অনন্যা দাশ এর সমস্ত লেখা একত্রে
ভয়ানক একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল রিশা। গা হাত-পা ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। বুকটা এখনও ঢিপঢিপ করছে। কী বাজে স্বপ্ন রে বাবা! তবে এইরকম স্বপ্ন এখন প্রায় রোজই দেখে রিশা। মাস দুয়েক হল বাবা-মার সঙ্গে কলকাতা থেকে মার্কিনমুলুকে এসছে সে। কলকাতায় একটা মোটামুটি ভালো স্কুলেই পড়ত রিশা। তাই বেশিরভাগ বিষয়গুলোতেই ওর কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। সায়েন্স, অঙ্ক সব ঠিক আছে। ঝামেলাটা হচ্ছে শুধু ইংলিশটাকে নিয়ে! ক্লাসে ছেলেমেয়ে বা টিচাররা এমনভাবে কথা বলে যে তার বুঝতে ভারি অসুবিধা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইংরেজি ক্লাসের টিচার ওকে প্রায়ই ক্লাসে রিডিং পড়তে দিয়ে দেন। রিশার ইংলিশ রিডিং শুনে ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েদের সে কী হাসি! বলে, কী অদ্ভুত অ্যাক্সেন্ট তোমার! কী বলো কিছুই বোঝা যায় না! ওদের কথা শুনে ভয়ানক রাগ হয় রিশার। ব্রেডন বা লরা যখন সব অঙ্ক ভুল করে তখন তো কেউ ওদের নিয়ে হাসে না! আর ওর বেলাতেই যত্ত সব!
ওকে স্কুলে ভর্তি নেওয়ার সময় অবশ্য প্রিন্সিপাল বলেছিলেন, “ও যদি ইংরেজিতে ভালো না করতে পারে বা যদি টিচার বা সহপাঠীদের কথা না বুঝতে পারে তাহলে ওকে এক গ্রেড নীচুতে বসতে হবে। ওখানে কোন ক্লাসে পড়ত সেটা বড়ো কথা নয়। এখানে ক্লাসে ওর স্বাচ্ছন্দ্যটাই বেশি জরুরি।”
সেই ভয়টাই রোজ কুরে কুরে খায় রিশাকে। দুঃস্বপ্নটাও সেটা নিয়েই। ইংলিশ ক্লাসে রিশা কী একটা পড়ছে, হঠাৎ দেখে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চলে এসেছেন! ওর পড়া শুনে ছেলেমেয়েগুলো সব হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। ক্লাস টিচার হাসি চাপার চেষ্টা করছেন আর প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কটমট করে ওর দিকে তাকাচ্ছেন।
এক পাতা পড়ার পরই উনি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “নারিশানা, আমি দুঃখিত কিন্তু তোমাকে এই ক্লাসে আর রাখা যাবে না। হ্যাঁ, প্রি-কেতে একটা সীট খালি আছে। তুমি যদি সেখানে যেতে চাও তো সেটার ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”
প্রি-কেতে তো সুনন্দামাসির চার বছরের মেয়ে হিয়া যায়! আর রিশার তো আট বছর হয়ে গেছে! লজ্জায়, ঘৃণায় ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলছিল রিশা। আর তক্ষুনি ওর ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল।
পরদিন সকালে উঠেই সে কান্নাকাটি জুড়ে দিল যে সে স্কুলে যাবে না কিছুতেই। সেটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ইদানীং রিশা প্রায়ই ওইরকম করে। ওর মা-বাবা ওকে নিয়ে বেশ চিন্তিত ইংলিশ নিয়ে ওর মনে একটা ভয় জন্মে গেছে বলে। ইংলিশ বই দেখলেই সে পালায়। অথচ কলকাতা থেকে আনা বাংলা গল্পের বই গোগ্রাসে গিলছে! বাবার অফিসের একজন সহকর্মীর স্ত্রী ওকে ইংলিশ পড়াতে রাজি, কিন্তু রিশা তার কাছেও যেতে চায় না। কারণ, ওনার দুটো ছেলে আছে, তারাও ওর কথা শুনে হাসাহাসি করে। তারপর যখন একদিন পাশের বাড়ির মিসেস ফরেস্টার ওরা নতুন এসেছে বলেছে ওদের জন্যে কুকি বিস্কুট নিয়ে ওদের বাড়ি বেড়াতে এলেন তখন রিশা একটা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে রইল। কিছুতেই বেরোল না ওনার সামনে।
সেদিনও বিকেলবেলা ওইরকম মন খারাপ করে বসে ছিল রিশা। এমন সময় দেখল আবার মিসেস ফরেস্টার আসছেন। রিশাকে দেখে উনি বললেন, “হ্যালো রিশা, কেমন আছ?”
