আগের পর্বগুলো
পত্র ৩৬
ঢাকা ছাড়ার আগেই, কৃষ্ণপক্ষ শুরুর প্রথমদিন দুই সন্তের উৎসবপালন শুরু হল; মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের কাছে এনারা হাসান ও হোসেন নামে পরিচিত। উৎসব চলল টানা দশদিন, ভাবগম্ভীর পরিবেশে। প্রথমদিন শহরের নানান জায়গা থেকে দলে দলে লোক শহরের ময়দান মতো এলাকাতে এসে জড়ো হল, যেখানে সাধারণত সভাসমিতি হয়ে থাকে। আটখানা খুঁটির ওপর বিরাট চাঁদোয়া খাটানো; মাঝামাঝি অবস্থানে আরো তিনখানা ভালো কাপড়ে তৈরি রঙবেরঙের তাঁবু; আর একদম ছোটো তাঁবুর মধ্যে একটা রুপোর পাত্রে খানিকটা মাটি রাখা, যা ওই সন্তদের দেহাবশেষের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষেরা এই সময়ে একদিন ব্যাবসা থেকে বিরত থাকেন এবং অধিকাংশত প্রার্থনায় সময় কাটান; ভক্তিমূলক কথা এবং অন্যান্য পবিত্র আচারও পালন করে থাকেন। এর পাশাপাশি ভক্তির নানান বহিঃপ্রকাশ চলতে থাকে, কখনো বুক চাপড়ে, দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে, চোখ অর্ধোন্মিলিত করে, বড়ো বড়ো শ্বাস টেনে, মুখে চাপা ও গভীর আওয়াজ করে নানান ভাবে এই আচরণের প্রকাশ হয়ে থাকে। এই সামাজিক জমায়েতে হিন্দু বা অমুসলমান মানুষদের প্রবেশাধিকার থাকে না। চারপাশে বাঁশের রেলিং দিয়ে এলাকাটা ঘিরে রাখা থাকে, রাতেরবেলায় মশালের আলোয় এলাকাটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আর খুঁটির ডগায় নানা রঙের পতাকা উড়তে থাকে। একদম ছোটো চাঁদোয়াটিতে চারটি বিশেষ রঙ ব্যবহৃত হয়, সোনালি পাড় দিয়ে মোড়া। এর নীচেই রুপোর পাত্রটি রাখা থাকে। সমস্ত মুসলমান মানুষজন এর চারপাশে ভক্তিভরে হাঁটুমুড়ে বসে আর বাদ্য-সংগীত এই ভক্তিভাব আরো বাড়িয়ে তোলে।
নবম দিনে রঙীন কাগজে তৈরি এক অপূর্ব সৌধ বানানো হয়। সম্ভবত মানুষের কল্পনাশক্তির আর কারুকৃতির এক শ্রেষ্ঠ এবং অত্যাশ্চর্য নিদর্শন। অনেকগুলো চূড়া, একটার পর একটা পাশাপাশি বানানো হয়। চূড়াগুলির ওপরের দিকটা ছুঁচোলো। এত রকমের জিনিস দিয়ে সেটাকে সাজানো হয় যে সত্যি প্রশংসার যোগ্য আর তেমনি রুচিবোধ, এককথায় অচিন্ত্যনীয়। আমি বুঝতে পারছি আপনি এর খানিকটা মাত্র আন্দাজ করতে পারবেন, কিন্তু কখনোই এই উঁচুদরের শিল্পকীর্তিটির সৌন্দর্যের পুরোপুরি ধারণা করতে পারবেন না, আর ঠিক সেকারনেই আমার দুঃখ হচ্ছে, কেননা আমার সীমিত ক্ষমতার কারণেই এমন অননুকরণীয় শিল্পসৌকর্যের অনুপুঙ্ক্ষ ও যথাযথ বর্ণনা করতে অপারগ হলাম। শহরের মধ্য দিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে রাত্রিবেলা এটিকে নিয়ে যাওয়া হয়; দুটি পাগড়ি আর রুপোর পাত্রটিকে রাখা হয় চার নম্বর চূড়াটির সামনের