গল্প ভয় অদিতি ভট্টাচার্য শরৎ ২০১৬

golpobhoy01 (Medium)

              অদিতি ভট্টাচার্য্য

সিনেমাটা দেখে এসে অবধি সুপ্রকাশবাবু স্বস্তিতে নেই। সিনেমাটার প্রশংসা ইদানীং সকলের মুখেই শুনছিলেন, খবরের কাগজে, পত্রিকাতেও তার সমালোচনা পড়েছেন। সবাই একবাক্যে বলেছে দারুণ সিনেমা। এরকম সিনেমা কমই হয়, তাই সুযোগ পেলে অবশ্যই দেখা উচিত। সবারই। ছেলে বুড়ো – সব্বার। সিনেমাটার জনপ্রিয়তার কারণে হিন্দিতে ডাবিংও হয়েছে।

সুপ্রকাশবাবু এমনিতে শান্তশিষ্ট মানুষ, হুজুগে মাতেন না বললেই চলে। কিন্তু এবার কী হল কে জানে রবিবার চলে গেলেন সিনেমাটা দেখতে। ঝাড়া একটি ঘন্টা লাইন দিতে হল টিকিটের জন্যে। কী ভিড়! কিন্তু সিনেমাটা দেখে বুঝলেন এ সিনেমা ওঁর জন্যে নয়। মানে উনি না দেখলেই ভালো হত। সিনেমা চলাকালীন হল থেকে উঠে আসতে পারেননি এরপর কী হয় দেখি করে। তাছাড়া যে সিনেমার জন্যে এক ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়েছেন তা পুরো না দেখলে আর কী হল! কিন্তু সিনেমাটা দেখার পর থকেই যে এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে আছেন তা বেশ বুঝতে পারছেন। খেয়ে, বসে, ঘুরে, ঘুমিয়ে – কিছুতেই শান্তি নেই।

সুপ্রকাশ ধাড়া নেতাজিনগর বয়েজ হাই স্কুলের ইংরিজির মাস্টারমশাই। অনেককাল পড়াচ্ছেন এখানে। বয়স হয়েছে। আর মাত্র দু’বছর এক মাস নাকি আছে অবসরগ্রহণ করতে। মানুষটা অতি শান্ত, নিরীহ এবং নির্বিবাদী। সারা স্কুলে একটা ছেলেও ওঁকে এক ফোঁটাও ভয় পায় না। বরং উঁচু ক্লাসের ধেড়ে বদমাশগুলোকে উনিই সমঝে চলেন। ক্লাসে পড়ানোর ব্যাপারে কোনো গাফিলতি করেন না ঠিকই কিন্তু ওঁর গলার আওয়াজ মাঝে মধ্যেই পেছনের বেঞ্চের ছেলেদের গুলতানির আওয়াজে চাপা পড়ে যায়। বাধ্য হয়েই তখন কন্ঠস্বর একটু চড়িয়ে “চুপ করো চুপ করো, কোয়ায়েট কোয়ায়েট” বলে বার দুই চেঁচান। সাময়িক কাজ হয় তাতে, তারপর আবার যে কে সেই। কিন্তু এর বেশি কিছু উনি করেও উঠতে পারেন না। জোর বকুনি দেওয়া বা চড়চাপড় মারা তো দূরের কথা।

প্রবল প্রতাপশালী হেডমাস্টারমশাই আর অঙ্কের কমলেশবাবু মাঝে মাঝে বলেন, “আর একটু কড়া হোন সুপ্রকাশদা। কিছু তো বলেন না আর এদিকে বাঁদরগুলো একেবারে মাথায় চড়ে বসছে।”

এ হেন শান্তশিষ্ট ইংরিজির মাস্টারমশাই সত্যিই দেখা যায় না। কিন্তু সুপ্রকাশবাবু এরকমই।

সিনেমা দেখে হল থেকে বেরিয়েই সুপ্রকাশবাবু বুঝলেন যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। লোকজনকেও সব বলিহারি বাবা! খালি বলে, “দারুণ সিনেমা, দুর্দান্ত!” ঠিক কী তা কেউ আর ভেঙে করে বলে না।

সুপ্রকাশবাবু দু চারজনকে চেপে ধরেছিলেন, “পুরো গল্পটা কী একটু খুলে বলুন তো।”

কিন্তু তাঁরা মোটে আমল দেননি, “তাহলে তো মজাই নষ্ট মশাই! এই তো ছায়াবাণীতে হচ্ছে, বাড়ির কাছেই তো, যান না রবিবার গিয়ে দেখে আসুন না!”

