ধারাবাহিক অভিযান কনটিকি অভিযান থর হেয়ারডাল অনুবাদ ইন্দ্রনাথ বসন্ত ২০১৮

কন-টিকি অভিযান-আগের পর্বগুলো

থর হেয়ারডাল।  (অনুবাদঃ ইন্দ্রনাথ)

আগের কথা

বিয়র্নের দৌলতে থর ও তার বন্ধুরা আমেরিকাতে নরওয়ের রাষ্ট্রদূত, কর্নেল মুনতে কস-এর সঙ্গে দেখা করে তার আশ্বাস পেলেন যে তিনি সুপারিশ করে চিঠি লিখে দেবেন। সেনা আকাদেমির দপ্তরে ফিল্ড রেশন, জল নিরোধক দেশলাই, প্রাইমাস স্টোভ, জল রাখার পিঁপে, রাবারের ব্যাগ, বিশেষ ধরণের জুতো, রান্নার বাসনপত্র ও ছুরি ইত্যাদি অভিযানের প্রয়োজনীয় নানান ধরণের জিনিস পাওয়া গেল। শর্ত একটাই, পরখ করে জিনিসগুলো সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে হবে। ইংল্যান্ড থেকে আনানো কিছু যন্ত্রপাতিও ছিল। ওদিকে অর্থ সাহায্যকারীর দল বলল অভিযান খানিকটা পিছিয়ে দিতে কেননা যথেষ্ট অর্থ জোগাড় হয়নি। হাতে মাত্র তিনমাস। মাথায় হাত। কর্নেল আবার মুস্কিল আসান হয়ে উদয় হলেন। অর্থ সাহায্য পেয়ে আবার তরতর করে এগোলো অভিযানের কাজ আর অবশেষে দক্ষিণ আমেরিকার উড়ানে চেপে বসল অভিযাত্রীরা।

(৭)

দক্ষিণ আমেরিকায়

বিষুবরেখা অতিক্রম করেই আমাদের প্লেনটা দুধসাদা মেঘের মধ্যে দিয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করল। এতক্ষণ মেঘের দল আমাদের নীচে গনগনে রোদ্দুরে ঝকঝকে বরফের মাঠের মতো বিছিয়ে ছিল। প্লেনের নীচে নামতেই জানলার কাচে কিছুক্ষণ ধোঁয়া ধোঁয়া লেগে রইল তারপর আবার মাথার ওপরে মেঘ, আর নীচে বিস্তৃত উজ্জ্বল সবুজ জঙ্গলের মাথা দেখা গেল। আমরা দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরে ঢুকে এলাম আর এসে নামলাম গ্রীষ্মপ্রধান গুয়ায়াকুইলের বিমানবন্দরে।

আগেরদিনের কোট, ভেস্ট, ওভারকোট হাতে ঝুলিয়ে বাইরের প্রচন্ড গরমে নামতে নামতে আর চারপাশে লোকেদের হালকা পোশাক আর কথাবার্তার মাঝেই টের পেলাম আমাদের শার্টগুলো ভিজে পিঠের সাথে সিঁটিয়ে গেছে। কাস্টমস আর অভিবাসনের ঝামেলা প্রায় সাথে সাথেই চুকিয়ে আমাদের গাড়িতে নিয়ে তোলা হল, শহরের সবচেয়ে ভালো হোটেলে, মানে একমাত্র ভালো হোটেলে নিয়ে যেতে। হোটেলে ঢুকেই যে যার মতো তড়িঘড়ি আগে বাথটাবে গিয়ে ঠান্ডা জলের কলের তলায় শুয়ে রইলাম। অবশেষে বালসা গাছের দেশে এসে পৌঁছোলাম, এখানেই আমাদের কাঠ কিনে ভেলা বানানোর কথা।

প্রথম দিনটা চলে গেল, এখানকার টাকাপয়সার লেনদেন ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে এবং কিছু কিছু স্প্যানিশ শিখতে যাতে নির্বিঘ্নে হোটেল খুঁজে ফিরে আসতে পারি। দ্বিতীয়দিন বাথটাব ছেড়ে একটু একটু করে বেরোনো শুরু করলাম, আর যতক্ষণে হারম্যান ওর ছোটোবেলার স্বপ্ন, একটা পাম গাছের গায়ে সত্যি হাত দিয়ে দাঁড়াতে পারল আর আমি যথেষ্ট ফ্রুট স্যালাড খেলাম, তখনই ঠিক করলাম অ্যাই, এইবারে বালসা কেনার জন্য কথাবার্তা চালাতে পারি।

