সাগরিকার আগের গল্পঃ ওরা ভূত পুরোহিতমশাই
নব সরকার লোকটি খারাপ নয়। ছোটবেলায় ভালো ছেলে ছিল। বড়ো হয়েও মোটামুটি ভালো লোকই হল। চাকরিও করে মোটামুটি একটা। কালিঘাটে গঙ্গার ধারে ছোটখাটো বাড়ি আছে। খিটখিটে বউ আছে। দুটো মেয়ে আছে। তারা কিন্তু মোট্টে খিটখিটে নয়। ক্লাস সেভেনে উঠে তাদের নিজস্ব মতামত হয়েছে। বড়ো হয়ে কী হবে সেটা ঠিক করে ফেলেছে নিজেরাই। তাতে নব সরকার খুশি। যাক বাবা, মাথা ঘামিয়ে তারা কী হবে ভাবতে হয়নি। আসলে নব সরকার কোনও ঝামেলা-টামেলা পছন্দ করে না। এইজন্য বাড়িতে নবর নাম একাচোরা। যে একা থাকতে ভালোবাসে। সেকথা খুব মিথ্যে নয়। নব অফিসেও সাতেপাঁচে থাকে না। কোনও ঝামেলায় জড়ায় না। নব জানে, অফিসে ওর নাম একঘরেবাবু। কেউ বা বলে ভেজা বেড়াল। তো একটা মানুষের মধ্যে কতরকম শেড খুঁজে পেয়েছে মানুষ। ভাবে আর হাঁটে নব। অফিসের ছুটি হলে স্ট্র্যান্ডরোড ধরে আসতে আসতে কত কিছু নজরে পড়ে। কতরকম মানুষ আছে এই দুনিয়ায়, ভাবতে ভাবতে রাস্তা পেরিয়ে বিবাদীবাগ স্টেশন থেকে চক্ররেলে উঠে পড়ে। নয়তো ময়দানে গিয়ে মানুষ দেখে। কখনও বসে থাকে একা কোথাও।
সেদিন মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে মেছুয়াবাজারে ঢুকে পড়ল। জায়গাটা একটুও গোছানো নয়। নোংরাও। কুটকুটে ময়লা সালোয়ার পরা মেয়ে আইসক্রিমওলার থেকে হলুদ রঙের আইসক্রিম কিনছিল। এইটুকু আইসক্রিমটাকে তিন টুকরো করে তাতে কমলা রঙের সিরাপ মিশিয়ে দিল লোকটা। খেতে খেতে চলে যাচ্ছে মেয়েটা। নব সরকার ভাবল, এদের পেটখারাপ হয় না? যা হোক, এই সময়ে ভাঙা বাজারে সস্তায় সবজি মেলে। নবর পকেটে সবসময়েই একখানি প্ল্যাস্টিকের বড়ো ক্যারিব্যাগ থাকে। কিছু বেগুন, দাগ লাগা বাঁধাকপি কিনে ফেললও। সস্তার জিনিস কেনে বলে বউ, মেয়েরা কথা শোনায়, “তুমি বড্ড কিপটে!” কিন্তু ওরা বোঝে না পয়সার কত দাম! পয়সা কি রাস্তায় পড়ে থাকে? নবর পিসি বলত, “পয়সার অসম্মান করবি না। পঞ্চাশ হাত মাটি খুঁড়েও কি চার আনা পয়সা পাবি? দরকারে কেউ টাকা দেবে? না।”
সেকথা মনে রেখেই নব জীবন চালাচ্ছে। চলুক এভাবে, খারাপ কিছু তো হচ্ছে না! হাতে পয়সা থাকলেই খরচ করতে হবে, তার কোনও মানে নেই। সবজিপাতি কিনে নব হিসেব করে দেখল, বেশ লাভ হয়েছে আজ। বেগুনে একটু পোকা থাকা মানেই তেমন কড়া সার দেওয়া নেই। কড়া সারে পোকা বাঁচতে পারত? আর কপিটা এট্টু ন্যাদামারা। তাতে কী? ও বেশ খাওয়া যাবে। বউ খিট খিট করে এসব বাজার দেখলে। নব অত দিকে কান দেয় না। আসলে কানে কম শোনে বলে সুবিধে আছে ওর। কিছু শুনে ফেললেও শুনছি না ভাব করে বেশ থাকা যায়। মেয়েরা বলেছিল কানে শোনার যন্ত্র নিতে। হিয়ারিং এইডের কথা জানে নব। কিন্তু দরকার কী? বেশ তো যাচ্ছে দিন। ক্যারিব্যাগ ঝুলিয়ে যেতে যেতে গলায় গান খেলায় নব, “এ শুদু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার আআ—”