খোলা অংশটায়। সামনে হাজার হাজার জনতা সাষ্টাঙ্গে ভক্তিনিবেদন করছে, আশেপাশে জড়ো হওয়া অসংখ্য গরীব মানুষদের দানধ্যান করছে। তারও পেছনে আরো অনেক মানুষ, মশাল হাতে, পতাকা হাতে, নানা বাদ্যযন্ত্রের গভীর সুরে সমস্ত পরিবেশকে ভরিয়ে তুলেছে। দশমদিনে এই কাগজের নির্মানটি, স্থানীয় ভাষায় যার নাম গৌরাহ , কবরখানায় নিয়ে গিয়ে সেখানে কোনো পুকুরে বা অন্য জলাশয়ে ভাসিয়ে দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি করা হয়।
মুসলমান ধর্মের মানুষেরা, বছরে একবার, এই রমজান মাসে তাদের প্রিয় কোনো একটি খাদ্য বা বস্তু ত্যাগ করে অর্থাৎ বত্রিশ দিন ধরে তা গ্রহণ করে না। এসময়ে তারা বিছানাতে শয়ন করেন না, স্ত্রীর সাথে থাকেন না এবং নিরামিষ খান; এমনকি প্রিয় পান তামাকও বর্জন করে থাকেন। এসময়ে তারা সবরকম বিনোদনই এড়িয়ে চলেন, প্রার্থনাতেই বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেন, আর দান ধ্যানের ব্যাপারটা তো আছেই। এমনকী এতটাই নীতিনিষ্ঠ, যে প্রচন্ড তৃষ্ণার সময়েও সন্ধ্যা সাতটা অবধি একবিন্দু জলপান করেন না। ধর্মীয় অনুশাসনের এমন কঠোর পালন বিষয়ে আমি এবারে একটা গল্প শোনাব।
একজন সম্পন্ন বস্ত্র ব্যবসায়ী ইংরেজ জাহাজে চেপে একবার বম্বে থেকে সুরাট যাচ্ছিলেন। সঙ্গে নিয়েছিলেন নিজের ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত জল; সাধারনত দু তিনদিন মতো সময় লাগত যেতে। যাই হোক, যা ঘটল তা হল, হাওয়া আর ঢেউয়ের প্রতিকূলতায় দেরি হল পৌঁছতে, আর নিজস্ব রসদের জল গেল ফুরিয়ে; তেষ্টায় মারা যাবার উপক্রম, যদিও জাহাজে যথেষ্ট পানীয় জল মজুদ ছিল। কিন্তু শত অনুরোধ উপরোধেও তিনি একবিন্দু জলও গ্রহণ করলেন না, কারণ তা ধর্মে নিষেধ। ধর্মের এহেন নিষেধ তার কাছে প্রাণের চেয়েও অধিক ছিল। নিদারুণ তেষ্টার যাতনা সয়ে তিনি মরেই যেতেন, যদি না পালে বাতাস পেয়ে সুরাটের কাছে গান্ডেভিতে এসে জাহাজ ভিড়ত। ততক্ষণে লোকটির অবস্থা শোচনীয়, প্রাণটা গলার কাছে এসে ঠেকেছে প্রায়।
পত্র ৩৭
কিছুদিন ঢাকায় কাটিয়ে আমরা কলকাতার দিকে যাত্রা করলাম। আর ঠিক দুদিনের মাথায় সুন্দরবনের মুখে এসে পৌঁছলাম। নদী এখানে অত্যন্ত সরু এবং অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় ভেঙেছে। নতুন নতুন দৃশ্য সত্যিই নয়নমনোহর। দুপাশের জমিগুলো নিচু আর বড়ো বড়ো গাছে ঢাকা, একেবারে জলের কিনার অবধি। টলটলে স্বচ্ছ আয়নার মতো জল, আমরা যেতে যেতে দেখলাম, দুপারের দীর্ঘ গাছগুলির ছায়া পড়েছে জলে। সৃষ্টি যেন বিশ্রামে আছে এখানে, চারপাশের নিস্তব্ধতায় কোনো ব্যাঘাত নেই, কেবল মাঝে মধ্যে আশেপাশের জঙ্গলে বন্য জন্তুর ডাক ছাড়া। দৃশ্যটা সত্যিই অসাধারণ, আলাদা কোনো শিল্পকীর্তি ছাড়াই নিজে নিজেই নিষ্কলুষ ও মহান। দুপারে যেসব গাছগুলো রয়েছে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, চন্দন, পেয়ারা এবং শিশু। জঙ্গলে নানা ধরনের হিংস্র পশুর অভাব নেই, অসতর্ক ভ্রমণকারীকে যারা অহরহই আক্রমণ করে; বিশেষত বাঘ, নদীর কিনারে জলের ধার পর্যন্ত নেমে এসে লাফ দিয়ে যাতায়াতের নৌকোয় উঠে মানুষ শিকার করে। নদীর পাড় বরাবর দশ বারো মাইল পরপর গ্রাম, আমরা সেখানে কোনো কোনো জায়গা থেকে নতুন খাদ্য-রসদ সংগ্রহ করলাম। সেখানকার কুঁড়েঘরগুলিতে কোনো বিশেষ কারুকাজ নেই, বাঁশের খাঁচার ওপরে গাছের চওড়া সবুজ পাতায় ছাওয়া ঘর মাত্র। যাতে বন্যার জল ঢুকে এলে, লোকেরা সহজেই নিজেদের মালপত্র গুটিয়ে, কুটিরের বেড়া, ছাদ-সহ গুটিয়ে বান্ডিল করে সুবিধেমতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে গিয়ে বিপদমুক্ত হতে পারে। আবার সেখানে নতুন করে বাসা বাঁধার সুবিধে দেখে নেয়। এখানকার অধিবাসীরা একেবারে প্রাকৃতিক পরিবেশে, ভিড়-ভারাক্কা, হৈ চৈ থেকে যথেষ্ট দূরে বসবাস করে; এদের চাহিদা অল্প, সহজেই সন্তুষ্ট; অত্যন্ত সহজ সরল তাদের ব্যবহার; এর কারণ তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রা এবং বড়ো বড়ো গঞ্জ বা শহরের দূরত্ব। শহরে, বিশেষত প্রাচুর্য ও বেহিসেবি খরচের নীচে চাপা পরে থাকে কুকীর্তি, শয়তানের গোলামি করে ভ্রষ্ট মানুষেরা।
গ্রামগুলির মাঝে ছড়ানো ছেটানো কিছু একক বাড়িও দেখলাম, ইয়োরোপীয় অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষদের অস্থায়ী বসবাসের জন্য। মূলত তাদের পাঠানো হয়েছিল কাঠ সংগ্রহ করে বাংলার নানান অঞ্চলে জাহাজ তৈরি ও অন্যান্য কাজে সরবরাহের জন্য।
১৭৮৩ সালের জানুয়ারিতে কলকাতায় পৌঁছলাম। সম্পদ ও বাণিজ্যের সম্ভার এখানে এবং এখানকার বিশিষ্ট লোকেদের কেতাদূরস্ত প্রকাশ ইউরোপের যেকোনো সম্ভ্রান্ত বৃত্ত থেকে কয়েক কদম এগিয়ে। প্রত্যেক ভদ্রজন অন্তত বিশজন ভৃত্য সঙ্গে রাখেন, যাদের মধ্যে আটজন বেহারা, পালা করে পালকি বহন করে, দুজন হাঁকারদার, পালকির আগে আগে চলে, তিন চারজন খাস চাকর, তাদের একজন পরিবেশক, একজন বাবুর্চি আর আরেকজন খিদমতগার। এছাড়া আরো সাত আটজন, তাদের কাজগুলো মোটামুটি এরকম – ‘হুকাবরদার’, যার মূল কাজই হল কল্কেতে তামাক সেজে হুঁকো প্রস্তুত করে দেয়া, একজন ‘আবদার’, বাবুর পান করার জল ঠান্ডা রাখা, দুতিনজন ‘সহিস’, যারা ঘোড়ার তদারকি করে, একজন ‘ঘাসুড়ে’, ঘাস কাটার জন্য, আর মশাল বহন করার জন্য তিনচারজন, ‘মশালচি’।
আরো রইস মানুষজনের ক্ষেত্রে ভৃত্যের সংখ্যা আরো কিছু বেশি। আগে দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী চাকরদের লেজটা আরেকটু বাড়বে, নকিব বা ঘোষক, সুমুখের রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে যাওয়া যার কাজ; চৌকিদার, যার হাতে থাকে বড়ো রুপোর দন্ড আর ‘সোঁটাবরদার’, ছোটো রুপোর ছড়ি হাতে এবং এছাড়া পেয়াদা, চিঠিপত্রবাহক হিসেবে।
এসব উঁচুমহলের মানুষেরা, যারা রৌদ্রময় জীবনের চূড়ায় বসে থাকেন, খ্যাতির শিখর থেকে নীচে তাকিয়ে দ্বিতীয় সারির মানুষদের দেখেন খুবই তাচ্ছিল্যভরে, যেন তাদের সম্মান পাবার যথেষ্ট যোগ্যতাই নেই, যেন এই মানুষেরা নির্বিশেষে শুধুমাত্রই অতি সাধারণ জীবন ধারণেরই উপযুক্ত। কখনো এই মনিবেরা তাদের নিচুতলার লোকেদের সাথে এতটাই তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞাভরে ব্যবহার করেন যে কারো কারো আহত আত্মসম্মান প্রকট হয়ে সুখসমৃদ্ধির দুধে দৃশ্যত একফোঁটা চোনা ফেলে দেয়।
আমি প্রায়ই দেখেছি, একজন সরকার অর্থাৎ কেরানিবাবুর মাথার ওপরে দিনের বেলা ছাতা ধরে আছে এক ভৃত্য, বাবুটিকে রোদ থেকে আড়াল করার জন্য আবার রাতে এক বা দুজন মশালবাহক সামনে সামনে চলেছে আলো দেখিয়ে।
পদস্থ সব লোকেরই একজন করে দারোয়ান রয়েছে, যে আগন্তুকের উপস্থিতি ঘোষণা করবে, বেশ উঁচু গলায়, চিৎকার করে, যেটা ভদ্রমহোদয়ের ভেতরের বাড়িতে অন্য একজন চাকর শুনে নিয়ে বাড়িতে ঢোকার মুখে সিঁড়ির নীচ থেকে চেঁচিয়ে একই কথা জানান দেবে। এমনি একাধিক হাঁকার মারফৎ অবশেষে সরাসরি জমিদারের কানে অথবা মূল হাঁকারদারের কানে পৌঁছবে যিনি জমিদারকে তার বৈঠকখানাঘরে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ দেবেন। এতে করে জমিদার তার অভ্যাগতের আপ্যায়নে প্রস্তুত হতে পারবেন!
শহরের বেশ কিছু অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করার ফলে, রাস্তা সারাইয়ের জন্য নিযুক্ত বেশ কিছু লোককে দেখেছি, পায়ে বড়ো কাঠের গুঁড়ি বাঁধা, সামান্য অপরাধের আইনানুগ শাস্তি হিসেবে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ছোটো অপরাধের জন্য মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়, যাতে তারা লোকের কাছে সহজেই হেয় প্রতিপন্ন হয়। বিবাহসংক্রান্ত অপরাধে গাধার পিঠে চড়িয়ে মাথার দুপাশে কাঁটার মতো কিছু বেঁধে দেওয়া হয় যাতে সহজেই লোকে দেখলেই বুঝতে পারে। এসব উদাহরণ, প্রকৃতপক্ষে, বুনো হাঁসের মতো, ক্কচিৎ দেখা যায় এশিয়া মহাদেশে, যেখানে বৈবাহিক সম্পর্কে বিশ্বাসভঙ্গতা খুবই ঘৃণ্য নজরে দেখা হয় এবং এর সঙ্গে জড়িত থাকা মানুষগুলোকে শুধু যে একঘরেই করা হয় তা নয়, তাদের সমাজের সমস্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়।