গল্প আয়না শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য বসন্ত ২০১৭

শিবশঙ্কর ভট্টাচার্যের  আগের বারোটি গল্পের সংগ্রহ

golpoayna02-medium

               পুজোর ছুটি ফুরিয়ে এল। বাতাসে শীত শীত ভাব। সকালের রোদ্দুরে হলুদ রঙের ছোঁয়া। মুন্নি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িভর্তি লোকজন, ওর দিকে নজর নেই তেমন বড়োদের। পুতুলদের শরীর ভালো নেই। ওদের সক্কলের সর্দি হয়েছে বলে মুন্নি বেজায় ব্যস্ত। একা মানুষ, কী যে করে!   ছেলে-মেয়েদের সকাল থেকে সারা গায়ে কাপড় জড়িয়ে রোদ্দুরে শুইয়ে রেখে এল ছাতের ঘরের দিকে।

               “একা একা চল্‌লি কোথায় মুন্নি?” মা ডাকল রান্নাঘর থেকে।

               “ডাক্তারবাবুকে খবর দিতে।”

               “কী হল আবার।”

               “ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে আর পারি না! কথা শোনে না একদম। গায়ে জামা থাকে না, জুতো মোজা নেই পায়ে। দিন রাত্তির টো টো করে বেড়ায়।”

               “তাই নাকি!”

               “হ্যাঁ গো। খুব সর্দি হয়েছে সব কটার!”

               “তোমার মাথায় টুপি কোথায় গেল?”

               সাড়া না দিয়ে দুপ্‌দুপিয়ে পালাল মুন্নি, যেন শুনতেই পায়নি। ধরে ফেলতে পারলে মা এক্ষুনি ওকে তেল মাখাতে বসাবে।

               “খালি পায়ে যাস না মুন্নি।”

               পেছন থেকে মার চেঁচামেচি কানে এলেও এক দৌড়ে মুন্নি সোজা ছাতের ঘরে।

               “ডাক্তারবাবু কী করছিস রে?”

               ছোটমামা রং তুলি নিয়ে কাজে ব্যস্ত। মুন্নি এসে বসল সটান কোলের ওপর।

               “আমার ছেলেমেয়েদের খুব সর্দি হয়েছে, ওষুধ দেনা রে ডাক্তারবাবু।”

               “আপনার ছেলেমেয়েরা টুপি মাথায় দেয় কি?”

               “না।”

               “জুতো মোজা বা চটি পায়ে দেয়?”

               “উহু।”

               “গলায় স্কার্ফ জড়ায়?”

               “নাঃ। জামা কাপড় স্কার্ফ সব খুলে ফেলে।”

               “হুঁ! তবে তো খুব অসুবিধে আপনার!”

               “খুব! কথাই শোনে না আমার।”

               “আচ্ছা ওরা কি দুধ খাবার সময় কাঁদে?”

               “হ্যাঁ তো! খুব কাঁদে। খেতেই চায় না।”

               “তাই!”

               “বকে বকে খাওয়াতে হয়। কী করে যে বড়ো হবে!”

               “তবে তো ওষুধে হবে না। ইঞ্জেকশন দিতে হবে। তারপর তোকমারি দিতে হবে মাথান্যাড়া করে।”

               “তোকমারি কী গো?”

               “সে খুব খারাপ, যাকে দেওয়া হয় সে টের পায়। ইঞ্জেকশনের চেয়েও খারাপ।” ছোটোমামা খুব গম্ভীর। ডাক্তারবাবুদের যেমন হতে হয়।

               মুন্নি গলা জড়িয়ে ধরল তাড়াতাড়ি। “না, না, ইঞ্জেকশন দিতে হবে না গো, ছোটোশিশির ওষুধ দিলেই চলবে। জ্বর হয়নি তো, শুধু সর্দি। এরপর থেকে জামা জুতো না পরলে আমি খুব বকব। তাহলে আর সর্দি হবে না।”

               ডাক্তারবাবু মুন্নিকে কাঁধে নিয়ে নীচে যাবার আগেই গরম জলের বালতি আর তেলের বাটি হাতে মা এল ছাতে।

               “আয় মুন্নি চান করিয়ে দিই।”

 golpoayna-2-mediumদুপুরবেলা ঘুম ভেঙে গেল মুন্নির। সারা বাড়িতে বেশ কাজের ধুম্‌ পড়েছে। ছবি আঁকা মাথায় উঠেছে, ছোটমামা ছাতের ওপর শতরঞ্চি পেতে পুরোনো তোরঙ্গ খুলে বসেছে। মা আছে পাশে। ছাতময় লেপ কম্বল কাঁথা মেলে রোদ খাওয়ানো হচ্ছে। আম গাছের ছায়ায় ডালা খোলা আদ্যিকালের তোরঙ্গ। ঢেউ খেলানো লোহার চাদরের ওপর উঁচু উঁচু আঙুরলতার কাজ করা তোরঙ্গের রং আগে কী ছিল কে জানে। এখানে ওখানে কিছু নীল সবুজ রঙের ছোপ, বেশির ভাগটাই রং উঠে গিয়ে কালচে।

