আগের পর্বগুলো
বাবা বলল, “ডাকটা এসেছে কাল আমরা যেদিকে যাব একেবারে সেইদিক থেকে। আমাদের এক্ষুণি ফিরে যেতে হবে। ভবানীর ইচ্ছে নয় আমরা আর সামনে এগোই। এগোলে ভয়ানক বিপদ আসবে।”
আমার কিন্তু মন মানছিল না। বাবাকে গিয়ে বললাম, “আমরা কোন ভুল করছি না তো? পুজোপাঠ একেবারে নিয়ম মেনে করা হচ্ছে। তার ওপর বেরোবার মুখে ভবানী তো খুব শুভ সংকেতই দিয়েছিলেন।”
“বোকার মত কথা বলিস না,” বাবা জবাব দিল, “পুজোপাঠ যা হয়েছে হয়েছে। কিন্তু পরপর দুবার একারিয়া শোনবার পর সামনে এগোনো মানে জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাওয়া। এখন অবধি বারবার ধুলোমুঠি সোনামুঠি হয়েছে তোর। তাই বলে সে গর্বে ভবানীর সংকেতকে অবহেলা করিস না। সর্বনাশ হবে তাহলে। বের হবার সময় তিনি কেন শুভ সংকেত দিয়েছিলেন, আর এখন কেন একারিয়া শোনাচ্ছেন সে প্রশ্ন করবার তুই কে? সবই তাঁর ইচ্ছা। তাঁর মনে কী আছে আমরা তার কতটুকু বুঝি?”
ততক্ষণে গোটা দলটাই একারিয়া শুনতে পেয়ে আমাদের তাঁবুতে এসে ভিড় করেছে। সবার মুখেই এক কথা। হয় সবাই মিলে ঝালোনে ফিরে যেতে হবে। আর নাহয় তাদের ছেড়ে দিতে হবে দল থেকে। ভয়টা তখন গোটা দলটাকেই এমনভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে যে তাদের নিয়ে সামনে এগোলে এমনিতেই বিপদ হতে বাধ্য। ফলে নিরুপায় হয়ে ফেরবার আদেশ দিতে হল আমাকে। সে রাতেই ঘাঁটি উঠিয়ে ফিরতি পথে কয়েক ক্রোশ এগিয়ে গেলাম আমরা। তার পরদিন থেকে তাড়াতাড়ি পথ চলে একেবারে খালি হাতে ঝালোনে ফিরে এলাম ফের কয়েকদিনের মধ্যে।
মাসখানেক বাদে ফের আমি আমার দলবল একত্র করে ভবানীর সংকেত পরীক্ষা করলাম। দেখা গেল ভবানী ফের শুভ সংকেত দিয়েছেন। তবে এবারে তিনি যেতে বলেছেন পশ্চিমদিকে। সেদিকটায় বম্বে আর ইন্দোরের মাঝামাঝি এলাকাটায় তো বটেই, তা ছাড়াও গোটা মালবের মালভূমি জুড়েই প্রচুর ধনসপম্পদের আনা-নেওয়া চলতে থাকে। গণেশ জেমাদার তখন তার দল নিয়ে অন্য কোন এক দিকে অভিযানে বের হয়ে গেছে। তাদের কোন খবর আমাদের কাছে ছিল না। তাতে অবশ্য আমার কোন আক্ষেপ ছিল না, কারণ মুখে যতই ভালো ব্যবহার করি , লোকটাকে কেন যেন আমার একেবারে পছন্দ হত না। কয়েকদিনের মধ্যেই সব বন্দোবস্ত করে ফেলে আমি পীর খানকে সঙ্গে করে একশো কুড়ি জনের একটা দল নিয়ে রওনা হয়ে পড়লাম। রাস্তা খুব লম্বা বলে এ-যাত্রা বাবা আর আমাদের সঙ্গে বের হল না।
