জুলাই ১৬, ২৪৪৫, মানব সভ্যতার ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল দিন বলে ঘোষিত হতে চলেছে আজকের এই দিনটি। অবশেষে আনথ্রোপোসিন যুগের ৫০০তম বার্ষিকীতে মানবসভ্যতা তার সব থেকে বড় স্বপ্নকে সাকার করতে চলেছে, চতুর্মাত্রিক মহাবিশ্বকে অবশেষে তারই ভাষায় জবাব দিতে ত্রিমাত্রিক জগতের অধিবাসীরা শতাব্দীর সাধনার পর বিজ্ঞানের মন্ত্রবলে জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে স্থান ও কালের সীমারেখাকে অতিক্রম করে যাওয়ার আধিভৌতিক স্বপ্নতোরণ কৃত্রিম কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোলের। কয়েক শতাব্দী ধরে যে স্বপ্ন দেখছিল মানবসভ্যতা, অবশেষে সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপায়িত হতে চলেছে। সৌরজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যাসট্রোফিজিসিস্ট ডক্টর এন. রিচার্ড এর নেতৃত্বে আজ সফল হতে চলেছে কয়েক শতাব্দীর এই প্রয়াস। স্পেস স্টেশন থেকে মহাবিশ্বের কালো অমানিশার গর্ভে জন্ম নেওয়া এই নির্মীয়মান কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে যেন ভুলে যাওয়া অতীতকে আরো একবার ফিরে দেখতে পাচ্ছিলেন এই বৃদ্ধ বিজ্ঞানসাধক।
বিজ্ঞানী রিচার্ডস এর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর প্রিয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিষ্য ডক্টর আদিত্য রায়। মাত্র ৩০ বছর বয়সেই এক সার্থক বিজ্ঞানভিক্ষু হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন এই নবীন বিজ্ঞানী। আর তার সাথে জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছেন সৌরমন্ডলের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানতপস্বীর ঐকান্তিক স্নেহ। নম্র স্বরে ডক্টর আদিত্য বলে উঠলেন, “স্যার, সময় হয়ে এসেছে, এবার কৃষ্ণগহ্বর প্রকৃত অর্থে জন্ম নিতে চলেছে। কিন্তু এত দিন থাকতে আপনি আজকের দিনটাকেই কেন বেছে নিলেন এই যুগান্তরকারী পদক্ষেপ এর জন্য?”
বৃদ্ধ বিজ্ঞানী তাঁর গভীর দৃষ্টি তাঁরই হাতে নির্মিত মহাশক্তি থেকে সরিয়ে আনলেন তাঁর পুত্রবত প্রিয় এই নবীন শিষ্যের দিকে, হাসিমুখে বলে উঠলেন, “আজ থেকে ৫০০ বছর আগে এই দিনটিতেই আমাদের আজকের এই আনথ্রোপোসিন যুগের শুভারম্ভ হয়েছিল আদিত্য। আর তাই আজ ৫০০ বছর পর এই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পদক্ষেপটি নিয়ে সেই মানহাটান পারমাণবিক প্রজেক্ট এর মহাবিজ্ঞানীদের প্রতি একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করাই আমার আজকের এই দিনটি বেছে নেওয়ার একেমেবাদ্বিতীয়ম কারণ ডিয়ার।”
খানিক বাদে শান্ত কন্ঠে আদিত্য বলে উঠলেন, “স্যার,আপনার স্পেসশিপ তৈরি হয়ে গেছে ,আপনি সৌরমন্ডলের ভেতরে এবার ফিরে যেতে পারেন আপনার সৃষ্ট কৃষ্ণগহ্বরকে জন্ম নিতে দেখতে, কিন্তু এটা কি সত্যি প্রয়োজন? আপনি জানেন কতটা বিপদজনক এই পদক্ষেপ, তা সত্বেও কেন আপনি এগিয়ে চলেছেন এই মহাশক্তির এত কাছে?”
