গল্প রাক্ষসের বন্ধুরা অপর্ণা গাঙ্গুলী শীত ২০১৭

 

অপর্ণা গাঙ্গুলীর আরো গল্প- ছেলে আর দয়ালু কুমির   বোতলের ভূতুয়া    কেজো ভূতের গল্প

এক রাক্ষস।  তার মনে ভারী দু:খ। কারণ, তার কোনো বন্ধু নেই। অথচ সে সবার সাথে বন্ধুত্ব করতে ভালবাসে। পারলে, এর ওর দিকে তাকিয়ে হাসে, কথা কয়। কিন্তু বনের সব্বাই মায় বাঘ সিংহগুলো পর্য্যন্ত ‘ভাগ ভাগ ওই বুঝি রাক্ষস এলো, ধরল,’ বলে ছুটে পালায়।

তা রাক্ষস আর কী করে। মনের দু:খে গাছের ফলমূল পেড়ে খায় আর চুপ করে একটা বড় টিলার উপর বসে বসে গুন গুন করে। দু:খের গান। সেই বনে গাছ কাটা বারণ, তাই গাছের পাতা ডাল যা ভেঙে পড়ে থাকে, তাই কুড়িয়ে নিয়ে যায় কুড়ানির দল। পুরুষ, নারী আর তাদের ছেলেমেয়েরা সব এক সুরে কেমন গান গায়। রাক্ষস একদিন হেঁড়ে গলায় তাদের সাথে গলা মেলাতে চেষ্টা করেছিল। আর তাই শুনে তাদের সে কি হাসি। হা হা হো হো করে হাসতে হাসতে সব্বাই মিলে ছুট লাগিয়েছিল বনের বাইরে হুই সে তিনমুখো পাহাড়ের তলে, যেথায় তাদের ডেরা, সেই দিকেই। লজ্জায় আর রাক্ষস কোনদিন গান গায়নি। তাই তো বলি, কোনভাবেই সুবিধে করতে পারে না রাক্ষস, বন্ধুত্ব করতে পারে না কারও সাথেই। মনমরা রাক্ষস একটা গুহার ভেতর থাকে, আর গাছের ডাল দিয়ে তৈরী একটা বিকট রকমের বাজনা বাজায়, মন খুব খারাপ হলে।

সেই সব শুনে কাঠবেড়ালিরা লেজ তলে পুটুরপাটুর তাকিয়ে দে হাওয়া। বুলবুলি গুহার সামনের গাছের ডালে দোল খায়, শিস দেয়, তবে যেই রাক্ষস তার সেই ভয়ংকর বাজনা বাজিয়ে বুলবুলিকে খুশি করতে চায়, মনে ভাবে, বুলবুলি খুশি হলেই তার বন্ধু হয়ে যাবে, অমনি বুলবুলি ফুরুত। এমন কি সেই বদমেজাজি লেজ মোটা লাল রঙা শেয়ালটা যে বনের অন্য সমস্ত পশুর সাথে ঝগড়া করে বেড়ায়, সে পর্যন্ত ওই রাক্ষসটার ধারেপাশে আসতে চায় না। কেবল ইয়া বড় জিভ বের করে দূর থেকে দেখে আর লেজ উঁচিয়ে ছুট লাগায় নিজের গর্তের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সবাই যে এত ভয় পায় ওই রাক্ষসকে, রাক্ষস তো কাউকেই ভয় দেখায় না, দেখাতে চায় না। সে শুধু ভালবাসতে চায় ওদের সকলকেই, কাছে টানতে চায়, বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে ধরতে চায় সব পশু, পক্ষী, মানুষজনকেই।