               ডালার ভেতর দিকে পারা খসে যাওয়া গোল আয়না। তার তলায় মর্চে রঙের পুরানো তুলোট কাগজে লেখা “শ্রীহরি সহায়, ঢাকা হইতে শিমলা, ভায়া কলিকাতা- সন ১৮৮০।” তোরঙ্গের ভেতর থেকে ছোটমামা একটা একটা করে ভাঁজ করে রাখা কাপড় বার করে দিচ্ছে, মা সেগুলো ভাঁজ খুলে যত্ন করে মেলে দিচ্ছে কাঁথার ওপর।

                 মুন্নি ঘুম ঘুম চোখে ছোটমামার পিঠের ওপর ঝুলে থাকল। তোরঙ্গ থেকে কেমন পুরানো পুরানো গন্ধ ভেসে আসছে। ভালো লাগছে মুন্নির। সবে ঘুম থেকে ওঠা মুন্নি ভাঙা গলায় বানান করে আয়নার ওপর লেখাটা পড়বার চেষ্টা করছে। ইস্কুলে ভর্তি হয়নি বলে বেশিদূর বিদ্যে নয় ওর।

               “বাক্‌সোর ভেতর কী লেখা গো মা?”

               “শ্রীহরি সহায়। চুপ করো এখন সোনা, কাজ করছি।”

               “নৌকোর মতো ওটা কী?”

               “চন্দ্রবিন্দু। ওং। ওং শ্রীহরি।”

               “তারপর?”

               “ওঃ হো! তারপর ঢাকা সিমলা অনেক কথা। চুপ করে বসো।”

               কিছুক্ষণ চুপ করে রইল মুন্নি। হাই তুলল।

               ছোটোমামার পিঠ থেকে এবার মায়ের পিঠের ওপর।

               “ছি হরির সামনে চন্নবিন্দু কেন গো মা?”

               “মারা গেছেন তো তাই।”

               “ছি হরি তো ভগবান।”

               “মারা গেলে সবাই ভগবান হয়।”

               “বুড়োদিদা কেন হয়নি?”

               “জানিনা, যাঃ।”

               মুন্নি কিছুক্ষণ চুপচাপ। কুলগাছের ফুল দেখছে। ডানা কাঁপিয়ে টুনটুনি পাখির নাচ দেখছে। কুলগাছের পাতা সেলাই করে বাসা বাঁধবে ওরা। একটা বুলবুলি পাখি এসে বসল ওই বকুলগাছের মগডালে। তারপর আরো একটা। ছাতের আলসের ওপর দিয়ে কাঠবেড়ালিরা ছুটোছুটি করছে। ওরাও নাকি শীতের আগে বাকসো টাকসো গুছিয়ে রাখে। কোথায় বসে কাঠঠোকরা গাছের গায়ে লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠুকে ঠুকে গর্ত করছে, শব্দ হচ্ছে ঠক্‌ ঠক্‌ ঠক্‌। দক্ষিণের মাঠে ছোড়দা ব্যাট বল খেলছে দাদাভাই আর সুমনদাদাদের সঙ্গে। দিদা আর দিদিভাই গল্প করছে নীচের ঘরে বসে। দিদা গান গাইছে। অনেক ওপরের আকাশে একা একা চক্কর দিচ্ছে চিল।

               “ঢাকা কী গো ছোতমামা?”

               “একটা দেশ। বড়ো বড়ো বাড়ি ঘর। মাঠ ময়দান, গাছপালা নদী নালা ধান দুব্বো। বুড়োদিদা থাকত।”

               “থাকতেন বলতে হয়। বড়োদের থাকত বলবি না, বুঝলি।”

               “সে আপনি যা বলেন।”

               “সিমলা কী রে?”

               “আর একটা দেশ। পাহাড় জঙ্গল বরফ ঝরনা। ভায়া কলিকাতা বুড়োদিদার দিদা গেল ঢাকা থেকে সিমলা পাহাড়ে।”

               “আবার গেল বললি!”

               “দিদা গেলেন।”

               “কেন গেলেন রে ছোতমামা?”

               “বিয়ে হল যে। শ্বশুরমশাইয়ের কোলে চড়ে শ্বশুরবাড়ি গেলেন।”

               “ওমা! বড়োরা বুঝি কোলে ওঠে?”