বম্বে অবধি বিশেষ কোন বলবার মত ঘটনা ঘটল না আমাদের। তবে আয়রোজগারও মন্দ হয়নি। একতিরিশটা শিকার জুটেছিল রাস্তায়। তাদে থেকে হাজারচারেক টাকা পাওয়া গেছিল। তাছাড়া, বম্বের সমুদ্র আর তার ওপর কুলকিনারাহীন জল পেরিয়ে আসা ফিরিঙ্গি জাহাজের বহর দেখে বেশ আনন্দ পেলাম আমি।
বম্বের দুর্গের চৌহদ্দির বাইরে একটা বাজার এলাকায় ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে থাকছিলাম আমরা। সবার চোখ এড়িয়ে দেখাসাক্ষাত করবার জন্য বেছে নিয়েছিলাম কাছেই থানে নামের একটা জায়গাক। সে জায়গাটা মূল ভুখন্ডের একেবারে শেষ সীমাতে হওয়ায়, বম্বে আসা যাওয়ার পথে হাজারো লোকের ভিড় লেগেই থাকে সবসময়।
কদিন সেখানে থাকবার পর ঠিক করলাম এবারে বম্বে ছেড়ে রওনা দেব।
রওনা দেবার আগের দিন দুপুরে দুর্গের সামনের ঘাসে শুয়ে শুয়ে সমুদ্র দেখছি, এমন সময় এক ভদ্রলোক আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “সালাম আলেকুম। গত কয়েকদিনই ধরেই দেখছি আপনি এইখানে এসে শুয়ে শুয়ে সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকেন। পোশাক আশাক দেখে মনে হচ্ছে আপনি হিন্দুস্তানের লোক। আগে কখনো সমুদ্র দেখেন নি নাকি?”
“একেবারে ঠিক ধরেছেন। হিন্দুস্তানে সমুদ্রের থেকে বহু ভেতরের এলাকায় আমার গ্রাম। জীবনে এই প্রথম সমুদ্র দেখলাম আমি। আহা কী রূপ! চোখ ফেরানো যায় না।,” আমি তাড়াতাড়ি জবাব দিলাম।
“আমিও হিন্দুস্তানের লোক, বুঝলেন? আপনার কথার টান কিন্তু আমার খুব চেনা ঠেকছে। কোত্থেকে আসছেন বলুন তো? গ্রামের নাম?”
বললাম, “আমরা মুরনির লোক। উপস্থত ঝালোনে থাকি।”
লোকটা আশ্চর্য হয়ে বলে, “মুরনি?” কিন্তু তারপরেই গলা সংযত করে বলল, “তার মানে সিন্ধিয়ার রাজত্বে, তাই তো?”
“উঁহু। উপস্থিত মুরনি ফিরিঙ্গিদের দখলে।”
লোকটা এইবারে হঠাৎ প্রসং বদলে বলে, “কখনো জাহাজে উঠেছেন নাকি?”
“নাঃ,”আমি জবাব দিলাম, “কয়েকবার মনে হয়েছে যাই , গিয়ে চড়ে দেখে আসি একবার। কিন্তু তারপর যখন পাড় থেকে জাহাজ অবধি নিয়ে যাবার নৌকোগুলোর দেখলাম, হাল দেখলাম, তখন আর সাহসে কুলোয়নি। যদি ডুবে যায়? তাছাড়া আমি ভিনদেশি লোক, গেলেই যে আমায় চড়তে দেবে সে কথাই বা কে বলল?”
