প্রথম পর্ব
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
পর্ব – ২
১
দেবলঋষি ও নালকের কথা
হিমালয়ের বরফাবৃত পর্বত কন্দরে ধ্যান মগ্ন ঋষি অসিতদেবল বা কালদেবলের হঠাৎ ধ্যান ভঙ্গ হয়ে গেল। কী এক দিব্য আনন্দে তাঁর মন ভরে উঠল। তিনি ভাবতে লাগলেন কেন হঠাৎ এই অপার আনন্দ তাঁর ভেতর অনুভূত হচ্ছে? তিনি সে কথা জানার জন্য প্রসন্ন মনে আবারও ধ্যানমগ্ন হলেন। ধ্যানে বসে তিনি অপরূপ রূপে ব্যাপ্ত জ্যোতিপুঞ্জের মধ্যে বহু দেবপুরুষদের দেখতে পেলেন। তাঁরাও যেন সকলে হঠাৎ আনন্দে উদ্বেল। ঋষি কালদেবল জানতে চাইলেন, ”আপনারা সকলে আজ এত আনন্দিত কেন? আমারও অন্তরে আজ যেন আনন্দের বান ডেকেছে। এর কারণ কী? দয়া করে আমাকে জানান!”
”আজ বড়ো খুশির দিন। আজ দেবপুরুষ তথাগত পৃথিবীতে জন্মলাভ করেছেন। ভবিষ্যতে তিনি এই পৃথিবীতে এক নতুন ধর্মমতের প্রতিষ্ঠা করবেন। তাকে দর্শন করলে মানবজন্ম সার্থক হয়। যদি তাঁকে দেখতে চাও, তবে এখনই যাত্রা শুরু করো।”
”কোথায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি? আমাকে এখনই বলুন! আমি তাঁকে দেখতে উদগ্রীব হয়েছি।”
”তিনি কপিলাবস্তুর রাজপুত্র। তাঁকে দেখে চর্মচক্ষু সার্থক করো!”
”বেশ! আমি তবে আজই যাত্রা করছি।”
ঋষি মহানন্দে যাত্রা করলেন কপিলাবস্তুর দিকে। যাত্রা পথে এল কত বন, কত নির্ঝরিনী, কত উপত্যকা তার যেন শেষ নেই। পথে চলতে চলতে ছেড়ে গেলেন, কত শষ্যপূর্ণ যবের ক্ষেত, আখের ক্ষেত, শালিধানের ক্ষেত। তিনি ক্ষেতের চাষীদের দেখতে পেয়ে বললেন, কুমোরকে বললেন, কর্মকারকে বললেন, ”তোমরা সকলে শোনো! ভগবান তথাগত এসেছেন পৃথিবীর বুকে!” তারা তাঁর কথা বুঝতে পারল না। সবাই অবাক চোখে কেবল ঋষিকে দেখতে লাগল। দেবল ঋষি নাচতে নাচতে হাসতে হাসতে পথ চলতে লাগলেন। আজ চর্মচক্ষে সাক্ষাৎ ভগবান দর্শন হবে তাঁর! এমন সুযোগ কোটি জন্মেও মেলে না। আজ তাই মনে যেন আনন্দের বান ডেকেছে তাঁর। অবশেষে তিনি কপিলাবস্তুর রাজবাড়ির দুয়ারে এসে উপস্থিত হলেন। দ্বারপালকে ডেকে বললেন, ”মহারাজকে বলো গিয়ে, ঋষি অসিত দেবল দূর হিমবন্তপ্রদেশ থেকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”
দ্বারপালের কথা শুনে রাজা স্বয়ং ছুটে এলেন। ঋষিকে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে বরণ করে নিলেন। জানতে চাইলেন তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য।
”মহর্ষি! আপনার কী প্রয়োজন আমাকে বলুন! আমি যথাসাধ্য তা পূরণ করতে চেষ্টা করব। আপনার কি খাদ্য বা বস্ত্রের প্রয়োজন?”
দেবল ঋষি স্মিত হেসে বললেন, ”রাজা আমার একটি বিষয়েই আগ্রহ। আপনি কি সম্প্রতি একটি পুত্র সন্তানের পিতা হয়েছেন? আমি কেবল আপনার সেই পুত্রটিকে একবার দেখতে চাই।”
রাজা এ কথা শুনে পরম আনন্দ পেলেন। তিনি অন্তঃপুর থেকে পুত্রকে আনিয়ে ঋষির পদতলে তার মাথা ঠেকাতে চাইলেন। কিন্তু যতবার তার মাথাটি ঋষির পায়ের কাছে আনা হয়, শিশুটি ঘুরে যায় এবং তার পা দুটি ঋষির মাথার দিকে ঘুরে যায়। রাজা তিনবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই পারলেন না।
ঋষি এই দৃশ্য অবাক হয়ে দেখছিলেন। তিনি হঠাৎ শিশুটির দিকে দু’হাত জোড় করে তাঁকে বন্দনা করতে লাগলেন। তারপর শিশুটিকে কোলে নিয়ে তাঁর পা দুটি নিজের মাথার উপর রাখলেন। শিশুটির পা দুটি তখন আর ঘুরে গেল না। তা স্থিরভাবে দেবল ঋষির জটার উপর বিরাজ করতে লাগল। ঋষির চোখ থেকে প্রগাঢ় ভক্তিতে জল ঝরে পড়তে লাগল।
রাজা জানতেন, কালদেবল ঋষি একজন পরম পূজনীয় মহাত্মা। তিনি সুদূর অতীত ও ভবিষ্যতদ্রষ্টা। ঋষির এমন আচরণ দেখে রাজা অবাক হয়ে গেলেন। ঋষি শিশুটিকে নিজের কোলে নিয়ে আগ্রহ ভরে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। ঋষি দেখলেন শিশুটির দেহে বত্রিশটি মহাপুরুষের লক্ষণ বিরাজ করছে। তিনি বুঝলেন, এই শিশুটিই হবে ভবিষ্যৎ বুদ্ধ। তিনি শিশুটিকে কোলে নিয়ে বসে বসে হাসতে লাগলেন। একটু পরে শিশুটির ভবিষ্যত দেখতে চাইলেন তিনি। তিনি দেখলেন শিশুটি বড় হয়ে যখন ধর্ম প্রচার করবে, তখন তিনি আর জীবিত থাকবেন না। ভবিষ্যত বুদ্ধের ধর্মবচন শোনার তাঁর কোনও উপায়ই নেই। ভবিষ্যতের এই দৃশ্য দেখে তাঁর মন দুঃখে ভরে উঠল, তিনি তখন নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগলেন।
রাজা ও অন্যান্য শাক্য রাজপরিবারের পরিজনগণ ঋষিকে অবাক হয়ে দেখছিলেন। রাজা বললেন, ”মহর্ষি আপনি কাঁদছেন কেন? রাজকুমারের ভবিষ্যতে কি কোনও বিপদ হবে?”
