টাইম মেশিন ঠগির আত্মকথা অলবিরুণী শীত ২০১৬

আগের পর্বগুলো এইখানে

।৩০।

কয়েক ক্রোশ পথ চলবার পর একটা ছোট গ্রামের পাশে এসে থেমে আমরা গুড়প্রসাদ খেয়ে ভাগবাঁটোয়ারায় বসলাম। শুরফুনের দলের থেকে বেশ ভালো টাকাপয়সা, সোনাদানা পাওয়া গিয়েছিল। ভাগাভাগি মিটে গেলে কথা উঠল এইবার কোনদিকে যাব আমরা সেই নিয়ে। একদল বলল, নেগপুরের দিকেই যাওয়া যাক ফের। আমারও তাই মত ছিল। কিন্তু পীর খান বলে, ওতে বিপদ আছে। একই পথে বারবার এতবড় একটা দলকে আসাযাওয়া করতে দেখলে লোকের সন্দেহ হবেই। কথাটা আমারও মনে ধরল। তখন শলাপর্শে ঠিক হল, আমরা ফেরার পথ ধরব। যাবো এলিচপুরের পাশ দিয়ে, তবে শহরের ধারও মাড়াবো না। দূরে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে পথ চলব যাতে সলাবত খানের লোকজন আমাদের কথা টের না পায়। খবর যা শুনেছি তাতে ও এলাকায় নাকি জোর গুজব, সলাবত খানের অতিথি  সবজি খানকে ঠগিরা নিকেশ করেছে। সে অতএব নিঃসন্দেহে আমাদের সন্ধানে থাকবে।

এই সময় কয়েকদিন ধরে আমার খুব খারাপ দশা চলছিল। সারারাত ধরে দুচোখের পাতা এক করলেই শুধু দুঃস্বপ্ন দেখি একবার শুরফুনের সুন্দর মুখ আমায় প্রেমের কথা বলছে আর অন্যবার তার সেই গলায় ফাঁস লেগে মরা মুখ, বেরিয়ে আসা চোখগুলো নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে নিজের ভাগ্যের জন্য অভিশাপ দিয়ে চলেছে আমাকে।  অবস্থা দেখে ভূত প্রেত তাড়াবার অনেক মন্ত্রটন্ত্র পড়া হল, কিন্তু তাতে লাভ হল না কিছু। এলিচপুরের কাছাকাছি এলাকায় যখন এসে পৌঁছোলাম তখন আমার এমন দশা যে ঘোড়ার ওপর বসে থাকতে পারছি না, ধরে বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।

          এখন উপায় কী তবে? এলিচপুর শহরে ঢোকা মানে তো সাক্ষাত বাঘের মুখে মাথা গলানো। আমি তখন বনের ভেতর একটা গোন্দ গ্রামে জ্বর নিয়ে শুয়ে আছি। খানিক বাদে খোঁজারুরা খবর আনলো খানিক দূরে বড় একটা গ্রাম রয়েছে। তাতে আমার মনে পড়ল, সবজি খানকে নিয়ে রওনা হবার সময় এই এলাকায় একটা গ্রামকে আমরা এড়িয়ে গিয়েছিলাম বটে। ঘোড়ার পিঠে শুয়িয়ে আমায় সেইখানেই নিয়ে যাওয়া হল। তার বাজারে এক বানিয়ার ফাঁকা দোকানঘরে যথাসম্ভব আরামের ব্যবস্থা করে আমায় শোয়ানো হল নিয়ে। আমার তখন প্রবল জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে আর সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে।

          একটা আচ্ছন্ন অবস্থায় বেশ কটা দিন কেটে যাবার পর প্রথম যে মানুষের গলাটা আমি শুনতে পেলাম সেটা ছিল আমার চাকর জংলির। শুনি সে বলছে, “শুকে খুদা, মালিকের জ্ঞান ফিরেছে!” এই বলে সে পীর খান আর মোতিরামকে হাঁকডাক শুরু করে দিল।

          “আমি কোথায়?” আমি দুর্বল গলায় জিজ্ঞাসা করলাম। জ্বরের ঘোরে আমি সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম।

পীর খান এসে গিয়েছে ততক্ষণে। সে জবাব দিল, “আপনার মনে নেই? আমরা রয়েছি এলিচপুর থেকে তিন ক্রোশ দূরে সরসগাঁও গ্রামে। আপনার জন্য আমাদের খুব চিন্তা হচ্ছিল। হেকিম কালকেও বলে গেছে আপনি আর বাঁচবেন না।  কিন্তু এইবারে একবার যখন চোখ খুলেছেন আর কথা বলেছেন, আমাদের আর চিন্তা নেই। আবার আপনি আমাদের দলের মাথা হয়ে আগে আগে চলবেন– ”

আমি বললাম, “পীর খান , আমার জন্য অপেক্ষা করে তোমরা ঠিক করছ না। এই কাল জ্বরের হাত থেকে সেরেও উঠি যদি তাহলেও, আমার শরীরের যা হাল হয়েছে তাতে আমি তোমাদের দলে একটা বোঝা বই কিছু হব না। তার চেয়ে আমাকে আমার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে তোমরা রওনা হয়ে যাও। এখানে সময় নষ্ট কোরো না। কপালে থাকলে আমি সেরে উঠে দেশে ফিরে যাব। নইলে ওপরওলার যেমন ইচ্ছে তাই হবে। ”

“কী যে বলেন মীরসাহেব! আপনাকে ফেলে রেখে চলে যাব? তাহলে আপনার সেবা করবে কে? যদি মারা যান তাহলে গোর দেবে কে? আপনি আমাদের ভাই, আমাদের দলের মাথা। আপনাকে ছাড়া আমাদের কী হবে?”

