আগের পর্বগুলো
“না। ফিরিঙ্গি দেখিনি, কিন্তু তাদের লাল কোট পরা পিঁপড়ের সারের মত সেপাইরা আগেভাগে একদল মালবোঝাই উট নিয়ে এসে পৌঁছে গেছে সেটা দেখেছি।”
“উঠেছে কোথায়?”
“গ্রামের মধ্যে ঢুকেছে গিয়ে। এই জায়গাটা চাইছিল, আমি মানা করে দিয়েছি। বলেছি আমাদের সঙ্গে মুনসিজি আছেন। তিনি রইস আদমি। তাঁকে এভাবে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। তাছাড়া গ্রামের উল্টোদিকে আরো ভালো ভালো সব জমি আছে, সেইখানেই গিয়ে থাকবার জায়গা দেখে নিক।
“হুম। তাহলে চিন্তা কোরো না। আমাদের হাতের কাজটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলা যাক এসো। ইতিমধ্যে কোন লাল কোট লশকর যদি এদিকে উঁকি দিতে আসে তাহলে তাকে কী করতে হবে সে তোমার ভালোই জানা আছে।গ্রামে আমাদের দলের প্যাটেল আছে, হিতা সিং আছে, আমাদের তবে আর চিন্তা কী?”
“বেশ বেশ মীরসাহেব। কিন্তু যা করবার খুব তাড়াতাড়ি করবে। একটুও সময় যেন নষ্ট না হয়।”
তাকে বাইরের কাজ শেষ করতে বলে আমি হাতের রুমালটা নিয়ে খেলতে খেলতে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে এলাম ফের।
“কী হল?” আমি ভেতরে ঢুকতে মুন্সী জিজ্ঞাসা করল।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “ও কিছু না। ফিরিঙ্গিদের লোকজন এসে এইখানে তাঁবু খাটাতে চাইছিল। আমার লোকেরা তাদের বুঝিয়েসুজিয়ে গ্রামে অন্যধারে পাঠিয়ে দিয়েছে। কাল সকালে সব এসে হাজির হবে দেখবেন।”
“সুখবর। কাল থেকে তাহলে আর আপনাকে বিরক্ত করব না মীরসাহেব। আমি ওই ফিরিঙ্গিদের সঙ্গেই চলে যাব।” এই বলে আমার লোকজনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সে আবার বলল, “কী হে গান থামল কেন? গাও, গাও সব। কাল চলে যাব বলে কি আজ আনন্দফুর্তি করব না নাকি? গাও, গাও, ভালো বখশিস দেব।”
গানবাজনার শব্দ যখন একেবারে তুঙ্গে উঠেছে ঠিক তখন আমি ঝিরনিটা দিয়ে দিলাম। মুন্সি তাঁবুর কানাতের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছিল। ফলে তার পেছনদিকে গিয়ে দাঁড়াতে মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল আমার। তাই দেখে আমাদের দলের একজন গিয়ে বলে, “মুন্সিজি, উঠে একটু এগিয়ে দাঁড়াবেন একবার?”
সে অবাক হয়ে বলে, “কেন?”
