কন-টিকি অভিযান-আগের পর্বগুলো
আগের কথা
অভিযাত্রী ক্লাব থেকে বেশ কিছু নতুন অথচ কাজের জিনিস পাওয়ার আশ্বাস পাওয়া গেল। পরদিন ঝাজিদের ঠেকে থর এর সাথে আলাপ হল হারম্যান এর। রেফ্রিজারেটর বিশেষজ্ঞ। খুব দ্রুত দলে ভিড়ে গেল হারম্যন। এবারে দুজনে একত্রে কাজ শুরু করল। বিখ্যাত অভিযাত্রী ফ্রাউসেন এর কল্যাণে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান প্রেসে ফলাও করে প্রচার হল ওদের সমুদ্র অভিযান। ফলে একটা স্পনসর জোটার সম্ভাবনা তৈরী হল। এবারে যন্ত্রপাতি আর লোকলস্কর নিয়ে ভাবলেই হবে। টাকা পয়সার ভাবনা অন্য লোকের। একে একে টরস্টাইন, এরিক আর ন্যুট জুটে গেল। প্রস্তুতি পূর্ণ উদ্যমে চলছে, এরই মধ্যে বিয়র্ন ওয়াশিংটন থেকে ফোন করল। পরদিনই দুজন ছুটল সামরিক দপ্তরে।
বিয়র্নকে সামরিক দূতের অফিসে ওর ঘরেই পেয়ে গেলাম।
“আমার মনে হয় সব ঠিকই আছে,” ও জানাল, “কর্নেলের কাছ থেকে যথাযথ সুপারিশ পাওয়া গেলে আমরা আগামীকালই বিদেশ-মৈত্রী বিভাগে যেতে পারি!”
কর্নেল হলেন অটো মুনতে কস, নরওয়ের সামরিক রাষ্ট্রদূত। ভদ্রলোক যথেষ্ট ভদ্র; উনি যখন আমাদের উদ্দেশ্যটা শুনলেন, বেশ আগ্রহের সাথেই রাজি হয়ে গেলেন সুপারিশ করে একটা চিঠি লিখে দিতে।
পরদিন সকালে চিঠিটা আনতে গেছি, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন যে ওঁর মনে হচ্ছে আমাদের সঙ্গে উনিও গেলে বেশি ভালো হবে। সুতরাং কর্নেলের গাড়ি চেপেই পেন্টাগনে সামরিক দপ্তরে গেলাম। সামনের সিটে কর্নেল আর বিয়র্ন; তাদের সামরিক পোশাকে দুরস্ত লাগছিল; আর আমরা, হারম্যান আর আমি পেছনের সিটে বসে কাচের ভেতর দিয়ে পেন্টাগনের বিশাল বাড়িটা দেখছিলাম। তিরিশ হাজার কেরানি আর ষোল মাইল করিডোরের এই বিশাল বাড়িটা শেষমেষ আমাদের অভিযানের বিষয়ে সামরিক উচ্চপদস্থ অফিসারদের সঙ্গে কথা বলার মঞ্চ হল! সত্যি বলছি, অভিযানের আগেও না, পরেও না, আমাদের ভেলাটাকে কখোনো এতটা অসহায় আর এট্টোটুকু লাগেনি কখনো।
এধার ওধার এই করিডোর ওই করিডোর ঘুরতে ঘুরতে শেষে বিদেশ মৈত্রী দপ্তরের দোরগোড়ায় পৌঁছোলাম। চারধারে ঝকঝকে উর্দিধারীরা। একটা বড়ো মেহগনি কাঠের টেবিলের চারধারে বসলাম। দপ্তরের প্রধান যিনি, তিনিই মিটিং এর সভাপতিত্ব করলেন।
সেনা অ্যাকাডেমির কর্তাটি চেহারায় বেশ লম্বা চওড়া। টেবিলের একপ্রান্ত প্রায় জুড়েই বসেছিলেন; উনি তো প্রথমে আমাদের ভেলা-অভিযানের সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধ বিভাগের কী সম্পর্ক তা বুঝেই উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু কর্নেলের সুচিন্তিত বক্তব্য আর অন্যান্য অফিসাররা যারা বসেছিলেন টেবিলের চারপাশে, তদের চটপট উত্তরে আর ওয়াকিবহাল মন্তব্যে আমাদের কাজটা সোজা হয়ে গেল, বা বলা যায়, উনি আমাদের খানিকটা পাত্তা দিতে শুরু করলেন, এবং যন্ত্রপাতি বিভাগ থেকে আসা বিমানসামগ্রী আধিকারিকের চিঠিটায় মনোযোগ দিলেন। পড়া শেষ করে ভদ্রলোক তার অফিসারদের খুব সংক্ষিপ্ত আদেশে জানালেন যাতে সাহায্য করা হয়। আমাদের শুভেচ্ছা জানালেন। এবং গটগট করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