ডক্টর রিচার্ড হাসি মুখে বলে উঠলেন, “নিজের সন্তানকে জন্ম নিতে নিজের চোখেই দেখতে হয় আদিত্য। যুগ যুগ ধরে বহু বিজ্ঞানীদের সাধনার ফল আজ বাস্তবায়িত হয়ে উঠতে চলেছে। তাদের প্রতিনিধি রূপে এই মহাসন্ধিক্ষণের সাক্ষি তো আমায় হতেই হবে ডিয়ার।”
“কিন্তু এই কৃষ্ণগহ্বর সৌরমন্ডলের ভিতরেই জন্ম দেবার কি সত্যি প্রয়োজন ছিল ডক্টর? সৌরমন্ডলের বাইরের অসীম মহাকাশের বুকেও এর জন্ম দেওয়া যেত।”
ডক্টর রিচার্ড এবার কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে ওঠেন, “তুমি জান আদিত্য আমি নিজেই চাইনি সৌরমন্ডলের ভেতরে এই কৃষ্ণগহ্বরকে জন্ম দিতে। কিন্তু আমার ইচ্ছার থেকেও এখানে বড় হয়ে উঠেছিল এই মহা প্রকল্পকে যে সমস্ত রাষ্ট্রনায়কেরা স্পন্সর করছেন তাঁদের আদেশ। এঁরা আজ একে অপরকে চূড়ান্ত অবিশ্বাস করেন আদিত্য। তাই প্রত্যেকেই চেয়েছেন তাঁদের দৃষ্টির সামনে , তাঁদের তত্ত্বাবধানে এই কৃষ্ণগহ্বরকে জন্ম দিতে। এই অবিশ্বাসের সামনে যে কোনো বিপদের আশঙ্কাই অনেক ছোট হয়ে গেছে ডিয়ার।”
“কিন্তু ডক্টর, বিভিন্ন গ্রহ ও উপগ্রহের মহাকর্ষীয় শক্তি, সৌররশ্মি, এই কৃষ্ণ গহ্বরের প্রকৃতিকে অনিয়ন্ত্রিত করে তুলে পারে, আপনি কি জানাননি এই সত্য তাদের? কত বড় মহাবিনাশ তাদের এই অন্ধ জেদের মাশুল হিসেবে আসতে পারে এর ধারণা কি নেই তাদের ?”
ডক্টর রিচার্ড বিষণ্ণ গলায় বলে ওঠেন, “তুমি এখনো নবীন মনের আদিত্য, অবিশ্বাস এবং ঈর্ষার আগুন মানুষের দৃষ্টিকে কতটা অন্ধ করে দিতে পারে সেই ধারণা নেই তোমার। সব জেনেও ,সব বলার পরেও এঁরা তা শুনতে চান না, বুঝতে চান না। যারা বুঝতে চান না তাঁদের বোঝানো কয়েক কোটি আলোকবর্ষ পার করার থেকেও কয়েকশগুন বেশি দুরূহ মাই ডিয়ার। যাই হোক ,আর দেরি করা ঠিক হবে না। চল এবার স্পেসশিপে উঠে আমায় এগিয়ে চলতে হবে আমার এত বছরের প্রতীক্ষিত স্বপ্ন সার্থক হতে দেখতে। “
স্পেসস্টেশন থেকে শিপে ওঠার ঠিক আগের মুহুর্তে ডক্টর রিচার্ড তার প্রিয় ছাত্রের হাত ধরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলেন, “যদি কোনো মহাবিনাশের জন্ম দেয় আমাদের এই আবিষ্কার তবে এই স্পেসস্টেশনের প্রধান হিসেবে তুমি একে সৌরমন্ডলের সীমার থেকে বহুদূরে নিয়ে যাবে আদিত্য। মানবসভ্যতার ইতিহাসের চিহ্ন হয়ে তোমাদের জীবিত থাকা সমস্ত মানবজাতির দাবি। সেটাই হবে তোমার এই গুরুর প্রতি তোমার গুরুদক্ষিণা।”
“এরকম কোনো মহাবিনাশের আভাস দেবেন না ডক্টর। এমন গুরুদায়িত্ব নেবার যোগ্যতা নেই আপনার এই শিষ্যের, ” আদিত্য কাতর স্বরে বলে উঠল।
ডক্টর রিচার্ড হাসি মুখে বলে উঠলেন, “কোনো মানুষের যোগ্যতা তখনই সে জানতে পারে যখন সেই যোগ্যতার সমতুল্য দায়িত্বের ভার পরে তার উপর ডিয়ার। তোমার যোগ্যতা তুমি জান না ,কিন্তু বিশ্বাস কর এই বৃদ্ধ চোখদুটি মানুষ চিনতে ভুল করে না। তোমার কর্মনিষ্ঠা এবং কর্তব্যবোধ বহুকাল আগেই চিনে নিতে পেরেছিল এই স্বার্থপর বৃদ্ধ মানুষটি। তাই জীবনে প্রথমবার সুপারিশ করে তোমাকে এই স্পেসস্টেশন এর কর্ণধার হিসেবে নিযুক্ত করেছি। কারণ এই গুরুদায়িত্ব অন্য কাউকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে আমি পারতাম না আদিত্য। তোমার কাছ থেকে আমি প্রতিশ্রুতি চাই যদি কোনো মহাবিনাশ হয় তবে মানব সভ্যতার ইতিহাসের চিহ্ন হয়ে যত কাল সম্ভব তোমরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখবে এই মহাবিশ্বের বুকে। “
কিছুটা নীরব সময় কেটে গেল গুরুশিষ্যের। অবশেষে আদিত্য বলে উঠল, “ডক্টর, যদি সে’রকম কোনো মহাবিনাশ সত্যি হয়, তবে তার প্রতিকার কী?”