আমি বললাম, “দাঁড়ানই না একবার। তারপর বলছি।”
মুন্সি একটু ইতিস্তত করে উঠে দাঁড়াতেই আমি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলাম, “পান লাও।”
বলতে বলতেই আমি আমার রুমালটা তার গলায় জড়িয়ে দিয়েছি। একফোঁটা শব্দও গলা থেকে বের না করে মুন্সি মাটিতে আছড়ে পড়ল। তাঁবুর একটা ফুটো দিয়ে মুন্সির বউ আমাদের গানবাজনা দেখছিল। হঠাৎ এই দৃশ্য দেখে সে আর্তনাদ করতে করতে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল আমাদের একেবারে মাঝখানে। বাচ্চাটাকে তার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমি ঠগিদের মাঝখানে বউটাকে রেখে দিয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম। বের হয়ে এসে প্রথমেই দেখা গণেশের সঙ্গে। মশালের আলোয় তার মুখটা আনন্দে ডগমগ করছিল।
আমায় দেখে বলে, “সবক’টা শেষ। আমি নিজে মেরেছি দুটোকে। লুগাইরা কোথায় গেল? তাড়াতাড়ি হাত লাগাক এসে। সময় নেই।”
ওদিকে তাঁবুর মধ্যে গানবাজনা কিন্তু তখনও সেই একইভাবে চলছে। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম মুন্সীর জায়গাটায় বসে বাবা গান শুনে যাচ্ছে হাসি হাসি মুখে। ওরই মধ্যে অন্য ঠগিরা হাতে হাতে লাশগুলো নিয়ে গিয়ে কুয়োর মধ্যে ফেলছিল এক এক করে।
আমার কোল থেকে বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদছে তখন, আর বার বার শুধু বলছে, “আমায় আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাও।” তাকে কোলে নিয়ে ভোলাতে ভোলাতে আমি একবার কুয়োটার দিকে গেলাম কাজ কীরকম এগোচ্ছে তাই দেখতে। সেখানে গণেশ দাঁড়িয়ে কাজের তদারক করছিল। বাচ্চাটাকে আমার কোলে দেখে সে এগিয়ে এসে বলে, “এ আবার কেমন বোকামো মীরসাহেব? এত বিপদের মধ্যে কাজ হচ্ছে, আর তার মধ্যেও বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রেখে বিপদ বাড়াচ্ছেন কেন আপনি? দিন, দিন, আমার কাছে দিন। শয়তানের বাচ্চাকে চুপ করিয়ে বাপ মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিই।”
“খবরদার,” আমি হাঁক দিয়ে উঠে বললাম, “টাকাপয়সা যা পাওয়া যাবে সেই সব তুমি নিতে পারো, কিন্তু বাচ্চাটাকে মারা চলবে না। ও আমার। আমার এই বয়েসি ছেলে একটা মারা গেছে। একে আমি দত্তক নিচ্ছি।”
“পাগলামি করবেন না মীরসাহেব। এটাকে বাঁচিয়ে রেখে কতবড় ঝুঁকি নিচ্ছেন আপনি তার আন্দাজ করতে পারেন?”
“না গণেশ। একে তুমি মারতে পারবে না।”
গণেশ দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “জীবনে একবারই একটা বাচ্চাকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে দিয়েছিলাম। তারপর ভবানীর কাছে কিরে খেয়েছি, দ্বিতীয়বার সে ভুল আমি করব না।”
“সে তুমি কী কিরে খেয়েছো না খেয়েছো সে তোমার ব্যাপার। এখন একটা ঝগড়া যদি না বাধাতে চাও তাহলে নিজের কাজ করো, আমার ব্যাপারে মাথা গলিও না,” বলতে বলতে আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছি তখন গণেশ এসে আমার একটা হাত চেপে ধরল।
আমি কোমরে হাত দিয়ে ছুরিটা খুঁজতে খুঁজতে বললাম, “আমার হাতে ছুরি খেতে না চাইলে আমায় যেতে দাও গণেশ। নইলে–”
“আরে ছোকরা, তুই গণেশকে কি ছুরি দেখাবি রে? গণেশ তোকে অনেক দেখেছে। তোর হাতের ছুরিকে আমিই ভয় পাই না। বাচ্চাটা দে। ওর আওয়াজ শুনে এরপর ফিরিঙ্গিদের সেপাই চলে আসবে। তার আগেই গলাটা টিপে দিই–”
কোমর হাতড়াতে হাতড়াতে আমার খেয়াল হল, ছুরি আর তলোয়ার দুটোই তাঁবুতে রয়ে গেছে আমার। উপায় না দেখে ভাবলাম লোকটার মনে যদি একটু দয়াটয়া আনা যায় সে চেষ্টা করে দেখি। বললাম, “তোমার বুকে কি একফোঁটা দয়ামায়াও হয় না জেমাদার? এইটুকু একটা বাচ্চা, তাকে মারতেও হাত কাঁপবে না তোমার?”
