গল্প বুকুন, প্রদীপের দৈত্য ও আজব ঝড় সুবীর শরৎ ২০১৭

সুবীর মণ্ডলের আগের গল্প মিউটেশন 

প্রতি রবিবারের মতো আজও টিউশন পড়তে এসেছিল বুকুন। কিন্তু শুনল কাল রাতের ঝড়ে স্যারের ঘরের কাছে যে বড়ো আমগাছটা আছে সেটা পাঁচিলের উপর ভেঙে পড়েছে। সেটা তুলে সব ঠিক করতে অনেক সময় লাগবে। তাই আজ ছুটি। বুকুন এটা ভেবে পেল না কাল ঝড়টা হল কখন। বুকুন চুপচাপ চলে আসছিল। হঠাৎ দেখতে পেল পাশের জগাইদার চা-দোকানে বসে সন্তুদা পেপার পড়ছে। সন্তুদা কলেজে পড়ে, এই পাড়াতেই থাকে। রোজ সকালে পাশের ক্লাবে ব্যায়াম করতে আসে। বুকুনের সাথে প্রায়ই দেখা হয়। বুকুন পায়ে পায়ে সন্তুদার দিকে এগিয়ে যায়। বুকুনকে দেখতে পেয়ে সন্তু বলে ওঠে, “কী রে বুকু, ফিরে যাচ্ছিস, শরীর খারাপ নাকি?”

“না গো। স্যার আজ পড়াবে না। সন্তুদা কাল এখানে ঝড় হয়েছিল?”

“ঝড় হয়েছিল, আবার হয়নি। তুই আজ পেপার পড়িসনি?”

“না। মানে, টিউশনে আসব বলে আজ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছি, তাই পড়া হয়নি।”

“আজ প্রতিটি পেপারের হেডলাইন তো এই ঝড়ের খবর!”

“কিন্তু কাল তো কোনও ঝড় হয়নি। মানে, আমদের পাড়ায় তো না।”

“দাঁড়া, তোকে একটা খবর দেখাই।” সন্তু পেপারের একটা বিশেষ অংশ বুকুনকে পড়তে দিল।

 ‘আজব ঝড়’

কাল রাত আটটার সময় ডায়মন্ড হারবারের একটি বিশেষ অঞ্চলে প্রবল ঝড় হয়েছে। ঝড়টি এক কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ঝড়ে বিশেষ কোনও ক্ষতি হয়নি। শুধু একটি গাছ ভেঙে পড়েছে। কিন্তু ওই এক কিলোমিটার অঞ্চলে হঠাৎ এই ঝড় কেন হল, এ ব্যপারে আবহাওয়াবিদরা কিছু বলতে পারছে না। বিশেষজ্ঞদের একটি দল আজ ওই অঞ্চলটি পরিদর্শনে যাবেন।

খবর পড়া শেষ  হতে সন্তুদা বলল, “তোদের স্যারের আমগাছ ভাঙার জন্য আমাদের এলাকায় আজব ঝড় হয়েছিল। বুঝলি? আসি রে। তুইও বাড়ির দিকে যা।”

বুকুন অবাক হয়ে ভাবল, আজব ঝড়। ঘাড় ঘুরিয়ে ওই আমগাছটার দিকে তাকাল। আর তখনই দেখতে পেল ওই অদ্ভুত জিনিসটা। যেন বুকুনকে দেখা দেবার জন্যই ওটা এতক্ষণ কেউ দেখতে পায়নি। বুকুন গিয়ে ওটা তুলে নিজের ব্যাগের মধ্যে  নিয়ে নিল, আর বাড়ির পথে হাঁটা দিল।

বাড়ি ফিরতে মা বলল, “কী রে, চলে এলি কেন? শরীর খারাপ নাকি?”

“না। কাল ঝড়ে গাছ পড়ে ওনার ঘরের পাঁচিল ভেঙে গেছে। সেটা ঠিক করতে আনেক সময় লাগবে। তাই ছুটি দিয়েছে।“

“ঝড়! কাল আবার কখন ঝড় হল? সকালবেলায় বাঁদরামি হচ্ছে?”

“তুমি আজ পেপার পড়েছ?”

বুকুনের কথা শুনে হতবাক মা। “না। তোর বাবা পড়ছে।”

“গিয়ে দেখ, কাগজের হেডলাইন। কাল স্যারের বাড়ির কাছে আজব ঝড় হয়েছে।”

মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বুকুন নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। ঘরে ঢুকেই বুকুন দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর ব্যাগ থেকে সেই জিনিসটা বের করে আনল। বুকুন ক’দিন আগেই আলাদিন নামে একটা অ্যানিমেটেড সিনেমা দেখছিল। সেখানে আলাদিন একটা প্রদীপ পাবে যেটা ঘষলে দৈত্য আসবে। আজ বুকুন যেটা পেয়েছে সেটাও ওই প্রদীপের মতো দেখতে। বুকুন দেখল, প্রদীপের সূচালো অগ্রভাগে মাটি জমে গিয়ে মুখটা পুরো বন্ধ হয়ে গেছে। বুকুন একটা পেন্সিল নিয়ে ওই প্রদীপের মুখ থেকে মাটি সরিয়ে দিতে লাগল। প্রায় হয়ে এসেছে এমন সময় প্রদীপের মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল। গন্ধহীন সাদা রঙের আজব ধোঁয়া। বুকুন ভয় পেল। মনে মনে ভাবল, তবে কি এটা সত্যি সেই আশ্চর্য প্রদীপ!

