রাজকুমার রায়চৌধুরীর আগের সমস্ত গল্প
রাজকুমার রায়চৌধুরি
জীবরত্ল জানার একটা অদ্ভুত হবি ছিল৷ তাঁর চেনা জানা বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন কেউ মারা গেলে শোক সভা শ্রাদ্ধ ইত্যাদিতে হাজির থাকতেন নিমন্ত্রণ থাকুক বা না থাকুক৷ বিখ্যাত মানুষদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম ছিল৷ তাঁর একটা ডায়েরি ছিল ৷ তাতে মৃত ব্যক্তির সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য লেখা থাকত, যেমন জন্ম মত্যু সময় ও তারিখ, কী অসুখে মারা গেছেন, মদ্যপান বা/ও ধূম পান করতেন কিনা ইত্যাদি তথ্য৷ প্রায় দশ হাজার মানুষের এই সব তথ্য ওঁর ডায়েরিতে আছে ৷ অবশ্য এর জন্য একটা নয় দশটা ডায়েরি লেগেছে৷ দশম ডায়েরি ও শেষ হওয়ার মুখে৷ ওনার এই ডায়েরির কথা কী করে আমেরিকা অবধি পৌঁছয় ৷ দুজন আমেরিকান অধ্যাপক ওঁর ডেটাবেস কিনে নিতে চান মোটা দামে ৷ জীবরত্ন ভাবছেন কী করবেন৷
জীবরত্ন একটা মফঃসল কলেজে পড়াতেন ৷ সবে রিটায়ার করেছেন৷ দক্ষিণ কলকাতায় এক শহরতলি অঞ্চলে একটা এক কামরার একটা ফ্ল্যাট কিনে রিটায়ার করে এই ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন৷ ফ্ল্যাটবাড়িটা পুরনো কিন্তু ভালো সারাই করে রাখবার দরুণ নতুনই দেখায় ৷ নিরাপত্তার অভাব নেই৷ প্রাইভেসিও আছে৷ এর আগে উনি উত্তর কোলকাতার একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন৷
জীবরত্নবাবুর এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে৷ ছেলে পুনেতে থাকে, মেয়ে জামাই দুজনেই ব্যাঙ্কে চাকরি করে৷ সল্টলেকে ভাড়াবাড়িতে থাকে৷ স্ত্রী দু বছর হল গত হয়েছেন৷ জীবরত্নকে এখন মুক্তপুরুষ বলা যেতে পারে৷
২
নিজের ফ্ল্যাটে এসে জীবরত্লের বেশ ভালোই লাগছে৷ উনি ঠিক করলেন ডায়েরি উনি কাউকে দেবেন না৷ ডায়েরিতে যত মৃত ব্যাক্তির নাম আছে তাঁদের সবার ফটো জোগাড় করবেন৷ সেলিব্রেটিদের ব্যাপারে কোন সমস্যা নেই। ইন্টারনেট সার্চ করলেই পাওয়া যাবে ৷ অনেক ছবি ওঁর সংরক্ষিত আলবামে পাওয়া যাবে৷ কলেজে পড়ার সময় একটা ক্যামেরা কিনেছিলেন৷ তারপর আর একটা ভালো ক্যামেরা কিনেছিলেন৷ এ যাবত যত ছবি তুলেছিলেন সব আছে ৷ যাদের ছবি আছে তাঁদের বেশির ভাগ মানুষই মারা গেছেন৷ তাঁদের ছবিগুলো তো এখনি ডায়েরির পাতায় সেঁটে দেওয়া যায়৷
জীবরত্ল কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ছিলেন৷ ৩০ বছর কেমিস্ট্রি পড়ালে যা হয়, জীবন সম্পর্কে একটা ঔদাসিন্য আসতে বাধ্য৷ যে সব বিজ্ঞানী শেষ বয়সে সাধু হয়ে যান বা দার্শনিক হন,জীবরত্নবাবুর মতে তাঁরা সবাই কেমিস্ট৷
৩