“অ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা…”
নব চমকে উঠল। কে রে? “অ্যা অ্যা” করে কেউ ভ্যাঙাচ্ছে ওকে? কার এত সাহস? না, নবর গানের গলা ছাগলের বা পাঁঠা-খাসির মতো নয়। তাহলে এভাবে ইনসাল্ট করছে কারা? দরকার হলে ন্যাদামারা কপি দিয়েই মাথা ফাটিয়ে দেবে নব তার! নব চারপাশে কড়া চোখে তাকায়। আর তখনই ফের, “অ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা!”
নব চমকে তাকাল। একটা ম্যাটাডোর ভ্যানে বেঁধে রাখা হয়েছে দুটো খাসিকে। পাশে দাঁড়িয়ে সাদা রঙের একটা গরু। এই তিনজনের মধ্যেই কেউ একজন নবর সুরে সুর মেলাচ্ছে! হয়তো খিদে পেয়েছে, ভাবল নব। তিনজনের বর্জ্য পদার্থে ভ্যানের পেছনটা বিদঘুটে গন্ধ ছড়াচ্ছে। কী নোংরা রে বাবা! নব নাক টিপে জায়গাটা পেরিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে একবার কেন যে তাকাল কে জানে। হয়তো ম্যাটাডোর ভ্যানে চেপে ওরা কোথায় যাচ্ছে সেটা মনে মনে ভাবছিল। তাকিয়েই মনটা কেমন করে উঠল। দুটো খাসি, একটা গরু কোথায় যাচ্ছে সেটা বুঝতে কি বেশি কিছু বুদ্ধির দরকার? কোনও গরু-ছাগলের বাজার থেকে ভ্যানটা এসেছে এদের নিয়ে। সোজা কসাইখানায় নিয়ে যাওয়া হবে এদের। পশুগুলো কি সেই ভয়ের গন্ধটা পেয়েই ডেকে উঠল? নবকে কিছু বলতে চেয়েছে কি ওরা? কেন নব ভ্যানের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ওদের কেউ ডাক দিল? নবকে ডেকেছে? ধুর, এমনি ডেকেছে নিশ্চয়ই।
কিন্তু মনটা এমন হাহাকার কেন করল? নব সরকার থমকে দাঁড়াল। বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। সারাজীবনে ভাল কাজ কিছু কি করা হয়েছে? কারও জন্য এক তিল ভেবেছে নব? না তো! অথচ ছেলেবেলায় কত কাক নবর বন্ধু ছিল। নবকে দেখলে “খে-খে-খে-রে” বলে ডেকে উঠতো। পাপু নামের ছাইরঙা বেড়ালটা কত ভালোবাসত নবকে! নবর মনখারাপ হলে “ম্যাঁও ম্যাঁও” করে অস্থির হয়ে যেত। বেড়ালটা মরে গেল বাইকচাপা পড়ে। নব পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। তখন বরানগরের মামা এসে ওকে নিয়ে গিয়েছিল মন ভালো করে দেওয়ার জন্য। সব মনে পড়ে যাচ্ছে কেন? নব তাকিয়ে দেখল, সাদা গরুটা চুপ করে দাঁড়িয়েই আছে। ওর কি পায়ে ব্যথা করছে না? খাসিদুটো অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। নতুন জায়গার গন্ধ ওদের নাকে লাগছে।
