গল্প হাইজ্যাক কাণ্ড সহেলী চট্টোপাধ্যায় শরৎ ২০১৭

সহেলীর আরো গল্প  জন্মান্তর রহস্য  ভাই আর বোনের গল্প

বাসটা বেশ জোরেই ছুটছে। পিকনিক সেরে আমরা ফিরছি। সারাদিন খুব ধকল গেছে। বাসের ভেতর গান বাজছে ‘ম্যায় নাগিন নাগিন’। সেজজেঠু ভাবছে, ছ্যা ছ্যা, গানের কি ছিরি! দেশটা অপসংস্কৃতিতে একদম ডুবে গেল। আর তো সহ্য হয় না। আমরা মানে, আমি, ইন্দুদি, বিন্দুদি আলোচনা করছি আজকের পিকনিকের ব্যাপারে। সামনের সিটে মেজদা বসেছে জানালার ধারে। জানলার কাচ তুলে রেখেছে। হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। মেজদার পাশে বড়দা মাঙ্কি ক্যাপ পরে উঁ উঁ করে কাঁপছে। কয়েকবার বলেছে, “লাল্টু, প্লিজ জানালাটা বন্ধ কর। তোর ঠাণ্ডা লাগছে না?”

মেজদা জানালা দিয়ে রাস্তার ফটো তুলতে তুলতে উত্তর দিয়েছে, “এ আর এমন কী! আলাস্কায় যখন ছিলাম তখন এর চেয়েও বেশি ঠাণ্ডা পেয়েছি। এই শীতে আমার আর কিচ্ছু যায় আসে না।”

“কিন্তু আমি তো আর আলাস্কায় থাকিনি, তাই এতেই আমার কষ্ট হয়।”

“কষ্ট করতে শেখো, দাদা। আর না হলে তুমি অন্য কোথাও গিয়ে বসো। আমার গরম লাগছে। জানালা বন্ধ করলে আর টিকতে পারব না।”

আমি সবার মনের কথা বুঝতে পারি। সবসময় পারি বললে মিথ্যা বলা হবে। কখনও কখনও পারি। আসলে অনুমান করে নিই। যেমন এখন মেজদা মনে মনে ভাবছে, আমার পেছনেই গেঁড়ি-গুগলিগুলো বসেছে। এদের মতলব মোটেই ভালো নয়। আমাকে সাবধানে থাকতে হবে। গেঁড়ি-গুগলি মানে আমি, ইন্দুদি, বিন্দুদি, আমাদের সাথে কিট্টু আছে। কিট্টু আমাদের টিয়াপাখি যাকে আমরা খাঁচায় পোরার কথা ভাবতে পারি না। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। এখন ও ইন্দুদির কাঁধে। আমরা সবাই কাজিনের চেয়ে বেশি, আর কোনও পরিচয় আমাদের নেই। সেজো জেঠু আমাদের কাজিন নয় অবশ্য। কারোর সেজোজেঠু, কারোর সেজোকাকা, কারোর বাবা। বড়দা, মেজদা, ছোড়দা সবার নিজস্ব জগত আছে। বড়দার কেকের দোকান, মেজদা বৈজ্ঞানিক, ছোড়দা সাংবাদিক। বাকিরা কলেজে। আমি, ইন্দুদি, বিন্দুদি আর বিট্টু স্কুলে।

বড়দা মনে মনে ভাবতে লাগল, এই মেজোভাইয়ের জন্য আমার জীবন না চলে যায়। আমাদের ঠিক আরেক পাশে বাপ্পাদা, তাতাইদা পাপাইদা। বাপ্পাদা ভুরু কুঁচকে ভাবছে, এই একটা লোকের জন্য পুরো টিমের নিউমোনিয়া হয়ে যাবে। তাতাইদা, পাপাইদা ভুরুও কুঁচকে তাকিয়ে আছে মেজদার দিকে। কিন্তু যতই যাই হোক না কেন, মেজদা জানালা বন্ধ করবে না। গরমের ধাত খুব বেশি।

