গল্প দুটি অণুগল্প পিয়ালী গাঙ্গুলি বর্ষা ২০১৮

পিয়ালি গাঙ্গুলীর আগের লেখা–  ফোচনের  কীর্তি , ফোচনের আরেক কীর্তি                  

      

জিয়াকে ড্রয়িং ক্লাস থেকে নিয়ে ফেরার পথে ‘মিও মরে’তে ঢুকল রিয়া। ভালোই খিদে পেয়েছে। হিয়ারও টিউশন থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে সবাই মিলে একসাথেই খাওয়া যাবে। জিয়া সারা দোকান ছুটে বেড়াচ্ছে। খাওয়ার সাথে তার পরম শত্রুতা। কিছুই খেতে চায় না। সারাদিন খেতে না দিলেও কোনো অসুবিধে নেই। এক চকোলেট ছাড়া কিছুতে লোভও নেই।
রিয়ার বিল মেটানো প্রায় হয়ে গেছিল, হঠাৎ এসে শো কেসে একটা নির্দিষ্ট চকোলেট পেস্ট্রির দিকে ইশারা করে বলল, “আমায় কাল টিফিনে ওই কেকটা দেবে?” রিয়া আনন্দে আত্মহারা। মেয়ে নিজে থেকে কিছু খেতে চেয়েছে। যাক, তাহলে একটা দিন অন্তত টিফিন ফেরত আসবে না। ভেবেও শান্তি।
স্টাফরুমের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে রিয়া। স্কুলটা বাইপাসের ধারে শিফট হয়ে ভালোই হয়েছে। ওপর থেকে এই ওয়াটার বডিগুলো দেখতে ছবির মত লাগে। আজকের দিনটা এখনো পর্যন্ত পারফেক্ট ডে চলছে। এমনিতে আজ ক্লাস কম থাকে, তার ওপরে আজ আবার সাবস্টিটিউশনও পড়েনি। তবে সবচেয়ে জবর খবর হচ্ছে যে ওদের পে স্কেল রিভিশন হচ্ছে। টাকার নামেই সকাল থেকে কতকিছু ভেবে ফেলেছে রিয়া। বরেরও কয়েকমাস আগে প্রমোশন হয়েছে। এবার তাহলে গাড়িটা বদলে ফেলবে। বহুদিনের শখ একটা সেডানের। তবে তার আগে একটা লং হলিডে। সামনেই ভেকেশন আসছে।
মোবাইলের রিংটা রিয়ার স্বপ্নের উড়ানকে একেবারে ক্র্যাশ করিয়ে দিল। জিয়ার ক্লাস টিচারের নম্বর। এই রে! আবার কী করল জিয়া? ডায়েরি নোট রোজই আসতে থাকে। টকেটিভ, রেস্টলেস, ডাজ নট সিট ইন ওয়ান প্লেস, হ্যাস আ টেন্ডেন্সি টু ডিসওবে – নার্সারি ওয়ান থেকে এসব কমপ্লেন শুনতে শুনতে রিয়ার গা সওয়া হয়ে গেছে। ক্লাস থেকে পালিয়ে টয়লেট বা অডিটোরিয়ামে লুকিয়ে থাকা, অন্যের মাথায় পেন্সিল কাটা ফুলকি ঢেলে দেওয়া, টেস্ট কপি ক্লাসের ডাস্টবিনে ফেলে আসা, ক্লাসে জল ঢালা, মারপিট… নিত্যনতুন দুষ্টুমির নালিশ শুনতে শুনতে রিয়া ক্লান্ত। নিয়মিত স্কুল থেকে ডেকে পাঠায়। মাথা নীচু করে সব শুনে আসা ছাড়া ওর আর কিছু করার থাকে না। সব দোষ তো ওর মেয়েরই। আর সবচেয়ে লজ্জার কথা ও নিজে একজন শিক্ষিকা আর নিজের মেয়েকেই মানুষ করতে পারছে না। ঠারে ঠোরে এই কথাটা অনেকবার শুনিয়েছেন ক্লাস টিচার আর প্রিন্সিপাল।
বড় মেয়ে হিয়াকে নিয়ে কোনো সমস্যাই হয়নি। একইভাবে তো বড় করেছে ওকে। যত সমস্যা জিয়াকে নিয়ে। এক্কেবারে প্রবলেম চাইল্ড। ছোট থেকেই। একই স্কুলে পড়ে বলে বড় দিদি হিসেবে হিয়াকে বনুর টিচারদের থেকে বনুর নামে রোজই নালিশ শুনতে হয়।