গণেশ কিন্তু কোন কথা শোনবার জন্য একমুহূর্তও অপেক্ষা করল না। ছুটে এসে আমার কোল থেকে হ্যাঁচকা টানে বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে কুয়োর ভেতর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে, “ওসব হাতটাত আমার কখনো কাঁপে না মীরসাহেব। এখন যাও, তাঁবুতে গিয়ে খেলনা হারাবার দুঃখে বসে বসে কাঁদো গে।”
আমি ছুটে গিয়ে কুয়োটার মধ্যে উঁকি দিলাম একবার। বাচ্চাটা সেখানে লাশগুলোর মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। তার ওপরে ঝপাঝপ মাটি পড়ছে তখন।
পেছনদিকে ঘুরে গণেশের মুখোমুখি হয়ে আমি দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, “কুকুরের বাচ্চা। আমার তলোয়ারটা যদি হাতের কাছে তখন থাকত তাহলে তুই আজ–”
“আরে যাও যাও মীরসাহেব। ওসব ফাঁকা বুলি আউড়ে আমায় ভয় দেখাতে এসো না। তোমার মত একটা মাথামোটা বাচ্চা ছেলেকে গণেশ ভয় করে না।”
সেসময় আমাদের যা অবস্থা তাতে প্রতিশোধ টতিশোধ নেবার ইচ্ছেটাকে মনের মধ্যেই রেখে দিতে হল আমাকে। তাঁবুতে ফিরে বাবাকে আর আমার একেবারে কাছের তিনজন ঠগিকে আমি সব খুলে বললাম। তারা সবাই কথা দিল আমি বদলা নিতে চাইলে তারা আমার সঙ্গে থাকবে। ইচ্ছে করলে পরের দিনই আমি গণেশকে ধরতে পারতাম, কিন্তু তা আমি করলাম না। তাকে ধরেছিলাম কিছুদিন পরে উপযুক্ত সময় বুঝে, সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যাবার পর।
উপস্থিত সে রাতটা সেইখানেই কাটিয়ে দেয়া হল। মুন্সির পালকিটাকে ভেঙে কুয়োতেই ফেলে দেয়া হয়েছিল। পরদিন সকালে রওনা হয়ে আমরা একেবারে ফিরিঙ্গিদের ঘাঁটিটার মধ্যে দিয়েই গেলাম। সেটা আমাদের এত কাছে ছিল যে, আমাদের এখানকার চ্যাঁচামেচির শব্দ তাদের কানে যাবার কথা। তবে ওই গানবাজনার কৌশলটা করায় সে সমস্যাটা আর হয়নি।
কাজটা করে টাকাপয়সা অবশ্য বেশি পাওয়া যায়নি। সাকুল্যে তিন হাজার টাকা জুটেছিল আমাদের। কাজেই ফের আমরা পথে নামলাম। ডাকুগুলোর নাগাল না পেলে এবারের যাত্রায় টাকাপয়সার মুখ আর যে বিশেষ দেখা যাবে না সে আমি ভালোই বুঝে গিয়েছিলাম।
নাগপুর পৌঁছে আমরা মুন্সির ঘোড়া আর উটগুলো বিক্রি করে দিলাম। তারপর দলটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে একটা দল ইমাম বকশ জেমাদারের নেতৃত্বে চলে গেল অমরাবতীর দিকে, আর আমাদের বাকি দলটা নাগপুরে চার দিন কাটিয়ে যে পথে এসেছি সেই পথেই ফিরে যাওয়া শুরু করলাম।
দিনদুয়েক চলবার পর একদিন একটা গ্রামে এসে পৌঁছোতেই আমাদের চরেরা খবর আনল ডাকুর দলটাকে সেই গ্রামে দেখা গেছে।
তাদের বর্ণনা টর্ণনা শুনে বাবা মাথা নেড়ে বলে, “এদের খেলিয়ে তুলতে বেগ পেতে হবে রে! সোথার কাজটা আমি আর কাউকে দিয়ে ভরসা পাব না। ওটা তুই আমার হাতে ছেড়ে দে। আমি হায়দারাবাদ থেকে আসা হিন্দু রাজপুত সর্দার সেজে এদের গিয়ে ধরব। তারপর মজাটা দেখে যা শুধু। কাজকারবার কিচ্ছু ভুলিনি, তুই দেখে নিস!”
