গল্প বাঘবন্দি মন্তর শিশির বিশ্বাস বর্ষা ২০১৭ সুতপা দাশ

জয়ঢাকে প্রকাশিত শিশির বিশ্বাসের সব লেখা একত্রে

মস্ত চওড়া নদী। এক তীর থেকে অন্য তীরকে দেখায় যেন সরু একটা ধোঁয়াটে রেখা। নীল জল টলমল করে। বর্ষায় কিংবা ভরা জোয়ারে ঢেউয়ের দাপট এমন বাড়ে যে, মাতালের মতো টলতে থাকে বড় বড় নৌকো, লঞ্চ, স্টিমার। নদীর নাম তাই মাতলা। সুন্দরবনের সব চাইতে ডাকসাইটে নদী। এই মাতলা ধরে সোজা নেমে যাও দক্ষিণে। পৌছে যাবে একেবারে বঙ্গোপসাগরের মুখে। এইখানেই নদীর পূবদিকে সুন্দবনের যে অংশটা চোখে পড়বে তারই নাম মায়াদ্বীপ। সুন্দরী, গরান, কেওড়া আর হেঁতাল ঝোপের জমজমাট বন। সুন্দরবনের কুখ্যাত নরখাদকের মনের মতো আস্তানা।

অনেক দিন আগের কথা। এই মায়াদ্বীপেই ছোট একটা নৌকো নিয়ে কাঠ কাটতে  এসেছিল মোল্লাখালি গাঁয়ের পেল্লাদ আর তার ভাই জটাই সর্দার। যে সে কাঠ নয়, খোদ তবলাকাঠ। যে সময়ের  কথা বলছি, তখন তবলাকাঠের খুব কদর ছিল। দেশলাই কাঠি তৈরি হত কিনা। তাছাড়া এ কাঠ সুন্দরবনে পাওয়াও যেত খুব কম। অনেক খুঁজে পেতে মিলত এক আধটা। তা পেল্লাদ সর্দার আবাদের গুণিন। কেউ বলে বাওয়ালী। মন্তর তন্তর ঝাঁড়ফুক জানে। খুদে একটা ডিঙি নিয়ে বনকে বন হাঁটকে বেড়ায়। সুতরাং তবলাকাঠের খোঁজ পেল্লাদ পাবে না তো কে পাবে? পেল্লাদের ভাই জাটাই আবার অন্য ধাঁচের। লম্বা চওড়া জোয়ান; মোষের মতো চেহারা। শরীরে মত্ত হাতির বল। মন্তরে তন্তরে মোটে বিশ্বাস নেই। বাদাবনে নেমে বাওয়ালীর দেওয়া মন্ত্রপূত কাপড়ের টুকরো তুলে কোথায় যে ফেলে দেয়! এতটুকু ভয়ডর নেই। ভাইয়ের আক্কেল দেখে পেল্লাদের তাই চিন্তার অন্ত নেই। একলা জটাইকে কখনো বাদায় যেতে দেয় না। সব সময় সঙ্গে থাকে।

ঠিক জোয়ারের মুখে মাতলার জল যখন হু হু করে শিষ খালের মধ্যে ঢুকতে শুরু করেছে, দুজনে নৌকো ঢুকিয়ে দিল খালের মধ্যে। তারপর নির্দিষ্ট জায়গায় নৌকো বেঁধে কুড়ুল হাতে দুজনে বাদায় নামল। খাল থেকে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে তবলাগাছের জায়গা। পেল্লাদ দিন কয়েক আগে একাই এসে দেখে গেছে। সুতরাং সেখানে পৌছুতে বিলম্ব হল না। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়ানোছিটানো হেঁতাল ঝাড়। তারই মাঝে দূরে দূরে গোটাকয়েক বাবলাগাছ।

