই বা আলাদা রাজ্যের।

হোটেলে পৌঁছার আগেই রাস্তাতে অভিমন্যুর ফোন বেজে উঠল। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখতেই থমথমে মুখটা একটু যেন হালকা হল।

“হ্যাঁ তনু, বল। কী! কোথায়? ওকে, তুই যা ভালো বুঝিস কর। এখানকার কাজ আপাতত শেষ। হ্যাঁ হ্যাঁ, ফ্লাইটেই চলে আসব। চিন্তা করিস না। তোর হোটেলের ঠিকানাটা আমায় মেসেজ করে দে। ওকে, বাই!”

ঘাড় ফিরিয়ে রাউতের উৎসুক দৃষ্টি চোখে পড়তেই অভিমন্যু বললেন, “এবার কালিম্পং মশাই। যাবেন নাকি?”

“হবে না। তিনদিনের ছুটি ছিল। ফুরিয়ে যাচ্ছে। তা, তনুটা কে বললেন না তো?’’

“ওহ, সরি! ওর নাম তন্ময় রায়চৌধুরী। আমাদের পাড়াতেই থাকে। তুখোড় ছেলে, বুদ্ধিমান আর সাহসী। ওখানকার প্রাথমিক কাজটা ওই সেরে রাখছে।”

“সুযোগ্য শাগরেদ পেয়েছেন বলুন?”

দু’জনের অট্টহাসিতে গত কয়েক ঘণ্টার গুমোট পরিবেশটা অনেকটা হালকা হয়ে গেল। অভিমন্যু হঠাৎ জিগ্যেস করলেন, “আচ্ছা মিঃ রাউত, আপনিও তো অফিসিয়ালি ইনভেস্টিগেশনেই এসেছেন। তবে আগাগোড়া চুপ করে রইলেন কেন? সোমনাথের ব্যাপারে তো জেরা করতে পারতেন বিজুকে। যেহেতু সে ওই হোটেলেই কাজ করত।”

রাউত লঘুস্বরে বললেন, “লাভ হতো না কিছুই স্যার। এখন কেসাং ব্যাটাই আমাদের কালো ঘোড়া। যা জানার ওর কাছ থেকেই জানতে হবে। আমি যতটুকু জেনেছি বিজু সোমনাথের মৃত্যুর আগেই বাড়ি চলে এসেছিল। তাছাড়া সোমনাথের কেসের তদন্ত তো আপনিও করছেন। বিজুকে ল্যাংড়া ঘোড়া হিসেবে আপনিও কিন্তু বাদের খাতাতেই রেখেছেন ওকে।”

।।দশ।।

uponyasoperationsymnergyকালিম্পং পৌঁছেই তন্ময়কে ফোন করলেন অভিমন্যু। ভুরু কুঁচকে উঠল তার। বারবার সুইচড অফ আসছে কেন? অভিমন্যু ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠলেন। পরের ছেলে, একা পাঠানো ঠিক হয়নি এখানে। কোনও বিপদআপদ হয়নি তো বড়ো? আরও কয়েকবার তন্ময়ের নম্বর ডায়াল করে শেষে হাল ছেড়ে দিলেন অভিমন্যু। চটজলদি একটা ট্যাক্সি ডেকে সোজা গিয়ে উঠলেন তন্ময়ের হোটেলে। অবশ্য ওখানে যাওয়ার প্ল্যান ছিল না তার একেবারেই। ঠিক করে রেখেছিলেন কালিম্পং পৌঁছে তন্ময়কে ডেকে নিয়ে অন্য একটা সুবিধেমতো হোটেলে গিয়ে উঠবেন দু’জনে মিলে। কিন্তু এখন তো তন্ময়ের সাথেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।

 তড়িঘড়ি হোটেলটায় পৌঁছে ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে বলতে মুখের সমস্ত পেশিগুলো দৃঢ় হয়ে উঠতে লাগল অভিমন্যুর। চোখমুখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরোতে লাগল। কাল রাত দশটা নাগাদ হোটেলের ছাদে জলের ট্যাঙ্কের পেছন থেকে প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তন্ময় রায়চৌধুরীকে। মাথায় আঘাত পেয়েছে। এখন হাসপাতালে আছে। ভালোই আছে, আঘাত গুরুতর নয়। সকাল আটটা নাগাদ হাসপাতালে ফোন করে খবর নিয়েছেন ম্যানেজার। অভিমন্যু ছুটলেন হাসপাতালে।

পরদিন ছাড়া পেয়ে তন্ময় আর অভিমন্যু এসে ঢুকলেন সেই হোটেলেই। একটা ডবল বেডেড রুম নিলেন অভিমন্যু। তন্ময় এখন বেশ সুস্থ। মাথার ডানদিকে মেরেছিল দুশমন। তবে বিশেষ কিছু ক্ষতি করতে পারেনি। থেঁতলে গিয়েছিল মাত্র কিছুটা জায়গা। গোঙানির শব্দ পেয়ে হোটেল স্টাফদের একজন ছাদে এসে দেখে এই কাণ্ড।

“কিন্তু কে হতে পারে আন্দাজ করতে পারিসনি কিছু? ক’জন ছিল?” অভিমন্যু জিগ্যেস করলেন।

“বলছি একেবারে শুরু থেকে। একটু দাঁড়াও, টয়লেট থেকে আসছি।”

টয়লেট থেকে ফিরে এসে তন্ময় দেখল ততক্ষণে দু’মগ গরম কফি এসে গেছে। ধোঁয়া উঠে সারাঘর দারুণ গন্ধে ম ম করছে। অভিদার এই ব্যাপারটা দারুণ। ঠিক সময়মতো সঠিক জিনিসটা এনে হাজির করে। কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করল এবার তন্ময়, “কালিম্পঙে ঢুকে সোজা এই হোটেলেই এসে উঠেছিলাম। তোমার প্ল্যান অনুযায়ী সার্ভিস বয়দের হাতে আনার চেষ্টা করতে লাগলাম ধীরে ধীরে। আর খুঁজতে লাগলাম এমন একজনকে যে আমাকে সাহায্য করতে পারে আমার কাজে। তোমার পরিচয় দিয়ে থানায় ঘুরে এলাম। ইনচার্জকে খুলে বললাম আমার কালিম্পং আসার উদ্দেশ্য।”

“কেসাং ভুটিয়ার কোনও রেকর্ড পেলি থানায়?”

“পেয়েছি।”

ভারত পাকিস্তান ক্রিকেট মানে বরাবরই একটা অঘোষিত যুদ্ধ। ক্রিকেটপ্রেমীদের উত্তেজনা থাকে তুঙ্গে। ব্যাঙ্গালুরুর মঙ্গলম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে আজ দু’পক্ষের দিনরাতের যুযুধান লড়াই। অভিমন্যুর চোখ একপলকের জন্যেও টিভিটার পর্দা থেকে নড়ছে না। গোটা হোটেলটাই কেমন যেন ঝিম মেরে আছে। সকাল নাগাদ একটিবার বেরিয়েই তাড়াতাড়ি আবার হোটেলে ফিরে এসেছেন। স্নান খাওয়া সেরে রিমোট হাতে নিয়ে এখন একেবারে খাটে লম্বা হয়ে রয়েছেন।

কালিম্পঙের আপার কার্ট রোডের এক গলির গলি তস্য গলির একটা ঝুপড়ি ঘরে জমা হয়েছে রাজ্যের যত জুয়াড়ির দল। দম আটকে টিভির পর্দায় চোখ রেখে বসে আছে সবাই। যেন নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে। টিভিতে ম্যাচ চলছে। সামনে একটা টেবিলে পড়ে আছে দু-দু’টো ল্যাপটপ আর গোটা দশেক মোবাইল ফোন। কোনওটা হঠাৎ সচল হয়ে চিৎকার করে উঠছে কোনওটা একেবারেই নীরব। ইলেক্ট্রিসিটি আর ক্যাবলের ওপর ভরসা না করে প্রথম থেকেই নিজস্ব ডিশ অ্যান্টেনা আর জেনারেটরে খেলা চালানো হয়েছে। ব্যাক-আপ হিসেবে রাখা হয়েছে ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট কানেকশন। রয়েছে একটা উন্নতমানের বিদেশি ভয়েস রেকর্ডার। যারা খেলবেন তাদের বাজীতে লাগানো টাকার পরিমাণসহ কথাবার্তার রেকর্ড রাখা হয়। যাতে পেমেন্টের সময় ঝামেলা না হয়।

প্রত্যেকটা বল, প্রত্যেকটা ওভার, এমনকি ব্যাটিং আর বোলিং অর্ডার নিয়েও বেটিং হচ্ছে একের পর এক বড়ো বড়ো দানের। বাজীর শেষে কেউ চাপা উল্লাসে ফেটে পড়ছে, কেউ বা থমথমে মুখ নিয়ে বসে পড়ছে। কেউ আবার নতুন করে দান মারার উদ্যোগ নিচ্ছে, কেউ আবার গোমড়া মুখে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। যাই কিছু ঘটুক আর না ঘটুক, দলের সর্দারের কোনও হেলদোল নেই তাতে। চেহারার প্রত্যেকটা রেখা একই জায়গায় অবস্থান করছে আগাগোড়া। সে কানে হেড ফোন লাগিয়ে ‘মাস্টার কোড’ কিনতে ব্যস্ত। এই কোডগুলো আসে বিদেশ থেকে। একেকটা কোড একেক রকম, একেক রকম বেটিং। কোডগুলোর ভ্যালুও প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা।

পুরো চক্রটার সিকিউরিটির দায়িত্ব পেঞ্জোর হাতে। কিন্তু আজ সে এখনও এসে পৌঁছায়নি। মোবাইলটাও বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। তার দলবল বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে বটে, তবে ব্যবস্থা আজ বড়ো ঢিলেঢালা। মাঝে মাঝে দুয়েকজন ঘরে ঢুকে একটু আধটু খেলাও দেখে আসছে গিয়ে পালা করে। ভারত-পাকিস্তান বলে কথা।

পেঞ্জোর অনুপস্থিতির ব্যাপারটা এবার গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করলেন বেটিং চক্রের সর্দার। আর ভাবতে না ভাবতেই পেঞ্জো এসে দাঁড়াল সামনে। পেছনে চার পাঁচজন নতুন খেলুড়ে। এরা আজকের ম্যাচে বড়ো অঙ্কের টাকা লাগাতে চান।

খাটে শুয়ে একমনে খেলা দেখে যাওয়া অভিমন্যুর এই রিল্যাক্স মুডটা তন্ময়কে বেজায় অস্বস্তিতে ফেলে রেখেছে। সে উসুখুসু করছিল তখন থেকে। একবার জিগ্যেসও করেছিল, “কোথায় গিয়েছিলে তখন?”