নতুন ফ্লাটে এসে জীবরত্নবাবুর একটা কাজ হয়ে দাঁড়াল রোজ সন্ধেবেলা বসবার ঘরে বসে ডায়েরিগুলোর পাতা ওল্টানো৷ দশমটি ডায়েরিতে আর নতুন তথ্য লেখার জায়গা খুব বেশি নেই৷ ডায়েরির পাতা ঘাঁটলে জীবরত্নবাবুর মনে হয় টাইম ট্রাভেল করে অতীতেফিরে যাচ্ছেন৷ রিটায়ার করার পর জীবরত্ন একটা প্রাইভেট কলেজে পার্ট টাইম পড়ান৷ যতটা না টাকার জন্য তার চেয়ে বেশি সময় কাটানোর জন্য৷
৪
এক দিন সন্ধেবেলা ফিরে বসবার ঘরে বসে জীবরত্ন কফি খেতে খেতে ডায়েরির পাতা উল্টাচ্ছিলেন ৷ অনেকগুলি তথ্য আরো যোগাড় করতে হবে , যেমন মৃত্যুর সঠিক কারণ কী ছিল সব জায়গায় লেখা নেই ৷ যেমন বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে লেখা আছে ক্যানসার, কিন্তু শরীরের কোন অংশে প্রথম ক্যানসার শুরু হয়েছিল লেখা নেই৷ হার্ট অ্যাটাক বা সেরিব্রাল স্ট্রোক কয়েকটা জায়গায় লেখা থাকলেও অনেক সেলিব্রেটির ক্ষেত্রে লেখা আছে বার্ধক্যের কারণে মৃত্যু।
ঐ সব ভাবতে ভাবতে জীবরত্নের মনে হল ঘরের টেম্পারেচার একটু কম৷ অন্তত শোবার ঘরের তুলনায় ৷ কয়েক দিনঝড় বৃষ্টি হওয়ায় খেয়াল করেন নি৷ কিন্তু আজ কাঠফাটা রোদ্দুর ছিল আর তার সঙ্গে তাল দিয়ে আর্দ্রতা৷ জীবরত্নের ফ্ল্যাটে এ সি নেই ৷ সর্দির ধাত আছেবলে এসি কেনেননি৷
আরও একটা জিনিস ভাবিয়ে তুলেছে৷ জীবরত্ন আরো অনেক নিরীহ লোকের মত মারপিটের সিনেমা দেখেন টিভিতে। ইংরেজি চ্যানেলে যে ছবিগুলি দেখায় বেশির ভাগ কংফু বা ওই জাতীয়৷ প্রায় সব ছবিই হাতাহাতিতে শেষ হয়া ভিলেন আর নায়কের হাতে আধুনিকতম অস্ত্র থাকতেও কেন সব ছুঁড়ে ফেলে হাতাহাতি করে আগে বুঝতে পারতেন না৷ এখন মনে হচ্ছে এটা ইগোর ব্যাপার৷ গুলি করে একটা রোগাপটকা লোকও একটা পালোয়ানকে মেরে ফেলতে পারে৷
আর যেসব সিনেমা দেখানো হয় ভূত বা প্রেতাত্মার ছবি, নয় গডজিলা বা আনাকোন্ডা জাতীয় আযনিম্যালহরর ফিল্ম। ভূতের ছবিতে মানুষের, বিশেষ করে মেয়েদের দুষ্ট আত্মা আশ্রয় নেয় ৷ অনেক সময় গোটা বাড়িটাই ভূতে দখল নেয়৷ ওদের তাড়াতে বেশিরভাগ সময় ষীশুখ্রিষ্টের নাম বা কাঠের ক্রসই যথেষ্ট৷ আমাদের দেশে ওঝারা অবশ্য ঝাঁটার উপরই বেশি ভরসা রাখে৷ আর একরকম ভূতুড়ে ছবি আছে যেখানে ভূত বা প্রেতাত্মা দেখা যায় না কিন্তু অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকে বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না৷ এর আর এক নাম প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিটিজ।
তবে জীবরত্নবাবু আগে এসব সিনেমা খুব বেশি দেখতেন না ৷ কিন্তু কিছুদিন হল উনি এসব সিনেমাই বেশি দেখছেন অথচ শোবার ঘরে গেলে মনে হয় কেন ওই সব সিনেমা দেখলেন৷ একটা পরীক্ষা করার জন্য উনি আর একটা ছোট টিভি কিনে শোবার ঘরে রাখলেন৷ কেবল কানেকশানও একটু কম রেটে পেলেন৷ উনি যা ভেবেছিলেন তাই হল। নিজের পছন্দমত চ্যানেলগুলি্ দেখতে কোন সমস্যা হল না৷