তারপর তিলক কেটে, চোখের ওপর ছাই মেখে কালচে করে হিন্দু পোশাক-আশাক পরে দলের একটা লোককে সঙ্গে নিয়ে বাবা গ্রামে গিয়ে ঢুকল। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, বাবা না আবার গুলিয়ে ফেলে সবকিছু ভেস্তে দেয়। গণেশের কিন্তু বাবার ওপর অগাধ আস্থা। সে খালি বলছিল, “ইসমাইল সব সামলে নেবে। ভবানীর সাক্ষাত বরপুত্র। ও কখনো কোন কাজে হেরে ফেরেনি–”
রাত বেশ খানিকটা গভীর হবার পর বাবা ফিরল। আমার ততক্ষণে দুশ্চিন্তা হতে শুরু করেছে। বাবা ফিরতে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে আমি বললাম, “এত দেরি হল যে? সব ঠিক আছে তো?”
বাবা ঘোড়া থেকে নামতে নামতে বলে, “ঠিক আছে। ব্যাটাদের ফাঁদে ফেলেছি। যাবে কোথায়?”
আমি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললাম, “দারুণ খবর বাবা। কিন্তু করলে কী করে?”
“আরে শুরুতেই বিপদ হতে যাচ্ছিল। ডাকুগুলোর মধ্যে একটাকে আমি চিনি। সে-ও আমাকে ভালো করেই চিনত অনেকদিন আগে। তাকে দেখে ভাবলাম, সর্বনাশ বুঝি হয়েই গেল। কিন্তু ভবানীর দয়ায় আমার সাদা দাড়ি আর কপালে এইসব কাফেরি ছাপছোপ দেখে ব্যাটা ধরতেই পারেনি যে আমিই সেই ইসমাইল ঠগি। বলে তারা নাকি ফিরিঙ্গিদের সেপাই। ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে। আমিও গল্প লাগিয়ে দিলাম একটা, বললাম আমি জালনার আবগারি খাজনাওয়ালা। সেই শুনে তারা তো আমাকে মাথায় তুলে ফেলে প্রায়। নিজেদের মধ্যে যেসব ইশারা চালাচালি করছিল তাতে বুঝলাম আমাকে এরা বেশ ভালো বুনিজ ঠাউরেছে। খানিকক্ষণের মধ্যেই বলে, দু’দল মিলে একসঙ্গে পথ চললে কেমন হয়। আমি রাজি হয়ে গেলাম। তবে এদের নিয়ে দেরি করলে চলবে না। ভবানীর সংকেতটেত একবার দেখে নিই, তারপর কালকেই শুভকাজটা করে ফেলতে হবে। নইলে বুনিজ ভেবে এরা আমাদের ওপরেই উলটে হামলা করে ফেলতে পারে।”
আমি বললাম, “ভালো ভালো দেখে ভুত্তোট বাছতে হবে প্রথমে। আমি সর্দারটাকে নেব।”
গণেশ এগিয়ে এসে বলে, “আমিও ভুত্তোট হব। আমি কখনো ডাকু মারিনি। লোকগুলোর গায়ে খুব জোর হয় তাই না?”