শুধু গাছদের সাথে এখন বন্ধুতা রাক্ষসটার। কদম গাছ কদম ফুল ফেলে তার গায়ে, হলুদ নরম ফুল রাক্ষস তার কানে, মাথায় গোঁজে, সাজগোজ করে, আর সব্বার হাসির খোরাক হয় বেচারা। আম গাছ জাম গাছ কাছে গেলেই ফল ফেলে দেয় এত্ত, রাক্ষস দু’হাত ভরে খায় আর গাছেদের চুমো দেয়, দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তাদের। সেদিন কী হল, একদল গাছ কাটিয়ে এলো ইয়া বড় বড় যন্ত্র নিয়ে গাছ কাটবে বলে। আর রাক্ষস জানতে পেরেই হুমকার দিয়ে এক লাফে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বললে, ‘কে রে, কার এত সাহস, আমার গাছ বন্ধুদের ক্ষতি করে? তোমরা কি জানো না, গাছ কাটা মানা, গাছ কাটলে পৃথিবীর ক্ষতি হয়, গরম বাড়ে, বৃষ্টি পড়ে না একদম? আর তাই থেকে সমস্ত প্রাণীজগতের কি ভীষণ ক্ষতি হয় ?’ সেই কথাগুলো রাক্ষস মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে, মেঘের মত গর্জন করে করে বলতে লাগলো সেই গাছ কাঠুরেদের। সব্বাই তার পাহাড়ের মত চেহারা দেখে, যে যার যন্ত্র-টন্ত্র ফেলে দিয়ে কিনা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচলে।

আর গাছেরা খুব খুশি হলো। তারা পাতায় পাতায় এ ওকে জানিয়ে দিল দয়ালু বন্ধু রাক্ষসের কথা। বাতাস, খুব আনন্দ করে খেলে গেল গাছের ডালে ডালে, পাতায় পাতায়, আর কেমন সঙ্গীত খেলে গেল চারিভিতে। নদীর জলে, ঝর্ণার নুড়ি পাথরে লাগা সঙ্গীতে, পাতার মর্মরে, এখানে, ওখানে, সেখানে। রাক্ষস তো বেজায় খুশি হয়ে ‘জিঙ্গা লালা’ নাচ করে ফেলল খানিকটা। আর তার সাথে মাথা দোলাতে লাগলো সব গাছগুলো। তাই দেখে জন্তুরা পশু পক্ষিরা আর থাকতে পারে? তারাও বুঝেছে, এই রাক্ষস আমাদের বন্ধু। চেহারা বিকট আর ভীষণ হলে কী হবে, ওর মন, সত্যিই ভালো।

তখন বাঘ সিংহ শেয়াল কুমীর হাতি আরো যত যত বন্ধু আছে সব্বাই এসে হাত মেলাল আর বন্ধু হয়ে গেল সেই রাক্ষসের। আচ্ছা বাকিদের নাম আমি বলছি না। তোমরাই বরং এঁকে ফেল, আর লিখে ফেল তাদের নাম তোমাদের খাতায়, কেমন ? কী কী পাখি এলো বল তো? সব সব। অমনি করে একে একে প্রতিটি পাখির নাম লেখ আর এঁকে ফেল দেখি ; সেই পাখিদের রং দিতে ভুলো না কিন্তু। কারণ রাক্ষসের সাথে বন্ধুত্ব করে তাদের মন কী ভীষণ ভালো, কি ভীষণ রঙিন হয়ে গেল, তোমরা তো জানই। তিনমুখো পাহাড়ের কাছে থাকা মানুষরা তখন বুঝে গেল, কি ভালই না রাক্ষস। তারা সব্বাই এসে ভারী নাচাগানা জুড়ে দিল রাক্ষসকে ঘিরে।

গাছ বাঁচানো যে খুব বড় কাজ, তা কে না জানে? আর সেই রাক্ষসটার আর তার চেহারা নিয়ে কোনো কষ্ট রইলো না। সবাই বুঝল, সক্কলে জানল, চেহারাই সব নয়। ওর মনের ভেতরটা কী যে ভালো আর কত্ত যে সুন্দর! সে অমনি হেসে গেয়ে খেয়ে মেখে সবার সঙ্গে আনন্দে দিন কাটাতে লাগল। আর ঝকঝকে দু পাটি দাঁত মেলে কেবলি হাসতে লাগল।

কই, কেমন সে? আঁকো তো দেখি সেই রাক্ষসকে, যে যেমন পারো!

অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s