এই লেখকের আগের গল্পঃ হারানো সুর পথের বাঁকে
রোজ সকালবেলালাল ট্যমেটোর মত টুসটুসে সুয্যিখানা হাই তুলে,আড়মোড়া ভেঙে চোখ চেয়ে উঠে বসলেই, পাশের বাড়ির রাশভারি ফুলদাদুর প্রথম কাজই হল-সাদা একটা পাতলা পাজামাপাঞ্জাবী গায়ে চড়িয়ে,নড়বড়ে দাঁতের ফাঁকে নীল রঙের ব্রাশখানি গুঁজে হেবোকার চাপাঁউরুটির দোকানে গিয়ে হত্যে দেওয়া।
তারপর গোমড়ামুখে একহাতে পাঁউরুটি,অন্যহাতে দুধের প্যাকেট আর খবরের কাগজ নিয়ে বাড়ি ফেরেন ফুলদাদু। কিছুক্ষণ একমনে চিলতে বাগানে ফুলগাছগুলোর তদারকি করে বারান্দায় বসে বসে কাগজ পড়েন তিনি। বুল্টির মা বিনিপিসি ফুলদাদুর রান্নাবান্না সেরে ঘরদোর পরিষ্কার করে চলে গেলে স্নান সেরে,ভাত খেয়ে ফুলদাদু নাক ডাকিয়ে ঘুম দেন। তারপর যেই একটু অলস বিকেলে নীল আকাশের গায়ে গা হেলিয়ে সুয্যিমামা হাই তুলেছেন কি তোলেননি -ফুলদাদু পার্কে গিয়ে জোটেন। পাড়ার আরো কয়েকজন দাদুঠাকুর্দাও সে সময় পার্কে খানিক জটলা করেন বটে, কিন্তু ফুলদাদুর কারোর সঙ্গেই তেমন জমে না! তাই একাই খানিক হাঁটাহাঁটি করে বাড়ি ফিরে এসে বসে বসে মন দিয়ে টিভিতে খবর শোনেন। তারপরআবার রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
ফুলদাদুর এই একঘেঁয়ে রুটিনখানি কিছুটা ওদের কাজের পিসি বিনিপিসির কাছ থেকে শুনে শুনে আর কিছুটা নিজের চোখে অবজার্ভ করে করে কিট্টুর এখনপ্রায় পুরো মুখস্থই হয়ে গেছে! কিট্টুদের ঠিক পাশের বাড়িতেই থাকেন ফুলদাদু। ফুলদাদুর একমাত্র ছেলে তমালমামা চাকরিসূত্রে বাইরে থাকেন। ফুলদিদিমা মারা যাওয়ার পর থেকেই তাই ফুলদাদু একা!একাই ফাঁকাবাড়ি আঁকড়ে পড়ে আছেন!শুধু বাড়ি নয়,একঘেঁয়ে এই রুটিন আঁকড়েও বলা যেতে পারে!
কিট্টুর তো সোম থেকে শুক্র বাড়ি থেকে স্কুল,আর স্কুল থেকে বাড়ি –এই পাঁচদিনের সেই এক বিচ্ছিরি রুটিনে এমন হাঁফ ধরে যায় যে শনিরবিবার চলে ওর রুটিনের শেকল ভাঙার পালা!ঐ দুটো দিন ও পাড়ার লেকে সাঁতার কাটে;ছবি আঁকে;গল্পের বই পড়ে;সিনেমা দেখে;পার্কে খেলতে যায়; বাবামার সঙ্গে এদিকওদিক বেড়াতে যায়;আরো কত কত কিছু করে।কিন্তু ফুলদাদুর শনিরবিবারের রুটিন দেখ- সেই একইরকম বোরিং- থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়!একাকী ফুলদাদুকে দেখলেইতাই ওর বেজায় কষ্ট হয়। কিট্টুর নিজের ঠাম্মি-দাদা নেই, দাদুনদিদুন আছেন বটে-কিন্তু তাঁরাও থাকেন অনেক দূরে-সেই জলপাইগুড়ি! ন’মাসে,ছ’মাসে-ছুটিছাটায় খালি তাঁদের সাথে দেখা হয়!