দুর্ভাগ্যক্রমে, এটা করার চেয়ে বলা ঢের সোজা। চাইলেই যতখুশি বালসা কিনতে পারি কিন্তু যেমন চাই তেমন গোটা গোটা লগ কেনা! উঁহু। সমুদ্রপাড়ের জঙ্গলে বালসা গাছ সহজেই পাওয়া যাচ্ছে, সে-সব দিন গেছে। শেষ যুদ্ধই তাতে ইতি টেনে দিয়েছে; হাজারে হাজারে গাছ কেটে বিমান বানানোর কারখানায় পাঠানো হয়েছে, কেন না এই কাঠ বায়বীয় ও হালকা। শুনলাম এখন বড়ো বড়ো বালসা গাছ একমাত্র দেশের ভেতরে জঙ্গলের মধ্যে জন্মায়।

‘তাহলে সেখানেই যাব আর যেমন দরকার কেটে আনব’ আমরা বললাম।   

‘অসম্ভব’ কর্তাব্যক্তিরা বলল, ‘বর্ষা শুরু হয়ে গেছে, জঙ্গলে ঢোকার কোনো রাস্তাই আর যাতায়াতের যোগ্য নেই, বন্যার জল আর কাদায় ঢেকে আছে। বালসা কাঠ চাইলে ছমাস বাদে ইকুয়েডরে ফিরে আসতে হবে। তদ্দিনে ওখানে বৃষ্টিও থেমে যাবে আর রাস্তাগুলোও শুকিয়ে উঠবে।

নিরুপায় হয়ে ইকুয়েডরের বালসা-রাজ ডন গুস্তাভো ফন বুচোয়াল্ড-এর সাথে কথা বললাম। হারম্যান ওর ভেলার স্কেচটা সামনে মেলে ধরল যাতে লেখা আমরা ঠিক কী কী মাপের লগ চাই। ছোটখাটো মানুষটা অমনি ফোনে ওর দালালদের ধরে কাজে লাগালেন। হালকা বোর্ড, সরু লম্বা গুঁড়ি, আলাদা আলাদা ছোটো মাপের কাঠ পাওয়া গেল, কিন্তু কোনো চেরাইকলেই যেমনটা চাইছি তেমন লম্বা কাঠ পাওয়া গেল না। গুস্তাভের গোলায় দুটো বড়ো শুকনো লগ ছিল, কিন্তু তা দিয়ে আমাদের খুব একটা লাভ হবে না। পরিষ্কার হয়ে গেছিল, খোঁজাখুঁজিটা বৃথাই গেল। 

ডন গুস্তাভো অবশ্য বেশ আশার কথা শোনাল, ‘আমার এক ভাই, বুঝলে, তার ওখানে বেশ বড়োসড়ো জায়গা জুড়ে বালসা গাছ লাগানো আছে। ওর নাম ডন ফেদেরিকো। উত্তরের জঙ্গল লাগোয়া ছোটো শহর কুইভেদোয় থাকে। বর্ষার পরপরই ওর সাথে যোগাযোগ করলেই তোমরা যেমন চাও তেমনই জোগাড় হয়ে যাবে। এখন তো মুশকিল, এখন ওদিকের জঙ্গলে বর্ষা।

ডন গুস্তাভো যদি হাল ছেড়ে দেয় তাহলে সারা ইকুয়েডরে আর একজনও নেই। সকলেই বলবে, নাহ পারা যাচ্ছে না। সুতরাং আমরা গুয়ায়াকুইলে, ভেলার জন্য কোনো কাঠ জোগাড় নেই, নিজেরা যে গিয়ে সংগ্রহ করে আনব, কয়েক মাসের আগে তারও উপায় নেই অথচ তদ্দিনে বেশ দেরি হয়ে যাবে। 

‘সময় নেই’ হারম্যান বলল।

‘আর বালসা চাইই চাই।’ আমি বলি, ‘হুবহু একরকম ভেলা বানাতে হবে নইলে বেঁচে ফেরবার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