রিশার ওনার কথার উত্তর না দিয়েই দৌড়ে শোবার ঘরে ঢুকে গেল। এমনি মিসেস ফরেস্টারকে হাসিখুশি গোলগাল মিসেস স্যান্টা ক্লসের মতন দেখতে। আর ওনার দেওয়া কুকিগুলো খুব ভালো খেতে ছিল। কিন্তু তাও রিশার ওনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করল না।
মন খারাপ করে খাটের ওপর বসেছিল সে। এমন সময় মা ঘরে এসে বললেন, “রিশা চল, মিসেস ফরেস্টার আমাদের এক জায়গায় নিয়ে যাবে বলে এসেছেন। বাবা অফিস থেকে ফেরার আগেই আমরা চলে আসব।”
রিশার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। কোথায় আবার নিয়ে যাবেন? যাই হোক, মায়ের কথা শুনে ইচ্ছে না করলেও ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। মিসেস ফরেস্টার ওকে দেখে একগাল হেসে বললেন, “ভয় পেও না রিশা, আমি তোমাকে কয়েকজন বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করতে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি আসবে তো আমার সঙ্গে? আজকে তোমার মাও যাবেন অবশ্য সঙ্গে।”
রিশার মন আরও দমে গেল। আবার কিছু বদমাইশ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পড়াশোনা করতে হবে ওকে। তারা হাসবে ওর কথা শুনে। মিসেস ফরেস্টার হাসিমাখা মুখে ওর দিকে চেয়ে আছেন দেখে ও সম্মতিতে ‘হ্যাঁ’ বলে মাথা নাড়াল।
নিজের গাড়ি করেই ওদের নিয়ে চললেন মিসেস ফরেস্টার। অনেক গল্প করছিলেন যেতে যেতে। মিনিট দশেক পরে ওরা একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। বাড়িটার গায়ে লেখা রয়েছে ‘অ্যানিম্যাল রেসকিউ লিগ অফ বার্ক্স কাউন্টি’। এ আবার কোথায় নিয়ে এলেন ওদের?
ওরা তিনজন ভেতরে ঢুকতেই একটা সোনালি চুলের মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, “হ্যালো মিসেস ফরেস্টার, আজকে তো আপনার আসার দিন নয়!”
মিসেস ফরেস্টার বললেন, “না, আজকে আমি নিজের জন্যে আসিনি। আজকে তোমাদের জন্যে একজন বুক বাডি এনেছি। এই হল রিশা। ও আজ সাইমন, গ্রে, মিসি আর ট্যাবিকে কয়েকটা গল্প পড়ে শোনাবে।”
রিশার তো ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল। কী করবে সে? সোনালি চুলের মহিলা হেসে বললেন, “সুপার! আসার জন্যে অনেক থ্যাঙ্ক ইউ রিশা! আমার নাম ডি। আসলে ডিয়ানা, কিন্তু সবাই ডি বলেই ডাকে আমাকে। এসো, তোমাকে ওদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। মিসেস ফরেস্টার আপনি আসবেন?” বলে টেবিলের ওপর থেকে কয়েকটা বই হাতে নিয়ে নিলেন।
মিসেস ফরেস্টার বললেন, “না না, আমার যাওয়ার দরকার নেই। তুমিই নিয়ে যাও না ওকে।”
রিশা দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে ওর মা বললেন, “যাও রিশা, বড়োদের কথা শুনতে হয়।”
রিশা এমনিতে ভালো মেয়ে। মার কথা শোনে তাই মন খারাপ করে ডির পেছন পেছন চলল। ওকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ডি ডাক দিলেন, “সাইমন, গ্রে, মিসি, ট্যাবি, দেখো কে এসেছে তোমাদের বুক বাডি হতে!”
