অর্চি।মানে অর্চিষ্মান বন্দোপাধ্যায়। মায়ের পাটু বাবু পটলা।
পড়তে শিখছে পাটু।দিদির মত অত তাড়াতাড়ি নয়।কিন্ত শামুকের মতন ও নয়।ঐ যুক্ত অক্ষর হলে একটু মনে মনে বানান করে নেয়।
দিদি ত পাকা বুড়ি থুরথুরি। পুলপুলি দেবী। পাটুর চাইতে পুরো দু বছরের বড়ো।সে ছেলেবেলা থেকে দাদাইয়ের কোলে বসে অ-চ-ল অ-ধ-ম করেছে তো।তাই ইস্কুলে ঢোকার আগেই রিডিং পড়ার অভ্যেস হয়ে গেছে।
কেমন গিন্নিমার মত মুখ করে বলল,” কিছুই যে পড়িস না ভাই,শেষে কি গোমুখ্যু হবি?”
হুঁ! শক্ত শক্ত শব্দ বলতে গিয়ে ওর সামনের খুদি খুদি সাদা দাঁতগুলো টপটপ করে খুলে পড়ে যায়নি এদ্দিনে যে, এই না ঢের।
দোষের মধ্যে কী না অর্চি, এই ফুটকি থেকে পেন্সিল দিয়ে ওই ফুটকি অব্দি লাইন টেনে টেনে কার্সিভ রাইটিং এর পাতা ভর্তি জি,এইচ লিখছিল না। কেবলই এই পেন্সিল দিয়ে হিজিবিজি কেটে হাত ব্যথা করতে কাঁহাতক ভাল লাগে?
দাদাইয়ের সোফার পিঠটায় চড়ে বসেছিল পটলকুমার পাটুবাবু। সামনেই গ্রিল দেওয়া পুবদিকের জানালাটা। পাশে চৌকো চৌকো রঙিন কাচ দেয়া ভাঁজ করা দরজা পেরিয়ে দোতলার ঝোলানো বারান্দা। বারান্দার মাথায় ঢালু লাল টালি। রোজ পুবের আলো বারান্দা পেরিয়ে রঙিন কাচের মধ্যে দিয়ে ঘরে এসে “জবাকুসুমসঙ্কাশং” বললেই দাদাই এসে সুর্যকে প্রণাম করেন। ওপরে ঠাকুরঘরে ঠাকুরকে গুড মর্নিং করে,কই গো বললেই, আম্মু ধোঁয়া ওঠা নেসক্যাফে আর গুড ডে বিস্কুট নিয়ে হাজির।
গরমের ছুটতে পাটু আর তার পুলপুলিদিদি, বেশির ভাগ সময়টাই দাদা আম্মুর বাড়ি “সীমাস্বর্গ”তে থাকে। খুউব মজা তখন। তার মধ্যে কেন হোম ওয়ার্ক টোম ওয়ার্কের খারাপ কথাগুলো মনে করা?
সোফার উঁচু পিঠটার দুদিকে পা দিয়ে বসে অর্চি ট্রাক চালায়। বিলকুল ট্রাকের মতই আওয়াজ হয় মুখ দিয়ে। বাঁইবাঁই করে স্টিয়ারিং ঘোরে দুই হাতে। সোফায় বসে দাদাই অনেক সময় ব্যাংকের কাগজ, হিসেবপত্র, এটা ওটা লেখেন। তাতে অর্চির কোন অসুবিধে হয় না। দাদার ঘাড়ের ওপরে হেলান দিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকে সে। দাদা মাঝেমাঝে বলেন, “ভাই গাড়ি তো আমার ঘাড়ের ওপরই চালিয়ে দিলে, কাজ করব কী করে?”
কিন্ত তাতে কারো কোনই হেলদোল হয় না। অর্চি জানে, দাদা কখনো বকেন না।আর তার গাড়িভক্তির পাঁচালিতে দাদাই তার একমাত্র পার্টনার। সামনের বাড়ির দুটো তিনটে বাইক এলেই, কে দৌড়য় পাটুর সংগে, হ্যাঁ? দাদা সাথেসাথেই, ভাই আয় আয় লাল গাড়িটা এল,নীল গাড়িটা এল— বলে ওর সংগে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান কিনা? বুঝবে আর কেউ লাল নীল ভ্রুম করে এসে দাঁড়ানো মোটরবাইকের মাহাত্ম্য? একটা গানও আছে ওদের। চুপিচুপি দুজনে মিলে গায়-
” লাল গাড়িটা কোথায় গেলি
নীল গাড়িটা কোথায় গেলি
জজ্জা জানলা কোথায় গেলি……”
আসলে,ভাইকে রংপেন্সিল দিয়ে নানারকম গাড়ি যেই এঁকে দ্যান দাদাই, অমনি তার খুদি খুদি জরজা জানলা দেখে ভারি উত্তেজিত হয়ে পড়ে দাদার সোনার গুল্লিভাই, শ্রীমান অর্চিষ্মান বন্দোপাধ্যায়। দাদা,বাবা, পিসেমশায়, যেখানে যত গাড়ি কিনতে পাওয়া যায়,সব এনে জড়ো করেন সবাই শ্রীমান ভাইয়ের জন্যে। ট্রাক, সাইকেল, পুলিশের জিপগাড়ি, এরোপ্লেন, ট্যাক্সি –কী যে নেই!
