আবীর গুপ্ত
সুনন্দ পেশায় জিওলজিস্ট। সরকারি চাকরি করে। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের কাছে গোরাঙ্গি পাহাড় অঞ্চলে যতবারই ফিল্ড করতে গেছে ততবারই ওর মনে হয়েছে পাহাড়টায় চড়তে হবে। এর কারণ আছে। ও অ্যামেচার অর্নিথোলজিস্ট। সবসময় সঙ্গে থাকে বাইনোকুলার যা পাখি দেখা ও চেনার জন্য দরকার।
বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে পাখি খুঁজতে গিয়ে গোরাঙ্গি পাহাড়ের মাথায় একটা গুহা দেখতে পেয়েছে। এটাই ওকে আকর্ষণ করেছে। গুহাটায় না ঢুকতে পারলে ওর মনে শান্তি হচ্ছে না। গোরাঙ্গি পাহাড়ে ওঠা বেশ কঠিন কারণ পাহাড়টার চারপাশে ঢাল বেশ বেশি। চারপাশে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে ঐ পাহাড়ের মাথায় কেউ কোনদিন ওঠেনি। যদি ও উঠতে পারে তবে ও হবে প্রথম ব্যাক্তি। সমস্যা একটাই, ও মাউন্টেনিয়ারিং জানে না। জানলে ওঠা কঠিন হত না। কিন্তু ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, পাহাড়ের মাথায় উঠতেই হবে। ওর সঙ্গে যে দুটো লোকাল ছেলে কাজ করছে তারা বেশ এফিশিয়েন্ট।
ও সমস্যাটা বলতেই ওরা সব ব্যবস্থা করে ফেলল। ঠিক হল ওদের একজন আগে আগে উঠবে, খানিকটা উঠে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেবে, সেই দড়ি ধরে অন্য ছেলেটির সাহায্যে সুনন্দ উপরে উঠবে।
গোরাঙ্গী পাহাড়ের সব দিকই ঢাল বেশি এবং জঙ্গলে ঢাকা। সুনন্দ পাহাড়ের ঢাল যেদিকে অপেক্ষাকৃত কম মনে হল সেদিক দিয়েই ওঠা শুরু করল। গাছের ডালপালা ধরে উঠতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। একটি ছেলে আগে আগে উঠে গাছের গুড়িতে দড়ি বেঁধে দড়ি ঝুলিয়ে দিচ্ছে। সেই দড়ি ও কোমরে বেঁধে উঠছে। হাত ফস্কে গেলেও পড়ে যবার চান্স নেই। সঙ্গে থাকা দ্বিতীয় ছেলেটি ওকে পাহাড়ে উঠতে সাহায্য করছে। গুহার মুখ থেকে ফুট চল্লিশেক নিচে শুরু হল খাড়াই। ঢাল অত্যন্ত বেশি। সুনন্দ কী করে যে গুহার মুখের কাছে পৌঁছল তা ও নিজেই জানে না। গুহার মুখটা ছোট হলে কি হবে, ভিতরটা চওড়া আর ছাদ বেশ উঁচুতে। মেঝেটা সমতল। সুনন্দ গুহার ভিতর ঢুকে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। গুহার ভিতরটা উঠে দেখার মতন শারীরিক ক্ষমতা ওর এ মুহূর্তে নেই।
২
প্রায় মিনিট পনের গুহার মেঝেতে শুয়ে থাকার পর উঠে বসল। প্রথম যে বিষয়টা ওকে অবাক করে দিল সেটা হল গুহার মেঝেতে একফোঁটা ধুলো নেই। এটা কীভাবে সম্ভব!