ডক্টর রিচার্ড একটা প্রাণখোলা উদাস হাসি হেসে বললেন, “আমাদের সাধ্য কী ডিয়ার, মানবসভ্যতা আজ এত বৃহৎ মহাশক্তির কাছে অসহায়। না উপায় আমাদের হাতে নেই আদিত্য, আছে শুধুই একজনের হাতে।”
আদিত্য ব্যাকুল স্বরে বলে উঠল, “কার কাছে ?”
“সৌর মন্ডলের মহাধিপতি, এর জন্মদাতা দিবাকর সূর্যের হাতেই। “
আদিত্য বিস্মিত স্বরে বলে ওঠেন, “কীভাবে ডক্টর ?”
“এই কৃষ্ণগহ্বর প্রাকৃতিক নয় আদিত্য, কৃত্রিম। তাই এর শক্তি এবং আয়ু সীমাবদ্ধ। সূর্য এই কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বকে কখনই মেনে নিতে পারবে না। সংগ্রাম চলবে এই মানবনির্মিত কৃত্রিম কৃষ্ণগহ্বর এবং দিবাকর দিনমণির মধ্যে।
“এই কৃষ্ণগহ্বর প্রাকৃতিক হলে অনেকগুণ বেশি ক্ষমতাশালী হত। কিন্তু এই কৃত্রিম কৃষ্ণগহ্বরের শক্তি সীমাবদ্ধ, তাই যুগের পর যুগ ধরে সংঘাতের পর একসময় এর অস্তিত্ব মুছে যাবে সৌরমন্ডলের বুক থেকে। কিন্তু কতকাল, কতযুগ পার করে এই সংগ্রাম চলবে তা কেউ জানে না।”
ডক্টর রিচার্ড এর স্পেসশিপ প্রবল বেগে এগিয়ে চলেছে এই মহা রহস্যময় কৃষ্ণকায় গোলকধাঁধার দিকে। একটু একটু করে পূর্ণরূপ পেতে চলেছে শত বিজ্ঞান সাধকের কয়েক শতাব্দীর এই সাধনার ফসল। অবশেষে ডক্টর রিচার্ড এর চোখের সামনে ফুটে উঠল তাঁর এত বছরের স্বপ্ন এত সাধনার ফসল, তাঁর সন্তানসম এই কৃষ্ণগহ্বর। এক অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন ডক্টর রিচার্ড তাঁর নবনির্মিত এই মহারহস্যের দিকে। আর শুধু তিনি নন, তাঁর সাথে যেন যুগ যুগের কত শত বিখ্যাত এবং নামহীন বিজ্ঞানের সাধকের দল আজ অপার বিস্ময় ও গর্বের সাথে তাকিয়ে রয়েছে বিজ্ঞানের এই মহাশক্তির দিকে। এই শক্তি যা আজকের এই যুগের সর্ব শ্রেষ্ঠ কীর্তি। যা বদলে দেবে পৃথিবী তথা সৌরমন্ডলের মানব ইতিহাসকে………..