               “বড়ো কোথায়! বুড়োদিদার দিদা তখন তো ছোট্ট। ঠিক তোমার মতো। চার বছুরি। এই দ্যাখো ছবি।”

               সুতো খুলে যাওয়া সোনালি অ্যালবামে ছোটো ছোটো ছবি। স্বপ্ন স্বপ্ন চোখে ঝুঁকে পড়ে দেখছে মুন্নি। মা আর ছোটোমামা দেখছে মুন্নিকে। একশো কুড়ি বছর আগেকার ছোট্ট নতুন বউ প্রিয়তমা দেবীর চেহারাটি অবিকল এখনকার মুন্নি! মেমসাহেবদের মতো লালচে উড়ু উড়ু চুল, টুকটুকে ফর্সা, পুতুল পুতুল গড়ন। মোটা সোটা শ্বশুরমশাইয়ের গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে কোলে বসে আছে দিব্যি। ঘোমটা মাথায় হাসিমুখ, সামনের দুটি দাঁত নেই। পাশে দাঁড়িয়ে লাজুকমুখে ছোট্ট-খাট্ট পাঠশালায় পড়ুয়া নতুন বর।

golpoayna-medium

               ছবিতে আঙুল ঠেকাল মুন্নি, “এতা বুড়োদিদার দিদার বর বুঝি?”

               “হ্যাঁ গো পাকাবুড়ি। তোমার পছন্দ হয়?”

               “পছন্দ হয়। তারপর কী হলো গো ছোতমামা? শ্বশুরবাড়ি গেল?”

               “তুমি যাবে?”

               “কোথায়?”

               “সিমলায়।”

               “বুড়োদিদার দিদার সঙ্গে দেখা হবে তো ওখানে! ওর সঙ্গে খেলা করব। আমার পুতুল দেব ওকে। আর রিমোট কন্টোলের গাড়ি দেব। ও আমার বন্ধু কিনা! ওকে খুব ভালোবাসি আমি।”

               রাজ্যের জিনিসপত্তর ঠাসা তোরঙ্গের মধ্যে। আদ্যিকালের হলদে হয়ে যাওয়া চিঠির বান্ডিল, চশমার খাপে রাখা শুকনো নির্মালি, ছোট বড়ো জামা কাপড়, চন্দনকাঠের সাজগোজের বাক্‌সো, আরো কত কী! সাজের বাক্‌সোর মধ্যে আতরের বাহারি শিশি, কাজললতা, ছোট্ট দুটি সিঁদুর মাখানো শাঁখা, সিঁদুর কৌটো, আর কোণের কাছে ছুঁচ সুতোয় ‘প্রিয়তমা’ লেখা ছোট্ট গোলাপি রুমাল। আর আছে গয়নার বাক্‌সো। সেখান থেকে বার করে ছোটোমামি মুন্নিকে পরালেন ছোটমাপের বালা, টিকলি, সিঁথিপাটি আর ঝুমকোদুল। দিদিভাই আর মুনিয়াদিদি যত্ন করে শাড়ি পরিয়ে মাঝে সিঁথি কেটে চুল বেঁধে দেবার পর চুপ করে তোরঙ্গের পাশে বসে রইল মুন্নি।

golpoayna-2-mediumবিকেলবেলা ছাত সুনসান। দিদি ভাইরা সবাই মিলে বেড়াতে গেছে। মুন্নিকে কিছুতেই নিয়ে যাওয়া যায়নি আজ। ছোটোমামা ছাতের ঘরে কাজে ব্যস্ত। ওখান থেকেই নজরে রেখেছে মুন্নিকে। আজ আর একটুও দুষ্টুমি নেই ওর। নিমালিপুর বা মানির বাড়ি বা লম্বরিদিদির কাছে যাবে বলে বায়না করছে না রোজকার মতো। সেজেগুজে বসে আছে তো বসেই আছে ডালা খোলা তোরঙ্গের পাশে, মুখে কুলুপ এঁটে।

               নীচের মাঠে দাদাভাইদের ব্যাটবল খেলা শেষ। পুকুর পাড়ের আধো অন্ধকার কলাঝোপে লুকিয়ে বসে ডাহুক ডাকছে কুপ-কুপ-চুপ-চুপ-চুপ। অনেকদূরের নিমগাছের ঝাড় থেকে বাসায় ফেরা কাক বক শালিকদের শোরগোল ভেসে আসছে। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। শেষ রোদের আবিরে আলোয় রাঙা মুন্নি বসে আছে খোলা তোরঙ্গের ডালায় পারা খসে যাওয়া গোল আয়নার দিকে চেয়ে। আয়নার ওপরে ছোট্ট খাট্টো নতুন বউ। ভারী মিষ্টি করে হাসল যেন মুন্নির দিকে চেয়ে!

               “তুমি কে গো?”

               “আমি পিওতমা। তুমি?”

               “আমি তো মুন্নি। আমার একটা মেয়ে আছে, আর সাতটা ছেলে।”

               “আমারও।”

               “তুমি আমার খেলনা নেবে?”

               “হ্যাঁ। তুমিও আমার সাজের বাক্‌সো নাও।”

               “নেব। তুমি তো আমার বন্ধু। আমরা রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে খেলা করব , কেমন?”

               পিওতমা বলল, “আচ্ছা।” মুন্নি আয়নাতে ঠোঁট ঠেকিয়ে আদর করে চুমো খেল। পিওতমাও তারপর তোরঙ্গের পাশে লেপের ওপর শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল।”

ছবিঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

 

1 thought on “গল্প আয়না শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য বসন্ত ২০১৭

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s