আমি ক্ষীণ গলায় জবাব দিলাম,“আল্লার যেমন মর্জি তাই হোক। কয়েকদিন দেখ তাহলে। ওর মধ্যেই হয় আমি কবরে যাব, না হয় সেরে উঠে–”

“এখন আর কথা বলবেন না মীরসাহেব। হেকিম বলে গেছিল আপনার জ্ঞান এলে যেন তাঁকে খবর দিই। আমি এখন যাই–” বলতে বলতে উঠে চলে গেল পীর খান।

খানিক বাদে সে হেকিমকে নিয়ে ফিরে এল। তিনি আমার নাড়িটাড়ি পরীক্ষা করে বললেন, “রোগি ভালো আছে। একটা ওষুধ বানিয়ে এনেছি। খাইয়ে দিন, জ্বরটর পালাবে এইবার। কালকেই দেখবেন উঠে বসেছে। তবে হ্যাঁ, দুর্বলতাটা কাটতে কয়েকদিন সময় লাগবে।”

দিনদুয়েকের মধ্যেই আমার অবস্থার বেশ খানিকটা উন্নতি হল। দলের লোকজনও বসে থেকে থেকে অস্থির হচ্ছিল। ঠিক করা হল এইবার ফের রওনা হতে হবে। আমার তুখনো ঘোড়ার পিঠে চড়বার অবস্থা নয়। অতএব পীর খান গিয়ে এলিচপুর থেকে একটা পালকি ব্যবস্থা করে নিয়ে এল।

হেকিমসাহেবকে প্রচুর নজরানাটানা দিয়ে আমি পালকি চেপে রওনা হলাম। গন্তব্য বুরহানপুর। জলগাঁও পৌঁছোতে পৌঁছোতে গায়ে মোটামুটি বল ফিরতে পালকি ছেড়ে ফের ঘোড়ার পিঠে গিয়ে উঠলাম। সেই দিন সকালে ঘোড়ায় চড়ে যা আনন্দ পেয়েছিলাম, আর কখনো তেমনটা পাইনি। 

সরসগাঁও ছাড়বার দিনদশেক পর আমরা গিয়ে পৌঁছোলাম বুরহানপুর। পথে আর তেমন কিছু ঘটেনি। শহরের পৌঁছে তার সরাইখানায় গিয়ে উঠলাম। ঠিক করলাম, পরের শিকারটা না পাওয়া অবধি সেখানেই অপেক্ষা করব। শহরের দোকানে বাজারে লোকজন ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু এক সপ্তাহ কেটে গেলেও যখন ভালো কোন শিকারের খোঁজ মিলল না তখন আমার ভয় হল, শুরফুনের অভিশাপ লেগেছে দলের ওপর। তার কাটানের জন্য বেশ বড়োসড়ো করে ভবানীর পুজো দিলাম একটা। তাতে লক্ষণটক্ষণ বিচার করে দেখা গেল বেশ ভালো সময় আসছে সামনে।

 এর দিনদুই পরে একদিন দুপুরবেলা মোতিরাম এসে বলে, “বম্বে থেকে মালবে আফিং কিনতে আসা রোকরিয়ারা এইখান দিয়ে যাতায়াত করে জানেন তো?”

বললাম, “জানি। বাবা বলেছিল ফেরার পথে বুরহানপুর হয়ে আসবার সময়ে এমন দু একটাকে ধরতে। এদের কাছে তো নগদ টাকা থাকে প্রচুর।”

“বেশ।  তাহলে যে একবার আপনাকে আসতে হচ্ছে! মনে হয় গোটা আষ্টেক রোকরিয়া পেয়েছি। একবার আপনি এসে দেখে নিন দেখি!”

এ সময়টা আফিং রুইবার সময়ও বটে। রোকরিয়ারা এই সময়টা প্রচুর নগদ টাকা সঙ্গে করে নিয়ে মালবে যায় চাষীদের অগ্রিম দাদন দিতে। কাজেই মোতিরামের ভুল করবার সম্ভাবনা কম ছিল। “চলো,” বলে পীর খানকেও ডেকে নিয়ে আমি উঠলাম।

বাজারের মধ্যে একটা খালি দোকানঘরে লোকগুলো বসে ছিল। সঙ্গে একটা উট। ভারী সন্দেহের চোখে চারদিকে তাকাচ্ছিল বারবার। চলতে চলতে আড়চোখে তাদের দিকে একনজর দেখেই আমি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম এরা রোকরিয়া না হয়ে যায় না। মোটাসোটা চেহারা সব। সর্বক্ষণ চোখে ভয় ভয় ভাব। সন্দেহের চোখে বারবার বাইরের দিকে দেখছে।

