গল্প সে রাত ভয়ংকর কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎ ২০১৮

কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ে আগের গল্প টুইটি

দক্ষিণ কলকাতার তারাতলা থেকে একেবারে বঙ্গোপসাগরের দিকে মুখ করে সোজা চলে গেছে সাবেকি ডায়মন্ডহারবার রোড। মোটামুটি বেহালা পেরিয়ে ঠাকুরপুকুর পর্যন্ত বেশ জমজমাট। একটা পুরোদস্তুর শহুরে চেহারা। দু’পাশে ঝলমলে দোকান, নতুন নতুন শপিং মল, ঝাঁ-চকচকে বাড়িঘর, রেস্তোঁরা, যানবাহনের বেজায় গুঁতোগুঁতি, কী নেই!

কিন্তু তার একটু পর থেকেই এ-রাস্তার চেহারা একটু একটু করে পালটে যেতে থাকে। কোনওরকমে জোকা হয়ে পৈলান পেরোলেই বেশ মফস্বলী ভাব ধরা পড়তে থাকে এর দু’পাশে। মাটির সোঁদা গন্ধ বা সর্ষেক্ষেতের রেণু যেন বাতাসে ভেসে বেড়ায়। আর সন্ধের পর এই অন্ধকারে বাসে করে যেতে যেতে তো মনে হয়, পিচরাস্তা নয়, যেন এক মাঠের আলপথ ধরে হু হু করে ছুটে চলেছি গ্রামের মধ্যে দিয়ে।

অন্তত আমার এখন তাই মনে হচ্ছিল। এর আগে এই রাস্তা ধরে এতদূর কোনওদিন আসিনি। আসার কথা ভাবতামও না, যদি না সঙ্গে দিগন্ত থাকত।

আমি আর দিগন্ত একই অফিসে চাকরি করি। আজ অফিস ছুটির পর যাচ্ছি ডায়মন্ডহারবারের কাছাকাছি পীরগাছা নামে কোনও এক অচিনপুরে, আমাদেরই কলিগ দেবাশিসের গ্রামের বাড়ির কালীপুজোয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেবাশিস গল্প শোনাচ্ছিল ওদের বাড়ির এই পুজোর। প্রায় একশো বছর আগে এই পুজোর প্রতিষ্ঠা। দেবীমূর্তি নাকি প্রচণ্ড জাগ্রতা। পুজোর জাঁকজমক, খাওয়াদাওয়ার রাজকীয় বন্দোবস্ত, পাঁঠাবলি, বাজি পোড়ানো ইত্যাদি হরেকরকম লোভনীয় আকর্ষণের চাপে পড়ে শেষপর্যন্ত এ-বছর রাজি হয়েই গেলাম ওদের পুজো দেখতে যেতে।

কালীপুজো আগামীকাল। অফিস ছুটি। তাই আজ পুরো অফিস। ভেবেছিলাম একটু আগে আগে বেরিয়ে যাব, কিন্তু সেটা আর হল না। বেরোতে সেই পাঁচটা বেজেই গেল।

নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। পাঁচটাতেই সন্ধে নেমে আসে এখন। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডার একটা ভাবও ছড়িয়ে পড়ে সন্ধে হলেই। কলকাতাতেই এই অবস্থা, আর ওরকম গ্রামের দিকে তো আরও ঠাণ্ডা পড়বে। তাই কোন রিস্ক নিইনি, সোয়েটার আর চাদর দুটোই নিয়ে এসেছি।

তারাতলা থেকে উস্থির বাসটায় যখন চেপে বসি, তখনই প্রায় সাতটা বাজে। পৌঁছতে কম সে কম ঘন্টা দুয়েক তো লাগবেই। তারপর বাস-স্ট্যান্ড থেকে ওদের বাড়ি হাঁটাপথে আরও নাকি মিনিট কুড়ি। তবে অসুবিধে নেই, দেবাশিস বাস-স্ট্যান্ডেই থাকবে।

সাঁই সাঁই করে চওড়া পিচঢালা রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে বাসটা। একের পর এক পেরিয়ে যাচ্ছি ছোটো ছোটো সব জনপদ। ভাসা, খড়িবেড়িয়া, বিষ্ণুপুর, আমতলা।