অভিমন্যু একবার শুধু আড়চোখে তাকিয়ে একটি মাত্র শব্দ খরচ করেছিলেন, “থানায়।”

ব্যস, আর কোনও কথা নয়। দু’জনেই বোবা হয়ে বোকাবাক্সর দিকে তাকিয়ে আছে। ফার্স্ট ইনিংস প্রায় শেষের পথে। স্লগ ওভার চলছে। আর মাত্র চার ওভার বাকি। ঠিক তখনই অভিমন্যুর ফোনটা নিজের উপস্থিতি জানান দিল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ফোন কানে চেপে বললেন, “হ্যাঁ, রক্ষিত বলছি। তুলেছেন? ঠিক আছে, আসছি এখুনি। আপনি থাকছেন তো? ওকে ওকে।”

ঝড়ের বেগে শার্ট প্যান্ট পরতে পরতে বললেন, “চল চল তনু, থানায় যেতে হবে।”

“আসুন মিঃ রক্ষিত। বসুন।”

“বিশেষ কোনও ঝামেলা হয়নি তো?”

“না, আপনি যাকে টার্গেট করেছিলেন তাকেই ডেকে এনে একটু আদর করে জিগ্যেস করতেই ঠিকানাটা পেয়ে গেলাম। বড়ো বড়ো বেটিং চলছিল নাকি আজ। তারপর আমরা পাঁচজন সাদা পোশাকে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম গ্যাম্বলার সেজে।” চোখ নাচালেন ওসি।

তন্ময় চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকাতেই অভিমন্যু বললেন, “পেঞ্জো, আমাদের হোটেলের সেই বয়টার কথা বলছেন। তুই যাকে প্রথম বেটিংয়ের অফার দিয়েছিলি। তাকেই টার্গেট করার প্ল্যান ছিল।”

ওসি সাহেব আবার বললেন, “আসলে কী জানেন তো, আমাদের সবই জানা থাকে। তবে সবদিকে একসাথে তো আর নজর রাখা যায় না। ছেলেটা আগেও ধরা পড়েছিল একবার। তখন বয়স খুব অল্প আর অপরাধ খুব সামান্য বলে খুব করে ধমকে দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন দেখছি… সেদিনের ছিঁচকে আজ একেবারে সর্দার!”

“আছে কোথায়?”

“লক আপে। আসুন, ওইদিকে। বের করে আনতে বলছি।”

“গুড ইভনিং কেসাং! আসলে এভাবে একটা উত্তেজক খেলা মাটি করে কাউকে উঠিয়ে আনা ঠিক ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না, কী বল?”

অভিমন্যুর শ্লেষটা গায়ে না মেখে কেসাং মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল স্থির দৃষ্টিতে। শারীরিক ভাষা আহত বাঘের মতো।

“এখন যদি সময় নষ্ট না করে যা জিগ্যেস করব চটপট উত্তর দিয়ে দাও তবে সেকেন্ড ইনিংসের গোড়ার দিকে কয়েকটা ওভার মিস করলেও বাকি খেলাটা হয়তো দেখতে পারব গিয়ে। কী, দেবে তো ভাই?”

ওসি দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন, “বোস ওই টুলে। আর যা যা জিগ্যেস করবেন উনি ঠিকঠাক উত্তর দিবি। নইলে এমন এমন চার্জ লাগিয়ে দেব, বাপের জম্মেও ছাড়া পাবি না।”

অভিমন্যু এবার একটু নড়েচড়ে বসে জিগ্যেস করলেন, “তোমার জুতোর নম্বর কত কেসাং?”

কেসাং বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল অভিমন্যুর মুখের দিকে। অভিমন্যু জিভ কেটে বললেন, “না না, ছিঃ ছিঃ, জোক করছি না কেসাং। বল না, নম্বরটা কতো?”

“আজ্ঞে, ছয়।”

“বাড়িতে কে কে আছেন?”

নিচুস্বরে জবাব এল, “মা বাবা আর বোন।”

“আর কে আছেন কেসাং?”

“আর কেউ না।”

“আর কে আছেন কেসাং?” অভিমন্যুর বরফ শীতল অথচ ইস্পাতের মতো কণ্ঠস্বরে প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার উচ্চারিত হতেই চকিতে একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল কেসাং। বসে রইল চুপ করে।

“বলবে না? বেশ। এবার চলো পুরীতে। পুরীর হোটেলে সোমনাথ চট্টরাজের ঘরে শেষ কখন ঢুকেছিলে তুমি?”

“আমি! ত-তা প্রায় রাত এগারোটা হবে।” একটা জোরালো ইলেকট্রিক শক খেল যেন কেসাং। কেঁপে উঠল অন্তরাত্মা।

“কেন?”

“খাবার দিতে।”

“সোমনাথ কোথায় ছিলেন তখন?”

“ঘরেই ছিলেন।”

“ঘরে কোথায়? বিছানায়, না টেবিলে, না বাথরুমে?”

“আজ্ঞে, বিছানায়।”

“এত রাতে খাবার দিতে গেলে কেন? তোমাদের ফুডকোর্ট তো শার্প সাড়ে নয়টায় বন্ধ হয়ে যায়।”

“যারা একটু রাতের দিকে খাবার দিতে বলেন তাদের জন্যে আগেই আনিয়ে রাখি আমরা অর্ডারমতো।”

“বেশ। ঘরে ঢুকে কী দেখলে? সোমনাথ কী করছিলেন তখন?”

“ড-ডায়েরি লিখছিলেন।” কথাটা উপস্থিত সবার কানেই বিসদৃশ ঠেকল।

অভিমন্যু আশ্চর্য হলেন, “বিকেলবেলা এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল আর রাতে উনি ডায়েরি লিখছিলেন? আর সেটা যে ডায়েরিই ছিল তুমি তা বুঝলে কী করে? যতটুকু দেখলাম, বিছানা তো ডাইনিং টেবিল থেকে অনেকটা দূরে। তোমার তো টেবিল থেকেই ফিরে আসার কথা খাবার রেখে।”

“আমি ওনার কাকার ব্যাপারে খোঁজ নিতে বিছানার পাশে গিয়েছিলাম।”

“বেশ বেশ। খুব ভালো করেছিলে। গেস্টদের সবরকম সুবিধা অসুবিধারই খোঁজখবর রাখা উচিত।”

কেসাং কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। মুহূর্তেই আবার জ্বলে উঠলেন অভিমন্যু, “ডায়েরিটা এখন কোথায় আছে কেসাং? তোমার বাড়িতে? না এখানেই তোমার হোটেলের রুমে? মিথ্যে বললে জিভ উপড়ে নেব তোমার। ডায়েরিটা আমার চাই।”

কেসাং কেঁপে উঠল এই হুঙ্কারে। কোনওমতে বলল, “পুরীতেই আছে ম্যানেজারের কাছে।”

“ওহ, কেসাং কেসাং, ইউ আর লাইয়িং ডিয়ার! ম্যানেজারের কাছে থাকলে উনি আগেই জমা দিতেন থানাতে। সত্যি বল, কোথায় রেখেছ।”

“আমি সত্যি বলছি স্যার। একবর্ণ মিথ্যে বললে জ্যান্ত পুঁতে দেবেন।”

“হ্যালো, মিঃ রাউত! কোথায় আছেন, খণ্ডগিরি থানায়?”

দু’দিনের মধ্যেই পুরীর হোটেলের ম্যানেজারকে প্রত্যেকদিন একবার করে পুরী থানায় হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে ডায়েরিটা নিয়ে কালিম্পংয়ে হাজির হলেন ইনস্পেকটর রাউত।

হাতে পেয়ে ডায়েরিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগলেন অভিমন্যু।

সোমনাথের ডায়েরি

সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ। যাক, শেষ অবধি পুরী এসে পৌঁছলাম তবে।

“কী দারুণ দেখাচ্ছে না রে সোমু? দ্যাখ একবার!” রবিনকাকার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বরটা কানে ঢুকতেই তাঁর আঙুলের দিকে চকিতে তাকালাম। কাকাকে অনেকদিন এমন খুশি হতে দেখিনি।

সকাল সকাল পুরী স্টেশনে নেমে একটা অটোরিকশা করে হোটেলের খোঁজে যাচ্ছিলাম। মিনিট দশেকের পথ। আচার্য হরিহর স্কোয়ার পেছনে ফেলে বাঁক পেরিয়ে গাড়ি মেরিন ড্রাইভের রাস্তায় পড়তেই রবিনকাকা নড়েচড়ে বসলেন। নীলবসনা বঙ্গোপসাগরের ভাঙা ঢেউগুলোর দিকে আঙুল তাক করে বললেন, “পুরীর সমুদ্র তো ভয়ানক সুন্দর রে! তোকে একটা বড়ো করে থ্যাঙ্কস দিতেই হয়।”

সত্যিই, রাশি রাশি নীলকাঁচের তরল যেন আমাদের দিকেই ছুটে আসছে। আর পৃথিবীর যত সাবানজলের ফেনা এসে আছড়ে পড়েই পিছলে নেমে যাচ্ছে বালুতট ভিজিয়ে। হালকা কুয়াশায় আবছা ধূসর দিগন্তে আকাশ আর সমুদ্র মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। স্বর্গদ্বারের মহাশ্মশানটার সামনে আসতেই কাকা কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলেন আবার। তিনটে চুল্লী থেকে পেঁচিয়ে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখাগুলো সত্যিই এত সুন্দর সকালটাকে থমথমে করে দিচ্ছিল। সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের যে সুবেদার মেজর রবিন চট্টরাজ একদিন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে রেখেছিলেন আজ শ্মশানকালীর মন্দিরটার দিকে তিনি ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েই রইলেন নির্নিমেষ ঝাপসা চোখে।

রবিনকাকাকে রাজি করিয়ে এই পুরী অবধি টেনে আনতে আমার মাস খানেকের মতো লেগে থাকতে হয়েছে। মাস ছয়েক আগে চাকরি থেকে হঠাৎ ভি.আর.এস. নিয়ে বাড়িতে এসে মনমরা হয়ে বসেছিলেন কাকা। বারান্দার কোণের আরামকেদারাটায় বসে বিষণ্ণ মনে কী যেন ভেবেই যেতেন সারাদিন। অকৃতদার মানুষ। নিয়ম করে বছরে দু’বার যখন হৈ হৈ করে বাড়ি আসতেন তখন খুশির সীমা পরিসীমা থাকত না কারও। নিত্যনতুন খেলাধুলো আর আজব আজব সব গালগল্পে মাতিয়ে রাখতেন আমাদের।