“লোকগুলোকে কীভাবে দলে ভেড়ানো যায় সেটাই ভাবছি,” ফিরে আসতে আসতে আমি বলছিলাম, “এরা বেজায় সাবধানী লোক। আমাদের দলে এসে সহজে ঢুকবে না। তার চেয়ে আমরাই বরং এদের দলে ভিড়ে যাই না কেন? আমি আর পীর খান মিলে গায়ে ধুলোময়লা মেখে একটা টাট্টুর পিঠে প্রচুর মালপত্র চাপিয়ে শহরে এসে ঢুকব। সঙ্গে চাকর সেজে থাকবে জংলি আর আরো দুটো লোক। এদের কাছাকাছি এসে আস্তানা নেব। তারপর ভুলিয়ে ভালিয়ে এদেরই সঙ্গ ধরব। আর মোতি্রাম, তুমি থাকবে দলের দায়িত্বে। আমাদের পেছন পেছন আসবে। আর দুজন তিনজন করে লোককে পাঠাবে আমাদের সঙ্গে এসে ভেড়বার জন্য। কিছু লোককে আগেই রওনা করে দেবে, যাতে আমরা পথে তাদের নাগাল পাই। এমনি করে কয়েকদিনের মধ্যে দলে বেশ কটা লোক হলে তারপর যা করবার করা যাবে। কী বলো?”

“ভালো ফন্দি,” দু’জনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “এখন চলো কাজ শুরু করে দেয়া যাক।”

সেদিন বিকেলবেলা দেখা গেল বুরহানপুরের দক্ষিণ দরজা দিয়ে দুজন ক্লান্ত পথিক এসে শহরে ঢুকছে। তাদের পোশাক আশাক বেজায় ময়লা। বেশ ক’দিনের পথ চলার ধুলো জমে আছে তাতে। সঙ্গের তিনজন চাকরের অবস্থাও তথৈবচ। হা ক্লান্ত অবস্থা সবার। দেখলে একনজরেই বোঝা যায়, বহুদূরের পথ পেরিয়ে এসেছে তারা। শহরের বাজার এলাকায় এসে ঢুকে তারা বারবার সেই বড়ো দোকানঘরটার দিকে ফিরে ফিরে তাকায় আর এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে। শেষমেষ, যেন খানিকটা ভয়েভয়েই তাদের মধ্যে একজন এসে দোকানের ভেতর বসে থাকা আটজন লোকের দলটার সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বলল, “দোস্ত, আপনারাও মনে হয় আমাদেরই মত পথিক। আপনারা নিশ্চয় বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমাদের এই চত্বরে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছেন! কিন্তু এই গোটা বাজার এলাকাটা চক্কর দিয়েও এমন একটা কাউকে পেলাম না যে বলে, ‘আহা, নেমে একটু হাতমুখ ধুয়ে জিরিয়ে নাও। বেশ ক’টা খালি দোকানঘরও পড়ে আছে এদিক ওদিক। কিন্তু ঢুকতে গেলেই লোকজন মার মার করে তেড়ে আসে! জাহান্নমে যাক সব শয়তানগুলো। এইখানে তো অনেক জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। তা আপনারা যদি দয়া করে একটু–’ ”

এই লোকটা ছিলাম আমি নিজে। আমার কথা শুনে তাদের মধ্যে সর্দারমত লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “সরাইখানায় চলে যাও না কেন? জায়গা পেয়ে যাবে।”

“সরাইখানা? সেইখান থেকেই তো তাড়া খেয়ে এই বাজারে এলাম। সেখানে পঞ্চাশ ষাটটা সন্দেহজনক লোক এসে উঠেছে। ঢুকতে গেলাম, তো আমাদের তাড়িয়ে দিল। বলে এখন এখানে এসো না। অবশ্য না বললেও থাকতাম না আমরা ওখানে। সঙ্গে দামি জিনিসপত্র রয়েছে, আর লোকগুলোকেও বিশেষ সুবিধের ঠেকছিল না।”

পীর খানের কথায় দেখি সর্দারমতো লোকটা একটু ভাবছে। আমি তখন বেজায় ক্লান্ত গলায় বললাম, “শরীরে আর বইছে না মালিক। আপনারা হিন্দু। বিপদে পড়ে একটু আশ্রয় চাইছি। সামান্য একটু কিছু খেয়ে এককোণে শুয়ে ঘুমোবো। আপনাদের বিরক্ত করব না। দয়া করে আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না।।”

সর্দারমশাইয়ের মনে হল একটু দয়া হয়েছে এইবার। হাঁক দিয়ে তার দলের এক রোকরিয়াকে বলে, “দুর্জন, উটের জিনটিনগুলো আর আমাদের মালপত্র আমাদের দিকে আর একটু সরিয়ে দে দেখি, বেচারারা একটু আরাম করুক।” তাদের মালপত্রের ভারি থলেগুলো যখন টেনে টেনে সরানো হচ্ছে তখন শুনি তার মধ্যে ঝনঝন করে টাকা বাজছে।

খানিক বাদে আমরা কিছু খাবারদাবার খেয়ে নিলাম। নিজেদের ক্লান্ত চেহারা বানাবার জন্য সারাদিন উপোস করে ছিলাম। খেয়ে খুব আরাম হল। খাবার পর রোকরিয়াদের সঙ্গে আলাপ হল একটু একটু। তারা কোথায় যাচ্ছে কথাবার্তায় তার একটা আন্দাজ  করে নিয়ে আমি আমার পরিচয় সাজালাম। বললাম আমরা সৈনিক।  পুনায় হোলকারদের ওখানে কাজ করি। সরকারী কাজে গিয়েছিলাম পেশোয়া বাজিরাও-এর দরবারে। সেই কাজ সেরে এখন ফিরছি। সঙ্গে দরকারি দলিলদস্তাবেজ আছে, আর বেশ কিছু দামি হুন্ডি।

