আগের পর্বগুলো
।।৩৫।।
ঘাঁটিতে ফিরে আমি আমার ঠগি বন্ধুদের একত্র করে বললাম, “গফুর খান যে সাক্ষাত শয়তান সে তো তোমরা সবাই জান। পিন্ডারিরা সবাই বদমাশ, কিন্তু গফুর খানের ধারে কাছে কেউ আসে না। লোকটা মানুষ নয়। মোতি আর পীর খান, তোমাদের করিঞ্জার সেই মেয়েটার কথা মনে আছে? আমি তখনই মনস্থির করে নিয়েছিলাম, একদিন এর পাপের শাস্তি আমি নিজে হাতে দেব। আজ আল্লা আমায় সেই দিন দেখিয়েছেন। আজ শয়তানটা যা করেছে, তার চেয়ে জঘন্য পাপ যে আর হয় না সে তো তোমরা সবাই নিজের চোখেই দেখেছ। আজ তবে এর পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে। তোমাদের কী মত?”
“ঠিক কথা মীরসাহেব,” সবাই একযোগে বলে উঠল, “ওর পাপের ঘড়া আজ পূর্ণ হয়েছে। ভবানীর শপথ, ও আমাদের।”
“তাই হবে। এখন শোন। আমার কাছে এখনও গুন্টুর থেকে আনা তিন বোতল ফিরিঙ্গি মদ রয়েছে। মদটা গফুর খান পছন্দ করে। এ মদের লোভ দেখালে ও ঠিক চলে আসবে। ওর পেয়ালায় খানিকটা আফিং মিশিয়ে দিতে হবে। কয়েক পেয়ালা আফিং মেশানো মদ খেলেই মুখ গুঁজে পড়বে’খন। তখন সবাই মিলে ওকে শেষ করে দেব, কী বল?”
“কবে করবে? আজ রাতে?” পীর খান জিজ্ঞাসা করল।
“উঁহু, আজকে নয়। অনেক লোকজন চারপাশে। কাল আমাদের তাঁবুটাকে একটু একটেরেতে নিয়ে লাগিও। কাজটা করব একেবারে মাঝরাতে।”
“একটা অনুরোধ ছিল,” পীর খান বলল, “গফুর খানের ঘোড়ার জিনে অনেক ওনাদানা জমানো আছে। ওটা কি আমরা…”
“আমিও ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি, পীর খান। কিন্তু ওতে ধরা পড়বার একটা ভয় থেকে যাবে।”
ব্যাপারটা নিয়ে একটুক্ষণ ভেবে পীর খান বলল, “একটা বুদ্ধি করলে হয় মীরসাহেব। নেশা জমে উঠলে আপনি খানকে বলুন রাতে আর না ফিরে আপনার তাঁবুতেই থেকে যেতে। তারপর তাকে বলবেন তার ঘোড়া আর জিন চেয়ে পাঠাতে, যাতে সকাল সকাল উঠেই ঘোড়া নিয়ে তৈরি হয়ে পড়তে পারে। যদি বুদ্ধিটা কাজে লেগে যায় তাহলে জিন থেকে জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়ে সেটাও ওর সঙ্গে কবরে চালান করে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। কী বলেন?”
“দাঁড়ান, আগে ভবানী কী সংকেত দেন দেখি। সেসব ভালো হলে চেষ্টাটা করা যেতে পারে,” মোতিরাম মাথা নেড়ে জানাল।
“বেশ। কাল তাহলে সেসব একবার দেখেশুনে নিও। আমিও পীর খানের প্রস্তাবটা নিয়ে একটু ভাবব আজকের রাতটা।”
পরদিন সকাল থেকে আমি গফুর খানের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থেকে এটা ওটা গল্প করতে লাগলাম। পথে যেসব ছোটোখাটো লুটপাট হচ্ছিল সেসব দিকে নজর দিলাম না বিশেষ। কথা বলতে বলতে এক ফাঁকে আমি হঠাৎ বললাম, “খানসাহেব, গুন্টুরে সেই ফিরিঙ্গিদের বাড়ি পোড়ানোর কথা খেয়াল আছে আপনার? ব্যাটারা নবাবদের মতো বড়োলোক, অথচ বাড়িতে সোনাদানা দূরস্থান একটা ফুটো পয়সা পর্যন্ত রাখে না। খালি চিনেমাটির থালাবাসন ভর্তি। সেসব ভেঙে হাতের সুখ হয়েছিল কিছু।”
“মনে নেই আবার? চিতু-সর্দার যদি ভয় পেয়ে আমাদের না আটকাত তাহলে সেদিন ফিরিঙ্গির তোষাখানা লুট করে বড়োলোক হয়ে যেতাম আমরা। তার বদলে বাড়িগুলো লন্ডভন্ড করে আফসোস মেটাতে হয়েছিল।”
“যা বলেছেন। উহ্, বাড়িগুলো জ্বলতে দেখে ব্যাটাদের বুকে কেমন জ্বালা হয়েছিল ভাবুন তো। ওহো, বলতে বলতে মনে হল, একটা বাড়িতে গায়ে ছাপা কাগজের লেবেল লাগানো ছোটো ছোটো বোতলে একরকমের মদ পেয়েছিলাম, মনে আছে? জিনিসটা খেতে কিন্তু দারুণ ছিল।”
