আগের পর্বগুলো
পত্র ৩৪
গোলমালটা শেষ হয়েছে কি হয়নি, গাজীপুরে নতুন করে এক আরেকপ্রস্থ গোলমালের সূত্রপাত হল। গাজীপুর গোলাপ জলের জন্য বিখ্যাত ছিল। ওখানকার অধিবাসী আর ফৌজদারের মধ্যেই গোলমাল; এনার পদমর্যাদা, রাজা চৈত সিং এর কাছে যেমন ছিল, তেমনই রক্ষিত ছিল। বড়লাট মাপ করে দিয়েছিলেন একে, ফলে তিনি তার কাজকর্মেই বহাল রইল। জনগণের মধ্যে একটা অসন্তোষ ছিল, তাদের প্রাক্তন রাজার পরিণতিকে ঘিরে, ফলে তারা খুব সহজেই ইংরাজের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। আর এদিকে ফৌজদার তার কাজের খাতিরেই যখন খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলেন, সর্বত্র বাধা পেলেন, আর শেষে মানুষের রোষ থেকে অতিকষ্টে পালিয়ে বাঁচলেন।
বিদ্রোহের শুরুতেই তিনি বড়োলাটকে সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য করার কথা লিখেছিলেন, কিন্তু বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। ফলে সহায়তার জন্য ক্যাপ্টেন বেকারকে তার সৈন্যদলসহ রামনগর থেকে পাঠানো হল। গাজীপুরে পৌঁছনোর পরদিন বেলুয়া নামে একটা ছোটো গ্রামের দিকে রওনা দিলাম আমরা, যেখানে বিদ্রোহীরা একটা মাটির দূর্গে একজোট হয়েছিল, বেশ ভালোরকম প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়ে।
এরকম একটা বিশৃঙ্খল দলের কাছ থেকে যেটা অপ্রত্যাশিত, সেটা হল প্রাথমিকভাবে আমাদের মাস্কেটিয়ারদের গুলিচালনা বেশ সাহসের সঙ্গেই প্রতিরোধ করা; কিন্তু যেই আমাদের কামানগুলো এগোতে শুরু করল, কিছু লোক পালাল, তাদের ধাওয়া করে বন্দী করা হল। আর বাকিরা, সেও সংখ্যায় প্রচুর, তাদের প্রতিনিধি পাঠাল ক্যাপ্টেনের কাছে। আক্রমণ থামানোর আর্জি নিয়ে। ক্যাপ্টেন রাজি হলেন এক শর্তে, যে যার ডেরায় ফিরে যাবে, আর জনজীবন একেবারেই বিপর্যস্ত করা যাবে না।
বন্দীদের মধ্যে একজন, ছাড়া পাওয়ার আগে, আমাদের খবর দিল যে কাছাকাছিই, সেনাপতি রামজীবনের অনেক হাতিঘোড়া মজুত রয়েছে, এবং সে আমাদের জায়গাটা দেখিয়ে দিতে পারে; আমাকেই আদেশ করা হল; কয়েকজন সেপাই সঙ্গে নিয়ে তার বলে দেওয়া জায়গায় গিয়ে দেখি কয়েকজন চাষাভুষোর তত্ত্বাবধানে রয়েছে দুটো হাতি, দুটো উট আর বারোটা আরবি ঘোড়া । তারা তো বন্দুকধারী আমাদের দেখেই চম্পট দিল, আমিও শত্রু সম্পত্তি হিসেবে জানোয়ারগুলো বাজেয়াপ্ত করে সেগুলোকে গাজীপুরে নিয়ে চললাম। আমার দল ওখানেই অপেক্ষায় ছিল।
ক্যাপ্টেন বেকার একখানা মাত্র ঘোড়া নিজের ব্যবহারের জন্য রেখে বাকি সমস্ত বাজেয়াপ্ত করা জিনিস সৈন্যদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন, যুদ্ধের পারিতোষিক হিসেবে।
একমাস মতন থাকার পর, ক্যাপ্টেন লেন এসে গেলে আমাদের ওখানকার পাট চুকল আর আমরা জৌনপুরের দিকে চললাম। জৌনপুর সম্বন্ধে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু বলবার নেই, কিন্তু দুর্গটা চমৎকার আর বেশ কিছু ভালো অট্টালিকা আছে। তবে আমাদের শেষ সেনাছাউনি হিসেবে জায়গাটা অসাধারণ; আর হ্যাঁ, এখানকার গোলাপ জল আর গোলাপের তেল সারা এশিয়া মহাদেশে গন্ধদ্রব্যের জন্য নামকরা।