আসলে বছর খানেক আগের সেই দুর্ঘটনাটা আমূল পালটে দিয়েছিল রবিনকাকাকে। সেটা অবশ্য জেনেছিলাম অনেক পরে। অবসর নিয়ে বাড়ি ফিরেই কাকা কেমন যেন গুম মেরে গেলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শতবার জিগ্যেস করেও কেউ কিছু বের করতে পারল না মুখ থেকে। অনেকদিন পর শুধু আমায় একদিন ডেকে বলেছিলেন ত্রিপুরার কালাঝাড়ি পাহাড়ের ‘সিনার্জি অপারেশন’-এর এক রোমহর্ষক অভিযানের ঘটনা।

নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে কাকার শরীর আর মন দুইই দিন দিন ভাঙতে লাগল দ্রুত। ডাক্তার-বদ্যিরা কেউই কাকাকে আগের জীবনটা ফিরিয়ে দিতে পারলেন না। শেষে আমিই তোড়জোড় করে কাকাকে কোনওমতে নিমরাজি করিয়ে পুরীর টিকিট কাটলাম।

কাকার হাতের উৎসাহী স্পর্শটা কাঁধে অনুভব করতেই চোখের ঝাপসা দৃষ্টিটা এক লহমায় স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার। কাকা জিগ্যেস করলেন, “হ্যাঁ রে সোমু, ক’বার এলি এ নিয়ে এখানে?”

দু’মুহূর্ত হিসেব করে নিয়ে বললাম, “এ নিয়ে মোট চারবার হল কাকা। তবে পুরীর সমুদ্র আমার কাছে চিরনতুন। তোমার তো দূর থেকেই ভালো লেগে গেছে দেখছি। সমুদ্রে নামলে তো আর উঠতেই চাইবে না শেষে।”

মেরিন ড্রাইভের সবুজ লনওলা হোটেলটাতে আমি আগেও থেকে গেছি দু’বার। এর আনাচকানাচ আমার ভালোরকম জানা আছে বলেই সোজা এখানে কাকাকে এনে তুললাম যাতে কোনও অসুবিধে না হয়। চেক ইনের সইসাবুদ সারতে না সারতেই দেখলাম রিসেপশনের ডাকে কেসাং এসে হাজির। আমি মনে মনে বেশ খুশি হলাম। কেসাং জাতে ভুটিয়া, কালিম্পঙে বাড়ি। এ নিয়ে তিনবার ওকে আমাদের রুমের সার্ভিস বয় হিসেবে পেলাম। সেও আমায় চিনতে পেরে কুতকুতে চোখদু’টোতে খুশির ঝিলিক মেখে জিগ্যেস করল, “ভালো আছেন সাবজী?”

কেসাং ভালো বাংলা বলতে পারে। সৌজন্য বিনিময় সেরে কাকার দিকে তাকিয়ে, ‘আমার কাকা’ বলতে গিয়ে চমকে উঠলাম। সারামুখে কে যেন একটা আতঙ্ক লেপে রেখে গেছে কাকার। কাঁপা ঠোঁটের ফাঁক গলে বিড়বিড় আওয়াজ বেরোচ্ছে অনবরত। আশ্চর্য হয়ে কাকার হাতটা ধরে ফেললাম খপ করে। দেখলাম কেসাংয়ের চোখে পড়েনি ব্যাপারটা। ও ততক্ষণে শিস দিতে দিতে লাগেজ টেনে নিয়ে এগিয়ে গেছে রুমের দিকে।

বিছানাপত্র গোছগাছ করে কেসাং হাসিমুখে বেরিয়ে যেতেই কাকা আমার পাশে আড়ষ্ট হয়ে বসে ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিগ্যেস করলেন, “ছেলেটা কে রে সোমু? মানে, ঘরবাড়ি কোথায়?”

ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই মনে হল সামলে নিয়েছেন নিজেকে একটু। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললেন, “না মানে, হোটেল বয় তো দেখতেই পাচ্ছি। নামটাও কেসাং শুনলাম। উত্তরপূর্বের দিকেরই হবে হয়তো। তবে কী জানিস, মঙ্গোলিয়ন টাইপের চেহারাগুলো বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দেয় আমায়। আলাদা করে ঠিকঠাক মনে রাখতে পারি না আমি। বেশিরভাগ লোকেরই কেমন যেন একইরকম চেহারা প্রায়।”

এবার আমার মনে আশঙ্কার ছায়া পড়ল। তাড়াতাড়ি বললাম, “শরীর খারাপ লাগছে, কাকা তোমার? অসুবিধে হচ্ছে কিছু? আচ্ছা যাও না, স্নানটা সেরে নাও চট করে। তারপর একটা কিছু মুখে দিয়ে টানা বিশ্রাম এখন। বিকেলে সমুদ্রর পাড়ে যাব। যাও যাও, দেরি কোরো না।”

কথাগুলো বলে আপনা থেকেই হাসি পেয়ে গেল। মনে হল যেন দশ বছরের এক অবোধ বালককে লজেন্সের লোভ দেখাচ্ছি।

বাথরুম থেকেই টের পেলাম কেসাং এসে বসেছে রুমে আর অনবরত বকে যাচ্ছে। কাকার গলার বিরক্তি মেশানো টুকটাক আওয়াজও ভেসে আসছে কানে অস্পষ্ট স্বরে। আমি বেরোতেই কেসাং বলল, “ব্রেকফাস্টের টাইম শেষ হয়ে গেছে। তবে চাইলে একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পারব। আর দুপুরে যদি আমাদের ফুড কোর্টে খান তবে অর্ডারটা দিয়ে দিন স্যার।”

শরীরটা ছেড়ে দিয়ে বললাম, “এক পাও নড়তে ইচ্ছে করছে না কেসাং। দ্যাখো না, ব্রেকফাস্টের কিছু ব্যবস্থা করতে পার কি না। আর লাঞ্চটা ভাই তুমি রুম সার্ভিসই করে দিও। কেমন?”

মুচকি হেসে কেসাং বেরিয়ে যেতেই কাকা যেন হামলে পড়লেন আমার ওপর। দরজার দিকে চোখ রেখে বললেন, “তুই রুম সার্ভিস বললি কেন? আমি ফুড কোর্টেই গিয়েই খাব। চেনা নেই জানা নেই, কে একজন খাবার এনে দেবে। কিছু মিশিয়ে-টিশিয়ে দিলে! আমার বাপু ওই কেসাংটাকে একদমই পছন্দ নয়।”

“আহা! কে তোমার খাবারে আবার… আর ক্যানোই বা…” আমি হা হা করে উঠতে গিয়েও পারলাম না। ভীষণ মায়া হল রবিনকাকার বিব্রত মুখটার দিকে তাকিয়ে। যে কাকা কোনও কিছুতেই পরোয়া করতেন না, আজ তাঁর এ কী অবস্থা! এধরনের হাস্যকর সন্দেহের বীজ মনে ঢুকল কী করে!

আজ তিনদিন হয়ে গেল আমরা পুরীতে আছি। রবিনকাকা অবশ্য বেশ ফুরফুরে আছেন দু’দিন ধরে। কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে এই ভেবে যে, হোটেলে আসা অবধি কেসাংকে যেমন পছন্দ করতেন না, এখনও করছেন না। অথচ খুব মিশুকে ছেলে এই কেসাং। কাকার জগন্নাথ দর্শন হয়ে গেছে। এ ক’দিন আশ মিটিয়ে সমুদ্রস্নান করছি আর বিকেল বিকেল বীচে নেমে কাকা ভাইপো মিলে ঠেলাগাড়ি ঠাসা একের পর এক জানা অজানা দশরকম মাছভাজা সাঁটাচ্ছি।

মাঝে সত্যিই একটা বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম একদিন। বিকেলবেলা আমরা এক একদিন এক একটা দোকান থেকে মাছভাজা চাখি। সেদিনও অন্যথা হয়নি। কিন্তু রাত দশটা নাগাদ হঠাৎ কাকার দাস্তবমি শুরু হল। বারোটা না বাজতেই নেতিয়ে পড়লেন একেবারে। আপদকালীন ওষুধপত্র নিজের কাছে যা ছিল তা যখন কাজে এল না তখন বাধ্য হয়ে হোটেলের রিসেপশনে ফোন করে একজন ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে বললাম। ডাক্তারবাবু দেখেশুনে প্রেসক্রিপশন লেখার উদ্যোগ নিতেই রবিনকাকা শরীরের সবটুকু শক্তি এক করে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “এ কোনও সাধারণ ফুড পয়জনিং নয় ডাক্তারবাবু। আমি নিশ্চিত বিষ দেওয়া হয়েছে আমায়। আপনি সেইমতো চিকিৎসা করুন।”

ডাক্তারবাবু অভয় দিলেন, “এটা একটা অর্ডিনারি ফুড পয়জনিং মিঃ চট্টরাজ। আপনি প্যানিক হবেন না প্লিজ। আমি সোমনাথবাবুর কাছে জেনেছি আপনারা অচেনা একটা সামুদ্রিক মাছ খেয়েছিলেন বিকেলে। কালকেই ঠিক হয়ে যাবেন আপনি। বিলিভ মি।”

কাকার চোখমুখ থেকে আতঙ্ক সরছিল না তবুও। রাতে আমায় একা পেয়ে বললেন, “সোমু, মনে হচ্ছে আমি একটা বিপদের বেড়াজালে ঢুকে গেছি রে। মনটা ভালো লাগছে না, কু ডাকছে কেমন। মাছভাজার দোকানটায় কেসাংকে দেখতে পেলাম আজ। লুকিয়ে বসেছিল ওই ভাজার কড়াটার পেছনে। চোখাচোখি হতেই চট করে ভিড়ে মিশে গেল। মন বলছে, ও কিছু একটা মিশিয়েছিল আমার প্লেটে।”

আমি চমকে ওঠে তাকিয়ে রইলাম কাকার দিকে। কেসাং! সে কেন হঠাৎ… ওর তো এমন করার কথা নয়…

তবে কাকার আত্মপ্রত্যয় চাক্ষুষ করে আস্তে আস্তে আমার মনটাও বিষিয়ে উঠতে লাগল কেসাংয়ের প্রতি। কাকার প্রতিও বিরক্ত হলাম বেশ। অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাকার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে ওষুধপত্র কী আছে না আছে দেখতে গিয়েই শক্তমতো একটা জিনিস ঠেকল হাতে। আস্তে আস্তে হাতড়ে হাতড়ে বুঝে গেলাম সেটা একটা বিপজ্জনক জিনিস। এখানেও কাকার এটা নিয়ে আসার কী দরকার ছিল বুঝতে পারছি না। সত্যি সত্যি কাকার মাথায় গণ্ডগোল হয়নি তো!