“মাশাল্লা। সে স্বাদ কি কেউ ভুলতে পারে? বেশ ক’দিন ধরে জিভে লেগে ছিল। কাফিরগুলো আর যাই পারুক না পারুক, মদ বানাতে ওস্তাদ। মাঝে মাঝে ভাবি ওখানে বসেই সব খেয়ে না ফেলে কয়েকটা বোতল যদি সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম তাহলে মাঝে মাঝে সারাদিনের খাটুনির শেষে দু-একপাত্র পেলে মন্দ হত না।”
“আমি কিন্তু একটু হিসেবি মানুষ, খানসাহেব,” আমি মাথা নেড়ে বললাম, “আমার কাছে এখনও কয়েকটা বোতল বাঁচিয়ে রাখা আছে।”
“আছে? তাহলে বন্ধু নিজের সম্পত্তি নিয়ে এত কৃপণতা কোরো না। এমন স্বর্গের সুরা, আমায় তার একটু ভাগ দাও। চল চল।”
“আহা সে তো আপনার সেবার জন্য প্রস্তুতই আছে, খানসাহেব। আপনি ইচ্ছে করলেই হয়। তবে এই দিনের বেলা লোকসমক্ষে মদ খেলে আবার বদনাম-টাম না হয়। বলি কী, আজ রাতে আমার তাঁবুতে আসুন না একবার। একটু পোলাও রাঁধিয়ে রাখব’খন কাউকে দিয়ে। খাওয়াদাওয়া সেরে তারপর আরাম করে বসে দু’পাত্র খেলেই হবে। কেউ জানতে পারবে না।”
“আহা মীরসাহেব, আপনার জয় হোক। আমি সন্ধে হতেই আমার সহিসকে বলব আমার ঘোড়াটা যেন সে আপনার ঘোড়াদের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বেঁধে রাখে। কেউ জানতেই পারবে না আমি কোথায় গেছি। দ্বিতীয় কাউকে আমি সঙ্গেও আনব না। মানে বুঝতেই তো পারছেন, এসব অধর্মের কাজ…”
খানের কথাগুলো শুনে আমার বুকের ভেতরটা আনন্দে লাফিয়ে উঠল একেবারে। যেমনভাবে চাইছি, কিছু না করতেই ঠিক তেমনিভাবে ধরা দিতে চলেছে গফুর খান। ওর সোনাদানাভরা জিনটা তাহলে হাতাতে কোনও অসুবিধেই হবে না আমাদের। মাথা নেড়ে বললাম, “কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন, খানসাহেব। কেউ দেখে ফেললে ব্যাপারটা মোটেই ভালো হবে না। আমার সঙ্গেও শুধু আমার ধর্মভাই পীর খান থাকবে। চেনেন তো? খুব ভালো ছেলে। সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ কোনওকিছু জানবেই না। তাহলে আজ সন্ধেবেলা পোলাওটা রান্না হয়ে গেলেই আমি আপনার কাছে খবর পাঠাব’খন।”
“আরে না না, খবরদার। ওসব একদম করবেন না। অন্ধকার হওয়ার পর আমি নিজেই সবার চোখের আড়ালে আপনার তাঁবুতে এসে ঢুকে পড়ব,” বলতে বলতে পাশে পাশে চলা সহিসের দিকে ফিরে ফিসফিস করে বলে, “এই শোন, আমি রাতের বেলা যেই বের হব সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘোড়াটাকে নিয়ে পেছন পেছন বের হবি। পেছন পেছন এমন ভাব করে আসবি যেন আমি কোথাও যাচ্ছি ঘোড়ায় চড়ে। তারপর সবার চোখের আড়ালে এসে ঘোড়াটাকে এনে মীরসাহেবের তাঁবুর পেছনে বেঁধে দিবি।”
সে মাথা নেড়ে বলল, “জো হুকম।”
“আর শোন, কোথায় যাচ্ছি সেকথা কেউ জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিবি না কিন্তু।”
“যে আজ্ঞে, মালিক।”
“কথাটা খেয়াল থাকে যেন। কাকপক্ষীতে জানতে পারলে তোর আর ধড়ের ওপর মুন্ডুটা থাকবে না এটা জেনে রাখিস।”
সারাদিন তীব্র গরমে ঘোড়া ছুটিয়ে সন্ধের মুখমুখ সেদিন আমরা আমাদের বিশ্রামের জায়গায় পৌঁছে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। খান ঘন ঘন লোক পাঠাচ্ছিল আমাদের পোলাও রান্নার কদ্দুর সে খবর নিতে। কিন্তু খাবার যে তৈরি সেকথা তাকে ঠিক সময়টা আসবার আগে জানিয়ে দিলে আমাদের কাজটাই পন্ড হয়ে যেত। কাজেই তাকে খবর দিলাম, রান্নার দেরি আছে।
মোতিরাম মধ্যে একবার এসে বলে, “সারাদিন যে খানসাহেবের সঙ্গে রইলেন মীরসাহেব, তা ভবানীর সংকেত-টংকেত কিছু খেয়াল করলেন?”
বললাম, “উঁহু, খেয়াল করিনি। তুমি কিছু পেলে?”