দরজা বন্ধ হবার প্রায় সংগে সংগে এক যুবক, পদমর্যাদায় ওঁর ঠিক পরেই, ফিসফিস করে আমার কানের গোড়ায় বললেন, “বাজি ফেলছি, যা দরকার আপনি তাইই পাবেন। এক্কেবারে ছোটখাটো সৈন্য অভিযানের মতো লাগছে। আমাদের নিস্তরঙ্গ শান্ত অফিস আবহাওয়ায় খানিকটা পরিবর্তন তো বটেই! তাছাড়া এটা আমাদের নানান সামগ্রী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার একটা দারুণ সুযোগ।”
যোগাযোগকারী অফিসারটি কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল এর গবেষণাগারে আমাদের সংগে মিস্টার লুইসের একটা সাক্ষাৎকারের দ্রুত বন্দোবস্ত করে ফেললেন। আর প্রায় সাথে সাথেই আমাকে আর হারম্যানকে সেখানে গাড়িতে করে নিয়ে চললেন।
মরিস দুর্দান্ত লোক, মস্তো সেনা অফিসার, বন্ধুর মতো, খেলোয়ারসুলভ। তিনি তক্ষুণি গবেষণগারের নানান বিভাগে দায়িত্বে থাকা লোকেদের ডেকে পাঠালেন। সক্কলে খুশিমনে তাঁদের নিজের নিজের সামগ্রীর পরিমাণ বাতলে দিলেন, যেগুলো তাঁরা আমাদের মাধ্যমে পরীক্ষা করাতে চান। আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি অথচ যা যা চাইতে পারি এমন সমস্ত জিনিসই আমাদের চাহিদার কয়েক গুণ পরিমাণ গড়গড় করে আমাদের সামনে বলে যাওয়া হল। ফিল্ড রেশন থেকে শুরু করে, সানবার্ন লোশন থেকে জলনিরোধক স্লিপিং ব্যাগ অবধি।
এবারে সমস্ত জিনিসগুলো সরেজমিনে দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হল। ফিল্ড রেশন চেখে দেখলাম দুজনে; দেশলাই জ্বেলে দেখলাম, ভিজে অবস্থাতেও দিব্যি সে কাঠি জ্বলল। নতুন প্রাইমাস স্টোভ, জল রাখার পিপে, রাবারের ব্যাগ, বিশেষ ধরণের জুতো, রান্নার বাসনপত্র ও ছুরি যেগুলো জলে ভাসতে পারে এবং একটা অভিযানে লাগার মতো আরো আরো নানান জিনিসপত্র।
হারম্যানের দিকে তাকালাম। ওর অবস্থাটা জুলজুলে চোখের সেই সরল বাচ্চাটার মতো যে কিনা, মনে করা যাক, খুব ধনী পিসিমার সাথে চকলেটের দোকানে এসেছে! কর্নেল আমাদের সমস্ত জিনিস দেখাতে দেখাতে চললেন, আর ঘুরে দেখার মধ্যেই সঙ্গী সহায়ক অফিসারটি একটা তালিকা করে ফেললেন, যাতে লেখা রইল আমাদের কী কী জিনিস কতটা করে লাগবে। মনে হচ্ছিল অর্ধেক যুদ্ধ জয় হয়ে গেছে, মনে হচ্ছিল আমার হোটেলের ঘরটায় ছুট্টে ফিরে গিয়ে নিরিবিলিতে টান টান হয়ে শুয়ে সত্যি সত্যি কী হচ্ছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করি। অমনি, তখনই, দীর্ঘদেহী বন্ধু কর্নেল বলে উঠলেন, “তাহলে চলো এবার বস এর সঙ্গে কথা সেরে নিই, কেন না তিনিই একমাত্র এসব জিনিস তোমাদের দেবার অনুমতি দিতে পারেন।”
আমার প্রায় মাটিতে পড়ে যাবার জোগাড় হল। তার মানে আবার সেই বক্তিমে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে! আর ভগবানই জানেন এই বস লোকটি আদতে কেমন।
দেখলাম বস লোকটি ছোট্টোখাট্টো, রাশভারী আর গম্ভীর। লেখার টেবিলে বসেছিলেন। আমরা ঘরে ঢুকতেই তার গভীর নীল চোখ দুটো দিয়ে আমাদের জরিপ করে নিয়ে বসতে বললেন।
“বেশ, কী চান এই ভদ্রলোকেরা?” প্রশ্নটা করা হল সরাসরি কর্নেল লুইসকে অথচ চোখ আমার উপর থেকে সরল না।
“ইয়ে, সামান্য কয়েকটা জিনিস,” কর্নেল লুইস তড়িঘড়ি মুখ খোলেন। তারপর আমাদের গল্পটা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন, আর গোটা সময়টা বস লোকটা একচুল না নড়ে চুপ করে শুনলেন।
“আর বদলে কী দেবেন ওরা?” কথা শেষে, জিজ্ঞাসা করলেন ভদ্রলোক; স্পষ্টত এসব অভিযানের কাহিনির ছিঁটেফোঁটাও প্রভাব পড়েনি ওঁর ওপর।
“হ্যাঁ, ঠিকই,” কর্নেল বললেন, বেশ সাফাইয়ের মতো করে, “মানে ওরা আমাদের একটা রিপোর্ট দিতে পারেন এইসব নতুন খাবারদাবার আর যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও গুণমান বিষয়ে। এ অভিযানে ওরা তো বেশ প্রতিকূল অবস্থাতেই ওগুলো ব্যবহার করবেন, তাই…”
রাশভারী, গম্ভীর ভদ্রলোকটি নিজের লেখার টেবিলের পেছনের চেয়ারটাতে খুব ধীরে ধীরে পেছনদিকে হেলে বসলেন। চোখ কিন্তু আমার ওপর থেকে একটুও সরেনি। লোকটি যখন শান্ত ভাবে মুখ খুললেন, আমি ক্রমশ চেয়ারের অতলে ডুবে যেতে থাকলাম, “আমি তো দেখতে পাচ্ছি না ওঁরা আমাদের এর বদলে সত্যিই কিছু দিতে পারবেন।” ঘরে শ্মশানের নীরবতা। কর্নেল লুইস তার কলারটা ঠিক করলেন; আমাদের কেউই মুখ থেকে টুঁ শব্দটি করল না।
“তবে,” বড়োসায়েব হঠাৎ করে বলে উঠলেন, এবারে তার চোখে হালকা হাসির ঝিলিক, “সাহস আর প্রত্যয় খুব বড়ো জিনিসও বটে। কর্নেল লুইস আপনি ওদের জিনিসগুলো দিয়ে দিন।”
হোটেলের ঘরে ফেরার গাড়িটায় আমি ভেবলে বসে ছিলাম, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে, আনন্দে। এদিকে হারম্যান আমার পাশে বসে আপনমনে হেসেই চলেছে।
“বেহেড হলে নাকি?” ওকে জিজ্ঞাসা করলাম।
“নাহ” বলে নির্লজ্জের মতো হাসতে থাকল, বলল, “খাবার দাবারের মধ্যে, দেখেছ, ৬৮৪ বাক্স আনারস। ওটা আবার আমার সবচে প্রিয়।”
হাজারটা কাজ বাকি রয়েছে। আর এদিকে সময় নেই। ছটা লোক, কাঠের ভেলা, তার যাবতীয় মালপত্র পেরুর সৈকতে এনে জড়ো করতে হবে। তিনমাস মাত্র সময়, হাতে কোনো আলাদিনের প্রদীপও নেই। নিউ ইয়র্ক গেলাম। লিয়াজঁ অফিস থেকে আগেই যোগাযোগ করে রাখা ছিল। আমরা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেহরের সাথে দেখা করলাম। সামরিক দপ্তরের ভৌগোলিক গবেষণাদলে তিনিই ছিলেন প্রধান। ইনিই শেষ হাসিটা হাসলেন আরকি, আর আমাদের হারম্যান গিয়ে দামী দামী যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে এল, যাতে অভিযানের সময়ে বৈজ্ঞানিক পরিমাপগুলো সঠিক হয়।
এরপর গেলাম ওয়াশিংটন। অ্যাডমিরাল গ্লোভারের সাথে দেখা করতে। নৌবাহিনীর জলসম্পদ সংস্থায়। বুড়ো, মানুষ ভালো, দক্ষ নাবিক। তিনি তার সব অফিসারকে ডেকে পাঠালেন এবং আমার আর হারম্যানের পরিচয় দিয়ে, দেয়ালে ঝোলানো প্রশান্ত মহাসাগরের চার্টটা দেখিয়ে বললেন, “এই ভদ্রমহোদয়েরা আমাদের তৈরি সাম্প্রতিক মানচিত্র দেখেশুনে নিতে চান। ওদের সাহায্য কর।”
আমাদের অভিযানের গাড়ি গড়গড় করে দৌড়োচ্ছিল। ইংরেজ, কর্নেল লামসডেন, ওয়াশিংটনের ব্রিটিশ মিলিটারি মিশন-এ সভা ডেকে বসলেন। বিষয়, আগামী অভিযানের সমস্যা আর তার সম্ভাব্য সুষ্ঠু সমাধান। বহু ভালো ভালো পরামর্শ পেলাম আমরা, তার সাথে ইংল্যান্ড থেকে আনানো বেশ কিছু ব্রিটিশ যন্ত্রপাতি, যা আমরা অভিযানের কাজে লাগাব। ব্রিটিশ মেডিক্যাল অফিসারটি বিশেষ একটা গুঁড়োর কথা বারে বারে বলছিলেন। অদ্ভুত রকম; হাঙরদের জন্য তৈরি। কোনো হাঙর একটু বেশি নাছোড়বান্দা হলে, আমাদের স্রেফ একটু গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে হবে জলে, ব্যস হাঙরবাবাজি গায়েব হয়ে যাবে।
“মশায়,” আমি বলি, “ইয়ে, আমরা কি এই গুঁড়োটার ওপর নির্ভর করতে পারি?”
“হুঁ,” ইংরেজ ভদ্রলোকটি মুচকি হাসলেন, “সেটাই তো আমরা দেখতে চাইছি!”
সময় যখন কম, আর ট্রেনের বদলে প্লেন, হাঁটার বদলে ট্যাক্সি এসব হলেই পকেটের হাল চুপসে ঝরাপাতার ঝোলা হয়ে ওঠে! শেষ অবধি আমার নরওয়ে ফেরার টিকিটের টাকাও যখন খরচা হয়ে গেল, আমরা নিউ ইয়র্কে আমাদের বন্ধু আর পৃষ্ঠপোষকদের কাছে গেলাম সাহায্যের জন্য। সেখানে গিয়ে তো অবাক, সে আবার এক উলটো সমস্যা! আমাদের অর্থসচিব জ্বরে পড়ে বিছানায় আর তার দুই সহকারী ঠুঁটো জগন্নাথ, ওঁকে ছাড়া কিছু করার ক্ষমতা তাদের নেই। অর্থসাহায্য নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল তা থেকে তারা সরে আসেননি বটে, কিন্তু তক্ষুনি তাদের কিচ্ছু করারও ছিল না। আমাদের বলা হল কাজকর্ম একটু পিছিয়ে দিতে;
একান্তই অবাস্তব একটা প্রস্তাব, বিশেষ করে, সেই মুহূর্তে। ততদিনে জল গড়াতে শুরু করেছে, চাকা ঘুরছে, আর তা থামিয়ে দেবার সাধ্য আমাদের আর নেই। আমরা খালি শক্ত করে হাল ধরে আছি এইই। বন্ধ করা বা থামিয়ে দেওয়া একান্তই অসম্ভব। বন্ধুরা তখন বলল, চুক্তিটা বাতিল করে, সংস্থাটাকে বন্ধ করলে আমরা নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে চটপট কাজ করতে পারব।
সুতরাং, পকেটে হাত। আমরা রাস্তায়।
“ডিসেম্বর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি” হারম্যান বিড়বিড় করে বলল।
“আর মার্চের কটা দিন” আমি বলি, “কিন্তু, যাইই হোক আমাদের শুরু করে দিতেই হবে।”
বাকী সবকিছু ধোঁয়াশায় থাকলেও একটা বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার ছিল, আমাদের অভিযানের একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে আর সেটাকে, ওই কাঠের পিপেয় নায়াগ্রায় ঝাঁপ দেয়া কিম্বা সতেরোদিন টানা মাস্তুলের ডগায় বসে থাকা অন্যান্য বাজীকরদের কাজকর্মের সাথে লোকে গুলিয়ে ফেলুক তা আমরা মোটেই চাইছিলাম না।
“সস্তা পিঠ চাপড়ানি মার্কা ব্যাপার চাই না।” হারম্যান বলল।
এবিষয়ে আমরা গভীরভাবে সহমত ছিলাম।
নরওয়ের মুদ্রা পেতে পারতাম, কিন্তু আটলান্টিকের এপারে তা দিয়ে আমাদের কাজ সমাধা হত না। কোন সংস্থা থেকে অনুদান চাইতেই পারতাম, কিন্তু আমাদের বিতর্কিত তত্ত্ব নিয়ে সেটা খুবই মুশকিলের ছিল, কারণ ওই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই ভেলা-অভিযান করছি কিনা! দ্রুত বুঝে গেলাম, না কোনো খবরের কম্পানি, অথবা ব্যক্তিগত উদ্যোগী কেউ, এমন কিছুতে টাকা ঢালতে রাজি নয় যে অভিযানটাকে তারা অথবা বীমা কম্পানিগুলো স্রেফ আত্মহত্মার নামান্তর মনে করে! কিন্তু যদি “সহি-সালামত” ফিরে আসি, তখন অন্য কথা।
ব্যাপারটা বেশ খানিকটা হতাশাব্যঞ্জকই লাগছিল, আর বহুদিন কোনো আশার আলোও দেখা যাচ্ছিল না। এমন সময় কর্নেল মুনতে কস এসে উদয় হলেন।
“ওহে ছেলেরা,আটকে গেছ দেখছি, বললেন ভদ্রলোক, “এই নাও চেকখানা ধরো, দক্ষিণ সাগরের দ্বীপ থেকে যখন ফিরে আসবে তখন ফেরত দিতে পারো।”
তার দেখাদেখি আরো কয়েকজন আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। ফলে আমার ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ যথেষ্ট ফুলেফেঁপে উঠল কোনো এজেন্ট বা অন্যান্য লোকেদের সাহায্য ছাড়াই। এবার আমরা দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়ে ভেলা বানানো শুরু করতেই পারি।
পুরোনো পেরুর বাসিন্দাদের ভেলাগুলো বানানো হত বালসা কাঠের। শুকনো অবস্থায় সেগুলো শোলার চেয়ে হাল্কা। বালসা গাছগুলো জন্মায় পেরুতে, তাও আন্দিজ পর্বতমালা পেরিয়ে। ফলে ইনকাদের সময়কার সমুদ্রযাত্রাকারীরা, সমুদ্রতীর বরাবর ইকুয়েডর অবধি গিয়ে সেখানে বড়ো বড়ো বালসা কাঠের গুঁড়ি কেটে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরেই জড়ো করত। আমরাও ঠিক সেটাই করতে চাই।
এখনকার দিনের যাতায়াতের সমস্যা ইনকাদের সময়ের যাতায়াতের সমস্যার থেকে অনেকটাই আলাদা। আমাদের গাড়ি রয়েছে, উড়োজাহাজ রয়েছে, ভ্রমণ সংস্থা রয়েছে। আবার সব মিলিয়ে ব্যাপারখানা ততও সহজ নয়, সীমান্তের বাধা যেমন, বোতামআঁটা প্রহরী; তার কারো ওপর সন্দেহ হতে পারে, মালপত্র ফর্দাফাঁই করে দিতে পারে, এমনকি স্ট্যাম্প-পত্তর মারা কাগজে কাগজে বোঝাই হয়ে উঠবে, অবশ্য আদৌ যদি ঢুকতে পারো। এই বোতামআঁটা লোকগুলোর কারণেই আমরা জানতাম আমরা কখনোই প্যাকিং বাক্স, ট্রাঙ্ক ঠাসা অদ্ভুত জিনিসপত্র নিয়ে ওদেশে ঢুকতে পারব না; হয়তো ঢুকলাম আর ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশে আলতো করে টুপি উঠিয়ে বললাম যে আমরা এসেছি, আমাদের ঢুকতে দিন, আমরা ভেলায় চড়ে এখান থেকে সাগরপাড়ি দেব! অমনি সোজা জেলে ভরে দেবে!
