“হন্ডুরাসে তখন আমি গুয়ানা নামে এক স্থানীয় জেলের সহায়তায় চুটিয়ে মুক্তোর চাষ শুরু করেছি। আর তাতে ইলিকো আমার ওপর রেগে কাঁই হয়ে গেছে। ঐ এলাকায় মুক্তো চাষে ওরই ছিল এত কাল একাধিপত্য, যাকে বলে মুক্তো সম্রাট। একটা আমার মতো ভিনদেশি সেই রাজত্বে থাবা বসালে রাগ তো হবেই। ও তাই খবর পেলাম, আমাকে ওখান থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে সুপারি দিয়েছে সুকাবাকে; ইতিমধ্যেই গোটা চল্লিশ খুনের মামলা ঝুলছে যার নামে। কিন্তু তোমরা জানই তো, ঐ সংবাদে ভয় পাওয়ার বান্দা আমি মোটেই নই। অমন অনেক সুকাবাকে আমি…”
মনাদার কথা শেষ হল না। মা তারা রেস্টুরেন্টের ছ’নম্বর টেবিলের সামনে হঠাৎই তখন তনুর আগমন ঘটল। ওর মুখে চোখে বেশ একটা উত্তেজনার ছাপ। তা উত্তেজনা মানুষের নানা কারণে হতেই পারে, তা বলে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিচার করে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে তো। তনুটার সেসব বোধ কোনও কালেই নেই। তাই মনাদার কথার মাঝখানেই ও সটান মন্তব্য করে বসল, “আজ সকালে আমার ব্যাবসার কাজে একজনের সাথে দেখা করতে বজবজ পার হয়ে আছিপুর বলে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম, বুঝলি? কাজ মেটার পর ঐ লোকটাই আমাকে বাইকে চাপিয়ে কাছেই একটা চিনা মন্দিরে নিয়ে গেল। আমি তো অবাক! ওখানে দেখি রীতিমতো উৎসব চলছে। কলকাতা থেকে যে কত চিনা ওখানে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই! রঙিন মোমবাতি আর ধূপ জ্বেলে সবাই মন্দিরে দুই দেবদেবীর পুজো দিচ্ছে। মন্দিরের সামনে রাখা একটা বিরাট টেবিলে দেবতার উদ্দেশে দেওয়া হয়েছে ভোগ—গোটা শুয়োর আর মুরগির রোস্ট, মোমো, নানারকমের গোটা ফলমূল, আরও কত কী! মন্দিরের বাইরের মাঠে পোড়ানো হচ্ছে বাজি। কলকাতার এত কাছে চিনারা যে এভাবে উৎসব পালন করে, আজ ওখানে না গেলে জানতেই পারতাম না।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলার পর আমাদের মুখচোখ দেখে তনুর বোধহয় মালুম হল একটা বড়োসড়ো ভুল ও করে ফেলেছে। তখন পাপস্খালনের জন্য মনাদার দিকে তাকিয়ে বেশ মোলায়েম সুরে বলল, “আপনি বোধহয় ওদের কিছ একটা বলছিলেন, মনাদা। মাঝপথে ডিসর্টাব করে ফেললাম মনে হয়…”
কিন্তু আমরা তো বেশ ভালো করেই জানি, তনু যতই মলম লাগানোর চেষ্টা করুক তাতে কোনও কাজ হবে না। একবার গল্প বলায় বাধা পড়লে সেই বিষয় নিয়ে মনাদাকে তক্ষুনি মুখ খোলানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। হলও তাই। হন্ডুরাসে মনাদার অমন রোমহর্ষক মুক্তোচাষের বিবরণ মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল। আমরা খুব সঙ্গত কারণেই বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। আসলে অনেকদিন বাদে আমাদের আড্ডাখানায় মনাদাকে এরকম গল্প বলার মুডে পাওয়া গেছে। ভেবেছিলাম, ফেব্রুয়ারির শনিবাসরীয় এই শীতের সন্ধ্যাটা দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যাবে মনাদার হন্ডুরাসে মুক্তাভিযানের গা ছমছম করা কাহিনি শুনে। কিন্তু তনুটার জ্বালায় সে সাধ আর পূর্ণ হল না।
তবে মনাদার মুডটা সেদিন সত্যিই ফুরফুরে ছিল বলতে হবে। তাই তিনি হন্ডুরাসের প্রসঙ্গ ত্যাগ করলেও একেবারে গুম মেরে গেলেন না। বরং উলটে তনুকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি আছিপুর সংলগ্ন চিনেম্যানতলায় চিনাদের বার্ষিক নববর্ষ উৎসবের কথা বলছ? ওই উৎসবে প্রতিবছর কিন্তু শুধু কলকাতার চিনারা নন, সুদূর চিনদেশ থেকেও অনেক মানুষ যোগ দিতে আসেন। তবে ইদানিংকালে তাঁদের সংখ্যা অবশ্য অনেকটাই কমে গেছে।”
তনু এবার মনাদার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি চিনাদের ওই উৎসবের কথা জানেন?”
এইধরনের প্রশ্ন করলে সচরাচর মনাদা মুখে কিছু বলেন না। শুধু মুখমণ্ডলে ফুটিয়ে তোলেন একটা ক্ষমাসুন্দর অভিব্যক্তি। এবারেও তাই করলেন। মুখের ভাবটা দেখে মনে হল, যেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর মশায়কে বিধবাবিবাহের প্রচলন সম্পর্কে কিছু জানেন কি না জিজ্ঞাসা করা হয়েছে।
যাই হোক, মনাদার ঐ মুখ দেখেই আমরা বুঝে গেলাম, আজ হন্ডুরাস মিস হলেও চিনেম্যানতলা নিয়ে উনি মুখ খুলবেনই খুলবেন। আমাদের তো গল্প শোনা উদ্দেশ্য, তা সে বিদেশের হোক বা দেশের, কিছু যায় আসে না। অতঃপর, আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আমি তনুকে ধমকে উঠলাম, “তুই কি ভাবলি, চিনাদের ওই পরবের কথা শুনিয়ে তুই মনাদাকে চমকে দিবি? মনাদা ঐ চিনেম্যানতলার খবর তোর থেকে অনেক বেশি রাখেন।”
ওষুধে কাজ হল। মনাদা তনুর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন, “যে ভদ্রলোক তোমাকে মেলায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি তোমাকে ওই চিনা মন্দির সম্পর্কে আর কিছু বলেননি?”
তনু এবার মাথা চুলকে বলল, “হ্যাঁ, আরও কিছু কথা বলছিলেন বটে। অছুসাহেব বলে একজন চিনা ব্যবসায়ী নাকি অনেকদিন আগে ওখানে লোকজন নিয়ে এসেছিলেন, জমি নিয়েছিলেন, কারখানা বানিয়েছিলেন। তাঁর নাম থেকেই নাকি জায়গাটার নাম হয়েছে আছিপুর।”
“তা কাল তুমি ওই অছুসাহেবের সমাধিটা দেখে এসেছ নিশ্চয়ই?”
“কই, সমাধি-টমাধি কিছু দেখাননি তো!”
“সে কি! অছুসাহেবের সমাধিটা তো ঐ মন্দির থেকে বেশি দূরে নয়। অতটাই যখন গেলে, তখন সমাধিটা দেখে এলেই পারতে।”
“আসলে কাল আমার একটু তাড়াতাড়িও ছিল। তাই হয়তো আমাকে আর ওখানে… তবে উনি বলছিলেন, আছিপুরের অতীত ইতিহাস নিয়ে বজবজেরই কয়েকজন মানুষের লেখা কিছু বইপত্র নাকি ওঁর কাছে আছে। সামনের সপ্তাহেই আমাকে আবার নিজের কাজে ওখানে যেতে হবে। তখন বইগুলো উনি আমাকে পড়ার জন্য দেবেন বলেছেন।”
“সে তো ভালো কথা। তবে একটা ব্যাপার কী জান, ইতিহাসের সবকথা তো আর বইতে লেখা থাকে না, কিছু তথ্য সবসময় আড়ালেই থেকে যায়। তাই ইতিহাস বই পড়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতীতের সবটা জানা সম্ভব হয় না, তা সে স্থানীয় ইতিহাসের কথাই বল বা বৃহত্তর ইতিহাস। এই যেমন, আমি নিশ্চিৎ, আছিপুর নিয়ে লেখা ঐ ইতিহাস বইগুলোতে তুমি কখনওই কিম শেঙের নাম খুঁজে পাবে না। তাই জানতে পারবে না সে কেবল কৃতজ্ঞতাবশত টং অছুকে মিথ্যা খুনের দায় থেকে বাঁচাবার জন্য কী অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল বা অসুস্থ হতভাগ্য অন্নদাতার শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে রক্ষা করেছিল বুদ্ধ-তারাকে। কিংবা জানতে পারবে না পেলিমেমের সেই দূর সম্পর্কের ভাই, পেশায় দরজি, গোলাম আলির কথা, যার সাহায্য না পেলে একা কিমের পক্ষে কোনওদিনই নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা সম্ভব হত না, আর অছুসাহেবকে জীবদ্দশাতেই হয়তো শুনে যেতে হত যে তাঁর আরাধ্য গৃহদেবতারা শোভা পাচ্ছেন কোনও ভিনদেশি ধনকুবেরের ব্যক্তিগত সংগ্রহে।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে মনাদা আমাদের চারজনের মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। এটাই মনাদার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। গত কয়েকবছর ধরে দেখে আসছি। আসলে উনি একপলকে বুঝে নিতে চান, ওঁর মন্তব্য আমাদের মনে যথেষ্ট আলোড়ন তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে কি না। আমরাও এই অবস্থায় কী করতে হয় তা শিখে গেছি। গৌতম আর দেরি না করে পাঁচটা ওমলেটের অর্ডার দিয়ে দিল, সঙ্গে চা। আর শুভ মনাদাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, “কীসব বললেন, সব তো গুলিয়ে গেল, মনাদা। একটু খোলসা করে বলুন না।”
মনাদা যথারীতি গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন, “বলতে তো বাধা নেই, তবে তার জন্য আছিপুরের ইতিহাসটা একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। সময় লাগবে অনেকটাই। সে সময় তোমাদের আছে তো?”
আমি তৎক্ষণাৎ জোর গলায় বলে উঠলাম, “আলবাত আছে। আপনি শুরু করুন তো।”
আমি একথা বলা মাত্রই গৌতম, শুভ আর তনু বেশ নড়েচড়ে বসল। আর মনাদা একটা সিগারেট ধরিয়ে, তাতে পরপর দুটো সুখটান দিয়ে শুরু করলেন এক অনবদ্য কাহিনি। কী গল্প শোনালেন, সে কথা একটু বাদে বলছি। তার আগে আমাদের নতুন পাঠকদের কাছে মনাদার পরিচয়টা সংক্ষেপে একটু বলে নিই।
মনোতোষ পাল ওরফে মনাদার সাথে আমাদের প্রথম আলাপ এই ১/১, দেশবন্ধু রোডের মা তারা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টেই। দোকানের মালিক সুবীর আমাদের বন্ধু হওয়ায় এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতে আমাদের কোনও বাধা নেই। আমাদের আড্ডা মূলত বসে শনি আর রবিবারের সন্ধ্যায়। বছর কয়েক আগে একদিন হঠাৎই এখানে দ্য গ্রেট মনাদার আবির্ভাব ঘটে। প্রথম আলাপেই উনি আমাদের চার্লস ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন থিয়োরি আবিষ্কারের রোমহর্ষক কাহিনি শুনিয়ে চমকে দিয়েছিলেন। সেদিনই আমরা জানতে পেরেছিলাম, মনাদার ঠাকুরদার ঠাকুরদার বাবা সন্তোষ পাল ওরফে পল স্যান্টোস না থাকলে ডারউইনের পক্ষে ঐ যুগান্তকারী আবিষ্কারটি করা আদৌ সম্ভবই হত না।
আমাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই মনাদা শোনালেন তাঁর দ্বিতীয় গল্প। যা থেকে আমরা জানতে পারলাম, মনাদার জন্ম পৃথিবীর আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক পদ্ধতিতে হয়নি। ওঁর জন্ম হয়েছে ক্লোনিং পদ্ধতিতে। এবং উনিই এই বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র ক্লোনড মানুষ। এসব শুনে আমাদের অনেকেরই ভিরমি খাওয়ার হাল হয়েছিল বটে, তবে অন্যদিকে সেদিন থেকেই আমরা সকলে মনাদার ফ্যান হয়ে গেলাম।
পরবর্তীকালে উনি আমাদের আরও কয়েকটা অবিশ্বাস্য কাহিনি শুনিয়েছেন। সেগুলোর উল্লেখ এখানে আর করছি না, কারণ তা পড়ে স্বয়ং পাঠকও সংজ্ঞা হারাতে পারেন। সেক্ষেত্রে লেখক হিসাবে আমাকে চিরকাল একটা অপরাধবোধে ভুগতে হবে। আমাদের আড্ডাখানায় অবশ্য কালেভদ্রেই মনাদার আগমন ঘটে। তবে একবার ওঁকে দেখতে পেলেই আনন্দে আমরা আত্মহারা হয়ে যাই, আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি তাঁর অনবদ্য সব গল্পগাথা। আর কথা বাড়াব না, এবার আবার চলে আসি মনাদার সেই আছিপুরের ইতিহাস প্রসঙ্গে।
মনাদা বলতে শুরু করলেন, “সে প্রায় দুশো তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেকার কথা। ইতিমধ্যে ইংরেজদের কাছে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের আর বক্সারের যুদ্ধে মীরকাশিমের পরাজয় ঘটে গেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করে ফেলেছে গোটা বাংলা, বিহার আর উড়িষ্যায়। আর বাংলার বুকে ঘটে গেছে সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। ইতিমধ্যে কলকাতা নবগঠিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়ে উঠছে। এই সময় সুদূর চিন দেশ থেকে দু-একটা জাহাজ ভারতে আসতে শুরু করেছিল ব্যাবসার খাতিরে। তাদেরই মধ্যে একটা বাণিজ্যতরী হঠাৎ প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে দিকভ্রষ্ট হয়ে কোনওভাবে ঢুকে পড়েছিল হুগলী নদীর মোহনায়, আটকে পড়েছিল চড়ামাদারি বা চকখঞ্জাপুরের ঘাটে, যার উল্টোদিকেই উলুবেড়িয়া, তখনকার দিনে নদীবন্দর হিসাবে বেশ বিখ্যাত।
“যাই হোক, ঐ ঝঞ্ঝা-বিধ্বস্ত জাহাজটিতে যে চিনা দলটি ছিল, তারই নেতা ছিলেন টং অছু। উনি সদলবলে যাত্রা করেছিলেন চিনের ক্যান্টন বন্দর থেকে। লক্ষ্য ছিল কলকাতা। পথভ্রষ্ট হয়ে চড়ামাদারির চড়ায় ওঁদের জাহাজটা যখন আটকাল, তখন অছুসহ গোটা দলটাই ভীষণ ক্লান্ত, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর। এই অবস্থায় ডাঙায় নেমে ওঁরা খানিক অপ্রত্যাশিতভাবেই স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাছ থেকে পেলেন যথেষ্ট সহযোগিতা। আর তাতেই মনে হয় টং অছুর ভালো লেগে গেল জায়গাটাকে। একদিকে রাজারামপুর আর অন্যদিকে মায়াপুর নামের দুটো গ্রামের মধ্যবর্তী বিশাল উর্বর ফাঁকা জমি দেখে অছু সেখানে জমিয়ে চাষ-আবাদ করার পরিকল্পনা নিলেন। সঙ্গে একটা চিনা কলোনি গড়ার কথাও তাঁর মাথায় এল। কিন্তু শুধু ভাবলেই তো হবে না, জমিটা তো পেতে হবে। তাই আর দেরি না করে তিনি ঐ জমি লিজ নেওয়ার জন্য লিখিত আবেদন করলেন দেওয়ান বাহাদুরের কাছে। তখন বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস।”
“তাহলে সেই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এভাবে চিনাদের মতো বিদেশিদের ভারতের জমি লিজ দিত?” প্রশ্নটা শুভ করল।
মনাদা হেসে জবাব দিলেন, “দেবে না কেন? সে সময়ের অবস্থাটা একটু বোঝার চেষ্টা করো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সবে বাংলা, বিহার আর উড়িষ্যায় দেওয়ানি লাভ করেছে। রাজস্ব আদায়ের নানা ভাবনা তখন ওদের মাথায়। তার পরে পরেই ঘটে গেছে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। রাজ্যের জনসংখ্যার তখন বেশিরভাগই কৃষক। তাদের সংখ্যা ঐ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের জেরে হ্রাস পেয়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ফলে প্রচুর জমি পড়ে আছে অনাবাদী অবস্থায়। এছাড়া এমনিও বেশ কিছু ফাঁকা জমি স্রেফ বনজঙ্গলে ভরে পড়ে রয়েছে। এইরকম জায়গা খুঁজে বের করে আর পুরনো চাষের জমি পুনরুদ্ধার করে তা বাসযোগ্য করে তুলতে বা কৃষিকাজের আওতায় আনতে পারলে ভালো টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে। তাই ইংরেজরা চাইছিলই অনাবাদী ফাঁকা জমি ইজারা দিয়ে তার থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করতে।
“তাছাড়া সাহেবরা ভালোই জানত যে চিনারা খুব পরিশ্রমী জাতি। তাই জমি নিয়ে ওরা চাষাবাদ বা ব্যাবসাপাতি করলে, তাতে কোম্পানি আর্থিকভাবে লাভবানই হবে। আর যেখানে ঝুঁকিবিহীন লাভের প্রশ্ন, সেখানে জমি দিতে আপত্তি কোথায়? তাই অছু্র অনুরোধ উপেক্ষিত হল না। উনি সহজেই জমি পেয়ে গেলেন। ঠিক করে বললে, জমি পাওয়ার আশ্বাস পেয়ে গেলেন। খাতায় কলমে ইজারা অবশ্য তখনও পাননি। অছু কোম্পানির বড়োকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝে গেলেন, বজবজের ছয় মাইল পশ্চিমে যে জমিটা তিনি চাইছেন, সেটাই ওঁকে দেওয়া হবে। সে সময়ে বেনারসী ঘোষ নামে জনৈক ব্যক্তিকে ঐ জমিটা ইজারা দেওয়া ছিল। কিন্তু কিছু না করে ভদ্রলোক জমিটা জাস্ট ফেলে রেখেছিলেন। অতঃপর, ঐ জমিতে গিয়ে প্রাথমিক কিছু কাজ সেরে নিতে এখন কোনও সমস্যা নেই।”
“একে বলে এক্কেবারে পাক্কা ব্যবসায়ী, কী বলেন মনাদা?” তনু ফোড়নটা কাটল।
মনাদা তনুর বক্তব্যকে সমর্থন করে বললেন, “সে আর বলতে। নাহলে অতদূরে একটা অচেনা অজানা জায়গায় হঠাৎ হাজির হয়ে, সেখানকার স্থানীয় মানুষদের মধ্যে থেকে, তাদের আস্থা অর্জন করে এবং তাদেরই সাহায্য নিয়ে সেই যুগে অর্থ উপার্জনের একটা অত বড়ো কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলা, সেটা টিপিকাল ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি না থাকলে কখনও অছুর পক্ষে সম্ভব হত নাকি?”