জীবরত্নবাবু বিজ্ঞানের ছাত্র ৷ অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করেন না৷ কিন্তু তবু মনটা খচখচকরতে লাগল৷ মনে হলঘরটার একটা নিজস্ব সত্বা আছে৷ এবং এটা এত শক্তিশালী যে ওঁর নিজের ব্যাক্তিত্বকে প্রভাবিত করছে৷ তারপরই মনে হল বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে এসব চিন্তাকে প্রশয় দেওয়া উচিত না৷
এইসব ভাবতে ভাবতে ডায়েরির পাতা উল্টাচ্ছিলেন হঠাৎ একটা ঠিকানায় চোখ আটকাল – ৫/৩ হরলাল বক্সী লেন ৷ জীবরত্ন মনে করবার চেষ্টা করলেন কোথায় ঠিকানা টা দেখেছেন ৷ চকিতে মনে পড়ল এখন ষে বাড়ির ফ্ল্যাটে বসে আছেন এটা সেই বাড়ির আগের ঠিকানা৷ বাড়িটা পুরোনো ছিল৷ ফ্ল্যাট হবার পর ঠিকানা বদলে গেছে৷ এবার মনে পড়ল একজন লেখকের মৃত্যুর পর উনি তার স্মরণ সভায় গিয়েছিলেন রবাহূত হয়ে৷ লেখকের নাম বিনয় বক্সী , হয়ত হরলাল বক্সীর বংশধর৷ এখন যেখানে উনি বসে আছেন পুরানো বাড়ির সেই একতলাটা এখানে ছিল আর বিনয়বাবু এখানেই থাকতেন৷ মৃত্যুর কারণ লেখা আছে আকস্মিক হৃদরোগ। ভাবলেন মিহিরের কাছে পরামর্শ নিলে ও কিছু আলোকপাত করতে পারে৷
ওঁর বন্ধুবান্ধব খুব বেশি নেই৷ ফ্ল্যাট বাড়িতে দোতলায় থাকেন ডঃ ভবেশ ভাওয়াল নিউরোলজিস্ট ৷ ন্যু ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে PhD করেছেন৷ ওঁর সঙ্গে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধরনের বিষ নিয়ে আলোচনা হয়৷ জীবরত্নের ডায়েরিতে যাদের নাম আছে তার মধ্যে ১০০ জন আত্মহত্যা করেছে৷ বেশির ভাগ ই বিষ খেয়ে৷ একজন তো স্বেচ্ছায় গোখরোর কামড় খেয়ে মরেছে৷
তবে ওঁর পূর্বতন কলেজের ফিজিক্মের অধ্যাপক মিহির মুস্তাফীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে ৷ মিহিরবাবু নাস্তিক বটে তবে নানান বিষয়ে পড়াশোনা করেন৷
৫
পরের রবিবারই জীবরত্ন মিহিরবাবুর বাড়িতে হাজির৷ মিহিরবাবু বিপত্নীক ৷ পৈত্রিক বাড়িতে থাকেন৷ এক বিধবা দিদি থাকেন। উনিই সব দেখাশুনা করেন৷ মিহিরবাবু সারাক্ষণ বই বা কমপিউটার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন৷ জীবরত্ন আসাতে খুশিই হলেন৷ জীবরত্নের ডায়েরির ব্যাপার উনি ভালই জানতেন ৷ মাঝেমাঝে ঠাট্টা করে বলতেন, “বুঝলে রত্ন, যদি ব্লাড গ্রুপ আর ডিএন এর স্যাম্পলটাও নিয়ে রাখতে তোমার ডায়েরি থেকে দুটো থিসিস হতে পারত৷”
আজও প্রথমেই সেই কথাটা বলতে জীবরত্ন বললেন, “ঠাট্টা করছ কর কিন্তু আমার যা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হচ্ছে কিছুতেই ব্যাখ্যা করতে পারছি না৷”
মিহিরবাবু বললেন, “ঝেড়ে কাশো তো দেখি–”