এরই মধ্যে কন্ডাক্টেড ট্যুরের এজেন্ট এসে ঝুলে পড়লেন। ঠিক হল কাল সকালে নিজেদের বাসে করে আমাদের চন্দ্রভাগা, সূর্য মন্দির, ধৌলগিরির শান্তিস্তূপ, লিঙ্গরাজ মন্দির, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, নন্দনকানন, সাক্ষীগোপাল ইত্যাদি দেখিয়ে আনবেন এরা।

সাতটা নাগাদ হরিহর চকের কাছাকাছি আসতেই ট্যুর বাসের দেখা পেয়ে গেলাম। টিকিট নিয়ে বাসে চড়তেই একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে এল, “সোমনাথদাদা, এই যে, এই দু’টো বোধহয় আপনাদের।”

“আরে, কেসাং তুমি? আগে বলনি তো তুমিও যাচ্ছ!”

“বছরে দু’তিনবার তো যাই আমি। ভালো লাগে। আজ ছুটি আমার।”

“ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ। আজ ছুটি তোমার বলেছিলে বটে কাল। যাক ভালোই হল।”

জনাতিরিশেক যাত্রী মিলে এতবড়ো লম্বা জার্নির তালটাই কেটে গেল কেমন যেন কেসাং সঙ্গ নেওয়ায়। ভেবেছিলাম রাস্তাটা ভালোই কাটবে কাকার সাথে চুটিয়ে আড্ডা মারতে মারতে। হয়েছে উলটোটা। কেসাং অনবরত বকে যাচ্ছে আর আমি উদাসী ভান করে তিতকুটে মেজাজ নিয়ে জানালায় চোখ রেখে বসে আছি। আর কাকা উৎকর্ণ হয়ে আছেন কখন ট্র্যাভেল এজেন্সির গাইড আবার ধারাভাষ্য শুরু করবেন সেই আশায়।

আকাশ মুখ গোমড়া করে থাকায় এত সকালে চন্দ্রভাগার সৈকত ভালো ঠাহর হল না। সূর্যমন্দির পৌঁছতেই সূর্যদেব স্বমহিমায় ফিরে এলেন আবার। কী একটা সরকারি ছুটি থাকায় ভিড়টাও অসম্ভব হয়েছে আজ। মন্দিরটা চক্কর কেটে বেরিয়ে আসব, এমন সময় মনে হল কাকাকে অনেকক্ষণ দেখিনি। ধক করে উঠল বুকটা। আর কেসাং? কেসাং কোথায়? ওকেও তো খুঁজে পাচ্ছি না। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এল আমার।

আঁতিপাঁতি খুঁজেও যখন দু’জনের মধ্যে একজনেরও খোঁজ পেলাম না তখন সোজা গাড়ির দিকে দৌড়ে গেলাম। অবশ্য দূর থেকেই গাড়ির সীটে দু’জনকেই দেখতে পেয়ে শ্বাস ফিরে পেলাম যেন। তবে মাথাটা গরম হয়ে গেল পরমুহূর্তেই। লাফ মেরে গাড়িতে উঠেই চোটপাট শুরু করলাম, “কী আক্কেল গো তোমার কাকা, অ্যাঁ? না বলে কয়ে চলে এলে! আর কেসাং, তুমিই বা…”

বলেই খেয়াল করলাম কাকা ঘোলাটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টে। দুর্বল গলায় বললেন, “হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে রঘুনাথকে দেখে… স্পষ্ট দেখতে পেলাম খানিকটা দূর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। তারপর এগিয়ে যেতে যেতে বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল আমার দিকে। ওর চোখের ইশারা আমায় টানছিল ভীষণ।”

আমার চোখদুটো গোল্লা হয়ে গিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল।

“হ্যাঁ হ্যাঁ সোমনাথ ভাইয়া, আমি দেখলাম কাকাজী ভিড়ভাট্টা ঠেলেঠুলে কোথায় যেন ছুটে চলেছেন। আমিও পিছু নিলাম। একটু এগিয়েই দেখলাম, জংলায় ভরা একটা লেকের ধারে বসে আছেন থম মেরে। আমি টানতে টানতে বাসে নিয়ে এলাম। ভাবলাম, আপনি তো খুঁজতে খুঁজতে এখানে আসবেনই। কাকাজীকে একা ছেড়ে আপনাকে খুঁজতে যেতে সাহস পেলাম না। যদি আবার কোথাও… কিন্তু রঘুনাথ কে? কাকাকে তো জিগ্যেস করতে করতে জিভ খসে গেল আমার।”

আমি থতমত খেয়ে বললাম, “ওই আর কী। কাকার সাথে এক ব্যাটেলিয়নে চাকরি করতেন সিআরপিএফে। যাক গে, বাসে চলে এসে ভালোই করেছ কেসাং। নইলে সমস্যা হয়ে যেত ঠিকই।”

কাকার পাশে বসে গলাটা যতটুকু সম্ভব খাদে নামিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, “রঘুনাথ সিং মারা গেছেন কাকা। ত্রিপুরা লিবারেশন ফ্রন্টের ওই ছেলেটাই মেরে ফেলেছে ওঁকে। আর কতদিন এভাবে নিজেকে… উফ, ভাগবান!”

কাকা আকুলি-বিকুলি করে প্রতিবাদ করে উঠলেন, “না না, ওই ছেলেটি নয়। ওই ছেলেটি নয়। রঘুনাথকে গুলি করেছিল দিলমণি স্বয়ং। আমাকেই টার্গেট করেছিল নিশ্চয়ই। রঘুনাথ তেড়ে এসে সামনে না দাঁড়ালে বোধহয় ওর জায়গায় আমি থাকতাম আজ।”

আমি আর ঘাঁটালাম না কাকাকে। কাকার মানসিক অবস্থাটা কি… কীসব ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা জুড়ে দিয়েছেন ঘুরতে এসে!

এরপর অবশ্য বাকি স্পটগুলো একরকম নির্বিঘ্নেই দেখালাম কাকাকে। যদিও বেশ কড়া নজরে প্রায় বন্দী করে রেখেছিলাম কাকাকে আমি আর কেসাং মিলে। সত্যি বলতে কী, কেসাংয়ের আমাদের সঙ্গ নেওয়াটা খুব একটা পছন্দ করিনি তখন। কিন্তু কোনার্কে কাকাকে উদ্ধার করার ঘটনায় কেসাংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল আমার। তবে কাকা কেসাং সম্পর্কে সেই অনড়ই রইলেন আগাগোড়া। মাঝে একটা রেস্তোরাঁয় ডেলিভারি কাউন্টার থেকে কেসাং নিজেই ওঠে খাবারের প্লেটগুলো আনতে যাচ্ছিল। কাকার কড়া চাউনির জেরে কেসাংকে ক্ষান্ত করে আমিই নিয়ে এলাম শেষে। কেসাংয়ের আনা খাবার কাকা খাবেন না কিছুতেই।

কিন্তু খণ্ডগিরিতে যা ঘটে গেল তার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না একেবারেই। নিশ্চিত বাজিও উলটে যেতে দেখেছি অনেক। কিন্তু এভাবে! সে এক অভাবনীয় ঘটনা।

আহ! কেসাংটা বড্ড জ্বালাচ্ছে। এই নিয়ে চারবার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, বেল বাজাচ্ছে। ওর রহস্যটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। আমি খণ্ডগিরি থেকে ফিরে দেখি কেসাং নিজের রুমে বসে তাস খেলছে আরও তিন পার্টনারের সাথে। ম্যানেজারবাবুও জোর গলায় বললেন যে কেসাং নাকি আজ সারাদিন হোটেলের ভেতরেই ছিল। অথচ সেই সকাল সাতটা থেকে ও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে। এক মিনিটের জন্যেও আমাদের ছেড়ে যায়নি কোথাও।

কেসাং খাবার দিয়ে গেল। চোখমুখ আজ কেমন যেন ফোলা ফোলা একটু। ও কি নেশাভাঙ করে কিছু? নাকি কাকার জন্যে কান্নাকাটি করছিল? একটা প্রশ্নই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে মাথায়। কিছুতেই মেলাতে পারছি না। কেসাং সারাদিন হোটেলে থাকলে আমাদের সঙ্গের লোকটা তবে কে ছিল?

যাক গে, এখন আর মেলা না মেলা সব সমান। যে অপরাধ আমি করেছি তার শাস্তিটা বাকি আছে আছে এখনও। ওটা নিজের হাতেই তুলে নেব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। লেখাটা শেষ করেই…

খণ্ডগিরির ঘটনাটা আমায় লিখে রাখতেই হবে। নইলে অযথা একতরফা কলঙ্কের বোঝা… কিন্তু শরীরটা হঠাৎ এত খারাপ লাগছে কেন!

মাথাটা ভোম হয়ে আছে। চোখদু’টো ঝাপসা হয়ে ঘুম আসছে ভীষণ। কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। লিখতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আঙুলগুলো এভাবে বেঁকিয়ে উঠছে কেন?

একী! এটা এল কোত্থেকে হঠাৎ!