“আমার এসব কাজে আলসেমি করবার অভ্যাস নেই। কাল রাতেই কথাবার্তার পরে আমি আর পীর খান গিয়ে নিশানের পায়ে গুড়ের ভোগ চড়িয়ে ভবানীর আদেশ জানতে চেয়েছিলাম। ভবানী থিবাহু, পিলাহু দুই দিয়েছেন। আজকের কাজে তাঁর পূর্ণ আশীর্বাদ আছে।”
“থাকতেই হবে, মোতিরাম। পুণ্যকর্ম করতে যাচ্ছি যে! তবে একটা কথা কী জান, দেবতার আশীর্বাদ না পেলেও এ কাজটা আমি করতামই।”
“এমন কথা বলবেন না, জেমাদারসাহেব,” হাসতে হাসতে মোতিরাম বলল, “আপনি যা নিয়ম মেনে চলা লোক! তবে আর সেসব ভাবনার কোনও দরকার নেই। সব সংকেত শুভ। এখন কাজটা করে ফেললেই হয়।”
“এ কাজটা ভালোভাবে হয়ে গেলে আমরা আমাদের পথে ফের কয়েকটা কাজ করব বলে ঠিক করে রেখেছি। তবে সেসব পরে হবে। উপস্থিত এ লোকটা উধাও হবার পর একটা হইচই হবে। সেসব থিতিয়ে যাওয়া অবধি আমাদের একটু চুপচাপ থাকতে হবে।”
“ভালো। আসলে আমরাও কদিন ধরে এই নিয়েই ভাবনাচিন্তা করছিলাম। আপনার সঙ্গেও কথা বলব বলে ঠিক করেছিলাম। চারপাশে এই পিণ্ডারি কুকুরগুলো সঙ্গে হাজার হাজার টাকা নিয়ে ঘুরছে, আর আমরা কিনা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি! লজ্জার কথা। এখানে তো রোজ রাতেই কিছু না কিছু কাজ করা যায়।”
“একটু ধৈর্য ধর, মোতিরাম। আগে তো খানের ব্যাপারটা মিটুক! লোকজন নেই সাথে। লুগাইয়ের কাজটাও তো সেই আমাদেরই করতে হবে।”
“সে আমরা তৈরি আছি। আপনি ভাববেন না, মীরসাহেব।”
“তাহলে আর দেরি কোরো না। তোমার তাঁবুটা আমার তাঁবুর গায়ে গায়ে ঘেঁষে লাগিয়ে ফেল। মাঝখানে একটা পর্দা দিয়ে তার পেছনে গর্তটা খুঁড়বে। খান আসবার আগেই কাজটা… উঁহু, না। সন্দেহ করে এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে পারে। ও বরং খান এসে আসর বসাবার পরই শুরু কোরো।”
“তা ঠিকই বলেছেন মীরসাহেব। লোকটা সেয়ানা আছে। এসে নেশা করতে শুরু করলেই চটপট হাতে হাতে কাজ হয়ে যাবে। আমাদের দলের জনাতিনেকের লুগাইয়ের কাজ করবার অভ্যেস আছে। ওরাই সামলে দেবে। গর্ত তো আর বেশি গভীর করতে হবে না!”
“সহিসটাকেও ছাড়া চলবে না, মোতি।”
“ও আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। আপনি আর পীর খান মিলে এই খানটকে সামলান দেখি!”
“বেশ। সব ঠিক হয়ে গেল তাহলে। খেয়াল রেখ, খাবার জায়গায় খানের সঙ্গে থাকব কেবল আমি আর পীর খান। তোমরা বাকিরা থাকবে চোখের আড়ালে। ঘোড়াগুলো তৈরি রাখবে। কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে যাতে সঙ্গে সঙ্গে পালাতে পারি। তবে মনে হয় সেসবের দরকার হবে না, কী বল?”
“আমারও তাই মনে হয়। লোকটা এদের ওপরতলার মানুষ। হারিয়ে গেলে একটু হইচই হবে সেটা ঠিক, কিন্তু লোকে ভাববে হয় নিজের লুটের মাল নিয়ে পালিয়েছে ব্যাটা, আর না হয় পিন্ডারিদেরই কেউ তাকে খুন করেছে। ওকে তো কেউই পছন্দ করে না! দলের বেশ ক’টা পিন্ডারিকে খুনও করেছে ওর লোকজন। ফলে ওর ওপর অনেকেরই রাগ।”
“সে আমি জানি। এখন যাও, তৈরি হও গে। তোমার তাঁবুটা এনে লাগাও চটপট।”
অবশেষে সন্ধে হল। চারপাশ থেকে নামাজের শব্দ উঠছিল। লোকজন দলে দলে যার যার আসন বিছিয়ে নামাজে ব্যস্ত। তাদের দেখে কে বলবে যে তাদের অনেকেরই হাতে তখনও মানুষের রক্ত লেগে আছে!
নামাজের পাট চুকলে সবাই গিয়ে যে যার ঘোড়ার পাশে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ল। আমি আর পীর খান তখন আমাদের তাঁবুতে বসে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছি, কখন খান আসে। জীবনে এই প্রথমবার কোনও নির্দোষ মানুষের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য কাজ করবে আমার রুমাল!
“বোতলে আফিং মিশিয়েছ?”
পীর খানের প্রশ্নের জবাবে আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “সব হয়ে গেছে। প্রথম বোতলটায় কিছু মেশাইনি। পরেরগুলোতে দু’তোলা করে আফিং মিশিয়ে রেখেছি। একটু গন্ধ ছাড়ছে বটে, তবে প্রথম বোতলটা সাবাড় করবার পর তো দু’নম্বরটা ধরবে! তখন অতশত টের পাবে না আর। একে দু’জন মিলেই দিব্যি সামলে দেব, কী বল?”
“না পারলে কীসের ঠগি হলাম আমরা, মীরসাহেব? গায়ের জোর খানের চেয়ে আমার কিছু কম নেই। আর রুমালে তো তুমি যাকে বলে সিদ্ধহস্ত। তবে শব্দটব্দ তো একটু হবেই। কী করব? খান প্রথম বোতল সাবড়াবার পর মোতিরামকে দু-তিনজনকে নিয়ে গানবাজনা করতে বসিয়ে দেব নাকি? ওর একটা সেতার আছে সঙ্গে। ঢোলকও পাওয়া যাবে। খান যতই ছটফট করুক না কেন গানবাজনার শব্দে সব চাপা পড়ে যাবে।”
“না না। একেবারে নয়। এদের বাকি লোকজন যদি গানবাজনা শুনতে চলে আসে তাহলে গোটা কাজটাই মাঠে মারা যাবে। ওসব থাক। আমরাই যা পারি করব। তারপর কী হবে না হবে সেসবের জন্য তো আল্লাই রইলেন মাথার ওপরে!”
রাত গভীর হল। একে একে চারপাশে সব শব্দ থেমে গেল। তাঁবুর দরজা ধরে আমি একরাশ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। খান এখনও আসছে না কেন? বেশ কিছুক্ষণ ওইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে যখন ধরেই নিয়েছি যে খান আমাদের ফাঁকি দিয়েছে, তখন দেখা গেল অন্ধকারের মধ্যে এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে থাকা পিন্ডারিদের মধ্যে সাবধানে পা ফেলে ফেলে একটা লম্বা চেহারার মানুষ এদিকে আসছে।
তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে দেখে নিয়েই আমি পীর খানকে বললাম, “খান আসছে। ওর পেছনে ঘোড়া নিয়ে সহিসটা আসছে, দেখতে পাচ্ছ?”