সুন্দরবনের ভেতর হেঁতালঝোপ সব সময়েই সন্দেহজনক। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল পেল্লাদ। বড় বড় নিশ্বাস নিল গোটা কয়। সন্দেহ তবুও যেতে চায় না। চারপাশটা যেন বড্ড বেশি নিস্তব্ধ। কিন্তু অত ভাববার সময়ও যে নেই। ভাটার আগে নৌকো নিয়ে গাঙে পৌছুতে হবে। দেরি হলেই সর্বনাশ। বিড় বিড় করে বাঘবন্দী মন্ত্র আউড়ে পেল্লাদ একমুঠো মাটি চারদিকে ছিটিয়ে দিল। শেষবারের মতো হুঁশিয়ার করে দিল জটাইকে।

তারপর দুজনে সুবিধামতো গাছের খোঁজে দুদিকে ছড়িয়ে পড়ল। একটা গাছ দেখে পেল্লাদ সবে গোটা কয়েক কুড়ুলের কোপ বসিয়েছে হঠাৎ ওর বাঁদিকে আট দশ হাত দূরে একটা হেঁতাল ঝোপের ডগা সামান্য দুলে উঠল। আর মুহূর্তে ডোরাকাটা প্রকাণ্ড একটা মাথা বেরিয়ে এল।

ব্যাপারটা তৎক্ষনাৎ নজরে পড়ল পেল্লাদের। বাদার মানুষ। বাঘ নেহাত কম দেখেনি। কিন্তু এত কাছ থেকে এই প্রথম। কী প্রকাণ্ড মাথাটা। চোখ দুটো ভাঁটার মতো জ্বলছে। সাক্ষাৎ বাবা দক্ষিন রায়ের বাহন। বুকটা কেঁপে উঠল।

পেল্লাদের হাতের কুড়ুল ততক্ষণে থেমে গেছে শূন্যে। বাওয়ালী সুলভ কায়দায় সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি মেরে হেঁকে উঠল, ‘হে-ই-ই খবরদার’

সে আওয়াজ পেল্লাদের নিজের কানেই কেমন হাস্যকর শোনাল। পেল্লাদ বুঝতে পারল তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আর সেই মুহূর্তেই বিকট এক গর্জনে চারপাশে একরাশ লালা ছিটিয়ে বাঘটা বিদ্যুত-বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল পেল্লাদের ওপর। থাবার আঘাতে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে হাতের কুড়ুলটা দিয়ে পেল্লাদ সজোরে আঘাত করল বাঘটার ওপর। কিন্তু কিছুই হল না। ধারাল ফলাটা বাঘের ঢলঢলে মসৃণ চমড়ার লেগে পদ্মপাতার জলের মতো পিছলে বেরিয়ে গেল। দ্বিতীয়বার কোপ বসাবার সুযোগ পেল না পেল্লাদ। তার আগেই বাঘটা এক মোক্ষম কামড় বসিয়ে দিয়েছে ওর ঘাড়ে। গোঙাতে গোঙাতে পেল্লাদ বৃথাই হাত পা ছুঁড়তে লাগল।

জটাই গাছ কাটছিল একটু দূরে। হঠাৎ দাদার চাপা চিৎকার আর সেই মূহূর্তেই বাঘের গর্জনে দারুণ চমকে ঘাড় ফেরাতেই তো তার চক্ষু স্থির। কী ভীষণ ব্যাপার! একটা প্রকাণ্ড বাঘ তার দাদার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড় কামড়ে ধরেছে। গলাসুদ্ধ মাথায় প্রায় অর্ধেকটাই বাঘের মুখের মধ্যে!