।।এগারো।।

“আলটিমেটলি উই হ্যাভ গট দ্য জেনুইন কাস্টমার আই থিঙ্ক। এবারে লোকটা ত্রিশ লাখ গেট পাস দিতে রাজি আছে। পরশু আসছে বলল উইথ ক্যাশ।”

“বেশ। কেসাংয়ের আগের দু’টো পার্টি তো জিনিসটা দেখতেই ত্রিশ লাখ লাগবে শুনে উলটো পথ ধরেছিল। আর কিনতে দু’কোটি লাগবে শুনতে পেলে তো বোধহয় হার্টফেলই করত। যাক গে, নয়নকে ইন্সট্রাকশন যা দেওয়ার দিয়ে দাও। আর ও যেন সতর্ক থাকে ভীষণ। ব্যাটা ইদানিং বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।”

“হুম, আবার একটু কড়কে দিতে হবে। কেসাং অবশ্য পার্টি সম্পর্কে পুরো ডিটেল পাঠিয়েছে। বেসিক্যালি কোলকাতার পার্টি, বিজনেস মায়ানমারের সাথে। জেনুইন স্মাগলার হিসেবে মার্কেটে বেশ পরিচিতি রয়েছে গত পনেরো বছর ধরে প্রায়।”

“যা হোক কিছু একটা করা দরকার তাড়াতাড়ি। জিনিসটা যে রিস্কে শেষ অবধি এখানে আনতে পেরেছিলাম সে তো তোমার জানাই আছে। বেশিদিন হাতে রেখে দিলে রিস্ক আরও বেড়ে যাবে। কোনদিন কোত্থেকে কোন বিপদ এসে হাজির হবে বলা যায় না। তাছাড়া দাম চড়তে চড়তে হঠাৎ করে পড়েও যায় এসব জিনিসের। এভাবে অপেক্ষা করা যাবে না বেশিদিন এটাকে নিয়ে।”

“তা ঠিক। এবারে ভাবছি একটু উপরনিচ করে হলেও ওটা ছেড়েই দেব। কী বলেন? জায়গাটারও বেশিদিন ভরসা নেই। শুনতে পাচ্ছি এই জায়গাটা নিয়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সাথে পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের একটা রফা হয়েছে। কীসের একটা কনস্ট্রাকশন শুরু হবে এখানে ইতিমধ্যেই। এরকম একটা জিনিস নিয়ে বারবার জায়গা বদল করাটা ভেরি রিস্কি।”

“দ্যাখো। কততে রাজি করাতে পার।”

“হুম। ওদিকে বিজুর কথা জিগ্যেস করলেই কেসাং বলছে শ্রীলঙ্কার পার্টিটা আরও কয়েকটা দিন সময় চাইছে। কেসাংটাও দুয়েকদিন ধরে কেমন যেন ভাসা ভাসা কথা বলছে। পার্টিটা পাঠাচ্ছে ঠিকই, তবে আগের সেই উৎসাহটা যেন দমে গেছে ওর।”

“হুম, টাকা নেওয়ার সময় দেখব উৎসাহ বাড়ে না কমে। বাই দ্য ওয়ে, সিংয়ের ব্যাপারে কী ভেবেছ? ওর ফ্যামিলিটা বেশ কষ্টে আছে শুনলাম।”

“ব্যাটা সবকিছু ফাঁস করে দেবার তালে না থাকলে সেদিন এভাবে ওপারে পৌঁছে যেত না। তবে আপনি বললে লাম্পসাম একটা কিছু জমা করে দেওয়া যায় ওর স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে।”

“ঠিক আছে, ভেবে দেখব। ডিলটা হোক আগে। প্রত্যেকটা স্টেপই নিতে হবে নিক্তি মেপে, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ক্যালকুলেশন করে।”

।।বারো।।

uponyasoperationynergy04বাগডোগরা থেকে উড়ে এসে আগরতলা এয়ারপোর্টের রানওয়েতে প্লেনের চাকা ছুঁতেই গাটা শিরশির করে উঠল একবার তন্ময়ের। উত্তরপূর্বের এই শ্যামলী রাজ্যটাতে ঘুরতে আসার ইচ্ছে ছিল বহুদিন ওর। কিন্তু প্রথমবারেই এভাবে এসে নামতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি ও। অভিমন্যু লাগেজ ক্যারাউজেল থেকে ব্যাগটা তুলে এগিয়ে গিয়ে ওপাশে গিয়ে চুপটি করে একটা চেয়ারে বসে রইলেন। তন্ময় অস্থির হয়ে উঠল, “একি! বসে পড়লে যে! যাবে না বাইরে? ওরা নিশ্চয়ই…”

“দাঁড়া, আর মিনিট দশেক পরেই কলকাতা থেকে একটা ফ্লাইট ল্যান্ড করবে। তখন বেরব একসাথে। ফ্লাইট অন টাইমে আছে।”

“কেন?”

অভিমন্যু একটু বিরক্ত হলেন, “আমাদের আসার কথা কোত্থেকে? আর আসছি কোত্থেকে?”

“ওহ, সরি সরি! নজর রাখতে পারে বলছ?”

“আলবাত!”

একটা টয়লেট খালি পেয়ে অভিমন্যু একটা নতুন নম্বর থেকে কোথায় একটা ফোন করলেন। কথা শেষ করে ছোট্ট ফোনটা আবার আগের মতো জুতোয় লুকিয়ে রাখলেন। আধঘণ্টা পর এগজিট গেট দিয়ে বেরিয়ে আসতেই একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। নির্দেশমতো অভিমন্যু আর তন্ময় রাস্তায় পার্ক করা একটা কালো কাঁচ তোলা গাড়ির দরজা খুলে বসতে গিয়ে দেখতে পেল ড্রাইভার ছাড়া আরও দু’জন বসে আছে এসি চালিয়ে। গাড়িতে বসা মাত্রই ক্ষিপ্রগতিতে হাতের ব্রিফকেস ফোনগুলো আর লাগেজটা পাশে বসা লোকটা কব্জা করে নিল। ব্রিফকেস খুলে একটা টাকার বান্ডিল তুলে নেড়েচেড়ে রেখে দিয়ে বলল, “ওয়েলকাম টু ত্রিপুরা। চলুন যাওয়া যাক। বেশি দূরে নয়, ভিআইপি রোড ধরে খানিকটা এগিয়ে গেলেই শালবাগান। তারপর…”

“আহ নয়ন! এত কথা বলছিস কেন? এই বেশি কথার জন্যেই একদিন মারা পড়বি দেখিস।” ঘাড় ফিরিয়ে নয়নকে ধমকে চুপ করিয়ে দিল ড্রাইভার। নয়নের মুখ থেকে ভকভক করে মিষ্টি মিষ্টি একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। অভিমন্যু বুঝলেন নয়ন প্রকৃতিস্থ নয় এই মুহূর্তে। ড্রাইভারের পাশে বসা লোকটা কোনও কথা বলছে না। বোবা না কালা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

লিচুবাগান থেকে বাঁদিকে বাঁক নিতেই নয়ন আবার মুখ খুলল, “সত্যি, এত হ্যান্ডসাম স্মাগলার আমি এই প্রথম দেখলাম। আপনি সিনেমায় কেন নামলেন না স্যার?” বলেই চোখমুখ টিপে খি খি করে হেসে উঠল। তন্ময়ের কান মাথা গরম হয়ে উঠছিল। অভিদার সাথে কাউকে এভাবে কথা বলতে দেখেনি কখনও সে। অভিমন্যু কিন্তু নির্বিকার। ঠোঁটে একটা স্মিতরেখা টেনে বসে রইলেন নিশ্চিন্তে।

ব্রহ্মকুণ্ড রোড থেকে নেমে তাদের গাড়িটা গান্ধিগ্রামের রাস্তায় ঢুকে যেতেই তন্ময় লক্ষ করল এয়ারপোর্টের পার্কিং লট থেকে ফলো করে আসা দু’টো বড়ো বড়ো প্রাইভেট কার হুঁশ হুঁশ করে সোজা রাস্তায় চলে গেল।

চারদিকে দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ঘেরা একটা পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা সবাই। গাড়িটা গান্ধিগ্রাম বাজারেই ছেড়ে দিয়েছিল নয়নেরা। চারদিকে ঘন গাছপালা সূর্যের আলো আটকে দেওয়ায় ঘরটা আবছা একটা অন্ধকারে ভরা। ইলেকট্রিক কানেকশন তো দূর, একটা চার্জার লাইটেরও ব্যবস্থা নেই। ঘরের ঠিক মধ্যিখানে একটা টেবিলের ওপাশে একজন বেশ লম্বা চওড়া চেহারার লোক বসে আছে। ইয়া মোটা কাঁচাপাকা গোঁফ নাকের নীচে। চেহারাটা কেমন যেন আবছা আবছা পরিচিত মনে হচ্ছে তন্ময়ের। কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছে না।

“আসুন মিঃ মল্লিক। উনি?”

“আমার পার্টনার।”

ভদ্রলোক কথা বলতেই চমকে উঠল ও। লোকটা বাঙালি? নাকি বাংলা জানে, অন্য জাতি? এতক্ষণ তো উত্তর ভারতের লোক বলেই নিশ্চিত ছিল তন্ময়। তবে তখনও আরেকটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তাদের জন্যে। কয়েক সেকেন্ডর মধ্যেই ফোনে কথা বলতে বলতে পেছনের দরমার বেড়া ঠেলে একজন উপজাতি সম্প্রদায়ের লোক এসে বসল ওই মোটা গোঁফের পাশের চেয়ারে। এবার শুধু তন্ময় নয় অভিমন্যুও যেন একটু নড়ে উঠলেন। ভুরু কুঁচকে উঠতে না উঠতেই সামলে নিয়ে নির্বিকার মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বসে রইলেন।

ওদিকে তন্ময়ের তো মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। কেসাং! কেসাং এখানে কীভাবে! ওর কাছে তো এখন একটা মাছিও গলতে পারবে না এসপির পারমিশন ছাড়া। তবে?

“নয়ন, গেট পাস ঠিক আছে তো?” উপজাতি লোকটা জিগ্যেস করলেন নয়নকে।

“হ্যাঁ স্যার, চেক করে নিয়েছি।”

“ঠিক আছে, বাইরে গিয়ে নজর রাখ তোরা।”

 কেসাংয়ের আর লোকটার বাংলা এক্সেন্ট এক নয়। তন্ময় আবার ভ্যাকাচ্যাকা খেয়ে গেল। এটা কেসাং নয়। কেসাং হতেই পারে না। তবে লোকটা কে? যেন কেসাংয়ের মুখটাই লোকটার মুখে এনে বসিয়ে দিয়ে গেছে কেউ।

গোঁফওয়ালা বললেন, “ও হ্যাঁ, প্রাইস নিয়ে কোনও কম্প্রোমাইজ নয় মিঃ মল্লিক। সরি! যা দিয়ে কিনছেন তার থেকে ফিফটি পারসেন্ট দাম বেশি পেয়ে যাবেন বার্মা বর্ডারে।”

অভিমন্যু হা হা করে উঠলেন, “সেকি! একটু কিছু তো কনসিডার করতেই হবে স্যার। বাজার এখন অতটা চাঙ্গা নয়।”

টেবিলের ওপাশের দু’জন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। অভিমন্যু হেসে উঠে বললেন, “ঠিক আছে, দেখান তো আগে জিনিসটা। তারপর নয় প্রাইসটা ফিক্স করা যাবে।”

উঠে গিয়ে দরমার বেড়ার ওপাশ থেকে একটা লোহার ছোটো সিন্দুক টানতে টানতে নিয়ে এল সেই উপজাতি লোকটা। তন্ময়ের বুকের ধুকপুকুনিটা অসম্ভব বেড়ে যেতে লাগল। এই সেই জিনিস যার জন্যে এত হাঙ্গামা। নম্বর মিলিয়ে সিন্দুকের ডালাটা খুলে তুলে ধরতেই অভিমন্যু আর তন্ময় ঝুঁকে পড়ল জিনিসটার দিকে। এই তবে সেই গেইতংপা!

