গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে আনন্দবাবুর। এক মুহূর্তও তিনি আর এই অসহ্য দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে চাননা কিন্তু কোন যাদুবলে তার পা’দুখানা সামনের বাড়ির খোলা জানালার সামনেই আটকে আছে মিনিট পনেরো।
ব্যাপারটা এই নিয়ে পরপর তিন রাত্রি ঘটল। মাঝরাত্রে রোজই আনন্দবাবুর টয়লেটে যাবার প্রয়োজন পরে। পরশু তেমনই প্রায় রাত্রি দুটো নাগাদ টয়লেট সেরে বারান্দা দিয়ে ফেরার সময় সামনের বাড়ির সদ্য শেষ হওয়া দোতলার মুখোমুখি জানালাটা খোলা দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন।
স্ট্রিট লাইটের আবাছা আলোয় দেখতে ভুল হল না একটি মেয়ের অবয়ব। এক পিঠ খোলা চুল নিয়ে জানালার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দবাবু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিলেন। যতদূর জানেন এত বড় বাড়িতে বৃদ্ধ বৃদ্ধা ছাড়া কেউ থাকেন না। তাও তাদের দোতলায় কোনোদিন উঠতে দেখেননি। মাঝরাত্রে খোলা জানালায় এই রহস্যময়ী নারীকে দেখে তাই অবাক হবারই কথা।
ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার জন্য আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। এক সময় নিজের উপস্থিতি জানান দেবার জন্য অল্প একটু কাশলেন। সেই শব্দ শুনেই মেয়েটি নড়েচড়ে উঠল। তারপর সামনের দেওয়াল অভিমুখে হাঁটতে শুরু করল। আনন্দবাবু বিস্ফারিত চোখে দেখতে থাকলেন, ম্যাক্সিমাম বারো বাই চোদ্দর ঘরটা যেন প্রকান্ড ফুটবল মাঠ হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে হাঁটার গতি বাড়তে লাগল, তারপর এক সময় ছুটতে শুরু করল মেয়েটি তবু যেন সামনের সাদা দেওয়ালটার কাছাকাছি পৌঁছতে পারছে না। এই দৃশ্য দেখে আনন্দবাবু আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পাননি। টিউবটা জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন।
সকালে বেশ দেরিতে ঘুম ভেঙেছিল। বিছানা থেকে নেমেই বারান্দায় দৌড়েছিলেন, যথারীতি দোতলার সমস্ত জানলা বন্ধ। দিনের বেলায় পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর লেগেছিল এবং অফিসে কাজ করতে করতে ভেবেছিলেন গতরাত্রে হোটেলের রিচ খাবারে অ্যাসিডিটি ফর্ম করেছিল তাই মাঝ রাত্রে হ্যালুসিনেট করেছিলেন।
কিন্তু দ্বিতীয় রাত্রে আবার মেয়েটিকে দেখলেন খোলা জানলার গ্রিলে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা অলস, বিষণ্ণ সেই ভঙ্গি। ঘাড় ঈষৎ বাঁকানো , এক পাশের গালে তেরছা ভাবে আবছা আলো এসে পড়েছে। মেয়েটি যেন আস্তে আস্তে সজাগ হয়ে উঠল। আনন্দবাবুর উপস্থিতি যেন মুখ না ঘুরিয়েও শুধুমাত্র ঘ্রাণের মাধ্যমে টের পেতে শুরু করেছে। এখুনি যেন শুরু করে দেবে গতরাত্রের মত প্রাণপ্রণ হাঁটা। আনন্দবাবু আর দাঁড়ালেন না। নিঃশব্দে পায়ের পাতা টিপে টিপে প্রায় দৌড়ে নিজের ঘরে ফিরে এলেন।
কিন্তু তৃতীয় দিন অফিসে কাজ করতে করতে ভাবলেন এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। রাত্রে ভালো করে ঘুমতে পাচ্ছেন না। সারাদিন অদ্ভূত রহস্যময়ী ঐ ছায়ামানবী হন্ট করে বেড়াচ্ছে। কাজকর্মে মন বসাতে পারছেন না। প্রতিমকে একবার বলে দেখবেন। ও রাজি হলে ভালো নাহলে আজ রাত্রে আরো সতর্ক থাকবেন।
লাঞ্চ আওয়ারে প্রতিমকে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন , “আচ্ছা তুমি কোনদিন ভুত প্রেত দেখেছ ?” রুটির টুকরো চিবোতে চিবোতে প্রতিম কিছুক্ষণ আনন্দবাবুকে অবাক চোখে দেখল। যদিও তিনি প্রতিমের এই জহুরি চোখে পর্যবেক্ষণ লক্ষ করলেন না। আনমনে জলের গ্লাসে আঁকিবুকি কাটছিলেন। প্রতিম আস্তে আস্তে প্রশ্ন করল, “কেন বলুন তো ? আপনি কী কিছু হ্যলুসিনেট করেছেন ?”