অমানুষিক দৃশ্যটা জটাইয়ের মতো শক্ত মানুষকেও বুঝি প্রায় অসাড় করে ফেলেছিল। কিন্তু মুহূর্তে সামলে নিয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটল অকুস্থলের দিকে।

হঠাৎ এই উটকো ঝামেলায় কামড় একটুও আলগা না করে সামান্য মুখ তুলল বাঘটা। ভাঁটার মতো চোখ দুটো জ্বলে উঠল। মুখ দিয়ে দ্বিগুন  বেগে গর্‌-গর্‌ করে আওয়াজ বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে লালা ছিটোতে লাগল চারপাশে। তারপর ঘাড়টা নিচু করে ফের আগের কাজে মনোনিবেশ করল। ভাবটা এই রকম আর একটু রোসো বাপু। তারপর তোমার ব্যবস্থাও হচ্ছে।

ততক্ষণে সেখানে পৌছে গেছে জটাই। মাত্র হাত দুয়েক দূরে কালান্তক যম সাদৃশ্য বাঘটা। দু’হাতে শক্ত মুঠোয় ধারাল কুড়ুলটা সটান শূন্যে উঠে গেল। এলোমেলো কতকগুলো ছবি ওর মগজের কোষে ঝিলিক দিয়ে গেল। দাদা বলেছিল, ধারাল কাটারি দিয়ে একবার বাঘের মাথায় কোপ বসিয়েছিল একজন। ঠং করে ছিটকে উঠেছিল কাটারিখানা। বাঘের কিছুমাত্র হয়নি। আর একবার এই রকমেরই এক পরিস্থিতিতে বাঘের মাথায় কুড়ুলের কোপ বসাতে ধারাল ফলাখানা বাঘের খুলিতে বসে এত জোরে এঁটে গিয়েছিল যে টেনেও তুলতে পারেনি। দ্বিতীয় কোপ বসাবার সুযোগ আর মেলেনি। বাঘটা থাবার এক আঘাতে ছিঁড়ে ফেলেছিল মানুষটাকে। জটাইয়ের কানের কাছে কে যেন ফিসফিসিয়ে গেল, বাঘের খুলি লোহার থেকেও শক্ত জটাই। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে আঘাত হানো। সময় নেই আর।

মুহূর্তে জানোয়ারটার কপালের ঠিক মাঝখানে কালো ডোরা বরাবর নিপুণ লক্ষ্যে সুতীব্র বেগে নেমে এল জটাইয়ের হাতের ধারাল কুড়ুলখানা। আর সেই এক আঘাতেই দারুন শব্দে বাঘের খুলি দুভাগ হয়ে গেল। কাটা কলাগাছের মতো বাঘটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। সারা শরীর গোটা কয়েক মাত্র ঝাঁকুনি দিয়ে এক সময় স্থির হয়ে গেল। শুধু লেজের ডগাটাই অনেকক্ষন ধরে নড়তে লাগল তিরতির করে। কী ভীষণ জোরে জটাই কোপ মেরেছিল ভাবা যায় না। কিন্তু এত বড় সাফল্যেও আনন্দ কোথায়? বাঘটার সঙ্গে বাওয়ালী পেল্লাদও যে ততক্ষণে ইহোলোকের মায়া কাটিয়েছে।

আর দেরি না করে দুটো মৃতদেহ খাল পর্যন্ত বয়ে এনে নৌকোয় চাপিয়ে জটাই যখন গ্রামে পৌছাল, সারা গাঁয়ের মানুষ ভেঙে পড়ল গাঁয়ে। গাঙের ঘাটে সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য!

জটাই এর পরেও বনে গেছে বহুবার। রশুল মিয়ার সঙ্গে সেবার যখন তার দেখা হয় তখন জটায়ের বয়স হয়েছে। মাথার চুল ধবধবে সাদা। শরীরে সেই আগের তেজ আর নেই। রশুল মিয়া বাওয়ালী শুনে হেসে বলেছিল, ‘ওসব মন্তর তন্তর সব তোমাদের বুজরুকি, বুঝলে চাচা। আসল হল এই শরীর আর কলজের জোর। বাদার বাঘ এতেই বশ থাকে। মন্তরে নয়।’

গ্রাফিক্‌স্‌- সুতপা দাশ

জয়ঢাকের গল্প ঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s