একসময় শিরাকোল থেকে বাঁদিকে ঘুরে উস্থির রাস্তা ধরল আমাদের বাস। আর তখনই মনে হল, যেন এক নিমেষে আমরা ডুবে গেলাম ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে। এতক্ষণ হাইওয়ে ধরে যাচ্ছিলাম, তাই রাস্তার দু’পাশে অন্তত আলোর অভাব হয়নি। এবার কেমন একটা শিরশিরানি আর অজানা ছমছমে ভাব চেপে বসল মনে।

দিগন্তেরও মনের ভাব যেন অনেকটা সেইরকমই। দু’জনের কেউই কথা বলছি না। মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি আর জানালা দিয়ে বাইরের নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছি।

বাসভর্তি অচেনা লোক। সবাই লোকাল যাত্রী। কন্ডাক্টর স্টপেজের নাম ধরে চিৎকার করছে আর বাস দাঁড়ালে ওঠানামা চলছে। বাসের মধ্যে টিমটিমে আলোর রেখা। সে আলোয় অন্ধকার যেন আরও জমাট বেঁধে বসছে ক্রমশ। সমস্ত শরীর-মন যেন ক্রমশ বিবশ হয়ে আসছে।

কখন সিটে মাথা রেখে ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ অনেক লোকের হাঁকডাক, চিৎকার আর দিগন্তের ঠেলা খেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। তেঁতুলতলা এসে গেছে। এখানেই তো আমাদের নামার কথা! দিগন্তের পেছন পেছন হুড়মুড় করে নেমে আসি। বাসটা হর্ন দিতে দিতে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যায়।

এবার অবস্থাটা পুরোপুরি অনুভব করতে পারি। এ কোথায় এলাম আমরা? আমাদের চারপাশে নরকের মতো পুঞ্জীভূত অন্ধকার। পিচঢালা রাস্তার পাশে শুধু দুয়েকটা ভাঙা আটচালা, ক্ষয়ে যাওয়া মাটির কুটির আর বিরাট এক বটগাছের তলায় বাঁশের একটা মাচা। বাকি যেদিকেই তাকাই শুধু ধানক্ষেত আর বাদাজমি।

কিন্তু দেবাশিস কোথায়? ওর তো এখানেই দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল! মোবাইল বার করে ওকে ফোন করি। নট রিচেবল। এবার কী হবে?

দিগন্ত বলে, “ওই দ্যাখ। ওই বাঁশের সাঁকোটা পেরিয়ে একটা রাস্তা। মনে হয় পীরগাছা ওটা দিয়েই যেতে হবে। আর তো কোনও রাস্তা নেই। খানিকটা এগিয়ে দেখা যাক, কারুর দেখা পেলে জিগ্যেস করে নেওয়া যাবে।”

অগত্যা ব্যাগ কাঁধে তুলে ওদিকেই হাঁটা শুরু করি। রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। কনকনে একটা হাওয়া বইছে। সঙ্গে হিমও পড়ছে। তবুও আশ্চর্য, আমাদের যেন ঠাণ্ডাই লাগছে না। সেটা কি উত্তেজনায়? নাকি উৎকন্ঠায়? দেবাশিসের হঠাৎ হল কী? কাজে আটকে গেল নাকি? তাহলেও তো ওর কাউকে পাঠানো উচিত ছিল। আর ওর ফোনই বা নট রিচেবল কেন?

ভাবতে ভাবতে কতটা চলে এসেছি জানি না। কাঁচা মেঠো পথের আঁকাবাঁকা গোলকধাঁধায় হেঁটেই চলেছি। ভিজে ঘাসে জুতো আর প্যান্টের তলাটা ভিজে গেছে। ক্লান্তও লাগছে খুব।

হঠাৎ বেশ কিছুটা দূরে একটা আলো চোখে পড়ল। উঁচু একটা অন্ধকারের ঢিবির নিচে একটা উজ্জ্বল আলো। পা চালালাম। কাছাকাছি পৌঁছে দেখি, মাঠের মধ্যে একটা আগুন জ্বলছে। তাকে ঘিরে কয়েকজন স্থানীয় লোক বসে আগুন পোয়াচ্ছে। কাছে গিয়ে ডেকে উঠি, “দাদা, পীরগাছা গ্রামটা কোনদিকে হবে বলতে পারেন?”