প্রতিমের প্রশ্নে আনন্দবাবু সতর্ক হন। এমনিতেই এই অফিসে তিনি কিছুদিন হল এসেছেন। ভালো করে সবার সাথে আলাপ পরিচয় হয়ে ওঠেনি। প্রতিমের সঙ্গেই যা একটু ঘনিষ্ঠতা। ও কিছু সন্দেহ করলে সর্বনাশ , শেষে না তার মস্তিষ্কবিকৃতি হয়েছে বলে অফিসে রটে যায় !তাই আপাতত রাত্রে ওকে রাত্রে সঙ্গী করার বাসনাটা মুলতুবি রাখলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ওঠেন, “ না, না তেমন কিছু না , এমনিই প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল তাই আর কি।” চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন প্রতিম কেমন অবিশ্বাসী চোখে তাঁকে দেখছে। তারপর এক টুকরো অমলেট মুখে চালান করে দিতে দিতে বলল, “ একটু সাবধানে থাকবেন আনন্দদা। এই সেদিন সিঁড়ি থেকে পড়ে কপালটা ফাটালেন। আমার মনে হয় কড়া অ্যান্টিবায়টিকের ডোজে আপনি ড্রাউজি ফিল করছেন আর সেখান থেকেই হ্যালুসিনেশন ……”।
কথাটা শেষ করতে পারল না প্রতিম , আনন্দবাবু কখন যেন অভূক্ত প্লেট ফেলে ওয়াশ বেসিনের দিকে এগিয়ে গেছেন।
(দুই)
ডাইনিং টেবিলের উপর একে একে মিষ্টির বাক্স , ফলের প্যাকেটগুলো সাজিয়ে রাখছিলেন আনন্দবাবু। প্রায় এক মাস পরে বাড়ি এলেন। অপালাদেবী বলে উঠলেন , “কী দরকার ছিল তোমার চাকরিটা করার ? সারাজীবন তো চাকরি করলে। অবসরের পরে অন্তত মেয়ে বউ এর সাথে আনন্দে দিনগুলো কাটাতে। চেহারার কী অবস্থা হয়েছে দেখেছ ? খাওয়া দাওয়া কী কর না ?”
স্ত্রীর প্রশ্নবাণ সামলাতে সামলাতে বড় আয়নার সামনে দাঁড়ান আনন্দবাবু। বেশ কিছুদিন ধরেই প্যান্টগুলো ঢিলে হয়ে যাচ্ছে , বেল্ট দিয়ে পরতে হচ্ছে। আজ আয়নার সামনে আপাদমস্তক নিজেকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। মেয়ে অদিতি চায়ের কাপ হাতে সামনে দাঁড়িয়েছে। চোখে তার বাষ্প, “ বাপি চাকরিটা করার খুব দরকার ছিল ? তাও যদি কাছে পোস্টিং পেতে, কথা ছিল। কোথায় সেই ধ্যড়ধ্যাড়ে বাঁকুড়া ! কোনও মানে হয়!”
আনন্দবাবু কথা বাড়ান না , মেয়ের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেন। তারপর অপালাকে বলেন , “এখনো কর্মঠ আছি, আর তাছাড়া পি ডি সি এল এর অনারারি পোস্ট, গুচ্ছের টাকা মাইনে দিচ্ছে। হাতের লক্ষ্মী কেউ পায়ে ঠেলে নাকি?”