তাহলে কি এই গুহায় মানুষ জাতীয় প্রাণীর যাতায়াত আছে? চিন্তিত হয়ে উঠে দাঁড়াল, চারপাশে তাকিয়ে দেখল গুহার ছাদে অজস্র বাদুড় ঝুলছে। ও উঠে দাঁড়াতেই কয়েকটা বাদুড় ডানা ঝাপটানো শুরু করল। গুহায় বাদুড় থাকবে এটা তো স্বাভাবিক তাই ও এই নিয়ে চিন্তা করল না।
ভিতরদিকে গুহাটা ক্রমশ চওড়া হয়ে গেছে। ও এগিয়ে চলল। সঙ্গের ছেলেদুটোকে ওর সঙ্গে আসতে বলল। ওকে যেটা অবাক করছিল সেটা হল গুহার ভিতরের দিকে বাদুড়ের অনুপস্থিতি, যেটা অস্বাভাবিক। ভিতরটা অন্ধকার নয়। কোন দিক দিয়ে আলো আসছে। একটা হালকা আলো গুহার ভিতরটা আলোকিত করে রেখেছে। ঐ আলোতে সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। ঐ আলোতেই দেখতে পেল গুহার মাঝামাঝি জায়গায় এক বিরাট গহ্বর যার ব্যাস ১৮ থেকে ২০ ফুট হবে।
ও সামনে এগিয়ে গিয়েই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। গহ্বরের ভিতরের দেওয়ালে একটা বেশ চওড়া ঘোরানো সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে। এই সিঁড়ি প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হতে পারে না, ডেফিনিটলি ম্যানমেড। নীচে কোন বিপদ আপদ থাকতে পারে। ওর মন ওকে নীচে নামতে বলছে। সঙ্গের ছেলে দুটোকে সঙ্গে নেওয়া ঠিক হবে না, কোন বিপদ ঘটলে ওদের আত্মীয়স্বজনের কাছ মুখ দেখানো যাবে না।
ও একাই নীচে নামবে বলে ঠিক করল। ছেলে দুটোকে বলল উপরেই অপেক্ষা করতে। ঘন্টাদুয়েক অপেক্ষা করার পরও যদি ও না ফেরে তাহলে গুহার বাইরে গিয়ে পাহাড় থেকে নিচে নেমে লোকাল লোকের সাহায্য নিতে। ছেলে দুটো ওর কথায় রাজি হচ্ছিল না, কিন্তু ও জোর দিয়ে বলায় মানতে বাধ্য হল।
ও সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করল। নামছে তো নামছেই সিঁড়ির শেষ নেই। যত নিচে নামছে তত আলো বাড়ছে। এই আলো সাদা আলো। হঠাৎ সিঁড়ি শেষ হল। দেখল আলোয় আলোকিত একটা বিরাট হলঘরের মাঝে ও দাঁড়িয়ে আছে। হলঘরের একধারে একটা বিরাট স্ক্রিন আর তার সামনে একটা টেবিলের মতো প্যানেলে যাতে ভর্তি স্যুইচ। একটি অদ্ভুত দর্শন প্রাণী টেবিলের সামনে একটা অদ্ভুত ছক্কার মতন দেখতে টুলের উপর বসে স্যুইচ টেপাটেপি করছে। প্রাণীটার একটা বিরাট ফুটবলের মতন মাথা, দেহটা ছোট্ট আর তা থেকে আটটা শুঁড় বা হাত বেরিয়ে এসেছে। এই শুঁড় দিয়েই স্যুইচ টেপাটেপি করছে। ওর দিকে মাথা না ঘুরিয়ে, মুখ না ফিরিয়েই পরিষ্কার বাংলায় বলল, “সুনন্দবাবু, ওয়েলকাম টু মাই হাউস। আমার বাড়িতে স্বাগত। আমি তোমারই অপেক্ষায় বসে আছি।”
শুনে সুনন্দ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
একটা হাসির আওয়াজ, প্রাণীটা ওর দিকে ঘুরে বসে বলল, “অবাক হয়েছ? আমার ইচ্ছাশক্তির জোরেই তুমি এসেছ। তোমাকে আমার প্রয়োজন। বয়সে অনেক বড়ো, তাই তুমি করে বলছি।”
সুনন্দ মনে মনে ভাবল, “এরা কারা? কোথা থেকে এসেছে?”