জীবরত্লবাবু্ নতুন বাড়িতে আসার পর যা যা অভিজ্ঞতা হয়েছে সব খুলে বললেন৷ মিহিরবাবু শুনে হোহো করে হাসলেন, “আরে এর মধ্যে কোন অলৌকিক ব্যাপার নেই ৷ সারাক্ষণ মৃত লোকদের নিয়ে পড়ে থেকে যে ভূত দেখনি এটাই আশ্চর্য৷ ”
“দেখ, এখানে আসার পর বিনয়বাবুর কিছু লেখা পড়লাম, সবই প্যারানর্মাল সংক্রান্ত৷ এছাড়া ওমেন, এক্সরসিস্ট, প্যারানর্মাল ইত্যাদি সিনেমার ওঁর ভালো কালেকশান ছিল ৷ আমিও ওগুলো দেখছি৷ আচ্ছা একটা কথা বল৷ তুমি তো কিছুই বিশ্বাস কর না,অথচ তোমারবাড়িতে, অলৌকিক, ধর্ম এমনকি ভূতের বই গাদা গাদা রয়েছে দেখছি”
“দেখ রত্ন, প্রতিপক্ষ এইসব অলৌকিক ঘটনার কী যুক্তি দিচ্ছে না জেনে খন্ডন করবো কী করে? যদিও যত পড়ছি ততই অবাক হচ্ছি সমাজে শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত লোকদের মধ্যে ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার অভাব দেখে ৷ এক শিক্ষিত ভদ্রলোক বললেন উনি গণেশকে দুধ খেতে দেখেছেন৷ তর্ক করতে গেলে ভাববেন ওঁকে মিথ্যেবাদী বলছেন গণেশ যে একটা কাল্পনিক দেবতা, তা ওঁকে কে বোঝাবে? আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের মধ্যেও পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কার এমনভাবে মজ্জায় মজ্জায় মিশে রয়েছে যে তা দূর করতে হারকিউলিসও পারবেন না।”
“তুমি আমাকে সেই দলে ফেললে নাকি?”
জীবরত্লের প্রশ্ন শুনে মিহিরবাবু বললেন, “আরে না ৷ তুমি যা বললে সবই ব্যাখ্যা করা যায়৷ হয়ত তোমার শোবার ঘর পশ্চিম দিকে, তাই বসবার ঘরের থেকে একটু গরম লাগে৷ আর বিনয়বাবুর প্যারানরমাল বিষয়ে আগ্রহ আছে জেনে তুমিও ঐসব সিনেমা দেখতে শুরু করলে ৷ কেন করলে মনোবিদরা হয়ত বলতে পারবে।”
জীবরত্ন মন দিয়ে মিহিরবাবুর লেকচার শুনছিলেন৷ মিহিরবাবু থামার পরে বললেন, “তাহলে শোনো৷ আমার শোবার ঘর পশ্চিমদিকে নয় বরং আমার বসবার ঘর পশ্চিম দিকে৷ আর বিনয়বাবু সম্পর্কে কিছু জানার আগেই বসবার ঘরটা ঠান্ডা লাগত আর প্যারানরমাল ছবিও দেখতে যখন শুরু করি বিনয়বাবু এসবের চর্চা করতেন জানার আগে ৷ আর আমার শোবার ঘরের টিভিতে কেন এসব সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে না?”
‘ভাববার কথা ৷ তবে পুরোটাই হ্যালুসিনেশান হতে পারে৷ তুমি তো কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ,মৃত লোক পোড়ানোর পর কোন অর্গানিক কমপাউন্ডই পড়ে থাকবে না হয়ত নাভি ছাড়া ৷ সেটা তোমরাই বলতে পারবে।”
“তা ঠিক। ওইজন্যই আমিও ভূতপ্রেত এসবে বিশ্বাস করি না ৷ হ্যালুসিনেশান বলছ হতেও পারে ৷ কিন্তু হ্যালুসিনেশান এত সিল্কটিভ কেন হবে?”
“তবে কি তোমার মনে হচ্ছে বিনয়বাবুর প্রেতাত্মা তোমার উপর ভর করেছে?”