লোকটা বলল, “ঠিক আছে। চলুন। আপনাকে জাহাজ ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনি।”
লোকটা কে জানতাম না, কিন্তু দেখলাম জাহাজঘাটায় সবাই তাকে খুব মান্যগণ্য করে চলে। যার সঙ্গেই দেখা হয় সে-ই ঝুঁকে পড়ে সেলাম দেয়। আর সমুদ্রের ধারে পৌঁছোতে তো ছোট ছোট ডিঙিগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। সবাই তাঁকে নিজের নৌকোয় তুলতে চায়। তাদের মধ্যে একটা শক্তপোক্ত ডিঙি বেছে নিয়ে আমরা সমুদ্রের ভেসে পড়লাম। বড় বড় ঢেউগুলোর মাথায় মোচার খোলার মত ভাসতে ভাসতে ডিঙি যখন এগোচ্ছিল, তখন বেশ ভয় লাগছিল আমার। তবে খানিক বাদে ভয় কেটে যেতে ব্যাপারটায় বেশ মজাই লাগতে শুরু করল।
ছোটখাটো কয়েকটা জাহাজ পেরিয়ে একটা ফিরিঙ্গি যুদ্ধজাহাজের গায়ে এসে ডিঙি ভিড়িয়ে তার ক্যাপ্টেনের অনুমতি নিয়ে আমরা তার ওপর গিয়ে চড়লাম। ভারি সাজানো গোছানো জাহাজ। তার ওপরেরংশটা দেখবার পর, একজন নাবিককে দুটাকা বখশিস দিয়ে আমরা গিয়ে তার কামানঘরে গিয়ে ঢুকলাম। জায়গাটা দেখবার মত। সার সার কামান একেবারে নিখুঁতভাবে সাজানো, এমনকি তাদের পাশে রাখা দড়ির স্তূপগুলো অবধি এলোমেলো নয়। হিসেব করে রাখা একেবারে। যেন সাপের দল কুন্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে।
জাহাজ দেখা শেষ করে ফেরবার পথে সমুদ্র থেকে পাড়ের দিকে হাওয়া বইতে শুরু করতে ডিঙিওয়ালা একটুকরো পাল খাটিয়ে দিল। সেই হাওয়ার ঠেলায় ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে আমাদের ডিঙি বিনা কসরতে পাড়ে এসে ভিড়ল একটু পরে।
পাড়ে উঠে ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিদায় চাইতে তিনি আমার হাতটা ধরে বললেন, “একটু অপেক্ষা করুন মীরসাহেব। আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, তাহলে আমরা একই পেশার লোক। আমি এখন বম্বেতে থিতু হয়েছি বটে, কিন্তু সুযোগ পেলে ফের রাস্তায় নামতে পারি। আপনার সঙ্গে আমার দরকারি কথা আছে।”
আমি ভদ্রলোকের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে ঠগিদের সোপন সংকেতটা বলে উঠলাম, “আলি খান ভাই সালাম।”
জবাবে ভদ্রলোক বললেন, “সালাম আলেকুম।”
এ প্রশ্নের উত্তরে ওটাই ঠগিদের সংকেতবাক্য। বুঝলাম ইনি নিঃসন্দেহে একজন ঠগি। সংকেতবাক্যটা বলেই উনি ফের বললেন, “এ সংকেত বহুকাল পরে আমার কানে এল হে। পুরনো কথা সব মনে পড়ে যাচ্ছে। টুপুনির গুড়ের কথা–”
“আ-আপনি টুপুনির গুড় খেয়েছেন?”
“আরে হ্যাঁ। খেয়েছি।”
“বেশ বেশ, আর বলতে হবে না,” আমি তাঁর হাত ধরে বললাম, “আপনি আমার স্বধর্মের লোক। তবে আপনাকে তো ঠিক–”
“চিনতে পারলে না তাইতো? শোভারাম খান জেমাদারের নাম শুনেছ? মুরনিতে এখনো কারো কারো আমার কথা মনে থাকবে নিশ্চয়!”
“শুনেছি। তবে ওখানে লোকের বিশ্বাস আপনি মারা গেছেন। কিন্তু আপনি এখানে, এরকম একজন কর্তাব্যক্তি হয়ে বসলেন কীভাবে?”