প্রাণীটা হাসতে হাসতে বলল, “আমরা থট্ রিডিং জানি। তুমি ভাবছ আমরা কারা, কোথা থেকে এসেছি? সব বলব বলেই তোমাকে এখানে আনানো হয়েছে। তোমাদের গ্যালাক্সির বাসিন্দা আমরা নই। আমরা অন্য একটা গ্যালাক্সির বাসিন্দা। আমাদের গ্রহের নাম বললাম না কারণ সেই নাম তোমরা উচ্চারণ করতে পারবে না। আমাদের গ্রহের জন্ম প্রায় ৮০০ কোটি বছর আগে। আমার মতো প্রাণীদের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় সাতশো কোটি বছর আগে। তারপর থেকেই আমরা নজর রাখছিলাম অন্য গ্রহের উপর। আমাদের চোখের সামনেই প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে জন্ম হল পৃথিবীর। সে সময়ে আমাদের মনে হয়েছিল পৃথিবীর আবহাওয়া হয়ত আমাদের গ্রহের মতই হবে। আমার কথা বোধহয় তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমরা মিথ্যা কথা বলি না, মিথ্যা বলতেও জানি না। যা বলছি সব সত্যি কথা। আমরা নানা সময়ে নানাভাবে পৃথিবীর জীবেদের উন্নতি করার চেষ্টা করেছি। আমাদের বিজ্ঞান তোমাদের থেকে অনেক অনেক উন্নত। আমাদের কাছে তোমারা এখন শৈশব অবস্থাতেই আছ। যাই হোক যা বলছিলাম, পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটল এককোষী প্রাণীর। কীভাবে আবির্ভাব ঘটল তা তোমরা এখনও ঠিকভাবে বুঝতে পারনি। এই এককোষী প্রাণী আমরাই পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিলাম। আমরা বিবর্তনের ধারাকে বিবর্তনকে কনট্রোল করতে পারি। বিবর্তনে এককোষী প্রাণী থেকে এল উদ্ভিদ আর জলে এল মাছ। এই মাছ থেকে কালক্রমে এল উভচর প্রাণী আর তার থেকে সরীসৃপ। এদিকে বিবর্তন যখন চলছিল তখন আমাদের গ্রহ থেকে ডিসিশন নেওয়া হল বিবর্তনের ধারাকে কনট্রোল করার জন্য পৃথিবীতে আসা দরকার। আমাকে নির্বাচিত করা হল। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ এটা আমাদের স্পেশশিপ। তোমাদের ভূতত্ত্বীয় সময়সরণীতে ট্রায়াসিক যুগ শুরু হওয়ার ঠিক আগে অর্থাৎ এখন থেকে আনুমানিক ২৬ কোটি বছর আগে আমি চলে এলাম পৃথিবীতে। আমার স্পেশশিপ নামল এখানে। শুরু হল ট্রায়াসিক যুগ। আমার স্পেশশিপের আশপাশ দিয়ে এমনকি উপর দিয়েও বয়ে যাচ্ছিল নদীর জল। নদী জমা করছিল পলিমাটি আর বালি। ভেবেছিলাম এই পলিমাটি আর বালি কেটে স্পেশশিপ বেরোতে পারবে। ভুল ভেবেছিলাম। সে-প্রসঙ্গে পরে আসছি।”
৩
সুনন্দ শুনতে শুনতে ভাবছিল উপরে অপেক্ষা করে থাকা ছেলেদুটোর কথা। প্রাণীটি ওর ভাবনা বুঝতে পেরে বলল, “ওদের নিয়ে চিন্তা নেই। ওরা এখন অজ্ঞান অবস্থায় আছে। আমার রোবোপ্রাণী ওদেরকে গুহার বাইরে নিচের রাস্তায় রেখে আসবে। ওদের যখন জ্ঞান ফিরবে তখন ওরা গুহার কথা মনে করতে পারবে না। যা বলছিলাম। সরীসৃপদের চেহারা ট্রায়াসিক যুগের প্রথম দিকে যা ছিল তা দেখে আমাদের মন ভরল না। পৃথিবী শাসন করার জন্য দরকার বুদ্ধিমান প্রাণীর। অথচ ওদের বুদ্ধিশুদ্ধি সেরকম ছিল না। তাই অন্ত্য ট্রায়াসিকে আনুমানিক ২৩.