মিহিরবাবুর কথা শুনে জীবরত্ন একটু ক্ষুণ্ণ হলেন ৷ বললেন, “তুমি ঠাট্টা করছ৷ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ঘরটাই বিনয়বাবুর পার্স্নালিটি নিয়েছে৷”
“তাহলে তোমার ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে একটা নতুন ফ্ল্যাটে চলে যাও৷ যেখানে কারো ছায়া বা অপচ্ছায়া থাকবে না৷”
ওটাইতো মুশকিল। ঘরটায় থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে অথচ ছাড়তেও ইচ্ছে করছে না৷”
“তাহলে একটা কাজ কর৷ ডায়েরি ঘাঁটা বন্ধ কর আর কিছুদিন পাহাড় বা জঙ্গলে ঘুরে এস।”
“মন্দ বলনি৷” জীবরত্ন আর কথা না বাড়িয়ে মিহিরবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলেন৷
৬
জীববরত্নের ডায়েরিতে যে তথ্য নেওয়া বাকি ছিল সেগুলো তিনি সব জোগাড় করেছেন৷ একটা ছোট নোট বুকে টুকে রেখেছেন ৷ পরে বড়ো ডায়েরিতে তুলবেন৷ ইতিমধ্যে তাঁর পরিচিত দুজন ভদ্রলোক মারা গেছেন, একজন ক্যানসারে ও আর একজন এক দুর্ঘটনায় ৷ এছাড়া দুজন সেলিব্রেটি মারা গেছেন৷ একজন গায়ক ও আর একজন অভিনেত্রী ৷ আর একটা ডায়েরি কিনতে হবে৷ আপাতত ছোট নোটবুকে এগুলিও টুকে রেখেছেন৷ জীবরত্ন বাবু এখন ডঃ ভাওয়ালের ফ্ল্যাটে এসেছেন কিছু পরামর্শ নেবার জন্য৷ মিহিরবাবু একটা মেসেজ পাঠিয়েছেন জীবরত্নের দুটো ঘরের ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশনের ডিস্ট্রিবিউন মাপতে৷ এ ব্যাপারে উনি হেল্প করতে পারেন৷ প্ল্যন্ক ডিস্ট্রিবিউশন না হলে ভাববার কথা৷ মিহিরবাবু আর একটা সাজেশন দিয়েছেন ডঃ ভাওয়ালের কাছে জেনে নিতে নার্ভাস সিস্টেমের উপর রেডিয়েশনের প্রভাব কতটা৷ ডঃ ভাওয়াল এই প্রশ্ন শুনে বললেন এই বিষয় নিয়ে তিনি সবে গবেষণা শুরু করেছেন ৷ অতি সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে খুব অল্প ডোজ রেডিয়েশন ও ব্রেনকে প্রভাবিত করে৷ জীবরত্ন যখন প্রশ্ন করেন রেডিযেশনের ফলে ব্রেন এমন কোন সিগনাল পাঠায় কিনা যার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার কোন মিল নেই৷ যেমন ঠান্ডার অনুভূতিবা হ্যালুসিনেশান ইত্যাদি৷
“খুব জরুরি প্রশ্ল করেছেন। তবে এ ব্যাপারে বিশেষ করে হ্যালুসিনেশান আর রেডিয়েশনের উপর খুব একটা বেশি কাজ হয়নি৷ তবে মিহিরবাবু যে ব্ল্যাকবডি রেডিয়শনের কথা বলেছেন তার কোন এফেক্ট নার্ভাস সিস্টেমের উপর থাকার কথা নয়।”
“কেন বলুন দেখি?”
