গল্প-আব্বুলিশ সিদ্ধার্থ সিংহ শীত ২০১৬

golpoabbulishমেঝের উপরে শতরঞ্চি পাতা। তার উপরে গোল করে বসে চোর পুলিশ খেলছে চার বন্ধু। তাদের একজন, দু’হাতের মুঠোয় ঝাঁকিয়ে চার ভাঁজ করা কাগজের টুকরোগুলো ছড়িয়ে দিতেই, ওরা প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিল এক একটা কাগজ। আর, কেউ যাতে দেখতে না পায়, প্রত্যেকেই প্রত্যেককে আড়াল করে খুলতে লাগল সেই কাগজের ভাঁজ। যেই একজন দেখল, তার কাগজে বড় বড় হরফে লেখা- চোর। অমনি মুহূর্তের মধ্যে সূর্য উধাও। কিচিরমিচির করতে করতে ঝাঁক ঝাঁক পাখি দল বেঁধে ফিরতে লাগত বাসায়। একটা বাড়ির উল্টো দিকে অন্ধকারের মধ্যে বসে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করতে লাগল সে- কখন ওই বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায়।

তার পাশের জন চুপি চুপি কাগজটা খুলে যখন দেখল, তার কাগজের টুকরোটায় লেখা- ডাকাত। অমনি তার সঙ্গে জুটে গেল ষণ্ডামার্কা কতগুলো ছেলে এবং বুক চিতিয়ে একটা ব্যাঙ্কে ঢুকে পড়ল তারা। সোজা গিয়ে হাজির হল ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের সামনে। তার মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে সে বলল, চাবিটা দে।

তার উল্টো দিকে বসেছিলেন যিনি, তিনি কাগজটা খুলে যখনই দেখলেন, তাতে লেখা রয়েছে- মন্ত্রী। অমনি টান টান করে শতরঞ্চির উপরে সেই কাগজটা রাখলেন তিনি। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ল কতগুলো দেহরক্ষী। গাড়ির সামনে হুটার বাজিয়ে ছুটতে লাগল এস্কর্ট ভ্যান। মুখের সামনে জড়ো হল হাজার একটা টিভি চ্যানেলের বুম। এ জানতে চায় ওটা, সে জানতে চায় সেটা।

“আপনি কি জানেন গোটা দেশ এখন চোরে চোরে ছেয়ে গেছে?”

“আপনার কাছে কি এখনও খবর এসে পৌঁছয়নি যে, মধ্য শহরের একটা ব্যাঙ্ক এখন ডাকাতদের কবলে?”

“চারদিকে যে ভাবে দুর্নীতি বাড়ছে, তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য আপনারা কী কী করছেন?”

একের পর এক প্রশ্ন। মন্ত্রী সব শুনলেন। তার পরে ডানদিকে একটু ঘাড় ঘোরালেন তিনি। তাঁর ঘাড় ঘোরানো দেখেই সচকিত হল সে। যে একটু আগেই তাঁর সঙ্গে খেলছিল। যার কাগজের টুকরোটায় লেখা ছিল- পুলিশ। এবং ‘পুলিশ’ দেখেই সবার সামনে কাগজটা মেলে ধরেছিল সে। আর তার পরমুহূর্তেই পৌঁছে গিয়েছিল থানায়।

মন্ত্রী ইশারা করতেই সে তাঁর সামনে গিয়ে হাজির। মন্ত্রী নির্দেশ দিলেন, “যাও, এক্ষুনি গিয়ে ডাকাত ধরে নিয়ে এস।”

মন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়ামাত্র পুলিশ ছুটতে শুরু করল। ছুটতে ছুটতে সে ব্যাঙ্কে। ব্যাঙ্কের ভিতর থেকে দলবল নিয়ে তখন সবেমাত্র ডাকাতরা বেরোচ্ছে। পুলিশকে দেখেই, তারা তাদের লুঠ করা ব্যাগের ভিতরে থেকে কিছু টাকার বান্ডিল ছুড়ে দিল তার দিকে। পুলিশ সেটা কুড়িয়ে নিল। টাকা পেয়েই সে মহাখুশি। থুতু দিয়ে টাকা গুনতে লাগল। গুনতে গুনতে সে ভুলেই গেল, কী জন্য সে এখানে এসেছিল। ততক্ষণে ডাকাত তার দলবল নিয়ে হাওয়া।

খবরটা গিয়ে পৌঁছল মন্ত্রীর কাছে। মন্ত্রী তো রেগে কাঁই। সঙ্গে সঙ্গে তলব করলেন পুলিশকে। তলব পেয়েই, গতকাল ডাকাতদের ছুঁড়ে দেওয়া টাকার ক’টা বান্ডিল সুদৃশ্য মোড়কে মুড়ে ফেলল পুলিশ। তারপর সেটা নিয়ে সোজা মন্ত্রীর কাছে। মন্ত্রী কিছু বলার আগেই সে সেটা রেখে দিল মন্ত্রীর টেবিলে। ওটা রাখতে দেখে, মন্ত্রী তাকালেন তার দিকে। চোখে চোখে কী কথা হল কে জানে! মন্ত্রী সেটা হাতে নিয়ে বললেন, “থুড়ি, ডাকাত নয়, যাও, চোরকে গিয়ে ধর।”

পুলিশ ছুটল চোর ধরতে। তখন সকাল হয়-হয়। মালপত্র বোঁচকা বেঁধে চোরটা তখন সে বাড়ির দরজা অল্প ফাঁক করে, চারদিক ভাল করে দেখে টেখে নিয়ে, সবে পা রাখতে যাচ্ছে রাস্তায়, খপ্‌ করে তাকে ধরে ফেলল পুলিশ।

“এই ব্যাটা চোর, পালাচ্ছিস কোথায়?”