হোটেলে একটা ইস্কুলপাঠ্য ম্যাপ পেলাম। তাতে সবুজ জঙ্গল, বাদামি রঙের পাহাড়, লাল গোল চিহ্ন দিয়ে বসতি আঁকা। সেটায় দেখলাম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে শুরু করে উঁচু আন্দিজ পাহাড়ের তলা অবধি নিরবচ্ছিন্ন জঙ্গল। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সমুদ্রের দিক থেকে জঙ্গল ঠেলে কুইভেদোর বালসা গাছের কাছাকাছি এখন পৌঁছনো অসম্ভব মানছি। কিন্তু উলটো দিক থেকে মানে আন্দিজ পর্বতের বরফের ঢাল বেয়ে সোজা নেমে জঙ্গলের দিকে যদি বালসা পেয়ে যাই? আমাদের যা মনে হচ্ছিল, এটাই একমাত্র সম্ভাবনা।

বিমানবন্দরে একটা মালবাহী প্লেন রাজি হল আমাদের কুইটো পৌঁছে দেবে; আন্দিজের ওপর এ দেশের রাজধানী, সমুদ্রতল থেকে ৯৩০০ ফুট উঁচুতে। মেঘের রাজ্যে ঢুকে পড়ার আগে প্লেনের প্যাকিং বাক্স আর আসবাবের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে আমাদের চোখে পড়ছিল সবুজ জঙ্গল আর রুপোলি নদী। মেঘের ওপর উঠে আসার পর নীচের দিকে অসীম দিগন্ত অবধি সাদা মেঘে ঢাকা, জমি দেখা যাচ্ছে না কিন্তু সামনে শুকনো পাহাড়, উঁচু চূড়াগুলো মেঘের সমুদ্র থেকে গাঢ় নীল আকাশের দিকে উঠে গেছে। প্লেনটা সোজা পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল, পাহাড়ি রেলগাড়ির মতো, কেবল দিয়ে যেভাবে টেনে ওপরে তোলে ঠিক অমনি।

বিষুবরেখা কাছেই, দেখা যাচ্ছে। তবুও ঝকঝকে বরফের মাঠ, আমাদের ঠিক পাশে পাশেই! পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে উড়ে উড়ে আমরা আলপাইনের সবুজের মাঝে একটা অদ্ভুত রাজধানী শহরের কাছে এসে নামলাম।

কুইটোর পৌনে দু’লাখ বাসিন্দার সকলেই হয় খাঁটি পাহাড়ি ইন্ডিয়ান নয়তো আধা ইন্ডিয়ান। কেননা কলম্বাসের আবিষ্কার অথবা আমাদের লোকেরা আমেরিকা দেশ জানার বহু আগে থেকেই তাদের বাপ ঠাকুর্দাদের রাজধানী ছিল এটা। শহরে বহু প্রাচীন মঠ-মনাস্ট্রি, তাতে অমূল্য সব শিল্পকীর্তি; শুকনো ইঁটের তৈরি ইন্ডিয়ানদের নিচু ছাতের বাড়ির পাশাপাশি স্পেনীয়দের তৈরি চমৎকার কিছু উঁচু উঁচু পুরনো বাড়ি। দুধারে মাটির দেয়ালের মাঝখান দিয়ে অসংখ্য গলিঘুঁজি; লাল বুটি দেয়া পোষাক ও বাড়িতে তৈরি বিশাল টুপি পরা ইন্ডিয়ানরা গিজ গিজ করছে সেখানে। কেউ গাধার পিঠে মালপত্র নিয়ে বাজারে চলেছে, কেউবা মাটির দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কুঁজো হয়ে বসে গরমের মধ্যেই ঝিমোচ্ছে। ঐ সরু রাস্তায় ক্রমাগত হর্ন বাজিয়ে বাজিয়ে বাচ্চাকাচ্চা, গাধা, খালি পা ইন্ডিয়ানদের মধ্যে দিয়ে পথ করে কয়েকটা গাড়ি সাধারণ গতিতে পার হয়ে যাচ্ছে। আরোহীরা স্পেনীয় অভিজাত মানুষ। এতটা ওপরে বাতাস স্বভাবতই খুব নির্মল ও স্বচ্ছ আর এর মধ্যে চারপাশের পাহাড়ের প্রভাব এক অন্য পৃথিবীর আবহাওয়ার কথা বলে।