রিশা তাকিয়ে দেখল। ওমা কোথায় ছেলেমেয়ে? এ তো চারটে বেড়াল! সাইমনের রঙ সাদা আর গায়ে কালো ছোপ, গ্রে খুব সুন্দর নীলচে ধূসর, মিসি আর ট্যাবি কেমন একটা খয়েরি-কমলা মতন। ওদের দেখে ওরা ম্যাঁও, ম্যাঁও করে আনন্দ জানাল।
ডি হেসে নিজের হাতের বইগুলো রিশাকে দিয়ে বললেন, “ওরা কয়েকদিন হল এই শেল্টারে এসেছে। আগে একজনের পোষ্য ছিল। কিন্তু সেই মহিলার খুব বয়স হয়েছিল। উনি আর একলা থাকতে পারছিলেন না। তাই ওনাকে ওনার মেয়ে এসে নিজের বাড়ি নিয়ে গেছে। মেয়ে নিউ ইয়র্কে থাকে আর ওর বাড়িটা খুব ছোটো। তাই সেখানে চারখানা বেড়াল রাখা সম্ভব নয়। সেইজন্যে এদের এখানে দিয়ে গেছে। ওরা ছোটোদের খুব পছন্দ করে। তুমি ওদের বইগুলো পড়ে শোনাও, তাহলে ওদের খুব ভালো লাগবে। আসলে ওরা খুব মানুষ ভালোবাসে। কিন্তু ওদের তো ঘরবাড়ি নেই, তাই ওরা এই শেল্টারেই থাকছে আপাতত যতদিন না আমরা ওদের জন্যে কোনও ঘর খুঁজে পাচ্ছি। আচ্ছা, তুমি পড়ো, আমি সামনের রিসেপশানেই আছি। কেমন? আধঘন্টা পরে তোমাকে নিয়ে যাব।”
ওমা ডি চলে গেলেন ওকে ঘরে রেখে। রিশাদের কলকাতার বাড়িতে বেড়াল ছিল। তাই বেড়ালদের ও ভয় পায় না। সে একটা টুলের ওপর বসে একটা বই খুলে পড়তে শুরু করল। বইটা একটা রূপকথার গল্পের বই। সিন্ডারেলা, স্লিপিং বিউটি ইত্যাদি সব গল্প। ওমা, পড়া শুরু করতেই বেড়ালগুলো ওর কোলে, ঘাড়ে বসে গল্প শুনতে লাগল! কী মন দিয়ে শুনছিল ওরা! ওর অ্যাক্সেন্ট বা থমকে যাওয়াতে ওদের তো কিছু এসে যায় না। ওরা দিব্যি ওর কথা শুনছিল।
ওর যখন তিন-চারটে বই পড়া হয়ে গেছে তখন ডি এসে বললেন, “চলো রিশা। আজকের মতন এখানেই থাক। কাল মিসেস ফরেস্টার তোমাকে আবার নিয়ে আসবেন।”
সেই থেকে শুরু হল। কয়েকদিন পরে স্কুলের গরমের ছুটি পড়ে গেল তাই আরও সুবিধা হল। মিসেস ফরেস্টার তিনদিন ওই শেলটারে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেন। তাই উনি রিশাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। মাকে আর যেতে হয় না। রিশার সঙ্গে সাইমন, গ্রে, মিসি আর ট্যাবির খুব ভালো ভাব হয়ে গেছে। সপ্তায় তিনদিন করে ওদের গল্প পড়ে পড়ে শোনায় রিশা। মিসেস ফরেস্টার আর ডির সঙ্গেও অনেক কথা বলে। এখন ও ওনাদের কথা ঠিকই বুঝতে পারে, কোনও অসুবিধা হয় না।
তিনমাস ছুটির পর যখন স্কুল খুলল তখন নতুন ক্লাসের ইংলিশ টিচার ওকে রিডিং পড়তে দিলেন আবার। ভয়ে ভয়ে বই হাতে নিয়ে পড়তে গিয়ে রিশা দেখল ওর ইংরেজি পড়তে এখন আর তত অসুবিধা হচ্ছে না। উচ্চারণগুলোও তত উলটোপালটা হচ্ছে না, আর হোঁচট তো খেতেই হচ্ছে না। দিব্যি গড়গড় করে পড়ে যেতে পারছে।
ওর পড়া শেষ হতেই টিচার বললেন, “বাহ! এই তো অনেক উন্নতি করে ফেলেছ। এমনিভাবে চালিয়ে গেলেই দেখবে আর বেশিদিন লাগবে না।”
বাড়ি ফিরে মাকে সেই কথা বলতে মাও খুব খুশি হলেন।
কয়েকদিন পর একদিন বিকেলবেলা মিসেস ফরেস্টার হঠাৎ এসে হাজির। রিশা ওনাকে দেখে বলল, “আজ তো সোমবার। আজ তো আপনার শেল্টারে যাওয়ার দিন নয়!”