হিয়া সিরিয়াস টাইপের, পড়াশুনায়ও ভালো। ওর এসবে খুব লজ্জা করে। বনুকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে। কোনো লাভ হয় না। বনু বনুর মত বিন্দাস। স্কুলের পানিশমেন্ট, ডিটেনশান সবই চলতে থাকে। তাতেও তার বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া হয় না। শেষবার সাসপেন্ড হতে হতে বেঁচেছে। লাস্ট ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে।
অসহায় লাগে রিয়ার। অনেকবার ভেবেছে চাইল্ড সাইকোলজিস্ট কনসাল্ট করবে। নেট ঘেঁটে কয়েকটা নামও জোগাড় করেছে। বন্ধু আর সহকর্মীরা ওকে ধমকে থামিয়ে দিয়েছে। রিয়াই নাকি বেশি হাইপার হচ্ছে, ওরই কাউন্সেলিং দরকার। “জিয়া ইজ পারফেক্টলি নর্মাল”। ইন্টেলিজেন্ট বাচ্চারা নাকি এরকম হয়। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। ক্লাস ফাইভ তো হল, আর কবে বড় হবে কে জানে! 
ট্রফি আর সার্টিফিকেটে সাজানো প্রিন্সিপালের ঘর। তা তো হবেই। এতবছরের ঐতিহ্যশালী আর এত নামকরা স্কুল। বলিপ্রদত্ত পাঁঠার মত ভয়ে ভয়ে বসে আছে রিয়া। প্রিন্সিপালের মুখ থমথমে। জিয়াকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। দিব্যি হাসি হাসি মুখে ঢুকল মেয়ে। সাথে ক্লাসটিচার।
“ইউ নো হোয়াট শি হ্যাজ ডান দিস টাইম?” রিয়া মনে মনে বলল “বলেই ফেলুন, আসামী তো হাজির”।
আজ টিফিনে জিয়া ওরই ক্লাসের রায়ান নামে কোনো ছেলের মাথায় একটা গোটা চকোলেট পেস্ট্রি ঘষে দিয়েছে। ছেলেটার মাথার নাকি এমন অবস্থা হয়েছিল যে তাড়াতাড়ি তার গার্জেন ডেকে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হয়েছে।
রিয়ার মাথায় বজ্রাঘাত। ওহ, এই ছিল তাহলে জিয়ার মনে! মনে মনে ফন্দি এঁটেই কালকে ‘মিও মরে’তে চকোলেট পেস্ট্রি বায়না করেছিল। সত্যি ও কি বোকা! ভেবেছিল মেয়ের খেতে ইচ্ছা হয়েছে। ওর মেয়ে যে কি উঁচুদরের বদমাইশ সেটা ও কী করে ভুলে গেল?
রিয়ার ইচ্ছা করছিল সজোরে একটা থাপ্পড় কষায়। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। কেন এরকম করেছে তার কৈফিয়ত চাওয়ায় খুব ঠান্ডা মাথাতেই মেয়ে জবাব দিল, “রায়ান  কালকে আমার মাথায় কেকের গুঁড়ো ঢেলে দিয়েছিল। তাই তো আমি ওকে গোটা কেক মাখিয়ে দিয়েছি। আমার সাথে লাগতে আসা?”
উবারের সিটে গা এলিয়ে বসে আছে রিয়া। মাথায় হাজার চিন্তার জট। অবশেষে ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে আজ। সাতদিনের জন্য জিয়া সাসপেন্ড। এই সাতদিন এখন ওকে কার কাছে রেখে বেরোবে? বাবা মা নিজেদের বাড়ি ছেড়ে এসে থাকতে চায় না। অতএব ওকে রোজ নিজের স্কুল যাওয়ার আগে জিয়াকে বাবা মায়ের কাছে রেখে দিয়ে যেতে হবে আবার ফেরার পথে নিয়ে আসতে হবে। শাস্তিটা তো জিয়ার হল না, জিয়ার মায়ের হল। রাগে গড়গড় করতে করতে মেয়ের দিকে তাকালো রিয়া। সে দিব্যি বসে আছে। মুখে বিজয়িনীর হাসি। যেন অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতে এনেছে। আগামী সাতদিনে কী করে বাড়ির সকলের হাড়মাস জ্বালানো যায় হয়ত মনে মনে বসে সেই প্ল্যানই কষছে।