একবার খর্সাং নামের এক পাহাড়ি জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিল নব সরকার। চমৎকার জায়গা। পাহাড়ের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে গিয়ে মাঝেমাঝে সাইডে সরে দাঁড়াতে হচ্ছিল। হুস-হাস গাড়ি আসছিল। তার মধ্যে এক দুটো ভ্যানও ছিল। একটা ভ্যানে দুটো লোক তিন-চারটে খাসি, ছাগল নিয়ে নেমে যাচ্ছিল। পাহাড়ের পরিবেশ থেকে নেমে যাওয়ার সময় পশুগুলো ঘাড় উঁচু করে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। কিছু চিনতে পারছিল না হয়তো। সঙ্গে ওদের ভাইবোন, মা, বাবা কেউ ছিল না বলে সবকিছু অচেনা বলে ব্যাকুল চোখে দেখছিল। নব সরকারের মনে আছে ওদের চোখের দৃষ্টি। এত বছর পরেও মনে আছে। মনে যে আছে, সেটাই মনে ছিল না!
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে উল্টোপাল্টা ভেবে সময় নষ্ট না করে এগিয়ে গেলে মেট্রো ধরে বাড়িতে পৌঁছে আরাম করা যায়। তবুও নব সরকার নড়তে পারছিল না। একধারে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কী করা উচিত, কী করতে পারে ও, কিছুই মাথায় এল না, আসছে না। আবার এখান থেকে চলে যেতেও পারছে না। কী মুশকিল বল দেখি!
দূরের একটা মসজিদ থেকে যোহরের নমাজের আওয়াজ আসছিল। একটু আগেই একট শনিমন্দিরে প্রণাম করে এসেছে নব। দুপুরে গরম বাতাস গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। সেই তাপ ক্রমে জুড়িয়ে আসছে । বিকেলের নরম রোদ বাতাসে একটু একটু মিশে যাচ্ছে। সামনেই ঈদ। তারপরেই দুর্গাপুজো। বাজার জমজমাট। ফুটপাতে কতরকমের জিনিস! জামাকাপড় থেকে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে বসেছে দোকানি। লাল গেঞ্জি পরা কালো দোকানি সবজির খোসা ছাড়ানোর ছুরি বিক্রি করছে। এরকম একটা নিয়ে গেলে বউয়ের সুবিধে হয়। চেয়ারে বসে বসেই আলুর খোসা ছাড়ানো যায়। নানা রঙের তালা, কাপড় শুকোনোর ক্লিপ, নেইল কাটার, ছাঁকনি… কী নেই! এসব দোকান দেখতে ভারি ভালো লাগে নবর। মনে হয়, সবই দরকারি। সব নিয়ে যেতে হবে। মাকড়াপাড়ার কাকিমা যেমন “লে লে বাবু”, আট আনার দোকান থেকে পুজোর সময় সেফটিপিন থেকে ন্যাপথালিন অব্দি কিনে রাখত। নবর ছেলেবেলায় জিনিসপত্রের দাম কত কম ছিল! এখন পুজোর বাজারের কথা ভাবলে বুক শুকিয়ে যায়। খাওয়াদাওয়া, কেনাকাটা… কী খরচ! মেয়েরা আবার বিরিয়ানি খাবে। উফ! মাংস খেতে কী যে ভালোবাসে ওরা!