“সে সব কথা পরে হবে। আগে বলো, আমার বন্ধু ইসমাইল জেমাদার কেমন আছেন? বেঁচে আছেন কি?”
“ভালো আছেন। উনি আমার বাবা হন।”
“সুকর খুদা, তুমি—ইসমাইলের ছেলে—কিন্তু তার তো কোন ছেলেপুলে ছিল না! আমি যখন দেশ ছেড়ে চলে এলাম তখন তো তার বিয়েও হয় নি!”
আমি হেসে বললাম, “তা হবে। তবে, তার পরে বিয়েটিয়েও করেছেন, আর–”
“আহা বেশ বেশ। তা আমার আরেক বন্ধু হুসেন? তার খবর কী?”
“তিনি বছরদুয়েক আগে মারা গিয়েছেন।”
এরপর আস্তে আস্তে জানা গেল ভদ্রলোক কয়েকপুরুষের ঠগি। একবার ইন্দোরের এক ব্যবসায়ীর কাজের লোক হিসেবে বম্বেতে এসে পৌঁছে জায়গাটা তাঁর ভালো লেগে যেতে এখানেই থেকে যান। ইংরেজ সাহেবের গদিতে বেয়ারার কাজ নিয়ে ঢুকে তাদের দয়ায় আস্তে আস্তে উন্নতি করে জেমাদারের পদে উঠেছেন। ভবিষ্যতে আরো উন্নতি করবেন। সুখেই আছেন। আমার দলের খোঁজখবর নিয়ে টিয়ে বললেন, “ভালো কথা। এসে যখন পড়েছো এত বড় দল নিয়ে, তখন কাজকর্মের কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তা আমি ঠগিদলের জেমাদারের কাজ ছেড়ে চলে এলাম কেন জানো? তোমার বাবা ইসমাইলের সঙ্গে একটা বোকার মত ঝগড়া বাধিয়ে। বয়স তখন আমাদের দুজনেরই কম। কী একটা ব্যাপার নিয়ে দুজনে একদিন ঝগড়া বাঁধল। দুজনেই তলোয়ার বের করে ফেললাম। সে ঝগড়া তখনকার মত মিটলেও তারপর আমার প্রাণে ভয় হল, ইসমাইল দলে আমার চেয়ে উঁচু পদে আছে। তার দিকে তলোয়ার তুলে দলের নিয়ম ভেঙেছি, তার জন্য যদি আমার প্রাণদন্ড হয়! সেই ভয়ে বুঝলে, আমি একদিন দল ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে ইন্দোরের সেই সাহুকারের সঙ্গে জুটলাম। তার পরের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছো। এখন বয়েস হয়ে গিয়ে নিজে আর বের হতে পারি না বটে, কিন্তু ঠগিদের দলবল যারা এদিকে আসে তাদের সঙ্গে যোগাযোগটা রাখি নিয়মিত, কাজকর্ম খুঁজে দিই। তবে তারা সবই এই দক্ষিণ এলাকার লোকজন। আগে ছুটিছাটা নিয়ে তাদের সঙ্গে পুনা অবধি দু একটা অভিযানেও বের হয়েছি। হিন্দুস্তানের কোন দলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি বিশেষ এর আগে। কিন্তু ভবানী যখন এবারে তেমন একটা দল আমার কাছে এনে তুলেইছেন তখন তাঁর ইচ্ছের অমান্য করব না। ভালো ব্যবসায়ীর দল ধরে দেবো দেখো তোমার লোকসান হবে না দেখে নিও। আমায় শুধু আমার ভাগটুকু ধরে দিও। শুভান খান ইজ্জতদার মানুষ। ফিরিঙ্গি সাহেবরাও তার ইমানদারীর কদর করে।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনাকে যতটুকু দেখলাম, তাতে আমারও সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।”