বলতে বলতেই আমি আমার জামার ভেতর থেকে একটা বড়োসড়ো , কাগজ ভর্তি লেফাফা বের করে এনে, কপালে ছুঁইয়ে রোকরিয়াদের সামনে ধরলাম।  তার ওপরে হোলকারের নাম লেখা। নামের নিচে একটা বড়োসড়ো শীলমোহর।

এই লেফাফাটাই ছিল আমার ওস্তাদের মার। ঘাঁটি থেকে ছদ্মবেশ নিয়ে বের হবার আগেই আমি বেশ কিছু ছেঁড়াখোঁড়া কাগজ জোগাড় করে তাকে একটা লেফাফায় পুড়ে, ওপরে হোলকারের নাম লিখে নিয়েছিলাম। নামের তলায় আমার নিজের শীলমোহরটা লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সেখানা বেশ জমকালো। দেখলে যে কেউ ধরে নেবে সেটা কোনো রাজবংশের মোহর।

timemachinethogi02ব্যাপার-স্যাপার দেখে তারা দেখি একটু নরম পড়েছে। আমার দিকে মাঝে মাঝে সম্ভ্রমের চোখে তাকাচ্ছে। মাঝেমাঝেই জিজ্ঞাসা করে পেশোয়া আর হোলকারের হালচাল কেমন চলছে, কিংবা দুদল মিলে এক হয়ে ফিরিঙ্গি তাড়াবার কোন মতলবে আছে নাকি। আমি কিন্তু সে’সব প্রশ্নের জবাবে একেবারে কিচ্ছু বললাম না। শুধু হ্যাঁ হুঁ দিয়ে কাজ চালিয়ে  কথা ঘুরিয়ে দিলাম পেশোয়া আর হোলকারের মধ্যে কেমন ভাবসাব , কিংবা আমায় তাঁদের কে কত ভালোবাসেন সেইদিকে। এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি মিথ্যেকথা আমি আর কখনো বলিনি। যেমন, আমার ঘোড়াটাকে দেখিয়ে আমি জানালাম, সেটা বাজি রাও আমায় উপহার দিয়েছেন। আমায় বেজায় ভালোবাসেন কিনা!

খানিক বাদে রোকরিয়াদের হাবেভাবে মালুম হল তারা আমাকে ছদ্মবেশী কোন বড় মানুষ ধরে নিয়েছে। তায় আবার সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র আছে। অতএব এহেন সরকারী বীরপুরুষের দলের সঙ্গে খানিকটা পথ একসাথে যাবার ব্যাপারে তাদের আপত্তি  হল না। লোকগুলো অবশ্য  সাবধানী। রাতে যখন তারা ঘুমোলো, দেখি দুজন লোক খোলা তলোয়ার হাতে তাদের টাকার থলেগুলো পাহারা দিচ্ছে।

ঘুমোতে যাবার আগে আমি জংলিকে পাঠিয়ে মোতিরামকে খবর দিলাম। সবার সামনেই আমি তার সঙ্গে রামাসি ভাষায় যা বলবার বললাম। লুকোছাপা করবার কোন চেষ্টাই করলাম না। রকরিয়াদের জেমাদার দেখি কান খাড়া করে শুনছে। জংলি চলে গেলে বলে, “এটা তো ভারি অদ্ভূত ভাষা?”

আমি হাত নেড়ে বললাম, “এ হল তেলুগু ভাষা। বছরদুয়েক আগে এই দাসটাকে আমি হায়দরাবাদে কিনেছিলাম। ভালো ছেলে। হিন্দুস্তানি বুঝতে পারে তবে বলতে পারে না। একটু পান আর তামাক কিনতে পাঠালাম।”

জংলিকে আমি সত্যিসত্যিই আসার সময় খানিক পান আর তামাক নিয়ে আসতে বলেছিলাম। খানিক পরে সে যখন সেসব নিয়ে ফিরে এলো তখন আর কারো কোন সন্দেহ করার রাস্তা রইল না। সেইসঙ্গে সে খবর আনলো, গুরু দত্তের সঙ্গে সাতজন বাছা বাছা ঠগি সেই রাতেই এগিয়ে পড়ছে।  বাকিরাও আস্তে আস্তে ছক কষে এগনো শুরু করবে। আমরা এরপর যে গ্রামটায় গিয়ে থামবোসেখানে একজন নজরদার রেখে যাওয়া হবে।

ঠিক করলাম আগামি তিনচারদিনের মধ্যে কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। পরদিন সকালে আমরা রওনা হয়ে গেলাম। সেদিনের পর আরো দুদিন পথে আমাদের দলের কাউকে দেখা গেল না। দেখে পীর খান খুব খুশি। বলে, সব ঠিকঠাক এগোচ্ছে তাহলে। ঠিক সময়ে সব এসে জুটবে।