চোখ ঘুরিয়ে ফের ভ্যানের দিকে তাকাল নব। কিছুই করার নেই। নব সরকার একটু দুঃখ দেখাতে পারে। তার বেশি কিছু করতে পারে না। আজ গরম পড়েছে খুব। তেষ্টা পাচ্ছে। একটা কুকুর চায়ের দোকানের মেঝেতে পড়ে থাকা নোংরা জল চেটেপুটে খাচ্ছে। আজ নব সরকারের মন ভারি খারাপ হয়ে গেছে। সস্তার সবজি কেনার আনন্দ আর নেই। অথচ দেখ, চিলি-চিকেন খাওয়ার সময় এসব মনে থাকে না! ভাবতেই নবর মাংস খাওয়ার লোভী মনটা বলে উঠল, আমি না খেলে যদি দুনিয়ার মুরগি বেঁচে যেত, তাহলে আর মুরগি খাব না। নব, মুরগির কথা ভাবছ, ভালো করেছ। তোমার ভাবনা তোমার নিজস্ব সম্পত্তি। অন্য মনদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল, তুমি তোমার কাজ কর না বাপু! কে কী করল না করল সেসব দেখে তোমার কী কাজ? পরীক্ষায় যখন ভালো নম্বর পেতে, তুমি মন দিয়ে পড়ে নম্বর পেতে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, তোমার কাজ তুমি করেছ। ভালো নম্বর পেয়েছ। তো এখন তোমার ভাবনা একান্তই তোমার নিজস্ব সম্পত্তি। নব অবাক হল। দুটো মনই সম্পত্তির কথা বলছে!
এত সম্পত্তি নিয়ে নব করে কী? পিসিমা বলত, মানুষের সেরা সম্পত্তি হল তার স্বভাব। সেটাই তাকে মৃত্যুর পরেও সম্পদশালী করে রাখে। মনীষীদের কথাই ভাব। কবে তাঁরা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন, তবুও আজও… ! কত মানবিক সম্পদে শক্তিশালী ছিলেন তাঁরা! মেয়েদের কতবার এসব কথা বুঝিয়েছে নব পরীক্ষার আগে। জীবনীমূলক রচনা লেখার সময় কোন কোন পয়েন্টে জোর দিতে হবে সেটা বেশ করে বুঝিয়েছে। কিন্তু নিজে কি সেকথা শিখেছে? ময়নাপাখির মতো জাস্ট আওড়ে গেছে। মনের ভেতরে সে কথাকে মোট্টে আমল দেয়নি। এত বয়স হল, আর কবে শিখবে নব সরকার?
দাঁড়িয়ে থেকে পা ধরে গেল। নব সরকার এগিয়ে যাবে কি না ভাবল। তারপর মরিয়া হয়ে ঢুকে পড়ল ভ্যান যেখানে লাগিয়ে রাখা, তার পাশের চায়ের দোকানে। ক্যাশে বসে আছে একজন। নব তার কাছে গিয়ে জানতে চায়, খুব দরকারি কথা আছে, কার সঙ্গে বলবে?
লোকটা মুখ ভর্তি পান নিয়ে ছ্যার ছ্যার করে কীসব বলল, নব তার একদানাও বুঝতে পারল না। না বুঝলেও একবার যখন আসরে নেমেছে, তখন নব সরকার পিছপা হবে না। সে আর একটু গলা বাড়াল, “একটা কথা আছে। বাইরে ভ্যানে যে গরু-ছাগলগুলো আছে, সেগুলো কার?”
লোকটা ফের ঝ্যার ঝ্যার করে কীসব বলে গেল। মুখের পান সামলাতে যদি না পারিস, তো কেনই বা পান খাস বাবা? কথাটা বলার ইচ্ছে থাকলেও বলে সময় নষ্ট করল না নব। এই লোকটা মনে হচ্ছে বাংলা ভাষা বোঝে না। হিন্দি চাই। নবর আবার হিন্দিটা তেমন খেলে না গলায়। তবুও চেষ্টায় কী না হয়? একথাও বলত পিসিমা। তো নব সরকার হিন্দির ভরসায় এগিয়ে গেল, “শুনিয়ে, বাইরে যো গরু আর ছাগল হ্যায় ভ্যানমে, কিস কা মানে কার হ্যায়?”
