গল্প ইভানের কীর্তি পাপিয়া গাঙ্গুলী বসন্ত ২০১৯

পাপিয়া গাঙ্গুলীর  আগের গল্প চিঁড়ে

ইভানের কীর্তি

পাপিয়া গাঙ্গুলি

– আমি নীচে নামব।

– ‎এত রাতে তুমি নীচে নেমে কী করবে? চারিদিক অন্ধকার।

– ‎গোটা গোটা দিন এই একজায়গায় বসে থাকতে  আমার মোটেও ভালো লাগে না। এক জায়গা, একই বন্ধু.. কোনো রোমাঞ্চ নেই।  

– ‎আমরা এই পুতুলরা এই শো-কেসে  একসঙ্গে  থাকি। একটা সুন্দর পরিবারের মত।  তুমি বলতে চাও আমাদেরকে তোমার পছন্দ হচ্ছে না?

– ‎পছন্দ হচ্ছে না বলিনি। বলেছি এই এক জায়গায় বসে থাকতে পারছি না।  আগে বাচ্চারা  পুতুল খেলত।  দোকান থেকে  কিনে নিয়ে এসে  খেলত, নিজেদের বাড়িতে। উপহার দিত অন্য বন্ধুকে।  এখন আমরা  শো-কেসে বসে থাকি সাজানো হয়ে। কেউ আমাদের চায় না। এই যে রাজু নামের  বাচ্চাটা  তো  কম্পিউটার বা ইন্টারনেট গেম নিয়েই  ব্যাস্ত। আমাদের সাজিয়ে রেখেছে। একবার হাতে  নিয়েও দেখে না।  কোনো রোমাঞ্চ নেই।

– ‎সে তো আমরাও জানি। তুমি এত উতলা হচ্ছ কেন?

– ‎আমি হাত পা ওয়ালা , জামাকাপড় পরা এক মানুষের মত  দেখতে পুতুল। আমার জন্ম সুদূর রাশিয়ায়। তোমার মতো কাপড়ের তৈরি মটকু ভালুক পুতুল আমি নই। আমি এক নায়ক হতে চাই। সকলে  আমায় দেখলেই ফিসফাস করবে “ঐ যায় আমাদের ইভান। দুনিয়ার একমাত্র হিরো ইভান ।”  রাশিয়ানরা  খুব সাহসী, তা জানো কি! এমন একজায়গায় বসে থাকা আমাদের মানায় না।

– ‎তা তোমার যদি মনে হয় আমাদের ছেড়ে তুমি ভালো থাকবে তখন তোমায় আটকিয়ে  লাভ নেই।
যাও তুমি হিরো হও। 

এরা হল ছোট্ট রাজুর পুতুলরা সব। একটা শো-কেসে সাজানো আছে  ইভান, মটকু ভল্লুক পটাস। লোমলোম সাদা কুকুর টমি। চিনেমাটির ভাইবোন, লিকপিকে হাত পা ওয়ালা একটা কালো  টুপি পরা ছেলে পিকো, সবুজ রঙের আধা  ঘুমন্ত কুমীর  অ্যালি, চাবি দেওয়া মঙ্কু মাঙ্কি আর গলায় ঘন্টা বাঁধা একটা  গরু হাম্বা। এটা মামা সুইজারল্যান্ড থেকে রাজুকে এনে দিয়েছিল।

হাম্বা গরু রাজুর একসময় পছন্দের ছিল। রাজু তার বারো বছরের জন্মদিনে কম্পিউটার গেম পেয়েছে বাবার থেকে, এখন  তাই নিয়ে ব্যস্ত। এসব পুতুল নিয়ে আজকাল আর খেলে না। ধুলো পরে পুতুলগুলো নোংরা হয়েছে।  কেউ খেলেনা, আদর করে না, তারা খুব একলা।

