গল্প সেই অদ্ভুত লোকটি– সূর্যনাথ ভট্টাচার্য শীত ২০১৪

সন্ধের ঠিক মুখটাতে এসে অনুজ আবিষ্কার করল সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। গাড়িটার স্পিড কমিয়ে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল, কাউকে দেখা যায় কিনা। কাউকে না পেয়ে অবশেষে সে গাড়ি থামাল। এই শহরে নতুন এসেছে অনুজ। পুরনো কলেজের বন্ধু চারু এই শহরেই থাকে। পুলিশ অফিসার। তার সঙ্গে দেখা করতেই আসা। ফোনে কথা হয়েছে, চারুর ঠিকানা অনুজের কাছে আছে। এই এলাকাতেই এমারেল্ড এনক্লেভ বলে কোন এক সোসাইটিতে চারুর ফ্ল্যাট। শহরের একটু বাইরে নতুন গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক আবাসন প্রকল্প। সারি সারি এক ধাঁচের একতলা দোতলা ছিমছাম বাড়ি ও বাংলো। খোলামেলা বাগানঘেরা বাড়িগুলো দেখলেই বোঝা যায় সেগুলো মহার্ঘ। একটু দূরে অনেকগুলো বহুতল টাওয়ারও দেখা যাচ্ছে। চারুর ফ্ল্যাট পাঁচতলায়, সুতরাং ঐ টাওয়ারগুলোরই কোনটায় হবে নিশ্চয়। এমন জায়গায় অনুজ সহজেই ঠিকানা খুঁজে নিতে পারবে ভেবেছিল। কিন্তু জায়গাটা যে এতটা জনহীন হবে বুঝতে পারে নি।

আসন্ন সন্ধের আলোআঁধারিতে খানিক ঘুরপাক খেয়ে অনুজ দেখল সে ঐ বহুতল বাড়িগুলোতে কিছুতেই পৌঁছোতে পারছে না। একইরকম দেখতে চওড়া রাস্তাগুলোতে মনে রাখার মত কোন চিহ্ন নেই। এই অঞ্চল থেকে বেরোবার রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। কোন বাড়িতে ঢুকে রাস্তা মালুম করাটা ঠিক সমীচীন বোধ করল না অনুজ। তাছাড়া বেশির ভাগ বাড়িতে এখনও কেউ আসে নি। দু’একখানা গাড়ি হুশ করে বেরিয়ে যেতে দেখেছে বটে, কিন্তু এতক্ষণে পথচারী একজনও দেখা যায় নি।

গাড়ি থামিয়ে চারুকে ফোন লাগাল অনুজ। চারু থানায় ছিল। বলল,”আরে, তুই কোথায়?”

অনুজ যে কোথায় তা কী করে বলবে? আশেপাশের কিছু বাড়িঘরের বর্ণনা দিতে চারু বললে, “মনে হচ্ছে বি-ব্লকের ওইদিকটায় চলে গেছিস। এদিকে আমি আবার একটু ফেঁসে গেছি। আমার ডিউটি শেষ, কিন্তু এক উড়ো ফোনে এইমাত্র কেউ জানালো এফ-ডি টাওয়ারে—আমার বাড়ি থেকে খানিকটা আগে— একটা মার্ডার না সুইসাইড কি হয়েছে। সেইটারই কেস নোট করে, আর একজনকে চার্জ বুঝিয়ে আসতে একটু টাইম লাগবে। তুই যেখানে আছিস সেখানেই ওয়েট কর। আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তোকে ঠিক খুঁজে নেব।”

এক ঘণ্টা! অনুজ ঘড়ি দেখল,সাতটা দশ। তার মানে চারুর আসতে আটটা-সাড়ে আটটা বাজবে। একটু হতাশভাবেই সিটের পেছনে মাথাটা এলিয়ে দিয়েছে অনুজ, এমন সময়ে দেখল উস্কো-খুস্কো চুল এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক হনহন করে তার দিকেই আসছে। সোজা টানটান হয়ে বসতেই লোকটা তার গাড়ির কাছে এসে গেল। অনুজ তাড়াতাড়ি আওয়াজ দিল, “এই যে স্যার, আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন? এক ঘন্টা আগে এক বন্ধুর সাথে দেখা করার কথা ছিল আমার, কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলায় আমি বুঝতে পারছি না কোথায় এসেছি।”