ঋষি জবাব দিলেন, ”রাজকুমারের কোনও বিপদ হবে না। তিনি হবেন এক অসাধারণ পুরুষ। তিনি ভবিষ্যতে হবেন সর্বজ্ঞ বুদ্ধ। তিনি বহুজনের সুখ ও শান্তি বিধান করবেন। এই কারণেই তাঁর এই ধরণীতে জন্ম হয়েছে। তবে সেই সময় আমি পৃথিবীতে আর থাকব না। আমার বয়স হয়েছে, তখন আমি কালগত হব, সেই দুঃখে আমি কাঁদছি মহারাজ!
মহারাজ দেখুন কুমারের শরীরের বত্রিশটি মহাপুরুষের লক্ষণঃ
১ মাথায় মুকুটের চিহ্ন, ২ চুলের রঙ কালো এবং তা ডান দিকে আকুঞ্চিত, ৩ কপাল সমতল এবং বিপুল, ৪ ভ্রু দুটি জোড়া এবং মধ্যভাগ উর্ণাঙ্কৃত, ৫ চোখের মণির রঙ ঘননীল এবং সমস্ত দাঁতগুলি একই রকম সমান, ৬ দাঁতগুলি ঘনসন্নিবিষ্ট ও দুধ সাদা, ৭ কন্ঠস্বর সুমধুর, ৮ জিহ্বার অগ্রভাগ রসাভিসিক্ত, ৯ জিহ্বা বৃহৎ অথচ কৃশ, ১০ চোয়াল সিংহের হনুর মতো, ১১ কাঁধ উন্নত ও গোলাকৃতি, ১২ গায়ের রঙ সোনার মতো বা সে সুবর্ণ বর্ণ, ১৩ দৃষ্টি স্থির, ১৪ তাঁর হাত দুটি অবনত ও প্রলম্বিত (আজানুলম্বিত বাহু), ১৫ শরীরের পূর্বভাগ সিংহের মতো, ১৬ কোমর ন্যগ্রোধ তরুর মতো সুগোল, ১৭ শরীরের রোমগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন, ১৮ উরুদেশ সুগোল, ১৯ জঙঘাদেশ এনমৃগের মতো, ২০ হাত ও পা এর আঙুলগুলি সুগঠিত ও লম্বা, ২১ তাঁর পা ও হাত আয়তাকার ও সুগঠিত ও কোমল, ২২ হাত ও পায়ের তালু অত্যধিক রেখাজাল বিশিষ্ট, ২৩ পায়ের তলায় প্রতিষ্ঠিত চক্রচিহ্ন, ২৪ পায়ের পাতা রঙ শুভ্র, ২৫ পা দুটি সুপ্রতিষ্ঠিত ও সমান, ২৬ ঠোঁট দুটি আরক্ত, ২৭ নাক সুউচ্চ, ২৮ গণ্ডদেশ পীন, ২৯
শরীর অপরূপ সুরভিত, ৩০ চোখ সুবিমল ও আয়তাকার, ৩১ ইন্দ্রিয় সকল সুপরিপূর্ণ, ৩২ চোখদুটি সুবিশাল ও নীল কুবলয়ের মতো এবং ভ্রুদুটি মাঝখানে সংযুক্ত (জোড়া ভুরু)।”
ঋষি জোড় হাতে শিশুটির বন্দনা করতে লাগলেন। শুদ্ধোদনও ঋষিকে দেখে ও তাঁর কথা শুনে নিজের পুত্রকে জোড় হাতে মাথা নত করে বন্দনা করলেন।
রাজা ঋষিকে বহুমূল্য অনেক উপহার ও খাদ্য সামগ্রী দিলেন তবে ঋষি কিছুই গ্রহণ করলেন না। সবই শিশুটির পদতলে রেখে তিনি বিদায় নিলেন।
ঋষি অসিত দেবল আজ যা দেখেছেন তার জন্য তিনি মনে অসম্ভব কষ্ট পেয়েছেন। তিনি দেখেছেন শিশুটির বয়স যখন পঁয়ত্রিশ বছর হবে তখন সে মহাবোধি জ্ঞান লাভ করবে। তিনি হলেন ভবিষ্যত পৃথিবীর বুদ্ধ। তবে তাঁর কাছ থেকে ধর্মভাষণ শোনা বা সেই পরিপূর্ণ শক্তিধর বুদ্ধকে দেখা তাঁর হবে না। কারণ তখন তাঁর মায়িক দেহটি পৃথিবীর বুকে আর থাকবে না। ঋষি এই ঘটনাকে তাঁর একান্ত দুর্ভাগ্য বলে মনে করলেন।
তিনি একমনে ভাবতে লাগলেন, তাঁর কোনও নিকট আত্মীয় বা পরিজন কি এমন কেউ আছেন? তিনি কোন সৌভাগ্যবান? যিনি সেই সময় পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন এবং বুদ্ধকে দেখতে পাবেন? এই কথা তাঁর মনে আসতেই ঋষি দেবলের নালকের কথা মনে এল। ঋষি ভবিষ্যত দেখতে পেলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, তাঁর বংশের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত একমাত্র নালকই বুদ্ধের ধর্মবাণী শুনতে সক্ষম হবে, এবং সেই বাণী শুনে মোক্ষমার্গে চরম উন্নতি করবে। নালক সম্পর্কে ঋষির ভাগ্নে হয়। তার বয়স এখন মাত্র সাত। এই কথা দিব্য দৃষ্টিতে জানতে পেরে, ঋষি তাঁর বোনের বাড়ির দিকে যেতে লাগলেন। তাঁর এখন নালককে বড় প্রয়োজন।
ঋষি তাঁর বোনের বাড়িতে পৌঁছে বোনকে ডেকে বললেন, ”নালক কোথায়?”
