গল্প উতলধারা গ্রামের ব্যাঙাচিকুমার রতনতনু ঘাটী শরৎ ২০১৭

রতনতনু ঘাটীর জয়ঢাকের প্রকাশিত সব লেখার লাইব্রেরি এইখানে

উতলধারা গ্রামে আজ সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি। তাই ব্যাঙাচিকুমারের একটুও মন ভালো নেই। তার আজ সকাল সকাল দিগন্তি দিদিমণির বাড়ি যাওয়ার কথা। আজই তো তার দিগন্তি দিদিমণির ইশকুলে ভর্তি হওয়ারও কথা ব্যাঙাচিকুমারের।

দিগন্তি দিদিমণির ইশকুল এক আজব ইশকুল, মায়ের মুখে শুনেছে ব্যাঙাচিকুমার। দিগন্তি দিদিমণি তার ইশকুলে নাকি একবার একজন মাত্র ছাত্রকে পড়ায়। সেই ছাত্রের পড়া শেষ হলে, ভালোমতো জ্ঞানগম্যির পরীক্ষা নেয় দিগন্তি দিদিমণি। তাতে পাশ করলে তবে সেই ছাত্রের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি মেলে। এরপর সেই ছাত্র বাড়ি ফিরে গেলে তখন আর একজন ছাত্রকে ভর্তি নেয় দিগন্তি দিদিমণি। তার ইশকুলের খুব কঠিন নিয়ম।

ব্যাঙাচিকুমারের মা প্রথম খোঁজ নিয়েছিল পানকৌড়িজেঠুর কাছে। জানতে চেয়েছিল, ‘‘হ্যাঁ গো পানকৌড়িদাদা, দিগন্তি দিদিমণির ইশকুল কি এখন ফাঁকা আছে? জান কি সে কথা?’’

পানকৌড়িজেঠু যাচ্ছিল শালুকবিলের দিকে। যদি মাছটাছ পাওয়া যায় দুয়েকটা। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘‘কেন, দিগন্তি দিদমণির ইশকুলের খোঁজ নিচ্ছ যে বড়ো? তুমি এই বয়সে ইশকুলে ভর্তি হবে নাকি? শুনে তো তেমনই মনে হচ্ছে!’’

ব্যাঙাচিকুমারের মা কানটান চুলকে বলল, ‘‘না গো না! আমার ব্যাঙাচিকুমার এবার তো বড়োটি হল। এবার একটু লেখাপড়া না শেখালে কি চলে? দেশে-গাঁয়ে এখনকার দিনে কে না পড়ালেখা শেখে বল? তাই তোমার কাছে খোঁজখবর করছিলাম।’’

পানকৌড়িজেঠু ঘাড় নেড়ে বলল, ‘‘দিন তিনেক আগে কার মুখে শুনেছিলাম বটে, এখন নাকি দিগন্তি দিদিমণির ইশকুল খালি যাচ্ছে। যদি দু-চারদিনের মধ্যে ছাত্রটাত্র না হয়, তাহলে নাকি দিগন্তি দিদিমণি কোন দূরদেশে আরও ভারী কিছু পড়তে চলে যাবে কয়েকমাসের জন্যে। আজই খবর নাও না কেন।’’

ব্যাঙাচিকুমারের মা এর ওর তার হাতে খবর করতে করতে হঠাৎ পুকুরের জলে নুয়ে পড়া বাঁশগাছে বসে থাকা মাছরাঙা-বউয়ের দেখা পেয়ে গেল। অমনি সে সুযোগ হাতছাড়া করে নাকি কেউ? ব্যাঙাচিকুমারের মাও সে সুযোগ হাতছাড়া করল না। মাছরাঙাবউকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘হ্যাঁ গো মাছরাঙাবউ, তুমি কত এদিক ওদিক উড়ে ঘুরে বেড়াও। তুমি খোঁজ পেয়েছ কি দিগন্তি দিদিমণির ইশকুল এখন খালি আছে কি না? আমার ব্যাঙাচিকুমার তো বড়োটি হল। ওকে দিগন্তি দিদিমণির ইশকুলে ভর্তি করতে চাই।’’