“তা তো হয়ই,” বাবা জবাব দিল, “তবে কিনা এরা সবসময় গায়ে ভারী ভারী অস্ত্র পরে ঘুরে বে্ড়ায়। কাজেই লাফঝাঁপ অতটা করতে পারে না। ও আমাদের সামলাতে কোন অসুবিধে হবে না।”
“তলোয়ারে মারব?” আমি প্রশ্ন করলাম।
বাবা জবাবে বলে, “উঁহু। সবকটাকে আগে ঘিরব। তারপর প্রথমে রুমালেই দেখা হবে। তাতে কাজ না হলে তখন অস্ত্রশস্ত্র চালানোর কথা ভাবা যাবে’খন।”
পরদিন সকালে ডাকুদের পঁচিশজনের দলটা আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিল। সবারই বেশ গায়েগতরে চেহারা। পা থেকে মাথা অবধি অস্ত্রশস্ত্রে সাজানো। সঙ্গে করে লুটের মালে ঠাসা তেরোটা টাট্টু নিয়ে চলেছে। এই টাট্টু থাকাটা আমাদের পক্ষে বেশ সুবিধের হয়ে গেল। তেরোটা টাট্টুকে চালাবার জন্য তেরোটা লোককে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছিল তাদের। ফলে হঠাৎ হামলা করলে আমাদের মুখোমুখি হবার জন্য বারোজনের বেশি লোক তারা পাবে না।
খানিকদূর চলবার পর বাবা এসে ফিসফিস করে আমাদের বলে, “এরা কিন্তু জেনে গেছে আমরা আসলে কী। সতর্ক থাকিস। যদি দেখিস টাট্টুওয়ালারা টাট্টু ছেড়ে দুজন একজন করে দল বাঁধছে তাহলে আর একমুহূর্ত দেরি করবি না। নইলে এরা আমাদের ওপরে হামলা করে দেবার সুযোগটা পেয়ে যাবে।”
খানিকদূর যাবার পর আমি ঘোড়া থেকে নেমে দলটার সর্দারের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করলাম। লোকটা আমাকে একেবারেই চিনতে পারেনি। ভারী গম্ভীর গলায় সে আমার কাছে গল্প শোনালো, যাবার পথে নাকি তারা ঠগিদের একটা বিরাট দলকে যুদ্ধ করে হারিয়ে তাদের লুটের হাজার কয়েক টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।
মিথ্যেবাদিটাকে মুখের ওপর জুতো ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার, কিন্তু অনেক কষ্টে আমি নিজেকে সামলালাম। উলটে তার বীরত্বের খানিক প্রসংশা করতে সে আবার বলে, “জানেন মীরসাহেব, এদের খবরাখবর তো আমি আমার ফিরিঙ্গি বড়কর্তাদের দেবই, তাছাড়া ঠগিগুলোর মধ্যে একটা গোমুখ্যু তখন বলে ফেলেছিল তারা ঝালোনে থাকে। এখন তো আমি ওই পথেই ফিরছি। ঝালোনের রাজার কানে গিয়ে খবরটা তুলে বেশ কিছু বখশিস কামানোরও ইচ্ছে আছে আমার।”
আমি মনে মনে বললাম, “রাজাকে বলবার জন্য রাজার রাজত্ব অবধি আগে গিয়ে পৌঁছোতে হবে যে বাছাধন! সে সুযোগ তুমি পাচ্ছো না আর।” মুখে বললাম, “তাহলে যে শুনেছি ঠগিরা খুব চালাক?”
“চালাক? হাঃ! হাসালেন মীরসাহেব। একটা ছোট বাচ্চার মতও বুদ্ধি ধরে না গাধাগুলো। আরে ওদের যে জেমাদারটা–ব্যাটা কাপড় দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে বসেছিল। কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। হাজার মুখের মধ্যে থেকে এক লহমায় চিনে নিতে পারব মশাই।”
“লোকটা ঠিক কেমন ছিল বলুন তো? মানে, ভাবছিলাম একটু চিনেটিনে রাখা দরকার যাতে পরে কখনো ওর খপ্পরে না পড়ি। এ-রাস্তায় তো প্রায়ই যাতায়াত করতে হয় আমায়! তা আপনারা কি ওদের ওপর হামলা করেছিলেন নাকি?”