আর খবরের কাগজ বা পত্রিকার সিনেমা বোদ্ধারা যেসব সমালোচনা করেছেন তাঁরা তো আরো এক কাঠি ওপরে। গল্পের শুরুটা ভাসা ভাসা বলে খালি স্পেশাল এফেক্টস, লোকেশন এইসব হাবিজাবি বকেছেন আর কেউ দশে সাড়ে আট দিয়েছেন তো কেউ চারখানা তারা দিয়েছেন! যেন ক্লাস টেস্টের খাতা দেখা হচ্ছে! কিন্তু কেউ ঘুণাক্ষরেও বলেনি যে সিনেমাটাতে এই জিনিস আছে। একটু আভাস পেলে সুপ্রকাশবাবু জীবনে হলমুখো হতেন না। কক্ষণো না।

ইংরিজি সিনেমা। এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা আর তাঁর পোষা দুই তাগড়াই কুকুর নিয়ে। ভদ্রমহিলা একাই এক প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকেন দুই পরিচারিকাকে নিয়ে। প্রভূত সম্পত্তির মালকিন এই বৃদ্ধা। তাঁর বইয়ের সংগ্রহও দেখার মতো। ওঁর আত্মীয় পরিজনদের ধারণা যা সম্পত্তির খবর তাঁরা জানেন তার থেকে ঢের বেশি আছে ওঁর। বাড়িটার আনাচে কানাচেও নাকি রহস্যের শেষ নেই। এর মধ্যে হঠাৎই একদিন মারা গেলেন বৃদ্ধা। একটা উইল পাওয়া গেল। কিন্তু তাতে বিশ্বাস করল না অনেকেই, গোলমাল শুরু হল। এর পরপর কুকুরদুটোও হঠাৎ করেই মারা গেল। ভদ্রমহিলা মারা যাওয়ার পর তো তারা বলতে গেলে অন্নজল ত্যাগ করেছিল। এরপরই শুরু আসল গল্প। ভদ্রমহিলার আসল উইল কী করে খুঁজে পাওয়া গেল,  ওঁর মৃত্যু যে স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না, সম্পত্তির লোভেই যে হত্যা করা হয়েছে, কে বা কারা সেই হত্যাকারী, ওঁর মহামূল্যবান পান্নার নেকলেসই বা কে চুরি করেছিল – এসব আস্তে আস্তে জানা গেল। আর এসবই বার করল ওই কুকুরদুটোর বিদেহী আত্মা। সোজা কথায় কুকুরদুটো ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বাঘা বাঘা গোয়েন্দা, পুলিশ যার সমাধান করতে পারছিল না তা করল এরা!

এটাই সুপ্রকাশবাবুর অস্বস্তির কারণ। ভূতে বড়ো ভয় পান উনি। এই বয়সেও। সিনেমা তো মাত্র আড়াই ঘন্টার কিন্তু সুপ্রকাশবাবু ভুলতে পারলে তো? থেকে থেকেই কুকুরদুটোর চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কালো বিশালাকায়, চোখগুলো কীরকম যেন লালচে লালচে, রেগে যখন গজরায় মুখের ভেতরের ধারালো শ্বাদন্ত দেখা যায় – মনে পড়লেই শিউরে উঠছেন সুপ্রকাশবাবু।কী ভয়ংকর! লোকে যে একাধিকবার কী করে দেখছে তা তারাই জানে! রবিবার সিনেমা দেখে ফিরে আসা পর থেকে রাস্তার নেড়িগুলোকে অবধি সহ্য করতে পারছেন না সুপ্রকাশবাবু।

golpobhoy04সোমবার সকালে দুটো রাস্তার কুকুর পাঁচিল টপকে সুপ্রকাশবাবুর উঠোনে ঢুকে পড়েছিল। তাতে সুপ্রকাশবাবু “তাড়া তাড়া, শিগগির তাড়া, এক্ষুণি তাড়া, লাঠি নিয়ে যা” করে এমন চেঁচামিচি শুরু করলেন যে ওঁর গৃহ পরিচারিকা বাসন্তী খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “এমন করছেন যেন বাড়িতে চোর ডাকাত ঢুকেছে! কুকুর দেখে দিনে দুপুরে ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠছেন! কী হয়েছে আপনার কাকু?”