চার দিনের দিন আমাদের একটা ছোট দলের দেখা পাওয়া গেল। তারা অবশ্য আমাদের দলের সঙ্গে এসে জুটল না। তবে তাদের কাছে জানা গেল গুরু দত্তের দল আর একদিনের পথ এগিয়ে রয়েছে। সেই দিন আর তার পরের দিনে তাদের দলটা দুই ভাগে আমাদের দলের কাছাকাছি এসে জুটবে।

সেদিন সন্ধেবেলা যে গ্রামে গিয়ে থামলাম, সেখানে আমাদের  জনাচারেকের একটা দল এসে হাজির হল। এবারে আমাদের লোকসংখ্যা হল নয় আর ওদের আট। দরকারে তলোয়ারবাজি করে এদের কাবু করা যায় কিনা সে ভাবনাটা একবার মাথা এলেও নিজেকে নিরস্ত করলাম। লোকগুলো প্রত্যেকেই বেশ শক্তিশালী। সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র রাখে আর বেড়ালের মত সতর্ক প্রত্যেকে।

এর পরদিন গুরু দত্ত আরতার দুজন সঙ্গী এসে জুটল। রোকরিয়ারা কিন্তু এবার আর অত সহজে তাদের দলে ভেড়াতে রাজি নয়। আমি যতই বলি পথে সঙ্গে একটু বেশি লোকজন থাকা ভালো, ততই তাদের জেমাদার ভীম সিং বলে, “পথেঘাটে অচেনা লোকজন বেশি সঙ্গে না নেয়াটাই আমাদের দস্তুর। আমরা রাস্তায় একটাও অচেনা লোক সঙ্গে নিয়েছি জানলে আমাদের মালিকরা আমাদের ছেড়ে কথা বলবে না। আপনাদের কথা আলাদা। আপনারা সরকারী লোক। সঙ্গে থাকলে ভরসা পাই। কিন্তু সে ছাড়া অচেনা অজানা লোক বেশি না নেয়াই ভালো।  আপনাকেও বলি, যখন নিজেরা নিজেরা পথ চলবেন অচেনা লোককে একদম দলে নেবেন না। ওতে ভালোর চেয়ে মন্দই হয় বেশি।

সে যাত্রা কোনমতে ভীম সিংকে রাজি করিয়ে গুরু দত্তদের তিনজনকে তো দলে ভেড়ালাম। কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, এর পরে আর কোন জোরাজুরি চলবে না। ভীম সিং আর একটাও নতুন লোককে দলে ভেড়াতে দেবে না। মরিয়া হয়ে আমি ভাবলাম, যা করার এই বারোজন মিলেই করতে হবে আমাদের। জংলির ওপর বিশেষ নির্ভর করা যায় না অবশ্য, কিন্তু বাকি এগারোজনই আমরা নামকরা ভুত্তোট। সেইসঙ্গে তলোয়ারেও প্রত্যেকেরই হাত তুখোড়।

কাছেই একটা জোয়ারের ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে আমি আর পীর খানকে আমার পরিকল্পনাটা বলতে সে একটু ভেবে আর একটা ভালো বুদ্ধি দিল। বলে, মোতিরামের কাছে একটা ছেলেকে পাঠিয়ে খবর দিতে যে পরের দিন সে যেন বাকি দলটাকে নিয়ে এসে রাস্তায় আমাদের কাছে পৌঁছোয়। একটা দল যখন আরেকটা দলকে পার হবার সময় দুই দলে মিলেমিশে যাবে,  ঠিক সেইসময়ে আমি ঝিরনি দিয়ে দেব। তাহলে পুরো দলটাকেই কাজে লাগানো যাবে।

বুদ্ধিটা ভালো।  কিন্তু ওতে মজা কম। এতগুলো লোক মিলে এই ক’টা লোককে মেরে কৃতিত্বটা কোথায়? মাথা নেড়ে বললাম, “না না , পীর খান। টাকাটাই কি সব? দল বেঁধে শিকার তো করাই যায়, কিন্তু ভাবো দেখি, আমরা বারোজন মিলে যদি এদের নিকেশ করে এতগুলো টাকা হাতাতে পারি তাহলে বেরাদরিতে আমাদের নামটা কেমন ছড়াবে? দেশশুদ্ধ যত ঠগি আছে সব কেমন সাবাশি দেবে আমাদের ভাবতে পারছ? তাছাড়া কপালে যদি মৃত্যু থাকে তাহলে মোতিরামের দল এসেও আমাদের বাঁচাতে পারবে না জেনে রেখো। চলো না কাল সকালে একবার বারোজন মিলে একহাত লড়ে দেখি কী হয়?”

পীর খান রাজি হয়ে গেল। প্রস্তাবটা সবাইকে গিয়ে দিতে বাকি দশজনের প্রত্যেকেই দেখি এমন একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার অংশ নিতে আগ্রহী। কারো কোন আপত্তি হল না। বললাম , “তাহলে কাল সকালে সবাই তৈরি থেকো। তলোয়ার তৈরি রাখবে। যার যার শিকার বেছে নাও। প্রথম চোট করবে বাঁহাতে। আমি আর পীর খান ঘোড়ায় থাকব। কাজেই আমাদের নিয়ে চিন্তা নেই। বাকিরা সাবধানে কাজ কোরো।”