“অত বড়ো কর্মকাণ্ড মানে? অছু ওখানে কী কী কাজ করেছিলেন?” এবার প্রশ্নটা আমি করলাম।
মনাদা জবাব দিলেন, “বজবজ বা আছিপুর এলাকাটা কলকাতা থেকে খুব দূরে না হলেও আজ থেকে ঐ প্রায় আড়াইশো বছর আগে জায়গাটা আসলে কিন্তু ছিল সুন্দরবন এলাকার অংশ। ফলে গাছপালার কোনও অভাব ছিল না। অছু প্রথমেই গাছের ডাল, বাঁশ, হোগলা দিয়ে বানিয়ে ফেললেন নিজের এবং সঙ্গীসাথীদের মাথা গোঁজার জায়গা।
“গোটা সুন্দরবন এলাকাটাতেই জান তো, দক্ষিণ রায়ের মন্দিরের ছড়াছড়ি। বাঘের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্যই দক্ষিণ রায় পূজিত হন। যদিও সে সময়ে চকমাদারির চরে বাঘের দেখা তেমন মিলত না, তবে দক্ষিণ রায়ের একটা মন্দির ওখানে অনেক আগে থেকেই ছিল। স্থানীয় মানুষের মন জয় করার জন্য অছু ঐ মন্দিরে পুজো দিলেন। তারপর গ্রামবাসীদের সাহায্য নিয়েই শুরু করে দিলেন জমি তৈরির কাজ। অছু যে জাহাজে চেপে এসেছিলেন, তাতে ছিল প্রচুর চায়ের পেটি। সেই চা উনি জমি তৈরির কাজে সাহায্যকারী স্থানীয় মানুষ আর দেশীয় সেপাইদের নিয়মিত খাওয়াতেন।”
“এই সেপাইরা আবার কোত্থেকে এল?” তনু জানতে চাইল।
“১৭৫৬ সালের ডিসেম্বরে বজবজে একটা যুদ্ধ হয়েছিল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর সিরাজের সেনাদের মধ্যে। এই যুদ্ধের কথা অবশ্য স্কুলের পাঠ্য বইতে পাওয়া যায় না। যাই হোক, সেই যুদ্ধে সিরাজবাহিনীর সেনাপতি ছিল মানিকচাঁদ। তার বিশ্বাসঘাতকতায় মূলত ঐ যুদ্ধে সিরাজবাহিনীর পরাজয় ঘটে। মানিকচাঁদ সোজা মুর্শিদাবাদে পালিয়ে যায়। এরপর থেকেই ওই বজবজ দুর্গে কোম্পানির সেপাই নিযুক্ত ছিল। যদিও তারা সবাই ছিল এদেশেরই লোক। সুতরাং বুঝতেই পারছ, ঐ এলাকায় থেকে চাষাবাদ করতে হলে শুধু স্থানীয় গ্রামবাসীদেরই নয়, ওই দেশীয় সেপাইদেরও খুশি রাখার কথা অছুকে মাথায় রাখতে হত। তাই ওই চা খাওয়ানোর ব্যবস্থা।
“আসলে এর আগে সেপাইরা তো তাড়ি ছাড়া আর কিছু খেত না। তাই অছুর দেওয়া গরম গরম চা খেয়ে তারা বেশ খুশিই হয়েছিল। অছু যখন নিজের দরকারে কলকাতা যেতেন, তখন কোম্পানির হোমরা-চোমরা সাহেবসুবোদেরও ঐ চা উপহার দিতেন। এমনকি নিজের হাতে চা বানিয়ে সার্ভও করতেন। ফলে একটা নতুন পানীয়ের আস্বাদ দিয়ে সেইসময়ে অছু এদেশের ছোটোবড়ো সবধরনের মানুষেরই মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।”
ঠিক এইসময়েই হোটেলের সবচেয়ে পুরনো কর্মচারী বিমলদা ওমলেট আর চা নিয়ে হাজির হল। আমি আবার চা দেখলে তাতে সঙ্গে সঙ্গে চুমুক না দিয়ে থাকতে পারি না। কিন্তু চা-টা মুখে দিতেই মেজাজটা আমার বিগড়ে গেল। বিমলদাকে বেশ ক্ষোভের সাথে জানালাম, “কী ব্যাপার! চিনির দাম কি হঠাৎ কমে গেছে নাকি? চায়ে এত গুচ্ছের চিনি দিয়েছ কেন?”
বিমলদা সঙ্গে সঙ্গে মাথা চুলকে বলল, “চিনি বেশি হয়েছে বুঝি? এবারটা কষ্ট করে খেয়ে নাও, পরেরবার কম করে দেব।” কথাটা বলেই ও আর একমুহূর্ত দাঁড়াল না, সুড়ুৎ করে সরে পড়ল।
এই দৃশ্য দেখা মাত্রই মনাদা মুচকি হেসে বললেন, “একে বলে ঘটনার সমাপতন, বুঝলে? অছু তাঁর জাহাজে শুধু চা নয় সঙ্গে চিনিও নিয়ে এসেছিলেন, যে জিনিসের সাথে তখনও আম-বাঙালির পরিচয় হয়নি। তারা গুড়ই কেবল চিনত। আমি সবে এই চিনির কথা বলতে যাচ্ছিলাম। আর তখনই বিমল এই বেশি চিনি দেওয়া চা নিয়ে হাজির হল।
“যাই হোক, যে কথা বলছিলাম। অছু এখানে কিছুদিন কাটিয়েই বুঝতে পেরে গেলেন কলকাতায় চিনির চাহিদা প্রচুর, বিশেষত সাহেবদের মধ্যে। আমাদের দেশে তখন জাভা সুমাত্রা থেকে চিনি আমদানি করা হত। অছু কোম্পানির কর্তাদের জানালেন যে তিনি তাঁর জমিতে চিনির কল বানাবেন। সাহেবরা তা শুনে তো বেজায় খুশি। এতে বাইরে থেকে চিনি আনার খরচ অনেক কমে যাবে। তারা কথা দিল, অছু চিনি তৈরি করলে তার সবটা কলকাতাই কিনে নেবে।”
“সে যুগে চিনি তৈরির একটা কারখানা বানানো, সে তো মস্ত হ্যাপার ব্যাপার, মনাদা?” গৌতম জিজ্ঞাসা করল।
“সে তো বটেই। প্রথমে জমিতে প্রচুর আখ চাষ করতে হবে। তারপর সেই আখ পিষে রস বের করে তা জ্বাল দিয়ে বানাতে হবে গুড়। সেই গুড় থেকে হবে চিনি এবং পুরো কাজটাই করতে হবে সেই অর্থে কোনও প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই, কেবল মানুষের কর্মক্ষমতার জোরে। কিন্তু অছু অতদিনে বুঝে গিয়েছেন, স্থানীয় মানুষজন ওখানে একনাগাড়ে বেশি খাটতে পারে না, শ্রমিক হিসাবে তারা মোটেও দক্ষ নয়। তাই এক্ষেত্রে চিনির কল স্থাপন করে তা ঠিকঠাক চালাতে গেলে জরুরি তাঁর দেশেরই দক্ষ, পরিশ্রমী শ্রমিক। তাছাড়া আগে থেকেই অছুর মনে এই ইচ্ছা ছিল, যে বিশাল জমি তিনি পেতে চলেছেন সেখানে তিনি স্বজাতীয় মানে চিনাদের একটা কলোনি গড়ে তুলবেন। অতঃপর উনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আবার দেশে ফিরে যাবেন। সেখান থেকেই নিয়ে আসবেন তাঁর স্বপ্নের চিনি কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক আর চকমাদারির পাড়ে নির্মাণ করবেন এক নতুন চিনা কলোনি।”
একথা শুনে আমি বললাম, “কিন্তু সেই সুদূর চিনদেশে যাওয়া তো মুখের কথা নয়। অছুর জাহাজটা তো ঝড়ে ভেঙে গিয়েছিল বলেছিলেন।”
মনাদা ইতিমধ্যে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছেন। তিনি একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে মন্তব্য করলেন, “সে তো গিয়েছিলই। সেটাকেই আবার উনি মেরামত করে সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার উপযোগী করে তুললেন। তারপর একদিন সত্যি সত্যিই ভেসে পড়লেন সমুদ্রে, নিজের মাতৃভূমির উদ্দেশে। যাত্রা শুরুর আগে অবশ্য দক্ষিণ রায়ের থানে প্রণাম করে গিয়েছিলেন। হাজার হোক বাঘের মতো প্রাণী ওঁকে ভয় করে বলে কথা।”
“অছু নির্বিঘ্নে দেশে ফিরতে পেরেছিলেন তো?” শুভ জিজ্ঞাসা করল।
“হ্যাঁ, এবার আর ঝড়ের কবলে পড়তে হয়নি। দেশে পৌঁছেই উনি অনেক কাজ সেরে ফেললেন। আগেই বলেছি, তিনি মনে মনে ঠিক করেই ফেলেছিলেন যে এবার ভারতে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে ব্যাবসা-বাণিজ্য করবেন। সেখানে স্থাপন করবেন একটা চিনা কলোনিও। অতঃপর, ক্যান্টনের সমস্ত পাট চুকিয়ে ফেলা জরুরি। তাই অছু ওখানে নিজের যা সম্পত্তি এবং জায়গাজমি ছিল, তা বিক্রিবাটার বন্দোবস্ত করে ফেললেন। তারপর খুঁজতে শুরু করলেন চিনি কারখানায় কাজ করার জন্য উপযুক্ত শ্রমিক।”
“ওখানে অছুর বৌ-বাচ্ছা ছিল না?” আমি জানতে চাইলাম।
মনাদা জবাব দিলেন, “বৌ ছিল কি না, আসলে তিনি বিবাহিতই ছিলেন কি না কিংবা বিবাহিত হলেও পত্নী-বিয়োগ হয়েছিল কি না, সে সম্বন্ধে কোনও পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এটুকু নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে তিনি একটি অনাথ মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন এবং তাকে একেবারে নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন। মেয়েটার নাম ছিল জুশি। সে নাকি আবার চিনের বিখ্যাত জিন রাজবংশের মেয়ে। রাজা-রাজড়ারা সবদেশে সবকালেই একটু অহংকারী আর গোঁয়ার প্রকৃতির হয়। জুশির চরিত্রেও পরবর্তীকালে সেই গোঁয়ার্তুমি প্রবলভাবে ফুটে উঠেছিল যা একেবারে ছারখার করে দিয়েছিল তার পালকপিতার জীবনটাকেই। সেই গল্পে খানিক বাদে আসছি।”
“তাহলে অছু ক্যান্টন থেকে ভারতে ফেরার সময় তার ওই পালিতা কন্যাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন?” গৌতম জানতে চাইল।
মনাদা উত্তরে বললেন, “হ্যাঁ, তা তো বটেই, আর সঙ্গে একশো দশজন দক্ষ চিনা শ্রমিক এবং অবশ্যই কয়েক পেটি চা। এছাড়া অছুর সঙ্গে ছিল অতি মূল্যবান সোনার তৈরি বুদ্ধরীতির দুটো মূর্তি। কেউ বলে ইয়ান আর ইং আবার কেউ বলে বুদ্ধ-তারা। আমারও মনে হয় ওই মূর্তিদুটো বুদ্ধ-তারারই ছিল। মূর্তিদুটো আগে ক্যান্টনে অছুর নিজস্ব মন্দিরে শোভা পেত। আসলে ঠাকুরদেবতার প্রতি অছুর বেশ ভালোই ভক্তি ছিল। ক্যান্টনের সমস্ত পাট যখন চুকিয়েই ফেললাম, ভারতেই যখন নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি, তখন আরাধ্য দেবতাও আমার সঙ্গেই যাবে – এই মনোভাব থেকেই অছু সম্ভবত ঐ স্বর্ণমূর্তি দু’খানা এদেশে নিয়ে এসেছিলেন। তবে ঐ দুই দেবদেবীকে নিয়ে তাঁকে যে অদূর ভবিষ্যতেই কী প্রবল দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে সে কথা অছু্র পক্ষে সেদিন কোনওভাবেই অনুমান করা সম্ভব ছিল না। করতে পারলে আশাকরি, ক্যান্টনের ঐ মন্দির থেকে তিনি মূর্তিদুটোকে ভুলেও বের করতেন না।”
এটুকু বলেই মনাদা আবার একবার থামলেন। এটাই ওঁর স্টাইল। আমরা ওঁর পরের কথাগুলো শোনার জন্য যে ভীষণ উদগ্রীব হয়ে উঠেছি, সেটা অবলোকন করে উনি মনে মনে বেশ তৃপ্তি অনুভব করেন। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, “অছু তাহলে কবে আবার এদেশে ফিরে এলেন?”