কথাটার কিছুটা অনুধাবন করেছে পানমুখো লোকটা। বুকে হাত দিয়ে প্রায় হাঁক পাড়ল, “হামারা হ্যায়।”
“বেচেগা? দাম কিতনা?”
“মতলব?” লোকটা কনফিউসড বলে মনে হচ্ছে। নব ইশারায় বাইরে ডেকে নিল লোকটাকে। লোকটা ক্যাশ ফেলে বিরক্ত এবং বিমূঢ় চোখে বাইরে এল, “ক্যায়া বোলা?”
নব হিন্দি বাংলা মিশিয়ে নিজের বক্তব্য জানাল। এই যে ভ্যানের ওপর একটা গরু, দুটো খাসি আছে, নব কিনতে চায়। এর জন্য কত দাম দিতে হবে? লোকটা আশ্চর্য চোখে নবকে একবার, গরু-খাসিগুলোকে একবার দেখল। পরে ব্যাপারটা ওর মতো করে বুঝে নিয়ে হাসতে শুরু করল। সে কী হাসি! ফুর-ফার করে পান ছিটকে বেরিয়ে নবর অফিসের মাড় দেওয়া শার্টের চব্বিশটা বাজিয়ে দিল। নব একলাফে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে লোকটার হাসি থামার জন্য ওয়েট করছিল। অবশেষে হাসি থামাল লোকটা, “আরে, হেস্টিংস মে যাও। বাজার উঁহা পে হ্যায়। কিতনে চাহিয়ে লেকর আও। ইয়ে ম্যায় খরিদা হু।”
নবর ভারি বিরক্ত লাগছিল। তোর এত কথা কীসের? তুই এই পশুগুলোকে কত দামে বেচবি বলে দে। তারপরে তুই যা হেস্টিংসে।
শেষ পর্যন্ত লোকটা ভেবে ভেবে নবর দিকে তাকিয়ে বলল, “তু দালাল? তো ঠিক হ্যায়, চালিশ হাজার দে দে। লে যা ইন সবকো।”
প্রথমে বুঝতে পারেনি নব সরকার। চালিশ মানে? যখন লোকটা কাগজে লিখে সংখ্যাটা দেখাল, নবর কিপটে মাথাটা বনবন করে উঠল। ক্যারিব্যাগের ভেতর থেকে পোকাধরা বেগুন আর ন্যাদামারা বাঁধাকপি খিক খিক করে হাসছিল নবর দশা দেখে। সারাজীবনে চল্লিশ হাজার টাকা জমাতে কত কষ্ট স্বীকার করতে হয়, নবর চাইতে সেটা বেশি কে জানে! নব সবজির ব্যাগটা চেপে ধরে। সম্ভব নয়। নব আবেগে ভেসে অসম্ভব কাজ করতে যাচ্ছিল। পাগল নাকি ও? গরু-ছাগল কিনতে যাচ্ছিল এত টাকা দিয়ে? মাথা নেড়ে পেছন ফেরে নব। বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ। মেয়েদের পড়াটা দেখিয়ে দিতে হয়। দেরি হলে ওরা অপেক্ষা করবে। জোরে পা চালায় নব সরকার। ভ্যানটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকায় না। মায়া বড়ো খারাপ জিনিস। আটকে ফেলে বাঁধনে। ওসব মায়াটায়া দূরে রাখ, নব সরকার। মায়া দেখিয়ে ফতুর হলে কেউ এগিয়ে আসবে হেল্প করতে? নাহ্, এসব ভাবনার কি কোনও কাজ নেই? বসে বসে নবর জন্যই কি অপেক্ষা করছিল এই মেছুয়াবাজারে? যেই না নবকে দেখেছে, অমনি হুট করে ঢুকে পড়েছে মাথায়। সংগে ওই মায়া-ফায়াও ছিল! কথায় বলে না মায়ামোহ! মায়ার জাল! মায়া কাটিয়ে ফেলা নাকি দুষ্কর।
মায়া মায়া করতে করতে নবর মায়ামাসিকে মনে পড়ে গেল। পুকুরে নেমেছিল কচুরিপানার তারার মতো ফুল তুলতে। এদিকে সাঁতার জানে না। শেষে যা হওয়ার ছিল তাই তো হল! জলের তলায় গিয়ে নিথর হয়ে শুয়ে ছিল। সিধুদা ডুবসাঁতার দিয়ে তুলে এনেছিল মায়ার বডি। সেই মায়া এখানেও। কচুরিপানার ফুলের মায়ামোহ! না বাবা, চোখকান বুজে এখান থেকে চলে যাওয়াই মঙ্গল। যাতে ওদের ফের দেখতে না হয়, তাই নব চোখ নামিয়ে ভ্যানটা পেরিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। অমনি “অ্যা অ্যা অ্যা…!”