৫ কোটি বছর আগে আমি ডাইনোসরদের পৃথিবীতে আনতে বাধ্য হলাম। এদের চেহারা ছোট থেকে অতি বিশাল করলাম। কিন্তু মনে একটা সন্দেহ থেকেই গেল। তাই ট্রায়াসিক যুগের শেষ দিকে এখন যেখানে মধ্যপ্রদেশের বেওহারি শহর তার কাছাকাছি একজায়গায় আবির্ভাব ঘটালাম প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণীর। সরীসৃপ থেকে বিবর্তনে এসে ছিল স্তন্যপায়ী সদৃশ্য সরীসৃপ সাইনোডন্ট। এই সাইনোডন্ট থেকেই আবির্ভাব ঘটালাম ইদুঁরের মাপের স্তন্যপায়ী প্রাণীর। পৃথিবীর নানান জায়গায় এদের আর্বিভাব ঘটলেও সর্বপ্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল মধ্যপ্রদেশের বেওয়ারি শহরের কাছে। যার ফসিল তোমাদের বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়ে নাম দিয়েছে গন্ডোয়ানাডন তপনী। এই স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রাচীনতম পূর্বপুরুষ সাইনোডণ্টও তোমরা খুঁজে পেয়েছ পুরুলিয়া জেলার ডুমডুমি গ্রামের কাছে। তোমরা আদর করে নাম দিয়েছে পাঞ্চেতোসাইনোডন দামোদরেন্মিস। এই ফসিলটি সম্ভবত তোমাদের বিজ্ঞানীমহলে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে কারণ এটির আবির্ভাব যে সময়ে ঘটেছিল যে সময়ে, আদি ট্রায়াসিক যুগে, এত উন্নতমানের দাঁতের গঠন কল্পনা করা যায় না। যাই হোক, এই সময়ে পৃথিবীতে রাজত্ব করা শুরু করল ডাইনোসররা। তোমাদের হিসাবে এককোটি বছর আমাদের গ্রহ থেকে আমাকে বলা হল ফেরত যাবার জন্য। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। স্পেশশিপের উপর যে বিপুল পরিমান পলিমাটি আর বালি জমা পড়েছিল তা ততদিনে কোটি কোটি বছরে প্রচন্ড চাপে ও তাপে পাথরে পরিনত হয়েছে। অতটা পুরু পাথর কেটে স্পেশশিপ বার করার ক্ষমতা আমার স্পেশশিপের ছিল না। তাই, আমি আটকে গেলাম পৃথিবীতে। পাথর কেটে বানালাম গুহা আর সিঁড়ি। সে সময়ে পৃথিবীতে রাজত্ব করছে বিশালদেহী ডাইনোসররা। আথচ, ওরা বুদ্ধিমান প্রাণী নয়। আমরা চাইছিলাম আমাদের মতন বুদ্ধিমান প্রাণীর যারা বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা কনসেনট্রেট করলাম স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উপর। আমাদের ধারনা হল এদের থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী পাওয়া সম্ভব? এদিকে সেসময়ে আকাশ আর জলেও সরীসৃপরা দখল নিয়ে নিয়েছিল।”
৪
সুনন্দ ভাবছিল প্রাণীটা এত সুন্দর বাংলা বলছে কীভাবে! প্রাণীটির হাসির আওয়াজ শুনল। শুনল বলছে, “আমি পৃথিবীর সব ভাষায় কথা বলতে পারি। এটা আমাদের বিশেষ গুণ।”
