সবর্না চ্যাটার্জি
ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী হায়দ্রাবাদ শহরের পশ্চিমে এবং হুসেনসাগর লেকের ৯ কিলোমিটার দূরে ইব্রাহিম বাগে অন্ধ্র তথা হায়দ্রাবাদের গর্ব একদা কুতুবশাহী সুলতানদের গৌরবময় রাজধানী গোলকুন্ডা দুর্গ অবস্থিত যার উপরের অংশ থেকে দৃশ্যমান হয় গোটা হায়দ্রাবাদ শহর। এটি মূলত মানকাল নামে পরিচিত। ১১৪৩ খ্রিস্টাব্দে একটি পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপিত হয়েছিল এই দুর্গ। গোলকুন্ডা, কুতুবশাহী রাজাদের প্রধান রাজধানী ছিল। এর অভ্যন্তরে প্রাসাদ, মসজিদ এবং প্রায় ১৩০ মিটার উঁচু একটি পাহাড়ের উপরের প্যাভিলিয়ন ধ্বংসাবশেষের হদিশ পাওয়া যায়। গোলকুন্ডা ফোর্ট নিঃসন্দেহে ভারতের উল্লেখযোগ্য দুর্গগুলির মধ্যে একটি।
কিংবদন্তি অনুসারে রাখালছেলের পাহাড় (শেফার্ড হিলস) নামে পরিচিত এই গোলকুন্ডা দুর্গের রয়েছে অত্যন্ত চমকপ্রদ এক ইতিহাস। একদিন এক রাখাল-বালক মঙ্গলাভরম নামে এক পাহাড়চুড়োর মাটি খুঁড়ে এক মূর্তি খুঁজে পায়। আর সে-খবর শুনে ১১৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সেসময়ের কাকাতীয় বংশের রাজা স্থানটি পবিত্র ভেবে মাটির দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেন। আবার কারও মতে ৯৪৫ – ৯৭০ খ্রিষ্টাব্দেই কাকাতীয় বংশের রাজারা পশ্চিমদিক থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য গোলকুন্ডা দুর্গটি নির্মাণ করেছিল। তবে সেটা ছিল মাটির তৈরি কাদা-দুর্গ বিশেষ। রানি রুদ্রামা দেবী এবং তার উত্তরসূরী প্রতাপরুদ্র দ্বারা দুর্গের পুনর্নির্মাণ জোরদার করা হয়। পরবর্তীকালে মুসুনুরি নায়েক ওয়ারগাল দখল করে তুঘলকি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করলে কেল্লা তার দখলে আসে। ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দে (প্রায় ২০০ বছর পর) একটি চুক্তি স্বাক্ষরের ভিত্তিতে মুসুনুরি কাপায়া নায়েকের থেকে বাহমনী সুলতানরা গোলকুন্ডা দুর্গের দখল লাভ করে।
বাহমনী সলতানতের অধীনে গোলকুন্ডা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুলতান কুলি কুতুব-উল-মুলক (১৪৮৭-১৫৪৩), ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে তেলঙ্গানার গভর্নর হিসাবে প্রেরিত হন। বাহমনী শাসন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়লে ১৫১৮ খ্রিষ্টাব্দে কুলি কুতুবশাহ ক্ষমতাসীন বাহমনী সলতানাত থেকে বেরিয়ে এসে কুতুবশাহী বংশের সূচনা করেন এবং গোলকুন্ডা দুর্গকে তার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর ৬০ বছর ধরে প্রথম তিনজন কুতুবশাহী সুলতানের হাত ধরে ইতিহাস বদলের সাথে সাথে বদলে যায় গোলকুন্ডা দুর্গের রূপ। মাটির দুর্গটিকে প্রথমেই বদল করা হয় কঠিন শিলা গ্রানাইট পাথরে। শুধু তাই নয়, বিস্তৃতি ঘটে তার আয়তনেও। ১২০ মিটার উঁচু সেই মঙ্গলাভরম পাহাড় ও তার পাদদেশকে কেন্দ্র করে ৫ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয় সুরক্ষিত এই দুর্গনগরী গোলকুন্ডাকে। ১৬ থেকে ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত কুতুবশাহী বংশের সুলতানি শাসনামলের বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই দুর্গের পতন ঘটে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে, তাঁর একাধিকবারের চেষ্টায় ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে।
গোলকোন্ডায় এখনও মাউন্ট করা ক্যানন, চারটি ড্রিব্রিজ, আটটি গেটওয়ে এবং রাজকীয় হলঘর, পত্রিকা, আস্তাবল ইত্যাদির সন্ধান মেলে।
Archaeological Survey of India দ্বারা প্রস্তুত ‘List of Monuments’-এর তালিকায় একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পত্তি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে এই গোলকুন্ডা ফোর্ট। (The Ancient Monuments and Archaeological Sites and Remains Act অনুসারে)