আমাদের মালবাহী প্লেনের বন্ধু জর্জ এর একটা ডাকনাম আছে, “পাগলা পাইলট” – দ্য ক্রেজি ফ্লায়ার। ওও কুইটোর প্রাচীন স্পেনীয় পরিবারগুলোর একটির সদস্য। সে আমাদের একটা প্রাচীন ও মজাদার হোটেলে তুলে দিয়ে খোঁজ করতে লাগল, কখনো আমাদের নিয়ে কখনো আমাদের ছাড়াই, যাতে নীচে কুইভেডোর জঙ্গলে যাবার একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা যায়। সন্ধেবেলা একটা পুরোনো স্পেনীয় কাফেতে আমরা জড়ো হতাম আর জর্জ একগাদা খারাপ খবর দিত। আমরা কুইভেডো যাবার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলাম। না কোনো লোক পাবার সম্ভাবনা না কোনো গাড়ি যে পাহাড় টপকে নিয়ে যাবে, আর জঙ্গলে তো নৈব নৈব চ। সেখানে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আর কাদায় আটকে গেলে তো লুটপাট হবেই। গেলবারই দশজন আমেরিকান তেল কম্পানির ইঞ্জিনিয়ারকে বিষ-তীর দিয়ে মারা হয়েছিল পূর্ব ইকুয়েডরের কাছে । ওখানে এখনো কিছু ইন্ডিয়ান জঙ্গলে নাঙ্গাই ঘোরাফেরা করে আর বিষতীর দিয়ে শিকার করে।

‘ওদের কেউ কেউ মুন্ডুশিকারী’ জর্জ কেমন হালকা করে কথাটা ভাসালো, হারম্যানের অবশ্য তাতে কোনো হেলদোল দেখা গেল না, মাংস আর পানীয়ের দিকেই তার বেশি মনোযোগ তখন!  

‘তোমার মনে হল আমি বাড়িয়ে বলছি?’ নীচু স্বরে বলে চলল জর্জ, ‘ যদিও পুরোপুরি নিষিদ্ধ, তবুও এখনও এদেশে কিছু লোক মরা মানুষের মাথা শুকিয়ে বিক্রি করে পেট চালায়। নিয়ন্ত্রণ করা একান্তই অসম্ভব, আজকের দিনেও জঙ্গলের ইন্ডিয়ানরা তাদের যাযাবর শত্রুদের মুন্ডু কেটে নেয়। তারপর খুলি বার করে নিয়ে মাথামুখের চামড়ার মধ্যে গরম বালি পুরে দেয় যাতে গোটা মাথাটা শুকিয়ে ছোটো হয়ে বড়োজোর একটা বেড়ালের মাথার মাপে হয়ে যায় অথচ মুখ চোখ নাকের আকার আকৃতি সবকিছুই ঠিকঠাক থাকে। একসময় শত্রুর এরকম ছোটো মাথা বেশ মূল্যবান ট্রফি ছিল; এখন তা কালোবাজারির জিনিস। দোআঁশলা দালালগুলো দেখে, যাতে সেগুলো নীচে সমুদ্রের পাড়ে খদ্দেরদের হাতে ঠিকঠাক পৌঁছোয়, যারা ট্যুরিস্টদের কাছে মোটা টাকায় সেগুলো বিক্রি করে।

জর্জ চকচকে চোখে তাকাল। ও বেচারি ভাসা ভাসা জানত  যে সেদিনই কুলিদের লজে আমাকে আর হারম্যানকে ডেকে ওরকমই দুখানা মাথার একেকটার জন্য ১০০০ সুক্রে (সে সময় ১৪-১৫ সুক্রে = ১ আমেরিকান ডলার) দাম দেয়া হয়েছিল। আজকাল বেশিরভাগই বাঁদরের মাথা দিয়ে বানানো নকল জিনিস, কিন্তু আমাদের যে দুটো দেখানো হয়েছিল, সেগুলো আসল, একেবারে খাঁটি ইন্ডিয়ানের মাথা, জীবন্ত, চোখ নাক মুখের ছোটো ছোটো বৈশিষ্ট্য সব ছিল। একটা ছেলে, আরেকটা মেয়ের মাথা; মেয়েটাই সুন্দরী বেশি যদিও কেবলমাত্র চোখের পাতা আর মাথার লম্বা কালো চুল এ দুটোই স্বাভাবিক আকারে সংরক্ষিত হয়েছিল। জর্জের কথায় কেঁপে উঠলেও একটু সন্দেহ প্রকাশ করলাম যে পশ্চিমের পাহাড়ে কি মুন্ডুশিকারীরা আছে?   