 রাশিয়ান পুতুল ইভান আর না পেরে ঠিক করেছে সে শোকেস ছেড়ে বেড়িয়ে আসবে। শোকেস থেকে নীচে নেমে সে এক হিরো হবে। রাত্তির দুটো  তখন।  রাজু  তার কিছু খেলনা,  ব্যাটারির গাড়ি, বইপত্তর ছড়িয়ে  রেখে আজ ঠাম্মির কাছে ঘুমিয়েছে। তার পড়ার টেবিলে একটা অ্যালার্ম ঘড়ি টিক টিক করে চলছে। ইভান সাবধানে শো-কেসের তাক ধরে ধরে নিচে নেমে এল। গরুটার লেজে টান পরেছিল মনে হয় ভুল করে। সে  গলা নাড়িয়ে টুংটাং আওয়াজ তুলল। নিচে নেমে ইভান দেখে দুটো রেসিং কার মেঝেতে রেস করতে ব্যস্ত। আর। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে দাবার ঘুঁটি সৈন্য, ঘোড়া, রাজা রানি।  ইভান ঠিক করলো সুপার হিরোদের মত এক হাতে একটা রেসিং কার আটকে  দিয়ে চমকে দেবে সকলকে।  তারপর সকলে তাকে কাঁধে তুলে জয় জয়ক্কার করবে। গুটি  গুটি পায়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল  ছুট্টে আসা নীল রেসিং কারের রাস্তায়।  রেসিং কারটা হকচকিয়ে গিয়ে কষে ব্রেক দিলো।  টাল সামলাতে না  পেরে আলতো  করে ধাক্কা দিল দাবার রাজাকে। রাজা টুক করে পড়ে গেল। হৈ হৈ কান্ড। দাবার ঘুঁটি  সৈন্যরা ঘিরে ফেলল ইভানকে। রেসিং কারটা অল্প তুবরে গেছে। রেসিং কারটা  খুব একচোট বকা দিল ইভানকে, হঠাৎ চলন্ত গাড়ির সামনে  আসার জন্য।

বকাটকা খেয়ে জায়গাটা থেকে বেরিয়ে গেল। হিরোগিরি  করা আর হল না। মুখটা পেঁচার মত করে সে গিয়ে  বসল  খেলনা শহরের একটা পার্কে ।এই খেলনা শহরটা সাজানো থাকে রাজুর পড়ার টেবিলের পাশে। সবুজ রংয়ের ঘাসের ওপর বসে  সে চোখ মুছলো।  

হঠাৎ দেখল একটা সোনালী চুল পুতুল  জলের ভেতর হাবুডুবু খাচ্ছে।  জল মানে সোনালী মাছেদের জলাশয়, একটা কাচের পাত্র। সোনালী মাছেরা দিব্যি সাঁতরে বেড়াচ্ছে। আর সোনালী চুল মেয়েটা জলে ডুবছে আর উঠছে। ইভান বুঝল পুতুলটা সাঁতার জানে না।  ডুবে মরবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ইভান চিৎকার করতে করতে ছুটল জলাশয়ের দিকে।  ” ডুবে গেল  ডুবে গেল…. ”  জলাশয়ের পাশে রাখা এক মাছ ধরার জাল দিয়ে ছেঁকে তুলল ছোট্ট পুতুলকে।  চারপাশে তখন লোকজন ঘিরে দাঁড়িয়ে।   দূরে শোনা যাচ্ছে পুলিশের গাড়ির সাইরেন।  জালে ওঠা পুতুল তখন চিৎকার করছে  হাত পা ছুঁড়ে

 -কেন ওঠালে আমায় জল থেকে?

 -‎ তুমি তো ডুবে যাচ্ছিলে-‎কে বলেছে ডুবছিলাম।   আমি হলাম সাঁতারু পুতুল। সাঁতার কাটাই। আমার কাজ।তাই মাছেদের সঙ্গে রেখেছে রাজু।  

ইভান ভুল বুঝতে পেরে পুতুলকে চটপট জাল থেকে রেহাই দিতে যায়। এখানে ঘটল আরেক বিপত্তি। জালে আটকে গেল পুতুলের পা। খোলার সময় অসাবধানতায় পুতুলের পা খানা গেল খুলে। 
পুতুল আর্তনাদ করে উঠলো। ততক্ষণে পুলিশ এসে উপস্থিত।  সাঁতারু মেয়ে পুলিশকে নালিশ করল ইভানের নামে।
–  শুনুন পুলিশ কাকু, এই ছেলেটা আমায় একটা নোংরা মাছ তোলার জাল দিয়ে তুলেছে। তারপর টেনে আমার পা ছিঁড়ে দিয়েছে।