“সে তো করেইছিলাম। পথেঘাটে আমিও বহুদিন চলাফেরা করছি। সহজে ঘাবড়াই না। ওদের দলে লোক ছিল আমার দলের তিনগুণ। তাতে অবশ্য আমরা ভয়টয় পাইনি। মাঝরাতে উঠে আক্রমণ করলাম। ব্যাটাদের কয়েকজন মারা গেল, বাকিগুলো ভয়ে পালিয়ে গেল। টাকাপয়সা যা পেলাম তাতে হায়দরাবাদ অবধি আমাদের পথখরচার আর ভাবনা ছিল না।”
শুনে আমি কোনক্রমে হাসি চাপলাম। আরো কিছুদূর চলবার পর দেখা গেল রাস্তার পাশে একজায়গায় দুটো বিরাট ঝুপসি গাছ। লোকজন তার গায়ে মানসিকের সুতো বেঁধে গাছগুলোকে রঙিন করে রেখেছে। জায়গাটা নির্জন। এইখানটাতে কাজটা করতে পারলে খুব ভালো হয়। ডাকুগুলোরও দেখি একই মতলব। একে একে তাদের টাট্টুওয়ালারা নিজের নিজের টাট্টু ছেড়ে এসে দল বাঁধছে। আর দেরি করা ঠিক নয়। ব্যাপারটা বাবাও নজর করেছিল। আমি কোমর থেকে আমার রুমালটা খুলে আনতে না আনতে বাবা ঝিরনি দিয়ে দিল। এগারোটা ডাকু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তলোয়ারের কোপে মাটি নিল। সর্দারটাকে নিকেশ করলাম আমি নিজে। তার গলায় রুমাল জড়িয়ে শেষ টানটা দেবার আগে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে বললাম, “আমিই সেই আমীর আলি। সেদিন তোর সঙ্গে যখন দেখা হল তখনই ঠিক করেছিলাম তোর মৃত্যু আমার হাতে লেখা–”
টাট্টুগুলোর পিঠের পোঁটলাপুঁটলি খুলে হিসেব করে দেখা গেল প্রায় তেরো হাজার টাকার মালপত্র পাওয়া গিয়েছে। ডাকুদের দেহগুলো ঝোপজঙ্গলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে সেইসব বাটপারির মালপত্র সঙ্গে নিয়ে আমরা বেজায় আনন্দে ফের পথ চলতে শুরু করলাম।
সিহোরের কাছাকাছি পৌঁছে দেখি, অনেক লোকজনের একটা দল নিয়ে এক ফিরিঙ্গি সাহেব চলেছে। সাহেবের আশ্রয়ে থাকলে এদের কিছু করা যাবে না। আমরা তখন দুটো দলে ভাগ হয়ে গেলাম। আমি আর বাবা একটা দল নিয়ে চললাম আর অন্য দলটা নিয়ে চলল গণেশ। দুটো দলই কেউ কাউকে যেন চিনি না এইভাবে সাহেবের দলে ভিড়ে কয়েকদিনের চেষ্টায় সেখান থেকে বেশ কিছু লোককে ভাঙিয়ে আমাদের সঙ্গে ভিড়িয়ে নিতে অসুবিধে হল না। তারা সাহেবের দলের সঙ্গে অত আস্তে আস্তে পথ চলাটা মোটেই পছন্দ করছিল না। বড় রাস্তার লম্বা পথ ছেড়ে তাদের নিয়ে আমরা জঙ্গলের মধ্যের কম লম্বা রাস্তা ধরলাম, যাতে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাওয়া যায়। তারপর শিকারপুর গ্রামের কাছে একটা চেনা জায়গায় পৌঁছে, একটা চাঁদনি রাত দেখে সেই আলোয় উনতিরিশজন পুরুষ, কিছু মহিলা ও বাচ্চা সহ গোটা দলটার মেরে একসাথে গোর দিয়ে দেয়া হল। শুধু একটা ছোট ছেলেকে আমি বাঁচিয়ে রাখলাম পুষব বলে। বাচ্চাটা হিন্দু। কিন্তু আমি ঠিক করে নিলাম তাকে মুসলমান ধর্মে দিক্ষা দিয়ে দত্তক নেব।