কথা বলতে বলতে আমরা তার বাড়িতে পৌঁছে গেছিলাম। সেখানে যথাযোগ্য অতিথিসৎকার করল শুভান খান। জানা গেল, আমরা বম্বেতে পা দেবার পরই সে আমাদের খবর পেয়ে গেছে। তারপর কয়েকদিন ধরে সে আমায় অনুসরণ করেছে, তারপর আমায় ফাঁকায় পেয়ে এসে কথা বলেছে। কয়েকদিনের মধয়েই শুভান খানের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তার সঙ্গে ফিরিঙ্গিদের দরবারেও গিয়ে দু একদিন ঘুরে এলাম আমি। সেখানে তার বেশ ভালো প্রতিপত্তি। শহরের আইনশৃংখলা বজায় রাখগবার দায়িত্ব দেয়া আছে তার ওপরে। কাজটা সে খুব মনযোগ দিয়ে করে বলে ফিরিঙ্গিরা তাকে ভালোও বাসে খুব। অন্যদিকে আবার, দক্ষিণের যত ঠগির দল আছে তাদের সবাই একেবারে তার মুঠোর মধ্যে ধরা। রাজসরকারে চাকরি করবার দরুণ বম্বে থেকে পুনা, শোলাপুর হায়দরাবাদ, নাসিক, গুজরাট এই সমস্ত রাস্তায় যত ধনী সাহুকারের যাতায়াত হয় তার সব খবর তার নখদর্পণে থাকে। দক্ষিণের সমস্ত ঠগির দলই মোটা টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে এইসব সাহুকারদের খবর কেনে।
শুভান খানের কথামতো প্রায় সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করলাম আমি। কিন্তু সে আর খবর কিছু দেয় না। এদিকে হাতের টাকাপয়সা তখন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে আসছে আমাদের। এইভাবে চলতে থাকলে রোজগার দূরস্থান বর্ষা শুরু হবার আগে ঝালোনে গিয়ে পৌঁছোনোও অসম্ভব হয়ে পড়বে। নিরুপায় হয়ে শেষে একদিন আমি শুভান খানের কাছে গিয়ে বললাম, “আর দিন দুয়েকের মধয়ে কোন খবর না পেলে আমাদের বম্বের পাট গুটিয়ে রওনা হয়ে পড়তে হবে। হাতে টাকাপয়সারবস্থা সুবিধের নয়।”
শুনে সে বলে, “তোমাদের জন্য খুব বড় কাজ খুঁজেছি হে! ইন্দোরের এক মস্ত রইস সাহুকার প্রায় লাখ দুয়েক টাকা পাঠাচ্ছে ইন্দোরের দিকে। রোকরিয়া সব ভাড়া করা হয়ে গেছে বলে খবর পেয়েছি। তবে সে টাকা নগদে যাবে না হুন্ডিতে সে খবরটা জোগাড় করতে দিনতিনেক লেগে যাবে আমার। আমি বলি কি, আর একটা বেশি দিন কষ্টেসৃষ্টে অপেক্ষা করে নাও। টাকার খুব দরকার হলে আমিই নয় হাজারখানেক্ল টাকা ধার দিচ্ছি, ঝালোনে পৌঁছে মাসে তিরিশ টাকা হারে সুদসমেত শোধ করে দিও তাহলেই হবে। হাজার হোক ছোটবেলার বন্ধুর ছেলে তুমি!”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না না এক্ষুণি টাকার তত দরকার আমার নেই। দলের সবার কাছে বিশ তিরিশ টাকা করে রয়েছে এখনো। তবে বম্বে যা লোভের জায়গা, এখানে বসে থাকলেই সবার হাত দিয়ে জলের মত টাকা গলে বেরিয়ে যাবে। তাই কাজকর্ম নেই দেখে চলে যাবার কথা ভাবছিলাম। টেনেটুনে চালালে যা আছে তাতে আরও সপ্তাহখানেক আমরা এখানে থেকে যেতে পারবো।”