ছোড়দা এসে বলল, “জানালাটা বন্ধ কর মেজদা। সবার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। তোমার গরম লাগলে তুমি বাসের ছাদে গিয়ে বসো। মনের সুখে হাওয়া খেতে পারবে, ছবিও তুলতে পারবে।”

কিট্টু ট্যাঁ ট্যাঁ করে বলল, “মেজদা দুষ্টু লোক। দুষ্টু লোক।”

কিট্টুর সাথে মেজদার ঝগড়া লেগেই থাকে। এ আর ঠিক হবার নয়। কিট্টু কথা না বলে থাকতে পারে না। আর কিট্টুর গলার আওয়াজে মেজদার মাথার মধ্যে কষ্ট হয়। আচ্ছা, মেজদাকে একটা ম্যাকাওপাখি কিনে দিলে কেমন হবে!

“তবে রে বজ্জাত পাখি! আমি দুষ্টু লোক! এই নে।” বলেই নিজের আঙুল দিয়ে বেশ করে কিট্টুর মাথায় খোঁচা মারল।

ছোড়দা রেগে গেল, “তুমি আমাদের ছোটোভাইয়ের গায়ে হাত তুললে!”

“মোটেই হাত তুলিনি, আঙুল তুলেছি শুধু।”

“তাই বা কেন তুলবে?”

“ওর একটু সহবত শেখা দরকার। আজ তোর জন্যই ওর এই অবস্থা। বড়োদের সম্মান করতে শেখেনি।”

বড়দা বলল, “তুই ওকে মারলি কেন লাল্টু? আমিও তো খুব বকি, কিন্তু মারি না কখনওই।”

ছোড়দা, “হ্যাঁ। ছোটদের মারা খুব খারাপ। দুষ্টু মানে মোটেই খারাপ নয়।”

মেজদা নিজের দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ, তা কী আর! তোর কাছে এবার আমায় শব্দার্থ শিখতে হবে।”

ছোড়দা এবার উপেন্দ্রকিশোর থেকে সুকুমার রায়ের প্রসঙ্গে চলে আসে। দুষ্টু শব্দটাকে এঁরা কত সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন, সেটা বোঝাবার চেষ্টা করে। এখন আর দুষ্টু মানে মন্দ নয়। দুষ্টু মানে মিষ্টি, কিউট কিছু।

মেজদা ছোড়দার কথা কিছুতেই মানছে না। কিট্টু মনখারাপ করে ইন্দুদির কাঁধে বসে আছে।

হঠাৎ বাসটা ব্রেক কষল জোরে। ছোড়দা দাঁড়িয়ে ছিল, হুড়মুড় করে পড়ে গেল বড়দার ওপর। বড়দা চেঁচিয়ে উঠল, “গেছি রে!”

আমার মাথাটা জোরে ঠুকে গেল সামনের সিটে। নাকে খুব লাগল। সবাই হইহই করে উঠল, কী ব্যাপার? মেজদা চিৎকার করে উঠল, “যাহ্‌, আমার ক্যামেরা!”

বড়দা, “ও আপদ যাওয়াই ভালো।”

“ইস! প্যারিসের ফুটপাথ থেকে কত দরদাম করে কিনেছি!”

এদিকে বাসের দরজা খুলে ঢুকে পড়েছে চারটে অল্পবয়সী ছেলে। মুখ বাঁধা, হাতে রিভলবার।

“সেরেছে, তাহলে বাস হাইজ্যাক হল!” ইন্দুদি আমার কানে কানে বলল।

চারটে ছেলের মধ্যে একজনের মাথা ন্যাড়া। সেই দলপতি মনে হল। হাতের পিস্তল নাচিয়ে বলল, “যে যেখানে চুপ করে বসে থাকুন। চালাকির চেষ্টা করলে ফল কিন্তু ভালো হবে না।”