লোকটার লম্বা একহারা চেহারা। ঝাঁকড়া চুলের জন্যে মাথাটা শরীরের তুলনায় বেশ বড়ো। পরনে হাঁটুপর্যন্ত একটা আলখাল্লা মত পাঞ্জাবী, আর কালো প্যান্ট। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য তার চোখদুটো। চোখের মণিটা তার হাল্কা সবুজ, এই সময়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় প্রায় সাদাই দেখাচ্ছে। মণির মাঝখানে একটা করে কালো বিন্দু। কটা চোখের মানুষ অনেক দেখেছে অনুজ, কিন্তু এমনটা ঠিক কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। লোকটা এক দৃষ্টিতে চাইতেই অনুজের গা’টা যেন শিরশির করে উঠল।

লোকটি খসখসে গলায় জবাব দিল,“তুমি রয়েছ এক মহার্ঘ চতুর্চক্রযানে যা ইচ্ছেমত ঘন্টায় ১২০ মাইল গতিতে দৌড়োতে পারে কিন্তু দরকার পড়লে বন্ধুর ঠিকানায় পৌঁছতে পারে না। তোমার পশ্চাদ্দেশ জমি থেকে ২৫ ইঞ্চি উঁচুতে। তোমার মস্তিষ্ক ক্লান্ত, মাত্র ২৮ ওয়াট ক্ষমতায় কাজ করছে। তুমি উদ্বিগ্ন, তোমার হৃদযন্ত্র প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৮৮ বার স্পন্দিত হচ্ছে।”

“আমি কোথায় এসেছি বলতে পারেন কি?”

“নিশ্চয়। তোমার অবস্থান এখন ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৭০ ও ৭৫ ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমাংশের মধ্যে।”

অনুজ বেশ হতভম্ব হয়ে গেল। লোকটা কি পাগল? ঠিক সেরকম তো মনে হচ্ছে না। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “এসব আপনি কী করে বলছেন?”

এবার লোকটা যে মুখভঙ্গি করল তা নিশ্চয় হাসির। কিন্তু সে হাসি নিঃশব্দ। তারপর বলল, “আমি তো আরও অনেক কিছু বলতে পারি। কিন্তু তাতে কার কী লাভ?”

“আপনি কি ম্যাথমেটিশিয়ান?” অনুজ জানতে চাইল।

“হ্যাঁ,তা বলতে পার। তবে আমি এমন অনেক কিছু জানি যা তোমার কোন ম্যাথমেটিসিয়ানই বলতে পারবে না।”

অনুজ বুঝে গেছে, পাগলের পাল্লায় পড়েছে। কিন্তু লেখাপড়া জানা পাগল। নবারুণদার মতো। নবারুণদা ছিল এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, অঙ্কপাগল। ফুলশয্যার রাতে বৌদিকেও মাল্টিপল ইন্টিগ্রেশন নিয়ে লেকচার দিয়েছিল। কিন্তু নবারুণদা এমনিতে বেশ হাসিখুশি।

এই লোকটা একটু অন্যরকম। অনুজ তাকে একটু উশকে দেবার জন্যেই প্রশ্ন করল, “যেমন?”

“এই যেমন ধর, ঐ গাছটার নীচ থেকে পাঁচ নম্বর ডালটায় কটা পাতা আছে কিংবা এখান থেকে পনেরো স্টেরেডিয়ান সলিড অ্যাঙ্গেলের মধ্যে মহাকাশে কত নক্ষত্র আছে, অথবা…”

“আপনার এইসব জানা আছে?” অনুজ ইচ্ছে করেই ব্যঙ্গের স্বরটা চাপবার চেষ্টা করল না।

“তা আছে। কিন্তু বলব না। কেননা তোমার এসব জানা নেই। কাজেই ভেরিফাই করতে পারবে না। এবং আমি যাই বলব, ভাববে গুল মারছে।”