“অতো সময় লাগবে না। কাল সন্ধেবেলা নামাজের পর একবার এসো তো আমার কাছে, তোমার বুনিজের আরো কিছু খবর জোগাড় করে রাখব’খন।”
শুভান খানের কাছ থেকে সেদিন ফিরে আসতে আসতে খুব রাগ হচ্ছিল আমার। লোকটা একটা চামার। নাহলে ঠগি হয়ে কেউ অন্য ঠগির কাছে সুদ নিতে চায়। ঠিক করলাম বাড়ি গিয়ে বাবার কাছে এর ব্যাপারে আরো খবর নিতে হবে। দেশ ছেড়ে যে পালিয়েছিলো তার পেছনে নিশ্চয় এর অন্য কোন বদমায়েশির ইতিহাস আছে।
লোকটা যে মোটেই সুবিধের নয় সে খবরটা সেদিন এক সরাইখানায় দক্ষিণের এক ঠগি জেমাদারও আমায় বলল। সে-ও তখন বম্বেতে শুভান খানের কাছ থেকে বুনিজের খবর পাবার জন্য অপেক্ষা করছে। বলে, এর মতো ঠগিদের রক্তচোষা লোক আর দুটো হয় না। বুনিজের খবয়াখবর দিয়ে যা টাকা পাবার নিয়ম তার দ্বিগুণ পরিমাণ টাকা আদায় করে ও একেকটা দলের কাছ থেকে। আপত্তি করলেই ধরিয়ে দেবার ভয় দেখায়। ওদিকে আবার বম্বের সব সাহুকারও একে খাতির করে চলে। তাদের কাছে মোটা টাকা নিয়ে লোকটা তাদের চোরাইচালানের কাজে সাহায্য করে। মাঝেমধ্যে তাদের কেউ বিপদে পড়লে মোটা টাকা দক্ষিণা নিয়ে সাহেবের দরবারে তাদের বিপদ আপদ কাটিয়েও দেয়। তবে যতই টাকা নিক ওকে ছাড়া এই এলাকার ঠগিদের কাজকর্ম অচল। শুভান খান যেমন শাঁসালো বুনিজের সন্ধান দেয় তাকে সব দিয়েথুয়েও প্রচুর লাভ থাকে ঠগিদের। তার সাহায্য ছাড়া সেসব খবর জোগাড় করা আর কারো পক্ষে অসম্ভব।
“তার মানে এ লোকটার রোজগার তো রাজাবাদশার মত।”
আমার প্রশ্ন শুনে দক্ষিণের সেই জেমাদার বলে, “তা বেশি বই কম হবে না।”
“লোকটাকে বিশ্বাস করা যায় তো?”
“হ্যাঁ, তা যায়। মাঝেমধ্যে দু একটা উল্টো খবর যে পাই না তা নয়, কিন্তু মোটের ওপর এ আমাদের খেয়ালটেয়াল রাখে। আপদেবিপদে দেখে। গোটা দক্ষিণের সবকটা জেমাদারের খবর ওর হাতের মুঠোয়। ইচ্ছে করলে সাহেবদের বলে একদিনের মধ্যে ঠগিদের গোটা রাজ্যপাটটা ধ্বসিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তাতে ওর কাভের চেয়ে লোকসান বেশি। কাজেই আমাদের ও মারবে না, বাঁচিয়েই রাখবে জানবেন। আমরা তো ওর দাসানুদাস হয়েই করে খাচ্ছি এই এলাকায়।”
পরে পীর খানকে সব কথা খুলে বলে আমি বললাম, “আমার কিন্তু কারো দাসত্ব করবার ইচ্ছে নেই পীর খান। এই প্রথম আর এই শেশ, তারপর এ লোকটার ছায়াটুকুও আর মাড়াচ্ছি না।”