মাছরাঙাবউ বলল, ‘‘কালই তো দেখে এলাম, দিগন্তি দিদিমণি জলে-ডাঙায় বসে বসে নীল আকাশে সাদা মেঘের হাঁস দেখছে। দাঁড়াও, আজই আমি খোঁজ নিয়ে তোমাকে জানিয়ে যাচ্ছি।’’

বলেই ফুড়ুৎ করে উড়াল দিল মাছরাঙাবউ। কে জানে দিগন্তি দিদিমণির ইশকুলের খোঁজে গেল কি না! শুধু উতলধারা গাঁয়েই বা বলি কেন, আশপাশের দশ-তেরোখানা গাঁয়ে মাছরাঙাবউয়ের উপকারি হিসেবে বেশ নামডাক আছে।

তারপর যখন বিকেল রাঙা হল, মেঘের গায়ে রং মাখামাখি শুরু হয়ে গেল। সূর্য তখন ডুবুডুব। অমন সময় মাছরাঙাবউ উড়তে উড়তে এসে বলল, ‘‘ও ব্যাঙাচিকুমারের মা, কালই ব্যাঙাচিকুমারকে দিগন্তি দিদিমণির ইশকুলে ভর্তি করে দাও। আমি দিগন্তি দিদিমণিকে বলেও এসেছি কথাটা। এখন ছাত্র নেই।’’

সেই শুনে রাতে ব্যাঙাচিকুমারের মা বলল, ‘‘বাবা, তুমি তো বড়ো হচ্ছ। এবার তো একটু পড়ালেখা না করলেই নয়। মাছরাঙাবউ আজই গিয়ে বলে এসেছে তোমাকে ইশকুলে ভর্তি নেওয়ার কথা। কাল সকালে উঠেই তুমি রওনা দিও। আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে তোমাকে দিগন্তি দিদিমণির ইশকুলে ভর্তি করতে যাব না। দিগন্তি দিদিমণি ছাত্রের সঙ্গে মা-বাবা কেউ যাক, একদম পছন্দ করে না!’’

ঘাড় নেড়ে সায় দিল ব্যাঙাচিকুমার। তারও ইশকুলে পড়ায় বেশ মন আছে। বুকে সাহসও আছে। মাথায় বুদ্ধি? তা যে একদম নেই তাও নয়।

আজ সকাল থেকে অঝোরধারায় এই বৃষ্টিতে এখন সে কী করবে? দেরি হলে দিগন্তি দিদিমণি যদি রাগ করে? সে তো আর দিগন্ত দিদিমণিকে আগে কখনও চোখে দেখেনি। মা পইপই করে বলে দিয়েছে, ‘‘তুমি যাচ্ছ দিগন্ত দিদিমণির বাড়ি লেখাপড়া শিখতে। ভিজে গায়ে গিয়ে হাজির হোয়ো না যেন! তেমন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে কোথাও দাঁড়িয়ে যেও খানিক। ভিজেটিজে আবার যেন জ্বর বাধিও না! দিগন্তি দিদিমণি একলা মানুষতো। তুমি জ্বর নিয়ে হাজির হলে তোমাকে দেখার লোক নেই তো বাড়িতে!’’

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় করে বেরিয়ে পড়ল ব্যাঙাচিকুমার। অমন সময় ব্যাঙাচিকুমার হঠাৎ দ্যাখে কী, সামনের আকন্দ ঝোপের পাশে একটা ব্যাঙের ছাতা ফুটে আছে। তার উপর দিকটা সাদা, তলার দিকটা ছাই-ছাই রঙের। খুব মিহি রঙের ডুরে ডুরে দাগ। অমনি সে তিন লাফে ব্যাঙের ছাতার নীচে গিয়ে জবুথবু হয়ে বসে পড়ল টুপুস করে। না, এখন আর একফোঁটাও বৃষ্টির দানা গায়ে পড়ছে না। এটাই বেশ হল! মা পরে যখন ব্যাঙাচিকুমারের মুখে এই কাণ্ড শুনবে, খুশিই হবে।