সুপ্রকাশবাবু তাড়াতাড়ি “কই কিছু হয়নি তো, কী আবার হবে। নোংরা করে রাখবে তাই তাড়িয়ে দিতে বলছি” বলে তখনকার মতো সামলে নিলেন বটে কিন্তু বেশ বুঝতে পারলেন গলা শুকিয়ে কাঠ। ঢুকেছে দুটো রোগা প্যাংলা লোম ওঠা নেড়ি আর উনি মনশ্চক্ষে দেখছেন কালো দশাসই দুটো কুকুরকে। সোমবার স্কুলেও বেশ অন্যমনস্ক ছিলেন। সবার চোখে সেটা ধরাও পড়ল। “কী হল সুপ্রকাশদা, কী এত ভাবছেন?” কমলেশবাবু তো জিজ্ঞেসই করলেন।

এইরকম করেই চলছিল। হয়তো আস্তে আস্তে ভয়টা কেটেও যেত। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধেয় যা হল তা আরো ভয়ংকর। সন্ধ্যেবেলা ঘরে বসে খাতা দেখছিলেন হঠাৎ ঘরের বাইরের জানলার কাছে কুকুরের ডাক। প্রথমে ঘেউ ঘেউ তারপর রাগে গজরানোর আওয়াজ। সুপ্রকাশবাবু এত চমকে উঠলেন যে হাত থেকে পেনটা মাটিতে পড়েই গেল। আবার কুকুর ঢুকেছে? কিন্তু এ ডাক তো রাস্তার নেড়ি কুকুরের ডাক নয়! এ একেবারে ভরাট আওয়াজ, পিলে চমকে যাওয়ার মতো! সুপ্রকাশবাবুর এক আত্মীয়র বাড়িতে অ্যালসেশিয়ান কুকুর ছিল একটা, সে এরকম করে ডাকত। আর আর সম্প্রতি এরকম ডাক শুনেছেন ……… সুপ্রকাশবাবু শিউরে উঠলেন। চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল কুকুরদুটোর চেহারা।

ডাকটা থামল কিন্তু মিনিটখানেক পরে আবার শুরু হল। সুপ্রকাশবাবুর ঘরের পূব দিকের জানলাটার ঠিক বাইরেই ডাকছে। এক চিলতে জমি আছে ওখানে, তার মানে ওখানেই এসে ঢুকেছে কুকুর। কিন্তু এরকম কুকুর তো আর রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায় না যে পাঁচিল টপকে এসে ঢুকবে? তাহলে? তার মানে ওই দুটোই? খাতা দেখা মাথায় উঠল। সুপ্রকাশবাবু ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন, খাটের ওপর সিঁটিয়ে বসে রইলেন।

কতক্ষণ যে এভাবে বসেছিলেন তা নিজেরই খেয়াল নেই, হঠাৎ একটা টিকটিকির বেশ জোরে টিকটিক আওয়াজে নড়েচড়ে বসলেন। চোখ খুলে বিছানা থেকে উঠে অনেক সাহস সঞ্চয় করে জানলাটা বন্ধ করে দিলেন। বন্ধ করতে করতেই শুনলেন আবার ডাকটা।

এখনও গরম তেমন পড়েনি। রাতে জানলা বন্ধ করে শুলেও পাখা লাগে না। জানলা বন্ধ করাতে তাই ঘুমের অসুবিধে হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সুপ্রকাশবাবু ঘুমোতে পারলেন না। খালি মনে হচ্ছে জানলার বাইরে কুকুর ওরকম গজরাচ্ছে কেন? কুড়ি বছর হয়ে গেল এ বাড়িতে বসবাস করছেন, কোনো দিন হয়নি, আজই হচ্ছে? সত্যিই কুকুর ঢুকেছে না অন্য কোন ব্যাপার? মানে যদি জ্যান্ত কুকুর না হয়? কিন্তু তারা ওঁর বাড়িতে আসবে কেন? অবশ্য এরকম অনেক ঘটনাই ঘটে যার ব্যাখ্যা বুদ্ধিতে দেওয়া যায় না। জানলা বন্ধ, তাও সুপ্রকাশবাবুর মনে হল যেন উনি শুনতে পাচ্ছেন কুকুরের গজরানি। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতেই সুপ্রকাশবাবু ভাবতে লাগলেন কখনো কোনোদিন কোনো কুকুরের ওপর অত্যাচার করেছেন কীনা। মনে পড়ল। তখন নতুন এসেছেন এ বাড়িতে। একটা কুকুর খুব উপদ্রব করত। বাড়ির ভেতরেও ঢুকে আসত। একদিন বিরক্ত হয়ে একটা ইঁটের টুকরো ছুঁড়ে মেরেছিলেন। নিখুঁত নিশানা। কুকুরটা কেঁউ কেঁউ করে আর্তনাদ করে গেটের ফাঁক গলে পালিয়েছিল। আর আসেনি। সেই কি তবে? রাস্তার কুকুর, কখন কোনটা মরছে, কোনটা কোথায় যাচ্ছে – কে খেয়াল রাখে! মরে ভূত হয়ে সে যদি এখন আসে প্রতিশোধ নিতে? সুপ্রকাশবাবু ঘামতে লাগলেন।