হঠাৎ একটা প্রচন্ড আকর্ষণে আসন থেকে ছিটকে পড়লেন ডক্টর রিচার্ড। দৃষ্টি পড়ল মহাকাশের বুকে জন্ম নেয়া তাঁর সাধনার ফসল এই কৃষ্ণগহ্বরের দিকে। এক ভিন্ন রূপে যেন ফুটে উঠছে তা অন্ধকার মহাকাশের বুকে! একটা অচেনা তরঙ্গের স্রোত যেন প্রবাহিত হয়ে চলেছে এর কেন্দ্রবিন্দু থেকে। সে অদ্ভুত স্রোত যেন একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে সমস্ত সৌরজগতকে। ডক্টর রিচার্ড একটা অদ্ভুত টান অনুভব করতে লাগলেন নিজের মধ্যে—
একইসাথে শারীরিক ও মানসিকভাবে ,তাঁর মন যেন এক অচেনা গতিতে এগিয়ে চলেছে ক্রমাগত ফেলে আসা অতীতের দিকে , আর তার শরীরে ঘটে চলেছে এক অদ্ভুত পরিবর্তন! বৃদ্ধ ডক্টর রিচার্ড সময়ের বিপরীত উজানে হারিয়ে গিয়ে ফিরে যাচ্ছেন তাঁর প্রৌঢ় বয়সে, আরো অতীতের দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন তিনি– প্রৌঢ়ত্ব থেকে যৌবনে এগিয়ে চলেছে তাঁর ক্লান্ত মন এবং জরাগ্রস্ত শরীর!
কিন্তু এখানেই আর থেমে থাকছে না সময়ের অদ্ভুত খামখেয়ালিপনা ,আরো পিছিয়ে যাচ্ছেন তিনি যৌবন থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে শৈশবে, উল্টো করে চালানো একটা সিনেমার রিলের মত তাঁর ফেলে আসা জীবনের বহু মানুষ যেন একে একে তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠছে আর তারই সাথে একে একে আবার এক গভীর অসীমতায় হারিয়ে যাচ্ছে, শৈশব থেকে আরো অতীতে হারিয়ে যাচ্ছেন তিনি!
একটা সময় তাঁর সমস্ত শরীর সংকুচিত হতে হতে শুধুমাত্র একটি ভ্রুণে পরিণত হল, আর তা থেকে শেষ অবধি শুধুমাত্র একটি কোষে,আর তারপর ডক্টর রিচার্ড এর আর কোনো অস্তিত্বই রইল না। সময়ের অদ্ভুত খামখেয়ালিপনায় মহাবিশ্বের এই যাত্রাপট থেকে মুছে গেলেন বৃদ্ধ বিজ্ঞান তাপস ডক্টর রিচার্ড।
কিন্তু সেখানেই থেমে থাকল না কৃত্রিম কৃষ্ণগহ্বরের অদ্ভুত পাগলামি। সমস্ত সৌরমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ল তার অদ্ভুত প্রভাব। গোটা সৌরমন্ডল ক্রমশ সময়ের অদ্ভুত গোলকধাঁধায় একটু একটু করে এক অজানা সময়ে হারিয়ে যেতে লাগল। আর সৌরমন্ডলের বাইরের একটি স্পেস স্টেশন থেকে টেলিস্কোপের লেন্সে চোখ রেখে এই অদ্ভুত পাগলামি দেখে বিস্ময়ে ,আতঙ্কে এবং সর্বোপরি নিদারুণ অসহায় ক্ষোভে ছটফট করে উঠল সেই স্পেসস্টেশন এর কর্ণধার এক ৩০ বছর বয়সী নবীন বিজ্ঞানী—
।২।
আমার নাম আদিত্য, আদিত্য রায়। কাজ কী করি? কাজ হিসেবে বলতে পারি সৌরমন্ডলের বাইরের এই স্পেসস্টেশনের কর্ণধারের দায়িত্ব পালন করা। যদিও আমার প্রকৃত দায়িত্ব এখন কী তা আমি নিজেও ভালোভাবে আর জানি না। বয়স কত আমার ? এটা ভারী সমস্যার প্রশ্ন করলেন মশাই। এক হিসেবে তা ৩৪ আর অন্য হিসেবে ৪০০৩৪ বছর। কী? আঁতকে উঠলেন নাকি ? কী করব বলুন? আমি নিজেও মাঝে মাঝে সবটা ভাবলে আঁতকে উঠতাম আগে।