ব্যাঙাচিকুমার কিন্তু সত্যি সত্যি ব্যাঙাচি না। তার নামটাই অমন। সে যখন সত্যি ব্যাঙাচি ছিল, তখন পানকৌড়িদের ছোড়দি, ওই যে গো, কী সুন্দর নকশা কাটা ডানা, হলদে রঙের ঠোঁট, সাদায়-কালোয় সে যে কী রং তার! গোলাপি রঙের পায়ের পাতা! আদর করে সেই ছোড়দিই অমন নাম রেখেছিল তার ‘ব্যাঙাচিকুমার’। প্রথম প্রথম সে যে নামটা নিয়ে একদম আপত্তি করেনি, তা নয়। দুর, নামটা যেন কেমন কেমন! মোটেও ভালো না।

মাকে গিয়ে বলেছিল, ‘‘মা, ব্যাঙাচিকুমার নামটা আমার মোটেও পছন্দ না। তুমি পানকৌড়িদের ছোড়দিকে বলে দিও তো, আমাকে যেন ওই নামে না ডাকে। আরও কত তো নাম আছে। উতলধারা গ্রামে কি নামের অভাব নাকি?’’

কিন্তু মা কানেই নেয়নি তার কথা। মা নাকি দিনেরবেলা হাতের সব কাজ সেরে একদিনও পানকৌড়িদিদির বাড়ি গিয়ে উঠতে পারেনি। শেষমেশ তার ওই নামটাই বহাল হয়ে গেল গোটা উতলধারা গ্রামে।

সেই কবে তার ব্যাঙাচি-লেজ খসে পড়েছে। তারপর সে একটা আস্ত ব্যাঙ হয়েছে, সে কি আজকের কথা? মা ছাড়া আর সে হিসেব কে রেখেছে বল? জল থেকে সে এখন ডাঙায় থাকতে ভালোবাসে। জলে যে নামে না একদম, তা নয়। নামলেও এই হুট্টুবুট্টু। তক্ষুনি উঠে আসে ডাঙায়। এমনকি, জলে সে ডুবসাঁতারও দিতে পারে অনেকটা! তবুও জলে বেশিক্ষণ থাকতে তার মন চায় না। জলে থাকলে নিজেকে তার কেমন পুঁচকে বলে মনে হয়। এখন সে একটু বড়ো হয়েছে যে! তার লম্বা লম্বা পা, বড়ো বড়ো চোখ। সে এখন হাট্টিটি করে লাফাতে পারে। এখন বলতে গেলে একটা ছোট্ট ব্যাঙ সে। গায়ের চমড়া কী মোলায়েম! আর কী রংবাহারি দেখতে! তার যে অমন রূপ, সে আসলে একটা সোনাব্যাঙ কিনা!

উতলধারা গ্রামটা কোথায়? সেই কথাটাই তো এখনও বলা হয়নি! টুটুনদের ওই যে একটা টালির বাড়ি আছে না? ওই টালির বাড়িটা বাঁ হাতে ফেলে গটরমটর করে খানিকটা সিধে এগোতে হবে। তারপর দেখতে পাবে বাঁ দিকে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে ঠাকুরমার কালের একটা ঝুরো বটগাছ। লোকে বলে, অনেকদিন আগে এক ঝড়-বাদলের নিশুতি রাতে কড়কড় শব্দ করে একদম বোকা-হাবা একটা অবুঝ বাজ পড়েছিল সটান বটগাছটার মাথার উপর। তারপর থেকেই তার অমন ঝুরো ঝুরো চেহারা হয়ে আছে।

তারপর সটান সেটা পেরিয়ে এগিয়ে যাও। চোখে পড়বে ঝুপ্পুস হয়ে থাকা একটা হিজলগাছ। ব্যাঙাচিকুমার মনে মনে মজা করে সে গাছটাকে বলে ‘হিজলবৃক্ষ’। অত বড়ো যে গাছ, সে বৃক্ষ না হয়ে কি পারে? সেই কবে গরমকালে গোলাপি-লাল হিজলফুল ফুটেছিল গাছটায়। এখন আষাঢ়মাস এসে গেল। তাও পুঁচকে দুয়েকটা ফুল দ্যাখো হটং-বটং করে এখনও দোল খাচ্ছে হিজলের ডালে।