সুনন্দ প্রাণীটির দিকে তাকাল। দুটো বড়ো বড়ো প্যাঁচার মতন চোখ ছাড়া রয়েছে সরু ঠোঁটের মতন মুখ। নাক নেই। প্রাণীটি বুঝতে পেরে বলল, -“আমাদের নাসারন্ধ্র রয়েছে আমাদের হাতের ডাগায়। তোমরা জিভের সাহায্যে যে কোন খাবারের টেস্ট বুঝতে পার। আমরা বুঝি স্পর্শ করে। যাই হোক যা বলছিলাম। তোমাদের হিসাবে আনুমানিক সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে আমাকে পৃথিবী থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর পৃথিবীর প্রাণীদের স্যাম্পেল নেওয়ার জন্য দুটি বিশাল বড়ো মাপের স্পেশশিপ পাঠানো হল। দুটিই ধ্বংস হয়ে গেল। একটি পড়েছিল এখন যেখানে মেস্কিকোর চিষ্মকুলাব শহর যেখানে আর অন্যটি পড়েছিল যেখানে এখন সেখানে ভারতের সমুদ্র বিরাজ করছে। ঘটনাটিকে তোমাদের বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করল উল্কাপাত হিসাবে। ভয়ঙ্কর প্রলয় হল। সেই প্রলয়ে ডাইনোসর, উড়ন্ত সরীসৃপ আর জলচর সরীসৃপরা সব ধ্বংস হয়ে গেল। এটাকেই তোমাদের বিজ্ঞানীরা বলছেন মাস্ এক্সটিংকশ্ন বা সার্বিক অবলুপ্তি।
আমরা ততদিনে বুঝে গেছি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের থেকেই বুদ্ধিমান প্রাণী পাওয়া সম্ভব। তাই ওদের মাস্ এক্সটিংকশন থেকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিলাম। বিবর্তনের ধারায় এল বনমানুষ। এত সময় লাগছিল বিবর্তনে যে আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। তাই মাঝের একটা স্টেজ সেই স্টেজটাকে তোমরা মিসিং লিংক বলেছ, যার ফসিল তোমরা নাওনি, সেই স্টেজটাকে আসতে না দিয়ে সরাসরি নিয়ে এলাম আদিম মানুষকে। আবির্ভাব ঘটল পৃথিবীতে সবচাইতে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষের।
মানুষের বিবর্তন, বিজ্ঞানের অগ্রগতি শুরু হল। আমি সবকিছুর উপর কড়া নজর রাখা শুরু করলাম। সাহায্য করলাম মানুষকে বিজ্ঞানকে উন্নত করার জন্য। তাদেরকে পথ দেখালাম। হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো বা মিশরের সভ্যতা- এত উন্নতি ওরা করেছিল কীভাবে? আমি ওদের সাহায্যে করেছিলাম। তুমি খেয়াল করে দেখ, ঐ সব জায়গায় বিজ্ঞানের অগ্রগতি পৃথিবীর অন্য জায়গার তুলনায় অস্বাভাবিক বেশি ভাবে হয়েছিল। পরবর্তীকালে তোমাদের আমলেই কয়েকজন নির্দেশিত পথে ওঁরা যা বানাবেন তা সমাজের কল্যানে ব্যবহৃত হবে। হল উলটো। ওঁরা বানালেন অ্যাটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, যা ব্যবহার করা হল মানুষকে, সভ্যতাকে ধবংস করার জন্য। আমি একজন জার্মান এরিক ফন দানিকেনকেও সাহায্য করেছিলাম। উনি সব জেনে সেকথা বই লিখে পৃথিবীবাসীকে জানালেন। নানান প্রমানও দিলেন। তোমাদের দেবতারা যে অণ্যগ্রহের প্রাণী তা লিখে জানানোয় বিজ্ঞানীরা ওকে ধিক্কার জানালেন। তোমাদের দেবরাজ ইন্দ্র আসলে আমার সৃষ্ট রোবোমানুষ। ওর সাদা হাতি ঐরাবত আমারই তৈরি। সাদা আমাদের প্রিয় রং, তাই হাতিটির রঙ সাদা করেছিলাম।”
৫