“সুকর খুদা। আসছে তাহলে শেষ অবধি!”
“কে, মীরসাহেব নাকি?” অন্ধকারের মধ্যে থেকে গফুর খানের গলা ভেসে এল একটু বাদে, “আমার তো ভয় হচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে আপনার তাঁবুটাই না শেষমেষ হারিয়ে ফেলি।”
“হ্যাঁ, খানসাহেব। বান্দা হাজির। আসুন, আসুন!”
“কী, আসল বস্তুটা আছে তো? দেখবেন, ঠকাবেন না আবার।”
“ছি ছি, কী যে বলেন খানসাহেব! আমি আপনাকে ঠকাতে পারি?” বলতে বলতে খানকে তাঁবুর মধ্যে ডেকে এনে আমি একধারা সাজানো বোতলগুলো দেখিয়ে বললাম, “ওই যে দেখুন। সব তৈরি। পীর খান গেছে পোলাও নিয়ে আসতে।”
“বেশ বেশ। রাতে ভালো করে খাব বলে আজ আমি সারাদিন প্রায় না খেয়ে রয়েছি। ঘন্টাখানেক আগেই চলে আসবার কথা ছিল, কিন্তু দরবারে ডাক পড়ল হঠাৎ। তাই একটু দেরি হয়ে গেল।”
“আর আপনার ঘোড়া?”
“ও ঠিক আছে। আমার সহিস ঘোড়াটাকে আপনার ঘোড়াদের সঙ্গে খুঁটো মেরে দিয়ে গেছে। ঘোড়াটাকে একটু ঘাস-জল খাইয়ে দেবেন, কেমন? বুঝলেন মীরসাহেব, বাকি নফরগুলোকে দারুণ ধোঁকা দিয়েছি আজ। বললাম, মাথা ধরেছে, রাতে আর কিছু খাব না। এই বলে তাঁবুতে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। বললাম, কেউ যেন রাতের বেলা আমাকে আর না জ্বালায়। এ কথা বলার পরে ব্যাটাদের আর সারারাতের মধ্যে আমার তাঁবুতে ঢোকবার সাহসই হবে না। খানিক মটকা মেরে পড়ে থেকে তারপর তাঁবুর পেছনের কানাত তুলে চুপিচুপি বের হয়ে পালিয়ে চলে এসেছি।”
কথা বলতে বলতেই পীর খান পোলাওয়ের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমরাও আর দেরি না করে পোলাওয়ে হাত ডুবিয়ে দিলাম। দু’গ্রাস মুখে তুলেই খান বলে, “কই, মদ কোথায়? গলা যে শুকিয়ে উঠল আমার!”
“এই যে হুজুর,” বলতে বলতে আমি খানের পেয়ালা ভরে ফিরিঙ্গি মদ ঢালতে ঢালতে বললাম, “আহা, রঙ দেখুন হুজুর!”
পেয়ালাটা তুলে সটান গলায় ঢেলে দিয়ে খান বলে, “আহা, কী স্বাদ! এ তো সাক্ষাৎ স্বর্গের শরবত, মীরসাহেব! ভেবে দেখুন, বেহস্তে যাবার পর আমরা, খাঁটি ধার্মিকেরা দিনরাত এমন শরবত খাব আর হুরিপরির দল আমাদের ঘিরে বসে থাকবে। আহা! কিন্তু ও কী? আপনি খাচ্ছেন না যে! নিন, নিন।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “এ বোতলটা গোটাটাই আপনার জন্য, খানসাহেব। তার পর আরও একটা আছে। তিন নম্বর বোতলটা আমি আর পীর খান ভাগ করে খাব।”
বোতল থেকে আর এক পেয়ালা ঢেলে নিতে নিতে খান বলে, “সাধে ফিরিঙ্গিরা এত বড়ো বড়ো কাজ করতে পারে? এমন মদ যারা দু’বেলা খায়, বীর তারা হবে না তো হবে কে? ব্যাটারা গোলটেবিলে বসে এই মদ খায়, তারপর চিৎকার করে করে গান গায় আর তারপর চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে উলটে পড়ে রোজ। কী মীরসাহেব, তাই না?”
“তাই তো শুনতে পাই, খানসাহেব। ফুর্তিবাজের দল সব।”
গফুর খানের নেশা হালকা হালকা চড়ছিল। বলে, “আচ্ছা ওদের কাছে যারা চাকরি করে তারা বোধহয় রোজ রোজ এই মদ খেতে পায়, তাই না?”
“পেতেই হবে,” আমি জোর গলায় উত্তর দিলাম।
“তাহলে আমি এবারে ইংরেজের ঘরে চাকরি নিচ্ছি, এই বলে দিলাম মীরসাহেব। শুনেছি সিকন্দর জা-ও নাকি এই মদের ভক্ত।”
“হায়দরাবাদে আমিও তাই শুনেছি, খানসাহেব। আসলে ওখানে থাকতেই আমি এ মদটা প্রথমবার চেখে দেখি। বোতলটা আমার চেনা ছিল। গুন্টুরের ফিরিঙ্গির বাড়ি লুট করতে গিয়ে তাই বোতলগুলো দেখে আমার চিনতে ভুল হয়নি।”
বোতলের শেষ পানীয়টুকু গলায় উলটে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খান বলে, “আহা! সাক্ষাৎ রাজার পানীয়। তা আরেক বোতল আছে বলে বলছিলেন যে, মীরসাহেব?”