“দেখুন আপনি তো জানেন একটা ঘর সূর্যের আলো শোষণ করে তাই বিকিরণ করে প্ল্যাঙ্কের সূত্র মেনে৷ রোজই তো সূর্যের বিকিরণ আপনার শরীরে উপর পড়ছে ৷ খুব বেশিক্ষণ রোদের মধ্যে না থাকলে ক্ষতি হয় না৷ আর আপনি বললেন আপনার ক্যানসার হয়নি তাই গামা রেও নিতে হয়নি৷ কয়েকবছর আগে পায়ের এক্সরে করিয়েছেন তখন যখন কিছু হয়নি তাই এতদিন পরে কিছুই হবে না৷ তবে হ্যালুসিনেশান ব্যাপারটা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না।” এই বলে টেবিলের উপর রাখা একটা প্যাডের পাতায় খস খস করে কয়েক লাইন লিখে পাতাটা প্যাড থেকে ছিঁড়ে জীবরত্নের হাতে দিয়ে তিনি বললেন, “আপনি একবার ডঃ পরিমল ঘোষ দস্তিদারের সঙ্গে দেখা করুন৷ উনি যে শুধু নাম করা সাইকিয়াট্রিস্ট তা নয়। রেডিয়েশনের এফেক্টের উপর জর্জ মেসন ইউনিভারসিটি থেকে PhD করেছেন৷ আমাদের একটা জয়েন্ট প্রজেক্টও আছে৷”
জীবরত্নবাবু কাগজ নিয়ে উঠলেন বটে তবে একটু নিরাশ হলেন৷ সবাই তাঁর অভিজ্ঞতাকে হ্যালুসিনেশান বলছেন কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারছেন না৷ ভাবলেন কালকেই ড ঘোষদস্তিদারে সঙ্গে দেখা করবেন৷
ভাওয়ালের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে জীবরত্ন নিজের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়ালেন৷ মালতী এখনো আসেনি৷ মালতী এক মধ্যবয়সী মহিলা,সন্ধেবেলা এসে রান্না করে৷ জীবরত্ন ঘরে থাকলে কফিও করে দেয়৷ জীবরত্ন বাবুর আসতে দেরি হলে ভাওয়ালের ফ্ল্যাট থেকে চাবি নিয়ে আসে৷ কাজ শেষ হলে চাবি ফেরত দিয়ে চলে যায়৷ অবশ্য ততক্ষণে প্রায়দিনই জীবরত্নবাবু ফিরে আসেন৷
ফ্ল্যাটে ঢুকেই জীবরত্নের চোখ গেল সোফার সামনে রাখা টেবিলের দিকে৷ এটা আসলে কফিটেবিলের মতন৷ সোফায় বসে ওই টেবিলের উপর ডায়েরিতে যা লেখার লেখেন৷ শোবার ঘরে একটা ছোট রাইটিং টেবিল আছে। ওটা ক্লাস নোট বা রিসার্চপেপার ইত্যাদি লেখার জন্য৷
কফি টেবিলের উপর যে ডায়েরিগুলি উনি গুছিয়ে রেখেছিলেন সব এলোমেলো ভাবে ছড়ানো৷ সব কটারই পাতা খোলা ৷ কেউ যেন তন্ন তন্ন করে কিছু খোঁজার চেষ্টা করেছে ৷ জীবরত্নবাবু খানিকটা মন্ত্রমুগ্ধের মত সোফাতে বসলেন৷ টেবিলে দুটো ডায়েরি রাখা পাতা খোলা অবস্থায়৷ এর মধ্যে একটা দশম ডাযেরি, যার শেষ পাতাটা খোলা৷ অন্য ডায়েরির খোলা পাতাটা দেখে কিন্তু জীবরত্ন খুব একটা চমকালেন না। এটাই তিনি আশা বা আশংকা করছিলেন৷ এই পাতাতেই বিনয় বক্সীর সব তথ্য দেওয়া আছে৷ পাতায় বিনয় বক্সীর একটা ছবিও আছে৷ জীবরত্নবাবুর মনে হলঘরটা আরো ঠান্ডা হয়ে গেছে৷ ওঁর হ্ৎপিন্ডের স্পন্দনও মনে হচ্ছে বেড়ে গেছে৷ সবই কি হ্যাল্লুসিনেশান? হঠাৎ জীবরত্নবাবুর মনে হল বিনয় বক্সীর ছবিটা ক্রমশ বড়ো হচ্ছে ৷ না ওঁর মাথা ঘুরছে না এটা উনি বুঝতে পারলেন৷ ঘরের অন্যান্য জিনিস তো ঠিকই আছে কিন্তু কোন অদৃশ্য জাদুকরের ম্যাজিকের মতন ছবিটা বড়ো হতে হতে টেবিল ছাড়িয়ে গেল৷