তারই পাশে হেলাফেলার মতো ভেসে থাকা একটা জল টইটই ডোবা আছে। অবশ্য ব্যাঙাচিকুমার ঠোঁট উলটে ওই ডোবাটা কে বলে, ‘সরোবর’। নিজের থাকার জায়গাকে কেউ কখনও ছোটো করে বলে নাকি? তারই গায়ে গা লাগিয়ে ঘুমপাড়ানিমাসির মতো লেপটে আছে একটা কাঁটা বাঁশের বন। তার উলটোদিকে খুব দুবলা, যেন এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়া একটা রোগাপটকা খেজুরগাছ। এই হল ব্যাঙাচিকুমারের উতলধারা গ্রামের ছবি।

এক ঝিমঝিম বৃষ্টির সন্ধেবেলা, যখন জোনাকিরা পিদিম জ্বালাচ্ছিল ঝোপের গায়ে, ব্যাঙাচিকুমার এই গ্রামেরই কারও মুখ থেকে গল্পটা শুনেছে। কার মুখ থেকে যে গল্পটা শুনেছে, এখন একটুও মনে করতে পারে না। তবে এটা তার স্পষ্ট মনে পড়ছে, সে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে একটা বড়ো ব্যাঙের গল্প। তার বাড়ি নাকি পাপুয়া নিউগিনিতে। সে দেশটায় পৌঁছতে হলে হেঁটে যেতে হয়, নাকি লাফ কেটে কেটে, নাকি ডুবসাঁতার দিয়ে যাওয়া যায়, নাকি আকাশে উড়ে, ব্যাঙাচিকুমারের এখনও ঠিকঠাক জানা হয়ে ওঠেনি। সে ব্যাঙটা নাকি চেহারায় মস্ত বড়ো, লম্বায় প্রায় এক ফুট।

ব্যাঙাচিকুমারকে বড়োরা সেই কোন ব্যাঙাচিবেলা থেকে শুনিয়ে রেখেছেন, তাকে অনেক অনেক বড়ো হতে হবে। কত বড়ো হতে হবে, সে নিয়ে তার এখনও স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তার নিজের ইচ্ছে, বড়ো যদি হতেই হয়, সে একদিন সত্যি সত্যি পাপুয়া নিউগিনির ওই ব্যাঙের মতনই অমন মস্ত বড়ো ব্যাঙ হবে। সব অবাক করা রেকর্ডের কথা লেখা কী একটা বই আছে বলে সে শুনেছে। সেই বইটায় তার নাম আর ছবি উঠবে! কত কত মানুষ দেখতে আসবে তাকে এই উতলধারা গ্রামে। পারলে তাকে দেখার জন্যে টিকিট কাটারও ব্যবস্থা করে ফেলতে পারে উতলধারা গ্রামের ‘মিচ্ছে ক্লাব’-এর ছেলেরা। তা টিকিট কেটে লোকে দেখতে আসুক না কেন! তাতে তার নামযশ হবে, কদরও তো হবে খুব।

মা বর্ষা-ভেজা সন্ধেবেলা উতলধারাগ্রামের সকলকে ডেকে ডেকে বলতে পারবে, ‘‘দ্যাখো তোমরা, আমার ব্যাঙাচিকুমারকে দ্যাখো! বড়ো হওয়া কাকে বলে! বড়ো হয়ে সে তো সব্বাইকে তাক লাগিয়ে দিল গো!’’

ব্যাঙাচিকুমার মনে মনে ঠিকই করে রেখেছে, সত্যি যদি সে অমন বড়ো হতে পারে, তখন একদিন চুপিচুপি মাকে বলে তার এই বিচ্ছিরি নামটা পালটে ফেলবে। ইশ, ব্যাঙাচিকুমার আবার কোনও নাম হল নাকি? তাও ব্যাঙকুমার নামটা হলেও না হয় চলত। তবে তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে-মড়িয়ে আছে ‘কুমার’ কথাটা, এটাই যা রক্ষে!