নব সরকার পেছন ফিরে তাকাল। ভ্যানের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পশুগুলো নবর দিকেই কি তাকিয়ে আছে? নব হতভম্ব হয়ে পড়ে। ওরা কি সত্যি নবকে কিছু বলছে? আজ একমাত্র নবই পারে ওদের বাঁচাতে। নবই পারে ওদের মারতে। সবটুকু নব সরকারের হাতে? এটা বোকা বোকা ভাবনা নয়? কোনওদিকে না তাকিয়ে মন শক্ত করে চলে যাওয়াই শ্রেয়। পা বাড়াতে গিয়ে ফের থমকে পড়ে নব। চল্লিশ হাজার টাকা! মানুষের স্বভাব হল তার সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। চল্লিশ হাজার টাকা কি তার থেকেও বড়ো? পিসিমা বলত, পঞ্চাশ হাত মাটি খুঁড়ে চার আনা পয়সা মেলে না। পয়সার অসম্মান করিস না কখনও। নব কখনও পয়সার অসম্মান করেনি। কখনও নষ্ট করেনি পয়সা। বিলাসিতা করেনি। তিল তিল করে জমিয়েছে পয়সা। কোনটা বড়ো সম্পদ? তিল তিল করে জমানো টাকা? নাকি স্বভাব? একাচোরা, একঘরে, ভেজা বেড়াল নব সরকার কি চল্লিশ হাজারের থেকে কম দামি?
ফের পেছন ফেরে নব। পানমুখো লোকটা দোকানের দিকে যাচ্ছে। তাকে ডেকে ফেরাল নব। কথা পাকা করে এটিএম-এ ঢুকে গেল। দুটো কার্ড আছে। নোট বাতিলের ধামাকায় আজ কাজে লাগবে দুটো এটিএম কার্ড।
বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে মেয়েরা তাদের মায়ের সঙ্গে অপেক্ষা করছিল। নব এসে হাঁকডাক করাতে দরজা খুলে সব্বাই অবাক। এমন কি পড়শিরাও। ভিড় হয়ে গেছে নবর বাড়ির সামনে। আশ্চর্য হয়ে সবাই দেখল একটা সাদা গরু, দুটো খাসিকে একটা ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে এসেছে নব। চওড়া কাঠের তক্তা ফেলে তিনটে পশুকে নামিয়ে আনছে। বাড়ির বারান্দায় তাদের থাকার আপাতত ব্যবস্থা হয়েছে। ক্যারিব্যাগ থেকে কপি আর বেগুন বের করে ওদের খাওয়াচ্ছিল নব। নবর খিটখিটে বউকে দেখে একবার ডেকে উঠল পশুরা। নবর বউ আজ খিটখিট করতে ভুলে গেছে। নব সরকারের স্বভাবের এই মনটা সবার অচেনা কিনা। কিন্তু নব জানে, যেকোনও দিন ভালো হওয়া শুরু করা যায়।
গ্রাফিক্সঃ ইন্দ্রশেখর