সেদিন রাত্রে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেন। পরেরদিন রবিবার ব্রেকফাস্ট টেবিলে লুচির প্লেট টেনে নিতে নিতে এই কদিনের অস্বস্তিকর ঘটনাটা মুচমুচে হাসির সঙ্গে স্ত্রী কন্যার কাছে পরিবেশন করলেন। তারপর হাসতে হাসতে বললেন , একেই বলে বুড়ো বয়সের ভীমরতি। না হলে শুনশান রাত্রে জনমানবশূণ্য বাড়িতে নারী দেখি!
ব্যাপারটা যতই তিনি হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করু্ন, মেয়ে আর বৌ এর মুখ শুকিয়ে গেল।
রাত্রে নরম বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছিল না। এপাশ ওপাশ করছিলেন। অপালা আজ অদিতির ঘরে শুয়েছেন। এসিটা বন্ধ করে ঘুমবার চেষ্টা করলেন আনন্দবাবু। একটু তন্দ্রার মত লেগেছে। হঠাৎ পরিচিত ঘরের দেওয়ালগুলো যেন মুছে গেল। ধীরে ধীরে জেগে উঠল বাঁকুড়ার সেই শোবার ঘরটি। তিনি চোখ বন্ধ করে রবিবারের দুপুরে ভাত ঘুম দিচ্ছেন। হঠাৎ শাড়ির মৃদু খসখস , চুরির রিনিঠিনিতে একটা মেয়েলি উপস্থিতি টের পেলেন। ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখলেন চৌকাঠের ওপাশে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স চব্বিশ পঁচিশ। চোখে চোখে পড়তেই মেয়েটির চোখ দুটো ঝিকিয়ে উঠল। আনন্দবাবুর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা একটা সরীসৃপ যেন পিছলে গেল।
মেয়েটি এবার অভয় দেবার কন্ঠে বলে উঠল, “ভয় পেও না কাকু। তুমি খুব ভালো। এত ভালো রান্না কর, জানো আমি তোমার রান্না করা সব খাবার খেয়ে নিই। আহ , কতকাল পরে এত ভালো করে খাচ্ছি।” তৃপ্তিতে মেয়েটি চোখ বন্ধ করে।
বলে কী এই মেয়ে ! সব খেয়ে নেয় ! তাহলে তিনি কীখান ! পাগল নাকি ! দরজা তো বন্ধ! মেয়েটি তার দোতলার ঘরে এল কীভাবে ! তার এতসব ভাবনার মধ্যেই মেয়েটি পিছন ফিরে দাঁড়াল আর তারপর ঘাড়টা ঈষৎ বেঁকিয়ে একবার আনন্দবাবুর দিকে তাকাল। গালের এক পাশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খুব চেনা। তবে কী—
আর ভাবতে পারলেন না। হঠাৎ মনে হল সূর্যটা নিভে গেল। তার এই অন্ধকার ঘরে এক রাশ পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে এসে তাঁর কাঁধে, বুকে, হাতে, পায়ে বসে ঠোকরাতে চাইছে। এই অন্ধকারেই টের পাওয়া যাচ্ছে একরাশ তীক্ষ্ণ চঞ্চু যেন ঝলসে উঠছে। আতঙ্কে চীৎকার করে উঠলেন তিনি।
অপালা আর অদিতি ঘুম চোখে দৌড়ে এলেন। এসে দেখলেন ঘামে ভিজে সপসপ করছে আনন্দবাবুর পরণের পাঞ্জাবিটা। আর মুখ দিয়ে একটা দুর্বোধ্য আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। অদিতি এগিয়ে এসে এক ঠ্যালা মারে বাবাকে। ধড়ফড় করে উঠে বসেন তিনি , শূন্য বোবা দৃষ্টিতে স্ত্রী কন্যার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
(তিন)