”নালক বাড়িতেই আছে দাদা।”
”তাকে আমার এখনই দরকার। ডাকো তাকে।”
নালককে ডাকা হলে ঋষি তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। নালকের পিতা একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ব্রাহ্মণ। তিনি গৃহপতি ও গ্রামপ্রধান এবং অগ্নির উপাসক। যাগযজ্ঞে তাঁর দিন কাটে। নালকের পিতাও ঋষি অসিত দেবলকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। নালকেরা সম্পন্ন গৃহস্থ। তাদের ঘরে শত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা সঞ্চিত আছে। নালক এখন বালক। সাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থেকে এতদিন সে কখনও কোনও দুঃখ কষ্ট সহ্য করেনি। তবুও বুদ্ধের কৃপা লাভের জন্য, ঋষি নালককে তাঁর শিষ্য করতে চান এবং সেইজন্য তাকে এই মুহূর্তে গৃহত্যাগ করতে হবে এবং বরণ করে নিতে হবে পরিব্রাজকের জীবন। সে জীবনে অসহ্য ত্যাগ ও নানা রকমের কষ্ট স্বীকার করতে হয়।
ঋষি নালকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”বাছা নালক! তুমি যে এতদিন আমার সঙ্গে প্রায়ই হিমবন্ত প্রদেশ দেখতে যেতে চাইতে, তেমন কি এখনও যেতে চাও? আজ কিন্তু আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে এসেছি।”
”আমি যাব। আপনি আমাকে সেইখানে নিয়ে চলুন!”
”মায়ের জন্য, বাড়ির সকলের জন্য তোমার মন কেমন করবে না তো?”
”যখন মায়ের কথা মনে পড়বে, আমি বাড়িতে এসে মাকে একবার দেখে যাব, আর কয়েকদিন পরে আবার আপনার কাছে চলে আসব।”
”বেশ। তবে বাড়ির ভেতরে গিয়ে পিতা মাতার মত নিয়ে এসো। আমার হাতে সময় অল্প, তাড়াতাড়ি এসো।”
নালকের মুখে এই কথা শুনে নালকের পিতা ও মাতা ঋষির কাছে ছুটে এলেন। ঋষি তাঁদের দেখে বললেন, ”আজ আমি দিব্য দৃষ্টিতে দেখেছি, ভবিষ্যতে নালক একজন বিরাট সুকৃতিশালী সাধক হবে। আজ তাই আমি ওকে নিতে এসেছি। পৃথিবীতে বুদ্ধের আবির্ভাব হয়েছে। আমার পিতৃকূল ও মাতৃকূলের সম্পূর্ণ বংশের মধ্যে একমাত্র নালকই ভবিষ্যত বুদ্ধের ধর্মবচন শুনে পরমজ্ঞান প্রাপ্ত হবে। আজ থেকে সন্ন্যাস নিয়ে নালককে তাই আমার সঙ্গী হতে হবে। আমিই ওকে ভাবী বুদ্ধের কৃপা পাওয়ার যোগ্য করে তুলব। ভাবী বুদ্ধের কৃপা লাভ করতে হলে, এখন থেকেই আত্মানুশীলন করে যেতে হবে নালককে।
ঋষির কথায় নালকের পিতা মাতা অসিত দেবলের হাতে নালককে তুলে দিলেন। তাঁরা জানতেন ঋষির বাক্য কখনও মিথ্যে হয় না। ঋষি নালককে নিয়ে তুষারাবৃত হিমবন্ত প্রদেশে চলে গেলেন। নালক ঋষির নির্দেশে হিমালয়ের গুহায় বসে দিনের পর দিন ধ্যানে মনোনিবেশ করতে লাগল এবং ভাবী বুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
২
মায়াদেবীর মৃত্যু