ফুলদাদুর রোজকার এই ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর রুটিন বদলানো যায় কিনা এ নিয়ে ওর আর টুকাইদের মধ্যে কম জল্পনাকল্পনা হয়নি। এইতো সেদিনই,শুক্রবারের ফুরফুরে বিকেলে একজোট হয়ে ওরা ভাবছিল, শনিরবিবার বেড়াতে বেরোলে ওরা ফুলদাদুকেও সঙ্গে আসতে বলবে। যদিও একগুঁয়ে,গোমড়ামুখো,খিটখিটে,একলাটে স্বভাবের ফুলদাদুকে প্রথমে কে দলে টানবে তা নিয়ে কিছুতেই সিদ্ধান্তে আসা গেলনা। এ পাড়ার কারোর সঙ্গেই একলা মানুষটির তেমন কোনো দহরম-মহরম নেই, কেউ ফুলদাদুকে নিয়ে তেমন মাথাও ঘামায় না! টুকাইএর ভাইটুবলুটা ক্লাস ফোরে পড়ে, ব্যাটা এতো পাজি, বলে কিনা–“তোর যখন এতো মাথাব্যথা তখন তুইই প্রথম দায়িত্ব নে। যেদিন তোরা ‘ফেলুদা’ দেখতে সাউথ সিটি যাবি, ফুলদাদুকেও মনে করে সঙ্গে নিয়ে যাস কিন্তু!”
অবশ্য ‘ফেলুদা’ দেখতে যাওয়ার আগেই সেই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটে গেল! এক অলস রবিবার সকালে, অতিকৌতূহলী সুয্যিটা টুপ করে কিট্টুর পুবের জানালা গলে ওর ঘরে ঢুকে পড়তেই রেগেমেগে সবে পর্দাটা টেনে সুয্যিটার মুখের ওপর ফেলতে যাচ্ছিল কিট্টু-হঠাৎ একটা কুঁইকুঁই শব্দ আর “অ্যাই যা,যাহ!” বকুনির যুগলবন্দীতে উৎসুক হয়ে জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে ও অবাক হয়ে দেখে কি–হাতে পাঁউরুটি, দুধের প্যাকেট আর খবরের কাগজ নিয়ে রোজের মতই সাদা পাঞ্জাবী পতপতিয়ে বাড়ি ফিরছে ফুলদাদু।
কিন্ত ওমা একী! তিতিবিরক্ত ফুলদাদুর পায়েপায়ে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে চলেছে ওটা কী? ওটা যে একটা ফুলকো
লুচির মত ফুলো ফুলো, কুতকুতে কুকুরছানা! বাহ,ফুলদাদুর ভাল সঙ্গী জুটেছে তো!
বোঝা গেল, সকালে চায়ের দোকানে পড়ে পাওয়া বিস্কুটের লোভটা শুধুমাত্র চায়ের দোকানের চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি,সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি অবধি ছুটেছে! কিন্তু ফুলদাদু যা খিটখিটে, একলাটে আর নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যেরকম গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেন,কাল থেকে আর চায়ের দোকানের আশেপাশেও এই কুকুরছানাটাকে দেখা যাবে কিনা সন্দেহ আছে!
এই সারাটা সপ্তাহ গুচ্ছের ক্লাস টেস্ট আর হাজার একটা হোমওয়ার্কের ঠেলায় আর ফুলদাদুর দিকে নজর রাখা সম্ভব হয়নি কিট্টুর। কিন্তু অবাক কান্ড-ফুলদাদুর সঙ্গে ‘ফুলকো’র বন্ধুত্ব যে বেশ জমে আইসক্রিম হয়ে গেছে তা টুকাইদের কাছ থেকে রিপোর্ট পেয়েছে ও! প্রমাণটা পেল ও আজ হাতেনাতেই। কিট্টুদের পাড়াটার পাশ দিয়েই অনেকখানি জায়গা জুড়ে কিছুদিন আগেই তৈরি হয়েছে একটা বিশাল মন্দির। পাবলো আর রুনির মা সবাই মিলে আজ মাকে ধরেছিল, এই শনিবার বিকেলবেলা সবাই একসাথে মন্দিরটা দেখতে যাবে।
অবশেষে,শনিবারের এই উড়ুৎফুড়ৎ বিকেলে ফুল পল্টন মিলে খলবল করতে করতে মন্দিরে পা রেখেই তো কিট্টুর আজ চক্ষু চড়কগাছ! দেখে কি,ফুলদাদুর কুকুরছানাটা টুকুস টুকুস করে লাফিয়ে লাফিয়ে মন্দিরের একটা একটা করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে আসছে আর পিছনে রাশভারি ফুলদাদু–“ওরে ও ফুলকো। নেমে আয় বলছি,আমি যে আর উঠতে পারছিনে!”বকতে বকতেই ফুলকোর পেছনে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে আসছেন।
অথচ এই কিছুদিন আগেই টুবলু বলছিল -ওর ঠাকুর্দা নাকি ফুলদাদুকে দুএকবার হাঁক পেড়ে ডেকেছিলেন—“চলো না হে ফুলু,একবার মন্দিরটা দেখে আসি। শুনলাম বড় সুন্দর বানিয়েছে হে!” ফুলদাদু নাকি সেই শুনে প্রবল জোরে মাথা নেড়ে বলেছিলেন-“ওরে ব্বাবা, ঐ চারতলা সমান উঁচু মন্দিরে উঠব আমি? একে তো আমি শ্বাসকষ্টের রুগী, তায় আবার আমার উঁচুতে উঠলেই মাথা ঘোরে,তারচে’ তোমরাই বরং ঘুরে এস গিয়ে। আমার নিচ থেকে দেখেই শান্তি!” সেই ফুলদাদু কিনা তাঁর সাধের কুকুরছানার পাল্লায় পড়ে শেষপর্যন্ত সেই মন্দিরের টঙে উঠে এসেছেন!