জিনিসটা দেখেশুনে একপলক হাতের ঘড়িটায় দৃষ্টি দিয়ে অভিমন্যু দরদাম নিয়ে কথা বলতে যাবেন এমন সময় পায়ে অসম্ভব সুড়সুড়ি দিয়ে সাইলেন্ট উইথ ভাইব্রেশন মোডে জুতোয় লুকিয়ে রাখা ফোনটা হঠাৎ গোঁ গোঁ করতে লাগল। অভিমন্যু যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

নয়নের দলটা তখন কোথায় ছিল কে জানে, বন্যজন্তুর মতো তাড়া খেয়ে হঠাৎ হুড়মুড় করে দরজায় ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকতেই পেছন পেছন একদল ফৌজ এসে টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। তন্ময় গলা বাড়িয়ে দেখে নিল পুরো ঘরটাকে বাইরে থেকে কর্ডন করে বন্দুকের নিশানায় রেখেছে এক বিশাল ফৌজ। পুলিশ, আসাম রাইফেলস, ত্রিপুরা ষ্টেট রাইফেলস আর সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশে একেবারে ছয়লাপ চারদিক।

এদের মধ্যে উড়িষ্যা পুলিশের একমাত্র প্রতিনিধি ইনস্পেকটর রাউত এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াতেই অভিমন্যু ওপাশের গোঁফওয়ালাকে লক্ষ্য করে বললেন, “খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল গরু কিনে।”

“উঁহু, যে সে গরু নয়, এঁড়ে গরু।” পাশে দাঁড়িয়ে ফুট কাটলেন এসপি সদর প্রবাল মজুমদার।

“চলুন মিঃ রবিন চট্টরাজ। অযথা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। দিলমণি, তোমায় নিশ্চয়ই আলাদা করে নেমন্তন্ন দিতে হবে না?”

অসহায় চোখে একে অপরকে দেখে নিয়ে সোজা ভ্যানে গিয়ে উঠল রবিন আর দিলমণি। দু’জনেই টের পেয়ে গেল এখানে বিন্দুমাত্র চালাকি করার চেষ্টা করলে সোজা এনকাউন্টার করে দেবে। নয়ন তার দলবলসহ আগেই উঠে বসে আছে ভ্যানে। সিন্দুকটা সিল করে এসপি সায়েবের গাড়িতে তুলে দিল দু’জন সিপাহি।

।।তেরো।।

রাত সাড়ে আটটা। এসপি প্রবাল মজুমদারের সুসজ্জিত কোয়ার্টারে বসে আছেন অভিমন্যু, মিঃ রাউত, তন্ময় আর প্রবাল নিজে। পুরো ঘটনা আদ্যোপান্ত না শুনে তিনি ছাড়বেন না বলে রেখেছিলেন গান্ধিগ্রাম থেকে ফেরার পথেই। তাই নিজের কোয়ার্টারে আজ ডিনারের নেমন্তন্ন করেছেন অভিমন্যুদের।

স্যুপের বাটি হাতে হাতে এগিয়ে দিতে দিতে তাড়া দিলেন প্রবাল, “নিন, এবার শুরু করুন মিঃ রক্ষিত। তারপর ডিনারে বসে গেলে হয়তো জমবে না তেমন। একেবারে গোড়া থেকে শুনতে চাই কিন্তু।”

অভিমন্যু একচিলতে হেসে বলতে শুরু করলেন, “গোড়া থেকেই বলছি শুনুন। আপনারা যেমন মাঝে মাঝে সিনার্জি অপারেশনে বের হন, ঠিক সেভাবেই এগিয়েছে গোটা ঘটনা। কখনই কোথাও এককভাবে কাজ হয়নি। তদুপরি এখানে দু’টো আলাদা আলাদা ঘটনা রয়েছে যা এখন এক হয়ে গেছে ধরা যায়।”

“সর্বনাশ! ঘটনাতেও সিনার্জি নাকি?” হাসতে লাগলেন প্রবাল।

“হ্যাঁ, বলতে পারেন। আমি কিন্তু প্রথমে ইনভেস্টিগেট করতে শুরু করি এই চুরি যাওয়া গাইতংপা নিয়ে। পুরীর কেস হাতে আসেনি তখনও। কিন্তু গাইতংপার কোনও ক্লু, কোনও লিঙ্ক হাতে আসছিল না অনেকদিন। অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম ভেতরে ভেতরে। হঠাৎ একদিন আমার এক মাস্টারমশাই তাঁর এক প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে এসে বললেন উনার ছেলেকে পুরীর সী বীচে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। কাকা ভাইপো মিলে বেড়াতে গিয়েছিল। কাকা নিখোঁজ। ইচ্ছে না ছিল না, কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে কেসটা নিলাম। এদিকে গাইতংপা নিয়েও এগোতে পারছিলাম না। তাই পুরীর কেসেই মন দিলাম। ক্লায়েন্টের বাড়ি একবার ঘুরে এসে ব্যবস্থাপত্র সেরে রওনা দিলাম পুরী।”

“এক-এক মিনিট, এই গাইতংপা জিনিসটা একটু খোলসা করে বলবেন প্লীজ? দিল্লি থেকে পর্যন্ত মেল এল আমার কাছে এ নিয়ে।”

মিঃ রাউত ভীষণ উৎসাহী হয়ে অভিমন্যুর অনুমতি নিয়ে গাইতংপা সম্পর্কে সেদিন যা যা অভিমন্যুর মুখে জেনেছিলেন গুছিয়ে বললেন।

“হুম, চোরাবাজারে এর ভ্যালু কত হবে মিঃ রক্ষিত?” প্রবাল প্রশ্ন করলেন।

“তা ধরুন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় কোটি তিনেক।”

“ওরে বাবা! এত মূল্যবান জিনিস?”

“টাকার মূল্যে যাই হোক না কেন, এর ঐতিহাসিক মূল্য কিন্তু বিশাল। আর সেই ভিত্তিতেই এধরনের জিনিসগুলোর বেচাকেনার মূল্য নির্ধারিত হয়। এই গাইতংপাও যে সে জিনিস নয়। প্রথমত এর বয়স একহাজার বছর। দুই, মোট তিনশো পাঁচ পৃষ্ঠা সম্বলিত চার ফুট লম্বা আর আড়াই ফুট চওড়া মূল্যবান কাঠের তৈরি এই পুঁথিটি আগাগোড়া সোনার জলে লেখা। প্রতিটি পাতাই একেকটা কাঠের পাটা। তাছাড়া সূক্ষ্ম কাজ করা খুব সুন্দর এক বুদ্ধের মূর্তি তৈরি করে মলাটটা বানানো হয়েছে। গোটা পুঁথিটির ওজন প্রায় চল্লিশ কেজি।”

“ওহ্‌ মাই গড! তা, পুরীর রিপোর্ট বলুন।”

“সোমনাথের রুম সার্চ করে বেশি কিছু পেলাম না। ম্যানেজারকে লেখা একটা চিঠি ছিল, তা অনেক আগেই মিঃ রাউত হস্তগত করেছেন। শুধু দরজার হাতলে কালচে হয়ে আসা একটু রক্তমতো নজরে এল। আর টিভির নীচ থেকে পেলাম এক স্ট্রিপ মিডোড্রাইন হাইড্রোক্লোরাইড। তবে সবক’টি ট্যাবলেটই অক্ষত রয়েছে। হোটেলে কয়েকজনকে মামুলি জিজ্ঞাসাবাদ করে স্যাম্পল নিয়ে সোজা চলে এলাম খণ্ডগিরিতে, মিঃ রাউতের কাছে। সেখানে সোমনাথ আর তাঁর কাকার লাগেজ ঘেঁটেও কিছু পাওয়া গেল না।”

“মিডোড্রাইন জিনিসটা কী?” জিগ্যেস করে নড়েচড়ে বসলেন প্রবাল।

“অ্যান্টিহাইপোটেনসিভ ড্রাগ। এমনিতে নিরীহ, কিন্তু অতিমাত্রায় ইনটেক করলে ব্লাড প্রেশার এতটাই বেড়ে যাবে যে অ্যাওরটাসহ বিভিন্ন আর্টারি ভেইন ফেটে অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে একটা লোক। ধন্দে পড়ে গেলাম, এরকম একটা বিপজ্জনক ড্রাগ এদের রুমে কেন! কাকা ভাইপোর মধ্যে কার হাইপোটেনশন আছে! নাকি এটা অন্য কারও, কত কত বোর্ডারই তো চেক ইন চেক আউট করছে হোটেলে রোজ। শেষে দুয়ে দুয়ে চার হয় সোমনাথের ফাইনাল পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা হাতে পাওয়ার পর।”

“তারপর?”

“এদিকে মিঃ রাউত তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। কেসাং পালিয়েছে। আর বিজু নামে একটা ছেলে ঘটনার আগেরদিনই বাড়ি গেছে ছুটি নিয়ে। রবিন চট্টরাজ নিখোঁজ খণ্ডগিরি থেকে। ওখানে কী হয়েছিল কেউ বলতে পারছে না। মনে হল কেসাংকে পেলে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারতাম। অনেক ভেবেচিন্তে তনু মানে ওকে পাঠালাম কেসাংয়ের খোঁজখবরে। ও কালিম্পঙে একটা হোটেলে থেকে নিজের কাজ করতে লাগল। অ্যাই, এরপর তোর ব্যাপারটা তুইই বল না রে, তনু!”