“হুঁ বুঝেছি,” অনুজ পাগলকে আর বেশি না ঘাঁটিয়ে জবাব দেয়, “আপনি দেখছি অনেক কিছু জানেন। কিন্তু আমি প্রথমে আপনার কাছে যা জানতে চেয়েছিলাম, তার জবাব তো পেলাম না। আপনার উত্তর হয়ত ম্যাথমেটিকালি কারেক্ট, কিন্তু এসব তথ্য আমার কী কাজে লাগবে তাতো বুঝলাম না। আমি এখনও আগের মতো পথ হারিয়েই আছি। কীভাবে বন্ধুর বাড়ি পৌঁছব, এখনও জানিনা। সোজা কথায় এখনো পর্যন্ত আপনি আমার কোন উপকারেই এলেন না।”

পথিক একটু থেমে তার কটা চোখে অনুজের দিকে কটমট করে চাইল। চাউনিতে বোঝা গেল সে চটেছে, কিন্তু ঠাণ্ডা গলাতেই বলল, “তুমি নিশ্চয়ই কোনো কোম্পানির ম্যানেজার, এমবিএ?”

“হ্যাঁ,” এবার অনুজের অবাক হবার পালা, “কিন্তু আপনি কীভাবে বুঝলেন?”

লোকটি উত্তর দিল, “খুব সহজ। তুমি জান না তুমি কোথায় রয়েছ বা কোথায় যাচ্ছ। বন্ধুর কাছে তুমি এমন প্রতিজ্ঞা করেছ যা রক্ষা করার উপায়ও তোমার জানা নেই, কিন্তু আশা করছ তোমার সমস্যা তোমার সম্পূর্ণ অপরিচিত আমি সমাধান করে দেব। ভাল করে ভেবে দেখ আমার সাথে সাক্ষাতের পূর্বে তুমি যেখানে ছিলে, সেখানেই আছ, আমি তোমার কোনো অতিরিক্ত অনিষ্ট করিনি। কিন্তু তুমি যে কোনভাবেই হোক আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে দিলে। ওয়াহঃ…এক্সেলেন্ট কোয়ালিটিজ অফ আ গুড ম্যানেজার,টেন অউট অফ টেন।”

এই বলেই লোকটা হনহনিয়ে পেছন দিকে চলে গেল। অনুজ দেখল,পাগল হোক ছাগল হোক,এই আঁধারে তার একমাত্র ভরসা চলে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলে মুখটা বাড়িয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে একটু গলা তুলে বলল,“ও মশাই, শুনছেন? এমারেল্ড এনক্লেভটা কোনদিকে হবে জানেন কি?”

লোকটা পিছন না ফিরেই ডানহাতটা মাথার পাশে নেড়ে রাগতস্বরে “জানিনা” বলে একইভাবে চলতে লাগল। অনুজ হতাশ হয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে আবার সিটে গা এলিয়ে দিল। এখন চারুর জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। চারু কতক্ষণে আসবে ভাবতে ভাবতে সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাতটা বাড়িয়েছে, হঠাৎ দেখে জানলায় একটা মুখ! সেই ঝাঁকড়া চুল, সেই সাদা চোখ! অনুজ আঁতকে উঠেছিল। লোকটা তার দিকে চেয়ে চাপাস্বরে বলল, “দ্যাখো ছোকরা, আমি জানি, কিন্তু বলব না।” বলেই যেদিক থেকে এসেছিল আবার সেই দিকে চলে গেল।

অনুজের হৃদযন্ত্র আকস্মিক চমকে বেশ ধড়ফড় করছিল, স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারল,লোকটার বোধহয় রাগ একটু পড়েছে। তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে অনুজ দেখল লোকটা বেশ খানিকটা চলে গেছে। ক্ষিপ্রগতিতে তার কাছে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “শুনুন না মশাই, কিছু মনে করবেন না। একটু এমারেল্ড এনক্লেভের রাস্তাটা বলে দিন না।”

লোকটা একবার অনুজের আপাদমস্তক দেখে নিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কতো নম্বর?”