“১৭৮১-এর ফেব্রুয়ারির শেষে। চকমাদারিতে অছুর পুনরাগমনের সাথে সাথে ওখানে বেশ সাড়া পড়ে গেল। ওখানে পা দিয়েই অছু একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। ওঁর আরাধ্য বুদ্ধ-তারাকে স্থাপন করবেন কোথায়? গ্রামের লোকই সমস্যার সমাধান করে দিল। বলল, দেবতা দেবস্থানেই থাকবেন। দক্ষিণ রায়ের মন্দিরের কথা আগেই বলেছি। এলাকার লোকই ঠিক করে দিল, ঐ ব্যাঘ্রদেবতার পাশেই বুদ্ধ-তারা আসীন হবেন। অছুও আর আপত্তি করলেন না। উনি সেকালের এক ছোটোধরনের ইঁট দিয়ে দক্ষিণ রায়ের মন্দিরের পাশেই বানিয়ে ফেললেন একটি উপাসনা গৃহ, যাতে চৈনিক শিল্পকলার ছাপ ছিল স্পষ্ট। অতঃপর নির্মাণ হয়ে গেল একটি চিনা মন্দির।
“ওই এলাকার বেশিরভাগ মানুষই ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁদের কাছে ওই দুই চৈনিক দেবদেবী ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠল খোদা-খুদি নামে। আর ওই অঞ্চলটার নাম হয়ে গেল খোদাখুদিতলা। বলাই বাহুল্য, যার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের আদৌ কোনও সম্পর্কই ছিল না। ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয় যে আজকের তারিখেও ঐ মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ স্থানীয় এক মুসলিম পরিবারের মানুষই পাঁচ-পুরুষ ধরে করে আসছেন। কোনও একটা জায়গায় হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ, এই তিন ধর্মের এমনভাবে মিলেমিশে থাকার উদাহরণ শুধু ভারতবর্ষ কেন পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ!”
“এটা আপনি একেবারে ঠিক কথা বলেছেন মনাদা। কলকাতা থেকে আছিপুর তো বেশি দূরেও নয়। আমার মনে হয়, এরকম একটা জায়গা আমাদের সকলেরই একবার দেখে আসা উচিত।” মন্তব্যটা গৌতমের।
“বেশ তো, এ তো ভালো প্রস্তাব। সকলে মিলে একদিন গেলেই হয়। আমার কোনও আপত্তি নেই।”
শুভর ইতিমধ্যে আর বোধহয় তর সইছিল না। ও মনাদাকে তাড়া লাগাল, “সে নয় একদিন যাওয়া যাবে’খন। এবার আসল গল্পটায় আসুন। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর অছুসাহেব কী করলেন?”
“মন্দির প্রতিষ্ঠার পর অছু আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করলেন না। কলকাতায় গিয়ে গভর্নর সাহেবকে আবার একটা দরখাস্ত জমা দিলেন। অনুরোধ জানালেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন ওঁকে সরকারীভাবে জমির দখল দিয়ে দেওয়া হয়। কোন জমিটা উনি আগের আবেদনে চেয়েছিলেন সেটার উল্লেখ করতেও ভুললেন না।
“খুব দ্রুত অছুর আবেদনে সাড়া দেওয়া হল। ঐ চা খাওয়ানোর সুফল আর কি! অছু পেলেন মোট সাড়ে ছ’শো বিঘা জমির ইজারা। জমি হাতে পেয়েই অছু জোরকদমে কাজে নেমে পড়লেন। একদিকে যেমন ধান ও আখের চাষ শুরু করলেন, অন্যদিকে তেমন মন দিলেন চিনি কারখানা ও চিনা শ্রমিকদের থাকার জন্য নতুন এক কলোনি গড়ার কাজে। জানো তো, এটাই ভারতে গড়ে ওঠা প্রথম চিনিকল আর ভারতে প্রথম চিনা বসতি।
“অছু ঐ সময়ে তাঁর চিনি কারখানার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করতেন। তবে একথা ঠিক যে স্বভূমি থেকে চুক্তিবদ্ধ দক্ষ শ্রমিক নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই অছুর পক্ষে ঐ চিনিকল গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। একটা নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য অছু ঐ চিনা মজুরদের সঙ্গে থাকা-খাওয়া-নিরাপত্তা ও বেতনদানের চুক্তি করেছিলেন। বিনিময়ে তারা কথা দিয়েছিল, অছুর অধীনে থেকে কারখানায় উদয়াস্ত শ্রমদান করবে। এই কারণে ঐ ১৭৮১ সালের শেষ নাগাদই অছুর চিনিকলে হৈ হৈ করে উৎপাদন শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর রেকর্ড বলছে, পরের বছর এপ্রিলেই ঐ কারখানা থেকে কলকাতায় চিনি বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় দু’হাজার সের মানে উনিশ-কুড়ি কুইন্টাল।”
“বাব্বা, এ তো ভাবাই যায় না। সে যুগে সবে তৈরি হওয়া একটা চিনিকল থেকে মাত্র কয়েকমাসেই অত চিনি উৎপাদন! অছু তো অসাধ্য সাধন করেছিলেন বলতে হয়।”
আমার মুখে একথা শুনে মনাদা মন্তব্য করলেন, “সে তো বটেই। আবারও বলছি, অছুর পক্ষে একাজ করা সম্ভব হয়েছিল কেবল চিন থেকে নিয়ে আসা চুক্তিবদ্ধ ঐ একশো দশজন শ্রমিকের কর্মদক্ষতার জোরেই। মাটির কলসিতে করে অছুর কারখানার চিনি কলকাতায় পৌঁছাত, কখনও জলপথে আবার কখনও স্থলপথে। চিনির চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমানতালে বাড়তে লাগল মাটির কলসির চাহিদাও। পাশের গ্রাম রাজারামপুরে তাই একদল কুমোর বসে গেল পোড়ামাটির হাঁড়ি-কলসি বানাতে। মানে, তৈরি হল নতুন এক কুমোরবাড়ি। স্থানীয় বহু মানুষ, তাদের কেউ হিন্দু, কেউ বা মুসলমান, কারখানায় নানা জিনিস যোগান দেওয়ার কাজে নেমে পড়ল কোমর বেঁধে। ওরা কারখানায় ও চিনা কলোনিতে জ্বালানি, হাঁড়ি-কলসি, খাবার বা নৌকা সরবরাহ করত। আবার কেউ বা খোদাখুদিতলায় পুজোর সামগ্রী যোগান দিত। এই কারণে ওখানে চিনাদের কলোনি বাদ দিয়েও নতুন কিছু বসতি গড়ে উঠল এবং খুব শীঘ্রই ওই এলাকা টং অছুর নামানুসারে আছিপুর বলে খ্যাত হয়ে উঠল।”
“অছুর প্রবল উৎসাহ আর কর্মক্ষমতার জোরেই এই অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছিল, তাই তো, মনাদা?”
“সে তো বটেই। তবে এক্ষেত্রে পেলির কথা ভুললেও চলবে না। ঐ মহিলাটি না থাকলে অছুর পক্ষে নিজের শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক রেখে কখনওই ঐ গোটা কর্মকাণ্ড দিনরাত তদারকি করা সম্ভব হত না।”
“তা ওই পেলি মহিলাটি আবার কে? তাকেও কি অছু নিজের দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলেন নাকি?” তনু জানতে চাইল।
“না না, পেলি ছিলেন এদেশেরই মানে ওই চকমাদারিরই একজন মুসলিম মেয়ে। অছু ১৭৭৮-এ প্রথমবার যখন ওখানে এসেছিলেন, তখন থেকেই পেলি ওঁর দেখাশোনা করতেন। তারপর ৮১-তে পাকাপাকিভাবে এদেশে চলে আসার পর সেই পেলিই অছুর খাওয়াদাওয়া, শরীর-স্বাস্থ্যের ওপর চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখতেন। অছুর বাড়িই হয়ে গিয়েছিল ভদ্রমহিলার স্থায়ী বাসস্থান। অছুও পেলিকে খুবই পছন্দ করতেন এবং পরবর্তীকালে পেলিকে বিয়েও করেছিলেন বলে শোনা যায়। সেই সময়ে ভিনদেশি বড়োলোক হওয়ায় এলাকার লোক অছুকে সাহেব বলে সম্বোধন করত। আর সাহেবের বউ তো মেম হবেই। তাই এলাকার মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ঐ মহিলা অচিরেই স্থানীয় মানুষজনের কাছে পেলিমেম নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। সুতরাং, পালিতা কন্যা জুশি আর বউ পেলিমেমকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল অছুসাহেবের ব্যক্তিগত সুখের সংসার।
“অছু প্রতিদিন সকালবেলাই জলযোগ সেরে সোজা চিনি কলে চলে যেতেন। সেখানে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ তদারকি করতেন। মাঝেমধ্যে আবার দু-একজনকে সঙ্গে নিয়ে চলে যেতেন আখ ও ধানক্ষেত পরিদর্শনে। দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য হয়তো বাড়ি ফিরতেন স্নান-খাওয়ার জন্য। কাজের চাপ বেশি থাকলে জুশিই চিনিকলে অছুর খাবার নিয়ে হাজির হত। আবার অনেক সময়ে সে বাবাকে ব্যাবসার নানা কাজে সাহায্যও করত। এইভাবে বেশ কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। এরপর একদিন একটা ঘটনা ঘটল।”
“কী ঘটনা, মনাদা?” আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম।
মনাদা এক ঢোঁক জল খেয়ে নিয়ে বললেন, “একদিন সন্ধ্যাবেলা চিনিকলের কাজ তদারকি করে অছু নিজের ঘরে ফিরছেন, এমন সময় রাস্তার পাশের একটা গাছের তলা থেকে গোঙানির শব্দ শুনতে পেলেন। কাছে গিয়ে দেখলেন, একটা অল্পবয়সী ছেলে, বয়স বড়োজোর কুড়ি-বাইশ হবে, প্রায় অচেতন অবস্থায় গাছের তলায় পড়ে আছে। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার গা। অছু সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় কয়েকজন মানুষের সহায়তায় তাকে নিয়ে এলেন নিজের বাড়ি। অসুস্থ ছেলেটা কিন্তু ঐ এলাকার বাসিন্দা নয়। তাকে কেউ চেনেও না।
“যাই হোক, পেলিমেম আর জুশির পরিচর্যায় সে পরদিন সকালে বেশ খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠল। ছেলেটি অছুকে জানাল, কাজের সন্ধানে সে নাকি আগেরদিন বিকালে আছিপুরে এসেছিল। কলকাতা বন্দরে সে কিছুদিন মজদুরি করেছে। সে কাজ তার পোষায়নি। তারপর লোক মুখে এই চিনিকলের কথা শুনে তার এদিকে আসা। কলকাতা থেকে সে হেঁটেই আসছিল, কিন্তু পথেই জ্বরে কাবু হয়ে পড়ে। কোনও মতে বিকালের দিকে আছিপুর পৌঁছায় বটে, কিন্তু শরীর আর সায় দিচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই সে ঐ গাছতলায় শুয়ে পড়ে। তারপর আর কিছু তার মনে নেই। এসব কথা সে অছুকে চিনা ভাষাতেই বলেছিল, সঙ্গে জানিয়েছিল যে তার নাম কিম শেং।
“নামটা শুনেই অছুর সন্দেহ হল। ছেলেটা নিজেকে চিনা প্রমাণ করতে চাইছে বটে, কিন্তু ওর চেহারাটা মোটেই চিনাদের মতো নয়, বরং একজন আম-ভারতীয়ের মতো। চিনাদের তো চোখ-নাক এরকম হয় না।
“একথা ছেলেটাকে বলতেই তৎক্ষণাৎ সে জবাব দিল যে তার বাবা একজন চিনা হলেও মা ভারতীয় বাঙালি। দেহের গড়নটা সে মায়ের মতোই পেয়েছে। বিশ বছর আগে নাকি তার বাবা চিন থেকে এদেশে এসেছিল। কাজ নিয়েছিল কলকাতা বন্দরে। সে সময়েই তার মায়ের সাথে বাবার আলাপ ও বিয়ে হয়। কিছুদিন আগে একটা দুর্ঘটনায় তার বাবার মৃত্যু হয়েছে। কিম তাই সংসার চালানোর জন্য ঐ কলকাতা বন্দরেই কাজে লেগে পড়ে। কিন্তু সেখানে খাটুনির তুলনায় বেতন খুব কম, ওপরওলারা খুব খারাপ ব্যবহারও করে। তাই আছিপুরে একটা নতুন চিনা কলোনি ও চিনিকল গড়ে উঠেছে শুনে সে এখানে এসে পৌঁছেছিল একটা কাজ জোটাতে। কিন্তু জ্বরে কাবু হয়ে তার আর কাল চিনিকলে যাওয়া হয়নি।
“অছু ছেলেটার কথা কতটা বিশ্বাস করেছিলেন জানি না, তবে ওকে তিনি চিনিকলে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে চিনা কলোনিতে থাকার ব্যবস্থাও। ওদিকে এক সপ্তাহের মধ্যেই কিম অছুর মন জয় করে নিয়েছিল। সে যেমন পরিশ্রমী, তেমন বিশ্বাসীও বটে। এরপর থেকে অছু ওকে সঙ্গে নিয়ে প্রায়ই বেরিয়ে পড়তেন চাষবাস দেখার কাজে। চাষাবাদ তো মূলত স্থানীয় কৃষকেরাই করত। কিম চিনা ভাষার সাথে বাংলাটাও জানত বলে চাষীদের সঙ্গে মত বিনিময় করতে বা তাদের কোনও নির্দেশ দিতে অছুর খুব সুবিধা হত।”
“তাহলে কিম আছিপুরে চিনিকলের শ্রমিক হতে গিয়ে আসলে দোভাষীর চাকরি পেয়ে গেল, কী বলেন মনাদা?”