সেজজেঠু বলল, “আমরা চুপ করেই বসে আছি। তোমরা কারা বাসের মধ্যে উঠেছ হাতে পিস্তল নিয়ে? এখন তোমাদের পড়াশোনা করার সময়। যাও, বাড়ি গিয়ে পড়তে বসো।”

“চুপ করে বসুন তো! আর পড়াশোনা করার কথা আমাদের বলবেন না। এই যে বাস হাইজ্যাক করলাম এটাই আমাদের পড়াশোনা। এটা আমাদের ফাইন্যাল পরীক্ষা। যদি শেষপর্যন্ত ঠিকভাবে উতরে যেতে পারি তাহলে স্টার পাব।”

“ভেরি গুড। যেকোনও কাজেই গভীর অধ্যাবসায় থাকা চাই।”

পাশের একজন সঙ্গী দলপতিকে থামিয়ে দিল বলল, “এত কথা বলবে না। কথা বেশি বললে কাজ পণ্ড হয়ে যায়।”

“চুপ কর। বলি, সর্দার কে? তুই না আমি? গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল!” বলল সর্দার।

কানে দুল পরা একটা ঝাঁকড়া চুলের ছেলে হাতের পিস্তল উঁচিয়ে বলল, “যার কাছে যা যা দামি জিনিস আছে সব এই থলেতে ফেলতে শুরু কর।”

সর্দার রেগে গিয়ে বলল, “আমি নির্দেশ দেব আগে, তারপর অ্যাকশন শুরু হবে। তোদের দেখছি তর সইছে না। এত তাড়াহুড়ো করলে কিছু হয়? সবুরে মেওয়া ফলে।”

“শুভ কাজে দেরি করতে নেই।”

“বেশ। এই ন্যাড়া, থলেটা বার কর। অ্যাকশন শুরু কর। মোবাইলগুলো দেবেন, আর বোনেরা গয়নাগুলো দেবেন এই গরিব ভাইদের।”

“থলেটা তো তোমার নেবার কথা ছিল! আমাদের বলনি তো!” ন্যাড়া উত্তর দিল।

“সব কি তোমাদের বলে বলে করাতে হবে? জান না, ডাকাতির সময় এগুলো কাজে লাগে? সব অপদার্থের দল!”

“গালমন্দ করবে না বলে দিচ্ছি।”

“হ্যাঁ, তোমাদের পুজো করব! যতসব! আপনারা বসে আছেন যে! এক এক করে এসে সব দিয়ে যান। কারও কাছে বড়ো প্লাস্টিক ব্যাগ হবে?”

বড়দা হেসে উঠল। সর্দার খুব রাগী চোখে তাকাল, “হাসছেন যে বড়ো?”

“হা হা! একটা ব্যাগও নিয়ে বেরয়নি!”

“শুনছেন না, এটা আমাদের প্রথম কেস! একটু আধটু ভুল হতেই পারে।”

মেজদা বলল, “ইস! পুরো ইউরোপে এরকম কান্ড কখনও দেখিনি। আমাদের দেশের ডাকাতরা দেখছি খুবই অনুন্নত! পিস্তলগুলোও বেশ সস্তা। আরে বাবা, ঝাঁ ঝাঁ করে গুলি বেরুবে তবে না লোকে ভয় পাবে! অ্যাকশনে নেমেই দুটো-চারটেকে আগে খতম করতে হয়। তবে না লোকে ডাকাত বলে মানবে!”