পরদিন সূর্য ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা রওনা হয়ে পড়লাম। পথে বেরিয়ে একটা মুশকিল হল। দুজন রোকরিয়া গিয়ে সঙ্গের উটটার পিঠে চড়ে বসল। বলে তাদের পায়ে ব্যথা হয়েছে। হাঁটতে পারবে না। মনে হল আমাদের সন্দেহ করছে নাকি? কারণ উটটার পিঠেই তো ওদের টাকাকরির থলের বেশির ভাগটা বাঁধা! মুখে অবশ্য মনের ভাবটা আমি বুঝতে দিলাম না কাউকে। আগের দিন রোকরিয়ারা কথায় কথায় তাদের উটটাকে দৌড় করিয়ে আমায় দেখিয়েছিল যে চাইলে সেটা ঘোড়ার চেয়ে বেশি জোরে ছুটতে পারে। অতএব আমি ঠিক করে নিলাম, বিন্দুমাত্র সন্দেহজনক কিছু দেখলে প্রথমেই উটটাকে অকেজো করে দিতে হবে যাতে টাকাপয়সা নিয়ে পালাতে না পারে।

দুপুর নাগাদ একটা ছোট নদী পেয়ে আমরা সেখানে এসে নামলাম। ইচ্ছে ছিল সেখানেই যা করার করে ফেলব। কিন্তু দেখা গেল লোকগুলো সেখানে জল খেতে নেমেও একেবারে গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছে। বোঝা যাচ্ছিল আমাদের ওপরে তাদের সন্দেহ কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে কাজটাকে আর বেশিক্ষণ ফেলে রাখার উপায় ছিল না আমাদের। তার আরেকটা কারণ ছিল, রোকরিয়ারা যেমন গতিতে চলেছে তাতে আমার লোকজন তাল রাখতে না পেরে ক্লান্ত  হয়ে পড়ছিল খুব তাড়াতাড়ি।

নদী ছাড়িয়ে ক্রোশখানেক পথ গিয়ে একটা উঁচুনিচু পাথুরে পথে গিয়ে পড়লাম আমরা। এইখানে উটগুলোর গতি একটু কমাতে বাধ্য হল রোকরিয়ারা। শত চেষ্টাতেও উটেরা সেখানে তাড়াতাড়ি যেতে নারাজ। এইবারে আমার লোকেরা একে একে তাদের জায়গা নিতে শুরু করল। খানিক পরে রাস্তাটা আরো খারাপ হতে উটের গতি যখন আরো কমে এল, আমি বুঝলাম এইবার সময় হয়েছে। উত্তেজনায় আমার বুক ঢিপঢিপ করছিল। একটা রোকরিয়া পীর খানের ঘোড়াটার ঠিক সামনে সামনে ধুঁকতে ধুঁকতে হাঁটছিল। সেইদিকে একবার দেখে পীর খান আড়চোখে আমার দিকে চাইল একবার। আরেকটা রোকরিয়া হাঁটছিল আমার ঘোড়াটার সামনে সামনে। আমার ঘোড়ার ঠিক সামনে ছিল উটদুটো। উটের ওপরে বসা লোকদুটো আমাদের দিকে পিঠ করে গান গাইতে গাইতে চলেছে। মধ্যে মধ্যে পায়ে হেঁটে চলা রোকরিয়ারা আর আমাদের দলের দু একজনও সেই গানে গলা মেলাচ্ছিল। জংলি আমার ঘোড়া লাগাম ধরে আমার আগে আগে হাঁটছিল। বাকিরা যার যার জায়গায় তৈরি। তাদের দিকে একবার দেখে নিয়ে আমি হাঁক দিলাম, “জংলি, পান লাও।”

timemachinethogi01সঙ্গে সঙ্গে একমুহূর্তে বারোটা তলোয়ার ঝিকিয়ে উঠল। আমার সামনে হাঁটা রোকরিয়াটার মাথায় আমি মোক্ষম একটা কোপ দিতে সেটা তার মাথাতে গেঁথে গেল। লোকটা সটান মাটিতে আছড়ে পড়তে আমার তলোয়ারটা হাত ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেল। লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে তার মাথায় গাঁথা তলোয়ারটা নিয়ে টানাটানি করছি এমন সময় দেখি উটটা পায়ে চোট খেয়ে মাটিতে বসে পড়েছে। তার সওয়ারি দুজন মাটিতে আছাড় খেলেও সামলে নিয়ে তলোয়ার বের করে ফেলেছে। একজন গিয়ে আক্রমণ করেছে জংলিকে আর অন্যজন তলোয়ার তুলে আমার দিকে তেড়ে আসছে। আমি তাই দেখে পিঠ থেকে ঢালটা খুলে এনে তার তলোয়ারের চোট বাঁচাতে বাঁচাতে প্রাণপণে আমার তলোয়ারটা টানতে টানতে একসময় সেটা খুলে এল। এইবারে আমরা দুজন সমানে সমানে লড়বার অবস্থায় এলাম। তলোয়ারে আমার হাত কেমন চলে সে তো আগেই বলেছি। কিন্তু এ রোকরিয়াটা দেখলাম একেবারে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। তার দলে তখন তারা দুজন ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। অন্যজন জংলিকে গুরুতর আহত করে পীর খানের সঙ্গে লড়ছে।