“ডি-৫৩।”

লোকটা শান্তস্বরেই বলল, “আমিও ওইদিকেই যাচ্ছি। আমাকে সঙ্গে নিতে চাইলে তোমাকে দেখিয়ে দিতে পারি।”

অনুজের একবার মনে হল, এ মন্দ নয়। তারপরেই ভাবল, লোকটার মতিগতি ভালো তো? গাড়িতে দামি জিনিস বিশেষ কিছু নেই অবশ্য। কিন্তু একলা গাড়িতে পেয়ে যদি ছোরাছুরি বার করে?

“ভয় নেই, এই দ্যাখো আমার সাথে অস্ত্রশস্ত্র কিছু নেই,” লোকটা যেন অনুজের মনের কথা পড়ে নিল। দুহাতে নিজের জামাটা ঝেড়ে দেখিয়ে বললে, “আসলে জায়গাটা খুব দূরে না হলেও এই রাতে চিনে যেতে পারবে না। তাই বলছিলাম। অবশ্য তোমার আপত্তি থাকলে বলি শোনো…।”

এরপর আর অনুজ না বলে পারল না,“না না কী যে বলেন,আপত্তি কিসের? আপনি আসুন না,তাহলে তো খুব ভালো হয়।”

দুজনে গাড়িতে বসে লোকটার কথায় অনুজ গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর চলল লোকটার নির্দেশমতো। নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে হাতের ইশারায়। লোকটা গাড়িতে ওঠবার পরে আর কোন কথা বলছে না। অনুজও তার হাতের দিকেই নজর রাখছিল, মুখের দিকে তাকাচ্ছিল না। খালি মনে হচ্ছিল, তাকালেই যদি দেখে একজোড়া সাদা চোখ তার দিকে চেয়ে আছে!

মিনিটপাঁচেক চলার পরেই তারা সেই টাওয়ারগুলোর কাছে এসে গেল। এতক্ষণ ঘুরেও অনুজ খুঁজে পায়নি কেন কে জানে। বড়ো বড়ো বাড়িগুলোর মাঝ দিয়ে বেশ অনেকগুলো সমকোণী বাঁক পেরিয়ে তারা চলল। মাঝে মাঝে অনুজের চোখে পড়ছিল ব্লকের নম্বর লেখা পাথরের ফলকগুলো। অবশেষে লোকটা গাড়ি থামাবার ইঙ্গিত করল। অস্পষ্টভাবে অনুজের মনে হল শেষ যে ব্লকের নামটা দেখেছিল সেটা এফ-ডি। কিন্তু সঠিক মনে করতে পারল না।

গাড়ি থেকে নেমে লোকটা সামনের উঁচু বাড়িটা দেখিয়ে বলল, “ঐ যে এফ-ডি ৫৩। চারুদত্ত চৌধুরি তো? পুলিশ অফিসার? পাঁচতলায়।”

অনুজের পরিষ্কার মনে আছে সে ডি-৫৩ বলেছিল। তবে কি সে ঠিকানা ভুল জানত? লোকটার কথায় তো মনে হচ্ছে, চারুকে সে ভালো করেই চেনে। একটু সন্দেহে সে পিছনে লোকটার দিকে চাইল। লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আরে আমি তো বলছি,এই বাড়ি। একবার দেখেই এসো না বাপু। আমি না হয় দাঁড়াচ্ছি এখানে।”

অনুজও তাই ঠিক করল। লিফটে চড়ে পাঁচ তলার বোতাম টিপে দিয়ে ভাবতে লাগল,চারু যখন তাকে ঠিকানা দিয়েছিল,সে নিশ্চয় শুনতে ভুল করে থাকবে। লোকটা যখন চারুকে এতো ভালো করে চেনে-

লিফটের দরজা খুলে যেতে অনুজ বেরিয়ে এল। সামনে প্রশস্ত ল্যান্ডিং-এর দু’পাশে দুটো দরজা। একটায় নামের ফলক, লেখা “জি পরাঞ্জপে”। অন্যটাই তাহলে চারুর। ব্যাটা এখনও নেমপ্লেট লাগায় নি?