“নাহ,” হারম্যান বলে “আমাদের একটা সরকারি পরিচিতি থাকা উচিত।”
জাতিপুঞ্জের বিদায়ী সভায় আমার এক বন্ধু, জাতিসঙ্ঘের মুখপাত্র ছিল। সে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এল। বলল, তার গাড়ি নিয়ে আসবে। ইউএনওতে অ্যাসেম্বলির বড়ো হলঘরে ঢুকে সত্যিই তাক লেগে গেল, সারা পৃথিবীর সকল দেশের মানুষ বেঞ্চের ওপর পাশাপাশি বসে চুপ করে এক কালো চুলের রাশিয়ানের কথা শুনছে, পেছনের কালো দেয়ালে গোটা পৃথিবীর এক প্রকান্ড মানচিত্র। আমাদের সাংবাদিক বন্ধুটি নিঃশব্দে ওরই মধ্যে প্রথমে পেরুর একজন তারপর ইকুয়েডরের একজন প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ সেরে ফেলল।
পাশের অ্যান্টিচেম্বারে চামড়াআঁটা নরম সোফায় বসে দুজনেই খুব আগ্রহের সাথে আমাদের পরিকল্পনাটা শুনল। আমরা সমুদ্র পার করতে চাইছি, শুধু এই প্রমাণ করার জন্য যে তাদেরই পূর্বপুরুষরাই সর্বপ্রথম সাগর পাড়ি দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে পৌঁছেছিল। দুজনেই নিশ্চিত করল যে অবশ্যই সরকারের কাছে এ প্রসঙ্গ তারা জানাবে এবং কথা দিল, আমরা গেলেই, দুজনেই তাদের নিজের নিজের দেশে যারপরনাই সাহায্য করবে। তুরগেভ লি, অ্যান্টিরুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, আমরা নরওয়ের লোক শুনে উনি এলেন, আর কেউ একটা পাশ থেকে প্রস্তাব দিল ভেলা-অভিযানে আমাদের সাথে যোগ দিতে। কিন্তু ডাঙাতে তার পাহাড় প্রমাণ কাজ ছিল যে! জাতিসঙ্ঘের সহকারী সম্পাদক চিলের ডক্টর বেঞ্জামিন কোহেন, নিজে একজন নামকরা শখের পুরাতাত্ত্বিক, আমাদের কাছে পেরুর রাষ্ট্রপতিকে লেখা একটা চিঠি দিলেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সেখানেই আমরা নরওয়ের রাষ্ট্রদূত, মর্গেনস্টার্ন-এর উইলহেলম ফন মুনতে-এর সাথে দেখা করলাম, যিনি তারপর থেকে আমাদের গোটা অভিযানে অমূল্য সহায়তা দিয়েছেন।
সুতরাং দুটো টিকিট কাটলাম আর দক্ষিণ আমেরিকার উড়ানে চেপে বসলাম। চারটে ইঞ্জিন চালু হল একের পর এক আর আমরা সিটে প্রায় এলিয়ে বসে রইলাম, যেন আমাদের ইতিমধ্যে নিংড়ে নিয়েছে কেউ। ভাষাহীন এক অনুভূতি হচ্ছিল; যাক, অভিযানের প্রথম পর্ব চুকল! আর শেষ অবধি, এই, এখন, সোজা অভিযানেই নেমে পড়া গেল।
ক্রমশ