“আমাদের অত পয়সা কোথায়? তার ওপর নোট বাতিলের জেরে আরও কাহিল। আপনি আমাদের টিচার হবেন? আমাদের সঙ্গে অ্যাকশনে নামবেন।” সর্দার বলল।

ছোড়দা বলল, “মেজদা, তুমি দয়া করে চুপ কর।” কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি বিদেশে ছিলে সেটা একদম বলবে না। তাহলে তোমায় ধরে নিয়ে যাবে।”

“এত সোজা নাকি! মেরেই তক্তা করে দেব।” হাত ছাড়িয়ে এমনভাবে বলল যে ছোড়দার নাকে মেজদার হাত লেগে গেল। ছোড়দা ‘আ আ’ করে উঠল।

বড়দা বলল, “নিজেরদের লোককে জখম না করে বরং ডাকাতগুলোকে জখম কর।”

সেজজেঠু, ‘সে গুড়ে বালি। সবক’টা আহাম্মক। মারপিটও করতে জানে না।’ বলল না অবশ্য ভাবছে।

“কী এত ভাবছেন সবাই? এই ব্যাঁকা, চট করে সবার মোবাইলগুলো কেড়ে নে তো। পুলিশে ফোন করে দিলেই হয়ে গেল!”

“বৃথাই চিন্তা করছেন। এখানে টাওয়ার নেই।” বড়দা বলল।

“তাহলে তো বেশ ভালো। বোনেরা কানে হাতে সব ইমিটেশান পরে এসেছ? খুব বাজে অভ্যাস। সোনা পরা অভ্যাস করতে হয়। এইসব বাজে জিনিসে হাতে গলায় র‍্যাশ বেরোয়। তারপর সেই র‍্যাশ সারাতে অনেক ক্যাশ বেরিয়ে যায়।”

ইন্দুদি দাঁড়িয়ে বলল, “কে বলেছে আমরা ইমিটেশান পরে এসেছি? আমরা সবাই সোনার চেনই পরে আছি। চ্যাটার্জি বাড়ির মেয়েরা কখনও নকল গয়না পরে না।”

সবাই গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রইল ইন্দুদির দিকে।

সর্দার বলল, “ব্রাভো, এই তো চাই। বেশ বেশ, তাহলে আর দেরি করো না তোমরা। আপনাদের কাছে বড়ো একটা প্লাস্টিক ব্যাগ হবে? এই এত জিনিস নিয়ে যাই কী করে?”

পাপাইদাদা হঠাৎ ‘ও ও’ করে কাঁদতে শুরু করল। কী হল, কী হল করে উঠল সবাই। বলল, “খুব পেট ব্যাথা করছে। উঁ উঁ উঁ।”

হজমের গোলমাল নির্ঘাত। পাপাইদাকে জল খাওয়ানো হল। মাথায় হাওয়া দেওয়া হল। সবাই ঘিরে ধরে বসে রইল। সর্দার বলল, “আমার কাছে ভালো একটা ওষুধ আছে পেট ব্যাথার।”

“আর দেরি না করে ছেলেটাকে খাইয়ে দাও।” ছোড়দা বলল।

“চুপ কর তো। যা হোক একটা খাইয়ে দিলেই হল? ওরা কী ডাক্তার?” মেজদা বলল।

“তাহলে এখন তুমিই একটা উপায় বার করো।”

“উপায় থাকলে কি বার করতাম না! এই বদমাশ ডাকাতগুলো এসেই সব নষ্ট করে দিল। কতক্ষণ ধরে আটকে রেখেছে!”

“মারপিট করতে পারছ না? খুব তো চেহারা করেছ পালোয়ানের মতো!”

“তুই পারছিস না? অন্যকে বলার আগে নিজে কিছু করে দেখা। বদমাশ ছেলে কোথাকার!”

দু’জনে হাত মুঠো করে তর্কাতর্কি শুরু করল। সর্দার পকেট থেকে একটা শিশি বার করে একটুখানি তরল পাপাইদাকে খাইয়ে দিল। বাপ্পাদাদা বলল, “ছেলেটাকে যেন প্রাণে মেরোনি!”