শিশুটির জন্মের সপ্তমদিনে তার মা মায়াদেবী পরলোকগত হলেন। মায়াদেবীর শরীর শিশুটির জন্মের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। দেবদহের সর্বাধিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক ছুটে আসেন তাঁকে দেখতে। কয়েক দিন পরে তিনি অপারগ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। মায়াদেবী সর্বক্ষণ আচ্ছন্ন অবস্থায় আছেন, তাঁর নাড়ী অতি ক্ষীণ, এই খবর পেয়ে ছুটে আসলেন রাজা শুদ্ধোদন। শুদ্ধোদন যখন এসে পৌঁছালেন, মায়াদেবী তখন সম্পূর্ণ চেতনাশূন্য। তাঁর জ্ঞান আর কখনও ফিরে এল না। শিশুটির জন্মের সাতদিনের মধ্যে মায়াদেবী পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অমৃতলোকে চলে গেলেন।
মায়ের মৃত্যু হওয়ায় শিশুটির দেখাশুনো করার ভার মহারানি গৌতমীকে দিলেন রাজা শুদ্ধোধন। এছাড়া শিশুটিকে পরিচর্যা করার জন্য বত্রিশজন পরিচারিকাও নিযুক্ত করা হল। রাজপুত্রের নামকরণ দিবস উপস্থিত হল। সেইদিনে রাজবাড়িতে একশো আটজন ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করলেন রাজা শুদ্ধোধন। তাদের মধ্যে আটজন ব্রাহ্মণ ছিলেন দৈবজ্ঞ জ্যোতির্বিদ। তাঁরা এর আগেও মায়াদেবীর স্বপ্ন ব্যাখ্যা করতে রাজপুরীতে এসেছিলেন। তাঁরা হলেন – রামদ্বিজ, ধ্বজ, মন্ত্রী, কোণ্ডণ্য, লক্ষণ, সুযাম, সুদান্ত এবং ভোজ।
জ্যোতিষীরা শিশুর জন্ম ছক তৈরী করলেন, জন্মসময়ের দণ্ড ও পল মেনে। দেখা গেল জন্ম ছকটি জাতকের অবিশ্বাস্য সৌভাগ্য বহন করছে। জন্ম কুণ্ডলীতে লগ্ন হল কর্কট। লগ্নে তুঙ্গী বৃহষ্পতির সঙ্গে রাহু। সপ্তমে অর্থাৎ মকরে তুঙ্গী মঙ্গল ও কেতু। এই যোগ একটি অভূতপূর্ব যোগ। জাতক হবেন দেহ মনে একেবারে পূত পবিত্র। জাগতিক মলিনতা তার মনকে কখনও স্পর্শ করতে পারবে না। তাছাড়া এটি একটি মহা রাজযোগ। মঙ্গল বৃহস্পতির সমসপ্তমে থাকা একটি মহান রাজযোগ। সমগ্র বিশ্বের রাজা হওয়ার যোগ। ভবিষ্যতে জাতক ধন, যশ মান সহিত বহু অনুচর সহকারে সসম্মানে বিরাজ করবেন। চতুর্থে চন্দ্র ও শনি, অসীম উপস্থিত বুদ্ধির পরিচায়ক। এর সঙ্গে দশমে অর্থাৎ মেষে তুঙ্গী রবি সঙ্গে বুধ, অর্থাৎ বুধাদিত্য যোগ। এর ফলে জাতক হবেন অসামান্য মেধাবী। একাদশে স্বক্ষেত্রে ভরণী নক্ষত্রে শুক্র। অর্থাৎ বহু প্রাপ্তিযোগ নির্দেশ করছে। সমগ্র বিশ্বে এমন রাশি চক্রের দেখা পাওয়াই ভার। জন্মছক তৈরী হওয়ার পর জ্যোতিষীগণ সবিস্ময়ে সেদিকে কেবল চেয়ে রইলেন।
শিশুটি তার পিতা মাতার মনোবাসনা সর্বার্থে সিদ্ধ বা পূর্ণ করেছে বলে রাজপুত্রের নাম রাখা হল সর্বার্থসিদ্ধ বা সংক্ষেপে সিদ্ধার্থ। গণনাকারীরা শিশুর ভবিষ্যত সম্পর্কে দু’ধরনের মত দিলেন। সাতজন দুটি আঙুল তুললেন। বললেন, ”যদি কুমার সংসারী হন, তাহলে রাজচক্রবর্তী রাজা হবেন আর যদি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন তাহলে সর্বজ্ঞ জ্ঞানী হবেন।”
তাঁদের মধ্যে সবথেকে বয়সে ছোট কোণ্ডণ্য কিন্তু এক আঙুল তুললেন। তিনি বললেন, ”কুমার কোনোমতেই সংসারী হবেন না। তার সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস নেওয়ার যোগই প্রবল।”
তা শুনে, ব্যাকুল স্বরে শুদ্ধোদন বললেন, ”কী দেখে কুমার সংসারে তার আগ্রহ হারাবে?”