এখন আর কোনো ভয় নেই, সে অনুভূতিটাই আজ ভেতর থেকে মরে গেছে। শুধু পড়ে রয়েছে এক প্রতিশ্রুতি এবং অপরিসীম দায়িত্ববোধ। প্রতিশ্রুতি নিজের গুরুর প্রতি আর দায়িত্ববোধ সমস্ত মানবজাতির প্রতি।
আজ থেকে ৪০০০০ বছর আগে সৌরমন্ডলের মধ্যে নবনির্মিত কৃষ্ণগহ্বরের যে অদ্ভুত পাগলামি ঘটেছিল তার প্রভাব পড়ে সমস্ত সৌরমন্ডলের উপর। অভিশপ্ত হয়েছিল সমস্ত মানব সভ্যতা। কিন্তু সব থেকে বড় অভিশাপ বোধ হয় পড়েছিল আমার উপর।
সে’দিন আমার শিক্ষক মহান বিজ্ঞানসাধক ডক্টর রিচার্ড যে আশংকা করেছিলেন তা বর্ণে বর্ণে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। সৌরমন্ডলের সীমার মধ্যেই কৃষ্ণগহ্বর নির্মাণের যে অবুঝ স্বার্থপর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাষ্ট্রনায়কেরা ,তার মাশুল সেদিন দিতে হয়েছিল সমস্ত মানবসভ্যতাকে। সদ্য তৈরি কৃষ্ণগহ্বর বদলে দিয়েছিল সৌরমন্ডলের মহাকর্ষীয় শক্তির ভারসাম্যকে। আর তার ফলেই দেশকালের বুনোটে এক অজানা পরিবর্তন ঘটে গিয়ে, ১০০০০ বছর পেছনে চলে গেছিল সমস্ত সৌরজগত।
মানবসভ্যতা নিজেদের সমস্ত সত্বা হারিয়ে ১০০০০ বছর আগের অতীতে চলে গিয়েছিল, আর শুধুমাত্র এক নীরব দর্শক হয়ে এই মহাবিনাশের সাক্ষি হয়ে রয়েছিলাম আমি। না। শুধু আমি একা নই, পৃথিবীর বুকে কয়েকটি স্থান যা পদার্থবিদদের সাধনায় “রক্ষক” তরঙ্গ দিয়ে সুরক্ষিত ছিল তারা ও কোনক্রমে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পেরেছিল, যদিও বহুদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারা। তাদের জীবন হয়ে উঠেছিল অভিশপ্ত। তাদের স্মৃতিতে বেঁচে রয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের যুগ কিন্তু তারা পৌছে গেছে ১০০০০ বছর আগের প্রাচীন অতীতে। তবুও হার মানেনি এই মানবসন্তানেরা। দুর্যোগের পর ওই কয়েকটি কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আবার তারা বিজ্ঞানের আলো,সভ্যতার দীপ্তি পৌছে দেওয়ার সংকল্প করেছিল এ গ্রহের প্রতিটি প্রান্তে।
এরপর কেটে যায় আবার একে একে দশ হাজার বছর। এই সময় নিজের প্রতিশ্রুতিকে বাঁচিয়ে রাখতে স্পেস স্টেশন এর সমস্ত কর্মীদের নিয়ে হাইবারনেশনে চলে যেতে হয় আমাকে। আশা করেছিলাম দশ হাজার বছর পর জেগে উঠে আবার নিজের চেনা পৃথিবীটিকে ফিরে দেখতে পাব। কিন্তু সেই আশা দুরাশা হিসেবেই রয়ে গেল।
দশ হাজার বছরের গভীর ঘুম থেকে উঠে যখন দেখেছিলাম পৃথিবীসহ সমস্ত সৌরজগতকে আবার সভ্যতার চূড়ান্ত শিখরে উঠে যেতে, যখন ভেবেছিলাম অবশেষে কৃষ্ণগহ্বরের অভিশাপ কেটে বেরিয়ে আসতে পেরেছে সমস্ত সৌরজগত, তখন আমার মূর্খামিতে হেসে উঠে আবার নিজের অভিশপ্ত সত্বার প্রকাশ ঘটিয়ে ছিল লুকিয়ে থাকা ওই কৃষ্ণগহ্বর। না এবার কেউ তা নির্মাণ করেনি। শুধু প্রকৃতির কোন আশ্চর্য লীলায় দশ হাজার বছর পরপর মানুষের হাতে নির্মিত ওই কালো অভিশাপ আবার নিজের পুরনো সত্বায় ফিরে আসে একটু একটু করে। আর অবশেষে ১০০০০ বছর পর ১৬ জুলাই এর সেই অভিশপ্ত দিনটিতেই আবার আত্মপ্রকাশ করে সে।