পীর খান মাথা নেড়ে বলল, “ছায়া না মাড়িয়ে যাবেন কোথা মীরসাহেব? সারাটা দেশই তো এই জাতের লোকে ভর্তি। তাদের মধ্যে জমিদার আছে, মুৎসুদ্দি আছে, পুরুত আছে, দোকানদার, সাহুকার, পন্ডিত, কে নেই! আমাদের ঝালোনের মহারাজার কথাই ধরুন না? আমরা তো তাঁর হাতের মুঠোয় থেকেই কাজ করি। তাহলে বাঁচবেন কোথায় গিয়ে? এদের নিয়েই আমাদের চিরকাল চলতে হবে মীরসাহেব।”
তিন দিনের মাথায় শুভান খানের কাছে যেতে সে বলল, “শোনো, সব খবর পাওয়া গেছে। দলটা দু লাখ টাকা নিয়ে রওনা দেবে। তার মধ্যে দশ হাজার টাকার হুন্ডি আর বাকি সবটা সোনা আর দামি পাথর। তবে পুরো খবরটা তোমায় দেবার আগে এসো আমাদের মধ্যে ব্যবসার কথাটা পাকা করে নেয়া যাক।”
আমি মাথা নাড়লাম, “বলুন, আপনার হিস্যা কী নেবেন?”
“দেখো বাবা, তুইমি আমার বন্ধুর ছেলে, তোমার কাছে বেশি আর কী চাইব। অন্যান্য দলের কাছে থেকে মোট রোজগারের তিন ভাগের একভাগ হিস্যা নিই, তুমি ওই গিয়ে পাঁচ ভাগের একভাগই নাহয় দিও। তার মানে বিশ হাজার। কি ঠিক তো?”
আমি বললাম, “আমি রাজি। ঝালোনে পৌঁছেই আমি আপনার নামে বিশ হাজার টাকার হুন্ডি কেটে পাঠিয়ে দেবো।”
শুভান খান খুশি হয়ে বলে, “বাঃ বাঃ, চমৎকার। এই তো সৈনিকের মত সোজাসাপটা কথা। বানিয়ার মত দশ পয়সা নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করা নেই।সোজা কথা সটান বলে দেয়া। বেশ বেশ। খুশি হলাম। এইবারে এসো, কথাটা কাগজে লেখাপড়া করে পাকা করে নেয়া যাক। মানে, লেখাপড়াটা একটা লোকদেখানো ব্যাপার, তবে বুঝলে কিনা, আমি তো আবার একটু নিয়ম মেনে চলা মানুষ। সরকারী কাজ করি তো– ”
লেখাপড়ার ব্যাপারে আমি একটু আপত্তি করতেই দেখি তার মুখটা অন্ধকার হয়ে উঠছে। সেই দেখে তাড়াতাড়ি মত বদলে আমি বললাম, “কাগজকলম আনুন, আমি লেখাপড়া করে দিচ্ছি।”
“অ্যাঁ? বলো কি? লেখাপড়া জানা ঠগি? এ তো ভাবাই যায় না হে। যাক ভালোই হল। লেখার কাজটা তুমি করলে আর তৃতীয় ব্যক্তি কাউকে কিছু বলতে হবে না।”
বলতে বলতে দোয়াত কলম, কাগজ সবকিছু এসে হাজির হল। আমি তাড়াতাড়ি তাতে একটা চুক্তপত্র লিখে তাতে আমার শীলমোহর লাগিয়ে সেটা শুভান খানের হাতে দিতে সে সেটাকে যত্ন করে নিজের পাগড়ির ভাঁজে গুঁজে রেখে বলে, “এইবারে কাজের কথা হোক। পনেরোজন রোকরিয়ার একটা দল টাকাটা নিয়ে রওনা হচ্ছে। সঙ্গে থাকবে দুটো উট। এরা এখান থেকে খানিকটা টাকাপয়সা সঙ্গে নিয়ে পুনা রওনা হয়ে গেছে গতকাল। সেখান থেকে বাকি টাকাপয়সা তুলে নিয়ে পুনা থেকে ইন্দোরের সেনাশিবিরের