“না। এটা আশ্চর্য প্রদীপ নয়। এটা আমার মহাকাশযান।”

বুকুন ঘাড় ঘুরিয়ে যাকে দেখল তাকে দেখে ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই দৈত্য। কিন্তু সেটা হলে ও যে বলছে ও দৈত্য নয়!

“আমি সত্যিই প্রদীপের দৈত্য নই। আমার নাম অরিন-১১১২৩১। আমি অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির ডেল্টা গ্রহ থেকে এসেছি। তোমাদের ভাষায় আমি একজন এলিয়েন।”

“এলিয়েন হলে তুমি প্রদীপের দৈত্যর মতো দেখতে কেন? আর আমার মনের কথা তুমি কীভাবে বুঝতে পারছ?”

“আমাদের বিশেষ ক্ষমতার সাহায্যে আমি আমার সামনের যেকোনও প্রাণীর মনের কথা বুঝতে পারি।”

“আমি সিনেমায় দেখেছি প্রদীপের দৈত্যকে। সবুজ রঙের গা, অনেক লম্বা আর রঙিন ঢোলা পাজামা পরে থাকে। তোমাকেও তো তেমনই দেখতে। খালি পাজামার বদলে তুমি পা পর্যন্ত ঝোলা জামা পরে আছ।”

“আসলে তোমরা যাকে দৈত্য বল, তারা কিন্তু আমাদের গ্রহেরই জীব। তোমাদের কল্পনায় সে হয়ে গেছে দৈত্য।”

“কিন্তু তুমি এত বড়ো হয়ে এই ছোটো প্রদীপ মানে, মহাকাশযানে এলে কী করে?”

“আসলে তুমি যেটা দেখছ সেটা আমার আসল চেহারা। কিন্তু মহাকাশযানে আমরা আমাদের শরীরকে ছোটো করে নিই। এতে জ্বালানির খরচ বাঁচে, আর ওজনও কম হয়। ফলে যানের গতি বৃদ্ধি পায়। আসলে কাল রাতে আমার মহাকাশযানের মধ্যে একটা সম্যস্যা হয়েছিল। সেটা ঠিক করার জন্য আমাকে নিচে নামতে হয়েছিল। কিন্তু পৃথিবী গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এতই বেশি যে আমার যান যদি এই শক্তির উপর ভর করে নামত তাহলে আমার যানের সবকিছু ভেঙে নষ্ট হয়ে যেত। তাই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রতিরোধ করার জন্য একটা ছোটো ঘূর্ণি তৈরি করেছিলাম। যার কারণে ওই অঞ্চলে কালকে ঝড় হয়।”

“আজব ঝড়!” বুকুন বলে উঠল।

“হ্যাঁ, আজব ঝড়। কারণ, কোনও আবহাওয়াবিদ কোনওদিন এই ঝড়ের প্রকৃত কারণ জানতে পারবে না।”

“তোমার যান কি ঠিক হয়ে গেছে?” প্রশ্ন করে বুকুন।

“ওটা কাল রাতেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কাল ওটা নিচে নামার সময় আমগাছটা ভেঙে পড়ে। গাছের ডালের আঘাতে যানের অগ্রভাগ মাটিতে গেঁড়ে গিয়েছিল। সেই কারণে আমি আর ওটা চালু করতে পারিনি। আর আমার বাইরে আসার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে আমি বাইরে এসে ওটা তুলব সেটা সম্ভব ছিল না। তাই আমি ওটা অদৃশ্য  করে রেখে নিজের গ্রহে সংবাদ পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ আবার কিছু গোলযোগ দেখা দেয়। তাই তুমি আমার যানকে দেখতে পেলে। সেটাও আমি ঠিক করে নিয়েছি। বুকুন, তুমি আমার অনেক উপকার করেছ। এখন তুমি আমার আরও একটা উপকার কর। আমার মহাকাশযানটা তুমি বাইরে কোনও ফাঁকা জায়গায় রেখে দাও। আমার যাওয়ার  সময়  হয়ে এল।”

এই বলে দৈত্য, থুড়ি এলিয়েন বুকুর সাথে বিদায় করমর্দন করে আবার ছোটো হয়ে তার যানে প্রবেশ করল। বুকুন ওটা হাতে নিয়ে কিছুদূরে মন্ডলদের মাঠের ঠিক মাঝখানে রেখে দিল। বুকুন মনে মনে বলল, বিদায় প্রদীপের দৈত্য। তারপর মাঠ থেকে রাস্তায় চলে এল।

এরপর মাঠজুড়ে শুরু হল ঝড়। আজব ঝড়।

বুকু এখন জানে কালকের খবরের কাগজে কী লেখা থাকবে।

ছবিঃ মৌসুমী

জয়ঢাকের গল্পঘর   

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s