টাক ডুমাডুম… টিং টং… প্রতিবারের মতোই পুজোর মরশুম ঘনিয়ে এসেছে। সেই সাথে দারুণ সব সাজপোশাক করে, এলাহি বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে একগাল হেসে টাব্বু, বুবুনদের মামার বাড়ির দরজায় হাজির সকলের প্রিয় বলাইমামা ওরফে ‘জাদুমামা’। সাত বছর বয়স থেকে ম্যাজিকই মামার শখ। পড়াশুনোয় ইতি টেনে কোনও এক বুড়ো ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে মাত্র সতেরোতেই মামা পালিয়েছিল ইস্তানবুল। এখন মামা ছত্রিশ। মামা এলেই বাড়ির সামনের স্কুল লাইব্রেরির মাঠে রীতিমতো মঞ্চ খাটিয়ে বসে যায় রমরমা ম্যাজিক-আসর। এই যেমন হাতের ডুগডুগি ঘোরাতে না ঘোরাতেই মিলিয়ে যায়। আশেপাশে ফুটে ওঠে অপূর্ব সব রঙিন ফুল, ফল। দেওয়াল জুড়ে ভেসে ওঠে মনোহর অরণ্য পরিবেশের ছবি। সাথে মিষ্টি সুরেলা পাখিদের ডাক। ছোটোবড়ো সকলের কী হাততালি!
এবারেও একটার পর একটা দারুণ ম্যাজিক দেখাচ্ছে মামা। তবে আসল ম্যাজিক শুরু হল মধ্যবিরতির পর। আস্তিনের পকেট থেকে মামা বার করল ছোট্ট এক পেন, যার নাম ‘ম্যাজিক পেন’। হাতে মাইক নিয়ে দর্শকদের ডাক দিল জাদুর মঞ্চে। বুবুনের ভাই টুকাই তো লাফাতে লাফাতে গেল। জাদুর নিয়ম অনুযায়ী টেবিলে রাখা বাক্স থেকে একটা চিরকুট বেছে নিয়ে না খুলেই পকেটে রেখে দিতে হল। তারপর যেই না হাতের পেন কাগজে ধরল, সরসর করে কয়েক লাইনে নিজে নিজেই লেখা হয়ে গেল পলাশীযুদ্ধের বিবরণ। টুকাইয়ের হাত শুধু কাঁপতে থাকল। উত্তরটা সে মাইকে পড়ে শোনাল। পকেটের চিরকুট খুলে আগে থেকে লিখে রাখা প্রশ্নটা ও শোনাল, ‘পলাশীর যুদ্ধ কাকে বলে?’ ব্যস! হাততালি আর হাততালি।
“এ তো আশ্চর্য ম্যাজিক! এর কোনও তুলনাই হয় না।”
‘‘কিন্তু, এ কী করে সম্ভব?”
একে একে বড়োরাও এল। নানানভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা হল। তবে প্রতিবারেই হাসিমুখো জাদুমামারই জয়। দর্শকের হাত শুধু পেন ধরে, আর পেন নিজে থেকেই সরসর করে উত্তর লিখে দেয়। চিরকুট খুললেই দেখা যায় উত্তরের সাথে মিলে গেছে আগে থেকে লিখে রাখা প্রশ্ন। দারুণ প্রশংসা পেল এই ম্যাজিক। সকলেরই মুখে একই আলোচনা, “কী করে সম্ভব?”
এসব দেখে দুষ্টু হাবুলবাবু পড়ল মহা ভাবনায়। পুজোর পরই তো পরীক্ষা। সারাবছর পড়াশুনো না করা আর দস্যিপনা করে বেড়ানো হাবুল কেবল ঐ পরীক্ষার সময়টাতেই তক্কে তক্কে থাকে কীভাবে ফন্দি এঁটে কম খেটেই পরীক্ষাকে উতরে দেওয়া যায়। তাই ম্যাজিকটা দেখে আসার পর থেকেই সে মনে মনে স্পষ্ট দেখছে, পেনটা সে যেই ধরছে, লেখা হয়ে যাচ্ছে পাতার পর পাতা পরীক্ষার খাতা। আর রেজাল্ট? সব বিষয়েই একশোয় একশো দশ। মানে, দশ নম্বর করে ভালো লেখার জন্য বাড়তি বোনাস। একেই বলে কেল্লা ফতে! একগাল হেসে হাবুল ভাবল, নাহ্, এই পেন তাকে বাগাতেই হবে। যে করেই হোক।
অতএব, যেমন ভাবা তেমন কাজ। একদিন বুবুনদের মামাবাড়ি জাদু দেখার নাম করে গিয়ে কাউকে না জানিয়েই টেবিলে পড়ে থাকা ম্যাজিকপেনটা সে অন্যায়ভাবে নিয়ে চলে এল। বিদেশের এত বড়ো ম্যাজিশিয়ানও ব্যাপারটা ধরতে পারল না? হি হি। নিজের এলেম দেখে সে খুবই হাসল। তবে আড়াল থেকে জাদুমামাও কি স্মিত হাসল?