দিকে যাওয়া সৈনদলের ছদ্মবেশে ছদ্মবেশে এরা রাস্তা চলবে। পথে নাসিক পড়বে। সেখানে তোমার দলবল নিয়ে তুমি এদের সঙ্গ ধরবে। আমার সব খবর একেবারে পাকা। আমি নিজেএদের সাহুকারদের সঙ্গে কথা বলেছি। এই রোকরিয়াদের সঙ্গেও রওনা হবার আগে কথাবার্তা বলে সব খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছি আমি। এরা যাতে তোমাদের সন্দেহ না করে তার জন্য এই কাগজটা তুমি সঙ্গে রাখবে,” বলতে বলতে একটা শিলমোহর লাগানো সরকারি কাগজ সে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “এতে মারাঠি আর ফার্সি ভাষায় তোমার জন্য বম্বের শুল্ক দফতরের ফিরিঙ্গি অফিসারের একটা পরিচয়পত্র আছে। তাতে সে তোমার পরিচয় দিয়েছে বেনারস থেকে বেনারস থেকে আসা সাহুকার হরিদাসের সহকারী হিসেবে। তুমি তার ব্যবসার আদায়পত্র নিয়ে ফিরে চলেছো। পথে কেউ যেন তোমার গায়ে হাত না দেয় সে হুকুম দেয়া আছে এতে। হরিদাসের আসল দলটা এখন বম্বেতেই আছে। বর্ষার পর তারা বম্বে ছাড়বে। ফলে জালিয়াতিটা কেউ ধরে ফেলতে পারবে না। তাদের পাহারাদার দলের নেতা ফতে মামুদ তোমারই বয়সি। চেহারাপইত্রও অনেকটা তোমারই মতন। পরিচয়পত্রে তাই তোমার ওই ফতে মামুদ নামই দেয়া আছে। এই অবধি ছক আমি কষে দিলাম। এবার বাকিটা তোমারে হাতযশ। ভবানীর নাম নিয়ে ভালোয় ভালোয় কাজটা শেষ করো। তারপর ফের এসো এইদিকে। আমি তোমায় আরো বড় কাজ ধরে দেবো।”
“সে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন খানসাহেব। কিছুদিনের মধ্যেই আমি ফের আসছি আপনার কাছে। আর আপনার বিশ হাজার টাকার ব্যাপারেও একেবারে নিশ্চিন্ত থাকুন। ও আপনি পেয়েই গেছেন ধরে নিন।”
“বেশ বেশ। তা পরের বার আসবে যখন, তোমার বাবাকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসো। দেখাসাক্ষাত হয়ে যাবে।”
“সে বোধ হয় আর হবে না। বাবার বয়স হয়েছে। গ্রাম ছেড়ে বিশেষ কোথাও যান না এখন। তব্বে হ্যাঁ, আমি বাবাকে দ্দিয়ে আপনার জন্য চিঠি একখানা লিখিয়ে নিয়ে আসব।”
এই বলে আমি শুভান খানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
পথে বেরিয়ে পীর খান রাগে গরগর করতে করতে বলে, “বিশ হাজার দূরে থাক, বিশটা ফুটো কড়িও দেব না বদমাশটাকে। ” আমিও মনে মনে ঠিক করে নিলাম, বাড়ি ফিরে বাবার সঙ্গে কথা বলে তেমন মনে হলে একে এক পয়সাও হিস্যা দেব না।
পরদিন বম্বে থেকে বের হয়ে দুদিনের মধ্যে আমরা থানে এলাকা পার হয়ে গেলাম। সুভান খানের দেয়া কাগজের টুকরোটার কল্যানে দেখি পথে সরকারি লোকজন খুবই সাহায্য করছে।
ক্রমশ