এই লেখকের আগের গল্প শুদ্ধ ভক্তের ঘড়ি শরৎ ২০১৬
এই যাহ্, বাসটা একেবারে দাঁড়িয়ে গেল কেন রে! একটা হেঁচকি তোলা ভাব ছিল বাসে ওঠা ইস্তক। গেল নাকি বিগড়ে! মাটি করেছে। এখনই তো এগারোটা বাজতে দশ। আজ কপালে দুঃখ আছে। সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নেমে যাওয়া প্যান্টটা একটু ওপরে তুলে নেন অজিত পান। তারপর গুটি গুটি বাসের দরজার দিকে এগোতেই কন্ডাকটার হুড়মুড়িয়ে উঠে আসে বাসের ভেতরে।
“ বাস আর যাবেনা, খারাপ হয়ে গেছে। আপনারা নেমে যান।”
“ ইহ্, নেমে যান বললেই হল? হয়েছেটা কী? ভাড়ার অদ্ধেক টাকা ফেরত করো দেখি বাছা।”
“ হ্যাঁ, তাই তো। তাছাড়া এত রাতে অন্য বাসটাসও তো পাব না।”
কন্ডাকটারকে ঘিরে হইচই-এর মাঝখানে বাস থেকে নেমে পড়লেন অজিত পান। এটা গরানপুর। আর ছ’টা স্টপ গেলেই হসরতগঞ্জ। এই ডান ধারে যে বিশাল মাঠ, সেটা ধরে ঘুরে গেলেই হসরতগঞ্জ। এতো রাতে এই ছ-ছ’খানা স্টপ হেঁটে যেতে গেলে ভালোই সময় লাগবে। তাছাড়া এখন বয়েস হয়েছে। একটানা এতটা হাঁটা হাঁটুতে সইবে না। এ চত্বরে এত রাতে ট্যাক্সি পাওয়া লটারি পাওয়ার সমান। তাহলে?
ঝাঁকড়া বাবলা গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন অজিতবাবু। হঠাৎই বাকি প্যাসেঞ্জাররা কঘ করছে ভেবে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখেন সব ভোঁ ভাঁ। বাসটাই শুধু দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার, কন্ডাকটারেরও দেখা নেই। গেছে হয়তো মেকানিকের খোঁজে। অজিতবাবুর শরীরটা কেমন খারাপ লাগতে শুরু করল। মনে হচ্ছে যেন পায়ে বিন্দুমাত্র জোর নেই। কিন্তু বাড়ি ফিরতে তো হবে। জনমানবহীন রাস্তায় তো আর রাত কাটানো যায় না।
মাঠটার দিকে তাকিয়েই কথাগুলো ভাবছিলেন অজিতবাবু। ধাঁ করে মাথায় একটা আইডিয়া এল। মাঠটাকে চিরে নাক বরাবর সোজা গেলেই হসরতগঞ্জ বাজার। সেখান থেকে ওঁর বাড়ি মিনিট সাতেক। সঙ্গে বিশেষ টাকা পয়সাও নেই যে ছিনতাই হতে পারে।অতএব, এই পথই নেওয়া যাক।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, যে সময়কার ঘটনা এটা, তখন মোবাইল আসেনি। তাই এরকম পরিস্থিতিতে বাড়িতে খবর দেবার কোন উপায়ই ছিল না। জয়গুরু বলে মাঠে নেমে পড়লেন অজিত পান। এক হাতে খুবই সাধারণ একটা থলেজাতীয় ব্যাগ। অন্য হাতে লম্বা বাঁটওয়ালা ছাতা। নিজের বুদ্ধির তারিফে ঠোঁটে একফালি হাসি।
পঞ্চাশ পা মতো এগিয়েছেন কী এগোননি, হাঁটু দুটো যেন ভেঙে পড়ছে। এই ভয়টাই তো পাচ্ছিলেন অজিতবাবু। কিন্তু এতটুকু হেঁটেই এমন অবস্থা হবে, তা ভাবেননি মোটেও। এঃ, শরীরটার আর কিছু নেই। বিরক্তি নিয়ে চেষ্টা করলেন ধীরে ধীরে এগোতে। মাথাটাও যেন ঘুরছে। একটু শুতে পারলে ভালো হত।
*******
চোখ খুলে অজিতবাবু প্রথমটায় বুঝতে পারলেন না কোথায় আছেন। আধা অন্ধকারে ভাবলেন নিজের ঘরের খাটেই শুয়ে আছেন। স্ত্রী সরমার নাম ধরে ডাকবার চেষ্টা করলেন। গলা শুকিয়ে কাঠ। এবার চেতনা সজাগ হল। ঘর কই, এতো খোলা আকাশ দেখতে পাচ্ছেন। দু’ফালি চাঁদ আর অজস্র তারা।
একটা গাছের তলায় বেদিতে শুয়ে আছেন। চারদিকে চাপ চাপ কুয়াশা। সমস্ত রক্ত নিমেষে মাথায় ছুটে গেল। মানেটা কী!! তড়িঘড়ি উঠে বসার চেষ্টা করতেই কানে এল,
“আরে করেন কী মশয়, দুমদাম উঠবেন না। আবার চক্কর খেয়ে পড়বেন।”
“ কে, কে ওখানে? কে কথা বললেন। ব্যাপারটা কী? আমি এখানে এলাম কী করে?”