কিন্তু ছেলেটা পোষ মানল না কিছুতেই। মরা মা’কে জড়িয়ে ধরে তার সে কী কান্না! যতবার তাকে ধরতে যাই, সে প্রাণপণে কিল-ঘুঁষি লাথি ছোঁড়ে, আমার মুখে থুতু দেয় আর চিৎকার করে কাঁদে। জোর করে তাকে তার মায়ের থেকে আলাদা করে সরিয়ে নিয়ে এসে তলোয়ার তুলে ভয় দেখালাম। তাতে সে ভয় তো পেলই না, উলটে তার চিৎকার আরো বেড়ে গেল। আমি তখন কী করি বুঝতে না পেরে যেই তাকে কোলে তুলে নিয়েছি, সে আমার কানে কামড়ে ধরে রক্ত বের করে দিল। রাগে, ব্যথায় পাগল হয়ে গেলাম আমি। স্বয়ং শয়তান সেই মুহূর্তে ভর করেছিল আমার মাথায়। তলোয়ারের ডগায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বাচ্চাটাকে মারছি যখন, তখন সে দৃশ্য দেখে আমার ঘোড়ার সহিসের কাজ করা ঠগিটাও ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। খানিক বাদে তার ছিন্নভিন্ন শরীরটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমি ঘোড়ার পিঠে উঠে সে জায়গা ছেড়ে চলে গেলাম।
দিনতিনেক চলবার পর একইন হঠাৎ দেখি জনাচল্লিশেকের একটা হাতিয়ারবন্দ্ দল ঘোড়ায় চেপে আমাদের দিকে ধাওয়া করে আসছে। লোকগুলোর হাবভাব সুবিধের নয়। আমি প্রমাদ গুণলাম।
ক্রোশদুয়েকের মধ্যে একটা গ্রামের প্যাটেল আমাদের বন্ধুলোক। কোনমতে একবার সেখানে পৌঁছোতে পারলে তার দেয়ালে, বুরুজে লোক বসিয়ে যে কোন আক্রমণের সঙ্গে লড়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তার আগেই এই লোকগুলো আমাদের ধরে ফেলবে। আর হঠাৎ করে যদি আক্রমণ করে তাহলে আমার দলের বেশির ভাগ লোকই যুদ্ধ না করে পালিয়ে যাবে। সেটা হতে দেয়া যায় না। আমি গোটা দলটাকে একসঙ্গে জড়ো করে বললাম, “সবাই কাছাকাছি থাকো। যাদের গাদাবন্দুক আছে, তারা বন্দুকে বারুদ ঠেসে তৈরি হও। এরা এগিয়ে এলে যার যার শিকার বেছে নিয়ে তৈরি থাকবে। একটা গুলিও যেন বাজে খরচ না হয়। ভয় নেই। এরা বোধ হয় পিন্ডারিদের কোন দল। বাধা পেলে পালিয়ে যাবে।”
লোকগুলো ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতেই আমাদের ন ভূতো ন ভবিষ্যতি গালাগাল করে যাচ্ছিল। কপাল ভালো সে জায়গাটায় রাস্তাটা বেশ সরু ছিল। দুপাশে ঘন কাঁটাবন। ফলে কেউ পেছনে তাড়া করে এলেও দুচারজনের বেশি একসঙ্গে এগোতে পারবে না। আমাদের কাছাকাছি এসে পৌঁছে তারা তাই একটু থমকে গেল। আমি হাঁক দিয়ে বললাম, “কে তোমরা? যদি বন্ধু হও তাহলে আর এগিও না। আর যদি শত্রু হও তাহলে প্রাণ নিয়ে পালাও, নাহলে একজনও জ্যান্ত ফিরবে না।”
জবাবে তাদের সর্দার সামনে এগিয়ে এসে বলল, “তোমাদের জেমাদার কে? আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। ”
আমি এগিয়ে এসে বললাম, “আমি জেমাদার। আপনি একা এগিয়ে এসে কী বলবার আছে বলুন। কিন্তু আপনার দলের আর একজনও যদি নড়ে তাহলে আল্লার কসম, গুলি চলবে।” বলতে বলতে পেছন ফিরে আমি আমার দলের বন্দুকধারীদের বললাম, “এরা কোনরকম চালাকি করলেই গুলি চালাবে। তাতে আমি মরি বা বাঁচি পরোয়া নেই।”
লোকটা খানিক এগিয়ে এসে বলল, “জেমাদার, আমাদের ঠাকুর তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। কারণটা আশা করি বুঝতে পারছো। ভালো চাও তো সঙ্গে এসো। ছোট একটা জরিমানা নিয়েই ছেড়ে দেয়া হবে তোমাদের। কোন ক্ষতি করা হবে না। রাজপুতের কসম।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “তোমরা কিংবা তোমাদের ঠাকুর কাউকেই আমি বিশ্বাস করি না। অতো বোকা ভেবো না আমাদের। ধরতে চাইলে, হিম্মত থাকে তো লড়াই করে ধরো। নইলে, ফিরে গিয়ে তোমাদের ঠাকুরকে বলো, আমির আলি ঠগির যতক্ষণ হাতে তলোয়ার আছে ততক্ষণ ততক্ষণ তাকে ধরে এমন বান্দা এখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি।”