ব্রাহ্মণেরা বললেন, ”জরাগ্রস্ত মানুষ অর্থাৎ বৃদ্ধ ব্যক্তি, রোগগ্রস্ত মানুষ, মানুষের মৃতদেহ এবং তরুণ সন্ন্যাসী।”
রাজা শুদ্ধোদন সঙ্গে সঙ্গে তার রাজ কর্মচারীদের হুকুম করলেন, ”আজ থেকে রাজবাড়ির চারদিকে ষোলো যোজন দূর পর্যন্ত পথে কোথাও যেন একজনও জরাগ্রস্ত মানুষ, রোগগ্রস্ত মানুষ, কিংবা মানুষের মৃতদেহ এবং সন্ন্যাসীদের দেখতে পাওয়া না যায়। আমার পুত্রের সন্ন্যাসী হয়ে কাজ নেই। আমি শুধু চাই সে রাজচক্রবর্তী রাজা হয়ে পরমসুখে সংসার করুক।”
দিনে দিনে বড় হয়ে উঠতে লাগল শিশু সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থের জন্মের অল্প কিছুদিন পরেই শুদ্ধোদন ও রানি মহাপ্রজাপতি গৌতমী একটি পুত্র সন্তান লাভ করলেন। অপূর্ব রূপবান এই পুত্রের নাম রাখা হল, রূপনন্দ বা নন্দকুমার। প্রজাপতি গৌতমী এই সময় শিশু সিদ্ধার্থ ও নন্দ দুজনকেই একভাবে তাঁর বুকের দুধ খাইয়ে বড় করতে লাগলেন।
একটু বড় হলে দেখা গেল, নন্দ সিদ্ধার্থের একান্ত অনুগত। ছোট থেকেই নন্দ ভীরু ও লাজুক স্বভাবের এবং সে সিদ্ধার্থের কথা শুনেই সমস্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।
৩
হলকর্ষণ উৎসব
যখন সিদ্ধার্থর বয়স পাঁচ ও নন্দের বয়স চার এমন সময় একদিন একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সেদিনটি ছিল কপিলাবস্তুর হলকর্ষণ উৎসবের দিন। কপিলাবস্তু রাজ্য জুড়ে এই সময় উৎসব পালিত হয়ে থাকে। প্রতিটি প্রজা ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সেদিন ফুলের মালা পরে ও কস্তুরী ও চন্দন প্রভৃতি সুগন্ধীচূর্ণ গায়ে মেখে রাজবাড়ি সংলগ্ন ময়দানে এসে উপস্থিত হয়। রাজাও আসেন।
সাধারণ প্রজারা তাদের লোহার লাঙ্গল নিয়ে আসে, ধনী প্রজারা ও শ্রেষ্ঠীরা আনে রূপার লাঙ্গল। রাজা একমাত্র সোনার লাঙ্গল ও সোনার কারুকার্যে শোভিত বলদ নিয়ে সেই ময়দানে আসেন। সেই বলদের শিং থেকে শুরু করে জোয়াল এমনকি রজ্জু এবং দণ্ডটি পর্যন্ত সোনার ও সোনার সূত্রে জড়ানো থাকে।
সেবারে ছোট রাজপুত্র নন্দ এর অসুস্থতার কারণে রানি তার দেখাশুনো করবেন বলে, রাজপুরীর অন্দরমহলে থেকে গেলেন। সিদ্ধার্থকে যে দাসীরা দেখাশুনা করত, তারাই তাকে নিয়ে ময়দানে এল। নাহলে তাদের উৎসব দেখা হবে না। ময়দানের তীব্র রোদে রাজপুত্রের যাতে কষ্ট না হয়, সেইজন্য সিদ্ধার্থকে একটি সুবিশাল জাম গাছের নীচে শয্যাসন বিছিয়ে বসিয়ে রাখা হল। সিদ্ধার্থের মাথার উপরে ছায়াদানের জন্য সোনার কারুকার্য করা একটি বস্ত্রখণ্ডকে চন্দ্রাতপের মতো টানিয়ে দেওয়া হল। জামগাছটির কাণ্ডটি ছিল সুবিশাল আর গাছটি ছিল ঘনসবুজ পাতায় ভরা। সকালের সূর্যকিরণের উত্তাপ গাছের নিচে ছিল না।
দাসীরা সিদ্ধার্থকে সব সময় খেয়াল করতে পারল না, কারণ মাঠে তখন উৎসব পূর্ণ উদ্যমে চলছে। রাজা ও রাজ্যের প্রায় আটশো প্রজা ময়দানে তাদের বলদ নিয়ে ভূমিকর্ষণ করতে এসেছেন। প্রবল রোদে বলদগুলি ঘর্মাক্ত কলবরে সমস্ত ময়দানময় ছোটাছুটি করতে শুরু করেছে। অন্যদিকে একটি ঘেরা জায়গায় ঘৃতপক্ক পলান্ন রান্না চলছে। আছে নানা রকমের মাংস ও মাছের উপকরণও। দাসীরা অনেকে পাকশালায় উঁকি দিয়ে পাচকদের রান্না দেখতে লাগল। আজ তাদের মনে অসীম আনন্দ। উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে আজ তারা স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করতে পারছে, নিয়ম ও হুকুমের কোনও বেড়াজাল নেই।
পাকশালায় আগত আগ্রহী এক সুন্দরী দাসীকে, পাচক একটি মাটির পাত্রে খানিকটা সুপক্ক ময়ুরের মাংস খেতে দিল। দাসী হেসে বলল, ”আমি এখানে তোমাদের রান্নাবান্না কতদূর তা দেখতেই এসেছি। উৎসব শেষ না হলে খাবার খাওয়ার কোনও সাধ আমার নেই। রাজপুরীতে কোনও রকম খাবারের অভাব নেই আমাদের। রাজার নির্দেশে সব দাসদাসীরাও সেখানে একইরকম খাবার খেয়ে থাকে। এমন পলান্ন আর মাংস আমরা রাজপুরীতে রোজ খেয়ে থাকি।”