“আরে না না। খুব ভালো ওষুধ। আমরা সবসময় ব্যাগে রেখে দিই।”

মেজদা চিৎকার করে উঠল, “যা যা, মেরে ফেলল, খুন করে ফেলল।”

“চুপ করো। কাজের কাজ কিছু পারে না আবার চিৎকার করছে।” ছোড়দা বলল।

বড়দা বলল, “সর্দার, এই লোকদুটোকে আপনারা নামিয়ে নিয়ে যান। আপনার দলে দুটো লোক বাড়বে।”

সেজোজেঠু ভাবছে, ‘ডাকাত সর্দার এত বোকা নয়।’

সর্দার, “ভালো বুদ্ধি দিয়েছেন। তবে দু’জনকে একই সঙ্গে কিডন্যাপ করা যাবে না।”

মেজদা হাত তুলে দাঁড়িয়ে, “আমাকে করুন। আমাকে করুন। আমি অনেকবার বিদেশ ঘুরে এসেছি। তাছাড়া আমি একজন বৈজ্ঞানিক। আমার আবিষ্কার আপনাদের কাজে লাগতে পারে।”

ছোড়দা, “বিদেশ আমিও অনেকবার ঘুরে এসেছি। তাই কিডন্যাপিং করতে হলে আমাকেই আগে করা উচিত।”

মেজদা হাত মুঠো করে, “খবরদার! আমি বড়ো, তাই প্রথম সুযোগ আমাকে দেওয়া উচিত।”

বড়দা, “কিডন্যাপিংয়ের সাথে বিদেশ যাওয়ার কী সম্পর্ক? আমি সবার বড়ো, তাই প্রথম সুযোগ আমাকে দিতে হবে। বিদেশ যাইনি বলে কি মানুষ নই? আমার দোকান আছে কেক-বিস্কুটের।”

“বেশ, আপনি অ্যাড্রেসটা দিয়ে যাবেন, আমরা একদিন গিয়ে ডাকাতি করে আসব।”

সেজোজেঠু, “সবাই চুপ কর। প্রথম সুযোগ আমার হবে। আমি এদের গার্জেন। আমাকে আগে ধরে নিয়ে চল।”

“আপনি বড্ড ধমক দেন। আপনাকে তো নেওয়াই যাবে না।”

ইন্দুদি, “আমাদের একটা চান্স দিতে হবে। অ্যাডভেঞ্চারের এরা ছাই বোঝে।”

বিন্দুদি, “হ্যাঁ, সন্তুর মতো আমরাও পালাব, তোমরা যেখানেই আটকে রাখ না কেন। আমাদের ক’দিন স্কুলে যেতে হবে না।”

সর্দার, “সন্তু আবার কে?”

“সে কি দাদা, তুমি কাকাবাবু আর সন্তুর নাম শোনোনি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সেই ভাইজ্যাকে গিয়ে দু’জনকে হাইজ্যাক করা হয়েছিল ওই গল্পটাই পড়েছি। দারুণ গল্প। ‘সন্তু কোথায়, কাকাবাবু কোথায়’।”

“এরপর বাকি গল্পগুলোও পড়ে নিও।”

কিট্টুকে দেখে সর্দার জিজ্ঞাসা করল, “এর নাম কী? ও বুঝি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে?”

কিট্টু বলল, “আমার নাম কিট্টু। আমার নাম কিট্টু। ট্যাঁ ট্যাঁ। আমার নাম কিট্টু।”

“শুনতে পেয়েছি। আমি তো আর কালা নই। আমারও এরকম একটা পাখি ছিল। ওর নাম ছিল পিকু।” সর্দার কিট্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

মেজদা, “কিট্টুকে নিয়ে চলে যান আপনারা। আমরা কিছু বলব না। ওকে পিকু বলে ডাকবেন। আমাদের তরফ থেকে আপনাদের একটা ছোট্ট উপহার।”

ছোড়দা, “হ্যাঁ, মামার বাড়ির আবদার!”

ইন্দুদি কিট্টুকে জড়িয়ে ধরল।

কিট্টু, “মেজদা দুষ্টু লোক। পেটুক কোথাকার!”

সর্দার, “বাবা রে! আমরা কারা? কী করতে যেন এই বাসে উঠেছিলাম? কিছুই মনে পড়ছে না। মাথাটা বন বন করে ঘুরছে। ন্যাড়া, ব্যাঁকা, তোদের কিছু মনে পড়ছে?”

