অনন্যা দাশ
লয়কে নিয়ে ওর মা, বাবা আর দিদি লিসা সবাই খুব বিরক্ত। লোকের মুখের ওপর দুমদাম কথা বলে দেয় সে। কার মনে কষ্ট হবে, কার দুঃখ হবে সে সব একবারের জন্যেও ভেবে দেখে না! কতবার বোঝানো হয়েছে যে এটা ভাল স্বভাব নয় তাও লয় শুনবে না।
সেদিন যেমন পাড়ার জোজোদাদের বাড়িতে গিয়ে দুম করে তার ভাগ্নে পোকোকে বলে, “কী মোটা, খুব খায় বুঝি?” আর ওদের কুকুর রকিকে “হ্যাংলা” বলে দিল লয়। আসলে রকি ওর জুতোটার একপাটি চিবিয়েটিবিয়ে অবস্থা খারাপ করে দিয়েছে দেখে রেগে গিয়েই লয় কথাগুলো বলেছিল। সেটা বলার তাও কারণ ছিল কিন্তু পোকোর বয়স মোটে তিন, তাকে মোটা বলাতে জেঠু, জেঠিমা, পোকোর মা টুসিদি, জোজোদা সবাই ভীষণ অখুশি হয়েছেন বোঝা যাচ্ছিল। লিসা সেটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি লয়কে ওখান থেকে টেনে বাড়িতে নিয়ে চলল।
বাড়ি ফেরার পথে লয় ওকে পাথরটা দেখালো। একটা গোল মতন চকচকে বেগুনি রঙের পাথর।
“কী রে ওটা?”
“জোজোদা দিল!”
“তুই নিলি কেন? নিশ্চয়ই ওটাতে কিছু একটা গন্ডগোল আছে! নাহলে তোর ওই রকম ব্যবহারের পর কেউ মোটেই তোকে কিছু দিতে চাইবে না।”
“কী সুন্দর রঙ না পাথরটার? তুষারকাকুদের বাড়িতে যে আমেথিস্ট আছে সেটার মতন দেখতে! আর জোজোদা মোটেই রাগ করেনি। রকি যে হ্যাংলা সেটা তো সবাই জানে!”
“আর পোকো? কতবার তোকে বলেছি অমন করে বাজে কথা বলতে নেই! তা তোর যদি শিক্ষা হয়! ওটা ফেরত দিয়ে দিবি, নাহলে মা দেখলে বকবে!”
লয় শুনে বলল, “হুঁ!”
সেদিনটা শনিবার। বড়মাসির শরীরটা ভাল নেই বলে মা বাবা বিকেলবেলা মাসিকে দেখতে চলে গেলেন। পরদিন বিকেলে ফিরে আসবেন বলে গেলেন। কাজের লোক রাধামাসি রয়েছে ওদের সঙ্গে। পাছে লিসা পাথরটা জোজোদাকে ফিরিয়ে দেয় সেই ভয়ে বাড়ি ফিরেই ওটাকে লুকিয়ে ফেলল লয়।
রাত নটা নাগাদ দরজায় কে যেন বেল দিল। লয় গিয়ে ম্যাজিক আই দিয়ে না দেখেই ঝপ করে দরজাটা খুলে দিল। মা ওকে অনেকবার ওই রকম করতে বারণ করেছেন তা সত্ত্বেও। ওমা দরজা খুলতেই একটা গাঁট্টাগোট্টা বেঁটে মতন লোক হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে এল। তার পোশাকও বেশ অদ্ভুত গোছের, মাথায় একটা ইয়া বড় একটা বেগুনি রঙের টুপি।
তাকে দেখে রাধামাসি তো হাঁ হাঁ করে উঠল, বলল, “কে গো তুমি? কী চাই?”
লোকটা বেশ রাগরাগ ভাব করে বলল, “আমাকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনা হয়েছে এখানে! আমি তো শুনেছিলাম এখানকার লোকেরা খুব অতিথিবৎসল হয়!”