“তা একরকম বলতে পার। অছু ওকে চিনিকলে কাজের দায়িত্ব কমিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে নিজের নানা কাজেই ব্যবহার করতে শুরু করলেন। মাঝেমধ্যে দুপুরবেলা নিজের বাড়িও নিয়ে যেতেন। ওকে নিয়েই সারতেন দিনের খাওয়া। এইভাবে অল্পদিনের মধ্যেই অছু ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে কিমের বেশ একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। ওদিকে আছিপুরের চিনিকল আর চিনা কলোনির জনপ্রিয়তাও বাড়তে লাগল হু হু করে। কলকাতা থেকে তখন প্রায় দিনই দু-একজন করে চিনা শ্রমিক অছুর কাছে আসতে লাগল কাজের আবেদন নিয়ে। তাদের বেশিরভাগকেই অছু চাকরিও দিলেন, কারণ সে সময়ে কলকাতায় চিনির চাহিদা দিন কে দিন বেড়ে চলেছে। সেই অনুপাতে উৎপাদনও তো বাড়ানো চাই। তার জন্য দরকার আরও শ্রমিকের। তাই নতুন মজুর তো নিয়োগ করতেই হবে। আর এই সুযোগটাই খুব ভালোমতো কাজে লাগিয়েছিল ফেং তাও।”
“এই ফেং তাওটা আবার কে?” শুভ জানতে চাইল।
“অছুর জীবনে সাক্ষাৎ শনি বলতে পার।”
এটুকু বলেই মনাদা একদম গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমাদের আর বুঝতে অসুবিধা হল না যে শুকনো গলায় বেশিক্ষণ কথা বলা বড়োই কষ্টকর। তাই সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হল আরও একপ্রস্থ চায়ের অর্ডার। শুভ আবার তার সাথে পাঁচটা কাটলেটও যোগ করল।
মনাদাও মুখ খুললেন, “ফেং তাও নিজেকে শ্রমিক পরিচয় দিয়ে অছুর কারখানায় কাজ নিয়েছিল বটে, কিন্তু আসলে সে ছিল চিনের জিয়ামেন শহরের একজন কুখ্যাত গুন্ডা এবং আফিমের চোরাচালানকারী। সেখানে একাধিক ডাকাতি ও খুনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে গিয়েছিল। তাই নিশ্চিত হাজতবাস এড়াতে সে একটা জাহাজের খালাসি সেজে কলকাতায় পালিয়ে আসে। তারপর আছিপুরের চিনা কলোনির খবর পেয়ে সেখানে হাজির হয়। দুর্দান্ত ক্রিমিনাল হলেও তার চেহারাটা ছিল খুবই আকর্ষণীয়। আর প্রথম ক’দিন সে চিনিকলে কাজও করেছিল যথেষ্ট মন দিয়েই। তাই অছুর আস্থা অর্জন করতে তাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। আর সেটা হয়ে যেতেই ফেং নেমে পড়েছিল নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে।”
“নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধি মানে? কী মতলবে ফেং ওখানে গিয়েছিল?” তনু প্রশ্ন করল।
মনাদা জবাবে বললেন, “মতলবটা যে ভীষণ খারাপ ছিল, তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই। আসলে কলকাতায় এসে ফেং শুরু করে দিয়েছিল আফিম চোরাচালানের ব্যাবসা। সে সময়ে আসাম ও বিহারের একটা বিরাট অংশ জুড়ে আফিমের চাষ হচ্ছে, চিনে যার ব্যাপক চাহিদা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চাষীদের কাছ থেকে সেই আফিম কিনে তা বড়ো ব্যবসায়ীদের কাছে নিলামে বিক্রি করে দিত। আর বড়ো ব্যবসায়ীরা তা নিয়ে পৌঁছে যেত চিনের উপকূলে। তারপর চোরাপথে সেই মাদক ঢুকে পড়ত চিনের অভ্যন্তরে।
“তবে ঐ আফিম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এড়িয়ে সরাসরি চাষীদের কাছ থেকে কিনে লুকিয়ে চিনে পৌঁছে দিতে পারলে বেশ ভালো টাকা কামিয়ে নেওয়া যায়। ফেং এই কাজটাই করত। কিন্তু কাজটা গুছিয়ে করতে হলে তেমন করিৎকর্মা লোকও চাই। তাই নিজের চোরাচালানের ব্যাবসায় লোক বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়েই ফেং এসেছিল আছিপুরের চিনা কলোনিতে। অছুর চিনিকলের শ্রমিকদের বেশি আয়ের লোভ দেখিয়ে সে চেয়েছিল নিজের দল ভারী করতে। আসলে যত বেশি লোক চোরাচালানে সে লাগাতে পারবে, তার ইনকামও বাড়বে সেই অনুপাতে।”
“এ তো মারাত্মক পরিকল্পনা! তা ফেং কি তার কাজে সফল হয়েছিল?” শুভ জানতে চাইল।
“শতকরা একশো ভাগ।” মনাদা জবাবে বললেন। তারপর আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে বলতে শুরু করলেন, “অছুর চিন থেকে আনা শ্রমিকদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে সে মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে কলকাতায় নিয়ে যেতে পেরেছিল। কিন্তু কাজটা সে করেছিল অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। তবে শুধু ফেং তাও-ই নয়, ওখানে ইতিমধ্যে আরও কিছু অসাধু মানুষ শ্রমিক সেজে চিনিকলে কাজ নিয়ে ঐ একই কুকাজ করছিল। ফলে অচিরেই অছুর কারখানায় শ্রমিক সমস্যা শুরু হয়ে গেল। রোজই দু-একজন কারখানা ছেড়ে চলে যায়। এমন চললে তো আর ব্যাবসা হয় না। তাই অছু কলকাতায় গিয়ে গভর্নরের শরণাপন্ন হলেন ১৭৮২-র নভেম্বরে।
“তাঁর নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে যারা আছিপুর চিনিকল থেকে শ্রমিক ভাঙিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের সতর্ক করে সরকারী গেজেটে একটা বিজ্ঞপ্তিও জারি হল। কিন্তু তাতে কাজের কাজ বিশেষ হল না। আসলে আফিমের চোরাচালান তখন রমরমিয়ে চলছে। কলকাতার অনেক ধনীব্যক্তি এবং কোম্পানির বেশ কিছু সাহেবসুবোও লুকিয়ে সেই কারবারে নেমে পড়েছে। তাই আফিমের চোরাচালান ঠেকাতে কোম্পানিরই বা বিশেষ উৎসাহ থাকবে কেন? ফলে অছুর কারখানায় শ্রমিক সমস্যা আর চিনা কলোনিতে নানা অশান্তি দিন দিন বাড়তেই থাকল।”
“এর পেছনে কাদের হাত আছে তা অছু জানতে পারেননি?”
আমার এই প্রশ্নের উত্তরে মনাদা বললেন, “সেই কথাতেই আসছিলাম। কারখানায় শ্রমিক ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে কারা আছে তাদের নাম কিমই জানিয়েছিল অছুকে। সঙ্গে মালিককে এই বলে সাবধানও করে দিয়েছিল যে ওদের সামনে তার কথা অছু যেন ভুলেও না বলে ফেলেন। তাহলে ভবিষ্যতে ওরা সতর্ক হয়ে যাবে, তখন কিম ওদের হালচালের আর কোনও খবরই জোগাড় করতে পারবে না। কিম যাদের নাম অছুর কাছে করেছিল, তাদের মধ্যে ফেং তাও-ও ছিল।
“অছু তাদের সকলকে একদিন আলাদা করে ডেকে পাঠালেন। তারপর রীতিমতো ধমক-ধামক দিতে শুরু করলেন। বাকি সকলে চুপচাপ থাকলেও ফেং কিন্তু নীরব রইল না। সে বিনীতভাবে অছুকে বোঝাতে লাগল যে ওকে মিথ্যাই সন্দেহ করা হচ্ছে। অমন কাজ সে আদৌ করেনি। সেদিন নিজের কথা বলতে গিয়ে ফেং আবেগের বশে অছুর হাতদুটোও চেপে ধরেছিল। তাতে অছু ওর প্রতি খানিকটা নরম হয়ে পড়েছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন কিম ওর সম্পর্কে ভুল খবর দিয়েছে। আসলে ফেং যে কেন সহসা অতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল, তার আসল কারণটা যদি অছু সেদিন বুঝতে পারতেন তাহলে উনি মোটেই…”
“আসল কারণ? সেটা কী, মনাদা?” শুভ উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল।
“সেটা একটু পরে বলছি। তার আগে ঐ ঘটনার দু’দিন বাদে কী ঘটেছিল, সেটা বলে নেওয়া জরুরি। আগেই বলেছি, আছিপুরে চিনিকল চালু হওয়ার পর অনেক চিনা মজুর কলকাতা থেকে অছুর কাছে আসত সেখানে কাজ চাইতে। তাদের অনেককে অছু নিজের চিনিকলে বহালও করতেন। সকলেই যে মন দিয়ে কাজ করত এমনও নয়। ফলে তাদের নিয়ে অছুকে মাঝেমধ্যেই বেশ সমস্যায় পড়তে হত। তেমনই একজন ছিল সু জং। কাজে তার বিশেষ মন তো ছিলই না, উপরন্তু অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে নিয়মিত সে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ত।
“যেদিনের কথা বলছি, সেদিন জং অছুর সামনেই এমনই এক ঝামেলা পাকিয়ে বসেছিল। অছুর মেজাজটাও সেদিন বিশেষ ভালো ছিল না। উনি কারখানার মধ্যেই সেদিন জংকে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিলেন। তারপর সতর্ক করে বললেন, আর কোনওদিন বেগড়বাই দেখলে ওকে কারখানা থেকে তাড়িয়েই দেবেন। জংও সেদিন ছিল বোধহয় মদ্যপ অবস্থায়। তাই সে চাকরি খোয়ানোর পরোয়া না করে কারখানার মধ্যেই অছুকে রীতিমতো গালাগাল করতে শুরু করে দিল। তারপর গটগট করে বেরিয়ে গেল ওখান থেকে। বলাই বাহুল্য, জংয়ের এই আচরণ সেদিন অছুর আত্মসম্মানে ভীষণ আঘাত করেছিল। উনি সকলের সামনেই চেঁচিয়ে জংয়ের উদ্দেশে বললেন, আর কোনওদিন ওই আছিপুর চত্বরে তাকে দেখতে পেলে একেবারে জানে মেরে ফেলবেন।
“এই সুযোগটাই দারুণভাবে কাজে লাগাতে চেয়েছিল ফেং তাও। সু জং কারখানা থেকে বেরিয়ে সেদিন চিনা কলোনিতেই ফিরে গিয়েছিল। ভেবেছিল পরদিন ভোরবেলাই আছিপুর ছেড়ে চলে যাবে। ফেং তাই আর এতটুকু সময় নষ্ট করেনি। সেদিন রাত্রিবেলাই জংকে সে নিজের চেলা মারফত ভরপেট মদ খাইয়ে নিয়ে গিয়েছিল নদীর ধারে। রাত্রিবেলা ওদিকটা একদম শুনশান থাকে। ফেং ওখানে আগে থেকেই একটা পাথরের আড়ালে অপেক্ষা করছিল, লোহার রড হাতে নিয়ে। জংয়ের তখন নেশার চোটে একেবারে বেসামাল অবস্থা। ফেং আর দেরি করেনি। পেছন থেকে সজোরে আঘাত করেছিল জংয়ের মাথায়। বেচারি সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। আর ফেং তৎক্ষণাৎ নিজের পকেট থেকে একটা আংটি বের করে মৃত জংয়ের ডানহাতের মুঠোয় গুঁজে দিয়ে চম্পট দিয়েছিল ওখান থেকে।”
“ফেং ওভাবে একটা লোককে মেরে ফেলল?”
“এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? খুনখারাপি সে তো নিজের দেশে থাকতেও অনেক করেছে। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ও-কাজ করতে তার কোনওদিনই হাত কাঁপেনি।”
“ওই আংটির ব্যাপারটা কী? আংটিটা ফেং জংয়ের হাতে গুঁজে দিয়েছিল কেন?”
“আংটিটা অছুর ছিল যে। মৃত জংয়ের হাতে লোকে ওটা দেখলে খুনের দায়টা সোজা অছুর ঘাড়ে গিয়ে পড়বে, এমনই মতলব ফেঁদেছিল সে। কিন্তু কিম যে তাকে গোপনে অনুসরণ করবে, সেটা ফেং ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।”
এবার আর আমি চুপ থাকতে পারলাম না। বললাম, “কিম ফেংকে ফলো করেছিল বলছেন? ফেংয়ের মতলবটা ও টের পেল কী করে?”
মনাদা ততক্ষণে আরও একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছেন। তাতে দুটো সুখটান দিয়ে উনি বলতে শুরু করলেন, “কিম সেদিন লক্ষ করেছিল, অছু জংকে রেগেমেগে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ার পরেই ফেং তার এক চেলাকে ডেকে ফিসফিস করে কী যেন বলছে। তা দেখেই কিমের সন্দেহ হয়। সন্ধ্যাবেলা তাই কারখানার কাজ শেষ হতেই ও সোজা চলে যায় চিনা কলোনিতে, আর নজর রাখতে শুরু করে ফেং ও তার চেলার গতিবিধির ওপর। কারণ, কিম বুঝে গিয়েছিল যে জং আজ রাতটা ঐ কলোনিতেই থাকবে এবং ফেং তার সঙ্গে যোগাযোগ করবেই। হয়েছিলও তাই। খানিক বাদেই ফেঙের ওই চেলা জংকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল কলোনির পেছনের একটা ফাঁকা জায়গায়। তারপর সেখানে তাকে ভরপেট মদ খাইয়ে কিছু একটা বুঝিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ওই নদীর ধারে।
“জংকে সাথে নিয়ে ফেংয়ের ঐ চেলা নদীর দিকে রওনা হওয়ামাত্রই কিম তাদের অনুসরণ করে এবং একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে জংকে হত্যা করার ঘটনাটাও নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে। এবার ফেং ওখান থেকে সড়ে পড়ার পরেই সে হাজির হয় জংয়ের মৃতদেহের পাশে। খুলে দেখে তার ডানহাতের মুঠো। তার মধ্যে ছিল ঐ আংটিটা। ওটা কার আংটি তা চিনতে কিমের অসুবিধা হয়নি এবং বুঝে ফেলতে তার অসুবিধা হয়নি ফেংয়ের কুমতলবটাও। কিম সঙ্গে সঙ্গে একটা দারুণ সিদ্ধান্ত নেয়। সে ঐ আংটিটা সু জংয়ের মুঠো থেকে বের করে ওখান থেকে চলে আসে।”
“ফেং অছুর ওই আংটিটা পেল কোথা থেকে?”
“অছুর আঙুল থেকে, আবার কোথা থেকে? আরে বাবা, দু’দিন আগে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে অছুর হাত ধরে বসার সেটাই তো ছিল আসল কারণ। আংটিটা সে ঐ সময়ে খুলে নিয়েছিল কোনও একটা সময়ে অছুকে ফাঁদে ফেলবে বলে। কিন্তু জংয়ের সূত্রে সেই সুযোগটা যে দু’দিন বাদেই চলে আসবে, সেটা অবশ্য ফেং আশা করেনি।”
“আংটিটা মৃত জংয়ের হাতে পাওয়া গেলে সকলে তার খুনি হিসাবে অছুকেই সন্দেহ করত। তাই তো, মনাদা?”
“তা তো বটেই। তখন কোম্পানির সেপাইরাও বাধ্য হত অছুকে জেলে পুরে দিতে। ফেং আর তার চেলারা হয়তো মিথ্যা সাক্ষ্যও দিতে পারত। সেক্ষেত্রে অছুকে খুবই বিপদে পড়তে হত। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হত। কিন্তু কিমের কল্যাণে সেই বিপদে তাঁকে পড়তে হয়নি।”
“কিম তাহলে অছুকে সবকথা তক্ষুনি জানিয়ে দিয়েছিল। তাই তো, মনাদা?”