            

২) রঙিন শৈশব

একতলায় দুটো সিমেন্টের ধাপের ওপর ছোট্ট একটা মিটার ঘর, মাথায় এসবেস্টসের শেড। স্বপনদের জ্বালায় রান্নাঘর থেকে আচারের শিশি বাঁচানো যেত না। খাবি খা, তাতে আপত্তি নেই, তাই বলে এঁটো করে খাবি? এই বিচ্ছুগুলোর হাত থেকে আচার বাঁচাতে অবশেষে কাকিমা ওই মিটার ঘরের শেডে আচার শুকোতে দিতে শুরু করেছিলেন। আশা ছিল এখানে অন্তত আচার নিরাপদ।

কয়েকদিনের মধ্যেই সেই ভুল ভাঙল। রহস্যজনকভাবে শিশি থেকে আচার কমে যাচ্ছে। কাকু বললেন “শিশির মুখ খোলা থাকে, নির্ঘাত কাকে খায়।”

পরদিনই শিশির মুখে কাপড় বাঁধা হল। কিন্তু স্বপন এন্ড গ্যাংও শিল্পী মানুষ সব। বাধা কাপড় খুলে, আচার সাঁটিয়ে ঠিক আগের মত আবার কাপড় বেঁধে দেয়।

কাকিমা পড়লেন মহা বিপাকে। কী করে আচার হাওয়া হচ্ছে কিছুতেই বুঝতে পারছেন না।

একদিন রান্না করতে করতে বাইরে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ দেখলেন তার আচারের শিশি শূন্যে উঠে যাচ্ছে। ছুটে বারান্দায় এলেন। এসে দেখেন শিশির দুই ধারে দুই ছাতার বাঁট, তাতেই ভর দিয়ে শিশিটা সুন্দর উঠে যাচ্ছে ওপরে। কাকিমা হৈচৈ করে উঠতেই ঝনঝন শব্দে কাচের শিশি মেঝেতে পড়ে গুঁড়ো।

সঙ্গে সঙ্গে ওপরে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ, ঠিক যেন কয়েকজন দৌড়ে পালাচ্ছে। কাকিমাও দৌড়লেন ওপরে। কাউকেই ধরতে পারলেন না।

দেখলেন স্বপনের দলবল সিঁড়িতে বসে আছে। কাকিমা জিজ্ঞেস করলেন “এই স্বপন কোথায় রে?” সবচেয়ে ছোটটা উত্তর দিল “দাদা তো বাবার ঘরে, অঙ্ক করছে।” নিরাশ হয়ে কাকিমা ফিরে এলেন।

সেদিন থেকে কাকিমা তক্কে তক্কে আছেন। চোর একদিন ধরবেনই। অপেক্ষা করতে করতে ফের একদিন চোখে পড়ল আচারের শিশি উড়তে শুরু করেছে। আজ আর কোনোরকম শব্দ না করে পা টিপে টিপে ওপরে উঠলেন। ঠিক যা সন্দেহ করেছিলেন তাই। এই চুরির নেপথ্যে স্বপন আর ওর ভাইবোনেরা। বারান্দার রেলিং থেকে শরীরের অর্ধেকের বেশি অংশ বাইরে ঝুলিয়ে ওনারা ছাতা দিয়ে শিশি তুলছেন।

দেখেই তো কাকিমার মুখ শুকিয়ে গেলে। যদি বেকায়দায় নিচে পড়ে যায়? উনি কোনো শব্দ করলেন না, অপেক্ষা করলেন শিশি ওপরে ওঠার।

বাবার একটা মারও সেদিন বাইরে পড়েনি। অবশ্য শেষমেষ কাকিমাই এসে “আর মারবেন না দাদা” বলে বাঁচিয়েছিলেন। 

এই কাকিমা কিন্তু স্বপন, তপন, বেবি, ডলিদের নিজের কাকিমা নন। ওদের বাড়ির একতলার ভাড়াটে। কিন্তু সম্পর্কটা বাড়িওয়ালা ভাড়াটের নয়, ছিল অনেকটা যৌথ পরিবারের মত। যৌথ পরিবার হওয়ার খেসারত কাকিমাকে দিতে হত। নারকেল নাড়ু, নিমকি, জিভে গজা এসব তো রান্নাঘর থেকে উধাও হতই, এমনকি ফলও রেহাই পেত না।

কাকু হয়ত সবে বাজারের থলি রান্নাঘরে নামিয়ে ঘরে গেছেন। কাকিমাও ব্যস্ত অফিসের ভাত দিতে। এই সুযোগে রান্নাঘরের দুই প্রশস্ত দরজা দিয়ে খুদে চোরের দল মালপত্র অর্ধেক ফাঁকা করে দিয়েছে। বাজার গুছিয়ে রাখতে গিয়ে কাকিমা গজগজ করছেন, “এ কী বাজারের ছিরি! এইটুকু  আমের (বা কুলের) কী চাটনি করব আর কী আচার করব?”

শুনে কাকু ধেয়ে এলেন, “তার মানে? আমি এক কিলো এনেছি, আর কত আনব?”

ব্যাপারটা তখনই জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। তারপর থেকে কাকু সবকিছু আরো বেশি করে আনতেন, চোরেদের ভাগ হিসেব করে।

স্বপনের বাবাও অফিস থেকে ফিরতেন সবার জন্য হিসেব করে তেলেভাজা বা মিষ্টি নিয়ে। দুর্গাপুজোয় একসঙ্গে ঠাকুর দেখা, লোডশেডিঙের রাতে সকলে একসঙ্গে ছাদে শুয়ে স্বপনের বাবার মুখে ভুতের গল্প শোনা বা ইলিশ মাছের মত মহার্ঘ কিছু এলে ভাগ করে খাওয়া, এভাবেই কেটে গেছিল স্বপনদের ছোটবেলা। 

আজ আর ও-বাড়িতে তপন ছাড়া কেউ থাকে না। তবু যেন বাড়িতে পা দিলেই ছোটবেলার সেই রঙিন দিনগুলো চোখে ভিড় করে আসে।

ছবিঃ শিমুল

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

 

1 thought on “গল্প দুটি অণুগল্প পিয়ালী গাঙ্গুলি বর্ষা ২০১৮

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s