সারারাত প্রায় জেগেই ছিলেন। ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল। উঠতে বেলা হয়ে গেল। স্কুলে আর গেলেন না। অনেক ছুটি জমা হয়ে আছে, একটা ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে নিলেই হবে। হেডমাস্টারমশাইকে ফোন করে বললেন যে শরীরটা একেবারে জুতের নেই, স্কুলে আজ যেতে পারছেন না।

“সিজন চেঞ্জের সময়, ঠাণ্ডা গরমে সবার শরীর খারাপ হচ্ছে। নয়তো আপনার শরীর ভালো নেই – এ তো শোনাই যায় না। বিশ্রাম নিন,” বললেন হেডমাস্টারমশাই।

তা সত্যি কথা। অসুখ বিসুখ সুপ্রকাশবাবুর ধারে কাছে বড়ো একটা ঘেঁষে না। স্কুলে ছুটিও খুব কমই নেন।

“কী যে হয়েছে, কেন যে শরীর ভালো লাগছে না সে তো আর আপনাকে বলা যায় না,” নিজের মনেই বললেন সুপ্রকাশবাবু।

ততক্ষণে বাসন্তী এসে গেছে, কাজ করছে। বাইরে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। সুপ্রকাশবাবু বাইরে এলেন। বোধহয় দিনের বেলা বলেই এইটুকু সাহস জোটাতে পেরেছেন। ঘরের ওপাশে এক ফালি জমি, তাতে গোটা তিনেক নারকোল গাছ আর চারটে সুপুরি গাছ সার দিয়ে লাগানো। কতটুকুই বা জায়গা! নাহ এখানে তো এখন কোনো কুকুর টুকুর নেই, অবশ্য রাতে ঢুকেছিল কিনা তা তো আর এখন বলা সম্ভব নয়।

ফিরে আসছেন এমন সময় আবার কুকুর ডেকে উঠল! সেই একরকম ডাক! কী গলা! কী আওয়াজ! পা চালিয়ে চলে আসার আগে কোনরকম একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন সুপ্রকাশবাবু। নারকোল গাছের তলায় কিছু রয়েছে মনে হচ্ছে না? কালো কালো মতো? এক ঝলক দেখা দিয়েই যেন মিলিয়ে গেল! সুপ্রকাশবাবু আর দেরি করলেন না, দুদ্দাড়িয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে বৈঠকখানার সোফার ওপর বসে পড়ে হাঁফাতে লাগলেন। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে ঘরে গেলেন।

golpobhoy02 (Medium)

বাসন্তী তখন ঘর ঝাঁট দিচ্ছে, সব জানলাক’টা হাট করে খুলে দিয়েছে। সুপ্রকাশবাবু ঘরে পা দেওয়া মাত্রই আবার সেই ডাক, আবার সেই গজরানি।

সুপ্রকাশবাবু আঁতকে উঠলেন, কাঁপা কাঁপা গলায় বাসন্তীকে বললেন, “জানলা খুলেছিস কেন? বন্ধ কর, শিগগির বন্ধ কর। শুনতে পাচ্ছিস না কুকুর ডাকছে!”

বাসন্তী এক মনে ঝাঁট দিচ্ছিল। সুপ্রকাশবাবুর কথা শুনে কাজ থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল, অবাক হয়ে বলল, “কুকুর ডাকছে তো কী হয়েছে? কুকুর বেড়াল তো কতই ডাকে, তাই বলে জানলা বন্ধ করবেন কেন?”