“একেবারেই নয়। কিম অছুকে কিচ্ছুটি জানায়নি। কারণ, সে বুঝেছিল, অছুকে সব জানালে তিনি আর নিজের রাগ সম্বরণ করতে পারবেন না। সোজা গিয়ে সেপাইদের কাছে নালিশ জানিয়ে ফেংকে তাদের হাতে তুলে দেবেন। তখন সাক্ষী হিসাবে কিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, মানে তার পরিচয় ফেং ও তার সঙ্গীসাথীদের কাছে প্রকাশিত হয়ে যাবে। এই অবস্থায় সে আর কোনওদিনই গোপনে তাদের কার্যকলাপ লক্ষ করে অছুকে সাহায্য করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, এই খুনের সাক্ষী একমাত্র সে। অথচ ওখানে ফেংয়ের বেশ কয়েকজন চেলা আছে। তাই তাদের মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ফেং বেকসুর খালাস পেয়েও যেতে পারে। তাতে লাভের লাভ তো কিছুই হবে না, উলটে সে পড়ে যাবে ফেংয়ের রোষে। আর ফেং যে-ধরনের লোক, তাতে নিজের জীবন বাঁচানোই কিমের পক্ষে মুশকিল হয়ে যাবে। এসব ভেবেই কিম চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করেছিল। তবে ফেং তাও যে তার মালিকের চরম সর্বনাশ করার আরও আয়োজন করে ফেলেছে, সেটা সে অতদিন ঐ চিনা কলোনিতে থেকেও ঘুণাক্ষরে টের পায়নি।”
ঠিক এই সময়েই চা আর কাটলেট নিয়ে বিমলদার আবির্ভাব ঘটল। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার চা-টা চুমুক দিয়ে দেখ, ঠিক আছে কি না।”
আমি তাই করলাম। হেসে বললাম, “একদম ঠিক আছে।”
বিমলদা তা শুনে গর্বিত মুখে বিদায় নিল।
মনাদা ইতিমধ্যে একটুকরো কাটলেট নিজের মুখে চালান করে দিয়েছেন। গৌতম বোধহয় একটু বেশিই অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। কাটলেট না ছুঁয়েই ও জানতে চাইল, “অছুর চরম সর্বনাশ বলতে কী বোঝাতে চাইছেন দাদা? ফেং কি চিনিকলের সব শ্রমিককে ভাঙিয়ে কলকাতা নিয়ে চলে গিয়েছিল নাকি?”
“আরে না না। সেটা কখনও একা ফেংয়ের পক্ষে সম্ভবও ছিল না। তবে ও যা করেছিল তা অছুর পক্ষে কারখানার সব শ্রমিক ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়ার থেকেও বেশি বেদনাদায়ক।”
আমরা প্রায় সবাই একসাথে বলে উঠলাম, “মানে?”
মনাদা কাটলেটটা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “মানে আর কী! ফেং চিনিকলে চাকরি নেওয়ার ক’দিন পর থেকেই গোপনে অছুর মেয়ে জুশির সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছিল। আমি আগেই বলেছি, জুশি শুধু ঘরে বসে দিন কাটাত না। প্রায়ই কারখানায় আসা যাওয়া করত, বাবাকে কিছু ব্যাপারে সাহায্যও করত। এদিকে ফেংয়ের চেহারা, বিশেষ করে কথাবার্তা ছিল খুবই আকর্ষণীয়। তাই সদ্য কৈশোর পেরনো জুশির মন বশ করে ফেলতে তাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।”
“অছু ঐ খবর জানতে পারেননি?”
“হ্যাঁ, পেরেছিলেন। সেটাও ঐ কিমের কল্যাণে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অছু অবশ্য প্রথমে খবরটা একদম বিশ্বাসই করেননি। তিনি সোজা মেয়ে জুশির কাছে চলে গেলেন। জানতে চাইলেন ঘটনাটা সত্যি কি না। আগেই বলেছি, জুশির শরীরে বইছিল জিন রাজবংশের রক্ত। জেনেটিকালি সে গোঁয়ার এবং আবেগপ্রবণ। তাই পালকপিতার কাছে সে সেদিন সত্যি তো গোপন করলই না, বরং স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে ফেংকেই সে পছন্দ করে এবং তাকেই বিয়ে করতে চায়।
“একথা শোনামাত্রই অছুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ততদিনে তিনি ফেং সম্পর্কে আরও অনেক কথা জেনে ফেলেছেন। একটা কুখ্যাত অপরাধীকে জুশি বিয়ে করতে চাইছে। কোনও বাবার পক্ষেই এ প্রস্তাবে রাজি হওয়া সম্ভব নয়। অছুও হলেন না। তিনি জুশির সিদ্ধান্তের প্রবল আপত্তি জানালেন আর তৎক্ষণাৎ কারখানায় গিয়ে ফেংকে আছিপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ফেং ইতিমধ্যে সবকাজ গুছিয়ে নিয়েছিল। তাই সে পরদিন ভোরেই বিনা বাক্যব্যয়ে কলোনি ছেড়ে চলে গেল। আর ঠিক তার পরেরদিন জুশিও কাউকে কিছু না জানিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে এল কলকাতায়, অবশ্যই ফেংয়ের এক চেলার সাহায্য নিয়ে।”
“ফেং ওকে বিয়ে করেছিল?” প্রশ্নটা শুভর।
মনাদা ঘাড় নেড়ে জবাব দিলেন, “করেছিল বৈকি। তারপর জুশিকে নিয়ে সংসার শুরু করেছিল কসাইটোলার পেছনের একটা বস্তিতে। আসলে ওখানেই ফেংয়ের একটা নতুন চিনা কলোনি গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। সেজন্য আছিপুরের চিনিকল থেকে বেশি আয়ের লোভ দেখিয়ে মজুর ভাঙিয়ে আনার কাজ সে চালিয়ে যেতেই লাগল তার বেশ কিছু চেলার মাধ্যমে, যারা তখনও আছিপুরের ঐ চিনি কারখানায় শ্রমিক হিসাবে দিব্যি বহাল ছিল।”
“এ তো খুবই বিচ্ছিরি ব্যাপার। অছুসাহেবের তো তখন যাকে বলে একেবারে নাজেহাল অবস্থা!” গৌতম মন্তব্যটা করল।
“সে আর বলতে। আসলে জুশি ওভাবে চলে যেতেই অছু শারীরিক ও মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়লেন। ভুগতে শুরু করলেন অবসাদে। তখন কারখানার দিকে আর তাঁর মনও ছিল না। আসলে জুশি পালিতাকন্যা হলেও অছু তাকে নিজ সন্তান স্নেহেই বড়ো করে তুলেছিলেন। মেয়েটাকে ভালোবাসতেন একেবারে অন্ধের মতো। আর সেই কিনা অছুর মতামতের তোয়াক্কা না করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল আর ঘর করতে লাগল একটা জঘন্য অপরাধীর সঙ্গে! কোনও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এই ব্যাপারটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। অছুর ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছিল। যত দিন যেতে লাগল, অছু ততই অসুস্থ ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে লাগলেন। এইসময়ে অবশ্য পেলিমেম আর কিম অনেক চেষ্টা করেছিল অছুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। বলাই বাহুল্য, সে চেষ্টা তাদের সফল হয়নি।
“পেলিমেম তো চব্বিশ ঘন্টাই নিজেকে স্বামীর সেবা-যত্নের কাজে নিযুক্ত রেখেছিলেন। কিমও রোজই বাড়ি গিয়ে অছুকে মানসিক সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করত। বোঝাত যা হওয়ার হয়ে গেছে, এবার অছু যেন সব ভুলে আবার তাঁর কারখানার দিকে মন দেন। কাজের মধ্যে থাকলে অছুর পক্ষে দুঃখ ভোলা সহজ হবে। কিন্তু তাতে বিশেষ ফল হয়নি। পেলি আর কিমের চাপে পড়ে অছু আবার কারখানায় যেতে শুরু করলেন বটে, কিন্তু বোঝা গেল ব্যাবসা চালানোর উদ্যমটাই তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। এইসময়ে পেলিমেমও চিনিকলে গিয়ে স্বামীকে নানা কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাতেও বিশেষ সুবিধা হল না। দেখা গেল কারখানার উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। চিন থেকে আনা শ্রমিকরাও এ সময়ে কাজে ফাঁকি দিতে শুরু করল। কয়েকটা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে অসন্তোষও দানা বাঁধল। এইভাবে কেটে গেল বেশ ক’টা দিন।”
“ফেং নিশ্চয়ই আর এইসময়ের মধ্যে আছিপুরমুখো হয়নি?” তনু জানতে চাইল।
মনাদা বললেন, “না তা হয়নি বটে, তবে ওখানে কী কী হচ্ছে তার সব খবরই সে চেলাদের মাধ্যমে রাখত। বিশেষত পেন লি বলে একটি মাঝবয়সী লোক ফেংয়ের খুব বশংবদ ছিল। সে একেবারে নিয়ম করে কারখানার সব খবর জানাত। অবশ্য তার জন্য সে নিয়মিত দক্ষিণাও পেত।
“যাই হোক, ওদিকে ফেংয়ের কলকাতার ব্যাবসাও কিন্তু খুব একটা ভালো চলছিল না। আসলে আফিম চোরাচালানে তখন আরও অনেক চিনা ঢুকে পড়েছে। নেমে পড়েছে কলকাতার বেশ কিছু ধনী ব্যবসায়ীও। কোম্পানির সাহেবসুবোদের কাছে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতও পাচ্ছে। মানে ফেং তাও তখন আফিম চোরাচালানের ব্যাবসায় প্রবল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। এমতবস্থায় টাকা কামাতে সে অন্যকিছু করার কথা ভাবছিল। যোগাযোগও রাখছিল দেশবিদেশের অপরাধজগতের বেশ কিছু লোকের সাথে। এই সময়েই সে অর্জন করল বাবা হওয়ার গৌরব। জুশি একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিল। তার নাম রাখা হল ফেং পাও হুং।
“সে পরবর্তীকালে বাবার যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে পেরেছিল। অন্ধকারজগতের সকলে তাকে একডাকে চিনত। প্রায় তিন দশক সে কুখ্যাত জলদস্যু হিসাবে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল দক্ষিণ চিন সমুদ্র আর পেয়েছিল দ্য টেরর অব চায়না সি-এর সম্মান। তবে তার শরীরে তো শুধু বাবা নয়, মা জুশির অর্থাৎ চিনের সেই বিখ্যাত জিন রাজবংশের রক্তও ছিল। তাই বয়স পঞ্চাশের কোঠা পার হতেই তার মনের হঠাৎই ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে এবং সে কুখ্যাত জলদস্যু থেকে রূপান্তরিত হয় এক প্রবল দেশভক্ত চিনা নাগরিকে। সেও এক আজব উপাখ্যান।”
এই বলে মনাদা আবার একটা সিগারেট ধরালেন। আমাদের কারুরই আর তর সইছিল না। তনু বলেই ফেলল, “সে আজব উপাখ্যানটা আমাদের শোনাবেন তো, নাকি?”
মনাদা বললেন, “এখনই শুনবে? শোনো তাহলে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের বাজারে চিনাসামগ্রীর ব্যাপক বাজার ছিল। চিনা সিল্ক, পোর্সেলিন আর চা বিক্রি হত হু হু করে। অথচ ইউরোপের কোনও জিনিস কিন্তু চিনে বিকত না। চিনারা নিজস্ব চাহিদা পূরণে স্বনির্ভর ছিল বলে সে দেশের অভ্যন্তরে ইউরোপীয় দ্রব্যের প্রবেশ একরকম নিষিদ্ধই ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ চিনের ক্যান্টন বন্দর থেকে মাল বোঝাই করত। বে-আইনি পথে চিনে প্রথমেই ঢুকতে শুরু করে আফিম। আগেই বলেছি, এইসময়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর আফিমের চাষ হত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এইসময় থেকেই আফিমের নিলাম শুরু করে, টাকার পরিবর্তে তারা মূলত সিলভার মানে রুপো নিত ব্যবসায়ীদের থেকে। মাঝেমধ্যে সোনাও। চিনের জনগণের মধ্যে তখন আফিমের ব্যাপক চাহিদা। তাই ঐ আফিম ব্যবসায়ীরা জাহাজে করে ঐ নেশার দ্রব্যটি পৌঁছে দিত চিন উপকূলে। এরপর স্থানীয় মিডলম্যানদের হাত ধরে তা চলে যেত সাধারণ চিনা নাগরিকদের ঘরে ঘরে। কারণ, সেসময়ে চিনে আফিম নিষিদ্ধ হলেও তা নিয়ে তৎকালীন সরকারের বিশেষ কড়াকড়ি ছিল না।
“তবে বেশ কিছু বছর এই ঘটনা চলার পর চিন সরকারের টনক নড়ে। তারা বুঝতে পারে যে তাদের দেশ থেকে দিন কে দিন প্রচুর সোনা রুপো বেরিয়ে যাচ্ছে আর চিনের সাধারণ মানুষ ক্রমশ আফিমের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠছে। দেশের সম্পদ আর সাধারণ মানুষের এমন ক্ষতি আর কোন রাষ্ট্রনায়ক বরদাস্ত করবে? চিনে তখন কিং সাম্রাজ্যের শাসন। ১৮৩৯ সালে সম্রাট দাওগুয়াং দেশে আফিম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভাইসরয় লিন জেংকে চিন থেকে আফিমের ব্যাবসা পুরোপুরি উৎখাত করার দায়িত্ব দেন।
“লিন সেসময়ে ক্যান্টন বন্দর থেকে প্রায় বারোশো টন আফিম বাজেয়াপ্ত করেন এবং কোনওরকম ভর্তুকি ছাড়াই ঐ ব্যাবসা বন্ধ করে দেন। সঙ্গে বেশ কিছু বিদেশি বণিককে আটকও করে রাখেন। বলাই বাহুল্য, এই সিদ্ধান্ত ব্রিটিশরা মেনে নিতে পারেনি। চিনে আফিম ঢোকা বন্ধ হয়ে গেলে তাদের বিরাট আর্থিক ক্ষতি। তাই ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তীব্রভাবে চিনের ঐ সরকারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এবং তাদের নৌ ও পদাতিক সৈন্যবাহিনীকে পাঠিয়ে দেয় চিন আক্রমণ করার জন্য। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে অ্যাংলো-চাইনিজ ওয়ার বা প্রথম আফিমের যুদ্ধ নামে পরিচিত।”
“সে নয় বোঝা গেল। কিন্তু এই যুদ্ধের সাথে ঐ অছুর নাতি পাও হুংয়ের সম্পর্ক কী?” গৌতম প্রশ্নটা করল।
মনাদা সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে নিভিয়ে মৃদু হেসে জবাব দিলেন, “সম্পর্ক আছে বৈকি। আমি আগেই বলেছি, পাও হুং যৌবনে ছিল একজন কুখ্যাত জলদস্যু। একটা সময়ে সে নিজেও চিনে আফিমের চোরাচালান করেছে। কিন্তু প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সে যখন দেখল শুধু নিজেদের ব্যাবসার ক্ষতি হচ্ছে বলে ব্রিটিশরা এক্কেবারে অনৈতিকভাবে চিন আক্রমণ করেছে, সে আর চুপ করে ঘরে বসে থাকতে পারল না। সটান হাজির হল নিজের দেশ চিনে। তারপর আর পাঁচটা দেশভক্ত চিনা নাগরিকের সঙ্গে নাম লেখাল চিনা সেনাবাহিনীতে, দুর্দান্ত ব্রিটিশ সেনার সঙ্গে লড়াই করার জন্য। এবং তোমরা শুনে হয়তো অবাক হয়ে যাবে যে ইংরেজ সেনার সাথে মুখোমুখি লড়াই করতে গিয়ে তাদের ছোঁড়া কামানের গোলার আঘাতে যুদ্ধক্ষেত্রেই পাও হুংয়ের মৃত্যু হয়েছিল।”
“সত্যি, মানবচরিত্র বড়োই অদ্ভুত।” তনু মন্তব্যটা করল। আমরাও সবাই ওর সাথে একমত হলাম। একটা কুখ্যাত অপরাধী দেশের জন্য আত্মবলিদান করছে, ভাবা যায়!
