শিবশঙ্কর ভট্টাচার্যের আগের তেরোটি গল্পের সংগ্রহ
জষ্টিমাস ষষ্টী পুজো। সকাল থেকে গনগনে রোদ্দুরের পর দুপুর নাগাদ ওপর-ঝাম্টা বৃষ্টি, থামবার নাম নেই! মেনি ষষ্টীঠাকুরাণীর বাহন। অন্যদিন মেনি “দূর ছাই”, আজ ওর আদর দেখে কে! ঠাকুরমা পর্যন্ত ধানদুব্বো আর ভেজা পাখার ষাট ষাট করে দিয়েছে!
লোকজনের হুল্লোড়ে শোবার ঘরের খাটের তলায় ঘুমোবার জো নেই আজ। খাওয়াদাওয়ার পর মেনি গেছে চিলছাদের আলসের তলায় জিরোতে। ক্ষীরের ভারে গোঁফ ঝুলে পড়েছে। আম, কাঁঠাল, পায়েসের আবেশে দু’চোখ ঢুলু ঢুলু। সর্বাঙ্গ এমন চটচট করছে যে আধঘন্টা ধরে চেটেও কুল পাওয়া যাচ্ছে না। কপালে আবার কী করে এক পোঁচ হাঁড়ির কালি লেগেছে, বিশ্রী দেখাচ্ছে! তার ওপর জায়গাটা জিভের নাগালের বাইরে। গড়াগড়ি দিয়েও সুবিধে হয়নি। মন খারাপ করে মেনি বসেছিল। এর মধ্যে বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছে। মেঘের ফাঁকে ফ্যাকাশেপানা একটু রোদ্দুর। এ’রকম দিনে খ্যাঁকশেয়ালদের বিয়ের ধুম পড়ে যায়। হোকগে বিয়ে! বিরক্ত মেনি পায়ে পায়ে আলসের ওপর সবে একটু রোদ পিঠে বসে চোখ বুঁজেছে, ফের এক পশলা ছাগল-তাড়ানী বৃষ্টি!
দৌড় দৌড়। সোজা ভাঁড়ার ঘরের চৌকির তলায়। লোম ফুলিয়ে গা ঝাড়া দিতে দিতে মেনির কান খাড়া হল। ফিক করে কে যেন হাসল না? নাঃ কোথায় কে? মনের ভুল। খানিক ইতিউতি চেয়ে ফের চাটাচাটি শুরু করতেই সুরেলা গলায় কে যেন বললে,
“একে বেড়াল কালো
তায় গাঙ সাঁতারে এলো,
তায় ছাই গাদাতে শুলো
একগুণো বিড়াল রূপে তিনগুণো হল।”
তবে রে! নিমেষে মেনির শরীর টান টান, চোখজোড়া আগুনের ভাঁটা। গলার আওয়াজটা চেনা চেনা ঠেকছে! এ হল দেড়ে ব্যাটার নতুন নাতবৌ কুটনিটার ফিচলেমী। সুন্দরী বলে দেমাকে পা পড়ে না। ছুঁড়ি যেন সং! ঠারে ঠোরে কথা শোনায় মেনিকে।
ভাঁড়ারঘরের কাঠের সিন্দুকের তলায় ছোট্ট ফাঁক। তাঁর ফাঁকে গোলাপী ঠোঁট নড়ে উঠল ফের, “রাগ করলি?”
“নাঃ, আহ্লাদে গলে গেলাম তোর ছড়া শুনে! ন্যাকা!”
“আহা, আয় না, দুটো মনের কথা বলি।”
“বয়ে গেছে আসতে।”
মেনির রাগের কথায় হি হি হাসছে কুটনি। গা জ্বলে যায়। ফাঁক দিয়ে ভারি মোলায়েম এক জোড়া নীল মার্বেল চোখ দেখা গেল।
“হাঁড়ি চাটতে যাওয়া হয়েছিল বুঝি?”
ঘাড়ের লোম ফুলে উঠেছে। গলায় গর গর করছে রাগ।
“তোর তাতে কী!”