“এই যে, খানসাহেব,” বলে আমি দ্বিতীয় বোতলটা বাড়িয়ে ধরলাম।
“আহা, কী সুখ! আমার এখন নাচতে ইচ্ছে করছে, গান গাইতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু… নাচলে লোকে নিন্দে করবে বোধহয়। তবে হ্যাঁ, গানবাজনাটা চলতে পারে। সেতার আছে নাকি কাছাকাছি? আমি কিন্তু খুব ভালো সেতারিয়া।”
আমি পীর খানের দিকে ঘুরে বললাম, “গিয়ে মোতিরামের সেতারটা নিয়ে এস। খানসাহেব, সেতারের মালিককেও আসতে বলব নাকি?”
“আরে মীরসাহেব, চাইলে স্বয়ং শয়তানকে নেওতা দিয়ে এস না। তোমার মোতিরাম গাইতে পারে?”
“সাক্ষাৎ বুলবুলের মতো গলা, খানসাহেব। কী আর বলব।”
বুলবুল শব্দটা কানে যেতেই খান দেখি সোজা হয়ে বসেছে। বলে, “বুলবুল! আহা, এখন যদি সত্যিই ক’টা বুলবুল এনে জড়ো করা যেত। এই সময়টা মীরসাহেব চুড়ির টুং টাং আর হরিণচোখের চাউনি না দেখলে মন ভরে না। কৃষ্ণার ধারে সেই নাচের আসরে… মনে আছে? আহা, কী দারুণ সব দিন গেছে তখন!”
“সব হবে, খানসাহেব। একবার নেমাওয়ারে পৌঁছে নিই। সেখানে নর্তকির অভাব হবে না। যত চান পাবেন।” বলতে বলতে সেতার হাতে মোতিরাম এসে ঢুকল।
“কী হে, সঙ্গীতরত্ন মুক্তারাম?” বলতে বলতে মোতির নাম নিয়ে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে কুটিপাটি হয়ে খান ফের বলল, “বাজনাটা সুরে বেঁধে এনেছ তো?”
“হ্যাঁ, জনাব।” মোতিরাম বিনীত কন্ঠে বলল।
সেতারের তারগুলোর ওপর একবার মৃদু হাত বুলিয়ে নিয়েই বাহবা দিয়ে উঠল খান। বলে, “খাসা সেতার। মিষ্টি সেতার।”
“কিছু আলাপ শোনান, খানসাহেব,” আমরা একসঙ্গে বলে উঠলাম এইবারে।
“শোনাব, শোনাব, নিশ্চয়ই শোনাব,” খান দরাজ গলায় সম্মতি দিল। তারপর ফের মোতিরামকে বলে, “গজল জান? গজল? তাহলে এইটা ধর তো দেখি, খুব সোজা গজল, ওই যে, মাহি আলম সোজ ইমাম, কই ধর ধর…” বলতে বলতেই দু’নম্বর বোতল থেকে আর এক ঢোঁক মদ খেয়ে আমার দিকে ঘুরে বলে, “এর স্বাদটা কেমন যেন একটু অন্যরকম ঠেকছে, খানসাহেব?”
বললাম, “ওহো, হ্যাঁ। এ বোতলটার গায়ের ছাপা কাগজটা একটু অন্যরকম ছিল বটে। হবে কোনও আরও দামি মদ! সাহেবগুলোর পয়সার তো মাথামুন্ডু নেই।”
“সে সস্তাই হোক আর দামিই হোক। খেতে যতক্ষণ ভালো লাগবে ততক্ষণ খেয়ে যাব, ব্যস। তা কই হে মোতি, গানটা ধর!”
মোতিরাম গান ধরল। খানসাহেবের সেতারের হাতটাও বড়ো মিষ্টি। গানবাজনায় আসর জমে উঠল বেশ। গান শেষ হলে আমি আর পীর খান সাবাশি দিয়ে উঠলাম। পীর খান বলে, “আমাদের কপাল ভালো। নইলে এই পোড়া জঙ্গলে এমন ওস্তাদি গানবাজনা ক’জনের ভাগ্যে জোটে। এবারে আপনার পালা, খানসাহেব। গান ধরুন একটা।”
“দাও হে, আর একটু হবে নাকি?” খানসাহেব খালি পাত্রটা বাড়িয়ে ধরলেন আমার দিকে।
আমি আবার তার পেয়ালাটা ভরে দিলাম। এক চুমুকে সেটা শেষ করে ফেলে সে পেয়ালা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “আর?”
“আর সাকুল্যে আধবোতল মতো বাকি রয়েছে, হুজুর।”
“তাহলে মোতিরামকে এক পেয়ালা দাও হে। বড়ো ভালো গানবাজনা শোনাল।”
“আজ্ঞে জনাব, আমি একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ,” মোতি সবিনয়ে জানাল।
“তোমার নাম মোতিরাম না হয়ে মোতি খান হলে বড়ো ভালো হত হে! মরার পরে স্বর্গে গিয়ে আল্লাতালাকেও তোমার গান শোনাতে পারতে।”
খান তার গজল ধরল যখন ততক্ষণে তার গলা ভারী হয়ে এসেছে। কিন্তু তারই মধ্যে চোখ ঘুরিয়ে, শরীর বাঁকিয়ে নাচনেওয়ালি মেয়েদের এমন সুন্দর নকল করে গাইতে লাগল যে আমরা হেসে কুটিপাটি। তার পেয়ালায় আরও একটু মদ ঢেলে দিতে সেটা খেয়ে নিয়ে সে আরেকবার গজল গাইবার চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে তার জিভ একটু একটু জড়িয়ে এসেছে।
মোতিরাম এবারে আবার একটা গজল গাইল। কিন্তু খানের সেতারের হাত তখন আর সুস্থ নেই। সুর-তাল সব কেটে যাচ্ছিল তার বারবার। খানিক বাদে রেগে গিয়ে সেতারটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল খান। তারপর হিক্কা তুলতে তুলতে বলে, “আরে ধুত! তিন হাজার সওয়ারের সেনাপতি আমি (হিক) গফুর খান, সারাদিন খেটেখুটে পিন্ডারি তাড়িয়ে এসে শেষে (হিক) গাওয়াইয়ার মতো গান গাইব নাকি? কভি নেহি (হিক)। কিন্তু-আ-(হিক) এই হিক্কার কী উপায় করি বলুন তো, মীরসাহেব?”