আবার যখন সে একা নিজের মনে বিড়বিড় করে ব্যাঙেদের জাতীয়সঙ্গীত গাওয়ার মতো গুনগুন করে ‘ব্যাঙাচিকুমার, ব্যাঙাচিকুমার’ বলে, তখন শুনতে কিন্তু তার বেশ লাগে। তার তখন মনে হয়, নামটা বেশ! রাজারাজড়ার ছেলের মতো লাগছে শুনতে। তখন তার মনে হয়, দুর, থাক না! এই নামটাই বেশ ভালো।

দিগন্তি দিদিমণির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে খুব মায়াময় গলায় দিদি যখন ডাকবে, ‘‘এস ব্যাঙাচিকুমার, এত দেরি করলে যে বড়?’’

তখন সে বলবে, ‘‘আপনার বাড়িতে আসতে গিয়ে এমন ঝড়-বাদলে পড়লাম কিনা দিগন্তি দিদিমণি! তাই তো অমন দেরি হয়ে গেল।’’

তখন দিগন্তি দিদিমণির মুখভার হবে কি না কে জানে? সে তো এর আগে কোনওদিন দিগন্তি দিদিমণির বাড়ি যায়নি। দিগন্তি দিদিকে চোখেও দ্যাখেনি। দিদি দেখতেই বা কেমন, সে কি কিছু আন্দাজ করতে পারে? না দেখে কি কোনও কিছু আন্দাজ করা যায়? তবে মা’র মুখে শুনেছে, দিগন্তি দিদিমণি খুব জ্ঞানী মানুষ। অনেক কথা জানে।

ব্যাঙাচিকুমার একটা কথা মা’র মুখে শুনেছে, দিগন্তি দিদিমণি নাকি আসলে একটা মস্ত বড়ো জলফড়িং। মা তাকে দিগন্তি দিদিমণির বাড়ি পাঠাচ্ছেন, পড়ালেখা করে যেন সে খুব বড়ো হয়, তাই। ব্যাঙ-সমাজের যেন অনেক উন্নতি করতে পারে। আর যত ব্যাঙ-নাগরিক আছে, সকলে যেন একবাক্যে বলতে পারে, ‘‘দ্যাখো, দ্যাখো, আমাদেরই ব্যাঙ-বংশে একখানা ছেলে জন্মেছিল বটে!’’

এবার বৃষ্টি একটু থম মেরেছে। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়াই ভালো। এমনিতেই কতখানি সময় পেরিয়ে গেল। এবার লাফ কেটে কেটে চটপট যেতে হবে। সে মা’র মুখে শুনেছে, উতলধারা গ্রাম থেকে দিগন্তি দিদিমণির বাড়ি যেতে তার ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় লেগে যাবে। নাকি তারও বেশি?

তা লাগুক! বড়ো হতে গেলে কত কিছুই না করতে হয়। বড়ো হওয়া কি মুখের কথা নাকি? ব্যাঙাচিকুমারও বড়ো হতে চায়, অনেক বড়ো। অনেক লেখাপড়া শিখে সে একদিন উতলধারা গ্রামের একজন কেউকেটা হবে। সকলে তাকে মান্য করবে। দরকারে অ-দরকারে সকলে তার কাছে পরামর্শ নিতে আসবে। সেজন্যে যা যা করতে হয়, সবই করবে ব্যাঙাচিকুমার।

ব্যাঙাচিকুমার গুনে গুনে লাফ কাটতে শুরু করল। সতেরোবার লাফানোর পর পেল একটা সাদা কাঞ্চনফুলের গাছ। ডালে ক’টা মৌটুসিপাখি ভিড় জমিয়েছে এই বর্ষায়। ব্যাঙাচিকুমার মনে রাখল কথাটা। একটু থেমে ফের লাফ কাটতে লাগল। ঘাসের মধ্যে শরীর ডুবে যাচ্ছে তার। একটু থেমে মুখ তুলে দেখে নিয়ে ফের লাফাতে লাগল।