সুনন্দ নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখল, ও যা দেখছে শুনছে তা সব সত্যি তো, নাকি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে। প্রাণীটির নাম কী? ওকে এখানে ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে টেনে আনার কারণটাই বা কী? প্রাণীটি হেসে বলল, “আমার যা নাম তা তোমার জিভে আসবে না। ধর আমার নাম অ্যান। তোমাকে এখানে আনার উদ্দেশ্য একটা আছে। পৃথিবীর মানুষের যে অধঃপতন ঘটেছে তাই দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। কী চেয়েছিলাম কী হল! কোথায় মানুষেরা একে অপরকে সাহায্য করে গড়ে তুলবে এক উন্নত সমাজ, যেখানে হিংসা, লোভ, রেষারেষি, খুনোখুনি থাকবে না। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হবে মানুষের কল্যানে। তা না হয়ে, হচ্ছে সব উলটো। তোমাদের কথামতো “কলিযুগ” চলছে। এই কলিযুগের অবসান দরাকার। সৃষ্টি হওয়া দরকার নতুন প্রজন্মের নতুন রকমের বুদ্ধিমান প্রাণীর। যাদের মধ্যে এই সব দোষ একদমই থাকবে না। এ-কারণেই তোমার সাহায্য ছাড়া এ-কাজ সম্ভব নয়।”
সুনন্দ একটু অবাক হয়েই বলল, “আমি সাহায্য করব! কীভাবে? আপনারা এত উন্নত, নিজেই তো ব্যবস্থা করতে পারেন।”
“না পারি না। আমার সৃষ্ট রোবোমানুষরা এতটাই বুদ্ধিমান যে ওরা ঐ বস্তুটি ব্যবহারই করবে না। ওরা মানুষের সংস্পর্শে এসে অত্যন্ত স্বার্থপর আর ক্ষমতালোভী হয়ে উঠেছে। আমার তৈরি বস্তুটি ওরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাজে লাগাবে।”
“বস্তুটি কী? কোন অস্ত্র?”
সেটা না জানলেও চলবে। বস্তুটি একটা ক্রিকেট বলের মতন। ভুলেও ওতে জল লাগাবে না। আমাদের গ্রহে জল নেই, তাই জল আমরা সহ্য করতে পারি না। এজন্য আমাদের পিপাসা পেলে আমরা বাষ্প বাতাস থেকে টেনে নিই। ঐ বস্তুটি নিয়ে বাইরে, মুক্ত আকাশের নিচে কাটাতে হবে। তুমি নতুন প্রজন্মের মানুষ, শিক্ষিত এবং উদার মনের। তুমি নিশ্চয়ই চাও পৃথিবীতে নতুন ধরনের, নতুন রকমের বুদ্ধিমান প্রাণীর আবির্ভাব ঘটুক। আমার অন্তিম সময় উপস্থিত হয়েছে। আমি মৃত্যু চেয়েছি। যদিও আমাদের মৃত্য হয় না। আমাদের মৃত্যু ইচ্ছামৃত্যু। তোমাদের ভীষ্ম আমারই দেওয়া শক্তিতে বলিয়ান ছিল। ওঁকে অমর করেছিলাম। কেবল ইচ্ছামৃতুই ওকে মৃত্যু দিতে পারত. দুর্ভাগ্যক্রমে ও ইচ্ছামৃত্যুই বেছে নিল। যাই হোক, এই সহজ কাজটা করতে আশা করি তোমার অসুবিধা হবে না। আমার কনট্রোল প্যানেলের উপর বস্তুটি রাখা আছে। নিয়ে নাও।”
৬
সুনন্দ একটু ইতস্তত করে এগিয়ে গেল কনট্রোল প্যানেলের দিকে।” কনট্রোল প্যানেলের উপর রাখা ক্রিকেট বলের মতন দেখতে বস্তুটিকে তুলে নিল। শুনল অ্যান বলছে, “খুব সাবধানে নিতে হবে, কোথাও ঠোকাঠুকি লাগলে কিন্তু ফেটে যাবে। এই জিনিসটা একটাই আছে আর নেই। এখানে এটা বানানোও সম্ভব নয়।”
“আপনি এখানে এটা ব্যবহার করছেন না কেন?”