দেখতে দেখতে চাকরির মেয়াদ ভালভাবে শেষ করে আনন্দবাবু বাড়ি ফিরলেন। এমনিতে কোনও অসুবিধা নেই তবে আগের থেকে অনেক গম্ভীর হয়ে গেলেন। আগের মত সংসারের খুঁটিনাটিতে তেমন মাথা ঘামান না। বই পড়ে সময় কাটান। শুধু শরীরটা দিনের পর দিন ভেঙে যেতে শুরু করল। ডাক্তারি পরীক্ষাতেও কিছু ধরা পড়ল না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা সবাই প্রায় এক কথাই বললেন , বয়সজনিত কারণে শরীরটা ভেঙে পড়ছে। হেলদি ডায়েট ফলো করতে।
এদিকে অপালা খাবার যোগাড় করতে করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন। সকালে ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই হলেই অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করেন আনন্দবাবু। মুখে উষ্মা , বারবার ঘড়ির দিকে তাকান। রুটি, পরোটা , লুচি এক একদিন একেকরকম বায়না। আর খাবার পরিমাণ ও কম না, যে মানুষ সারাজীবন দুটোর বেশি পরোটা , রুটি মুখে তোলেননি , পলকেই তিনি পাঁচ-ছটা গলঃধকরণ করে এক গ্লাস জল খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন।
দুপুর বারোটায় ডাল, ভাজা, সুক্তো , তরকারি , মাছ বা মাংসের হাল্কা ঝোল শেষ করে শুতে না শুতেই উঠে পড়ে ফ্রিজ হাঁটকে আম, আপেল, পেয়ার সিজনের ফল। পাউরুটি, কেক যেমন যা মজুত থাকে খেতে শুরু করেন। তারপরেও এক বুক খিদে নিয়ে শেষ বিকেলে অপালাকে ডাকেন, “ অপা বড্ড খিদে পাচ্ছে , বিস্কুটে হবে না। চায়ের সাথে এক বাটি মুড়ি দিও তো।”
অপালা আর অদিতি মুখ চাওয়াচায়ি করেন। পঁয়ষট্টি বছরের কোনও মানুষ এত খেতে পারে! যেখানে সারাজীবন মানুষটি মিতাহারী ছিলেন! রাত্রে পাশাপাশি শুয়ে মেয়ে ফিসফিস করে, “ মা লক্ষ করেছ, হার্টের ট্রাবল নিয়েও বাপি কেমন অমানুষিক পরিশ্রম করছে। গেল বর্ষায় নিজেই এত বড় বাগানটা পরিষ্কার করে, মাটি তৈরি করে অত গাছ লাগিয়ে ফেলল। তোমার অস্বাভাবিক লাগে না?”
অপালা জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শোন। কী জবাব দেবেন! তাঁদের দু’জনের চিন্তাধারাই যে এক খাতে বইছে। মুখ খুললেই যেন একে অপরের কাছে ধরা পড়ে যাবেন। হার্টের যা অবস্থা, মানুষটা এতদিন বাঁচার কথাই না। একটা আর্টারি ব্লকড। ভীতু মানুষটা কিছুতেই ওপেন হাট সার্জারি করাতে রাজি হননি। সেই মানুষটাই এত কর্মঠ হয়ে উঠলেন কীভাবে! তবে কী নিজের স্বার্থেই কেউ ওঁকে বাঁচিয়ে রাখছে? আপাদমস্তক শিউরে উঠে জোর করে চোখের পাতা বন্ধ করলেন তিনি।
কদিন হল একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। অপালার আবদারে আনন্দবাবুকে সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দিরে পূজো দিতে যেতে হয়েছিল। কিছুটা জেদ করেই রাজি করিয়েছিলেন অপালা। আসলে একটা পরীক্ষার জন্য মনে মনে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। আনন্দবাবু একটু গাঁইগুই করলেও শেষে রাজি হয়ে গিয়েছিলন। কিন্তু মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় কী যে হয়ে গেল, পা পিছলে পড়ে গেলেন আর ডান হাতটা ক্র্যাক করে গেল। পুজো রইল মাথায়। চেনা রিকশাওয়ালাকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারখানায় ছুটলেন অপালা।