গত জন্মদিনে দাদাই আবার সত্যিকারের মত একটা রেললাইন আর মস্ত ট্রেন কিনে দিয়েছেন। গোল করে লাইন পেতে সুইচ টিপে ট্রেন চালিয়ে দিলেই রেলগাড়ি চলতে থাকে। দিব্যি তার মধ্যেখানে বসে থাকে অর্চিষ্মান। মোট কথা দাদাই আর পটলু ভাই,এই দুজনেই গাড়ি বোদ্ধা।
সেদিন দাদাই বাজারে। তাই হরলিক্স আর বিস্কুট খেয়ে একাই সোফায় ট্রাক চালাচ্ছিল অর্চি। নিচে একতলার রাস্তা থেকে কত রকম সকাল বেলার আওয়াজ ভেসে আসছে।
“বা স ন নেবেন না কি। বোম্বে ইস্টিল……”
“এইচ্চাবি….”
“শিল কাটাউ–”
হঠাৎ বারান্দার নিচে খুব জোরে কে বলল,” কামড়ে নিবু”। চমকে উঠল অর্চি। রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে আম্মুকে দেখা যাচ্ছে না কিন্ত। কেমন গা ছমছম লাগল। আবার খুব জোরে কে বলল, ” কামড়ে নেব ।”
চমকে ধড়াস করে ওঠে বুকের ভেতর। পাটা ঘুরিয়ে নিয়ে সোফা নেমে বসল পাটু সড়াৎ করে। ডাকব আম্মুকে? নাঃ। আর তো শোনা যায়নি গলাটা।
আবার উপরে উঠে বসতে যাবে যেই,ফের, ” কামড়ে নেব।”
নাঃ আর এখানে থাকলে চলবে না। সাবধানে পা ঝুলিয়ে দিয়ে সোফা থেকে আলগোছে নেমে পড়ে অর্চি। এক পা, দু পা টিপিটিপি গিয়েই ধাঁ করে দৌড়ে খাবার আর রান্নার জায়গার মাঝখানে পৌঁছে গেল। গ্যাসের ওপরে ভাত টুগবুগ করে ফুটছে আর গন্ধ ছড়াচ্ছে হাঁড়ি থেকে। ঝকঝকে রান্নাঘরে রোদ। কিন্তু আম্মু তো নেই। তবে কি কেউ নিয়ে চলে গেলো আম্মুকে? পিছিয়ে পিছিয়ে আম্মুর শোয়ার ঘরের দিকে যেতে থাকল অর্চি।
আম্মুর ঘরের পিছন দিকে, পশ্চিমের বারান্দা থেকে পুলপুলিদিদির গলা ভেসে এল হঠাৎ, “ভাই,এই ভাই,কই গেলি রে,দেখে যা কুচি কুচি কত পেয়ারা হয়েছে গাছে।”
দিদিভাইউর গলা! বেঁচে গেলো পাটুবাবু। এক দৌড়ে আম্মুর ঘরের পাশের ছোট দরজা দিয়ে পিছনের বারান্দায়। দিদি সেখানে মস্ত লগা হাতে বীরের মত দাঁড়িয়ে।
“কী রে?”
“দ্যাখ ভাই দ্যাখ, পেয়ারা ফুল আর ছোট্ট ছোট্ট পেয়ারায় গাছ ভর্তি রে।”
“তাই তো! তুই লক্কা নিয়ে কী করছিস?”
মস্ত একখানা বাখারি।তার মাথায় কাস্তের মত বাঁকানো লোহা নারকেল দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খুউব শক্ত করে বাঁধা আছে। ওই দিয়েই টেনে টেনে আম্মু,দাদাই,রান্নার বউমা, নিম পাতা, পেয়ারা, আম সব পাড়ে গাছ থেকে। আরও নানা সাইজের লাঠি আছে এবাড়িতে। দুই ভাইবোনেরই তার প্রতি অনন্ত লোভ।আম্মু লাঠি লক্কা নিয়ে টানাটানি করতে বারণ করেন।পাছে ছোট হাতে চোঁচ ফুটে যায়। বা নিজেদেরই মাথায় টাথায় লেগে যায় বেমক্কা। তাই আরো বেশি লোভ। আর লাঠি তো লাঠিই।এই লম্বা জিনিষটা লক্কা। পাটু দিদির কাছ ঘেঁষে আসে।
“ওই দিদিরে, নিচে একটু আগে কে একটা চেঁচাল।”
“কে?”