আবার একটা নতুন বখেরায় জড়াতে হল, এবারে উচ্ছৃঙ্খল জনগণকে বাগে আনতে এলাকার বেশ অনেকটা ভেতরে ঢুকতে হল আর যে দুর্গে বিদ্রোহীরা জড়ো হয়েছিল সেটাকে প্রায় দুর্ভেদ্য করে তুলেছিল। তাদের সঙ্গে ছিল তীর ধনুক, ম্যাচলক নামের লম্বা নলের দিশি গাদা বন্দুক। প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলে তারা দুর্গটিকে প্রায় নয় দশদিন দখলে রেখে দিয়েছিল, শেষে রাতের অন্ধকারে পালাতে বাধ্য হয়; পেছনে পড়ে থাকে কয়েকজন মৃত সঙ্গীর দেহ।
এই গন্ডগোলের পর, এলাকা মোটামুটি ঠান্ডা হল, পরের তিনমাস অন্তত আর কোনো ঝামেলা শুনতে পাইনি।
বিদ্রোহীরা আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের ভয়ে আত্মসমর্পণ করত, তবু মনুষ্যত্বের খাতিরে বলতেই হয় সেসব হতভাগ্যের কথা, অযাচিত যুদ্ধ হঠাৎ যাদের চিরতরে মুছে দিল।
হায় রে বিনাশী যুদ্ধ, নির্মম তোর হাত
প্রিয়জন যতো, সকলেরে মুছি, খুলি বন্ধন হাত,
বন্ধুরে করে অশ্রুসজল, প্রিয় যাহা কিছু নিস
সারা পৃথিবীতে মৃত্যুমিছিল একা উপহার দিস।
দোষী নির্দোষ সাহসী ও ভীতু, অপচয়ী সংঘাতে
ডেকে আনে প্রেমী, বন্ধু , অনাথে ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাসে।
মৃত্যুরে শুধু বয়ে আনে তার পাখনার গাঢ় রঙ
ভয়াল কুটিল, বন্য জটিল, কুৎসিত এক সঙ।
অসুখী, হতাশা, মৃত্যু মিছিলে, যুদ্ধের তরবারি
সন্ত্রাসী আর নিষ্ঠুর শুধু রক্তনদীতে পাড়ি
এক লহমায় মুছে দেবে হায় জনপদ হবে ফাঁকা
যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধমিছিলে যুদ্ধই থাকে একা।
জৌনপুরের কাছে একটি চ্যাপেলে মুসলমানধর্মী মানুষজনের আনাগোনা ছিল, যার নীচে বেশ বড়োসড়ো এবং বহুদূরবিস্তৃত একটা সুড়ঙ্গও ছিল। যুদ্ধের সময় কেবল দেশীয়দের আশ্রয় ও দূর্গ হিসেবে এটাকে ব্যবহার করা হত আর এর গুপ্তপ্রবেশপথ কেবল তাদেরই জানা ছিল। এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকাতে আবার শান্তি ফিরে এলে আমরা চুনারগড়ে ফিরে গেলাম।
পত্র ৩৫
চুনারগড়ে ফেরার কয়েকমাস বাদে ক্যাপ্টেন বেকার ইয়োরোপে যাবার মনোবাসনা ব্যক্ত করলেন। তার সঙ্গী হবার জন্য আমিও সুবেদারের চাকরিতে ইস্তফা দিলাম, কেননা ওই ভূখন্ড দেখবার প্রবল ইচ্ছে ছিল আমার, যদিও জানতাম বন্ধু পরিজন ছেড়ে ভয়ানক মনোকষ্টে দিন কাটবে আমার। একটা নৌকোয় চেপে চুনারগড় থেকে ঢাকা হয়ে কলকাতার দিকে রওনা হলাম, গঙ্গানদী বরাবর তা প্রায় তিনশকিলোমিটার। আমাদের যাত্রা খুব আরামের হয়েছিল; একে তো আবহাওয়া চমৎকার, চাষিরাও ফসল কেটে সবে ঘরে তুলেছে। একপাল বলদ কোনো জমিদারের ফসল টেনে টেনে গোলায় নিয়ে যাচ্ছে, এরকম দৃশ্য দেখাও কিছু আশ্চর্যের নয়। নদীর দুপাশে চমৎকার সব জায়গা, নানাধরনের সুন্দর সুন্দর বাড়িঘরদোর, অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য আর নিস্তরঙ্গ গ্রামীন জীবনের ছবি, অবাক করবার পাশাপাশি, নয়নসুখের আনন্দে ভরিয়ে দেবেই।
এমনি যৎপরোনাস্তি সুখকর যাত্রা শেষ করে, ঢাকায় পৌঁছলাম। বাংলার সবচেয়ে বড়ো শহর। গঙ্গার পূর্বদিকের শাখানদীর পাড়ে, চব্বিশ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত। পাঁচমাইল মতো লম্বা, কিন্তু চওড়ায় খুবই কম, আর নদীনালায় পরিপূর্ণ।
ভারতের মধ্যে প্রথম উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে ঢাকা সুপ্রসিদ্ধ, সোনা রূপা ও সিল্কের কাজে সবচেয়ে উৎকর্ষ। এখানকার সুতিরও যথেষ্ট প্রসিদ্ধি আছে, যার মধ্যে মসলিন, ক্যালিকো (বিশেষ ধরণের ছাপা সুতির কাপড়), দিমিতি (উঁচু ডোরাযুক্ত শক্ত সুতিকাপড়) ইত্যাদি তৈরি হয়। অন্যান্য প্রদেশের থেকে যা বহুগুণে ভালো। সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের কাপড় তৈরি হত প্রথমত মুঘল বাদশা, আর জেনানাদের ব্যবহারের জন্য, সর্বোচ্চ কারুকাজ ও উৎকর্ষ কাপড় এবং দামে অন্যান্য দেশীয় বা বিদেশীয় মানুষের কাছে যা বিক্রয় করা হত তার চেয়ে বেশি।
জরির কাজ, বিশেষত, প্রশংসার, কারিগরীদক্ষতা ধাতুর ওপর কাজ করার চাইতেও দামী। এটা এমন নয় যে ফুট করে করে বসানো, এখানকার মতো, বরং সরু সরু করে কেটে এমন সুচারুভাবে জোড়া যে খুব সুক্ষ্মভাবে দেখলেও জোড়ের চিহ্ন পাওয়া যাবে না। এমব্রয়ডারি আর সূচীশিল্পের কমনীয় সৌন্দর্য বর্ণনার অতীত, এবং তুলনায় ওইধরণের ইউরোপীয় যেকোনো জিনিসের চেয়ে বহুগুণে ভালো। কিন্তু আশ্চর্য এই যে এখানে কোনো মহিলা এমব্রয়ডারিকারি অথবা মহিলা সূচীশিল্পি নেই। এইসব ক্ষেত্রে পুরুষেরাই যাবতীয় কাজ করে থাকে, আর তাদের ধৈর্য দেখে চমৎকৃত হতে হয়, ধীরতায় একমেবদ্বিতীয়ম।
সবরকমের জিনিস ঢাকায় পাওয়াও যায় আর সস্তাও। উর্বর মাটি, অবস্থানের সুবিধে, বহুকাল থেকেই ঢাকাকে ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র করে তুলেছে। শক্তিশালী একটি দূর্গের ভগ্নাবশেষ আজও আছে এখানে, আর তার মধ্যে এত ভারী একখানা কামান বসানো হয়েছিল, এই মাত্র কিছুকাল আগেই, সেটা নদীর একদিকের পাড়শুদ্ধ ভেঙে নদীগর্ভে গিয়ে পড়ল; সেপাড়েই কামানটিকে স্থাপন করা হয়েছিল; সেটা দৈর্ঘে চোদ্দ ফুট, সাড়েদশ ইঞ্চি, আর কামানের নলের ভেতরের দিকটা ১ ফুট ৩ ১/৮ ইঞ্চি ব্যাসযুক্ত। এতে রট আয়রনের পরিমাপ ছিল দুশ চৌত্রিশ হাজার চারশ তেরো ঘনফুট। কামানটার ওজন চৌষট্টি হাজার চারশ আঠারো পাউন্ড এবং এর গোলার ওজন চারশ পঁয়ষট্টি পাউন্ড।
এক বড়োসড়ো নবাবের বাস এখানে, পুরোনো রীতি অনুযায়ী, সিংহাসনে বসার সময়, অনেকটা ভেনিসের “ডোজে”দের মতো, নদীর বুকে একদিন বজরায় ঘোরেন; বজরাখানাও দেখার মতো, নাম শ্যামসুন্দর, অদ্ভুতরকম, পৃথিবীতে এমনটা বুঝি আর নেই। বজরাটি রুপো দিয়ে মোড়ানো। ঠিক মাঝখানে একটা রাজকীয় বেদী, রাজ্যাভিষেকের সময় যার ওপর সিংহাসন রাখা হয়। সামনের দিকে চমৎকার একটা রুপোর রেলিংঘেরা বসবার জায়গা, মাথার ওপর ঝলমলে চাঁদোয়া, তাতেও নানারকম সোনারুপোর কাজ করা; আর তার নীচেই মহামান্য নবাববাহাদুর বসেন। এই বজরাখানা, আর সঙ্গে আরো একখানা, নবাবের কাছের লোকই জানাল, মোটামুটি লাখখানেক টাকা দাম। তিনি সবসময় পাত্রমিত্র, গন্যমান্য লোক পরিবৃত হয়েই থাকেন, আর এসব অনুষ্ঠানের সময় টাকা খরচের হিসেবের কোনো সীমাপরিসীমা নেই; পুরোনো রীতিপালনের এই অনুষ্ঠানে জাঁকজমক আর ক্ষমতা দেখানোর ব্যাপারেও কোনো কার্পণ্য নেই। এপথে যে ভ্রমণকারী বা পথিক আসুক না কেন, এই অসামান্য বজরাদুটির কথা শুনে, কৌতূহলেই, দেখতে আসবেনই।