“আরেকটু মদ খান। একমাত্র মদ খেলেই হিক্কা কমতে পারে, হুজুর,” বলতে বলতে আমি আরেক পাত্র মদ তার সামনে ধরে দিয়েছি।
পাত্রটা হাতে নিয়ে গফুর খান বলে, “দাও দাও, যত মদ আছে তোমার কাছে সব দাও। আমি আজ ফিরিঙ্গি কাফির সাহেবদের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মদ খাব। হুঁ হুঁ হুঁ, সাহেববাড়ি চাকরি নেব। তারপর মদ খাব। সবার চেয়ে বেশি খাব, তারপর… কী বলে যেন চিৎকার করে মাতাল সাহেবে? কী যেন সেই…”
“বলুন, হিপ—হিপ—হিপ। সাহেবরা যখন মদ খেয়ে বেজায় মাতলামি করে তখন ওই বলে চিৎকার করে।”
“অ্যাঁ। বেশ, তাহলে আমিও বলব, এই হিপ হিপ হিপ… আচ্ছা মীরসাহেব, হিপ হিপ মানে কী?”
“মনে হয় ওইভাবে ওদের দেশে ভগবানের নাম করে ব্যাটারা। এই আমরা যেমন বলি না, বিসমিল্লা ই রহমানে রহিম, সেইরকম আর কী!”
“ঠিক বলেছেন, মীরসাহেব। আপনি জ্ঞানী মানুষ। আহা কী জিনিস যে খাওয়ালেন, সোজা একেবারে মাথায় চড়ে গেছে। তাঁবুটা চারপাশে এইসা পাক খাচ্ছে! এখন আমায় ধরুন দেখি একটু, উঠে দাঁড়াই। তারপর ফিরিঙ্গিদের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শেষ পাত্রটা খেয়ে ফেলি।”
“আহা দারুণ, দারুণ বলেছেন, খানসাহেব। আসুন।” এই বলে আমি তাকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হাতে মদের পেয়ালাটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “এই যে, জনাব। খেয়ে নিন।”
“বিসমিল্লা—হিপ—হিপ—হিপ” বলে জড়ানো গলায় একটা হাঁক মেরে খান পাত্রটা মুখে উপুড় করে দিল একেবারে। তারপর সামনের দিকে এক পা এগোতে গিয়ে ধড়াস করে আছড়ে পড়ল মাটির ওপর।
পীর খান ঠিক সময়ে সরে গেছিল খানের সামনে থেকে। এইবারে তার পড়ে থাকা শরীরটার দিকে তাকিয়ে বলে, “বাস। মহান খানসাহেব, আমাদের অনেক আনন্দ দিলে তুমি আজ। এবার খেল খতম।”
“একে তুলে বসিয়ে দাও কেউ। আমি তৈরি আছি। কেউ একজন ঝিরনিটা দিয়ে দিও,” আমি চাপা গলায় বললাম।
খানকে তুলে বসিয়ে দিতে দেখা গেল মুখ থেকে গ্যাঁজলা বের হচ্ছে তার। মাথাটা বুকের ওপর ঢুলে পড়েছে।
“এ তো মারা যাচ্ছে!” মোতিরাম হঠাৎ অবাক গলায় বলে উঠল। তারপর আমাদের দিকে ঘুরে বলে, “একে একদম ছোঁবে না। মরতে চলা মানুষের গায়ে হাত দিলে অমঙ্গল হয়।”
“মরছে, না আরও কিছু। জীবনে মদ ছুঁলে না, তুমি ওসব জানবে কী করে? আমি অনেক দেখেছি। এর নেশা হয়ে গেছে। এখন নাও, সোজা করে তুলে ধরে বসাও। মাথাটা কেউ তুলে ধর, আর ঝিরনি দাও তাড়াতাড়ি।”
অতএব তাই হল। ঝিরনির আওয়াজটা আসবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গফুর খানের প্রাণ বেরিয়ে গেল আমার হাতে। তার শরীরটা ছেড়ে দিয়ে আমি বললাম, “উল—হমুদ উল ইল্লা। ভবানী আর মহম্মদের অশেষ কৃপা। কাজ শেষ। এবার এর শরীরটার একটা গতি কর কেউ। এবারে সহিসটাকে দেখে আসি।”
খানের শরীরটা সেখানেই রেখে আমরা বাইরে এলাম। দলের বাকিরা সেখানেই অপেক্ষা করছিল। বললাম, “সহিস কোথায়?”
তারা দেখিয়ে দিল একটা গাছের নিচে সে ঘুমিয়ে আছে। পীর খান তার কাছে গিয়ে পা দিয়ে তার শরীরে একটা টোকা মারতে সে যেই ধড়মড় করে উঠে বসেছে অমনি পীর খান তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এক মুহূর্তের মধ্যে সব চুকেবুকে গেল।
অগভীর একটা কবর খুঁড়ে তার মধ্যে শরীরগুলো পুঁতে দেয়া হল। খানের ঘোড়ার জিনের কাপড় কেটে তার মধ্যে থেকে অনেকটা সোনা আর দামি পাথর পাওয়া গেল। খান তার সব রোজগার সাহুকারদের কাছে সোনায় বদলে নিয়ে নিজের কাছে কাছে রাখত। সোনাদানা বের করে নেবার পর ঘোড়ার জিনটাকে কেটে ফালা ফালা করে খানের সঙ্গে এক কবরেই সেটাকেও পুঁতে দেয়া হল।
“ঘোড়াটাকে নিয়ে কী করা যায়, মীরসাহেব? এত ভালো ঘোড়া! আমাদের কাছে কাল এটাকে দেখা গেলে তো মুশকিল! গায়ের রঙ পালটে দেব তার সময়ও তো নেই!”
