সমস্ত জাতক কথা একত্রে
বন্ধু-জাতক
নন্দিনী দাস চট্টোপাধ্যায়
সে জন্মে বুদ্ধদেব ছিলেন সিংহ।একটা বিশাল হ্রদের উত্তর দিকে ঘাসজমির মধ্যে তিনি থাকতেন।হ্রদের ঠিক উল্টো পাড়ে ছিল একটা ছেলে চিলের আস্তানা।আরেকটা মেয়ে চিল ও ছিল, তবে সে থাকত হ্রদের পশ্চিম দিকের জঙ্গলে। একদিন ছেলেটার ভারী সাধ হল মেয়েটাকে বিয়ে করে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সে সটান মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমায় বিয়ে করবে?’
মেয়েটা মুখ ঝামটে উঠল, ‘উহ্! শখ কত? তোমাকে বিয়ে করে মরি আর কি?’
‘কেন? কেন? আমি কারো চেয়ে কম কীসে?’ উত্তেজনায় বেচারার চোখ গোল গোল হয়ে উঠল।
‘কম তো বলিনি। তবে তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে।’
‘কী পরীক্ষা বলো’–চিল ঘাড় ফুলিয়ে বললো।
‘পরীক্ষা সে’রকম কিছু না। কাল ভোরবেলায় তুমি আমার সাথে উড়বে।’
পরদিন সুয্যিমামা আকাশের কোণায উঁকি দিয়েছে কি দেয়নি চিল এসে ডাক দিলো চিলনীকে, ‘কই গো?আমি কিন্তু এসে গেছি।’
সূর্যের নরম আলো গায়ে মেখে চিল আর চিলনী উড়ে গেলো। দেখতে দেখতে অনেক উপরে উঠে গেছে দুজনে। হ্রদ পেরিয়ে চলে এসেছে অনেক দূর। চিলনী চিলকে বলল, ‘নীচে কী দেখছ?’
চিল নীচে তাকিয়ে বলতে লাগলো,’একটা ছোটো নদী,তার পাশে একটা গ্রাম বসেছে দেখছি। কিন্তু এখানে কোনো গ্রাম তো ছিল না!’
‘আরো ভালো করে দেখ।’
‘গ্রামে অনেক লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরিব্বাস!প্রায় সবারই সঙ্গে তির-ধনুক রয়েছে দেখছি!’
‘দেখ দেখ ঐ গাছতলাটায়-‘
গাছতলায় অনেক মানুষের জটলার মধ্যে চিল ঠিক দেখতে পেয়েছে আনেকখানি কাঁচামাংসের স্তূপ।চিলের চোখ চকচক করে উঠল।
‘রোসো, আসছি’ বলেই হঠাৎ সাঁ করে সে নেমে গেল নীচে। একটুকরো মাংস ঠোঁটে নিয়েই তাড়াতাড়ি উড়ে এলো অনেক উপরে। ইশারায় চিলনীকে বললো আরো উপরে উঠতে। কারণ গ্রামের লোকেরা তির ছুঁড়ছে। দু-একটা তো একেবারে পাখনা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত নিরাপদে হ্রদ পেরিয়ে এপারে এসে দুজনে হাঁফ ছাড়ল।
এবারে চিলনী জানাল সে চিলকে বিয়ে করতে পারে তবে তার আগে কাছাকাছি যারা থাকে তাদের সাথে ভাব করতে হবে।
চিলের কথাটা ঠিক পছন্দ হল না। এ আবার কী আবদার? বিয়ে তো করবে তারা দুজন, তার মধ্যে অন্যদের সঙ্গে ভাব করার কথা আসছে কেন?
‘আরে বাবা, বন্ধু না থাকলে বিপদে আপদে আমাদের তো কেউই সাহায্য করবে না। আর বিয়েতেই বা কে আনন্দ করবে?’
অগত্যা…….