অনেকক্ষণ ধরে সমানে সমানে যুঝলাম আমরা। দুজনেরই ঢাল অন্যের তলোয়ারের ঘা খেয়ে খেয়ে ফুটিফাটা। এমন সময় লড়তে লড়তে হঠাৎ আমার পা টা পিছলে যেতে তার তলোয়ারের ঘা এসে লাগল আমার পাগড়িতে। পাগড়িটা কেটে দু ফালা হয়ে গিয়ে মাথাতেও চোট লাগল একটু। তবে, লোকটা ক্লান্ত ছিল বলে তার আঘাতটায় জোর ছিল না তেমন। তাই প্রাণে বেঁচে গেলাম সে যাত্রা। তবে আমি কিন্তু একেবারে পড়ে যাইনি। একটু থতমত খেয়ে গেছিলাম আঘাতটা পেয়ে। লোকটা সেই মুহূর্তটাকে কাজে লাগাল না। আর সেই ভুলটার মাশুলও দিতে হল তাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে আমি তলোয়ার উঁচিয়ে ধেয়ে গেলাম তার দিকে। হেরে যাবার ভয়ে তখন আমার শরীরে অসুরের শক্তি ভর করেছে। এইবারে লোকটা পিছোতে শুরু করল, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পা পিছলে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। সেই অওবস্থাতেও সে তার তলোয়ারটা তুলে ধরে এলোমেলো ঘোরাচ্ছিল। আমি একটা লাফ মেরে তার ওপরে গিয়ে পড়ে তলোয়ারটা তার গলায় গেঁথে দিলাম। মাটিতে পড়বার আগেই লোকটার প্রাণ বেরিয়ে গেল।

সেদিকে একনজর ত্যাকিয়ে নিয়ে আমি জংলির দিকে ফিরলাম। তারও গলাতেই চোট লেগেছে। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল চোটটা থেকে। আমার কোমরবন্ধটা খুলে চোটটার ওপরে বাঁধে দিতে রক্ত পড়াটা একটুক্ষণের জন্য কমল। জংলি একটু জল খেতে চাইছিল।

উটটার  একপাশে একটা চামড়ার পাত্রে জল ছিল তাই এনে তাকে খাওয়াতে সে একটু সুস্থির হয়ে বলে, “আমি আর বাঁচব না মীর সাহেব।” তারপর সামনেই পড়ে থাকা মৃতদেহটার দিকে দেখিয়ে সে আবার বলল, “এই লোকটার তলোয়ারে আমার প্রাণ গেল। আপনারা যখন লড়ছিলেন তখন আমি গিয়ে উটটার পায়ে তলোয়ারের কোপ মেরে সেটাকে অকেজো করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম উটের পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে লোকদুটো বুঝি থমকে যাবে একটুক্ষণ। কিন্তু ওরা উঠে পড়ে তলোয়ার নিয়ে তেড়ে এল। আপনারা সবাই তখন লড়ছেন। নইলে কেউ না কেউ আমায় সাহায্য করতই। কিন্তু সে হল না। আজ আমার কপালে মরণ লেখা ছিল, খন্ডাবো কীভাবে?” বলতে বলতেই সে ফের জ্ঞান হারাল। তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে আমাদের সবার চোখেই জল এল। বড় ভালো ছেলে ছিল এই জংলি। আমরা সবাই তাকে ছোট ভাইয়ের মতই ভালোবাসতাম। একটু পরে ফের তার জ্ঞান ফিরল একবার। খুবাস্তে আস্তে সে বলল, “মা—আমার মা-আমার ছোট্ট বোনটা—এবার ওরা যে না খেয়ে মরবে। কথা দিন মীর সাহেব, আপনি ওদের দেখবেন!”

আমার চোখের জল আর বাঁধ মানছিল না। জংলির মাকে আমি চিনি। আসবার সময় ছেলের জন্য তাঁর কী আকুতি! কত পুজো-আর্চা করেছিলেন ছেলেটা যাতে তাঁর ভালোভাবে ফিরে আসে। আমি তার মাথাটা হাতে ধরে বললাম, “ভাবিস না জংলি। আমীর খান থাকতে তোর মা বোনের কোনদিন অভাব হবে না, কথা দিলাম।”

আমার কথা শুনে ছেলেটা নিশ্চিন্ত হয়ে ফের আমার হাতেই মাথাটা রেখে চোখ বুঁজল। তার গলার ক্ষতটার মুখ খুলে গিয়ে তখন নতুন করে রক্ত বের হতে শুরু করেছে গলগল করে। একবার ঠোঁটদুটো নড়ে উঠলো তার, আর তারপরেই মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হয়ে এল। জংলি আর নড়ল না।

তার মাথাটা মাটিতে নামিয়ে রেখে আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “আমার একটা প্রস্তাব আছে।এদের কাছ থেকে যা পাওয়া যাবে তাতে জংলির হিস্যা যতটা হওয়া উচিত তার দ্বিগুণ পরিমাণ আমরা তার মায়ের হাতে তুলে দেব। কারো আপত্তি আছে কি?”