‘কে জানে? থাকতেই পারে’ জর্জ মুষড়ে পড়া গলায় বলল, ‘ধরো তোমার বন্ধু অদৃশ্য হয়ে গেল আর তারপর তারই মুন্ডু মিনিয়েচার হয়ে বাজারে এলো, তখন? আমার এক বন্ধুর সাথে অমনি হয়েছিল একবার।’ আমার দিকে ঠায় তাকিয়ে রইল জর্জ ।

‘বলো তো শুনি কী হয়েছিল’ খুব আস্তে আস্তে মাংসটা চিবোতে চিবোতে হালকা মজা করে হারম্যান বলে।

আমি আমার কাঁটা চামচ সরিয়ে রাখি। জর্জ গপ্পোটা বলে। ও তখন বউকে নিয়ে জঙ্গলের কাছাকাছি একটা জায়গায় থাকত। নিজে সোনা ছেঁকে তোলার কাজ করত আর অন্য যাঁরা ছেঁকে তুলত তাদের থেকেও সোনা কিনে নিত। স্থানীয় একটা বন্ধু ছিল ওদের, যে প্রায়শই জিনিসপত্রের বিনিময়ে সোনা দিয়ে যেত। একদিন এই বন্ধুটাকে জঙ্গলে কেউ খুন করল। জর্জ খুনিটাকে খুঁজে বার করে তাকে গুলি করার হুমকি দিয়ে এলো। এখন এই খুনিটা ছিল মৃত মানুষের মাথার সন্দেহভাজন ব্যবসায়ীদের একজন, ফলে জর্জ তাকে হুঁশিয়ারী দিলো, সে যদি তখুনি বন্ধুর মাথাটা তাকে দিয়ে দেয় তাহলে তাকে ছেড়ে দেবে। খুনিটা তক্ষুনি বন্ধুর মাথাটা বার করে দিলো। সেটার মাপ তখন হাতের মুঠের মতো ছোটো। বন্ধুকে ওইভাবে দেখে জর্জ মর্মাহত হল। ছোটো এইটুকু হয়ে যাওয়া ছাড়া মাথাটার আর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ভেতরে ভেতরে তোলপাড় চললেও জর্জ মাথাটা বাড়ি নিয়ে এলো। সেটা দেখে ওর বউ তো ভিরমি খেয়ে পড়ল। ফলে বন্ধুকে ট্রাঙ্কের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে হল জর্জকে। কিন্তু জঙ্গল এমন স্যাঁতসেতে যে মাথাটার ওপরে সবুজ ছাতা পড়ে যাচ্ছিল, তার ফলে জর্জকে প্রায়ই ওটা বার করে রোদে দিতে হত। কাপড় শুকোনোর দড়িতে মাথার চুলে বাঁধা মুন্ডুটা দিব্যি ঝুলত। আর প্রতিবারই ওর বউ সেটা দেখে অজ্ঞান হয়ে যেত। কিন্তু একদিন একটা ইঁদুর ট্রাঙ্কে ঢুকে পড়ে বন্ধুটার সব্বোনাশ করল। খুব মনখারাপ নিয়ে বিমানঘাঁটিতেই মাটিতে একটা ছোট্ট গর্ত করে পূর্ণ মর্যাদায় বন্ধুর সমাধি দিয়েছিল জর্জ। যতই হোক সে একটা মানুষ তো বটে! এইই ছিল জর্জের শেষতম উপলব্ধি।

‘খাবারটা দারুণ ছিল।’ প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য আমি মুখ খুলি।

অন্ধকারে বাড়ি ফেরার সময় কেমন একটা ধন্দ হল আমার; হারম্যানের টুপিটা কানের ওপর দিয়ে যেন অনেকটা নেমে এসেছে! কিন্তু না, ওইই ওটাকে টেনে নামিয়ে এনেছিল যাতে রাতের পাহাড়ের ঠান্ডা হাওয়া কানে না লাগে।