*********
চিল-চিলনী এখন বেশ সুখেই আছে।হ্রদের ওই পাড়ে থাকা সিংহ,পুবদিকের লম্বা তালগাছে বাসা বেঁধে থাকা বাজপাখি–এদের সাথে চিল-চিলনীর ভারী বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।আর হ্যাঁ, আরেকজন বন্ধুও জুটেছে এদের।
হ্রদের ঠিক মাঝখানে একটা ছোটো দ্বীপ আছে।একটা কচ্ছপ মাঝে মাঝেই সেখানে রোদ পোয়াতে ওঠে।তার সঙ্গেও সবার বন্ধুত্ব হযে গেছে।এই পাঁচজন এখন দিব্যি আছে। চিল আর চিলনী এই দ্বীপেই একটা ঝাঁকড়া উঁচু কদম গাছে বাসা বেঁধেছে।
এই ভাবে দিন যায়।
একদিন চিলনী দুটো ডিম পাড়ল। অতি যত্নে তা’ দিয়ে একদিন ডিম ফুটে ছোট্ট দুটো ছানা বেরোল। চিল আর চিলনী সবসময় ছানাদের পাহারা দেয়। চোখ না ফোটা ছোট্ট ছানা-যতদিন না নিজেরা উড়তে পারছে ততদিন এদের ভীষণভাবে আগলে রাখতে হয়।না হলে পদে পদে বিপদ।
*********
একদিন সন্ধ্যেবেলায় চিল আর চিলনী সবে বাচ্চা দুটোকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছে এমন সময় ধোঁয়ায় যেন দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। বাচ্চাদুটো ঘুম ভেঙে চিল-চিৎকার জুড়ে দিল। কী ব্যাপার? গাছের নীচে কি আগুন লেগেছে?
নীচে তাকিয়ে চিলজুটির তো আক্কেল গুড়ুম! দুজন লোক গাছের নীচে শুকনো পাতা জোগাড় করে আগুন জ্বালিয়েছে। চিলছানাদের চিৎকার শুনে নিচের লোকদুটোর সে কী আনন্দ!দুজনে আগুনটাকে গিরে রীতিমত নাচ শুরু করে দিয়েছে,’আজ পাখির ছানার মাংস খাব।’
আসলে হয়েছে কী, এরা গ্রাম থেকে জঙ্গলে এসেছিল শিকারের খোঁজে। অথচ এরা এখনো শিকারে তত পটু হয়ে ওঠেনি। কাজেই সারাদিন জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করেও না পশুপাখি, না মাছ কিছুই জোটেনি। এদিকে রাত হয়ে গেছে। অন্ধকারে জঙ্গল পেরিয়ে গ্রামে ফেরাও মুশকিল।সারাদিন শিকার জোটেনি তাই খাওয়াও হয়নি সেরকম। হ্রদের মধ্যিখানে এই দ্বীপে রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে সকালে আবার শিকারের খোঁজে বেরোন যাবে এরকমই মতলব এঁটে দুজনে গাছের নীচে আগুন জ্বালিয়েছে।পাখির ছানার সাড়া পেয়ে তাই দুজনের ভারী স্ফূর্তি হয়েছে।
মশাল জ্বেলে বড় পাখিদুটোকে তাড়িয়ে দিলেই আর পায় কে? সেইমত ওরা চটপট মশাল বানাতে বসে গেল।এদিকে সব দেখেশুনে চিল-চিলনীর তো চিন্তায় মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়।এখন উপায়? চিলনী চিলকে তাড়াতাড়ি পাঠালো বাজের কাছে। চিল উড়ল হ্রদ পেরিয়ে পুবদিকের লম্বা তালগাছের দিকে।
এই অসময়ে চিলকে দেখে বাজ তো অবাক, ‘এমন অসময়ে তুমি এখানে?’
‘শিগগির চলো দাদা, আমাদের ভারী বিপদ!’
সব শুনে বাজ উড়লো চিলের সাথে।
ইতিমধ্যে সেই লোক দুজন মশাল জ্বালিয়ে গাছে ওঠা শুরু করেছে।বাজ হ্রদের জলে ডানা ভিজিয়ে সাঁ করে চলে এলো জ্বলন্ত মশালের ঠিক উপরে।তার ডানার ঝাপটানিতে বৃষ্টির মতো জল পড়ে মশাল নিভে গেল। যতবারই এরা মশাল জ্বালাতে যায়, ততবারই বাজ এইভাবে মশাল নিভিয়ে দেয়। চিলনী খেয়াল করল আগুনের তাপে বাজের বুকের দিকটা ঝলসে গেছে। ক্লান্ত হলেও বাজের কর্তব্যে কিন্তু কোনো খামতি নেই।
বাজের অবস্থা দেখে চিল-চিলনীর ভারী কষ্ট হল। বলল, ‘তুমি এবার একটু বসো দাদা।’
‘না,না চিন্তা কোরো না, আমি ঠিক আছি,’ -এই বলে বাজ আবার হ্রদের দিকে উড়ল জল আনতে।
চিল এবার চললো কচ্ছপের আস্তানায়। অসময়ে চিলকে দেখে কচ্ছপ তো অবাক!
‘এমন অসময়ে তুমি এখানে?’