“না সর্দার, একদম উত্তমকুমারের হারানো সুরের মতো অবস্থা। আমরা ছিনতাই করতে এসেছিলাম না?”

“থাক, আর ছিনতাই করে কাজ নেই। এইসব আমাদের দ্বারা হবে না। চল, এবার বাড়ি যাই।”

সেজোজেঠু, “তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া কোরো।”

“ও জিনিস একদম ধাতে সয় না, জ্যাঠামশাই। আপনার মতো কেউ থাকলে আমরাও হয়তো লেখাপড়া করতাম মন দিয়ে।”

“তোমাদের সঙ্গে বুঝি বড়ো কেউ থাকে না?”

“আমরা একটা অরফ্যানে থাকতাম। ভাল্লাগে না, তাই চলে এসেছি। এখন চলন্ত বাস থামিয়ে ছিনতাই কী করে করতে হয় তার ওপর কোর্স করছি।”

“আহা। তোমরা আমাদের বাড়ি যাবে। এইসব জঘন্য কোর্স করে লাভ নেই। এখন ওই অরফ্যানেজেই ফিরে যাও, কেমন! ঠাকুরের ধ্যান করবে। সকাল-সন্ধে সাঁইবাবার ভজন গাইবে। ঠিক মন বসে যাবে। আমাদের বাড়ি আসবে কিন্তু।”

সেজোজেঠু একটা কাগজে নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর, পথনির্দেশ সব লিখে দিল। বড়দা নিজের দোকানের ঠিকানা দিল। দেখা করার জন্য বারবার করে বলে দিল।

পাপাইদা চোখ মেলে তাকিয়েছে। সর্দারের ওষুধে বেশ কাজ দিয়েছে। ‘হুর্‌ রে’ করে উঠল বাসের সবাই।

আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হঠাৎ পুলিশের জীপের সাইরেন বেজে উঠল। সর্দার বলল, “অনেক রাত হয়ে গেল। আমরা এবার আসি।”

“কেন, আরেকটু বসে যান।” বিট্টু বলল।

“না না, আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়। তোমরা সবাই খুব ভালো থেকো। একসাথে থেকো সবাই।”

টা টা করতে করতে সব ঝুপ-ঝাপ করে নেমে পড়ল বাসের দরজা খুলে। বাপ্পাদা বলল, “যাহ্‌, ডাকাতি করতে এসে কিছু না নিয়েই চলে গেল!”

“কিন্তু পুলিশের জীপের সাইরেন বাজল কী করে?” তাতাইদা জিজ্ঞাসা করল।

বিট্টু পকেট থেকে মোবাইল বার করে বলল, “এটা একটা অ্যাপস। পুলিশের জীপের সাইরেন শুধু নয়, ইচ্ছে করলে দমকলের ঘণ্টি, অ্যাম্বুলেন্সের ঘণ্টি, কারখানার সাইরেন সব বাজাতে পারি।”

“তবে ছেলেগুলো বেশ ভালো। সাইরেনটা না বাজালেই পারতিস।”

“কিন্তু খুব বোকা! আমি ইচ্ছা করে বাজাইনি। হাত লেগে বেজে গেছে। ভালোই হয়েছে একদিকে। এরা তো কিছুতেই ছাড়ছিল না আমাদের।”

“ভালো মানুষরা বোকাই হয়।”

বাস আবার স্টার্ট নিল। সবাই হাততালি দিল। খালি বৈজ্ঞানিক মেজদা মনখারাপ করে বসে রইল। মনখারাপ হবে না কেন, সন্দেশের বাক্সটা যে সর্দারকে দিয়ে দিয়েছে! একেবারে খালিহাতে সর্দার চলে যাবে তা তো হতে দেওয়া যায় না।

ছবিঃ মৌসুমী

  জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস একত্রে 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s