এদিকে ভূমিকর্ষণ প্রায় শেষ। এবার রাজা আসবেন কর্ষণ করতে। ঘোষণা হতেই দাসীরা ছোটাছুটি করে ময়দানে এসে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াল। রাজা সোনার লাঙল আর সোনার সজ্জায় সজ্জিত ষাঁড় নিয়ে ভূমি কর্ষণ শুরু করলেন। প্রজারা সকলে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল।
চারিদিকে বিপুল আনন্দ। কেবল সিদ্ধার্থ বিষণ্ণ মনে জামগাছের তলায় একা একা বসে আছে। সে একটু আগে চারিদিক ঘুরে দেখছিল। তখন তাকে কেউ খেয়ালই করেনি। আজ মেঘমুক্ত নীল আকাশ। মাঠের মাটি কর্ষণের ফলে আলগা হয়ে যেতেই, মাটির নিচের স্তরের শত শত পোকামাকড়েরা মাটির উপরে ঘোরাফেরা করছে। সিদ্ধার্থ মাটির উপর কিলবিল করা সেই পোকাদের একমনে দেখছিল। এমন সময় আকাশ থেকে উড়ে আসতে লাগল শিকারী পাখির দল, তারা সেই পোকাদের দিয়ে তাদের ভোজ সারতে লাগল। সিদ্ধার্থের হঠাৎ এই অসহায় কীটপতঙ্গদের জন্য ভীষণ কষ্ট হল। চারিদিকের আনন্দ কোলাহল থেকে সে সহসা কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তার মনে হল মানুষের আনন্দের কারণে এই নিরীহ পোকাদের মৃত্যু হয়েছে। সিদ্ধার্থ ধীরে ধীরে আবার জাম গাছের তলায় ফিরে এল। সে একমনে ভাবতে লাগল। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে এসেছে কত শত প্রাণ আর মৃত্যু হয়েছে তাদের। হঠাৎ তার মনে হল, প্রাণীরা জীবিত কিংবা মৃত তা বোঝার উপায় কি? সে কি এখন জীবিত? না মৃত? পরক্ষণেই সে তার নিজের নাকে হাত দিয়ে দেখে বুঝল যে তার শ্বাস পড়ছে। তার মানে সে জীবিত। এই শ্বাস যাওয়া আসা করলেই যে মানুষ জীবিত থাকে, এ-কথা সে তার পালনকারী একজন বিদেহ দেশের দাসীর মুখে শুনেছিল।
সিদ্ধার্থ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। তার সমস্ত মনোযোগ মুহূর্তের মধ্যে চলে এল, তার নিঃশ্বাস আর প্রশ্বাসের দিকে। সে অজান্তেই পদ্মাসনে সোজা হয়ে বসল। এই নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রত্যবেক্ষণকে বলা হয় আনাপানস্মৃতি। যোগসাধনকারীরা এভাবে ধ্যান অভ্যাস করে থাকেন। জন্ম জন্মান্তরের সাধন অভ্যাসের ফলে সিদ্ধার্থ সহজেই মনোনিবেশ করতে সক্ষম হল। তার মন এরপর বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে গেল। সে সকলের অগোচরে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে সমাধিস্থ হয়ে পড়ল।
সূর্য মধ্য গগনে এসেছে। গাছের তলায়ও আর এতটুকু ছায়া নেই। প্রবল তাপে যেন চারদিক ঝলসে যাচ্ছে। তবে যেখানে সিদ্ধার্থ সমাধিস্থ হয়ে বসে আছে, সেখানে সেই জামগাছের তলায় অদ্ভুতভাবে এখনও শীতল ছায়া দেখা যাচ্ছে। সকলের দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে।
রাঁধুনী পাচকদের সঙ্গে দাসীরা কথায় ও গল্পে মেতে আছে। সিদ্ধার্থের দিকে তাদের খেয়ালই নেই। এমন সময় একটি ষাঁড় উন্মত্ত হয়ে মাঠের চারিদিকে ছোটাছুটি করতে লাগল। তা দেখেই হঠাৎ রাজা শুদ্ধোদনের সিদ্ধার্থের কথা মনে পড়ল। সর্বনাশ! সে কোথায়? রাজা ভয় পেয়ে, এবং কুমারের অনিষ্টের আশঙ্কায় দ্রুত অগ্রসর হলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে লোকজন নিয়ে ছুটে এলেন ময়দানের শেষ প্রান্তে সেই জামগাছটির তলায়। রাজকর্মীরা তৎপর হয়ে ষাঁড়টিকে ততক্ষণে শান্ত করে ফেলেছে। রাজা গাছতলায় এসে, গাছের তলায় শীতল ছায়া দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তারপর চন্দ্রাতপের তলায় এসে দেখলেন সিদ্ধার্থ সেখানে স্থির হয়ে বসে আছে। তার শরীরটি যেন একটি আলোকিত তুলাযন্ত্রের উপর বসানো, অর্থাৎ সিদ্ধার্থের শরীর মাটি স্পর্শ করে নেই। একটি আলোকবর্তিকার মধ্যে ভাসমান।