এদিকে শুভ ইতিমধ্যে অস্থির হয়ে পড়েছে। ও বলল, “তা অছুসাহেবের নাতির কীর্তি তো শুনলাম। এবার আবার আগের ঘটনায় ফিরে আসুন। জুশির মা হওয়ার খবর নিশ্চয় অছুসাহেবের কানেও পৌঁছেছিল?”
“সে তো বটেই। ফেং তাও নিজের গরজেই সেই খবর পৌঁছে দিয়েছিল অছুর কানে। নাতি জন্মানোর সংবাদটা পেয়েই অছু ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠলেন। শত দুঃখের মধ্যেও মনটা তাঁর আনন্দে নেচে উঠল। দাদু হওয়ার সে এক অনাবিল তৃপ্তি। মন থেকে তাই অছু জুশির প্রতি সব অভিমান ঝেড়ে ফেলে সেই অসুস্থ শরীরেই পেলিমেমকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন কসাইটোলায়, নাতির মুখ দেখতে। ফেং যেন এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে শ্বশুর-শাশুড়িকে সাদরে আপ্যায়ন করল, তাদের যত্ন-আত্তির কোনও ত্রুটি করল না। আসলে এসব করে ফেং আবার আছিপুরে ঢোকার পথ পরিষ্কার করল। নাহলে তার মতলব সফল হবে কী করে?”
এবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আবার কী মতলব? চিনিকল থেকে শ্রমিক ভাঙানো, জুশিকে বিয়ে করা, সবই তো সে ইতিমধ্যে সেরে ফেলেছিল।”
“আরে বাবা, ওসব করেও তো সে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হতে পারেনি। আগেই তো বলেছি, আফিমের চোরাচালানে ফেং তখন তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। তাই সে চাইছিল অন্যকিছু করে বড়োলোক হতে। সেজন্য সে যোগাযোগও রাখছিল দেশবিদেশের নানা কুচক্রীর সঙ্গে। তাদেরই মধ্যে একজন ছিল ব্রিটিশ চোরাচালানকারী ড্যানি ওয়ালকট। সে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে পুরনো মূর্তি বা ছবি জোগাড় করে সেগুলো বেচে দিত ইউরোপের বেশ কিছু ধনকুবেরের কাছে। ফেং ড্যানিকে অছুর মন্দিরে থাকা বুদ্ধ-তারার মূর্তিদুটোর কথা জানিয়েছিল। ঐ মূর্তিদুটো তো অছু পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রে।
“ড্যানি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে তো বটেই, পাশাপাশি শিল্পকলার দিক থেকেও মূর্তিদুটো খুবই মূল্যবান এবং আকর্ষণীয়। সে তাই বুদ্ধ-তারা পাওয়ার জন্য ফেংকে বেশ ভালো টাকা অফার করে বসে। ফেংও টাকার অঙ্ক শুনে আর দেরি করতে চায়নি। সে মূর্তিদুটো চুরি করার পরিকল্পনা করে ফেলে। তবে এত বড়ো কাজটা সে চেলাদের দিয়ে নয়, নিজের হাতেই করতে চেয়েছিল। তাই বিনা বাধায় আবার আছিপুরে যাতায়াত করাটা তার ক্ষেত্রে জরুরি হয়ে পড়েছিল। নাতি জন্মানোর খবর পেয়ে অছুর তাদের বাড়িতে আসা ফেংকে সেই সুযোগটাই করে দিয়েছিল। এদিক থেকে ফেংকে ভাগ্যবান বলতে হবে।”
কথাটা শেষ করে মনাদা আবার একটা সিগারেট ধরাতে উদ্যত হলেন। এই অবসরে গৌতম জিজ্ঞাসা করল, “নাতির মুখ দেখে অছুসাহেবের মন ভালো হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। ওঁর অসুখটা তো মূলত মনেরই ছিল, তাই তো মনাদা?”
“অছুর অসুখটা যে মনেরই ছিল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে কসাইটোলা থেকে নাতির মুখ দেখে আসার পরেও তাঁর শারীরিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হল না। বরং অবসাদের মাত্রা দিন কে দিন বাড়তেই লাগল। ওঁর কেবলই মনে হতে লাগল, এ জীবনে তিনি নিশ্চয়ই বড়ো কোনও পাপ করে ফেলেছেন, তাই আজ ভগবান তাঁর এই দশা করেছেন।
“আসলে যৌবনকাল থেকেই অছু খানিক ধর্মভীরু প্রকৃতির ছিলেন। ঈশ্বর উপাসনা না করে কোনও বড়ো কাজে হাত দিতেন না। ক্যান্টনের পাট চোকানোর সময় নিজের সাতপুরুষের দেবদেবীকে সঙ্গে করে আছিপুর নিয়ে আসার সেটাও একটা বড়ো কারণ। কিন্তু বুদ্ধ-তারার সেই স্থানান্তরই একটা সময়ে অছুর দুর্বল মনে সংশয় তৈরি করল। তিনি একদিন পেলিমেমকে জানালেন যে ক্যান্টনের মন্দির থেকে ঐ দুই দেবতার মূর্তি এখানে নিয়ে আসা তাঁর ঠিক হয়নি। দুই দেবতাই এহেন কাজে নাকি ভীষণ কুপিত হয়েছেন এবং অছুকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে সেকথা জানিয়েওছেন তাঁরা। তাঁদের অভিশাপেই নাকি অছুর জীবনটা একেবারে তছনছ হয়ে গেছে।
“পেলিমেম অবশ্য খুবই বাস্তববাদী এবং বিচক্ষণ মহিলা ছিলেন। তাঁর বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হল না যে তীব্র অবসাদের জন্যই অছুর মনে এইসব ভাবনা ভিড় জমাচ্ছে। তিনি স্বামীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। তাঁকে বোঝাতে লাগলেন যে যেকোনও মানুষের জীবনেই এমন বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তার সাথে দেবতাদের কুপিত হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। মনটাকে একটু শক্ত করলে অছুর জীবনও আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
“কিন্তু তাতে অছুর মনোভাব বিশেষ বদলাল না। পেলিমেম তখন কিমকে ডেকে পাঠালেন। তাকে বললেন অছুর সমস্যার কথা। সব শুনে কিম গেল অছুর সঙ্গে কথা বলতে। অছু তখনও সেই স্বপ্নে পড়ে আছেন। তিনি কিমকে দেখে বললেন, ‘জান কিম, গতকাল আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমার মন্দির খালি পড়ে আছে। বুদ্ধ-তারা আমায় ছেড়ে চলে গেছেন। আসলে পাপীদের সাথে ভগবান তো কখনও…’
“কিম মাঝপথেই অছুকে থামিয়ে বলেছে, ‘কে বলেছে আপনি পাপী? আপনার মতো ভালো মানুষ এ যুগে খুব কমই আছে। এই এলাকার প্রতিটা মানুষ সে কথা মানে।’ কিমকে থামিয়ে অছু তখন বলেছেন, ‘তাহলে স্বপ্নে আমার গৃহদেবতারা আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলছেন কেন?’ কিম তখন তার মালিককে বুঝিয়েছে, ‘ওসব আপনার মনের ভ্রম। বুদ্ধ-তারা কখনওই আপনাকে ছেড়ে যাবেন না। আপনি মনটাকে শক্ত করুন, আবার কারখানার কাজ দেখাশোনা শুরু করুন, দেখবেন দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।’
“কিমের এই কথায় অছু কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন। তিনি কিমকে বলেছেন, ‘তুমি ঠিক বলছ তো কিম? ওঁরা আমাকে ছেড়ে কোনওদিন যাবেন না তো? তোমার কথাই যেন সত্যি হয়।’ কিম অছুকে বুঝিয়ে বিষণ্ন চিত্তে চিনিকলে ফিরে এসেছে। অছুর মানসিক অবস্থা তাকে বেশ বিব্রত করে তুলেছে। ওদিকে ফেং তাও যে সত্যিই তার মালিকের বুদ্ধ-তারা চুরি করার মতলব ফেঁদেছে, সে খবর তখনও সে জানে না।’
“ওই খবরটা কিম কীভাবে পেল?” প্রশ্নটা শুভ করল।
মনাদা জবাবে বললেন, “এমনিতে হয়নি। খবরটা পেতে তাকে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। আসলে কসাইটোলায় গিয়ে অছুর নাতির মুখ দেখে আসার পর থেকেই ফেং আছিপুরে ঘনঘন যাতায়াত করতে শুরু করে দেয়। ফেং এইসময়ে প্রায়শই রাত্রিবেলা তার বিশ্বস্ত চেলা পেন লির সাথে গোপনে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করত। ব্যাপারটা কিমের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই সেও গোপনে ওদের দু’জনের গতিবিধির ওপর সতর্ক নজর রাখতে শুরু করে। কিমের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে ফেং আবার কোনও একটা কুকর্ম করতে চলেছে। কিন্তু সেই অপকর্মটা যে আসলে কী, তা তার পক্ষে মোটেই বোঝা সম্ভব হত না যদি সে লিকে একদিন একটা ডিঙি নৌকা মেরামত করতে দেখে ফেলত।”
“লি ডিঙি নৌকা মেরামত করছিল কেন?”
“সে প্রশ্নটা তো কিমের মনেও জেগেছিল। আছিপুর থেকে কলকাতা বা অন্য কোথাও ঐসময়ে অনেকেই জলপথে যেত। সেটা স্থলপথের তুলনায় অনেক সুবিধাজনক ছিল। তাই আছিপুরের ঘাটে নৌকা বা মাঝিমাল্লার অভাব ছিল না। লির কোথাও নৌকায় চেপে যেতেই পারে। তার জন্য সে কোনও মাঝির সাথে কথা বলবে। কিন্তু তা না করে সে নিজেই একটা ভাঙা নৌকা সারাতে লেগে গেছে। তার মানে নৌকা চেপে সে কখন কোথায় যাবে সেটা কাউকে জানাতে চাইছে না। এই গোপনীয়তার কারণ কী? কোনও বদ মতলব না থাকলে কি কেউ এভাবে নিজের ডিঙি নিয়ে নদীপথে পাড়ি দেওয়ার কথা ভাবে? কিমের মনে সন্দেহ আরও প্রকট হয়েছিল, কারণ দু’দিন আগেই সে ফেংকে লির সাথে গোপনে কিছু একটা গুরুতর বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলতে দেখেছিল। তাই কিমের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে ফেংয়ের পরামর্শেই লি ডিঙিটা মেরামত করছে। কিন্তু ওদের মতলবটা তো জানা দরকার। নাহলে আবার কী অঘটন ঘটে যাবে কে জানে!
“কিম ভালোই জানত, লি যে প্রকৃতির ছেলে, তাতে ভয় দেখিয়ে তার পেট থেকে কথা বের করা আদৌ সম্ভব নয়। সুতরাং এক্ষেত্রে অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে। এটা চিনা কলোনির সকলেরই জানা যে রোজ রাত্তিরে মদ্যপান না করলে লির ঘুম আসে না। তবে সে মদ খায় একটা সীমা রেখে। কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে এক চিনা পরবের দিনে কিম লক্ষ করেছিল যে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে ফেললে লি আর নিজেকে সামলাতে পারে না। তখন ওর মুখ দিয়ে এমন অনেক কথাই বেরিয়ে পড়ে যা ও স্বাভাবিক অবস্থায় কখনওই বলে না। সুতরাং লির পেটের গোপন কথা বের করতে গেলে ওকে…”
“ভরপেট মদ খাওয়াতে হবে। তাই তো, মনাদা?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
মনাদা ঘাড় নেড়ে বললেন, “ঠিক তাই। একথা স্বীকার করতেই হবে যে কিমের আইডিয়াটা দারুণ ছিল। কিন্তু সেটা সফল করার জন্য ওকে কম হ্যাপা পোহাতে হয়নি। কিম নিজে তো মদ খেত না। চিনা কলোনির সকলে সেটা জানতও। তাই ভাটি থেকে মদ কিনে আনাই ছিল ওর পক্ষে বেশ অস্বস্তির ব্যাপার। সেইজন্য ওকে রীতিমতো ঘুষ দিয়ে একজন মদখোর শ্রমিক জোগাড় করতে হয়েছিল, যে মাটির একটা কলসিতে ওকে অনেকটা মদ এনে দিয়েছিল। সেই কলসিটা সঙ্গে নিয়ে রাত্রিবেলা একটা নিরিবিলিতে গিয়ে সে কায়দা করে ডেকে এনেছিল লিকে। তারপর তাকে কথায় ভুলিয়ে সে মদ খাওয়ানোটা ছিল আরও কঠিন কাজ। কিন্তু কিম সবকিছুই বেশ ধৈর্য সহকারে করতে পেরেছিল বলে সে জানতে পেরেছিল ফেংয়ের গোটা মতলবটার কথা।
“মদের নেশায় চুর হয়ে লি কিমকে জানিয়েছিল যে সামনের অমাবস্যার রাতে ফেং খোদাখুদিতলার ঐ মন্দির থেকে বুদ্ধ-তারার মূর্তিদুটো চুরি করবে। তারপর সে ওখান থেকে সোজা চলে আসবে নদীর ধারে। যে ডিঙিটা দু’দিন ধরে কসরত করে সারিয়েছে, সেটা নিয়ে লি আগে থেকেই অপেক্ষা করবে ঐ নদীর ঘাটে। সে ঐ নৌকায় চাপিয়ে ফেংকে পৌঁছে দেবে নদীর ওপারে মানে উলুবেড়িয়ায়। তারপর আবার আছিপুরে ফিরে আসবে। ফেংয়ের সেদিন রাত্রে আছিপুরে আসার খবর লি ছাড়া আর কেউ জানবে না। দু’দিন বাদে লিও চলে যাবে আছিপুর ছেড়ে। ফেং তার জন্য অন্য কাজের ব্যবস্থা করে রেখেছে।”
“এ তো দেখছি একেবারে নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনা। কেউ ধরতেই পারবে না কাজটা ফেং করেছে বলে। তা ফেংয়ের মতলবটা জানতে পেরে কিম কী করল? অছুসাহেবকে তক্ষুনি সব জানিয়ে দিল নিশ্চয়ই?”