পুলিশ সব শুনে অ্যাম্বুলেন্স ডাকল সোনালী চুল পুতুলকে নার্সিংহোম নিয়ে যেতে আর  অ্যারেস্ট করল ইভানকে। হাত কড়া লাগিয়ে নিয়ে চলল পুলিশ স্টেশনে।

পুলিশ স্টেশনে একটা অন্ধকার ঘেরা জায়গায় ঢুকিয়ে দিল বন্দুকের একটা খোঁচা মেরে। মাথার ওপর একটা ঘুলঘুলি শুধু।  ইভানের চোখ ফেটে তখন কান্না আসার জোগাড়। চাইল সে হিরো হতে, হয়ে গেল জিরো। কে বাঁচাবে তাকে এই বিপদ থেকে!!! শোকেসে বন্ধুদের সঙ্গে ভালোই ছিল।  মটকু ভালুক পটাস অনেকবার না করেছিল। 

পটাসের কথা ভেবে ইভান আরও খানিক কাঁদল। কাঁদতে কাঁদতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল।  খানিক বাদে কথাবার্তার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। ভুত নাকি!  চারপাশ তাকিয়ে বুঝতে পারল ঘুলঘুলির ওপার থেকে আওয়াজ আসছে।

তাইতো..   ভুল হওয়ার নয়। এ তো পটাশের গলা। পটাশ বলছে, “ইভান।  চাবি পেয়েছি। ঘুলঘুলি দিয়ে মঙ্কু মাঙ্কি তোমায় দিচ্ছে। তুমি চাবি খুলে পালিয়ে এসো। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি।”

টং করে একটা আওয়াজ হল। খুঁজে দেখল চাবি একটা। চাবি  পাওয়ামাত্র সাবধানে জেলের তালা খুলল। পাহারাদার ঘুমে কাদা।তবুও যেন মনে হল নড়েচড়ে উঠল। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ইভান। অপেক্ষা করল পাহারাদারের নাক ডাকার শব্দ শোনা পর্যন্ত।  সন্তর্পণে দরজা খুলে বাইরে এল। তারপর  গুটি গুটি পায়ে থানার বাইরে  চলে এল।

এসে দেখল তার সব বন্ধুরা তার জন্য দাঁড়িয়ে। নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় কথা বলছে। ইভানকে দেখে তারা জড়িয়ে ধরল সকলে। ইভান খুব খুশি সকলকে দেখে।  পটাসের দু’হাত ধরে বলল, 

-হিরো  হওয়া আমার হল না কিন্তু তুমি আসল হিরো। 

-হিরো আমি একা নয়। হিরো আমরা সকলে।  এরা তোমায় খুব ভালোবাসে। সকলে মিলে তোমায় বার করে এনেছি। পটাস বলল হাসিমুখে।

-‎আমিও তোমাদের খুব ভালোবাসি। আমি দুঃখিত তোমাদের সঙ্গে না থেকে আমি একা হিরো হতে চেয়েছিলাম।বন্ধুদের বাদ দিয়ে কিছু হয় না।

-‎নাও এবার পা চালাও। বাকি কথা শো-কেসে গিয়ে হবে। পুলিশ ধরলে এবার আমাদের সকলকেই জেলে ঢোকাবে। পটাস তাড়া দিল সকলকে।

রাজুর একটা রঙিন মই ছিল শো-কেস ঘেঁসে।  সকলে মিলে সেই মই বেয়ে ওপরে উঠে গেল। যে যার নিজের জায়গায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ইভান আর কোনোদিন বন্ধুদের ছেড়ে একা কোথাও যায়নি। 

(এনিড ব্লাইটনের ” adventurous clown” এর ছায়া অবলম্বনে)

অলঙ্করণঃ অংশুমান দাশ

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s