তেত্রিশবার লাফিয়ে গিয়ে থম হয়ে গেল ব্যাঙাচিকুমার। গুনতে ভুল হয়ে গেল না তো? সে তেত্রিশবার লাফাল, না একত্রিশবার? মনে হয় যেন একত্রিশবার। মা বলে দিয়েছে, “ক’বার লাফিয়ে তুই দিগন্তি দিদিমণির বাড়ি পৌঁছলি, ঠিক করে গুনে রাখিস কিন্তু। তাহলে যেদিন দিগন্তি দিদিমণির কাছে পড়ালেখা শেষ হয়ে যাবে, সেদিন তো তোকে একা একাই বাড়ি ফিরতে হবে। লাফগুলো গুনে রাখলে টং টং করে সোজা বাড়ি চলে আসবি। তোর পথ ভুল হওয়ার জো থাকবে না।”

নাহ্‌, কিছুতেই মনে পড়ছে না! মনে হয় গুনতে তার ঠিক ভুলই হয়েছে। আর ভুল হবে নাই বা কেন? সে কি কোনওদিন মাস্টারমশাইয়ের কাছে ভালো করে ধারাপাতটা শিখেছে নাকি? সেই জন্যেই তো তার দিগন্তি দিদিমণির বাড়ি যাওয়া।

সে ঠিক করল, এখান থেকে লাফ কাটতে কাটতে গুনে গুনে ফের পিছিয়ে যাবে। লাফ কাটতে লাগল ব্যাঙাচিকুমার। একত্রিশটা লাফানোর পর সে দেখল, পৌঁছে গেছে সাদা কাঞ্চনফুলের গাছটার কাছে। তা হলে ভুল তার হয়েছিল ঠিকই! সাদা কাঞ্চনফুলের গাছটার কাছে গিয়ে মাটিতে থেবড়ে বসে পড়ল ব্যাঙাচিকুমার। এবার সতেরোর সঙ্গে একত্রিশ যোগ করতে হবে। সে খুব কঠিন কাজ। থেমে থেমে হিসেব করল। প্রথমে যোগফল হল উনপঞ্চাশ। তারপর কী মনে হতে ফের যোগ করতে লাগল সে। ও মা, না। এখন তো আটচল্লিশ হচ্ছে। এই সামান্য যোগটা করতে তার লেগে গেল প্রায় একঘণ্টা। বেশ কয়েকবার যোগ করার পর সবশেষে আটচল্লিশটাই সঠিক যোগফল ধরে নিয়ে ব্যাঙাচিকুমার একটু আকাশের দিকে মুখ তুলে দম নিল।  কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে তার। বাঁ-হাতের চেটো দিয়ে কপালের ঘাম মুছল ব্যাঙাচিকুমার।

তারপর ফের একত্রিশবার লাফিয়ে পৌঁছে গেল আগের জায়গায়। হ্যাঁ, ওই তো বাঁদিকে সেই কামিনীগাছটা। ওই তো তার ঝুপ্পুস হয়ে থাকা ডালে ডুমো ডুমো ছোটো সবুজ ফল খেতে এসেছে কত কত বুলবুলিপাখি। বেশ লাগছে দেখতে। তার মনে হচ্ছে, দিগন্তিদিদির বাড়ি গিয়ে আর কাজ নেই। এখানেই থেকে যাই গোটা দিনটা। সে যে একটু ভুলো মনের, সে কথা মা বলে, কচ্ছপ-দিদিমাও বলে, আরও কত কে যে বলে, সে ওসব কথা অবশ্য মনেও রাখে না।

এসব ভাবতে ভাবতে ফের গুনে গুনে লাফ কেটে দিগন্তি দিদিমণির বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সে। হঠাৎ বাঁ-হাতটা মাথায় দিয়ে সে ধপাস করে বসে পড়ল একটা রঙ্গন ঝোপের পাশে। এই যাহ্‌! লাফ কাটা গুনতে এবারও ভুল হয়ে গেল যে! হঠাৎ একটুখানি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। ব্যস! কী হবে এবার? আবারও কি তাকে কামিনীফুলের গাছটার কাছে ফিরে যেতে হবে? এরকম হলে তো দিগন্তি দিদিমণির বাড়ি পৌঁছতে একমাসও লেগে যেতে পারে। তখন কী হবে?