গোলকুন্ডা দুর্গে প্রবেশের জন্য ছিল আটটি তোরণ, যার মধ্যে দক্ষিণ-পূর্বদিকের তোরণটি উঁচু খিলানওয়ালা এবং সেই সাথে লোহার শলাকা দিয়ে গাঁথা। উদ্দেশ্য, যেন কোনও শক্তিশালী হাতিও তা ভেঙে প্রবেশ করতে না পারে। এই তোরণটির নাম ফতেহ দরওয়াজা বা বিজয় তোরণ। এই বিজয় তোরণ দিয়েই আওরঙ্গজেব বিজয়ীর বেশে দুর্গে প্রবেশ করেছিলেন বলে এর নাম হয় বিজয় তোরণ। অবশ্য এই দুর্গ দখলের জন্য তাকে নয় মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল দুর্গ-প্রাচীরের বাইরে। অবশেষে এক বিশ্বাসঘাতকের মাধ্যমে আওরঙ্গজেব এই দুর্গ দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ইতিহাস বলে, পূর্বদিকের বালাহিসার তোরণটি ছিল কেল্লার প্রধান ফটক। সেই তোরণে রয়েছে এমনসব চিত্রশিল্প যা কিনা হিন্দু-মুসলিম শিল্পের অপূর্ব মেলবন্ধনের নমুনা। চারদিকে ঘিরে থাকা পরিখার মাঝে আর একের পর এক মোট তিন-তিনটি সুউচ্চ প্রাচীর-ঘেরা এই বিশাল গোলকুন্ডা দুর্গটি শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয়, শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে এর নির্মাণশৈলীতেও রয়েছে অত্যন্ত চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক কৌশলের ব্যবহার।
গোলাকুন্ডা দুর্গটির উঁচু খিলানওয়ালা ফতেহ দরওয়াজা দিয়ে প্রবেশ করেই খিলানের নিচে এক বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে তালি বাজালে দুর্গের সর্বোচ্চ চূড়ায় ১ কিলোমিটার উপরে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও ব্যক্তি তা স্পষ্ট শুনতে পান। এই যে এ তালির আওয়াজ, তোরণের আশেপাশের কোনও স্থাপনা থেকে শোনা যায় না। এর উদ্দেশ্য ছিল দুর্গের ফটকে কোনও অনাহুত আগন্তকের আগমনের বার্তা সাথে সাথে উপরে থাকা রাজকীয় ব্যক্তিবর্গের কানে পৌঁছে দেয়া। অতিথির পরিচয় অনুযায়ী সে ব্যবস্থা নেওয়া হত। বর্তমানে এই তালি বাজানো প্রক্রিয়াটি পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।
দুর্গের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য ছিল চারটি ঝুলন্ত সেতু যা প্রয়োজন মতো বিছিয়ে দেওয়া যেত বা উপরে উঠিয়ে দিলে ভারী দরজার মতো বন্ধ হয়ে যেত কেল্লায় প্রবেশের সেই চারটি মুখ। পাহাড়চুড়োর বালাহিসার হল থেকে পালিয়ে যাবার জন্য একটি সুড়ঙ্গপথ ছিল যা দুর্গের দেয়ালের বাইরে ১ কিমি দূরে কুতুবশাহী সমাধিতে মিশেছে। সমাধিক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাবার জন্য হায়দ্রাবাদ শহরের প্রাণকেন্দ্র চারমিনার পর্যন্ত আরেকটি সুড়ঙ্গ ছিল।
অন্দরমহলের বিভিন্ন মোটা মোটা গ্রানাইট পাথরের দেয়ালের জায়গায় জায়গায় ছিদ্র রয়েছে। ফিসফিস করে কোনও কথা বললে তা অন্য কোনও ছিদ্রে কান পাতলে স্পষ্ট শোনা যায়। গুপ্তচরবৃত্তির অথবা সেখানকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তার জন্য এটি একটি চূড়ান্ত উদাহরণ।
বহিঃশত্রুর আক্রমণ রাজধানী অর্থাৎ দুর্গটি রক্ষার জন্য সেই সুউচ্চ সীমানা প্রাচীরে একটু পর পর একটি চৌকিঘর ছিল যেখানে সৈনিকরা সবসময় পাহারায় থাকত। সেই চৌকিঘরগুলোতে কামান বসানোর বন্দোবস্ত ছিল। তবুও শেষপর্যন্ত গোলকুন্ডা দুর্গ হার মেনেছিল সম্রাট আওরঙ্গজেবের উপুর্যপুরি আক্রমণে আর সাথে তার ফতেহ রাহবেন কামানের ক্রমাগত গোলার আঘাতে আঘাতে।
এই দুর্গে নিচ থেক উঁচু পর্যন্ত জল সরবরাহের জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বিত হত তা সে-যুগের প্রযুক্তিতে এক বিস্ময়কর ব্যপার। প্রবেশপথের ডানদিকে রয়েছে মাঝখানে সরু পথ যার দু’দিকে সৈন্যদের ব্যারাক।