সিদ্ধার্থকে এমন অবস্থায় দেখে রাজা বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে গেলেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে ধ্যানরত সিদ্ধার্থের পায়ে নিজের মাথা রাখলেন। কুমারের জন্মের পরে দেবল ঋষির সঙ্গে সিদ্ধার্থকে বন্দনার পর এবার দ্বিতীয়বার রাজা সিদ্ধার্থকে প্রণাম করলেন। রাজকর্মচারীরাও রাজার দেখাদেখি রাজকুমারকে প্রণাম করলেন।
আশ্চর্য এই রাজকুমার সিদ্ধার্থ। তার জন্মলগ্ন থেকেই শোনা যায় নানা অলৌকিক ঘটনা! রাজকুমার বড় হয়ে অবশ্যই হবে প্রবল প্রতাপশালী একজন নৃপতি। বড় পবিত্র তার স্বভাব, এমন রাজা নিশ্চয় দয়ালু ও প্রজাবৎসলও হবে। তারা মগ্ন হয়ে এই বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। রাজা সিদ্ধার্থকে বুকে নিয়ে নানা কথা ভাবতে লাগলেন। জ্যোতিষী ও ঋষিরা রাজপুত্রকে নিয়ে নানা কথা বলেছেন। দেবল ঋষির ভবিষ্যতবাণী ভুলে যাননি রাজা। তিনি জানেন রাজপুত্র সিদ্ধার্থ অলৌকিক শক্তির অধিকারী এবং এক অসামান্য শিশু। রাজা সমাধিস্থ রাজকুমারকে কোলে করে রাজপুরীর দিকে এগিয়ে চললেন। এই ঘটনা রাজার মনকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করল।
৪
সিদ্ধার্থের শিক্ষা
সিদ্ধার্থের বয়স এখন আট। শুদ্ধোদন তার আমাত্যদের ডেকে সিদ্ধার্থের জন্য উপযুক্ত শিক্ষকের সন্ধান করতে বললেন। আমাত্যরা কপিলাবস্তুর মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত পণ্ডিত বিশ্বামিত্রের কথা রাজাকে এসে বললেন। উদীচ্য পরিবারের ব্রাহ্মণ বিশ্বামিত্র সিদ্ধার্থের শিক্ষার ভার নিলেন। অবশেষে জ্যোতিষীরা শুভদিন নির্ধারণ করে দিলেন। শাক্য আত্মীয়দের অন্যান্য কুমারদের সঙ্গে শুভক্রিয়া কর্ম পালন করে, কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে শাক্য রাজপরিবারের কুমারদের সঙ্গে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গুরুগৃহে যাত্রা করল।
সিদ্ধার্থ গুরুগৃহে চলেছে সোনার রথে চড়ে। অন্যান্য শাক্যপুত্ররা তার পেছন পেছন হাতে ঝুলন্ত কালির দোয়াত নিয়ে পায়ে হেঁটে পার্বত্যপথ পেরিয়ে চলল। সিদ্ধার্থের হাতে সুগন্ধী চন্দন কাঠের অনেকগুলি লিপিফলক, উৎকৃষ্ট লেখার কালিতে তার সোনার দোয়াতখানি পূর্ণ। এছাড়া তার হাতে আছে রত্নখচিত সোনার কলম বা লেখনী। সিদ্ধার্থের মন আজ আনন্দে পূর্ণ। গুরুগৃহে যাওয়ার জন্য তার মনে কোনও সংকোচ বা ভয় নেই।
শাক্যকুমারদের অভিবাদন করে পণ্ডিত বিশ্বামিত্র বললেন, ”কুমারগণ! তোমাদের যদি কোনও লিপি জানা থাকে, তাহলে তা তোমরা এখন লিপি ফলকে লেখো। এরপর সেই বুঝে আমি তোমাদের সবাইকে শিক্ষা দান করব।”
শাক্য কুমারেরা যে যা জানে, তাই লিখতে শুরু করল। সিদ্ধার্থও লিখতে বসলেন। তখন একটি ভারী আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। এর আগে সিদ্ধার্থ সবে সামান্য কিছু লিপি শিখতে শুরু করেছিল। কিন্তু হাতে কলম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরে যেন এক অপূর্ব শক্তি জেগে উঠল। সিদ্ধার্থ এক একটি চন্দন কাঠের ফলক হাতে নিতে লাগল এবং তাতে সুন্দর হস্তাক্ষরে এক একটি লিপি লিখে ফেলতে লাগল। এমন করে সে ব্রাহ্মী, খরোষ্ঠী, পুষ্করসারী, অঙ্গ লিপি, বঙ্গ লিপি, মগধ লিপি, দ্রাবিড় লিপি, উত্তরকুরুদ্বীপ লিপি, পূর্ব বিদেহ লিপি, দেব লিপি, কিন্নর লিপি, বজ্র লিপি, অপর গোদানি লিপি, উৎক্ষেপ লিপি, শকারি লিপি প্রভৃতি চৌষট্টি রকম লিপি লিখে বিশ্বামিত্রকে দেখাল। বিশ্বামিত্র বেশ কিছু লিপি জানতেন, তবে এত লিপির অক্ষর জানা দূরে থাক, তিনি এই বেশিরভাগ লিপির নাম পর্যন্ত শোনেননি। তিনি অবাক হয়ে সিদ্ধার্থকে ডাকলেন, ”কুমার তুমি এই এতগুলো লিপি কোথা থেকে শিক্ষা করেছ?