“কী জানি। বারবার বলছে, কামড়ে নেব, সত্যি।”
ভুরু কুঁচকে গেলো পুল্লিদিদির, “কই,চল দেখি।”
“লক্কাটা নিয়ে যাবি দিদি?”
“অ্যাঁ, না। দরজা দিয়ে বের করা বড্ড ঝামেলা। বারান্দার দরজা কত ছোট দেখছিস না! তার চে একটু দেখে আসি আগে। দরকার হলে,মায়ের ঠাকুরদাদার কালো পেয়ারার ডালের সেই যে লাঠিটা, মাথায় ওয়াইএর মত,ওইটা বরং নিয়ে যাব।”
হাত ধরে চলে দু ভাইবোনে।এ ঘর থেকে মাঝের সরু প্যাসেজ। তারপর দাদার ঘরের দরজা। ঘর পেরিয়ে সামনের বারান্দার কাছে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। দিদি বলে, “ধুত, শুধু শুধু ভয় পাস ভাই। কই, কেউ তো নেই।”
“বলছি আছে! কামড়ানোর কথা বলছিল।”
“কামড়ানো না হাতি।”
বাঘ সিংহদের আবার ভারি পছন্দ পুলপুলিদিদির। ভাইকে রোজ তার পোষা হাতির গল্প শোনায়। ছোট্ট মতন হাতির ছানা।নাকি,শুঁড় দুলিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে দৌড়ে আসে।পুচকে লেজ টিংটিং করে নাড়ে পিছনে। ওতে চড়ে দিদি নাকি ইস্কুল যাবে। ধ্যুত। এ তো নীল ভেলভেটের নরম ছোট্ট হাতু পুতুল।
না নাকি। দরকার পড়লেই দিদি ওর লম্বা কানে ফুঁ দিলেই ও বেলুনের মত ফুলতে ফুলতে বড়ো হয়ে যায় দিদিকে পিঠে নেবে বলে। দিদি কেমন চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, “সে কী? তুই দেখিসনি কখনো? কী হাঁদা রে—”
চুপ করে থাকে ভাই। কিন্তু বিশ্বাস হয় না। তো সে যাকগে। এখন তো সত্যিই কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না বারান্দার নিচে। দিদি দৌড়ে দাদার বুককেসের সামনে চলে গেল। সেখানে আয়নার সামনে সোনালি রঙের কাজ করা কানা উঁচু পেতলের মোরাদাবাদি থালা।ওপরে আম্মুর কাশ্মীরি কাজের গোল সিঁদুর কৌটো। থালার তলায় ধোপার হিসেব, মুদির দোকানের খাতা,কেবল টিভির রসিদ, সব চাপা দিয়ে রাখা। সেই সংগেই রাখা থাকে দিদিভাইউর পরম সম্পত্তি। হলুদ সেরেল্যাকের পুরোনো বাক্স কেটে দাদার বানানো অপূর্ব সব “চম” অর্থাৎ চশমা। কোনটা চৌকোনো,কোনটা নেতাজির ছবির মত গোল, কোনটা চোখের মত কোণা কোণা কায়দার। সে’রকমই একটা চশমা নাকের ডগায় লাগিয়ে গম্ভীর মুখে দিদি এগিয়ে গেলেন বারান্দায়। সাদা পিল্পের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল নিচে।
“কে রে ভাইকে ভয় দেখাচ্ছিল? ও মা! ও ভাই,দেখবি আয়।ও কামড়াবে না রে। ওই দ্যাখ, পাশে রাজাবনিদের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে। ও তো ফলওয়ালা কাকু। ওই যে মাথার ঝাঁকা নামিয়ে আম্মুর সংগে কথা বলছে। ওই যে রে,রোজ আমাদের জন্যে মুসাম্বি,কলা,আপেল দিয়ে যায় যে। আজকে কমলা লেবু এনেছে। এ বছর এই প্রথম কমলা লেবু রে, কী মজা! বুঝলি কী? কামড়ে নেবু না। বলছে কমল নেবু। আম্মু কমলা কিনছে ওর কাছ থেকে।”
আহ্লাদে গলাগলি বসে থাকে দুই মিষ্টি মানুষ। এইবার শীতকাল আসবে।
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে
ধন্যবাদ জয়ঢাক সম্পাদক মণ্ডলীকে।আশা করি ছোটদের আর বড়দের ও, ভাল লাগবে।
LikeLike
সুন্দর একটা লেখা আমাদের উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ। আশা করি ভবিষ্যতে আরোএমন গল্প পড়বার সুযোগ পাব আমরা।
LikeLike