রাধামাসি কিছু না বুঝে বলল, “ও, তোমাকে নিশ্চয়ই তাহলে দাদাবাবু ডেকেছেন। দাদার অফিসের লোক বুঝি? তা বৌদি তো আমাকে কিছু বলে যাননি। রাতে এখানেই খাবে নাকি?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! আমার খুব খিদে পেয়েছে।” বলে লোকটা বাইরের ঘরে সোফাটায় আরাম করে বসে রিমোটটা নিয়ে টিভিটা অন করে দিল!
বাবার অফিস থেকে মাঝে মাঝেই লোকজন আসে ওদের বাড়িতে, সেটা আশ্চর্যের কিছু নয় কিন্তু বাবা বাড়িতে থাকলে তবেই।
এদিকে ওদের সবার রাতের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল তাই মাসি আবার রাঁধতে বসল। গজগজ করে বলে চলল, “দাদার অফিসের ওই রকম কিম্ভুত দেখতে লোকজন রাতের বেলা কেন এসে হাজির হয়েছে জানি না বাপু! বাইরে কোথাও খেয়ে এলেই তো পারত!”
লয় আর লিসার অবশ্য প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল যে লোকটা মোটেই বাবার অফিসের নয়। সে টুপিটা খুলতে সেটা আরও স্পষ্ট হল। লোকটা দেখতে কেমন যেন শ্রেকের মতন, শুধু এর চামড়াটা বেগুনি।
লয় ফিসফিস করে বলল, “দেখে মনে হচ্ছে অন্য গ্রহ থেকে এসেছে! বন্ধুদের তাক্ লাগিয়ে দেব!”
লোকটা শুনতে পেল কিনা কে জানে হঠাৎ বলল, “সেবার যখন জোজোদের বাড়িতে ছিলাম তখন খুব মজা হয়েছিল। ওর মা কী ভাল রান্না করে।”
“তুমি জোজোদার বাড়িতে ছিলে? মানে আমাদের পাড়ার জোজোদা?”
“হ্যাঁ, ওদের কুকুর রকি প্রথমে আমাকে দেখে খুব ঘেউ ঘেউ করছিল তারপর আমার সঙ্গে এমন ভাব হয়ে গেল যে আর বলবার নয়!”
লয় হোমওয়ার্ক নিয়ে বসেছিল। ওর পেনসিলটা ভোঁতা দেখে লোকটা উঠে এসে সেটা নিয়ে হাত বোলাতেই মুখটা ছুঁচলো হয়ে গেল। টেবিলে রাখা ফুলগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিল হাত বুলিয়ে সেগুলোকে টাটকা করে দিল। মেঝের ভাঙা টাইলটা গোটা হয়ে গেল ফাটল মিলিয়ে গিয়ে। তারপর লোকটা হাত নাড়াতেই লয়ের হাতের লেখায় অঙ্কটা হয়ে গেল খাতায়। সে তো আহ্লাদে আটখানা, বলল, “তুমি কি জাদু জানো?”
লোকটা বলল, “না, না, জাদু আবার কী? আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে এই সব তো সবাই করতে পারে। ওখানে আর সব কিছু ভাল কিন্তু তোমাদের এখানকার মতন খাবারদাবার পাওয়া যায় না মোটেই। সব খালি বড়ি আর ক্যাপসুল! ওসব খেয়ে মজা নেই। তবে পৃথিবীর যত জায়গাতেই গেছি কোথাও এখানকার মতন খাবার পাইনি! আচ্ছা এত দেরি হচ্ছে কেন বলতো রান্না হতে? আর যে তর সইছে না!”