“এখানে ব্যবহার করলে পৃথিবীবাসীর কোন লাভ হবে না। উলটে আমার স্পেশশিপ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমিও থাকব না। পৃথিবীবাসীর ভালো যারা চায় তাদের একজন হিসাবে তুমি কি সেটা চাও? কনট্রোল প্যানেলের ডানদিকে সরু একটা পথ আছে। ঐ পথে সোজা পাথরের বাইরের রাস্তার পাশের জঙ্গলে গিয়ে পড়বে। ঐ পথে বেরিয়ে যাও। তোমাদের শুভ হোক।”
সুনন্দ হাতে বলটা নিয়ে ভাবছিল অ্যানের কথা। প্রাণীটা একা থাকতে থাকতে হয়তো কিছুটা বদলে গেছে, খ্যাপাটে হয়ে উঠেছে। যেহেতু ভাবনা বুঝতে পারে তাই এখানে ভাগ চলবে না। সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবছিল পৃথিবীর কথা, পৃথিবীর মানুষের কথা। পৃথিবী কত সুন্দর। লোভ, হিংসা, রেষারেষি, খুনোখুনি যেমন আছে তেমনই ভালোবাসাও আছে। ও নিজেই তো কত মানুষের আকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছে। এরকম ভালোবাসা কি অ্যান জাতীয় অতি উন্নত প্রাণীদের মধ্যে আছে? বোধহয় নেই। তাই, ওরা ভালোবাসা কাকে বলে জানে না, কাউকে ভালোবাসতেও জানে না। ওকে দিয়ে পৃথিবীবাসীকে ধ্বংস করতে চাইছে। ওদের বিজ্ঞান ধ্বংসের পরে গড়ে তুলবে নতুন বুদ্ধিমান প্রাণী। তাদের মধ্যে কি ভালোবাসা থাকবে? দেখার জন্য সুনন্দ কেন কোন মানুষই থাকবে না। এটা হতে দেওয়া যায় না। অ্যান বেঁচে থাকলেও বিপদ, ও একাজ না করলে অন্য কাউকে দিয়ে করবে।” সুনন্দ যখন এসব ভাবছিল তখন মনের উপর প্রচন্ড একটা চাপ টের পেল। অ্যান ওকে ঐ বোমাটাকে ফাটানোর জন্য মানসিক চাপ দিচ্ছে। যা সহ্য করা যাচ্ছে না। ওর খালি ইচ্ছা করছিল ছুটে বাইরে বেরিয়ে বোমাটাকে মুক্ত আকাশে ছুড়ে ফাটাতে। কিন্তু, যা করল সেটা উলটো। সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে গেল ভিতরে নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে স্পেশশিপের ভিতরে ঢুকে পড়ল। অ্যানকে দেখতে পেল, খেয়াল করল ওকে মানসিকভাবে প্রাভাবিত করার চেষ্টা করছে। আবার সুড়ঙ্গে ঢুকেই স্পেশশিপের ভিতর বোমাটাকে ছুঁড়ে দিয়ে দুহাতে কান ঢাকল। কোন শব্দ হল না। শুধু আলোকরশ্মির খেলা। স্ট্রং ম্যাগনেটিক ওয়েভের খেলা।
স্পেশশিপ পুরো ধ্বংস হয়ে গেলেও সুনন্দ আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গেল। যদিও ওর শরীর পাথরের ধুলোতে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। বাইরে এসে দেখল গোরঙ্গীপাহাড় যেমন ছিল তেমনই আছে শুধু গুহাটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ছেলেদুটো বাইরে ওর অপেক্ষায় বসেছিল, ওদেরকে বলল, “চল, যাওয়া যাক। উঃ, যা একটা ঝামেলায় পড়েছিল। আপাতত স্নান করা দরকার।”
ওদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুনন্দ ভাবছিল ওর যা অভিজ্ঞতা হল তা কোনদিন ভুলতেও পারবে না, কাউকে বলতেও পারবে না। বললে বিশ্বাস করবে না। তার জায়গায় ভুলে যাবার চেষ্টা করাই ভালো। শুধু একটাই আনন্দ-ও পৃথিবীকে বাঁচাতে পেরেছে।
শীর্ষচিত্রঃ মৈনাক দাস