জবাবে লোকটা আর কিছু না বলে তলোয়ার খুলে আমার দিকে সটান তেড়ে এলো। সম্ভবত ভেবেছিল, ঠগিরা সামনাসামনি যুদ্ধ করতে ভয় পায়। তার তলোয়ারের ঘা যখন আমার ঢালের ওপর এসে পড়লো, ঠিক সেই সময় আমার তলোয়ারটা তার ধড় থেকে মুন্ডুটাকে আলাদা করে দিয়েছে। তার মুন্ডহীন শরীরটা ঘোড়ার পিঠে আমার পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে ধপ করে মাটির ওপর গিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমার দলের লোকজন চিৎকার করে উঠে গাদাবন্দুক থেকে একঝাঁক গুলি ছুঁড়ে দিল উল্টোদিকে। তাতে ও-পক্ষের একজন ঘোড়সওয়ার মাটি নিল। পিন্ডারি অভিযানে আমার সঙ্গে যে লোকজন ছিল তেমন ক’টা জওয়ান সঙ্গে থাকলে আমি সেদিন এই লোকগুলোকে তাড়া করে শেষ করে দিতাম একেবারে। কিন্তু তেমন লোকজন তখন আমার সঙ্গে নেই। কাজেই তাদের সম্মুখযুদ্ধ থেকে নিরস্ত করে মানে মানে পিছু হটতে শুরু করলাম আমরা। ঘোড়সওয়ারের দলও বন্দুকের গুলির পাল্লার বাইরে থেকে আমাদের দলটার পেছন পেছন আসতে লাগল।
এমনি করে চলতে চলতে আমাদের চেনা গ্রামটার কাছাকাছি আসতে তারা যখন বুঝতে পারল এইবারে আমরা তাদের খপ্পর থেকে বেঁচে যেতে বসেছি তখন আর কোন বিপদের তোয়াক্কা তারা রে রে করে আমাদের দিকে তেড়ে এল। আমাদের দলের একটা বড়ো অংশ তাই দেখে প্রাণপণে ছুটে গিয়ে গ্রামের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়ল। আমি, দলের বাকি লোকজনকে নিয়ে রুখে দাঁড়ালাম।
লড়াই শুরু হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা যাচ্ছিল হাওয়া আমাদের বিপক্ষে। ওদের দলের আরো একটা লোক আমার হাতে কাটা পড়লেও ওদের আক্রমণে আমার লোকজন একে একে মাটি নিচ্ছিল।
বিপদ যখন বেশ ঘনিয়ে এসেছে এমন সময় পেছন থেকে একটা হইচইয়ের শব্দ উঠল। ঘুরে দেখি গ্রামের মধ্যে পালিয়ে যাওয়া আমার লোকজন গ্রামের আরো অনেক লোক সঙ্গে নিয়ে বাবার নেতৃত্বে গ্রাম থেকে বের হয়ে এদিকেই তেড়ে আসছে। এইবারে প্রমাদ গুণে রাজপুতেরা পিছু হটল। দুপুর অবধি গ্রাম থেকে খানিক দূরে দূরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে তারা অবশেষে বিদেয় হতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা সবাই।
গ্রামের প্যাটেল অবশ্য মোটা টাকা চেয়ে বসল আমাদের সাহায্য করবার দাম হিসেবে। গ্রামে ঢোকা বেরোনোর দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়ে সে দাবি করল, পুরো হাজার টাকা দিতে হবে তাকে। আমি একবার বলেছিলাম, এদের মেরেধরে পিন্ডারিদের কায়দায় গ্রামটাকে লুটপাট করে জ্বালিয়ে দিয়ে গেলে কেমন হয়। কিন্তু বাবা তাতে একেবারে আড় হয়ে পড়ল। বলে, “সর্বনাশ হয়ে যাবে। গোটা এলাকায় ঠগিদের ওপরে ক্ষেপে উঠবে। কোথাও পালিয়ে পাবি না।”
তার পাকা মাথার বুদ্ধি নিয়ে শেষে ওই হাজার টাকা দিয়েই প্যাটেলকে ঠান্ডা করা হল। তার পর, সেদিন সন্ধেবেলাই আমরা গ্রাম ছেড়ে বের হয়ে গেলাম।
ক্রমশ