চারু তো বাড়িতে নেই,অনুজ একটু ভেবে পরাঞ্জপেদের দরজাতেই নক করল। একটু পরেই সেই ভারী মেহগনি কাঠের দরজা খুলে গেল। বিলাসবহুল অভিজাত একটি ঘরের এক টুকরো অনুজের সামনে উন্মোচিত হল। দরজা যিনি খুলেছেন তিনি মধ্যতিরিশের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা। মিসেস পরাঞ্জপেই হবেন নিশ্চয়। মহিলার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে অনুজ হিন্দিতেই প্রশ্ন করল,“কিছু মনে করবেন না,চারুদত্ত চৌধুরি কি সামনের ঐ ফ্ল্যাটে থাকেন?”

“না, ওটা তো ডক্টর শেখাওয়াতের। তবে মনে হয় উনি এখন নেই।”

“এটা ডি…মানে এফ-ডি ৫৩ তো?”

“হ্যাঁ…?”

“আমি দুঃখিত, ভেবেছিলাম, আমার বন্ধু এই বিল্ডিঙয়ে থাকে, ফিফথ ফ্লোর, এফ-ডি-৫৩। মনে হচ্ছে ওটা বোধহয় ডি-৫৩ হবে।”

ঝাঁকড়া চুল, কটা চোখের ওপর ভারি রাগ হল অনুজের। জেনেশুনে ভুল জায়গায় নিয়ে এসেছে। চলেই আসছিল, ভদ্রমহিলা বললেন, “আপনি ফিফথ ফ্লোরে একবার দেখে নিন না। আসলে আমরা এখানে আড়াই মাস হল এসেছি, সবার সাথে তেমন আলাপ নেই…।”

“এটা ফিফথ ফ্লোর নয়?” হতবাক অনুজের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

“না, এটা তো ফোরথ। ঐ দেখুন না…” মহিলা সিঁড়ির পাশেই তলার ফলকটা দেখিয়ে দিলেন, সত্যিই সেখানে জ্বলজ্বল করছে লেখা, ফোরথ ফ্লোর।

তাহলে কি লিফটের বোতাম টিপতে ভুল হল অনুজের? অপ্রস্তুতভাবে দুঃখপ্রকাশ করে অনুজ আবার লিফটের কাছে এগিয়ে গেল। লিফট সেখানে ছিল না, কলিং বোতাম টিপতে অনেক নীচে যন্ত্রদানব যেন সক্রিয় হয়ে উঠল। মিসেস পরাঞ্জপে পিছনে দরজা বন্ধ করলেন।

একটাই তো তলা, হেঁটেই উঠে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতেই লিফট এসে গেল। অনুজ তাতে চড়ে খুব খেয়াল করে ৫ নম্বর বোতাম টিপল। লিফট একটা ফ্লোর উঠেই থামল। লিফট থেকে বেরিয়ে এসেই অনুজ আবার একটা ধাক্কা খেল। সামনের দরজায় লেখা “জি পরাঞ্জপে”, তলার ফলকে সেই ফোরথ ফ্লোর। অথচ লিফটটা তো একটা তলা উঠেছে? না কি ওঠেনি? যান্ত্রিক গোলযোগ?

কুণ্ঠিতভাবে সে আবার পরাঞ্জপেদের দরজাতেই নক করল। এবার একটু বেশি সময় লাগল। তারপর মিসেস পরাঞ্জপে আবার দরজা খুললেন। এবার চোখে তাঁর বিস্ময়।

“আবার আপনাকে একটু বিরক্ত করছি বলে খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু লিফটে কি কোন প্রবলেম আছে?” অনুজ জিজ্ঞেস করল।

“না। কেন বলুন তো?”