মন্দিরের সিকিউরিটি-“আরে আরে, কাকাবাবু! জানেন না, এখানে কুকুর নিয়ে আসা বারণ!” বলে হাঁহাঁ করে তেড়ে আসতেই ফুলদাদু মন্দিরের মার্বেল পাথরের সাদা ধবধবে চাতালে ধপ করে বসে পরে হাঁফ ছেড়ে কাতরে উঠলেন-“ওরে বাছা,কে কাকে টেনে আনে! আমি কী আর ওকে নিয়ে এসেছি,সে ক্ষমতা কী আর আমার আছে,বাবা? ওই তো আমাকে এখানে টেনে নিয়ে এলো!”
তারপর মন্দিরের বিশাল বিশাল থামগুলোর একটাতে ঠেস দিয়ে বেশ জম্পেশ করেহাতপা ছড়িয়ে বসে,বুক ভরে এক লম্বা নিঃশ্বাস টেনে বেশ ফুরফুরে গলায় বলে উঠলেন–“আহা, ওপর থেকে আমাদের পাড়াটা,চারপাশের শহরতলিটাযে এতো সুন্দর দেখায় তাতো জানতুম না হে! আহা, কী ঠান্ডা হাওয়া, প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো গো!”
ফুলকোর গভীর,কালো,চকচকে চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে কিট্টুর আজ হঠাৎ মনে হল, কেন জানি না বড় চেনা চেনা লাগছে চোখদুটো!টুকাইএর পোষাকুকুর সিম্বার চোখদুটো ঠিক এমনই অমায়িক না? টুকাইএর বাড়িতে যখনই যায় ও, লেজ নাড়তে নাড়তে ওর কাছে ছুট্টে আসে সিম্বা! এমনিতে দাম্ভিক সিম্বা সবার সাথে বন্ধুত্ব পাতায় না, কিন্তু কিভাবে যেন ওর সাথে সিম্বার বেশ একটা মাখোমাখো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে! সেই সিম্বার চোখদুটোও যেন এমনই মায়াজড়ানো, এমনই ভালোবাসামাখানো! আসলে ভালোবাসার রঙ বোধহয় সব বন্ধুর চোখেতেই এক!অভিন্ন!
সম্প্রতি কানাঘুষোয় কিট্টু শুনেছে,‘ফুলকো’ নাকি ফুলদাদুর পুরোন, বোরিং রুটিনের একেবারে দফারফা করে দিয়েছে! একঘেঁয়ে ফুলদাদু তার বেস্ট ফ্রেন্ড ‘ফুলকো’কে নিয়ে এখন রোজ নিত্যনতুন অ্যাডভেঞ্চারে বেরোতে শুরু করেছেন। কোন দিন কাঁটাপুকুর মাঠে শিল্ড ফাইনাল দেখতে,কি কোনদিন খালপাড়ের হাওয়া খেতে,কোনদিন আবার পাশেই কুমোরপাড়ায় দূর্গাপ্রতিমার হালহকিকত জানতে! মোদ্দা কথা,ফুলদাদুর চেহারায় জেল্লা বেড়েছে,পাঞ্জাবীতে রঙ ধরেছে,আর পাকা চুলে রোদ্দুর ছলকেছে !
আর বলাই বাহুল্য,কিট্টু পর্যন্ত এখন ফুলদাদুর নিত্যনতুন রুটিনের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে রোজ গোহারান হেরে চলেছে !
গ্রাফিক্সঃ ইন্দ্রশেখর