“না বাবু, পালাচ্ছি না।”

“তবে?”

“আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম হুজুর।”

“আমার কাছে!”

“হ্যাঁ হুজুর। এত মাল আমি একা নিতে পারি? এই নিন আপনার জিনিস।”

বলেই, চোরটা তার বোঁচকা থেকে এটা ওটা সেটা বের করে পুলিশটার হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর যখন বোঁচকাটা তুলে কাঁধে নিতে যাবে, পুলিশটা তখন বোঁচকাটার দিকে একবার তাকাল, আর একবার তাকাল তার নিজের হাতে ধরা জিনিসগুলোর দিকে। তারপরে বলল, মাত্র এইটুকু!

“আপনাকে অর্ধেকেরও বেশি দিয়েছি হুজুর।”

“নামা দেখি, আর কী আছে?”

“হুজুর, আজকের দিনটা ছেড়ে দিন। সকাল হয়ে আসছে। কাল আপনাকে পুষিয়ে দেব।”

“ঠিক বলছিস?”

“বান, জবান। ভদ্রলোকের এক কথা।”

“ঠিক আছে। তা হলে মাথাটা একটু ম্যাসাজ করে দে। বড় ঝিমঝিম করছে……” বলেই একটা বাড়ির রকে বসে পড়ল পুলিশটা। চোর তার মাথা ম্যাসাজ করতে লাগল। এদিকে সকাল হয়ে এসেছে। লোকজন রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। অনেকেই পুলিশটাকে চেনে। চোরটাকেও চেনে। দু’জনের ওই কীর্তি দেখে লোকজন দাঁড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এটা ওটা বলছে। এদিকে, ম্যাসাজ নিতে নিতে আরামে দু’চোখ বুজে এসেছিল পুলিশের। হঠাৎ চোখ খুলে যেই দেখল, লোকজন দাঁড়িয়ে পড়েছে। একটা জটলা তৈরি হচ্ছে। তাদের দেখে কী সব বলাবলি করছে, অমনি, রে রে করে উঠল সে, “এই, কী চাই? কী চাই এখানে?” বলেই তেড়ে গেল।

মন্ত্রীর কাছে এই খবর পৌঁছতেও সময় লাগল না। তিনি ফের ডেকে পাঠালেন পুলিশটাকে। পুলিশটা এসেই মন্ত্রীর টেবিলের উপর রাখল একটা টিফিন ক্যারিয়ার। এই টিফিন ক্যারিয়ারটা নিশ্চয়ই সে দিন বাড়ি থেকেই চোরটা নিয়েছিল। না হলে চোরটা তাকে যা যা দিয়েছিল, তার মধ্যে এটা এল কোথা থেকে!

“এটা কী?” চোখমুখ কুঁচকে, নাক সিঁটকে প্রশ্ন করলেন মন্ত্রী।

“খুলেই দেখুন না স্যার। আপনার জন্য যৎসামান্য…”

“কী?” বলতে বলতে টিফিন ক্যারিয়ারটার ঢাকনাটা খুললেন তিনি, “কী রে এটা? পায়েস, না ক্ষীর?”

“আজ্ঞে, যা বলবেন স্যার। আপনার বউমা আপনার জন্য পাঠিয়েছেন।”

মন্ত্রীর মুখ খুশিতে গদগদ হয়ে উঠল। একটা আঙুল টিফিন কৌটোর মধ্যে ঢুকিয়ে জিভে ঠেকালেন।

“বাঃ, দারুণ তো! তোর বউ তো খুব ভাল রান্না করে রে। মাঝে মধ্যে একটু আধটু খাওয়াতে পারিস তো……”

“ঠিক আছে স্যার, আনবখ’ন। কিন্তু আমাকে তলব করেছেন কেন স্যার? যদি জানতে পারতাম…”

“তলব! কাকে!”

“আমাকে স্যার।”

“কে বলল?”

“আপনার পেয়াদা স্যার।”

“তাই নাকি? কবে?”

“আজকেই সকালে স্যার।”

“কী জানি, আমার তো মনে পড়ছে না!” বলেই, টেবিলে রাখা অফিস বেলটা দু’বার বাজাতেই ঘরে ঢুকল পেয়াদা।

“কী রে, আমি কি ওকে তলব করেছিলাম?।“

“আজ্ঞে, হ্যাঁ হুজুর। ওই যে, চুরির মালের ভাগ নেওয়ার জন্য ওর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ জমা পড়েছে…”

“জমা পড়েছে বুঝি!”

“হ্যাঁ হুজুর।”

“চোপ।” মন্ত্রীর চিৎকারে গোটা ঘর থরথর করে কেঁপে উঠল, “ওকে দেখে কি মনে হয় ও চুরির মালের ভাগ নিতে পারে?”

“আজ্ঞে, আপনি হুকুম করেছিলেন দেখেই স্যার…”

“আমার কোনও হুকুম নেই। আব্বুলিশ।”

‘আব্বুলিশ’ শব্দটা উচ্চারণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব উধাও। আবার সেই ঘরের মেঝে। আবার সেই শতরঞ্চি। আবার সেই চার বন্ধু। এবং আবার সেই চার ভাঁজ করা কয়েকটা কাগজের টুকরো।

ছবিঃ মৌসুমী

  জয়ঢাকের গল্প ঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s