তন্ময় হঠাৎ একটু ভড়কে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। গলাটা পরিষ্কার করে বলল, “কালিম্পঙে গিয়েই প্রথমে থানায় যোগাযোগ করি। আমি কে, কেন এসেছি সব জানিয়ে রাখলাম অভিদার পরামর্শমতো। কেসাং সম্পর্কে একটা দারুণ ইনফরমেশন পেলাম থানা থেকে। তারপর হোটেলে বসে টোপ ফেলতে শুরু করলাম। কেসাং গাইতংপার সাথে জড়িত সে ব্যাপারে প্রথমে কোনও ধারণাই ছিল না আমাদের। কেসাংকে খুঁজে বের করে ও পুরী থেকে পালিয়েছিল কেন এটাই জানতে এসেছিলাম। থানায় খোঁজখবর করতে করতে জানলাম কেসাং আগে জুয়া খেলার অপরাধে ধরা পড়েছে। আমিও জুয়ার ফাঁদ পাতলাম। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে টাকা লাগাব বলে বুকি খুঁজতে শুরু করলাম। ভাব জমিয়ে একটা বেয়ারাকে খোঁচাতে শুরু করে দিলাম অনবরত। তিনদিন পর কেসাং ফাঁদে পা দিল। কিন্তু ফাঁদে পা দিয়ে দুয়েকটা কথাবার্তার পরই বুঝে গেল আমি ফেক পার্টি। উদ্দেশ্য হয়তো অন্য কিছু। রাতে হোটেলের ছাদে কায়দা করে ডেকে এনে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দিয়ে গেল মাথায়।”

“হ্যাঁ, সেদিন আমার রামেশ্বরমে শেষদিন।” অভিমন্যু বললেন।

“রামেশ্বরমে কেন? বিজুকে ধাওয়া করেছিলেন নাকি?” প্রবাল রহস্যের গন্ধ পেলেন।

“ঠিক। তবে ব্লাইন্ড চেজ নয়। এক সোর্স মারফৎ খবর পেলাম বৌদ্ধদের কিছু একটা অ্যান্টিক পিসের হাতবদল হতে যাচ্ছে কোডাণ্ডার রামমন্দিরের কাছে। শরীরের রক্ত হঠাৎ দৌড়োতে শুরু করে দিল। তখনও জানি না জিনিসটা কী। ভুবনেশ্বর থেকে রওনা হলাম মিঃ রাউতকে সঙ্গে করে। আফটার অল পুরীর কেসের আইও উনি। আর বিজুর সাথেও কেসটার একটা সম্পর্ক তো রয়েইছে।”

রাউত বললেন, “মিঃ রক্ষিতের দুর্দম সাহসের সাথে সেই প্রথম পরিচয় আমার। লোকাল থানার সাথে প্ল্যান করে প্রায় নাটকীয়ভাবে আমরা বিজু আর ওর এক সাগরেদকে পাকড়াতে পারলাম। তবে শ্রীলঙ্কার এজেন্টটা ফসকে গেল।”

“হ্যাঁ, রামেশ্বরমেই খবর পাই কেসাংয়ের বাড়ি অবধি খুঁজে বের করে ফেলেছে তনু। কেসাং বাড়ি ছিল না। তবে ওর ঘরে কিছু জামাকাপড় আর জুতোর সাইজের ওপর তনুর সন্দেহের নজর পড়েছিল যেগুলো অন্তত কেসাংয়ের হতে পারে না। তখনও আঁচ করতে পারিনি যে খণ্ডগিরি থেকে সোজা কেসাংয়ের বাড়ি এসে উঠেছেন মেজর রবিন চট্টরাজ।”

“পরে কীভাবে শিওর হলেন?”

“কেসাংকে জেরা করে। ক্রিকেট ম্যাচের দিন প্ল্যান ওয়াইজ তনুর হোটেলের বেয়ারাটাকে তুলে নিয়ে গেল কালিম্পং পুলিশ। ওর পেট থেকেই বেরোল যে বিশাল অঙ্কের বেটিং চলবে কেসাংয়ের আড্ডায় আজ। আস্তানাও উগড়ে দিল। পুলিশ সময়মতো গিয়ে কেসাংকে তুলে আনল। প্রথমদিন বরফ তেমন গলল না। কিন্তু দ্বিতীয়দিন আর স্থির থাকতে পারল না কেসাং। যেই বললাম বিজু ধরা পড়েছে আর সবকথা বলে দিয়েছে তখন গড়গড় করে সব বের করতে শুরু করল।

“সোমনাথের একটা ডায়েরির কথা উল্লেখ করেছিল প্রথমদিন রাতেই। বলল, পুরীর হোটেলের ম্যানেজারের কাছে রয়েছে সেটা। রাতেই মিঃ রাউতকে ফোনে ধরলাম। অনুরোধ করলাম, ম্যানেজারকে অ্যারেস্ট করে ডায়েরিটা নিয়ে কালিম্পং যেন চলে আসেন। তার আসামী পাওয়া গেছে।”

“কী ছিল ডায়েরিতে?” প্রবাল যেন কৌতূহল আর দমিয়ে রাখতে পারছেন না। এর মধ্যেই খাবারের জন্যে বেয়ারা অনুমতি নিতে এসেছিল একবার। প্রবাল আধঘণ্টা সময় বাড়িয়ে নিলেন।

“ডায়েরিটা আমার ব্যাগেই আছে। বের করছি স্যার।” বলে রাউত ডায়েরিটা এগিয়ে দিলেন।

প্রবাল পড়তে শুরু করে দিলেন।

uponyasoperationsynergy05পড়া শেষ করে ডায়েরির পাতার নীচের দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রবাল জিগ্যেস করলেন, “এই স্পটটা কীসের মিঃ রক্ষিত? কালির তো মনে হচ্ছে না।”

“খুব সম্ভব রক্তের। সোমনাথের খাবারে মিডোড্রাইন মেশানো হয়েছিল যেটা সোমনাথই কেসাংকে দিয়েছিল। আর আমি আগেই বলেছি ড্রাগটা বেশীমাত্রায় খেলে শিরা উপশিরা ছিঁড়ে রক্ত বেরোতে শুরু হয়। যে কারণে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সোমনাথের কানের ছিদ্রের গভীরে ব্লাড পাওয়া গিয়েছিল। নাকের রক্তটা হয়তো সমুদ্রের জলে মিশে সাফ হয়ে গেছে। আমার যতদূর ধারণা, এই একফোঁটা রক্ত সোমনাথ খাটে বসে বা শুয়ে নিচু হয়ে লিখতে গিয়ে ওর নাক থেকে পড়েছিল। এতেই হয়তো ভয় পেয়ে আর কিছু লিখে যেতে পারেনি।”

“সেকি! কে বিষ মিশিয়েছিল? কেসাং?”

“উঁহু, দিলমণি রাঙ্খল স্বয়ং। সঙ্গে আমার জোর ধারণা, ম্যানেজারও জড়িত ছিল। প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে তো বটেই।”

“দি-ল-ম-ণি!” মুখটা আক্ষরিক অর্থেই হা হয়ে গেল প্রবালের। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বললেন, “দিলমণি পুরীতে কী করছিল? আস্তে আস্তে ফ্রন্টে ভাঙন ধরায় ও তো এমনিতেই একদিন সারেন্ডার প্রপোজাল পাঠিয়ে ধরা দিয়েছিল। সারেন্ডার করার পর ওকে পুনর্বাসন দিয়ে একটা চাকরিও দেওয়া হয়েছিল।”

“দিলমণিকে পুরীতে ডেকে এনেছিল কেসাং আর রবিন মিলে। গাইতংপা তখনও দিলমণির হেপাজতেই ছিল। বোধহয় এই নিয়েই তাদের মিটিং করার কথা ছিল পুরীতে, যেহেতু জীবিত তিন পার্টনারের মধ্যে দু’জনই সেখানে উপস্থিত ছিল। তবে রবিন কিন্তু ধারণাও করতে পারেনি যে কেসাং পুরীতে তাদের হোটেলেই বর্তমান আছে। পরে হয়তো মিটিংটা প্ল্যান করেছিল তারা।”

“দিলমণির কাছে গাইতংপা এল কী করে মিঃ রক্ষিত?”

“বলছি। তবে আগে সোমনাথের ব্যাপারটা শেষ করে নিই। সোমনাথ নিজের ডায়েরিতে একটা পাপের কথা বলেছে। কিন্তু পাপটা কী সেটা লিখে যায়নি। পাপটা হল, সোমনাথ কাকার বিশাল অঙ্কের জমানো টাকার মোহে পড়ে কাকাকে খুন করতেই পুরী এনেছিল। খুনটা নিজের হাতে না করে কেসাংকে আগে থাকতেই ঠিক করে রেখেছিল ত্রিশ হাজার টাকার বিনিময়ে। ওই হোটেলে এর আগে ক’বার আসা যাওয়ার সুবাদে কেসাংয়ের সাথে খুব ভালো পরিচয় ছিল ওর। কাজটাও সোজা, কাকার হার্টে সমস্যা আছে সে কলকাতায় ডাক্তারের মুখে শুনেছিল। খুঁজে খুঁজে এমন একটা ওষুধ বের করল যা কোনওরকমে খাইয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। হার্ট একদম চৌচির করে দেবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এক স্ট্রিপ কেসাংকে দিয়ে আরেক স্ট্রিপ নিশ্চয়ই টিভির নীচে লুকিয়ে রেখেছিল নিজেই। দরকারমতো ব্যবহার করা যাবে ভেবে।

“কিন্তু ওই যে, রাখে কৃষ্ণ মারে কে! রবিনকে দেখামাত্রই কেসাং ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। রবিনই যে সোমনাথের কাকা তা তো ওর আগে জানার কথা নয়। কিন্তু হাবভাবে বিন্দুমাত্রও প্রকাশ করল না সে কথা। এই মেজরসাবই বছর দুয়েক আগে কেসাংদের পৈতৃক সম্পত্তি সেই গাইতংপা কিনে নিয়েছিলেন। অর্ধেক পেমেন্ট হয়েছিল। বাকি পঞ্চাশ লাখ জিনিসটা বিক্রি করার সাথে সাথেই পাঠিয়ে দেবেন কথা ছিল।

“মেজরের একজন পার্টনার ছিল। সে হচ্ছে দিলমণি। দিলমণিই জিনিসটার সন্ধান পেয়েছিল কালিম্পঙে। কিন্তু কোনওমতেই সুরক্ষিত অবস্থায় স্থানান্তরিত করতে সাহস পাচ্ছিল না। একবার কলকাতা থেকে ফেরার সময় পরিচয় হয় মেজরের সাথে। দিলমণি নিজেকে ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয়। মেজর ছুটি কাটিয়ে ক্যাম্পে ফিরছিলেন ত্রিপুরাতে। কিছুক্ষণ কথা বলেই দিলমণি বুঝে যায় মেজর হচ্ছেন সেই লোক যাকে ঢাল বানিয়ে গাইতংপা সরিয়ে আনা যাবে পেমলিংয়ের ঘন জঙ্গল থেকে। মেজরের ভেতরে লোভ আছে। সাহস আর কায়দা করে পার্টনারশিপটা অফার করতেই মেজর লুফে নেন। পরে রঘুনাথকে সঙ্গে নেন।