‘শিগগির চলো দাদা, আমাদের ভারী বিপদ!’
সব শুনে কচ্ছপের ছেলের রক্ত রাগে গরম হযে উঠল। সে বলল, ‘বাবা, আমি যাচ্ছি বদমাশ লোকদুটোকে শায়েস্তা করতে।’
‘না রে, তোর দেহটা এখনো ছোট্টোখাট্টো। ওখানে গেলে তোর বিপদ হবে। আমার এই বিশাল বপু দিয়ে ওদের কেমন হেনস্থা করি দেখ না!’ বলে কচ্ছপ চলল চিলের সঙ্গে।
এদিকে লোকদুটোও ততক্ষণে হয়রান হয়ে পড়েছিল। সারাদিন না খাওয়া, না দাওয়া; তারপর যদিবা একটা সহজ শিকারেরে সন্ধান পাওয়া গেল তো বাদ সেধেছে পাজি বাজটা। কচ্ছপকে দেখে দুজনে ভাবলো এটাকেই ধরে নিয়ে গ্রামে ফেরা যাক। তাহলে মাংসও অনেকটা জুটবে আর ভালো শিকারী হিসাবে নামডাকও হবে।এই না ভেবে ওরা জংলী গাছের শিকড়-বাকড় ,লতাপাতা দিয়ে শক্ত করে দড়ি বানাল। তাই দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধলো কচ্ছপকে। ব্যাস,এবার গ্রামের দিকে ফিরলেই হয়।হ্রদ পেরিয়ে একবার ওপারে পৌঁছতে পারলে আর পায় কে!গাঁয়ের লোক এ খবর পেলে সবাই মিলে কচ্ছপকে টেনে হিঁচড়ে গাঁয়ে নিয়ে তুলবে।
হ্রদে নামার পর কিন্তু ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে গেল।লোকদুটো একসময় টের পেল ওরা কচ্ছপকে টানছে না, বরং প্রবল হ্যাঁচকা টানে কচ্ছপমশাইই ওদের নিয়ে যাচ্ছে জলের গভীরে। নাকানি-চোবানি খেয়ে কোনোমতে দুজনে ভেসে উঠলো মাঝগাঙে।পরণের কাপড়-চোপড় সব ভিজে ঢোল। কী আর করা। আবার দুজনে সাঁতরে চলে এলো সেই কদম গাছের নীচে।এদেরও রোখ চেপে গেছে।এই পাখিগুলোর জন্যই এত হেনস্থা। আজ যে করেই হোক এদের সাবাড় করে মাংস খেলে তবে শান্তি।
বেগতিক দেখে চিল উড়ল সিংহের আস্তানার দিকে। চিলকে দেখে সিংহ অবাক।
‘এমন অসময়ে তুমি এখানে?’
‘শিগগির চলো দাদা, আমাদের ভারী বিপদ!’
সব শুনে সিংহ বলল, ‘তুমি যাও, সইকে বলো চিন্তা না করতে। আমি আসছি।’
তার স্বভাবসিদ্ধ সিংহনাদ ছেড়ে সিংহ হ্রদের জলে নামল। সেই আওয়াজে গোটা বনভূমি কেঁপে উঠলো থরথর করে।চাঁদের আবছা আলোয় হ্রদের জলে সিংহকে সাঁতরাতে দেখে লোকদুটোর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়!পড়িমড়ি ছুট লাগালো উল্টোদিকে।
‘দরকার নেই বাবা,পাখির ছানা খাওয়ার।এখন প্রাণটা থাকলে হয়।’
‘ঠিক বলেছ।কী সাংঘাতিক পাখি!’ বলতে বলতে ছুট–ছুট–ছুট–একেবারে দ্বীপের ওপারে গিয়ে সাঁতার কেটে ডাঙায় উঠে তবে শান্তি। সোজা ছুট এবার গ্রামের দিকে।
এদিকে সিংহ চিলেদের আস্তানার কাছে এসে দেখে বাজ, কচ্ছপ সবাই হাজির। কিন্তু কোনো মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। চিল-চিলনী এতক্ষণে হাঁফ ছাড়ল। বাছাদের ফাঁড়া তাহলে কাটল শেষ পর্যন্ত!আনন্দে তাদের চোখে জল, ‘ভাগ্যিস তোমরা ছিলে, নইলে যে আজ কী হত!’
সিংহ বলল, ‘আসলে আলাদা করে আমরা কেউই কিছু না। বন্ধুত্বই আমাদের আসল জোর।’
সবাই মাথা দুলিয়ে সিংহের কথায় সায় দিলো।
ছবিঃ তিতিল