”আমাকে যারা দেখাশুনো করেন, তাদের বিভিন্ন জনের বিভিন্ন ভাষা। আমি তাঁদের কাছ থেকে তাঁদের ভাষাগুলো শিখে নিয়েছি। তাঁদের ভাষা থেকেই আমি বিভিন্ন প্রকার লিপিগুলি সহজেই আন্দাজ করতে পেরেছি। এখানে লিখতে বসে আমি সেই সব রকমের লিপিগুলিকে আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। সেইমতোই লিখেছি।”
”বিস্ময়কর!” বলে উঠলেন বিশ্বামিত্র।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজবাড়িতে খবর পাঠালেন, ”এমন বিস্ময়কর শিষ্যকে আর প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। কুমার চৌষট্টিটি লিপি সঠিকভাবে লিখতে সক্ষম। তাঁকে এখন পদক, বৈয়াকরণ, ষড়ঙ্গশাস্ত্র প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন এবং তা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণকারী শাক্যপুত্রদের সঙ্গে আর দেওয়া যাবে না। কারণ রাজকুমার সিদ্ধার্থ তাদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছেন।”
পণ্ডিত বিশ্বামিত্রের এই কথা শুনে রাজা সিদ্ধার্থকে যুদ্ধবিদ্যা অর্থাৎ যুদ্ধের কৌশল, কূটনীতি ইত্যাদি এবং সেনানীতি অর্থাৎ কোন সময়ে কীভাবে সেনা সজ্জিত করতে হয়, তা শিক্ষা করতে কুমারকে সুপ্রবুদ্ধের পুত্র ক্ষান্তদেবের কাছে পাঠালেন। রাজার নির্দেশে সিদ্ধার্থের সঙ্গে সেখানে শিক্ষা করতে এল বাকি শাক্য কুমারগণও।
কয়েকদিনের ভেতরেই সহজেই যুদ্ধ ও সেনানীতির সকল কৌশল রপ্ত করে ফেলল সিদ্ধার্থ। তবে তার সব থেকে আগ্রহ হস্তীবিদ্যার প্রতি। জঙ্গলের সেই ভীষণ অতিকায় জীবটিকে কী করে সহজে বশীভূত করতে হয়, তা জানতে সিদ্ধার্থের বড়ই কৌতূহল। রাজপুত্রের এই ইচ্ছার কথা জানতে পারলেন রাজা।
সেইসময় বহু ধরণের শিক্ষা পদ্ধতি সমাজে পরিচিত ছিল। তার মধ্যে হস্তীদমনবিদ্যা বা হস্তীবিদ্যা এবং ধনুর্বিদ্যা ছিল খুবই প্রচলিত। এ ছাড়া আরও কত ধরণের যে পেশা ও সেই বিষয়ের আচার্য ছিল তার ইয়ত্তা নেই।
যেমন সামুদ্রিক বিদ্যা, ভূতবিদ্যা, বায়সবিদ্যা, স্বপ্নলক্ষণ, পক্ষীবিদ্যা, মূষিকবিদ্যা, মৃগচক্র, বাস্তুবিদ্যা, দর্বিহোম, পক্কধ্যান প্রভৃতি আরও অসংখ্য বিদ্যা।
সামুদ্রিক বিদ্যা হলো দৈহিক লক্ষণের উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যত গণনা। ভূত বিদ্যা হলো অপদেবতা বা অশুভ শক্তির থেকে মুক্তিলাভের উপায় শিক্ষা। বায়সবিদ্যা অর্থাৎ কাক চরিত্র দেখে শুভাশুভ নির্ধারণ। স্বপ্নলক্ষণ হল স্বপ্নের ব্যাখ্যা ও তা থেকে ভবিষ্যত নির্ধারণ করা। পক্ষীবিদ্যা অর্থাৎ পাখিদের আচরণ থেকে লাভালাভের উপায় নির্ধারণ। মূষিকবিদ্যা হলো ইঁদুরে ছিন্ন বস্ত্র দেখে ভবিষ্যৎ জানার উপায়। মৃগচক্র হলো সমস্ত প্রাণীর ভাষা বুঝতে পারার শিক্ষা। বাস্তুবিদ্যা অর্থাৎ ভূমি দেখে তা বসবাসের জন্য শুভ কিনা তা নির্ধারণ। দর্বি হোমের দর্বি কথার অর্থ হলো হাতা। এই হোম শিক্ষায় কী ধরণের হাতা থেকে যজ্ঞে ঘি আহুতি দিলে কী প্রকারের ফল পাওয়া যায় তা শিক্ষা করানো হয়। পক্কধ্যান অর্থাৎ মানুষের অবশিষ্ট আয়ু সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী শিক্ষা। এ ছাড়াও সমাজে আরও অনেক ধরণের শিক্ষা ও পেশার মানুষ ছিলেন। যাইহোক, এরপর রাজকুমারের মানসিক অভিরুচি অনুযায়ী তার শিক্ষার বিষয় নির্ধারণ করা হল।
রাজার নির্দেশে রাজকুমার সিদ্ধার্থ এরপর এই হস্তীদমনবিদ্যা শিক্ষা করতে শুরু করল, সুলভ নামক একজন আচার্যের কাছ থেকে। আচার্য তাকে হস্তী বশীভূত করার কৌশল রপ্ত করালেও, তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, অল্প কিছুদিনের অভ্যাসে কী করে যেন রাজপুত্র অরণ্যের হাতিদের কথা বুঝতে সক্ষম হয়েছে। এ কী করে সম্ভব হয়! তিনি কুমারকে জিজ্ঞাসা করলেন, ”রাজকুমার আপনার কি হস্তীবাক্য বোধগম্য হয়?”
রাজকুমারের স্বভাব মধুর হলেও তিনি বড় স্বল্পবাক। সে পরিষ্কার করে এর উত্তরে তাঁকে কিছু জানাল না। তবে হস্তীবিদ্যা সিদ্ধার্থ ধৈর্য্য ধরে শিক্ষা করল। এরপর সহদেব নামক অপর একজন আচার্যের কাছে কুমার শিখল ধনুর্বিদ্যা।
দেবদত্ত ও সিদ্ধার্থের প্রথম শত্রুতা
এইসময় একদিন একটি ঘটনা ঘটলো। কপিলাবস্তুর উপর দিয়ে বয়ে গেছে রোহিনী নদী। নদীর অপর পাড়ে দেবদহ নগর। সেখানে থাকে কোলিতরা। বহু যুগ ধরে শাক্য ও কোলিতদের শত্রুতা প্রতিষ্ঠিত। রোহিনীর তীরে শাক্য রাজকুমারেরা প্রায়ই খেলাধূলা করতে আসে। মাঝে মাঝে তারা নৌকা নিয়ে নদী পারাপার করে। বহুদিন আগে রাজা শুদ্ধোদন দেবদহের রাজকুমারী দুজনকে বিবাহ করে দুই নগরের দীর্ঘ শত্রুতার অবসান ঘটাতে চাইলেও এখনও কপিলাবস্তু ও দেবদহ নগরের অধিবাসীদের মধ্যে শত্রুতার মনোভাব যায়নি। তারা নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে পরস্পর বিবাদমান হয়।
ক্রমশ
অলঙ্করণঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য