জীবরত্নবাবু ভাবলেন ডঃ ভাওয়ালকে ডাকবেন৷ কিন্তু তাঁর হাত পা যেন জমে বরফ হয়ে গেছে ৷ চোখের সামনে দেখতে লাগলেন ছবিটাটা যেন হামাগুড়ি দিয়ে সামনের দেয়ালে সেঁটে গেল৷ কোনরকমে দশম ডায়েরিটা হাতে নিলেন তিনি৷ এর মধ্যে বিনয় বক্সীর ছবি পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়েছে ৷ পরনে সাদা ধুতিপাঞ্জাবী। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা৷ মুখে মৃদু হাসি৷
৭
সন্ধে সাতটায় মালতী এসে জীবরত্নবাবুর ফ্ল্যাটে দরজার পাশে রাখা কলিংবেলটা টিপল৷ নীচের তলায় চাবি আনতে গিয়ে জানল জীবরত্ন বাবু ফ্ল্যাটেই আছেন৷ কিন্তু বেল টেপার পাঁচ মিনিট পরেও কোন সাড়া না পেয়ে ভাবল উনি হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছেন ৷ কিন্তু এখন তো উনি কফি খান ৷ মালতী আবার বেল বাজাল৷ আবারও কোন সাড়াশব্দ নেই৷ মালতী ভাওয়ালের ফ্ল্যাট থেকে চাবি নিতে নীচে নামল৷ ডঃ ভাওয়াল সবে বেরোচ্ছিলেন। মালতীর মুখ থেকে সব শুনে বললেন, “আশ্চর্য! কিছুক্ষণ আগেই তো আমার সঙ্গে কথা হল৷ চল তোমার সঙ্গে যাই।”
দুজনে জীবরত্নের ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখলেন জীবরত্নবাবু সোফায় বসে কিন্তু মাথাটা সামনে ঝুঁকে আছে ৷
“স্যার বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন।”
ডঃ ভাওয়াল কোন কথা না বলে সোফায় বসা জীবরত্নবাবুকে সোফার উপর শুইয়ে দিলেন৷ নাকের নীচে হাত দিয়ে দেখলেন। খানিকক্ষণ নাড়ি পরীক্ষা করলেন৷ কোথাও জীবনের চিহ্ণ নেই৷ ডঃ ভাওয়াল একবার শেষ চেষ্টা করলেন। দু’হাত দিয়ে বুকের উপর চাপ দিলেন যদি হার্ট আবার চালু হয়৷ কিন্তু জীবরত্নের দেহ নিথর৷ জীবরত্ন বাবু আর নেই। মারা গেছেন৷
মালতী এতক্ষণ কান্না চেপে ছিল যদি ডাঃ বাবু স্যারকে বাঁচাতে পারেন ৷ এখন আর চুপ থাকতে পারল না। হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল৷ ডঃ ভাওয়ালের মেডিক্যাল ইমার্জেন্সিতে মাথা ঠিক থাকে৷ মালতীকে বললেন ডাঃ হালদারকে ডেকে আনতে৷ ডেথ সার্টিফিকেট হালদার দিলেই ভাল হয়৷
হঠাৎ কী মনে হতে ডঃ ভাওয়াল জীবরত্নের হাতের ডায়েরিটা তাঁর হাত থেকে তুলে নেবার চেষ্টা করলেন৷ ভীষণ শক্ত করে মৃত জীবরত্ন ডায়েরিটা ধরে আছেন৷ গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ডঃ ভাওয়াল ডায়েরিটা ছিনিয়ে নিলেন৷ শেষ পাতার শেষ অংশটা সদ্য লেখা। মনে হচ্ছে জীবরত্নেরই হাতের লেখা৷ ডঃ ভাওয়াল মৃতের মুখের দিকে তাকালেন৷ প্রচন্ড ভয়ে মুখ বিকৃত হয়ে গেছে৷
ডায়েরির শেষ পাতা পড়ে ডঃ ভাওয়াল থ হয়ে গেলেন ৷ প্রায় স্বগত উক্তির মত পডতে লাগলেন, “জীবরত্ন জানা ৷ জন্ম ১২ এপ্রিল ১৯৫৪। মৃত্যু ১৬ জুন ২০১৬। ধূমপান –না। মদ্যপান – না। মৃত্যুর কারণ — হার্ট ফেল৷
ছবিঃ শিমুল
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে