সেখানে সাতরঙা রামধনুর রং ছড়িয়ে উড়ে এল দুটো মৌটুসি পাখি। দিনটা বসন্তের রোদ্দুরে উজ্জ্বল। শীতের হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা আর নেই, কিন্তু সূর্যের তেজও বেশি নয়। ওরা দু’জন। একজন পুরুষ, আর এক জন মেয়ে – দেখতে একেবারে আলাদা। পুরুষটা প্রায় কালো, কিন্তু রোদের আলো পড়লেই চোখ ঝলসানো ময়ূরকণ্ঠী রঙের বাহার! কখনও নীল, কখনও সবুজ, কখনও বা বেগনে। মেয়েটা অতো উজ্জ্বল না। পিঠের দিকে গাঢ় কালচে, পেটের দিকটা সাদাটে। ছোট্ট পাখি, আমার বুড়ো আঙুলের মতো, কিন্তু ওড়ে বিদ্যুতের বেগে।
ছোটো জংলা বাগানটায় খানিকক্ষণ ইতিউতি উড়ে বেড়ালো দুজনে। বাড়িটা একেবারেই ভাঙা, পায়রা আর চামচিকের বাসা, একটা কুকুর, আর কয়েকটা সাপের আস্তানা। বাগানের যত্ন নেবার আর কেউ নেই, কিন্তু গাছে গাছে বসন্তের ফুল হয়েছে। মৌটুসিরা ফুল থেকে মধু খেল, গাছের মগডালে বসে গলা ছেড়ে গান গাইল। তার পরে উড়ে নেমে এল মাটির কাছে। ঘন ঝোপের মধ্যে একটা জায়গা পেল যেখানে বাসা বাঁধা যায়।
কেউ সাফা করতে আসে না, তাই বাগানের জমিতে পরতে পরতে জমে আছে শীতের ঝরাপাতা, আর ভাঙা ডালপালা। বাগানে ভর্তি মাকড়শার জাল। ঠোঁটে করে তাই ছিঁড়ে এনে ওরা পাতাগুলো একটা আর একটার সঙ্গে আটকে নিল – তৈরি হল বাসা।
ছোট্ট পাখির ছোট্ট বাসা। বটুয়ার মতো দেখতে। মা মৌটুসিটা ভেতরে আরাম করে বসল শুকনো পাতা আর পায়রার ঝরা পালকের নরম বিছানায়। তিনটে ডিম পেড়ে তা দিতে শুরু করল, নিজের শরীরের গরম দিয়ে।
পাশের বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে একটা বাচ্চা ছেলে ওদের দেখছিল। সঙ্গে ওর কাকা একটা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছিল। ক্যামেরার লেন্সটা কী বিরাট! একেবারে বন্দুকের মতো! ছবি তুলতে তুলতে কাকা ভাইপোকে পাখিদের সম্বন্ধে বলছিল।
“দেখ,” বলে কাকা একটা বই খুলে ওকে ছবি দেখাল। “মৌটুসি। ইংরেজিতে বলে পার্পল সানবার্ড। কতো রং দেখেছিস? আসলে বেগুনি, কিন্তু কোনও কোনও সময়ে দেখায় কালো, কখনও বা নীল। ওই রঙীনটা পুরুষ, অন্যজন মেয়ে। খাটো লেজ, লম্বা ঠোঁট, তরোয়ালের মতো বাঁকা।”
কাকা-ভাইপোর মতো এক জোড়া কোকিলও গাছের ডালে বসে মৌটুসিদের নজর করছিল। কোকিল বেশ বড়ো পাখি। কাকের সমান প্রায়। পুরুষটা কুচকুচে কালো। মেয়েটা বাদামি, সাদার ছোপ।
কোকিল ভালো গান গায়, সে তো সবাই জানে। কোকিলের গান শোনে পাখিরাও। কিন্তু সে অন্য কারণে।
বাড়ির ভেতরে কাকাও দেখেছে কোকিল দুটো। ভাইপোকে ডেকে বলল, “দেখেছিস, কেমন বসে বসে দেখছে। কেন জানিস? ওরা নিজেরা বাসা বাঁধে না। অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। তারা বুঝতে পারে না, নিজের বাচ্চা মনে করে বড়ো করে। সাধারণত কাকের বাসায় ডিম দেয় – কাক সেই জন্য ওদের একেবারে সহ্য করতে পারে না। ডাক শুনলেই তেড়ে যায়।”
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, “কী পাজি! অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে কেন? নিজেদের বাসা বানায় না কেন?”
“ওরা ওমনিই। প্রকৃতি ওদের ওমনি করেই বানিয়েছে। আমরাও তো গাছ কেটে, জঙ্গল সাফ করে, জলাজমি ভরাট করে বাড়ি বানাই। হাজার হাজার পশুপাখি আমাদের জন্য মরে যায় যাতে আমরা বাঁচতে পারি।”
ভাইপো উত্তর শুনে চুপ করে গেল।
কোকিল সু্যোগ পেলে মৌটুসির বাসাতেও ডিম পাড়ে বইকি! এই দু’জন মৌটুসি অবশ্য সেটা জানত না। তারা এতোদিন একটা ছোট্ট বাগানে থাকত, সেখানে কোনও কোকিল ওদের বাসা অবধি পৌঁছতেই পারত না। তাই কোকিলরা যে ওদের নজর করছে, সেটা ওরা বুঝতেও পারেনি।
যেমনই বাসা বানিয়ে মা মৌটুসি ডিম পেড়ে তা দিতে বসল, ওমনি কোকিল তারস্বরে গান শুরু করল। সাধারণত এই সময়ে বাসা ছেড়ে পাখিরা কোকিলকে তাড়া করে, আর সেই সুযোগে কোকিলনী খালি বাসায় ঢুকে নিজের ডিম পেড়ে আসে।
এই দুজন মৌটুসি তো আগে কোকিলের পাল্লায় পড়েনি, তাই ওরা কোকিলকে তাড়া করতে গেলই না। মা মৌটুসি যেমন রোজ তা দেয়, তেমনই দিতে থাকল, আর বাবাটা ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতে লাগল। কোকিলনীকে পরদিন সকাল অবধি অপেক্ষা করতে হল – মা মৌটুসি সকালে উড়ে গিয়ে লাল কৃষ্ণচূড়া গাছে গিয়ে যেমনই মধু খেতে লেগেছে, ওমনি গিয়ে কোকিলনী উড়ে গিয়েছে তাদের বাসায়। ছোট্ট বাসার থেকে একটা একটা করে ডিম নিয়ে ফেলতে লেগেছে বাইরে। এইভাবেই কোকিলরা ডিম পাড়ে। অন্য পাখির বাসায় নিজের ডিমের জায়গা বানায়। কিন্তু তিনটে ডিমই ফেলতে পারল না। আড়চোখে দেখল মা মৌটুসির মধু খাওয়া শেষ প্রায়, তাই দুটো ডিম ফেলে একটা রেখেই তার পাশে নিজের ডিম পেড়ে চলে গেল।
মা মৌটুসি এসে দেখে তার ছোট্ট একটা ডিমের পাশে মস্তো একটা ডিম। অবাক হয়ে বাবা মৌটুসিকে জিজ্ঞেস করল, “এটা আমাদের ডিম?”
বাবা মৌটুসি বলল, “আরে, আমাদের বাসা, আবার কার ডিম হবে?”
মা মৌটুসি বলল, “তুমি বলছ? কিন্তু এতো বড়ো ডিম আমি পাড়তে পারব?”
বাবা বলল, “বাসায় আছে যখন, তখন তা তো দিতেই হবে।” বলে উড়ে গেল।
অনেক কষ্টে মা মৌটুসি বিশাল ডিমটার ওপর তা দিতে বসল। কোকিলের ডিমটা ওর চেয়েও বড়ো। বাসায় আর জায়গাই বাকি নেই! নিজের ছোট্ট ডিমটা তা দেবে কী করে? বার বার এক বার বড়ো ডিমের ওপরে বসে, তার পরে ছোটো ডিমের ওপরে – এমনি করে তা দিতে থাকল।
গাছের নিচে, মাটিতে দুটো ভাঙা ডিমের চারপাশে হাজার পিঁপড়ের মেলা।
পাশের বাড়ির ছেলেটা বাইনোকুলার দিয়ে দেখছিল। কাকাও ছবি তোলা শেষ করে ভাইপোকে বুঝিয়ে দিল, অতো বড়ো হওয়া সত্ত্বেও পাখিরা বুঝতে পারে না, যে ডিমটা ওদের না। – ছোটো ছোটো পাখিও বিরাট বিরাট কোকিলছানা বড়ো করে নিজের বাচ্চা মনে করে।
*
কিছু দিনের মধ্যেই দুটো ডিম ফুটেই বাচ্চা বেরোলো। মৌটুসির বাচ্চাটা পুঁচকে, কোকিলের ছানাটা বিশাল। জন্মাবার কিছুদিনের মধ্যেই কোকিলছানাটা মৌটুসির বাচ্চাটাকে ঠেলে ঠেলে বাসা থেকে নিচে ফেলে দেবার চেষ্টা করতে শুরু করল। ওদের মায়েরা যেমন ডিম ফেলে দেয়, কোকিলছানারাও বাসায় অন্য ডিম বা বাচ্চা থাকলে তাদের বাইরে ফেলে দেয়, যাতে তারা মা-বাবার আনা সমস্ত খাবারটাই একা পায়।
কিন্তু মা মৌটুসি দেখে ফেলেছে! নিজের বাচ্চা মনে করে কোকিলের বাচ্চাটাকে দিয়েছে এক ধমক, “রানিচরিকে ধাক্কা দিচ্ছ কেন? ও তোমার বোন না?”
বাবা মৌটুসি জানতে চাইল, “ছোটোটার নাম রানিচরি?”
মা মৌটুসি একটু গর্বের সঙ্গে বলল, “হ্যাঁ। আমার রানি পাখি।”
বাবা বলল, “ওই ধুমসোটার নাম কী?”
মা বকে বলল, “এমন বিশ্রী করে বলছ কেন? ওর খারাপ লাগবে না?”
বাবাকে বকা সত্ত্বেও মা মৌটুসি কিন্তু বড়ো ছানাটার কোনও নাম দিল না।
বাবা বলল, “কালিচরি নাম দাও। বাবাঃ, অমানিশার মতো কালো!”
নামটা রয়ে গেল।
মৌটুসি মা দু’দিনেই বুঝে গেল যে কালিচরি খুব হ্যাংলা। মা বাবা খাবার নিয়ে আসলেই গলা বাড়িয়ে খেতে চায় – বাবা মৌটুসি বোঝে না, বার বার খালি ওকেই খাইয়ে দেয়।
মা কিন্তু অতো বোকা না। বলে, “কালী, নামো, নামো… এই মাত্র বাবা তোমাকে দু’বার খাইয়ে গেল। আমি দেখেছি। রানিকে খেতে দাও।”
বাবা মৌটুসি বাচ্চাদের বকতে পারে না। গাছের ডালে মাথা নিচু করে বসে থাকে। নিজের বাসা থেকে মা কাক গলা বার করে মৌটুসিদের বাসা দেখে বলল, “ও, তোমাদের বাসায় দেখি কোকিলের বাচ্চা!”
বাবা মৌটুসি রেগে বলল, “কী? কী বললে?”
বাবা কাক এসে উড়ে বসল পাশের ডালে। বলল, “ওই বিরাট বাচ্চাটা যে তোমাদের না তোমরা বুঝতে পারছ না? তোমাদের চেয়েও কতো বড়ো!”
মৌটুসিরা ভালো করে দেখল।
বাবা বলল, “জানো, কাক বোধহয় ঠিকই বলেছে।”
মা মৌটুসিও চিন্তিত। বলল, “হুঁ।”
মা কাক বলল, “আমারও মনে হচ্ছে আমার ডিমগুলোর মধ্যে একটা কোকিলের ডিম ছিল। কিন্তু আমার ডিম আর কোকিলের ডিম এতোই একরকম, যে আমরা আলাদা করতে পারি না। এই বাচ্চাগুলোর একটা কোকিল। আমরা চিনতে পারি না। সবাইকেই খাওয়াতে হয়।”
রাগ করে বাবা কাক বলল, “আর কোকিলের বাচ্চারা এতোই পাজি, যে আমাদের ডিম আর বাচ্চাগুলো বাসা থেকে ঠেলে ঠেলে ফেলে দেয় – শেষ অবধি আমরা কেবল মাত্র একটা কোকিলের বাচ্চাই বড়ো করি!”
মৌটুসিরা আবার তাকিয়ে দেখল, একটা বিশাল বাচ্চার পাশে ওদের ছোট্ট পুঁচকে বাচ্চা – ভয়ে বুক কেঁপে উঠল ওদের।
বাবা কাক বলল, “একটাই রাস্তা আছে। ঠেলে ঠেলে ওই বিরাট বাচ্চাটাকে ফেলে দাও। আমাদেরও তাই করা উচিত, কিন্তু আমরা তো বুঝতে পারি না। তোমরা তো বুঝছ।”
মা কাক রেগে বলল, “তুমিও যেমন! ওরা ওইটুকু পাখি – কী করে ওই বিরাট বাচ্চাটাকে ফেলে দেবে?” বলে মৌটুসিদের বলল, “তবে খাওয়াতে হবে না আর। খাওয়ানো বন্ধ করলেই তো মরে যাবে ও।”
সে দিন সূর্য ডোবার পরে মৌটুসিরা রাতের অন্ধকারে ব্যাপারটা আলোচনা করতে বসল। বাবা মৌটুসি বলল, “বাবা-কাক ঠিক বলেছে। ওকে বাইরে ফেলা আমাদের সাধ্য নয়। কিন্তু মা কাকের বুদ্ধিটা তোমার কেমন লাগছে?”
মা মৌটুসি বলল, “একটা বাচ্চাকে না খাইয়ে মেরে ফেলব? ও যে আমাদের বাসায় জন্মেছে, সেটা কি ওর দোষ?”
বাবা বলল, “ঠিক। কিন্তু এখন থেকে ওকে সাবধানে রাখতে হবে।”
মা বলল, “হ্যাঁ। হয় তুমি নয় আমি এখন থেকে বাসায় থাকব।”
দিন কাটে। মানুষের বাচ্চার চেয়ে পাখির বাচ্চা অনেক তাড়াতাড়ি বড়ো হয় – এক দিন কাকের বাসা থেকে কুহু কুহু করে সুরেলা ডাক ভেসে এল। রেগে আগুন কাক মা-বাবাকে ফেলে একটা কুচকুচে কালো কোকিল উড়ে বেরিয়ে গেল।
রানিচরিও বাসা ছাড়ার জন্য তৈরি। ওর বাচ্চাবয়সের পালক খসে গেছে। ওর মায়ের মতো ওর পিঠ গাঢ় ছাইছাই আর পেট সাদাটে হয়ে এসেছে। আজকাল ও প্রায়ই বাসার ধারে বসে ডানা ঝাপটায়। কিন্তু এখনও উড়তে পারে না।
কালিচরিই করল কাণ্ডটা। একদিন রানিচরি বাসার ধারে এসে ডানা ঝাপটে পাশের গাছের ডালে উড়ে যাবার চেষ্টা করছে চারপাশে গোল হয়ে উড়ে উড়ে মা-বাবা ওকে উৎসাহ দিচ্ছে ডেকে ডেকে।
হঠাৎ, কথা নেই বার্তা নেই, কালিচরি তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বেরিয়ে এল। বিরাট পাখি এখন কালিচরি। গাঢ় বাদামি রং, তাতে সাদা ছোপ – দেখেই চেনা যায় – মাদি কোকিল। এখন সে চলে যেতে চায়। ওইটুকু বাসায় আর ধরছে না। বাসার ধারে লাফিয়ে উঠে দু’বার ডানা ঝাপটেই উড়ে গেল কালিচরি।
রানিচরি ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেছে। গাছের ডালে পাতায় ধাক্কা খেতে খেতে পড়তে লেগেছে নিচে। প্রাণপনে ডানা ঝাপটে উড়তে চেষ্টা করছে, কিন্তু পাতা আর ডালের ভীড়ে ডানা মেলতে পারছে না।
তারস্বরে চিৎকার করে রানিচরিকে ডাকতে ডাকতে উড়ে বেড়াচ্ছে মা আর বাবা মৌটুসি।
বাবা কাক মা কাকের দিকে ফিরে বলল, “বলেছিলাম, খেতে দিস না, মেরে ফেল কোকিলটাকে।”
রানিচরি পড়তে পড়তে গাছের শেষ ডালের নিচে এসেই ডানা মেলতে পারল। যতো জোরে পারে ডানা ঝাপটাতেই দেখল, আরে! উড়ছে! উঠতে লেগেছে! আস্তে আস্তে, ডালপালা-পাতার মাঝে ফাঁক খুঁজে খুঁজে রানিচরি উঠতে থাকল, আর দেখতে দেখতে গাছের মাথা ছাড়িয়ে আকাশে বেরিয়ে দেখল মা বাবা তখনও ওকে খুঁজছে নিচে।
ডেকে বলল, “এই যে আমি!”
ওরা উড়ে এল। তিনজনে গিয়ে বসল গাছের ডালে। তার পরে কালিচরিকে বকার জন্য মা-বাবা ফিরে দেখে, কই, কোথায় কালিচরি! ভাঙা বাসা পড়ে আছে, কালীর দেখা নেই কোথাও। উড়ে গেছে। এর পর ও-ও একদিন ফিরে আসবে, অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়তে।
বাবা কাক বলল, “বাপরে! নাটক দেখলাম বটে!”
*
জানালা থেকে কাকা ভাইপো দেখল মৌটুসিরা উড়ে চলে গেল নীল আকাশে।
কাকা বলল, “ব্যাস! এ বছরের মতো হয়ে গেল।” বলে ক্যামেরা নিয়ে গেল কম্পিউটারে – ছবি কেমন হয়েছে দেখার জন্য। “আবার আসবে ওরা, আগামী বছর।”
গ্রাফিক্স্- ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে