গল্প কঙ্কাল বাড়ি দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎ ২০১৮

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগের গল্পঃ দেবারণ্য, হংসরাজের বংশধর

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

আমি আর মুরলীধর যাচ্ছিলাম মাদুরাই থেকে কন্যাকুমারী। সঙ্গে ড্রাইভার কার্তি। আমি মাদুরাই এসেছিলাম আমাদের কোম্পানির সাইট-অফিসে। কন্যাকুমারী যাচ্ছি আশেপাশের এলাকায় আমাদের কোম্পানির হয়ে অচিরাচরিত শক্তি দপ্তরের অধীন কয়েকটি হাওয়া-বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সহায়তা করার জন্য। পশ্চিমঘাট পর্বতমালাকে ডানপাশে রেখে ঝাঁ-চকচকে হাইওয়ে ধরে আমাদের গাড়িটা এগিয়ে চলেছিল। দু’পাশে দিগন্তছোঁয়া খোলা মাঠ আর চোখ জুড়ানো সবুজ নারকেল গাছের সারি। এপ্রিলের গরম দুপুর পার হয়ে বিকেলের আবেশ মিশছে বাতাসে।

রাস্তায় যানবাহন বেশ বিরল। একটা ধাবা পার হয়ে আমাদের গাড়িটা ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। জনশূন্য রাস্তাটা সামনে একটা টিলা পাহাড়ের পেট চিরে ওপারে চলে গিয়েছে। ভারি মনোরম জায়গাটা। পথের দু’পাশের কাঁকরের লাল রঙ আমায় আমার লাল মাটি মাখা জন্মভূমি বীরভূমের কথা মনে করিয়ে দিল।

“এখানে রাস্তার একপাশে গাড়িটা একটু থামান।”

মুরলীধর ড্রাইভারকে বলে রাস্তার পাশে গাড়িটা দাঁড় করাল। এরপর পকেট থেকে স্মার্ট ফোনটা বার করে গাড়ি থেকে নেমে গেল। আমিও গাড়ি থেকে নামলাম। মুরলীধর রাস্তার বামদিকে পায়ে চলা পথ দিয়ে কিছুটা হেঁটে একটা পরিত্যক্ত কটেজের কাছাকাছি গিয়ে থামল। এরপর বাড়িটাকে পিছনে রেখে হাসিহাসি মুখ করে একটা সেলফি তুলল। তারপর দ্রুত পা চালিয়ে ফিরে এসে বলল, “এই কটেজটা খুব স্পেশাল।”

আমি কটেজটার দিকে তাকালাম। কোনও ধনী ব্যক্তি হয়তো নিরিবিলিতে সময় কাটাবেন বলে এই সুন্দর কটেজটা বানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শখ স্থায়ী হয়নি। কিংবা অন্য কোনও কারণে কটেজ ছেড়ে চলে গেছেন। কারণ, কটেজের ভগ্ন চেহারা দেখে সাম্প্রতিক অতীতে ওখানে কেউ বসবাস করেছে বলে মনে হল না।

মুরলীধরের দিকে ফিরে তাকালাম। সে মৃদু হেসে বলল, “এটা আমার একটা অদ্ভুত হবি বলতে পার, সিদ্ধার্থ। হানাবাড়ির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলা।”

এই বলে সে গাড়িতে ফিরে এসে মোবাইলের ফটো গ্যালারি খুলে দেখাতে লাগল কোথায় কোথায় কোন কোন ভূতুড়ে বাড়িকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে নিজের ছবি তুলেছে। কী কী অলৌকিক গল্প জড়িয়ে আছে ছবির কোন বাড়িকে ঘিরে, সেসব সংগ্রহের কথাও জানাল গর্ব করে।

আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনে বললাম, “আজব হবি বটে তোমার। তা এই কটেজটার গল্পটা কী?”

আমাদের গাড়িটা ততক্ষণে দেড়-দু’ কিলোমিটার সামনে এগিয়ে গেছে। মুরলীধর একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছনে তাকিয়ে কটেজটা ফিরে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করল। তারপর বলল, “এই কটেজটাকে লোকে চেনে কঙ্কাল বাড়ি নামে। এই বাড়ির মালিক কর্নেল নটরাজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার ছিলেন। ব্যাচেলর মানুষ। খ্রিস্টান। কাছের লোক বলতে ছিল এক পুরাতন কেয়ারটেকার শ্রীনাথ, আর একপাল বিদেশি কুকুর। বক্সার, বুলডগ, ডোবারম্যান, রিট্রিভার সব জোড়া জোড়া। এদের সঙ্গে ছিল কর্নেলের খুব প্রিয় একটা ধূসর কাকাতুয়া।

“এই খবরটুকু যে কনট্রাক্টর কটেজটা বানিয়েছিল সেই পুলিশকে জানিয়েছিল, মানে তিনি কটেজ সাজিয়ে গুছিয়ে হ্যান্ডওভার করে গৃহপ্রবেশের দিন পেমেন্ট নিতে গিয়ে যেমনটা দেখে এসেছিলেন আরকি। আমি খবরের কাগজে পড়েছি।”

“এই বাড়ির কথা নিউজ পেপারে বেরিয়েছিল!” আমি বিস্ময়ের আবেশে প্রশ্ন করলাম।

“হ্যাঁ। তা বছর দুয়েক আগের ঘটনা হবে। এই বাড়ি থেকে কুকুরগুলোর আর শ্রীনাথের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল। একটা সময় পর্যন্ত কেউ কিছু জানতে পারেনি। কাছাকাছি একটা ধাবা থেকে খাবার নিয়ে যেত শ্রীনাথ। তার বদলে প্রায় মাস খানেক ধরে কর্নেল নটরাজন নিজেই খাবার নিয়ে যাচ্ছেন কেন? প্রথমদিকে ধাবার কর্মচারীদের মনে এই খটকা লাগে। একদিন এই নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তার উত্তরে কর্নেল ধাবার লোকেদের কিছু অসংলগ্ন কথা বলেন। তা থেকেই সন্দেহ করে ধাবার মালিক পুলিশে খবর দেন। পুলিশ জোর করে কটেজে ঢুকে দেখতে পায়, কর্নেল নটরাজন কঙ্কালগুলোর সঙ্গে নিশ্চিন্তে অবসর যাপন করছেন।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী? কর্নেল নটরাজনকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে কাউকে খুন করা বা অন্য কোনও অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে তিনি সুস্থ হয়ে ফিরেছিলেন কি না বা ফিরলে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ কিছু কেস দিয়েছিল কি না সেসব খবর আমার জানা নেই।”

এই বলে মুরলীধর ক্ষণিকের নীরবতায় ডুব দিয়ে আবার প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলল, “সেই কঙ্কাল কাণ্ডের জেরে এই কটেজ এলাকার অন্যতম বিখ্যাত হন্টেড হাউস হিসেবে পরিচিত!”

আমি বললাম, “বেশ। তো এখন কী করবে? ফেসবুকে পোস্ট করবে ছবিটা?”

“না। এটা একান্ত আমার নিজস্ব জগৎ। আসলে আমি চেন্নাইয়ের যে এলাকাটায় ছোটোবেলা কাটিয়েছি সেখানে অনেক পুরনো পুরনো বৃটিশ আমলের ঘরবাড়ি ছিল। আমার সবসময় মনে হত, এইসব বাড়িতে ভূত-প্রেত আছে। আমি মাঝেমাঝে সন্ধের দিকে বাড়িগুলোর কাছাকাছি গিয়ে চারপাশে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতাম।”

“কোনওদিন দেখেছিলে তেমন কিছু?”

“না, দেখিনি, তবে অনুভব করেছি। মাঝেমধ্যে একেকরকমের অস্বস্তিকর অশরীরী উপস্থিতি। হঠাৎ ঘোর লেগে গা-ছমছম করে উঠত। তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসতাম বাড়িতে।”

আমি মুরলীধরের মুখের দিকে তাকালাম। তিন-চার ঘণ্টার লম্বা সফরে এমন অদ্ভুত মানুষের সঙ্গ পেলে বেশ সময় কেটে যায়। তাই কখন এসব অলৌকিক চর্চা করতে করতে কন্যাকুমারী পৌঁছে গেলাম টের পেলাম না।

পরদিন সকালে প্রাতরাশ সেরে হোটেলের বারান্দায় বসে আছি। সামনের কয়েকটা ঝুপড়ি দোকান আর রাস্তার ওপারে নীল সমুদ্র সীমাহীন। বেশ ফুরফুরে হাওয়া বইছে চারপাশে। হঠাৎ মুরলীধর হাঁপাতে হাঁপাতে এল।

“কী হয়েছে?”

“আমার স্মার্টফোনটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। হোটেলে ঘরের বেডসাইড টেবিলে রেখেছিলাম। রাত দশটা নাগাদ একটা দরকারি কলও করেছিলাম মনে আছে। তারপর আর কোনও হদিস নেই।”

“রাতে কোথাও বেরিয়েছিলে?”

“খাবারদাবার সব ঘরেই অর্ডার দিয়েছিলাম। শুধু খেয়ে উঠে মিনিট পনেরোর জন্য হোটেলের লনে ঘোরাফেরা করেছিলাম। ওই সময় মোবাইল সঙ্গে ছিল কি না মনে পড়ছে না। সকাল থেকে যেখানে যেখানে হেঁটেছিলাম, গোটা এলাকাটাই তো তন্নতন্ন করে খুঁজলাম।”

“কল করলে রিং হচ্ছে?”

“না। একরকম আওয়াজ হচ্ছে। ল্যান্ড ফোনে কথা বলার সময় পাশে রাখা মোবাইলে কল এলে যেমন আওয়াজ হয় সেরকম। একটু লো ভলিউমে। তার পিছনে একটা কর্কশ শব্দ!”

“আশ্চর্য!”

এমন ঘটনা আগে কখনও শুনিনি। ফোনটা কোথাও পড়ে থাকলে রিং হত। কেউ চুরি করে থাকলে এতক্ষণ সুইচড অফ করে দিত।

“আচ্ছা, জলে পড়ে যায়নি তো?” আমি মুলরীধরের চোখে চোখ রেখে সম্ভাবনার কথাটা বললাম।

মুরলীধর নিজের কান-মাথা চুলকাতে চুলকাতে কিছুক্ষণ ধরে ভাবল। বলল, “আমার ঘর, বাথরুম, বারান্দা সব দেখা হয়ে গেছে।”

দু’জনে একসঙ্গে গিয়ে হোটেল ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি যতদূর ব্যবস্থা আছে তার সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখালেন আমাদের। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে কোনও সদুপায় না পেয়ে আমরা লোকাল পুলিশ স্টেশনে গেলাম মিসিং ডায়েরি করতে। যাতে এই সিমকার্ডটা ব্লক করে নতুন মোবাইলে একই নম্বরের সিমকার্ড পেতে পারে মুরলীধর।

দুপুরের দিকে আমার টুটিকোরিন যাওয়ার ছিল। ওখানে আজ রাতটা কাটিয়ে কাল সকাল সকাল কিছু কাজ আছে। ফেরা একদিন পর, মানে আগামী পরশু।

টুটিকোরিন থেকে ফিরে এসে হোটেলে মুরলীধরের দেখা পেলাম না। রেজিস্টারে দেখলাম চেক-আউট করে চলে গেছে গতকাল। ভাবলাম, মুরলীধর বোধহয় এই হোটেলটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। নতুন মোবাইল কিনেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি তো আমার নম্বরটা ওকে লিখে দিয়ে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, নতুন মোবাইলে সিমকার্ড সচল হলে জানিও।

ওর সঙ্গে একবার কথা বলে নেওয়া দরকার ছিল। কারণ, মুরলীধর অফিসের কাজে কন্যাকুমারী কিছুদিন থেকে যাবে। আমি তিরুঅনন্তপুরম হয়ে চেন্নাই ফিরে যাব। তাহলে কি আগের নম্বরটাই পেয়েছে টেলিকম কোম্পানি থেকে? আমি মুরলীধরের পুরনো নম্বররেই কল করলাম।

বিদঘুটে একটা সোঁ সোঁ আওয়াজ। তার সঙ্গে যেন কোনও কর্কশ ডাক মিশে রয়েছে। আশ্চর্য! এখনও কি মুরলীধরের হারানোর মোবাইলের সিমকার্ডটা লক হয়নি? ভাবলাম, যাক গে, ওর সঙ্গে দেখা হলে ভালো। না হলে অফিসে ফোন করে নতুন নম্বর কী পেয়েছে জেনে নেব।

মুরলীধরের সঙ্গে দেখা হল বিকেলে সানসেট পয়েন্টে। তখন সূর্য পশ্চিমের আরবসাগরে ডুব দেব দেব করছে। দামাল ঢেউয়ের দল সূর্যের লাল রঙ বয়ে এনে ঢেলে দিচ্ছে জলের মধ্যে ইতিউতি জেগে থাকা কালো পাথরগুলোর মাথায়। মুরলীধর সৈকতে একটা বড়ো পাথরের ওপর বসে একদৃষ্টিতে সূর্যাস্ত দেখছিল। আমি পিছনে গিয়ে কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠল।

“কী খবর তোমার? শরীর খারাপ নাকি?”

মুরলীধরকে দেখে আমিও পালটা চমকে উঠেছিলাম। দু’দিনের মধ্যে এ কী হাল হয়েছে চেহারার! মুখ শুকনো, চোখের কোল বসে গেছে, চুল উসকোখুসকো।

মুরলীধর বলল, “না, ঠিক আছি। তোমার টুটিকরিনের কাজ হল?”

“আমার কথা ছাড়ো। কী হয়েছে বলো তো তোমার? নতুন মোবাইল কিনেছ? সিমকার্ড পেলে?”

মুরলীধর নিজের নতুন নম্বর আর হোটেলের ঠিকানা দিয়ে উঠে পড়ল। “সন্ধে নামছে, চলো ফেরা যাক।”

আশেপাশে অনেক লোকজন বসে ছিল। চা-ওয়ালা হাঁক দিয়ে চা বিক্রি করছে। আমার আরেকটু বসে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মুরলীধরকে দেখে মনে হল, সে অন্ধকারকে ভয় পাচ্ছে।

কথোপকথন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, “ফিরে এসে হোটেলে তোমায় দেখতে না পেয়ে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তুমি চলে গেছ শুনে কী করব কিছু ভেবে না পেয়ে তোমার পুরনো নম্বরটাতেই ফোন করলাম। টেলিকম কোম্পানি থেকে এখনও ওটা বন্ধ করেনি কেন? ফোন করলে সেই বিশ্রী শব্দটা বেজে চলেছে।”

আমার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মুরলীধর উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। স্ট্রিট লাইটের সীমানার বাইরে ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কেমন জড়সড় হয়ে গেল যেন। এরপর দ্রুতপায়ে সৈকত ছেড়ে রাস্তায় উঠে একটা ব্যাটারিচালিত সার্টেল-গাড়িকে হাত তুলে থামাল। তারপর হুটোপাটি করে চড়ে বসল তাতে। আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

এই ঘটনার পর মনের মধ্যে একটা খটকা জন্ম নিল যা নিয়ে আগে কখনও ভাবিনি। মুরলীধরের ছোটোবেলা থেকে বয়ে নিয়ে আসা অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে অদ্ভুত হবি। বিশেষ করে মাদুরাই থেকে আসার পথে ওই কঙ্কাল বাড়ির সামনে সেলফি তোলা। সেসবের সঙ্গে ওর এই বর্তমান অস্থিরতার কোনও যোগ নেই তো? নাহলে মোবাইল তো কত লোকেই হারায়, তা নিয়ে এমন সংকটাপন্ন হয়ে পড়তে তো কাউকে দেখিনি।

মুরলীধরকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করেই রাতটা কেটে গেল আমার। একবার ভাবলাম, অফিস থেকে ওর বাড়ির কনট্যাক্ট নম্বর নিয়ে বিষয়টা জানাই। আরেকবার ভাবলাম, ওপরওয়ালাকে বলে অসুস্থতার জন্য ওকে কিছুদিনের ছুটি ব্যবস্থা করে দিই। ছুটি নিতে না চাইলে অন্য কোনও কাজে মেট্রো সিটিতে পোস্টিং দিয়েও দেখা যেতে পারে। হয়তো বড়ো শহরের কোলাহল আর ব্যস্ততার মধ্যে ভুলে থেকে বর্তমান সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে।

ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সাতটা নাগাদ পাশে মোবাইলটা বাজছে দেখে চমকে উঠলাম। কার্তি ফোন করেছে। কল রিসিভ করতেই সে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “মুরলীসাহেব ভোর হতে না হতেই ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে গাড়ি নিয়ে মাদুরাইয়ের দিকে কোথাও চলে গেছেন।”

ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক কার্তির পরিচিত। তিনিই সকালে দেখা হওয়ায় কার্তিকে বলেছেন মুরলীধরের গাড়ি বুকিংয়ের ব্যাপারটা। আমি শুনেই আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। গতকাল বিকেলে ওর আচরণ একটুও ঠিকঠাক লাগেনি আমার। কার্তিকে ডাকলাম। তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে চলে আসতে বললাম। মুরলীধরের নতুন নম্বরে ফোন করলাম। সুইচড অফ। কৌতূহলের বশে পুরনো নম্বরটাতেও ফোন করলাম। না, এবার ঠিক আছে। এই সিমটা বন্ধ করে দিয়েছে।

কার্তিকে নিয়ে প্রথমে মুরলীধর যে হোটেলে ছিল সেখানে গেলাম। হোটেলের যে সার্ভিস-বয় মুরলীধরের রুমে ডিউটি করেছে, মুরলীধরের আচরণে সে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছে দেখলাম। এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করাতে হড়বড় করে বলল, “ঘরে খাবার দিতে গিয়ে বারবার কলিংবেল বাজানোর পর সাহেব দরজা খুললেন। আমাকে দেখে প্রথমে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। আমি টেবিল পরিষ্কার করে খাবার রাখছিলাম যে সময়ে, সে সময় সাহেব সারাক্ষণ ঘরে মধ্যে পাগলের মতো পায়চারি করছিলেন। আর কোনও একটা নম্বরে বারবার ফোন করে ঘাড় বেঁকিয়ে কানে মোবাইলটা চেপে রাখছিলেন। তবে কারও সঙ্গে কোনও কথা বলতে আমি শুনিনি।”

হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্র্যাভেল এজেন্সির অফিসে গেলাম। সেখান থেকে যে ড্রাইভার মুরলীধরকে নিয়ে বেরিয়েছে তার মোবাইল নম্বর জোগাড় করে ফোন করলাম।

সে ফোন ধরে বলল, মুরলীধর মাঝরাস্তায় পান্নানকুলাম নামে একটা মফঃস্বলমতো জায়গায় নেমে গেছে। বলেছে, সেখানে ওর আত্মীয়ের বাড়ি আছে, দেখা করতে যাচ্ছে।

“কার্তি, চটপট গাড়ি চালাও। আমি জানি ও কোথায় যাচ্ছে। সেখানে সোজাসুজি গাড়ি নিয়ে গেলে ড্রাইভার সন্দেহ করবে, তাই আগে নেমে গেছে। এরপর বাকিটা যেতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করবে।”

আমার উদ্বেগ দেখে কার্তি ভয় পেয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। যেতে যেতে মুরলীধরকে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করতে লাগলাম। যদি একবারের জন্যও ফোন অন করে, একটু কথা বলতে পারা যায়। কিন্তু প্রতিবারই ফোন সুইচড অফ পেলাম।

*****

টিলা-পাহাড়ের পেট চিরে চলে যাওয়া রাস্তাটার কাছে এসে কার্তি গাড়ির গতি কমাল। আমরা গাড়ি থেমে নেমে লাল কাঁকরের কাঁচা পথ ধরে কঙ্কাল বাড়ির সামনে গেলাম। অদূরের হাই-রোডটা বাদ দিলে বাকিটা নিঝুম। আশেপাশে কোথাও কোনও লোকবসতি নেই। আমি কার্তিকে নিয়ে গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। জং ধরে জমে যাওয়া লোহার গেটটা আওয়াজ করে আপত্তি জানাল।

কার্তি বলল, “ঘরে ঢোকার সব দরজাই তো তালা দিয়ে সিল করে দেওয়া।”

“তবুও, আমি নিশ্চিত মুরলীধর এখানেই এসেছে। চলো, কটেজের পিছনদিকটা দেখি।”

আমরা ঝোপঝাড় ঠেলে পিছনে গেলাম। দেখলাম, কটেজ কম্পাউন্ডের মধ্যে এক জায়গায় উবু হয়ে বসে মুরলীধর হাতে করে উঠোনের মাটি আঁচড়াচ্ছে। আমরা দৌড়ে ওর কাছে গেলাম।

“এসব কী পাগলামি করছ তুমি!”

আমার ধমক খেয়ে মুরলীধর ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তারপর মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে মিথ্যের আবরণে লুকিয়ে নিয়ে বলল, “না, মানে। আমার হারানো মোবাইলটা খুঁজছিলাম।”

“এখানে তোমার মোবাইল কী করে আসবে? এদিকে তো কখনও তুমি আসনি। সত্যি করে বলো তো কী হয়েছে তোমার? এমন করে মাটি আঁচড়ে কী খুঁজছিলে তুমি?”

মুরলীধর এক ঝলক আমার চোখে চোখ রেখেই নিজের ভয়ার্ত দৃষ্টিটা সরিয়ে নিল। টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, “একটা কঙ্কাল খুঁজছিলাম। এ-বাড়ি থেকে সব কঙ্কালই তো উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। শুধু ওর দেহটাই রয়ে গেছে এখানে, মাটির তলায়, একটা বিশেষ কফিনের মধ্যে। ও ছিল মৃতদের মধ্যে প্রথমজন। তারপর ও-ই তো বাড়ির সব্বাইকে আগলে রেখেছিল, কাউকে বাইরে যেতে দেয়নি। কেউ বাইরে যেতে চাইলেই তাকে ডেকে নিত। ওর ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছিল। কেউ অবহেলা করতে পারেনি, পারা যায় না। তুমি আমার পুরনো মোবাইল নম্বরে ফোন করে সেই ডাক কি শুনতে পাওনি?”

আমি হতভম্ব হয়ে মুরলীধরে কথা শুনছিলাম। কী বলতে চাইছে ও?

“কর্নেল নটরাজনও তো এখানেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন, সবার সঙ্গে, কঙ্কাল হয়ে। ধাবার লোকগুলো সন্দেহ করছিল বলে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেবেন বলে ঠিক করেছিলেন। হঠাৎ করে ওরা পুলিশ ডেকে…”

মুরলীধরের কথা আমি একবর্ণও বুঝতে পারছিলাম না। এরপর সে এই কথাগুলোই আরেকবার বিড়বিড় করে বকতে বকতে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর শরীর ও মনে ক্লান্তির ভার ধরে রাখতে না পেরে ঢলে পড়ল আমার ওপর। আমি আর কার্তি ওকে ধরাধরি করে কঙ্কাল বাড়ি থেকে বার করে এনে গাড়িতে তুললাম। কন্যাকুমারীতে নিয়ে এসে নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিলাম। মুরলীধরের বাড়িতে খবর পাঠালাম।

ভিজিটিং আওয়ারে যখন দেখা করতে গেলাম, তখনও মুরলীধর ঘোরের মধ্যে। আমি কাছে যেতে চিনতে পারল। আমি পাশে বসে পুরনো প্রশ্নটা আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?”