“তো, পুরীর হোটেলে মেজরকে দেখেই মত বদলে ফেলে কেসাং। কারণ, জিনিসটার পেমেন্ট এখনও অর্ধেক বাকি। সুযোগ বুঝে ভাইপোর কীর্তি ফাঁস করে দেয় কাকার কাছে। কাকা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার সিদ্ধান্ত নেন। সোমনাথ কন্ডাক্টেড ট্যুরের প্ল্যান করল আর মেজর সোমনাথকে পুরীর অনেক বাইরে শেষ করে দেওয়ার মতলব আঁটল। ততদিনে দিলমণি পুরী চলে এসেছে তড়িঘড়ি। এই কেসে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট যেটা তা হচ্ছে একেবারে হুবহু না হলেও কেসাং আর দিলমণির চেহারায় এতটা মিল আছে যে চট করে ঘনিষ্ঠজনেরাও আলাদা করে উঠতে পারবে না। আমিও প্রথমে ধোঁকা খেয়ে গিয়েছিলাম আজ গান্ধিগ্রামে ওদের আড্ডায় কিছুক্ষণের জন্যে।

“যাই হোক, স্লট্যার-হাউস হিসেবে খণ্ডগিরিই ঠিক হয়। ওখানে একই দলের টুরিস্টরা সবাই যে যার ভাবে এতটাই দলছুট হয়ে পড়েন যে কেউ কারও খোঁজ রাখেন না যতক্ষণ সময় পাওয়া যায়। দিলমণিকে হোটেলে বসিয়ে কেসাংকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় এই কাজের। কারণ, কেসাংয়ের জায়গায় দিলমণি গেলে সোমনাথের চোখে ধরা পড়ে যেতে পারে। খণ্ডগিরির গুহার চাতালে সবাই মিলে উঠতে না উঠতেই দেখতে দেখতে কালো মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। উঠল তুমুল ঘূর্ণিঝড় বেশ কিছুক্ষণের জন্যে। মেজরদের কাজটা সহজ হয়ে গেল আরও। অন্যান্য টুরিস্টরা দৌড়ে নেমে এলেও কেসাং দৌড়ে উলটে পাশের জঙ্গলে গিয়ে ঢুকতেই পেছনে পেছনে প্রথমে মেজর এবং শেষে হতবুদ্ধি হয়ে সোমনাথ দৌড়ে যায়।

“সুবিধেমতো জায়গা পেয়েই কেসাং সোমনাথেরই দেওয়া মিডোড্রাইন গোলা ছোট্ট একটা জলের বোতল বের করে। ভাটার মতো চোখ নিয়ে মেজর চেপে ধরেন ভাইপোর গলা। এরই মধ্যে ঘটে যায় এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ধস্তাধস্তি চলার সময় গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে এক বিকৃত মস্তিষ্কের যমদূত। হাতে তার একটা শক্ত গাছের ডাল। বেরিয়ে এসে অতর্কিতে মেজরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই সোমনাথ সুযোগ বুঝে পালিয়ে যায়। কেসাং পিছু নিয়েই আবার ফিরে আসে গুলির শব্দে। ততক্ষণে মানসিক ভারসাম্যহীনের দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থরথর করে কাঁপছে। মেজর রিভলভার উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হিংস্র বাঘের মতো চেহারা নিয়ে। কাল বিলম্ব না করে অসাড় দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে একটা গুহার ভেতরে ফেলে পালিয়ে যায় মেজর আর কেসাং। তারপর হোটেল থেকে চারদিন পর পালায় দিলমণি। গিয়ে একসাথে জমা হয় কেসাংয়ের বাড়িতে। সেদিন কেসাংয়ের বাড়িতে যাওয়ার সময় দূর থেকেই ওরা তনুকে দেখতে পেয়ে আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছিল। তবে কেসাং তখন কালিম্পঙেই ছিল। মেজর আর দিলমণি হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, যে বাড়ি থেকে বছর দুয়েক আগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একটা মূল্যবান জিনিস তুলে নিয়ে গিয়েছিল অনেকদূরে, আবার একদিন তাড়া খেয়ে এখানেই এসে আত্মগোপন করে থাকতে হবে।”

“তার মানে গাইতংপা কেসাং ভুটিয়ার বাড়িতেই ছিল তিব্বত থেকে চুরি যাওয়ার পর?” আশ্চর্য কৌতূহলে গলার পারদটা একটু উঁচুতেই চড়ে গেল প্রবালের।

“হ্যাঁ, হয়তো তার কোনও পূর্বপুরুষ নিয়ে এসেছিল তিব্বত থেকে পালিয়ে। সে ইতিহাস জানা নেই এখনও আমার। বছর দুয়েক আগে একদিন জিপসি গাড়ি করে মেজর, রঘুনাথ সিং, দিলমণি আর কেসাং মিলে এই গাইতংপা হাজার কিলোমিটারের ওপর রাস্তা পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরায় নিয়ে এসেছিল। রেখেছিলেন হাতের নাগালেই – নিজের ক্যাম্পের কাছেই ওই জঙ্গলে। দিলমণি আর মেজরের গোপন আঁতাতের ব্যাপারটা সিনিয়র ইনস্পেকটর রঘুনাথ সিং কোনওমতে জেনে ফেলেছিলেন আগেই। মেজর তাকে টোপ দিয়ে দলে টেনে নেন। পরে মতান্তরের জেরে এক বৈরী বিরোধী অভিযানে টেকনিক্যালি খতম করে দেন।”

কথা শেষ করে খানিকটা জল খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলেন অভিমন্যু। প্রবাল একটুক্ষণ থম মেরে থেকে বললেন, “আচ্ছা মিঃ রক্ষিত, সোমনাথ কি সুইসাইড করতে চেয়েছিল?”

“হলফ করে বলা যায় না। তবে হোটেল ম্যানেজারকে লেখা ওর চিঠি আর ডায়েরি থেকে এটা আপাতস্পষ্ট।”

“কিন্তু তাকে সমুদ্রে এনে ফেলল কে?” অনেকক্ষণ পর এবার তন্ময় মুখ খুলল।

“দিলমণি আর খোদ মেজর মিলে। খণ্ডগিরি থেকে মেজর রাতের অন্ধকারে পুরী ফিরে এসেছিলেন ভাইপোর মৃত্যু নিশ্চিত করতে। যদিও ঘণ্টা দুয়েক আগে যখন আমি ওকে জেরা করছিলাম তখনও স্বীকার করেননি তিনি। আলাদা করে দিলমণিকে ভাঙতেই জানতে পারলাম। তবে কেসাং সেদিন জেরার উত্তরে মিথ্যে কথা বলেছিল। সোমনাথের খাবার কেসাং নয় দিলমণিই রুমে পৌঁছে দিয়েছিল। ধরা পড়ার ভয়ে সোমনাথের সাথে কোনও কথাবার্তা বলেনি। কেসাং খণ্ডগিরি থেকে পালিয়েছিল বলেই ডায়েরিটা দিলমণি কেসাংয়ের কাপড় জামা পেঁচিয়ে ম্যানেজারের ঘরে রেখে এসেছিল। ম্যানেজার হয়তো জানত না প্রথমে। দিলমণিও একটা ভুল করেছিল। ডায়েরিটা পুড়িয়ে ফেলেনি। হয়তো তেমন গুরুত্ব দেয়নি, পড়েও দেখেনি ভালো করে।”

এবার ইনস্পেকটর রাউত বললেন, “কিন্তু একটা কথা মাথায় ঢুকছে না মিঃ রক্ষিত।”

“কোনটা বলুন?”

“আপনি তো আমায় কালিম্পঙে সোমনাথের ডায়েরিসহ ডেকে পাঠিয়ে তারপর গতকাল চুপিচুপি আগরতলা পাঠিয়ে দিলেন এসপি সাহেবের সাথে প্ল্যান করে সব ঠিক করে রাখতে। সেই হিসেবেই রেইডটা হল আজ। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার যেটা, আপনার ফোনটা তো গাড়িতেই ছিনিয়ে নিয়েছিল ওরা। তন্ময়েরটাও। নিশ্চয়ই সুইচড অফ করেই রেখেছিল। তো, আপনার ফোন ট্র্যাক হল কী করে? ফোনটা ট্র্যাকিংয়ে ঝামেলা হলে তো আমরা স্পটটাই খুঁজে পেতাম না।”

অভিমন্যু মুচকি হেসে বললেন, “ওহ, এই ব্যাপার? আমি আমার অন্য আরেকটা ফোন নম্বর দিয়েছিলাম এসপি সাহেবকে। ওদের সাথে কথা বলেছিলাম আলাদা নম্বর থেকে। ফোনটা লুকিয়ে রেখেছিলাম জুতোর ভেতরে। তবে ভয় ছিল, ওরা মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে না সার্চ করে। ধরা পড়ে গেলে অন্য রাস্তা বের করতে হত। চলুন চলুন, বাকি কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে ডাইনিং টেবিলে কথা হবে। খিদেয় পেট জ্বলছে। ও হ্যাঁ, অফিসিয়ালি সব ক্রেডিট কিন্তু আপনার মিঃ রাউত। আপনার ওপরওয়ালাদের সাথে আমার এমনটাই শর্ত রয়েছে।”

খেতে বসে অভিমন্যু আঁতকে উঠলেন, “আরেব্বাস! করেছেন কী স্যার! তিন-তিনরকমের মাংস কেন?”

প্রবাল মুচকি হেসে বললেন, “মাংস বলতে পিওরলি দু’রকমেরই। পাঁঠার কষা আর মুরগির রোস্ট। আর ওটিতে শুধু মাংস নয় আরও অনেককিছু মিশিয়ে রান্না হয়েছে। এখানকার আদিবাসীদের স্পেশাল ডিশ, গোদক। আরে বুঝলেন না, সিনার্জি মশাই, সিনার্জি!”

এবারে একসাথে হা হা করে হেসে উঠলেন সবাই।

গ্রাফিক্‌স্‌-সুতপা নাথ

রাজীব কুমার সাহার সমস্ত লেখা

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s