একমাস পরে দিগন্তি দিদিমণির বাড়ি গিয়ে হাজির হলে দিদিমণি কি আর তাকে লেখাপড়া শেখাতে রাজি হবে? ইশকুলে ভর্তি নেবে আর? ততদিনে হয়তো নতুন কোনও ছাত্রকে ভর্তি নিয়ে নেবে। ইশকুল তো আর খালি পড়ে থাকতে পারে না!

তা হলে মা’র কাছে বকুনির আর শেষ থাকবে না। গোটা উতলধারা গ্রামে রটে যাবে, ব্যাঙাচিকুমার দেরি করে যাওয়ার জন্যে আর ইশকুলে ভর্তিই হতে পারল না। ছিঃ ছিঃ!

না, তাকে তো চেষ্টা করতেই হবে। মন শক্ত করে ফের কামিনীফুলের গাছ পর্যন্ত পিছিয়ে গেল ব্যাঙাচিকুমার। তারপর গুনে গুনে লাফ কাটতে লাগল। এবার সে কোনও মতেই অন্যমনস্ক হবে না। কীসব আবোল তাবোল ভাবতে গিয়ে এবার এই কাণ্ড হয়েছে।

কামিনীগাছ থেকে রঙ্গনগাছ পর্যন্ত হয়েছে সাতাশটা লাফ। সঙ্গে সঙ্গে যোগ করতে বসে গেল ব্যাঙাচিকুমার। আটচল্লিশ আর সাতাশ, যোগ করলে হল গিয়ে পঁচাত্তর।

আগুপিছু করতে করতে ব্যাঙাচিকুমার যাচ্ছে দিগন্তি দিদিমণির বাড়ি। যেতে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে যে! সে তবু প্রাণপণ চেষ্টা করছে। যেতে তাকে হতেই হবে।

দিগন্তি দিদিমণির উদ্দেশে সে মনে জোর এনে বলল। সে শুনেছে, মনের জোর নিয়ে কোনও কথা বললে, সে যার উদ্দেশে কথাটা বলছে, ঠিক তার কাছে পৌঁছে যায়। ব্যাঙাচিকুমার বলল, “ও দিগন্তি দিদিমণি, এই ঝড়-বাদল আর কাদায় পিছল রাস্তা পেরিয়ে যেচ্ছি। তাই তোমার ইশকুলে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি যেন এই ফাঁকে আর কাউকে তোমার ইশকুলে ভর্তি নিয়ে নিও না! ওই তো আকাশজুড়ে মস্ত একটা রংধনু উঠেছে গো! না, আর বৃষ্টিও পড়ছে না। দ্যাখো, চারপাশটা কেমন আলো ঝলমল করছে!”

এমন সময় ঘাসের ভেতর থেকে মুখ তুলে ব্যাঙাচিকুমারের একদম সামনে এসে একটা সবজে রঙের ঘাসফড়িং বলল, ‘‘ও ব্যাঙাচিকুমার, কোথা যাও অমন হনহন করে? দু’দণ্ড দাঁড়াও না খানিক। এস, দু’জনে মিলে আকাশের অমন বড়ো রংধনুটা মন ভরে দেখি।’’

‘‘না না। আমার হাতে এখন অত সময় নেই ঘাসফড়িংভাই! আমি এখন যাচ্ছি দিগন্তি দিদিমণির ইশকুলে ভর্তি হতে। আমাকে পড়ালেখা শিখে অনেক বড়ো হতে হবে না? তুমি একা একাই রংধনু দ্যাখো। আমি বড়ো হয়ে নিজেই যেন অমন বড়ো একটা রংধনু হতে পারি।”—–

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s