রাধামাসির রান্না হতেই সে হাঁউমাউ করে খেতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে সব খাবার শেষ! ঢেকুর তুলে পরমনান্দে হাত পা ছড়িয়ে আবার টিভির সামনে গিয়ে বসে পড়ল সে।
একটু পরেই লয় আর লিসাকে বলল, “তোমরা শুয়ে পড়ো। আমার ঘুম পেলে আমি এখানেই ঘুমিয়ে নেব।”
শুতে যাওয়ার আগে লিসা লয়কে বলল, “আমার মনে হয় তুই ঠিকই বলেছিস। অন্য গ্রহ থেকেই এসেছে লোকটা। মাসি ভেবেছে বাবার অফিসের লোক তাই কিছু বলছে না। মা-বাবা শুনলে কিন্তু খুব ভয় পাবে…”
লয় বলল, “তা পাবে হয়তো কিন্তু খুব মজা হচ্ছে। যতদিন না ওরা ফিরছে ততদিন থাক। কেমন সুন্দর অঙ্কটঙ্ক করে দিচ্ছে!”
লিসা কিন্তু চিন্তিত মুখে বলল, “জানি না বাবা, আমার কিন্তু কেমন ভয় ভয় করছে!”
পরদিন সকালে রাধামাসির চিৎকারে ঘুম ভাঙল ওদের।
লয় আর লিসা ছুটে গিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল মাসি মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে। ওদের দেখে বলল, “সাংঘাতিক কান্ড হয়ে গেছে। ওই লোকটা বাড়িতে যত খাবার ছিল সব খেয়ে ফেলছে! ফ্রিজে কিছুই নেই আর। রান্না করা খাবার, কাঁচা আনাজপাতি সব শেষ। বিস্কুট, চানাচুর, মুড়ি যা ছিল সব হাওয়া। দাদা-বৌদি তো আমাকে টাকাকড়িও দিয়ে যাননি বাজার করার জন্যে সব বাজার করা ছিল বলে। এখন কী হবে? কী রাক্ষুসে খিদে রে বাবা লোকটার!”
লিসা শুনে বলল, “আমার কাছে টাকা আছে, দিদা জামা কেনার জন্যে দিয়েছিলেন। তোমাকে দিচ্ছি, তুমি তাই দিয়ে সব্জি ইত্যাদি যা লাগে কিনে নিয়ে এসো।”
যার জন্যে এত কান্ড সে মনে হয় ঘুমোচ্ছিল। একটু বাদেই কোথা থেকে এসে হাজির হয়ে বলল, “রবিবার দিন সকালে তোমাদের বাড়িতে লুচিটুচি হয় না?”
লিসা মুখ চুন করে বলল, “কী করে হবে? লুচির সঙ্গে তো তরকারিও কিছু খেতে হয় আর তুমি তো সব আনাজপাতি খেয়ে ফেলেছো তাই মাসিকে আবার বাজারে যেতে হয়েছে! কাঁচা আলু পটল কেউ খায়?”
লোকটা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, “কী করব বলো? রাতে এত খিদে পেল গেল যে কী বলব। আর খিদে পেলে আমি কিছুতেই ঘুমোতে পারি না।”
রাধামাসি বাজার করে এনে লুচি ভাজল। লয় আর লিসা যতক্ষণে একটা করে লুচি খেয়েছে ততক্ষণে লোকটা সব লুচি আর তরকারি খেয়ে শেষ করে ফেলল! খেয়েই আবার সোফায় বসে গেল টিভি দেখতে।
লয় এবার বেশ রেগে গেল, “কী হ্যাংলা রে বাবা!”
লিসা ওকে অন্য দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা শুকনো হাসি হেসে বলল, “তুই রকিকে জোজোদার সামনে হ্যাংলা বলেছিলি, পোকোকে যাতা বলেছিলি বলে জোজোদা সত্যিকারের হ্যাংলা কাকে বলে দেখাবার জন্যে ওকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে! তোকে ওই বেগুনি পাথরটা সেই জন্যেই দিয়েছিল। লোকটার সঙ্গে পাথরটার নিশ্চয়ই কোন সম্পর্ক আছে।”
“কী হবে তাহলে এবার?”