তনুর এই প্রশ্নের উত্তরে মনাদা বললেন, “একদম না। অছুর শরীরের আর মনের অবস্থা কেমন, তা তো আগেই বলেছি। কিম বুঝেছিল, এই অবস্থায় অছুকে তাঁর জামাইয়ের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দিলে উনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তখন ওঁকে বাঁচানোই মুশকিল হয়ে যাবে। তাই ফেংয়ের মতলবের কথা সে অছুকে তো জানালই না বরং ঠিক করল সে ফেংকে ঐ মূর্তিদুটো চুরি করতে দেবে।”
“এ আবার কী কথা! মূর্তিদুটো চুরি করতে দেবে মানে? ও-দুটো চুরি হয়ে গেলে সেই আঘাত অছুর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে? তাতে তো উনি আরও ভেঙে পড়বেন। তাই নয় কি?” শুভ বেশ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলো বলে ফেলল।
কিমকে রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেখে মনাদা বলে উঠলেন, “আহা, তুমি আগে পুরোটা শুনবে তো। কিম ভুল কিছু ভাবেনি। সে এমন পরিকল্পনা করেছিল, যাতে সাপও মরবে অথচ লাঠিও ভাঙবে না। সত্যি বলতে কী, ওর প্ল্যানটা ছিল এককথায় অসাধারণ। এবং পেলিমেম ওকে একাজে খুব সাহায্যও করেছিল।”
“কীরকম?” আমি আর গৌতম প্রায় এক সঙ্গে বলে উঠলাম।
মনাদা জবাব দিলেন, “কিম পরদিন সকালেই অছুর বাড়ি হাজির হল। একটা আলাদা ঘরে পেলিমেমকে ডেকে বলল সবকথা। তারপর পেলিমেমকে জানাল তার প্ল্যানটা। কিন্তু কিম যে পরিকল্পনাটা করেছিল, তা বাস্তবায়িত করার জন্য একজন বিশ্বাসী দরজির বড়োই দরকার ছিল। পেলিমেমই তা শুনে কিমকে তাঁর এক দূর-সম্পর্কের ভাই গোলাম আলির কথা বলেন। নিজের কাজে সে যেমন দক্ষ, তেমনই আবার বিশ্বাসীও বটে। পেলিমেমের আস্থা ছিল সে-ই পারবে কিমের পরিকল্পনাকে সফল করতে।
“কিম তৎক্ষণাৎ গোলাম আলির বাড়ি চলে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে নিয়ে আবার পেলিমেমের কাছে চলে আসে। সে এবার ফেংয়ের মতলবের সবকথা গোলাম আলিকে খুলে বলে। তা শুনে তো আলিসাহেব রেগে কাঁই। সে বলে এই এলাকার সমস্ত মানুষ, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে টং অছুকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। আর ঐ মন্দিরটাকে একটা পবিত্র স্থান বলে ভাবে। সেই মন্দির থেকে কেউ মূর্তি চুরি করতে গেলে এলাকার লোকই তাকে উচিত শিক্ষা দেবে। গোলাম আলি বলে, এলাকার লোককে নিয়ে সে সামনের অমাবস্যার রাতে চিনা মন্দিরের আশেপাশে লুকিয়ে থাকবে আর ফেং মূর্তি চুরির জন্য ওখানে ঢুকলেই তাকে পাকড়াও করে এমন উত্তম-মধ্যম দেবে যে সে আর কোনওদিন ঐ মন্দিরের ধারেকাছেও আসবে না। কিম কিন্তু গোলাম আলির এই প্রস্তাবে রাজি হল না।”
“কেন, রাজি হল না কেন?” শুভ জানতে চাইল।
“তার অনেকগুলো সঙ্গত কারণ ছিল। প্রথমত, ঐ এলাকার লোককে কিম ভালোই চেনে। কিমের আশঙ্কা ছিল মূর্তি চুরি করতে গিয়ে এলাকার লোকের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলে ওখানে গণপ্রহারেই ফেংয়ের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটবে যা মোটেই কাম্য নয়। এই মৃত্যু একদিকে যেমন সদ্য মা হওয়া জুশিকে আহত করবে, তেমনই অছুকেও। সেটা বাবা বা মেয়ে কারুর ক্ষেত্রেই ভালো হবে না।
“দ্বিতীয়ত, এলাকার মানুষকে ফেংয়ের মূর্তি চুরির পরিকল্পনার কথা একবার জানিয়ে দিলে তা অতি উৎসাহের বশে চিনা কলোনিতেও পৌঁছে যাবে না, এমন নিশ্চয়তা কোথায়? সেক্ষেত্রে নিজের চেলা মারফত ফেং সহজেই জেনে যাবে যে তার মতলবের কথা ফাঁস হয়ে গেছে। অতপর সে আর আসবেই না মূর্তি চুরি করতে। এলাকার মানুষ তো আর সারাবছর ধরে মন্দির পাহারা দিতে পারবে না। ফেং অপেক্ষায় থাকবে। একদিন সুযোগ বুঝে সে মূর্তিদুটো চুরি করে নিয়ে যাবে। এদিকে আবার ফেংয়ের কুমতলবের কথা এলাকায় চাউর হয়ে গেলে তা নিশ্চয়ই অছুর কানেও একদিন পৌঁছবে। লোকটা এমনিতেই স্বপ্নে রোজ দেখছেন যে বুদ্ধ-তারা তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ফেংয়ের পরিকল্পনা শুনলে তো তিনি মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়বেন। তখন তো ওঁকে বাঁচানোই মুশকিল হয়ে যাবে।
“কিমের এই যুক্তিগুলো গোলাম আলির মনে ধরল। অতঃপর ঠিক হল, এলাকার মানুষকে ফেংয়ের পরিকল্পনার কথা কিছুই জানানো যাবে না। যা কিছু করতে হবে ওদের তিনজনকেই এবং সেটা চিরকাল গোপনই রাখতে হবে। এরপর কিম গোলাম আলিকে ঠিক কী কী করতে হবে তা ভালো করে বুঝিয়ে দিল। গোলাম আলি হাতে পেয়েছিল মাত্র তিনটে দিন। তার মধ্যেই সে অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে কিমের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল বলেই…”
মনাদা এই পর্যন্ত বলে থেমে যেতে বাধ্য হলেন। কারণ, ইতিমধ্যে বিমলদা অর্ডার না দেওয়া সত্ত্বেও আরও একপ্রস্থ চা এনে হাজির করেছে। কিন্তু ঐ মুহূর্তে আমাদের আর কারুরই বিশেষ তর সইছিল না। তনু বলেই ফেলল, “গোলাম আলির কাছে কিমের চাহিদাটা কী ছিল সেটা বলবেন তো?”
মনাদার মুখে কিন্তু কথা নেই। উনি ধীরেসুস্থে চায়ের কাপটা শেষ করে, তারপর আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে তবে মুখ খুললেন, “সেটা একটু বাদে বলছি। আগে ঐ অমাবস্যার রাতে কী হল শোনো। রাত বারোটা নাগাদ ফেং হাজির হল খোদাখুদিতলার ঐ মন্দিরের সামনে। সে সন্ধ্যাবেলাই অবশ্য পুজালি বলে একটা জায়গায় লুকিয়ে ছিল। এই পুজালি শব্দটা আসলে একটা চিনা কথা পুং জা লি-র অপভ্রংশ, যার অর্থ আর মাত্র এক মাইল। চিনা কলোনি থেকে ঐ এলাকার দূরত্ব বোঝাতেই শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে।
“যাই হোক, রাত্রিবেলা ঐ চিনা মন্দিরের কাঠের দরজা বন্ধ ছিল বটে, কিন্তু তাতে তালা লাগানোর রীতি তখন ছিল না। কারণ, দেবমূর্তি যে চুরি হতে পারে, সে যুগে ঐ অঞ্চলের মানুষ তা ভাবতেই পারত না। যাই হোক, ঐ অন্ধকারের মধ্যেই ফেং দরজা খুলে মন্দিরের ভেতর ঢুকল। তারপর বুদ্ধ-তারাকে নিজের গায়ের চাদরের তলায় লুকিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে এগিয়ে চলল নদীর দিকে। ওখান থেকে নদী প্রায় দু’মাইল পথ। অমাবস্যার রাত, বুঝতেই পারছ। তাই জোরে চলার উপায় নেই। কিন্তু ফেংয়ের যে পথ চলতে বিরাট অসুবিধা হচ্ছিল, এমনটাও নয়। আসলে সে তো প্রকৃত অর্থেই অন্ধকারের জীব। আঁধার রাতে পথ চলায় সে অনেককাল ধরেই অভ্যস্ত।
“মাইল দেড়েক যাওয়ার পর পড়ল একটা বড়ো মাঠ। তাতে আবার বড়ো বড়ো আগাছার ঝোপ। ঐ জায়গাটা পার হয়ে গেলেই দূর থেকে নদী নজরে আসে। ফেং গতি কমিয়ে নেমে পড়ল ঐ মাঠের মধ্যে। কিন্তু কিছুটা এগোনোর পরেই তার মনে হলো সামনের বড়ো ঝোপটার ডালপালাগুলো যেন বেশ নড়ছে। কিন্তু এত রাত্রে ওখানে কী থাকবে? কোনো জন্তুজানোয়ার নয় তো? ফেং তাই ইতিমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ভাবছে, কুকুর-বিড়াল হলে তেমন কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু তার থেকে বড়ো কিছু হলে? ভাবনাটা মাথায় আসতেই ফেংয়ের মতো লোকেরও বুক ঢিপঢিপানি শুরু হয়ে গেল। আসলে বেশ কিছুকাল তো সে এই অঞ্চলে কাটিয়ে ফেলেছে। সে জানে কয়েক বছর আগেও ঐ এলাকায় মাঝেমধ্যে বাঘের দেখা মিলত। ইদানিংকালে তাদের দেখাসাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি বটে, তবে এই নিশুতি রাতে তাদের কেউ একটা নদী পেরিয়ে গোরু-ছাগলের লোভে এদিকে চলে এলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
“সেদিন আকাশে চাঁদ না থাকলেও তারার অভাব ছিল না, আর আকাশটাও ছিল একেবারে মেঘমুক্ত। ফেং তাই চাইছিল সেই অল্প আলোতে নিজের চোখটা সইয়ে নিয়ে ঝোপের আড়ালে কোন প্রাণী তার জন্য ওঁত পেতে আছে তা বুঝে নিতে। কিন্তু চক্ষু অভিযোজনের সে সময় ফেং বিশেষ পেল না। তার আগেই ঝোপের পেছন থেকে একটা বড়ো জন্তু, গায়ে তার ডোরাকাটা হঠাৎ গর্জন করে বেরিয়ে এল তার সামনে। ফেং তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। ওখান থেকে দৌড়ে পালাবার শক্তিটুকুও যেন আর তার মধ্যে নেই। আসলে জন্তুটা যে বাঘ, তা নিয়ে তখন ফেংয়ের মনে আর কোনও সন্দেহ নেই।
“ফেং চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেও বাঘটা কিন্তু থেমে রইল না। সে দ্রুত এগিয়ে গেল ফেংয়ের দিকে। তারপর তার সামনের পা-দুটো সোজা তুলে দিল ফেংয়ের দু’কাঁধে। বেচারি তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারাল।”
“তারপর কী হল?” আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম।
“তারপর আর কী? প্রায় ঘন্টাখানেক ডিঙি নিয়ে নদীর ঘাটে অপেক্ষা করার পর ফেং আসছে না দেখে লি তাকে খুঁজতে বের হল। মন্দিরের পথে যেতে গেলে তাকেও ঐ মাঠ পেরোতে হবে। ঐ বড়ো ঝোপটার কাছে আসতেই লির কানে এল গোঙানির শব্দ। ঐ অন্ধকারেও নিজের গুরুকে চিনতে তার অসুবিধা হল না। পাশেই একটা ছোটো ডোবামতন ছিল। সেখান থেকে এক আঁজলা জল এনে লি ছিটিয়ে দিল তার গুরুর চোখে-মুখে। ফেংয়ের জ্ঞান ফিরল। তবে তার ভয় তখনও কাটেনি। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগল বাঘটা আশেপাশে আছে কি না। তারপর মনে পড়ল মূর্তিদুটোর কথা। বলাই বাহুল্য, সে দু’খানা ওখানে ছিল না। ওদিকে লি তো ভীষণ অধৈর্য হয়ে পড়েছে। সে ফেংকে জিজ্ঞাসা করল মূর্তিদুটোর কথা।
“ফেং তখন কোনওমতে উঠে দাঁড়িয়ে লিকে বলল, সে পরিকল্পনা মাফিক মূর্তিদুটো চুরি করেছিল বটে, তবে একটা বাঘ সেগুলো নিয়ে গেছে। তা শুনে লি তো অবাক। একটা বাঘ খাদ্যের অভাব হলে মানুষকে আক্রমণ করতেই পারে। কিন্তু সে মূর্তি নিয়ে যাবে কেমন করে! সোনার মূর্তি খেয়ে তো তার পেট ভরবে না। একথা শুনে ফেং বলল, বাঘ নয়, আসলে বাঘের রূপ ধরে স্বয়ং দক্ষিণ রায় এসেছিলেন তার কাছ থেকে মূর্তিদুটো কেড়ে নিয়ে যেতে। তাঁর মন্দিরের পাশেই তো ঐ চিনা মন্দির যেখানে বুদ্ধ-তারা আসীন ছিলেন। তাই ফেংয়ের কাজে তিনি ভীষণ কুপিত হয়ে এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন। ফেংকে যে প্রাণে মারেননি, সেটাই তার অনেক করুণা বলতে হবে। এই অবস্থায় আর একমুহূর্ত ওখানে নয়। ভালোয় ভালোয় প্রাণটা হাতে নিয়ে আছিপুর ছেড়ে সরে পড়াই ভালো।
“একথা শুনে লিও আর চিনা কলোনিতে থাকতে রাজি হল না। হাজার হোক দেবতার কোপ বলে কথা। ওরা দু’জনেই তৎক্ষণাৎ নদীঘাটের দিকে পা বাড়াল। দূরের আরেকটা ঝোপের আড়াল থেকে কিম ওদের সবকথাই শুনতে পেয়েছিল। নিজের পরিকল্পনা পুরোপুরি সফল হয়েছে জেনে মনে মনে সে খুব আনন্দও পেল। ওদিকে ডিঙিতে উঠে কুপির আলোয় লির চোখে পড়ল যে তার গুরুর কপালে আর গালে বাঘের নখের আঁচড়। ভয়ে সে খুব জোরে নৌকা চালাতে লাগল।”
“বোঝা গেল। তার মানে কিমই বাঘ সেজে ফেংকে ভয় দেখিয়েছিল। আর তাকে বাঘ সাজতে সাহায্য করেছিল গোলাম আলি। তাই তো, মনাদা?”