পরদিন সকালবেলা আমরা আমাদের কনসাল জেনারেল ব্রিন আর তার স্ত্রীর সাথে শহরের বাইরে ওদের  বিশাল বাগানবাড়িতে ইউক্যালিপটাসের ছায়ায় বসেছিলাম। ব্রিন মোটেই ভাবেনি যে কুইভেডোর জঙ্গলে অভিযানে গেলে আমাদের মাথাটা ছোটো হয়ে যেতে পারে; কথা তা নয়, তবে যেখানে যাবার কথা হচ্ছে সে অঞ্চলে ডাকাত তো আছেই। ও আমাদের খবরের কাগজের কাটিং দেখালো, যে, বর্ষা কাটলে ঐ এলাকাতে সেনাবাহিনীকে পাঠানো হবে কুইভেডোর আশপাশ থেকে ডাকাতদলকে সমূলে নিকেশ করতে। এখন ওখানে যাওয়া মানে স্রেফ পাগলামো, না পাওয়া যাবে গাইড, না গাড়ি। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই দেখি আমেরিকান দূতাবাসের অফিস থেকে একটা জিপ ধাঁ করে বেরিয়ে গেল, আর আমাদের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমরা কনসাল জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে সটান আমেরিকান দূতাবাসে চলে গেলাম, সামরিক দূত

ভদ্রলোকের সাথে দেখাও হয়ে গেল। পাতলা ছিপছিপে কমবয়েসী লোক, খাকি উর্দি আর ঘোড়ায় চড়ার জুতো পড়ে হাসতে হাসতে জানতে চাইলেন পাহাড়ের ওপর আমরা করছিটা কী, যখন স্থানীয় খবরের কাগজ বলছে আমাদের ভেলায় চেপে সমুদ্রে ভেসে পড়ার কথা!

আমরা জানালাম, কাঠগুলো এখনো কুইভেডোর জঙ্গলেই রয়ে গেছে, আর আমরা এদেশের ছাদ অবধি এসে গেছি অথচ কাঠ জোগাড় করতে পারছি না। সামরিক দূতকে বললাম হয় আমাদের একটা প্লেন আর প্যারাশ্যুট দিন নয় তো একটা জিপ আর এলাকাটা জানে এমন একটা ড্রাইভার দিন।   

ভদ্রলোক আমাদের কথায় প্রথমটায় কেমন থ মেরে বসে রইলেন, তারপর অল্প হেসে দুদিকে মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন আর শেষটায় বললেন ঠিকাছে, দ্বিতীয়টা, কেননা আমরা ওকে তৃতীয় কোনো বিকল্প দিইনি। 

পরদিন সকাল সওয়া পাঁচটা নাগাদ হোটেলের সামনে একটা জিপ এসে দাঁড়াল, আর একজন ইকুয়াডোরিয়ান ক্যাপ্টেন লাফ দিয়ে তা থেকে নেমে এসে বললেন আমাদের সাহায্যের জন্য এসেছেন। তাঁকে আদেশ করা হয়েছে আমাদের কুইভেডোয় নিয়ে যেতে, তা সে রাস্তায় কাদা থাক আর নাই থাক। জিপে গ্যাসোলিনের জার ঠাসা, কেননা রাস্তায় কোনো পাম্প নেই, এমনকী যেখানে যাব সেই পথে গাড়ির রাস্তাও নেই। আমাদের নতুন বন্ধুটি, ক্যাপ্টেন আগুর্তো আলেক্সিস আলভারেজ, পথে ডাকাতের ভয় আছে বলে ছুরি বন্দুক সব সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। আমরা সঙ্গে কেবল টাকা নিয়ে এসেছিলাম সমুদ্রের পাড়েই কাঠ কিনে নেব বলে; আমাদের যত যন্ত্রপাতি সব জাহাজেই ছিল। ফলে জিপে কেবল রইল এক ব্যাগ টিনবন্দি খাবার। এছাড়া তাড়াহুড়ো করে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ক্যামেরা আর নিজেদের জন্য একজোড়া শক্ত পোক্ত খাকি ব্রিচেস খালি নিয়ে নিলাম। এর বাইরে কনসাল জেনারেল জোর করে আমাদের দুটো বড় রিভলবার আর যথেষ্ট পরিমাণে গুলি দিয়ে দিলেন। রাস্তায় বাধা বিপত্তি যাইই আসুক স্রেফ উড়িয়ে দিই যেন।