“ ওখানে কেন হব, আমি তো আপনার পাশেই আছি। শুধু আমি নই, আমরা সবাই আছি আপনার ধারে পাশে। আপনি ওই গরানপুরের কাছাকাছি মাঠের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের তাঁউ দেখতে পেয়ে খবর দিতে আমরা গিয়ে আপনাকে তুলে আনলাম। বাব্বাঃ, কী ভারী আপনি! পনেরো ষোলোজন মিলে আপনাকে তুলেছি। এতো খান কেন?”
অজিত পানের চোখ তখন কপাল ছাড়িয়ে ব্রহ্ম তালুর কাছাকাছি। এরা কারা? এরা কী তেনারা? তাই এই গরমেও কুয়াশা… ওরে বাবা রে…
“ আরে দূর মশয়, ভয় কাঁপতে লাগলেন কেন। আপনাদের এই এক রোগ। কিছুই জানেন না। জ্ঞানের ভাণ্ডার তো খাঁ খাঁ করছে তাও আপনাদের দম্ভের শেষ নেই।”
অজিত পান বাকরুদ্ধ। খানিক ভয়, খানিক ভূতের জ্ঞান শুনে। এরা এমনতর কথা বলে নাকি! হে শিব, হে কালি, হে গণেশ, হে লক্ষ্মী, হে…।
“ ভয় পাবার কিচ্ছু নেই। আপনারা চিরটাকাল আমাদের ভুল ভেবেছেন, ভুল বুঝেছেন। আজ আপনি আসল সত্যিটা জেনে নিন আমাদের কাছ থেকে।”
এটা আবার আলাদা গলা। আরও অনেকে যে আছে এখানে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। আজ আর প্রাণ নিয়ে ফেরত যাওয়া হবেনা। সরমা, তিতলি, তিলক আর মায়ের মুখ ভেসে উঠল অজিতবাবুর মনে।
“ একটু বসব…” কোন রকমে বললেন অজিত বাবু। এক ঝাঁক কুয়াশা অজিতবাবু কে পিঠের দিক থেকে ঠেলে গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিল বেশ যত্ন করে।
একটু হাল্কা গলায় একজন বলে উঠল, “আপনার মনে হয় খিদে পেয়েছে। কিন্তু আমরা তো… ”
“আহা চুপ কর না, পুরোটা বলতে দে আমাকে।” বয়স্ক কেউ বলল মনে হয়।
“শুনুন মশয়, মন দিয়ে শুনুন। ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন জল স্থল মিলিয়ে কমবেশি প্রায় সাতাশী লক্ষ প্রাণী। আমরা সেই ঈশ্বর সৃষ্ট এক ধরণের প্রাণী। যাকে অনন্তকাল ধরে আপনারা, মানে মানুষ ভুল ব্যাখ্যা করে এসেছে।
“আপনাদের ধারণা, মানুষ মরে ভূত হয়। কী হাস্যকর চিন্তা ভাবনা! এত এত লেখাপড়া করেও সত্যিটা আবিষ্কার করতে পারেননি আপনারা। কেউ কেউ যে ব্যাপারটা বোঝেনি তাও নয়। কিন্তু বুঝলেও প্রকাশ করেনি। কারণ প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু তাও বলব, আমাদের নিয়ে আপনাদের আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন ছিল। এখনও আছে।”
অজিত পান বুঝতেই পারছেন না উনি বেঁচে আছেন কিনা। এসব কী জীবন্ত অবস্থায় শোনা যায়?