মেয়ে বলেছিল, “ক’টা দিন বাপির ঘরে শোও মা।” অপালার তেমন আপত্তি ছিল না। কিন্তু আনন্দবাবু রাজি হননি। তাই রাত্রে , মা মেয়ে যার যেমন ঘুম ভাঙে পাশের ঘরে একবার আনন্দবাবুকে দেখে আসেন।
আজ ও মাঝরাত্রে অপালার ঘুম ভেঙে যায়। সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে ওঠেন যাতে মেয়ের না ঘুম ভেঙে যায়। অনেক রাত্রি জেগে পড়াশোনা করেছে মেয়ে। সারাদিন স্কুলের খাটনির পর এই রাত্রিটুকুই থাকে কলেজ সার্ভিস কমিশনের প্রস্তুতির জন্য।
পাশের ঘরের দিকে এগিয়ে যান। ফ্যানের হাওয়ায় আনন্দবাবুর ঘরের পর্দাটা উড়ছে। ঘরের মধ্যে থেকে একটা হাল্কা আলো ভেসে আসছে। আনন্দবাবু তো ইদানিং ঘর অন্ধকার করে ঘুমান। মৃদু নাইট ল্যাম্পের আলোটাও সহ্য করতে পারেন না। তবে কী ঘুমের ঘোরে হাত পড়ে টর্চ লাইটটা জ্বলে গেছে? এসব ভাবতেভাবতেই তিনি দরজার কাছে এসে দাঁড়ান।
দরজার দিকে আনন্দবাবুর পা। আর পায়ের কাছেই একটা হাল্কা আলোর বলয়। চোখ কচলে ভালো করে দেখলেন একটি মেয়ে যেন সেই আলোর বলয়ের মধ্যে বসে ধীরে ধীরে আনন্দবাবুর প্লাস্টার করা হাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এবার স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন অপালা। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখটা যেন আস্তে আস্তে অপার্থিব হাসিতে ভরে যাচ্ছে। পর্দা আঁকড়ে দাঁড়িয়েই আছেন অপালা। তার উপস্থিতি টের পেয়ে মেয়েটি দরজার দিকে একটু যেন ঘাড় ঘোরাল। ঈষৎ শ্যমলা গাল , একটা মিষ্টি টোল পড়েছে। অপালা মন্ত্রমুগ্ধের মুগ্ধের মত তাকিয়ে রইলেন সেদিকে।
পরেরদিন সকালে স্নান করতে করতে অদিতি অন্যদিনের মতই চিৎকার করে উঠল , “মা দেরি হয়ে গেছে। খাবার সময় নেই। লাঞ্চ প্যাক করে দিও প্লিজ।”
আনন্দবাবু ও বার দুই কিচেনের দিকে ঘুরে গেছেন। স্নান সেরে অদিতি দেখল তার লাঞ্চ বক্স রেডি না করে , বাবাকে ব্রেকফাস্ট না দিয়ে মা নিজে এক গোছা রুটি নিয়ে কিচেনের মেঝেতে থেবড়ে বসেছে। সঙ্গে বড় বাটি ভর্তি সবজি। অদিতি এই দৃশ্যের সামনে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইল। আনন্দবাবু ও কিচেনের সামনে এসে এসব দেখে বিড়বিড় করে উঠলেন, “এই ভালো , এই ভালো , আমার একদম খিদে নেই। আমি বরং গোলাপ গাছগুলোতে জল দিয়ে আসি। ধীরে ধীরে তিনি বাগানে নেমে গেলেন। অদিতি অবাক চোখে একবার বাবাকে আর একবার মা’কে দেখতে দেখতে টের পেল তার কানের কাছে কে যেন খিলখিল করে হেসে উঠল।
ছবিঃ মৌসুমী
খুব ভালো গল্প, একটুও একঘেঁয়ে লাগেনি, বেশ ভয় ধরানো…
LikeLike
ভালো। বেশ ভালো। অনেককাল আগে একটা বিদেশী গল্পের বাংলা আনুবাদ পড়ে ছিলাম।গল্পের লেখক বা আনুবাদক – কারুর ই নাম মনে নেই।যাই হোক সেই গল্পের সামান্য ছায়া যেন এতে পড়েছে। সেখানে একটি প্রাচীন লুপ্ত জনগোষ্ঠী মাথার চুলের মধ্যে আশ্রয় নিত এবং তা এক মাথা থেকে অন্য মাথায় স্থানন্তরিত হতো।
LikeLike