ফাঁকা রাস্তা দিয়ে জিপটা বেরিয়ে এল। মাটির দেয়ালের ওপারে ফ্যাকাশে চাঁদ কেবল ঝুলে রইল, আর আমরা শহরের বাইরে একটা চমৎকার বালির রাস্তা ধরে ঝড়ের বেগে পাহাড়ি এলাকার মধ্যে দিয়ে দক্ষিণে চললাম।

পাহাড়ি গ্রাম লাটাকুঙ্গা অবধি ভালোই এলাম। এখানে জানালাবিহীন ইন্ডিয়ানদের বাড়িগুলো পাম গাছে ঘেরা সাদা একখানা চার্চকে ঘিরে গাদাগাদি করে রয়েছে। এখান থেকে পশ্চিমে একটা খচ্চর চলার উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা পথ ধরে পাহাড় উপত্যকা পার হয়ে আন্দিজ পর্বতের গায়ে গায়ে চললাম। এ এমন জগৎ আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি কখনো। পাহাড়ি ইন্ডিয়ানদের নিজস্ব জগৎ বুঝিবা, সূর্যেরও পুবে আর চাঁদেরও পশ্চিমে, দেশকালের সীমানা পেরিয়ে যাওয়া এক জায়গা। সারাটা রাস্তায় একটাও গাড়িঘোড়া দেখিনি। কেবল উজ্জ্বল পঞ্চো পড়া খালি-পা মেষপালকেরা খাড়া-পা লামাগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে অথবা গোটা একটা ইন্ডিয়ান পরিবারই পথে চলেছে। পরিবারের কর্তা একটা খচ্চরের পিঠে সকলের আগে আগে, তার ছোটোখাটো বউটা মাথার ওপর সমস্ত টুপির গোছা আর একদম কোলের শিশুটাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে তার পেছন পেছন। সারাটা পথ সে উল বুনতে বুনতে খুব ধীরে ধীরে আরাম করে চলেছে। পেছনে গাধার পিঠে খচ্চরের পিঠে কাঠকুটো, ঘাসপাতার বোঝা আর মাটির জিনিসপত্র। আরো খানিক যাবার পর স্প্যানিশ বলা ইন্ডিয়ান কমে এলো আর আগুর্তোর ভাষাজ্ঞান আর কাজে এলো না, ঠিক আমাদেরই মতো।

পাহাড়ের ওপরে এদিক ওদিক ছড়ানো বেশ কিছু কুঁড়েঘর; তার মধ্যে অল্পই মাটিতে তৈরি, বেশিরভাগই গাছের ডাল আর ঘাসপাতা দিয়ে বানানো। রোদে পোড়া-তামাটে, কুঁচকে যাওয়া চামড়ার মানুষগুলো আর কুঁড়েঘরগুলো যেন একই সাথে মাটি থেকে আপনা থেকেই জন্মেছে। আন্দিজ পাহাড়ের পাথরের দেওয়ালে, সূর্যের তাপের ফলে তাদের এই সুরতহাল। পাহাড়ি ঘাসের মতোই তারাও এই পাহাড়-চূড়া, ঝুরো-পাথর অথবা পাহাড়ি-ঢাল-এর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ যেন। গরীব ছোটোখাটো এই পাহাড়ি ইন্ডিয়ানরা জঙ্গলের প্রাণীর মতই শক্তপোক্ত এবং এদের অদ্ভুত সহনক্ষমতা আর আদিম মানুষদের মতো সহজ সতর্কতা; যতটা কথা কম বলে তত বেশি হাসতেও পারে। উজ্জ্বল মুখ আর ঝকঝকে হাসি, এইই দেখতে পেলাম আমরা। সাদা চামড়ার মানুষেরা দুপয়সা পেয়েছে কিংবা দুপয়সা হারিয়েছে এমন কোনো ইঙ্গিত আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পেলাম না। না আছে কোনো সাইনবোর্ড, না আছে রাস্তার দিকচিহ্ন। একটা টিন বা কাগজের টুকরো রাস্তার পাশে ফেলেছ কি তক্ষুনি সেটা ঘরকন্নার কোনো না কোনো কাজে ঠিক লেগে যাবে।

ক্রমশ

খেলার পাতায় সমস্ত ধারাবাহিক অভিযান একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s