“আমি আগের বার আপনার সাথে কথা বলে লিফটে গিয়ে ওপরে উঠলাম। কিন্তু দেখছি সেই একই ফ্লোরে রয়ে গেছি।”

“আপনি কী বলছেন ঠিক বুঝলাম না,” ভদ্রমহিলার মনের বিরক্তি অনুজের কাছে গোপন রইল না তাঁর কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তায়, “নতুন লিফট, কোন প্রবলেম নেই। আপনার নিশ্চয় ভুল হয়েছে।”

অনুজ জানে তার বোতাম টিপতে কোন ভুল হয় নি। মাথাটা কিরকম গুলিয়ে গেল। আবার পিছন ফিরে চলে আসছিল, শুনতে পেল মিসেস পরাঞ্জপে বলছেন, “আপনি সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান না হয়। আর দেখুন, কাল আমার ছেলের পরীক্ষা। একটু ব্যস্ত আছি, শুধুশুধু বারবার ডিস্টার্ব না করলে ভালো হয়…।”

না, আর ওনাকে বিরক্ত করবে না অনুজ। উনি ঠিকই বলেছেন, লিফট নয়, এবার সিঁড়ি দিয়েই যাবে সে।

তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে অনুজ উঠে এলো ওপরতলায়। আগে দেখল তলার ফলকটা। বড়োবড়ো চোখ করে দেখল, চোখ কচলে আবার দেখল। সেখানে লেখা সেই ফোরথ ফ্লোর! সামনের দরজায় সেই পরাঞ্জপের নেমপ্লেট!

এবার যেন নিজের চোখকে আর বিশ্বাস করতে পারছিল না অনুজ। এখনও সিঁড়ি ওঠার ধকলে অল্প হাঁফাচ্ছে সে। এই বাড়ির সব তলাতেই কি ফোরথ ফ্লোর লেখা? কিন্তু পরাঞ্জপের ফ্ল্যাট? সেও কি সব ফ্লোরে?

মরীয়া হয়ে আবার একটা তলা উঠে গেল অনুজ। সেই ফোরথ ফ্লোর,সেই পরাঞ্জপেদের ফ্ল্যাট! দুদ্দাড় করে নেমে এলো অনুজ। সেই একই ছবি। আবার উঠল,আবার নামল। বেশ কয়েক তলা করে। এতবার ওঠানামা করে তার দম ফুরিয়ে এসেছে। দু’হাঁটুর ওপর হাত রেখে হাপরের মতো হাঁফাচ্ছে। মাথা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। চারতলার গোলকধাঁধা থেকে বেরোবার পথ পাচ্ছে না!

এ কী হল? কোথায় এসে পড়ল সে? আবার মিসেস পরাঞ্জপেকে বিরক্ত করবে? একটা ভয়ের অনুভূতি এবার শিরশির করে তার মেরুদন্ড বেয়ে নামতে লাগল। এই নিঝুমপুরীতে একটি মহিলাকেই সে দেখেছে। সে মিসেস পরাঞ্জপে, নাকি…?

পরাঞ্জপের দরজার দিকে পা বাড়িয়েও আবার থেমে গেল অনুজ। এতক্ষণ খেয়াল করে নি, শেখাওয়াতের ফ্ল্যাটের দরজার তলা দিয়ে একটা হাল্কা আলোর আভাস দেখতে পেল সে। তবে কি ডক্টর শেখাওয়াত ফিরে এসেছেন? কিন্তু কখন? কোন পথে?

অভিভূতের মতো অনুজ শেখাওয়াতের দরজায় গিয়ে চাপ দিল। দরজা তালাবন্ধ ছিল না,খুলে গেল নিঃশব্দে। ঘরের বিপরীত দিকে একটা হালকা আলো জ্বলছে। তার আলোয় অনুজ দেখল,বাঁদিকের দেওয়ালে একটা টেবিলের সামনের চেয়ারে একটা লোক বসে। ঠিক বসে নয়,এলিয়ে আছে। মাথাটা চেয়ারের হাতলের ওপর দিয়ে পিছনের দিকে ঝুলে আছে। লোকটার একমাথা ঝাঁকড়া চুল আর চোখ দুটো খোলা, সোজা অনুজের দিকে যেন চেয়ে আছে। সাদা দুটো চোখের তারার মাঝখানে স্থির হয়ে আছে দুটো কালো বিন্দু। হ্যাঁ, দেখলেই বোঝা যায় ভয়ঙ্কর সে চোখের দৃষ্টিতে প্রাণের কোন চিহ্ন নেই!

ছবিঃ শংখ করভৌমিক

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s