“বন্ধ কর, বন্ধ কর, শিগগির বন্ধ কর,” দু হাতে কান চাপা দিয়ে সুপ্রকাশবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “বুঝছিস না কেন ও কুকুর যে সে কুকুর নয়! ওরে বাবা! বন্ধ কর, ওরে বন্ধ কর জানলাগুলো।”

বাসন্তী কয়েক সেকেণ্ড হাঁ করে দেখল সুপ্রকাশবাবুকে, তারপর হাতের ঝাঁটাটা সজোরে মেঝেতে ফেলে জানলা বন্ধ করতে লাগল। সুপ্রকাশবাবু তখনও দু হাতে কান চাপা দিয়ে বসে আছেন।

“কী কুকুর ডাকছে বাবা কিছুই তো বুঝলাম না। কুকুর বেড়াল তো ডাকেই। কথাগুলোও কেমন যেন ঠেকছে। এই বুড়ো বয়সে মাথার গোলমাল হল কীনা কে জানে! একা মানুষ থাকে, এসব হলে দেখবে কে? তাছাড়া সত্যিই পাগল টাগল হয়ে গেলে আমাকেও কাজ ছাড়তে হবে, কী জানি কখন কী করে বসে! কিছু তো হয়েইছে নাহলে এরকম করছে কেন?” বাসন্তী ঝাঁট দিতে দিতে নিজের মনেই গজগজ করতে লাগল।

সারা দিন যে বাড়িতে কী করে কাটল সুপ্রকাশবাবুর, তা আর কহতব্য নয়। ছোটো বাড়ি, দুটি মাত্র ঘর। এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সব জানলা বন্ধ, তাও মনে হচ্ছে সে আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন। আর যখন শুনতে পাচ্ছেন না তখন ভয় করছে এই বুঝি ডাকল, এই বুঝি ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজের ঘরে গিয়ে নিশ্চিন্তে শুতেও পারছেন না। কাউকে বলারও নেই। কে বিশ্বাস করবে? বাসন্তী কীরকম অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওঁকে দেখছিল তা এত কিছুর মধ্যেও ওঁর চোখে পড়েছে। ওপাশের বাড়িতে কেউ থাকলে তারা হয়তো শুনতে পেত কিন্তু সে গুড়েও বালি। ও বাড়ির মিত্রবাবুরা সবাই মিলে বেড়াতে গেছেন। বাড়ি ফাঁকা।

সারা দিন, সারা সন্ধ্যে  অন্য ঘরে কাটালেন। কিন্তু রাতে নিজের বিছানায় না শুলে ওঁর ঘুম হয় না। তাই আর উপায় না দেখে একখানা ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লেন যাতে ওসব আওয়াজে ঘুম না ভাঙে। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে সুপ্রকাশবাবু দেখলেন ওঁর ঘরের মধ্যে যেন কালো কালো বড়ো বড়ো দুটো কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে।

“বাবু, বাবু, ও বাবু…………”

কেউ ডাকছে?

সুপ্রকাশবাবু বেশ কষ্ট করে চোখ খুললেন। মাথার বালিশের পাছেই ছোটো টাইমপিসটা থাকে। পৌনে সাতটা নাজে। বাসন্তী তো এখন আসে না। তাহলে? কে এল?

সুপ্রকাশবাবু উঠে দরজা খুললেন। গোপাল। ওঁর ওই এক ফালি জমিটা পরিষ্কার করে রাখে, নারকোল, সুপুরি পেড়ে দেয়।

“কী হয়েছে গোপাল?”

“বাবু আমার ফোনটা হারিয়ে গেছে। পরশু……”

“এই তো কিনলে কিছু দিন আগে, এর মধ্যে হারিয়েও ফেললে! কোথায় হারিয়েছে? কোথাও ফেলে এসেছ নাকি দেখো। নাকি আবার নতুন কিনবে বলে……” সুপ্রকাশবাবু ভাবলেন নিশ্চয়ই সাহায্য চাইতে এসেছে।