“কী আবার হবে? জোজোদাকে “সরি” বলে পাথরটা ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে।”
লয় পাথরটা যেখানে লুকিয়েছিল সেখানে খুঁজতে গিয়ে সেটাকে পেল না। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাথরটাকে পাওয়া গেল না।
দুজনে কী করবে ভাবছে এমন সময় রাধামাসি কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলো, “সর্বনাশ হয়ে গেছে! আমি দুপুরের রান্না করে স্নান করতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি রাক্ষসটা সব খেয়ে ফেলেছে! আমি আর রান্না করতে পারব না বাপু!”
লয় আর লিসার মুখ শুকিয়ে গেল। সকাল থেকে সেই একটা লুচি খেয়ে রয়েছে। দুজনে এবার জোজোদার বাড়ি ছুটল।
লয় জোজোদার কাছে কেঁদে পড়ল, “জোজোদা আমি খুব সরি। হ্যাংলা কাকে বলে এবার আমি বুঝেছি। আমি আর কোনদিন রকিকে হ্যাংলা বলব না আর পোকোকেও মোটা বলব না। তুমি প্লিজ আমাদের বাঁচাও – সকাল থেকে কিছু খাইনি!”
জোজোদা মুচকি হেসে বলল, “পাথরটা লোকটার কাছেই থাকবে। ও দিনেরবেলা বেশি ঘুমোয়, তখন পাথরটা নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দিলেই হবে। ওটাকে বাড়িতে রাখলেই মুশকিল!”
ওরা যখন ফিরল তখন লোকটা সোফাতেই ঘুমোচ্ছিল। বেগুনি পাথরটা ওর জামার পকেটেই ছিল। সেটা বার করে মাসিকে সব বলতে মাসি বলল, “তোমাদের কোথাও যেতে হবে না, দাদা-বৌদি জানতে পারলে রাগ করবেন। আমি ওটা নিয়ে যাচ্ছি দাও। আর তোমাদের ঘরে দু”বাটি মুড়ি মেখে রেখে এসেছি। রাক্ষসটা ঘুম থেকে ওঠার আগে খেয়ে নিও। আমার ফিরতে একটু দেরি হবে, আবার বাজার করে আনতে হবে। রাতে দাদা-বৌদি ফিরে এসে খাবেন তো।”
মুড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল দুই ভাইবোন। বিকেলবেলা ঘুম ভাঙতে বাইরের ঘরে ছুটে গিয়ে দেখল টিভিটা চলছে কিন্তু অবাঞ্ছিত অতিথি হাওয়া। সারা বাড়ি খুঁজে যখন কোথাও তাকে দেখতে পাওয়া গেল না তখন লয় আর লিসা আনন্দে খানিক ধেই ধেই করে নেচে নিল।
একটু পরে রাধামাসি বাজার নিয়ে ফিরতে ওরা দুজনে তাকে গিয়ে ধরল, “পাথরটা কাকে দিলে, কাকে দিলে” করে।
রাধামাসি চোখ কপালে তুলে বলল, “ওই রকম রাক্ষুসে অভিশাপ তো বড় শত্তুরকেও দেওয়া যায় না গো! তাই আমি পাথরটাকে পুকুরের জলে ফেলে দিয়ে এসেছি!”
মা-বাবা ফিরতে ওদের কিছু বলেনি ওরা বা রাধামাসি। বাবা শুধু ফাটা টাইলটা ঠিক হয়ে গেছে দেখে একটু অবাক হয়ে বলেছিলেন, “এটা ফাটা ছিল না? জোড়া লাগল কী ভাবে?”
ভিন গ্রহের জীবের কী হল জানা নেই কিন্তু লয় আর কখনও কাউকে মুখের ওপর সমালোচনা করেনি।
ছবিঃ শিমূল
অনন্যা দাশ এর আরো অনেক গল্প