মোতিরামের কথা শুনে ঘোড়াটার দিকে ঘুরে দেখলাম আমি একবার। ভারি তাগড়াই তেজি ঘোড়া। তার গায়ে হাত বুলিয়ে বললাম, “রেখে দিতে পারলে তো ভালোই হত। কিন্তু এর জানের চেয়ে আমাদের জানের দাম বেশি, মোতিরাম। এখান থেকে তির ছোঁড়া দূরত্বে একটা খাদ আছে। কেউ কি চেন?”
সবাই মাথা নাড়ল। কেউ দেখেনি খাদটা।
“হুঁ। তাহলে আমাকেই যেতে হবে দেখছি,” এই বলে আমার দলের এর একটা ছেলেকে ডেকে বললাম, “ঘাউস খান, ঘোড়াটাকে নিয়ে তুমি আমার সঙ্গে একবার এস তো!”
খাদটা গভীর। খাড়াই পাড়গুলো ওপর থেকে একেবারে নিচে পর্যন্ত জঙ্গলে ঢাকা। তার একেবারে ধারে গিয়ে ঘোড়াটাকে দাঁড় করিয়ে ঘাউস খানকে বললাম সেটার লাগাম ধরে মাথাটা একপাশে ঘুরিয়ে দিতে। তারপর সে ঘোড়াটাকে শক্ত করে ধরতে আমি আমার তলোয়ারটা দিয়ে জীবটার গলায় একটা গভীর টান দিয়ে দিলাম। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এল কাটা গলাটা দিয়ে। ঘোড়াটা কেঁপে উঠে এক পা পেছনদিকে যেতেই খাদের মধ্যে পড়ে গেল। একটুক্ষণ পরে অনেক নিচের থেকে ধুপ করে মৃদু শব্দ উঠল একটা। উঁকি মেরে দেখলাম, ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না আর।
তলোয়ারটা মুছে নিয়ে বললাম, “চল, ঘাউস খান। আর চিন্তা নেই। শেয়ালদের একটা বড়সড় ভোজ জুটে গেল আজকে রাতে।”
ঘাউস খান মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, “হায়দরাবাদের বাজারে কম করেও হাজার টাকা দাম মিলত ঘোড়াটার।”
“সে নিয়ে ভেব না,” আমি হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলাম, “অমন অনেক হাজার টাকা রোজগারের বন্দোবস্ত হচ্ছে তোমাদের।”
“কীভাবে, মীরসাহেব?” ঘাউস খান উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করল।
“আরে, এই তো আজকে রাতে আমরা আমাদের আসল কাজটা শুরু করে দিলাম। ইনশাল্লা এরপর আরও ভালো ভালো কাজ করব আমরা এখানে।”
তাঁবুতে ফিরে দেখি লুগাইরা তাদের কাজকর্ম সেরে ফেলেছে। গফুর খানের কবরের ওপরে আমাদের বিছানা পেতে দেয়া হয়েছে। সেখানে সবাই মিলে শুয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে গফুর খানের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নিয়ে হাজারো গুজব ছড়াল চারপাশে। কারও কারও মত হল, লোকটা যা বদমাশ ছিল তাতে শয়তান স্বয়ং এসে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেছে গতরাতে। আবার কেউ কেউ বলছিল, লোকটা এত সম্পত্তি জমিয়ে ফেলেছিল যে পাছে সেসব হাতছাড়া হয়ে যায় তাই সব নিয়ে রাতের অন্ধকারে দল ছেড়ে পালিয়েছে। গফুর খান যে তার সব লুটের মাল সোনায় বদলে নিয়ে ঘোড়ার জিনের সঙ্গে থলিতে সেলাই করে রাখত সে খবর পিন্ডারিদের সবারই জানা ছিল।
সেদিন সারাদিন চলবার পর রাতের ঘাঁটিতে পৌঁছে চিতু আমায় দরবারে ডেকে পাঠাল। গিয়ে দেখি দরবার একেবারে ভর্তি। গফুর খানের চাকরবাকরগুলোকে দড়ি বেঁধে মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আমি ঢুকে সেলাম দিতে চিতু আমায় ডেকে পাশে বসিয়ে বলল, “ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক, মীরসাহেব। গফুর খান গেল কোথায়? সেই ছোটোবেলা থেকেই আমার সঙ্গে আছে। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও তো বেশ ভালোই ছিল। তাহলে হঠাৎ পালাতে যাবে কেন? তোমার কী মনে হয়?”
বললাম, “আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না, হুজুর। নানান লোকে নানান কথা বলছে বটে, কিন্তু সেসব গুজবের কানাকড়িও দাম নেই। খানের চাকরবাকরদের থেকে কিছু জানা যায়নি?”
“উঁহু। এখনও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়নি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। নাও, শুরু কর।”
“আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব, হুজুর। কিন্তু শুরুটা আপনিই করুন। এরা আপনাকে অনেক বেশি সম্ভ্রম করে তো! সত্যি কথাটা বলে দেবে।”
“বেশ। তাই হোক,” বলে চিতু তার এক নফরকে ডেকে বলল, “ব্যাটাদের একটাকে আমার সামনে আন।”
একটা বয়স্কমতো লোক কাঁপতে কাঁপতে চিতুর সামনে এসে হাতজোড় করে দাঁড়াল।
“নাম কী তোর?” চিতু জলদগম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল।
“আজ্ঞে, সৈয়দ ইব্রাহিম, হুজুর।”
“গফুর খানের কাছে কী কাজ করতি?”