সবাই অবাক চোখ তুলে তাকায় আমাদের দিকে। তারপর ওদেরই মধ্যে বুড়োমতো একটা লোক চোখের ওপরে একটা হাত রেখে ভুরু কুঁচকে যেন অন্ধকারের মধ্যে ঠাহর করার চেষ্টা করে আমাদের। তারপর বলে ওঠে, ‘হেই গো বাবুরা! কোত্তেকে আসতেছ গো তোমরা?”

“কলকাতা থেকে। যাচ্ছি পীরগাছা, মিত্তিরদের বাড়ি। তা কোনটা দিয়ে যাব বলতে পারেন?”

এবার সবাই সমস্বরে হো হো করে হেসে ওঠে। অবাক হয়ে কী ব্যাপার জিগ্যেস করতে যাব, অমনি হাসি থামিয়ে বুড়ো বলে ওঠে, “তা বাবুরা, আর কষ্ট করতে হবেনি গো। যেখেনে যেতেছ, সেখেনেই তো পৌঁছে গেছ!”

“তার মানে? এটাই পীরগাছা নাকি?”

“হ গো বাবুরা, হুই ঢিবিটার পেছনপানে গেলিই রাস্তা পেয়ি যাবেন গো। দ্যাখেন কেনে।”

এতক্ষণে আমরা নিশ্চিন্ত হই। এই স্থানীয় লোকেরা যখন বলছে, তার মানে প্রায় এসেই গেছি। চটপট এগিয়ে যাই। ঢিবিটার কাছে পৌঁছে একবার পেছনদিকে তাকাই। ঘন কুয়াশায় লোকগুলোকে আবছা দেখাচ্ছে। তারপর ঢিবিটার পাশ দিয়ে হেঁটে তার পেছনে যেতেই একটা ভয়ংকর দৃশ্য পলকের মধ্যে আমাদের স্তম্ভিত করে দিল। নিমেষে কে যেন হৃৎপিন্ডটা খামচে ধরল সজোরে। আতঙ্ক, শিহরন, অবিশ্বাস, সব মিলিয়ে একটা প্রচণ্ড বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলা করতে লাগল সারা শরীরে। এ কী দেখছি আমরা?

আমাদের সামনেই সেই হাইওয়ে। জমি থেকে বেশ খানিকটা উঁচু দিয়ে লম্বা হয়ে চলে গেছে সেই পিচঢালা রাস্তাটা। আর তার পাশের ঢালু জমিতে আছড়ে পড়ে আছে একটা ভাঙাচোরা বাস। বাসের ভেতরে, বাইরে, চারদিকে ছড়িয়ে আছে শুধু মানুষের লাশ। ক্ষতবিক্ষত, বিকৃত কতকগুলো মৃতদেহ। চারদিকে থকথক করছে রক্ত। আর অদ্ভুত একটা নীরবতা। শূন্য শ্মশানের মতো এক বিশাল স্তব্ধতা যেন বিরাজ করছে এখানে।

মাথা কাজ করছিল না। গোটা শরীর ঝিমঝিম করছে। গলা শুকনো। হঠাৎ অনুভব করি, আমাদের ঘিরে কারা যেন এসে দাঁড়িয়েছে। পেছনে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পাই না। শুধু একটা হিমশীতল কন্ঠ যেন অন্ধকারে ভেসে আসে, ‘হেই গো বাবুরা! পীরগাছা যাবেননি? মিত্তিরদের বাড়ি? মোদের সাথে চলেন না কেনে? হেই বাবুরা!’

সেই ভয়ংকর কন্ঠ শুনে শিউরে উঠি। এক অজানা আতঙ্কে দৌড়ে পালাতে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। এ কী দেখছি? কারা এরা? এ যে আমাদের চেনা, খুব চেনা।

অবচেতনে হাত বাড়িয়ে দিগন্তর হাতটা চেপে ধরতে যাই। ধরতে পারি না। ও এখন ছায়ামূর্তি। আমি নিজেও যে তাই। আমরা কেউই আর কাউকে ছুঁতে পারব না। কারণ, আমাদের শরীরগুলো এখন পাশাপাশি পড়ে আছে এই অন্ধকারে, এই হিমভেজা মাঠে।

অলঙ্করণ জয়ন্ত বিশ্বাস

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

2 thoughts on “গল্প সে রাত ভয়ংকর কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎ ২০১৮

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s