স্কুল খোলার এক সপ্তাহ পরেই পরীক্ষা শুরু হল। হাবুলবাবু তো মহা আহ্লাদে খুব একটা না পড়েই পরীক্ষা দিতে দৌড়ে গেল। সাথে ম্যাজিক পেন আছে তো চিন্তা কী? একে একে সবের টেবিলে পরীক্ষার খাতা এল। প্রশ্নপত্রের দিকে তো সে তাকালই না। তারপর, হেঃ হেঃ করে হেসে যেই না সে পেনটা খাতায় ধরেছে, ম্যাজিক পেন তো চলতে শুরু করল নিজের মতন। কিন্তু, আরে! উত্তর কোথায়? এ তো খাতা জুড়ে আঁকা হয়ে যাচ্ছে জাদুমামার চকচকে মুখ। পেন তো থামছেই না। আর থামল তো সেই ছবি ফিকফিকিয়ে হাসতে শুরু করল। হাবুল তো সব দুষ্টুমি ভুলে ঘাবড়ে গিয়ে ঘামতে শুরু করল। আর তক্ষুনি ছবি থেকে একটা হাত বেরিয়ে এল। সাথে মোটা গলা ভেসে এল, “অ্যাই হাবুল, আমার পেনটা ফেরত দে তো। পেনটা দে!”
এই শুনে হাবুল ‘পে পে’ করে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান।
অসুস্থ হওয়ায় দুষ্টু হাবুলকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন হেডমাস্টার। ভয় তখনও কাটেনি হাবুলের। তবে নিজের ভুল সে বুঝেছে। বুবুন তাকে দেখতে এলে কাঁদো-কাঁদো গলায় হাবুল ম্যাজিক পেনটা ফেরত দিয়ে বলল, “জাদুমামাকে সরি বলে দিস ভাই। ইয়ে মানে, পেনটা সেদিন কীভাবে ভুলে চলে এসেছে। আর এই পেন দিয়ে লিখতে গিয়েই তো সব যেন কেমন গুলিয়ে গেল”
ফিক করে হেসে বুবুন বলল, “আমার মামা তো হিপনোথেরাপিও জানে রে। এমনকি দূর থেকেও হিপনোটাইজ করে দিতে পারে। তোর ঠিক কী হয়েছিল বল তো?”
দেখতে দেখতে বিদেশ ফেরার দিন চলে এল বলাইমামার। এয়ারপোর্টে পৌঁছে প্লেনের দিকে যাওয়ার আগে বুবুন ও হাবুলকে একইরকম দেখতে দুটো পেন দিয়ে জাদুমামা বলল, “সততা ও পরিশ্রমের কোনও বিকল্প হয় না। ম্যাজিক পেন বলে কিছু হয় না। ভালো করে পড়াশুনো করে যে পেন দিয়ে লিখবে সেই পেনই তোমাদের নিজ গুণেই হয়ে উঠবে ম্যাজিক পেন।” স্মিত হেসে পিঠ চাপড়ে ফিরে গেল মামা।
বাড়ি ফিরে পেনটা দেখতে দেখতে হাবুল ভাবছিল মামার বলে যাওয়া কথাগুলো। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করল, এখন থেকে সে সত্যিই মন দিয়ে পড়াশুনো করবে। তাহলে জাদুমামার কথামতন সব পেনই তার হাতে হয়ে উঠবে ম্যাজিক পেন।
অবাক কাণ্ড! এরপর থেকে স্কুলের পরীক্ষাগুলোয় হাবুলবাবু বেশ ভালো করে পড়াশুনো করে সত্যিই ভালো রেজাল্ট করতে শুরু করল। এখন তাকে সবাই ভালোবাসে। কেউ তাকে দুষ্টু হাবুল বলে না।
ছবিঃ ইন্দ্রশেখর