“ও মশয়, বুঝতে পারছেন তো, আমরা আপনাদের মতোই ভগবানের বেটাবেটি। বেশ কিছু কট্টর তফাত মানুষ আর ভূতের আছে বলেই এত বিপত্তি। এবার হাঁউ আপনাকে বিশ্লেষণ করবে আমাদের শারীরিক গঠন আর পার্থক্য।”
“সব্বোনাশ! হাঁউ আবার কে? খেয়ে নেবে না তো?” অজিত পান আর কিছু ভাবার আগেই একটা চ্যাংড়া টাইপের গলা বলে উঠল, “শুনুন মামা, আমাদের আর আপনাদের মেন ডিফারেন্স হচ্ছে, আপনাদের রক্ত লাল আর আমাদের সাদা। আপনাদের রক্তে হিমোগ্লোবিন আছে, আমাদের রক্তে আছে হিমোসায়ানিন। ওই যে গো মামা, আপনাদের প্রিয় চিংড়ি, যাকে আপনারা মাছ বলেন, হে হে, সেই চিংড়ির রক্তেও তাই আছে। এর জন্যেই আমাদের রক্ত চোখে দেখা যায়না। তাই আমরা ফ্যাকাশে।
“এছাড়া আমদের দেহ একটু স্বচ্ছ। তাই আলোতে আমাদের দেখাই যায় না। অন্ধকারেও একটা অবয়ব মতো দেখতে পান মাত্র। আর ভয় ভিরমি খান। আচ্ছা বলুন দেখি, এতে আমাদের কী দোষ? ইশ্বরের সৃষ্টি করা উন্নত যে কটি জীব আছে আমরা ভূতেরা তার মধ্যেই পড়ি। বুঝতেই পারছেন, জ্ঞানগম্যি কিছু কম নেই আমাদের। কেবল চেহারাটাই মেরে দিয়েছে।”
“তা তা তাহলে এতকাল আপনারা এসব…” কথা শেষ করতে পারলেন না অজিতবাবু। জিভ জড়িয়ে আসছে।
“আপনি কী বলতে চাইছেন বুঝেছি। এতকাল আমরা মানুষকে বোঝাইনি কেন? বোঝাব কী করে বলুন তো! বোঝাবার জন্যে চরাচর শান্ত হতে হবে। তাই রাতের বেলাই উপযুক্ত। যত দেশে যত ভূতই চেষ্টা করুক না কেন, অদৃশ্য কারো গলা শুনেই হয় ভয় অজ্ঞান নয়তো চোঁ চাঁ দৌড়। আজ কপাল ভালো যে আপনার মতো একজনকে আমাদের ডেরার কাছাকাছি পেয়ে গেছি। তাছাড়া আপনার কলজের জোর আছে, এটা মানতেই হবে।”
শরীরে একটু বল পেলেন অজিত পান। প্রশংসা শুনে মনটা পুলকিত হল কিনা!
“তাছাড়া আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, মানুষ যেমন জন্মলগ্ন থেকেই সভ্য হয়নি, অনেক ধাপ পেরিয়ে আজকের মানুষ হয়েছে, আমরা ভূতেরাও তাই। প্রথম দিকে একটু অসভ্য গোছের ছিল আমাদের পূর্বপুরুষ। কাঁচা মাংস খাওয়া, অন্যান্য প্রাণীদের ভয় দেখান, বিশেষ করে মানুষদের, এসব করত। তারপর যুগের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সভ্য হয়েছি। এখন বরং মানুষ আবার যেখান থেকে শুরু করেছিল, সেখানে ফিরে যাচ্ছে। কী বলেন? খ্যাক, খ্যাক, খ্যাক, খ্যাক…” সমবেত হাসির ছররা ছোটে। দু” একটা মেয়েলি গলাও শোনা গেল।
তা মন্দ বলেনি এরা। অনেকটাই তো বুঝলাম কিন্তু এরা থাকে কোথায়? খায় কী? পড়াশোনাই বা করে কী ভাবে? শয়ে শয়ে প্রশ্ন ভিড় করে আসে অজিত পানের মাথায়।
“ও মশয়, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? সাড়া নেই কেন?”