এই ভাবে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে গত ৪০০০০ বছর ধরে। প্রতি দশ হাজার বছর পর আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি। তাকিয়ে দেখি আমার চিরপরিচিত অথচ আজকের অচেনা সৌরজগতকে, অসহায়ের মত দেখি আবার তাকে অভিশপ্ত হতে, বোঝার চেষ্টা করি এই অভিশাপের মূল রহস্য, খোঁজার চেষ্টা করি এর কোনো প্রতিকার। তবে তা করি সৌরমন্ডল এর সীমারেখা থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে, কারণ একবার ওই সীমায় প্রবেশ করলে আমরাও হারিয়ে যাব সময়ের ওই গোলকধাঁধায়, একবার ওই চক্রব্যুহে প্রবেশ করলে তার থেকে বেরোনোর পথ আর নেই ,তাই শত ইচ্ছা সত্বেও আমরা ফিরে যেতে পারিনা নিজেদের এত সাধের ওই বসুন্ধরার বুকে।
বারংবার এক ঘটনা, একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। স্টেশন এর কর্মীরা যখন অধৈর্য হয়ে ওঠে , আমাকেই তাদের শান্ত করতে হয় ,বোঝাতে হয় আমাদের দায়িত্ব ,কর্তব্য, আমাদের অপেক্ষার মূল্য। তারপর আবার একদিন ঘুম থেকে উঠে গভীর উত্কন্ঠায় তাকিয়ে থাকতে হয় আশায় বুক বেঁধে।
তবে এই নিরাশার সমুদ্রেও আশার আলো অবশেষে জেগে উঠেছে। সত্য প্রমাণিত হতে চলেছে আমার পথ প্রদর্শনকারী সেই মহান বিজ্ঞানীর ভবিষ্যৎবাণী। প্রত্যেক কালবৃত্তে একটু একটু করে কৃষ্ণগহ্বরের প্রভাব কমছে সূর্যের অভিকর্ষের প্রভাবে। দিবাকর দিনমণি অবশেষে তার সংগ্রাম শুরু করেছে ওই কালো অভিশাপের বিরুদ্ধে , প্রবল যুদ্ধে নিজের রাজ্যকে শাপমুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে ,আর তার সাথে অতুল উত্কন্ঠা নিয়ে আমরা অপেক্ষা করছি তার বিজয়ের দিনটির স্বপ্ন নিয়ে, যে দিন অবশেষে এই মানব নির্মিত কালো অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে মানবসভ্যতা। আর অবশেষে আমরা ফিরতে পারব আমাদের নিজেদের গৃহে ,জানাতে পারব তাদের প্রকৃত ইতিহাস তাদেরকে, তুলে ধরতে পারব আমাদের এত সহস্রাব্দীর বিজ্ঞান সাধনার ফসল তাদের সামনে।
ডক্টর রিচার্ড পৃথিবীর প্রাচীন ভাষাগুলিকে ভালবাসতেন, তাদের কাহিনী পড়ে শোনাতেন আমাকে ,একবার তিনি আমাকে শুনিয়েছিলেন হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের এক রাক্ষসের কথা যে নাকি ৬ মাস ঘুমিয়ে ১ দিন জেগে থাকত।
আজ আমিও বোধ করি সেই একই জীবন যাপন করে চলেছি। বরং আরো বেশি অদ্ভুত এক জীবন। দশ হাজার বছরের নিদ্রা তারপর এক বছরের জাগরণ। তবুও আশার আলোয় ভর করে তাকিয়ে রয়েছি সৌরমন্ডলের নিয়ন্ত্রক শক্তি সূর্যদেবের দিকে। প্রতিদিনের মত আজও স্পেস স্টেশনের জানালা দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁর নামের সমার্থক নামের এই ক্ষুদ্র মানবসন্তান তাঁকে জানায় এক ভুলে যাওয়া ভাষায় প্রণাম…….
ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্।
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহষ্মি দিবাকরম্॥