মুরলীধর থমথমে দৃষ্টিতে আমার মুখে দিকে অপলক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “সেদিন কঙ্কাল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তোলা আমার সেলফিটা ভালো করে দেখেছিলে?”

আমি ঘাড় হেলালাম। “হ্যাঁ। কী সমস্যা আছে তাতে?”

“দোতলার ছাদের কার্নিশের কাছটা ভালো করে দেখেছিলে?”

“অত মনে পড়ছে না। ছবিটা এক ঝলক দেখেছিলাম। যাই থাকুক না কেন, কী হয়েছে তাতে?”

পরের শব্দটা বলতে গিয়ে মুরলীধর থরথর করে কেঁপে উঠল। “তুমি দেখনি? ঠিক দোতলার ছাদের কার্নিশের ঠিক ওপরটায়?”

মুরলীধরকে কাঁপতে দেখে একজন নার্স এগিয়ে এসে বাধা দিল। “আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পেশেন্টের উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু বলেছেন, তাড়াতাড়ি সেরে ওঠার জন্য পেশেন্টের নিরুপদ্রব বিশ্রামের প্রয়োজন।”

আমি দুঃখ প্রকাশ করে বেরিয়ে এলাম। কার্তির সঙ্গে আজ কন্যাকুমারীর সেই ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিকও মুরলীধরকে দেখতে এসেছেন। আমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে ওঁরা থেমে গেলেন। আমি বললাম, “চেন্নাই থেকে মুরলীধরের বাড়ির লোকেরা রওনা দিয়েছে।”

কার্তি সব দেখেশুনে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এইসব ভূত-প্রেত নিয়ে চর্চা মানুষের জীবনে কখন যে কী অভিশাপ ডেকে আনে! কর্নেল নটরাজনও কত হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। অথচ শেষে কী পরিণতি হল!”

আমি মুরলীধরের ঘটনা নিয়ে ভেতরে জমে থাকা ধন্দের তল খুঁজে পাওয়ার আশায় জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি চিনতেন নাকি তাঁকে?”

“হ্যাঁ, আগে এখানেই তো থাকতেন। কিন্তু ওই, থেকে থেকে বিভিন্ন ভূতুড়ে জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার নেশা চাপত। নিজের গাড়ি বেশিরভাগ সময় নিজেই চালাতেন, মাঝেমধ্যে একটু কঠিন রাস্তায় যাওয়ার দরকার পড়লে আমার থেকে ড্রাইভার চেয়ে নিতেন।”

“শেষে কী হয়েছিল তাঁর? যতদূর শুনেছিলাম, পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানেই কি?”

ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে বললেন, “সেখান থেকে তিনি সুস্থ হয়ে ফিরেছিলেন। একটা কিন্ডারগার্টেনে বাচ্চাদের পড়াতেন। ভালোই ছিলেন। সেবার বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে শীতে চিড়িয়াখানা ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ…”

একটু থেমে আমার স্থির চোখের ওপর চোখ বুলিয়ে ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক বললেন, “পাখির খাঁচার সামনে হার্টফেল করে মারা যান। সঙ্গে যারা ছিল তারা বলেছিল, কর্নেল খাঁচার মধ্যে একটা আফ্রিকান ধূসর কাকাতুয়া দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন! তারপরেই…”

অলঙ্করণঃ মৌসুমী

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s