সবাই একযোগে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বলে, “সেইসঙ্গে আমরা নিজের নিজের ভাগ থেকেও কিছু কিছু করে দেব। ও উটটার পায়ে চোট না করলে আজ উট নিয়ে দুই রোকরিয়া পালাত। টাকাপয়সা তো যেতই, তার ওপর বিপদেরও শেষ থাকত না তেমনটা হলে।”

আমি বললাম, “এই তো চাই ভাইয়েরা। তোমাদের কাছে ঠিক এমন জবাবই আশা করেছিলাম আমি। এখন তাড়াতাড়ি মরাগুলোর গতি কর। যা যা জিনিসপত্র পাওয়া যায় সেগুলো একত্র কর আর এই ছেলেটার জন্য একটা আলাদা কবর খোঁড়াবার বন্দোবস্ত কর। আমার মাথায় একটু চোট লেগেছে। আমি সেটার বন্দোবস্ত করে নিচ্ছি ততক্ষণে।”

উটটা একপাশে পড়ে কাতরাচ্ছিল। তার পায়ের শিরা কেটে গেছে। সেটাকে ধরে তোলবার চেষ্টা করা হল অনেক। কিন্তু লাভ হল না। তখন আমাদের একজন গিয়ে তলোয়ার দিয়ে উটটার গলা কেটে ফেলে তাকে যন্ত্রণার থেকে মুক্তি দিল। তার পিঠের থলেগুলো আমাদের ঘোড়ার পিঠে সরিয়ে নিয়ে তার মধ্যের টাকাপয়সা আর অন্যান্য জিনিসপত্র আমরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলাম সহজে বইবার জন্য। শরীরগুলো টেনে টেনে নিয়ে কাছের একটা ঝোপের মধ্যে পুঁতে দেয়া হল। রক্তমাখা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে ফেলে দিয়ে সেসব জায়গায় বালি ছড়িয়ে দেয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে মারপিটের কোন চিহ্নই আর রইল না। সব মিটিয়ে আমরা সেখান থেকে রওনা হয়ে গেলাম।

কিছুদূর যাবার পর আর একটা নদী পেয়ে তার জলে যখন আমরা গা ধুচ্ছি তখন হই হই করতে মোতিরাম আর দলের বাকি লোকজন এসে হাজির। মোতিরাম এসে আমায় দেখেই একেবারে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমরা তাড়াতাড়ি করে আসছিলাম যাতে তোমাদের নাগাল ধরতে পারি। মরা উটটাকে দেখে ভয় হয়েছিল খুব। তোমরা জায়গাটা ভালো করে পরিষ্কার করনি। দু এক জায়গায় রক্তের দাগ লেগেছিল মাটিতে। সেসব পরিষ্কার করে দিয়ে, তোমাদের জন্য দুশ্চিন্তা করতে করতে ভয়ে ভয়ে আসছিলাম। সব ঠিকঠাক আছে তো?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না। সব ঠিক নেই। জংলি লড়াইতে মারা পড়েছে। আমারও চোট লেগেছে, তবে ভয় পাবার মত কিছু নয়।”

সেদিন বিকেলে একটা গ্রামের কাছে পৌঁছে গুড়প্রসাদ খাবার পর আমার তাঁবুতে লুটের মাল এনে সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবার জোগাড়। টাকাপয়সা সোনাদানা মিলে প্রায় ষাট হাজার টাকার জিনিস! এ ছাড়াও মোমকাপড়ের মধ্যে সেলাই করা একটা ছোট বাক্স পাওয়া গেল, তার মধ্যে বড় বড় মুক্তোর ছখানা মালা। তার দামও প্রায় দশ হাজার টাকা। প্রায় কয়েক বছর সবার হেসেখেলে কেটে যাবে ওই টাকায়। তাড়াতাড়ি সব জিনিসপত্র ফের থলেতে ভরে থলের মুখ আমার শীলমোহর দিয়ে বন্ধ করে দিলাম।

এবার বাড়ি ফেরার পালা। আর কোন কাজকর্ম নয়। আমরা সবাই যত তাড়াতাড়ি পারি বাড়ির দিকে চললাম। পথে দুটো অভাগা জোর করে আমাদের সঙ্গ নিয়েছিল, সেদুটোকে বাধ্য হয়েই নিকেশ করতে হল আমাদের। তবে তাদের কাছে বিশেষ কিছু মেলেনি আর।

গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে আমি একটা ছেলেকে য়াগে আগে পাঠিয়ে দিলাম খবর দেবার জন্য। খানিক বাদে দূরে আমাদের গ্রামটা চোখে পড়ল। সেই সব চেনা গাছপালা, তাদের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা মসজিদের মাথা। আমার আর তর সইছিল না। ঘোড়ার পেটে খোঁচা মেরে দৌড় করিয়ে সোজা এসে হাজির হলাম আমার বাড়ির সামনে।

আসতে আসতেই চোখে পড়ল বাবা আর মইদিন খুব আস্তে আস্তে, মাথা নিচু করে এগিয়ে আসছে বাড়ির দরজা থেকে। বাবা কাঁদছিল। হঠাৎ ভীষণ একটা ভয় জেগে উঠল আমার বুকের ভেতর। বের হবার সময় আজিমার দ্বিতীয়বার ছেলেপিলে হবার কথা ছিল! ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নেমে আমি এক দৌড়ে বাবার কাছে গিয়ে বললাম, “আল্লাহর  কিরে, কী হয়েছে শীগগির বল আমায়। আজিমা—আজিমার কিছু হয় নি তো?”

বাবা মাথা নেড়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “তোর ছেলেটা আর নেই।”

 ক্রমশ

ছবিঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাকের টাইম মেশিনের লাইব্রেরি

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s