মিসেস ফরেস্টার বললেন, “নাহ, আজ আমি একটা অন্য কারণে এসেছি।” ওনার মুখটা বেশ গম্ভীর মনে হল।
রিশা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“ডির ফোন এসেছিল একটু আগে। সাইমন আর ট্যাবিকে একটা পরিবার এসে পছন্দ করে নিয়ে গেছে। আসলে ওদের অ্যানিম্যাল শেলটারে তো অনেক বিড়াল, তাই তাদের জন্যে ভালো একটা থাকার জায়গা খুঁজে পাওয়াটাই হল ওদের আসল উদ্দেশ্য। তা তোমার ওদের সঙ্গে তো খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল, তাই তোমাকে বলতে এলাম। তুমি মন খারাপ করো না। যারা ওদের নিয়ে গেছে তাদের দুটো বাচ্চা আছে। ওরা যত্নেই থাকবে।”
তাও রিশার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওই বেড়ালগুলোর জন্যেই তো আজ সে সুন্দরভাবে পড়তে শিখেছে। সত্যিই তো। সাইমন আর ট্যাবিকে আর দেখতে পাবে না সেই ভেবে চোখে জল এসে গেল ওর। মিসেস ফরেস্টার মাকে কী সব বললেন ফিসফিস করে।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরে দরজায় বেল দিতে মা খুব অল্প করে দরজাটা খুলে বললেন, “শিগগির ঢুকে এস, নাহলে পালাবে!”
কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে রিশা ঘরে ঢুকে দেখল ওদের বাইরের ঘরের সোফায় পরমানন্দে গা এলিয়ে বসে রয়েছে গ্রে আর মিসি! রিশাকে দেখতে পেয়ে ওর কাছে এসে পায়ের সঙ্গে লেপটে গেল। তখন রিশার আনন্দ আর দেখে কে।
মা বললেন, “মিসেস ফরেস্টারই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। স্কুল খুলে গেছে, পড়ার চাপ বেশি। তাই এখন আর তোমাকে তিনদিন করে অ্যানিম্যাল শেল্টারে যেতে হবে না। তোমার বুক বাডিরাই এখন এখানে চলে এসেছে তোমার কাছে গল্প শুনতে।”
রিশা এখন ইংরেজিটা খুব ভালো পড়তে লিখতে শিখে গেছে। ওর আর কোনও অসুবিধা হয় না। উচ্চারণও প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। তাও এখনও রোজ রাতে গ্রে আর মিসিকে গল্প পড়ে শোনায় রিশা। গল্প শেষ হলে ওরা দু’জনে মনের আনন্দে ‘ম্যাঁও’ করে। রিশা জানে সেই ‘ম্যাঁও’টার মানে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’। আর তারপরই সে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ে।
_____
পাদটিকাঃ মার্কিনমুলুকের পেন্সিলভেনিয়া রাজ্যের ‘অ্যানিমাল রেসকিউ লিগ অফ বার্ক্স কাউন্টি’ অ্যানিমাল শেলটারে ‘বুক বাডিস’ প্রোগ্রামটা খুব সফল। রিশার মতন অনেক ছেলেমেয়েরা ওই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে আনন্দ পায়। এইখানে দেখঃ http://www.berksarl.org/programs/book-buddies/#jp-carousel-3097
ছবিঃ মৌসুমী