বিশাল বিস্তৃত এই দুর্গের অভ্যন্তরে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বালাহিসার, সুলতানি নির্মাণশৈলীতে নির্মিত বাগান নাগিনা বাগ অন্দরমহলের মাঝে ছাদ-বাগান, রাজদরবার ইত্যাদি।
সুলতানের প্রিয় গায়িকা তারামতীর নামে মহিলা মসজিদ স্থাপিত হয়েছিল। বিখ্যাত ইব্রাহিম মসজিদ যা ছিল দুর্গের প্রধান উপাসনালয়। এই দুর্গের ভেতরে একটি হিন্দুমন্দির ঘিরে কিছু কথা কথিত আছে। রামদাসু নামে এক হিন্দু ব্যক্তি সুলতান আবুল হাসানের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। তহবিল তছরুপের অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। এর সত্যতা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন। যাই হোক, সেই রামদাসু তার দীর্ঘ এবং একক কারাবাস জীবন কাটিয়েছিলেন সেই গোলকুন্ডা দুর্গের এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। সেখানে আলো আসার একটিই পথ ছিল আর তা হল অনেক উপরে গম্বুজাকৃতি ছাদের ঠিক মাঝখানে ছোট্ট এক ছিদ্রপথ দিয়ে। সেই অন্ধকার বন্দী জীবনে রামদাসু তার কারাগারের দেয়াল খোদাই করেছিলেন বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি। সেই ঘরটি ঘিরেই পরবর্তীতে নির্মিত হয়েছে হিন্দুমন্দির।
পৃথিবী-বিখ্যাত হীরা যা বৃটেনের রানির মুকুটে শোভা পাচ্ছে সেই ‘কোহিনূর’, ইরানের রাজার মুকুটে শোভা পাওয়া ‘দরিয়া-ই-নূর’ (sea of light) এবং জগৎবিখ্যাত হীরা ‘দ্যা হোপ’ সবই আবিষ্কৃত হয়েছিল এই গোলকুন্ডাতেই।
যা বর্তমানে ধ্বংস প্রায়, আম্বরখানা বা খাদ্য গুদাম, জলের জন্য সিঁড়িওয়ালা কুয়া, বিশাল গ্রানাইট পাথর খোদাই করে তৈরি মন্দির, রামদাসুর কারাগার, রানিমহল, অন্দরমহল,
এই অঞ্চলে অনেক হীরকখনির হদিশ পাওয়া যায়। একসময় অন্যান্য হিরের সাথে বিখ্যাত দরিয়া-ই-নূর, হোপ ডায়মন্ড, কোহ-ই-নূর সংরক্ষণ করা হত। গোলকুন্ডা দক্ষিণ-পূর্বের কোল্লুর খনির নিকটবর্তী কুলুর, গুন্টুর জেলার পারিতলা এবং কৃষ্ণ জেলার আতকুরের কাছে কাকাতীয় রাজত্বকালে স্থাপিত একটি দুর্গ। সেই সময়ে একমাত্র হীরার খনি ছিল ভারতে। গোলকুন্ডার খনিগুলি অনেকগুলি হীরা উপহার দেয়। হীরা ব্যবসায়ের জন্য বিখ্যাত ছিল গোলকুন্ডা।
খনিগুলি হায়দ্রাবাদ রাজ্যের কুতুবশাহীদের রাজাদের কাছে প্রচুর ধনসম্পত্তি নিয়ে আসে। তারা ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে গোলকুন্ডা শাসন করেন, তারপর ১৭২৪ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত শাসন করেন হায়দ্রাবাদের নিজাম।
দুর্গে একটি শবদেহ গোসলের ঘরও ছিল। দুর্গের ভেতর বিশিষ্ট কেউ মারা গেলে এখানে তাকে গোসল করিয়ে কফন পরানো হত।
দুর্গের ভেতরে ছিল বিশাল এক অস্ত্রশালা।
বহুমূল্য মণিমানিক্যের পাশাপাশি এই দুর্গ নাকি এক নিবিড় প্রেমকাহিনির সাক্ষ্য বহন করে। নর্তকী তারামণি এবং আবদুল্লা কুতুব শাহর ভালোবাসা আজও নাকি দুর্গের প্রতিটি স্তম্ভের জানা। শুধু তাই নয়, শোনা যায় এই প্রেম নাকি পরিণতি পায়নি। তাই নাকি আজও নর্তকী তারামণির অতৃপ্ত আত্মা দুর্গে ঘুরে বেড়ায়।
পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য এখানে রাতে light and sound-এর একটি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা আছে। সেই সাথে জগৎবিখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের জলদগম্ভীর ভরাট কন্ঠে মূর্ত হয়ে ওঠে সুলতানি আমলের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাস।
তথ্যসূত্রঃ নিজস্ব দর্শন-অভিজ্ঞতা।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Golkonda
http://www.telanganatourism.gov.in/partials/destinations/heritage-spots/hyderabad/golconda-fort.html
http://www.hyderabadtourism.travel/golconda-fort-hyderabad