“না না বাবু এখন ফোন কিনতে পারব না। মার অসুখ, হাসপাতালে ভর্তি করেছি, তাতেই কত খরচ! পরশু হারিয়েছে ফোনটা। তিনটে বাড়িতে কাজ করেছিলাম সেদিন। ওই দুই বাড়িতে খুঁজে দেখেছি নেই, আপনার বাড়িতে আর আসতেই পারিনি। মাকে নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করছিলাম। আজ এলাম, দেখি একবার যদি থাকে,” বলল গোপাল।

“বেশ তো দেখো বাগানে, যদি ফেলে যাও” বলে সুপ্রকাশবাবু ভেতরে চলে যাচ্ছিলেন, গোপাল আবার ডাকল।

“বাবু বলছিলাম কী আমি তো দেখবই, আপনি যদি আপনার ফোন থেকে একটা ফোন করেন আমারটায়। বাজলে খুঁজতে সুবিধে হবে।”

 “আচ্ছা দাঁড়াও নিয়ে আসছি আমার ফোন।”

সুপ্রকাশবাবুও বাগানেই এলেন ফোন নিয়ে। গোপালের নম্বরটা সেভ করা আছে, মাঝে মাঝেই তো দরকার হয়। ডায়াল করলেন নম্বরটা।

ঘেউ ঘেউ ঘেউ…… গররররর…… কুকুরের গজরানি। সুপ্রকাশবাবুর হাত থেকে ফোনটা পড়েই যাচ্ছিল আর একটু হলে। খুব জোর সামলেছেন।

golpobhoy03 (Medium)ওদিকে গোপালের দন্ত বিকশিত, এক গাল হাসি, “এখেনেই ফেলে গেছি বাবু। আরেকবার বাজান না।”

সুপ্রকাশবাবু কিছু বলার বা বোঝার আগেই গোপাল প্রস্তুত হয়ে গেছে। তরতরিয়ে উঠে পড়ল দ্বিতীয় নারকোল গাছটাতে যেটা সুপ্রকাশবাবুর ঘরের পূবদিকের জানলাটার একেবারে সামনে। নেমেও এল একটু পরে। তরতরিয়ে নারকোল, সুপুরি গাছে উঠতে গোপালের জুড়ি নেই।

“পরশু সকালে এলাম না আপনার নারকোল গাছগুলোকে ছাড়াতে, পকেটে ফোন ছিল। গাছের ওপরে যখন তখনই একটা ফোন এসেছিল। টুক করে কথা বলে আর পকেটে পুরিনি, পাতার খাঁজে রেখে দিয়েছিলেম। তারপর এক্কেবারে ভুলে গেছি,” বলল গোপাল, হাতে ফোনটা ধরা।

“তোমার ফোন নারকোল গাছের ওপরে ছিল? পড়ে যায়নি? আশ্চর্য তো!” সুপ্রকাশবাবু একেবারে থ।

কী মনে হতে গোপালের নম্বরটাই আবার ডায়াল করলেন। আবার সেই গজরানি।

“আমার ফোনের আওয়াজ বাবু,” গোপালের মুখে এখনও হাসি, হারা নিধি ফিরে পেয়ে।

“তোমার ফোনের এটা রিং টোন? এই কুকুরের ডাক?” সুপ্রকাশবাবু বেশ জোরেই বললেন।

“হ্যাঁ বাবু। ছেলে করে দিয়েছে। কী একটা নতুন সিনেমা এসেছে না, সবাই দেখতে যাচ্ছে? তাতে আছে। আমার বড়ো ছেলে কোত্থেকে পেয়ে আমার ফোনে করে দিয়েছে। ভালো হয়নি বাবু?”

“মোটেও ভালো হয়নি, খুবই খারাপ হয়েছে। কুকুরের ডাক কেউ রিং টোন করে! এর জন্যে কত কিছু হতে পারত তুমি জানো? এক্ষুণি বাড়ি গিয়ে ছেলেকে বলবে রিং টোন পালটে দিতে। তুমি নিজে এসব পারো বলে তো মনে হয় না। অন্য কিছু দিতে বলবে, গান বাজনা টাজনা কিছু, বুঝলে? এসব কুকুরের ডাকটাক নয়,” সুপ্রকাশবাবু একেবারে খিঁচিয়ে উঠলেন, তারপর একটু নরম হয়ে বললেন, “কী যেন বেশ বলছিলে, মার অসুখ, অনেক খরচ হচ্ছে, একশটা টাকা নিয়ে যেও।”

ছবিঃ মৌসুমী

অদিতি ভট্টাচার্যের আরো গল্প

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s