“না, না ঘুমইনি। ঘুম কি আর আসে। বাড়িতে সব দুশ্চিন্তা করছে। ফিরতে পারলে ভালো হত।”
“তা ফিরবেন বইকি। আমরাই পৌঁছে দিয়ে আসব নাহয়। কিন্তু আমাদের আরও দু”এক কথা বলার আছে। আপনি জানলে পাঁচজন কে বলবেন।তারা আবার দশজনকে বলবে। এইভাবে যদি আমাদের সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ভাঙে মানুষের।” ভারী গলার কেউ একজন বলে।
“যেগুলো জানা জরুরি আপনাদের সেগুলো শুনুন। আমরা নিঃশ্বাস নিই না, চামড়া দিয়ে বাতাসের গ্যাস শোষণ করি। আমাদের অক্সিজেন কম লাগে, বেশি লাগে নাইট্রোজেন। কেন”“ সে ব্যাখ্যায় কাজ নেই। আপনার দেরি হবে ফিরতে। খাবারের রসদও আমরা প্রধানত বাতাস আর গাছপালা থেকেই সংগ্রহ করি। মানুষের খাবার আমরা খাই না। ওই আপনারা মেছো ভূত মাছ ভালোবাসে না কী সব বলেন, ওগুলো সব আপনাদের বানানো কথা,মিথ্যে কথা।
আমরা ফাঁকা জায়গায় থাকা পছন্দ করি তাই হাইওয়ের ধারে আমাদের আস্তানা বেশি। বা এরকম বড়সড় মাঠেও থাকি। ভিন্ন ভিন্ন দেশে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষি ভাই বেরাদররা থাকে। তাই সাহেব মরে বিদেশে সাহেব ভূতই থাকে। কত আর বোঝাব?”
“বুঝেছি দাদারা। খুব বুঝেছি। আশ্চয্যিও কম হচ্ছিনা। এতকাল এত ভুল জেনে আসলাম? ছি, ছি… আপনাদের কত অসম্মান করে মানুষ। আপনারা তো আমাদেরই মতো দেখতে পাচ্ছি। কিছু ক্ষেত্রে একটু এগিয়েও আছেন। আমি নিশ্চই আমার পরিচিতজনদের বুঝিয়ে দেব ব্যাপারটা।”
“বাঃ বাঃ, আপনি কিন্তু দিব্বি সজ্জন মানুষ। আপনি আমাদের সাহায্য করবেন আর আমরাও আপনাকে সাহায্য করব। যখনি কোন ঘোর বিপদে পড়বেন, যেমন আজ পড়েছেন, এই গাছতলায় এসে হাঁউরাম, মাঁউগিরি বা খাঁউধন বলে হাঁক দেবেন। এদের কেউ না কেউ ঠিক হাজির হয়ে যাবে আপনার সামনে।”
এই সেরেছে। এ আবার কেমন ধারা নাম! যাক গে, নাম দিয়ে কিই বা এসে যায়। ভাবলেন অজিত পান।
“দিনের বেলাও ডাকতে পারেন, আমাদের কোন অসুবিধে নেই। তবে আপনাদের মনুষ্য জাতির কেউ দেখলে আপনাকেই পাগল ভাববে, এই আর কি!”
“অনেক ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে। এখন মনে হচ্ছে ভাগ্যিস বাসটা বিগড়েছিল। নাহলে এমন চমৎকার অভিজ্ঞতা হতই না। এবার তবে যাওয়া যাক।”
“আপনাকেও ধন্যবাদ—” বয়স্ক গলায় কেউ বলে উঠলেন। তারপর নির্দেশ দিলেন, “ওরে ছেলেছোকরার দল, যা পৌঁছে দিয়ে আয় ওনাকে বাড়ি অবধি।”
নিমেষে এক রাশ কুয়াশা এসে উঁচু করে তুলে ধরে হাওয়ার বেগে নিয়ে চলে অজিতবাবুকে। দু’মিনিটও লাগে কিনা সন্দেহ, বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছে যান তিনি। ঝপ করে দাঁড় করিয়ে দিয়েই কুয়াশার রাশি যেন মিলিয়ে যেতে থাকে।
চড়াক করে একটা প্রশ্ন উদয় হতেই চিৎকার করে অজিতবাবু বলেন, “আচ্ছা ভাইয়েরা, তোমাদের জন্ম” মৃত্যু বিষয় কিছু জানা হল না তো?”
কোথায় ভাইয়েরা, চারিদিক শুনশান, অজিতবাবুর চিৎকারে নেড়িগুলো চেঁচাতে শুরু করল। আর একদিন যেতে হবে ব্যাপারটা জানতে। কলিং বেলে হাত রাখলেন অজিত পান।
ইসসস ! কী ভাল ! কীঈঈ ভাল গল্প !!!
LikeLike
ফাটাফাটি গল্প! এর একখান সিকুয়েল চাই-ই চাই।
LikeLike