“নাঃ, একা একা খেলি কিনা। আমার ছানাগুলো এখনও শুকিয়ে রয়েছে।”
“ আহা রে!” ছানাগুলোর কথা ভেবে একটু নরম ভাব মেনির। ইঁদুর বৌটার আবার স্বর ফুটেছে।
“যাক্গে! আমিই বা কত তোকে ভাগ দিতে পারছি বল? ওমনি বলছি। তাছাড়া হাঁড়িতে মুখ দিয়ে কী পিটুনিটাই না খাস তুই। খারাপ লাগে।”
ফের বজ্জাতি। লেজ একবার এদিক একবার ওদিক, গলার স্বর ফ্যাঁসফেঁসে, শরীর টান করে বসল মেনি।
“কে বললে পিটুনি খেয়েছি?”
“গায়ের ওই পুরনো দাগগুলো কীসের শুনি? ঠাকমা বুড়ি আলপনা এঁকে দিয়েছে বুঝি আদর করে?”
“তাতে তোর গা জ্বলছে কেন?”
“চুরিটাও করতে শিখলি না রে! আমার কাছে আসিস শিখিয়ে দেব’খন।”
মেনির চোখ চক্ চক্, লেজ ডাইনে বাঁয়ে নড়ছে, কান জোড়া মাথার দুপাশে সাঁটা।
“দোরটা খোল, শিখতে যাই।”
দুষ্টু ইঁদুর বৌটা হেসেই কুটিপাটি। হাসিটা কিন্তু ভারি মিঠে।
“অত বোকা নই রে! সেদিন নতুন ছোঁড়াটাকে বাবু নিয়ে এল ফুট-ফরমাশ খাটবার জন্য, পরদিনই বাসনকোসন নিয়ে হাওয়া! বোকা, বোকা! ছাপোষাদের দোর খুলতে হয় হিসেব করে।”
“হুঁ, বুদ্ধি যত আছে তোর মগজে?”
“গণেশ ঠাকুরের বাহন যে রে।”
“আমিও বানের জলে ভেসে আসিনি। ষষ্ঠীঠাকরুণের সাক্ষাৎ শিষ্যা!”
“দূর বোকা মেয়ে, গণপতিঠাকুরের সাথে কার তুলনা! দুগ্গা মা দুই ছেলেকে বললেন, যাও দুনিয়া দেখে এস। কার্তিক ঢাল-তলোয়ার বেঁধে, ময়ূরে চড়ে বছর পার করে দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে। গণপতি ঠাকুর করলেন কী? গোলগাল শরীরে হেলতে দুলতে মাকে একবার প্রদক্ষিণ করেই ব্যাস! হয়ে গেল দুনিয়া দেখা! কী বুদ্ধি!”
রাগটাগ ভুলে মেনি গল্প শুনছিল। বলার ঝোঁকে ইঁদুর বৌটাও খিড়কি দোর খুলে অনেকটা বাইরে। হঠাৎ খেয়াল হতেই ফের ওপার। হেসে গড়াগড়ি!
“হয়েছিল আর কি! এক্কেবারে তোর থাবার নাগালে চলে গেছলাম। নুলো বাড়ালি না যে বড়ো? ও মেনি রে তুই কি ভালো হয়ে গেলি রে?”
মেনি খেয়াল করেনি প্রথমটা। ফোঁস করে উঠল, “খারাপটা ছাড়া তো চোখেই পড়ে না তোর। তাছাড়া এত ক্ষীর, দই ছেড়ে তোকে খেতে বয়ে গেছে আমার। মুখ নষ্ট!”
খিড়কি দোর খুলে সটান সামনে হাজির ইঁদুর বৌ।
“সত্যি খাবি না তো?”
“বিশ্বাস হয় না বুঝি?”
“কী করব, স্বভাবটা তো ভালো বুঝিনি এতদিন। থাকগে- আয় সই পাতাই।”
মেনির বেড়াল হলেও বয়সে ছেলেমানুষ আর ধেড়ে ইঁদুরদের কুটনিকেও ছোট্টটি বলা যাবে না। সই হিসেবে খুব বেমানান হল না দুজনে। মেনি খুঁজে পেতে নিয়ে এল একদলা ক্ষীর আর দুব্বো বাঁধা একগাছি ষষ্টির সুতো, কুটনি নিয়ে এল বেনারসী শাড়ির এক চিলতে জরি। দুজনে দুজনার লেজে বেঁধে দিয়ে ঠাকুর সাক্ষী রেখে বলল, “আজ থেকে আমরা গঙ্গাজল।”
ছবিঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে
osadharon.
LikeLike
Durdanta lekha, typical Shibshankarda type
LikeLike