“খিদমতগার ছিলাম, মালিক। খানসাহেবের জামাকাপড় ঠিক রাখতাম, স্নান করিয়ে দিতাম, রাতে বিছানা পাততাম…”
“ঠিক আছে, ইব্রাহিম। এইবার যা জানিস সব ঠিকঠিক বল। ভয়ের কোনও কারণ নেই। তবে মিথ্যে কথা বলছিস টের পেলে এইখানেই কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব, এই বলে দিলাম।”
“না, মালিক। যা বলব, সত্যি বলব।”
“নে, তাহলে শুরু কর।”
“হুজুর, কাল সন্ধেবেলা আপনার দরবার থেকে ফিরে খানসাহেব দরবারের কাপড়জামা ছেড়ে তাঁবুতে গিয়ে শুলেন। আমি গিয়েছিলাম স্নানের জলসাবান নিয়ে। তা আমায় বললেন, ওসবের দরকার নেই। খাবার রান্না করা ছিল। বললেন, রাতে খাবেন না, আমরা যেন তাঁর জন্য রান্না করা খাবারদাবার সব খেয়ে নিই। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ে বললেন, রাতে যেন আর তাঁকে বিরক্ত না করা হয়। সারাটা দিন খানের সঙ্গে দৌড়োদৌড়ি করে আমিও ক্লান্ত ছিলাম। তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আমিও শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে ফের যখন খানকে জাগাবার জন্য তাঁবুতে ঢুকলাম, দেখি বিছানা খালি। খান নেই। খানের তলোয়ারটাও নেই। হাঁটবার সময় সঙ্গে একটা ছোটো ডান্ডা রাখতেন, সেটাও নেই। এর বেশি আমি কিছু জানি না। তবে হ্যাঁ, শেখ কাদির আমার পরে নাকি খানকে দেখেছিল। সে আরও কিছু জানতে পারে।”
শেখ কাদিরকে সামনে ডাকা হল। সে যা বলল তা মোটামুটি এইরকম, সে ছিল খানের হুঁকাবরদার। মালিককে তামাক, আফিং এইসব সেজে দেয়া তার কাজ ছিল। আগেরদিন রাত একটু গভীর হলে সে দেখে খান তার তাঁবুর পেছনের কানাত তুলে আস্তে আস্তে বের হয়ে এসে হাঁটা দিয়েছে। কৌতূহলী হয়ে সে খানের পিছু নিয়েছিল। কিন্তু খান হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে রেগে উঠতে সে কোরা খাবার ভয়ে এক বন্ধুর তাঁবুতে পালিয়ে যায়। এর বেশি আর কিছু সে জানে না।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “উঁহু। কিছু বোঝা যাচ্ছে না, হুজুর। আচ্ছা একটা কথা, খানের ঘোড়াটা কোথায়? এখনও এখানেই আছে তো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক, ঠিক। ঘোড়া কোথায় খানের?” চিতু আমার কথার প্রতিধ্বনি করল।
শেখ কাদির করুণ গলায় বলে, “জানি না, হুজুর। খানসাহেবের দুটো ঘোড়ার একটা আর তার সহিস দুটোই উবে গেছে কাল রাতে। খানের সোনাদানার থলে লাগানো জিনটাও গায়েব।”
“হুম। তা অন্য ঘোড়ার সহিসটা কোথায়?”
দরবারের এক দারোয়ান অমনি হাঁক দিয়ে উঠল, “পীর-উ-মুরশিদ-হাজি—ই—ই—র।”
সঙ্গে সঙ্গে খানের আর এক চাকর সামনে এগিয়ে এসে সেলাম দিল।
“তুমি কী জান, বল।”
“আজ্ঞে হুজুর, ছেয়ে রঙের ঘোড়াটাকে বিকেল থেকেই জিন পরিয়ে রাখা ছিল। এত সোনারুপোর থলেওয়ালা জিনটাকে খালি ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে রেখেছে কেন জিজ্ঞাসা করতে তার সহিস রেগে উঠে আমায় যা নয় তাই করে বলল, হুজুর। বলে, মালিকের হুকুম আছে। তোর এতে কথা বলবার কী দরকার। অন্ধকার হবার পর দেখি সহিস ঘোড়াটাকে খুলে নিয়ে বের হচ্ছে। আগেরবার বলতে গিয়ে গালি খেয়েছি, তাই তখন আর আমি কিছু বলতে সাহস পাইনি।”
আমি মাথা নেড়ে গম্ভীর মুখে বললাম, “গফুর খান তাহলে তার টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়েই গেছে, হুজুর। এ ছাড়া আর তো কিছু হতে পারে বলে মনে হচ্ছে না।”
“আমারও তাই মনে হচ্ছে, মীরসাহেব। হায়দরাবাদে ওর অনেক বন্ধুবান্ধব আছে। ওখানেই পালিয়ে গিয়ে থাকবে। মানুষ এত অকৃতজ্ঞও হয়? আমার ছেলেবেলার বন্ধু। এত সুযোগ দিলাম, তিন হাজার ঘোড়সওয়ারের সেনাপতি বানিয়ে দিলাম, কিন্তু শেষে আমাকেই ছেড়ে চলে গেল?” বলতে বলতে খানের চাকরবাকরগুলোর দিকে তাকিয়ে চিতু বলে, “যাও হে তোমরা। তোমাদের আরে কী দোষ! খানের অন্য ঘোড়াটাকে আমার আস্তাবলে নিয়ে বেঁধে রেখে এস গে।”
ব্যাপারটা এখানেই ধামাচাপা পড়ে গেল। এরপর আমরা প্রায় প্রতি রাতেই দুটো একটা করে পিন্ডারি শিকার করতে শুরু করলাম। কিন্তু সেসময় নেমাওয়ার যত এগিয়ে আসছে ততই একটা দুটো করে পিন্ডারি দল ছেড়ে পালাচ্ছে। ফলে দু-একটা লোকের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ হয়নি। তার ওপর কাছাকাছি একটা ফিরিঙ্গি সৈন্যের দল আমাদের তাড়া করে চলেছে তখন। তার মধ্যে এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কারও মাথা ঘামাবার সময় ছিল না।
ক্রমশ