“ঠিক তাই। আগেই বলেছি, বাঘের পোষাক বানাতে গোলাম আলি সময় পেয়েছিল মাত্র তিনটে দিন। ঐ সময়ে কিন্তু আজকের দিনের মতো রঙবেরঙের কাপড় পাওয়া যেত না। সবই সাদা কাপড়। গোলাম আলিকে হলুদ জলে গুলে তাতে সাদা কাপড় চুবিয়ে হলদে রঙ করতে হয়েছিল। আর কালো ডোরা দাগ তৈরির জন্য সে সম্ভবত ব্যবহার করেছিল ভুসোকালি। এছাড়া কাপড় ও কাগজ দিয়ে নিজেকেই বানাতে হয়েছিল একটা বাঘের মুখোশ। আর খড় পাকিয়ে তা হলুদ কাপড়ে মুড়ে যে জিনিসটা গোলাম আলি বানিয়েছিল তা অবিকল বাঘের লেজের মতো হয়েছিল। নিজের বাড়িতে এইসব কিছু পরিয়ে গোলাম আলি অমাবস্যার দিন সকালে কিমকে নিয়ে এনেছিল পেলিমেমের সামনে। কিমকে ঐ সাজে দিনের আলোতে দেখেই পেলিমেম বুঝে গিয়েছিলেন, আজ রাতের অন্ধকারে কিমকে সত্যিকারের বাঘ বলে ভুল করবেই করবে। বাস্তবে হয়েওছিল তাই। আর সেজন্যই ফেং ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল।
“ফেং জ্ঞান হারানো মাত্রই কিম তার হাতে থাকা একটা বাঘের নখ দিয়ে তার দু’গালে ও কপালে আঁচড় কেটে দেয়। তারপর মূর্তিদুটো হাতে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে মন্দিরের দিকে। মাঠটা পার হওয়ার পরেই একটা জায়গায় গোলাম আলি ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। সে এবার মূর্তিদুটো নিয়ে চলে আসে চিনা মন্দিরে। বুদ্ধ-তারাকে বসিয়ে দেয় তাঁদের জায়গায়। ওদিকে কিম ইতিমধ্যে বাঘের পোষাক খুলে রেখে আবার পৌঁছে গেছে সেই আগের জায়গায়। তারপর দূরের একটা ঝোপের আড়ালে থেকে অচৈতন্য ফেংয়ের ওপর নজর রাখতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে ওখানে লি এসে হাজির হয়। ওদের কথা শুনে কিম আশ্বস্ত হয় যে আজকের ঘটনার পরে আর ফেং কোনওদিন ঐ মূর্তি চুরির কথা ভাববে না।”
“তার মানে মূর্তি চুরির বিপদ চিরতরে কেটে গেল। কিমের পরিকল্পনাটা এক্ষেত্রে দারুণভাবে কাজ দিয়েছিল, স্বীকার করতেই হবে। অছুসাহেব নিশ্চয়ই এসবের কিছুই জানতে পারেননি?”
“পাগল! উনি যাতে কিছু জানতে না পারেন, তার জন্যই তো কিম অতকিছু করেছিল। আসলে কিম মনেপ্রাণে চেয়েছিল, অছু আগের মতো সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে উঠুন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা হয়নি। চিনিকল থেকে শ্রমিক আর বাড়ি থেকে মেয়ে চলে যাওয়ার শোক অছুর পক্ষে আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভবই হয়নি। এইসময়ে চিনিকলে উৎপাদন রীতিমতো ব্যাহত হচ্ছিল। ফলে দেখা দিয়েছিল আর্থিক সমস্যাও। সেকথা জানিয়ে অছু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা ধার করেন। সেই টাকা দিয়ে কিমের সহায়তায় পেলিমেম একবার শেষ চেষ্টা করেছিলেন কারখানাটাকে দাঁড় করাতে। কিন্তু ফেং বা তার চেলারা না থাকলেও সে সময়ে আছিপুরে খারাপ লোকের অভাব ছিল না। তারা বেশি আয়ের লোভ দেখিয়ে তখনও ওখান থেকে শ্রমিক ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। ফলে চিনিকলটা আর কোনওদিনই লাভের মুখ দেখতে পায়নি। ওদিকে কারখানার উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে ১৭৮৩-র গোড়া থেকে অছুর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে থাকে এবং ঐ বছরের নভেম্বরেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।
“অছু ওই এলাকায় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাই তাঁর অকালমৃত্যু ওখানকার সাধারণ মানুষের মনে গভীর শোকের পরিবেশ তৈরি করেছিল। অছুনির্মিত চিনা মন্দিরে অদূরে গঙ্গার ধারে যখন অছুকে সমাধিস্থ করা হচ্ছে, তখন সেখানে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হয়েছিল অগণিত মানুষ। ভারতবর্ষের প্রথম চিনা উপনিবেশ অছু আছিপুরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চেয়েছিলেন চিনিকল স্থাপনের মাধ্যমে ঐ এলাকাটাকে একটা শিল্পাঞ্চল হিসাবে গড়ে তুলতে। কিন্তু তাঁকে সমাধিস্থ করার সাথে সাথে অছুর সেই স্বপ্নও যেন সমাধিস্থ হয়ে গেল।”
“সত্যি, ব্যাপারটা বড়োই দুঃখের। তা অছুসাহেবের মৃত্যুর পর আছিপুরের ঐ চিনিকলও বন্ধ হয়ে গেল বুঝি?” গৌতম জিজ্ঞাসা করল।
“না, তক্ষুনি বন্ধ হয়নি। ধুঁকতে ধুঁকতে আরও কয়েক বছর চলেছিল বটে, তবে কোনওদিনই আর লাভের মুখ দেখতে পায়নি। আসলে ঐ সময় থেকেই ইউরোপীয়রাও ভারতে ব্যাপকভাবে চিনি আমদানির ব্যাবসায় নেমে পড়েছিল। নেতৃত্বহীন আছিপুরের চিনিকলের পক্ষে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে ওঠা সম্ভবই ছিল না।
“অছুর মৃত্যুর পর থেকেই আছিপুর চিনিকলের শ্রমিকরা ধীরে ধীরে চিনা কলোনি ছেড়ে কলকাতায় উঠে এসে জুতোর কারখানা, লন্ড্রি, হোটেল ইত্যাদিতে কাজ করতে শুরু করে। তবে তারা একে অপরের থেকে কখনওই দূরে চলে যায়নি। কলকাতার একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল টেরিটিবাজারে সবাই জড়ো হয়েছিল, যা আদি চায়না টাউন নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে ব্যাবসায়িক সুবিধার কথা মাথায় রেখে তারা ট্যাংরা অঞ্চলে উঠে আসে। সেখানে গড়ে ওঠে এক নতুন চিনা কলোনি, নিউ চায়না টাউন যা এখনও আছে।
“১৮০০ সাল নাগাদ প্রায় সমস্ত চিনাই আছিপুর ছেড়ে কলকাতায় উঠে এসেছিল। ১৮০৪-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে সরকারী গেজেটে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে আছিপুর এস্টেটের সমস্ত সম্পত্তি নিলামে তোলা হয়। আর পরের বছরই অছুর চিনিকল, ঘরবাড়ি, জমিজমা সবকিছুই বিক্রি হয়ে যায়। শুধু রয়ে যায় অছুর সমাধি আর তাঁর তৈরি চিনা মন্দিরখানা।”
“এসব শুনে মনখারাপ হয়ে গেল, মনাদা। খুব তাড়াতাড়ি একদিন কিন্তু আছিপুরে আমরা যাব। দেখে আসব ঐ মন্দির আর অছুসাহেবের সমাধিটা।” আমি কথাটা বললাম।
“সেটা যাওয়া যেতেই পারে। তবে ঐ মন্দিরে এখন কিন্তু আর অছুর সেই সোনার বুদ্ধ-তারা দেখতে পাবে না। তার বদলে পাবে চন্দনকাঠের দেবদেবীকে।”
“কেন, চন্দনকাঠের মূর্তি কেন? সোনার বুদ্ধ-তারা কি আবার কেউ চুরি করে নিয়েছে নাকি?”
“না না, চুরি করেনি। স্বাধীনতার পরে ঐ চিনা মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছে কলকাতার চায়না টাউনের জি হিং চার্চ এন্ড ক্লাব। তারাই শুনেছি মূর্তিদুটোকে চিনে পাঠিয়ে দিয়েছে। আসলে কলকাতার চিনাদের মধ্যে ঐ মূর্তিদুটো কোথায় থাকবে, তা নিয়ে একসময় মতান্তর তৈরি হয়েছিল। শোনা যায়, কলকাতার চিনাবাজারের এক ধনী ও প্রবল প্রতিপত্তিশালী চিনা খোদাখুদিকে আছিপুর থেকে নিউ চায়না টাউনে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, আছিপুরে এখন একজন চিনাও আর বাস করে না। তাহলে তাঁদের আরাধ্য দেবদেবী ওখানে পড়ে থাকবেন কেন? তাই ঐ মূর্তিদুটোকে কলকাতায় এনে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
“কিন্তু কাজটা করার পরেই ভদ্রলোক নাকি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন আর একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দেখেন যে সুন্দরবনের একটা বিশাল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার থাবা উঁচিয়ে রাগী চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে ভদ্রলোক নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলেন। তবে খানিক বাদে চোখ খুলতে আর বাঘটাকে দেখতে পাননি। এই ঘটনার পরেই তাঁর মনে প্রবল ভয় ঢুকে যায়। ওঁর মনে হতে থেকে বুদ্ধ-তারাকে তিনি আছিপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে এসেছেন বলেই দক্ষিণ রায় রাগ করেছেন। এতকাল ওঁরা পাশাপাশি ছিলেন, এখন কেউ হঠাৎ বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটালে রাগ তো হবেই। ঐ চিনা ভদ্রলোক আর ঝুঁকি নেননি। খোদাখুদিকে আবার আছিপুরের মন্দিরে রেখে আসেন।
“তখন থেকেই নাকি কলকাতার চিনাদের কাছে আছিপুরের ঐ মন্দিরের জনপ্রিয়তা ভীষণ বেড়ে যায়। তারা মন্দিরটা সংস্কারও করে এবং চিনা নববর্ষের সময় ব্যাপকভাবে ওখানে আসতেও শুরু করে। কলাকাতার চিনাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে একটা সময় চিন থেকেও নিয়ম করে লোকে ঐ উৎসবে যোগ দিতে আসত। তারপর ঐ জি হিং চার্চ এন্ড ক্লাব মন্দিরের দায়িত্ব নেওয়ার পরে নাকি ষাটের দশকের কোনও একসময়ে মূর্তিদুটোকে চিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরিবর্তে মন্দিরে বসানো হয়ে চন্দনকাঠের ঐ বুদ্ধ-তারাকে।”
একথা শুনে গৌতম যেন একটু নিরাশ হয়েই বলল, “সে আর কী করা যাবে। আছিপুরে গিয়ে না হয় ঐ চন্দনকাঠের মূর্তিই দেখব।”
একথা শুনে তনু মন্তব্য করল, “সামনের সপ্তাহে ওখানে গিয়েই আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলব। সকলে মিলে কবে আছিপুর যাওয়া হবে, আমাকে খালি সেই দিনটা জানিয়ে দে।”
শুভ কেন জানি এতক্ষণ একটু গুম মেরে ছিল। আমরা সবাই যখন আছিপুর যাওয়ার তারিখ ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, তখনই ও হঠাৎ মন্তব্য করে বসল, “আচ্ছা মনাদা, আপনি তো প্রথমেই বলেছিলেন যে কিম শেংয়ের কথা কোনও ইতিহাস বইতে নাকি পাওয়া যাবে না। তাহলে আপনি ওর এত কথা জানলেন কী করে?”
সত্যি তো! এ ব্যাপারটা তো আমরা কেউই ভেবে দেখিনি। শুভর এই প্রশ্নের উত্তরে মনাদা মুচকি হেসে জানালেন, “ওহো, আমারই ভুল। কিম শেংয়ের আসল পরিচয়টা তো তোমাদের দেওয়াই হয়নি। ওর প্রকৃত নাম কৃষ্ণতোষ পাল। আমি তোমাদের একবার আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদার বাবা সন্তোষ পালের কথা বলেছিলাম, মনে আছে নিশ্চয়ই?”
আমরা সমস্বরে বললাম, “আছে আছে। সন্তোষ পাল মানে পল স্যান্টোস, যিনি না থাকলে ডারউইনের পক্ষে ন্যাচারাল সিলেকশন থিয়োরি আবিষ্কার করাই…”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই সন্তোষ পাল। কৃষ্ণতোষ হলেন তাঁরই বাবা। মানে সম্পর্কের দিক দিয়ে আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদা।”
বলাই বাহুল্য, মনাদার এই মন্তব্য শুনে আমাদের সকলের মাথাই তখন কমবেশি ঝিমঝিম করতে শুরু করে দিয়েছে। তনুই প্রথম নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মুখ খুলল। জানতে চাইল, “আপনি যে বলেছিলেন কিমের বাবা একজন চিনা ছিলেন? তার মানে আপনার শরীরে একজন…”
মনাদা এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলেন, “আসলে কী জান, প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী আমরা কেবল জন্মদাতাকেই পিতা বলে মানি। কিন্তু ঐ জন্মদাতার অকালমৃত্যু হলে কোনও সহৃদয় পুরুষ যদি তার কচি ছেলেটাকে সন্তানস্নেহে বড়ো করে তোলেন, তাহলে কি তিনি পিতার চেয়ে কিছু কম সম্মানের অধিকারী হন? এই যে টং অছু জুশির জন্মদাতা ছিলেন না, তা বলে উনি কি জুশির পিতার চেয়ে কম কিছু ছিলেন?”
“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন জুশিকে যেমন অছুসাহেব দত্তক নিয়েছিলেন, তেমনই কৃষ্ণতোষকেও কোনও এক চিনা ভদ্রলোক…”
“না, ঠিক তাও নয়। জিয়াও শেং, প্রথানুযায়ী কৃষ্ণতোষকে দত্তক নেননি কখনওই। তবে সহকর্মী বন্ধুর অকালমৃত্যুর পর তিনি যেভাবে শত দারিদ্রের মধ্যেও বড়ো করে তুলেছিলেন, তা পিতার দায়িত্বের থেকে কোনও অংশে কম ছিল না।
“আসলে কৃষ্ণতোষের পিতা একবার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জিয়াও শেংকে একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তখন থেকেই ওঁরা অভিন্নহৃদয় বন্ধু। একসঙ্গে কলকাতা বন্দরে শ্রমিকের কাজ করতেন। সেটা ১৭৭০-এর দশকের একেবারে গোড়ার দিক। এইসময়ে একদিন অসাবধানতাবশত, কৃষ্ণতোষের বাবা জাহাজের ডেকে ভারী মাল ওঠাতে গিয়ে গুরুতর আঘাত পান। দু’দিন বাদে ওঁর মৃত্যুও ঘটে। কৃষ্ণতোষের বয়স তখন মাত্র তিন। ঐ একরত্তি ছেলেকে নিয়ে তার মা সুরদাসী তো তখন অকূলপাথারে। এইসময়ে ঐ জিয়াও শেংই সুরদাসীকে আশ্বস্ত করেন এবং কৃষ্ণতোষকে বড়ো করার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেন।
“এরপর নিয়ম করে তিনি কৃষ্ণতোষদের বাড়ি আসতেন, তাদের খাবারদাবার, পোষাক এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের যথাসম্ভব ব্যবস্থা করে দিতেন। ভদ্রলোকের নিজের উপার্জনও তো বেশি ছিল না। তাই নিজে বিয়ে-থাও করেননি পাছে সহকর্মী বন্ধুর পরিবার সমস্যায় পড়ে। এমন আত্মত্যাগের নিদর্শন সত্যিই বিরল। তাই কৃষ্ণতোষও জিয়াও শেংকে মনে মনে বাবার মতোই শ্রদ্ধা করত। কৈশোরে পা দিয়েই সে ভেবেছিল, আর কিছুদিন বাদে সে নিজেই কলকাতা বন্দরে কাজে লেগে যাবে। তারপর জিয়াওকে বলবে অত খাটনির কাজ ছেড়ে দিয়ে ঘরে বিশ্রাম নিতে। কিন্তু পিতৃসম জিয়াওকে শেষ জীবনে সেই সুখটুকু দেওয়ার সৌভাগ্য কৃষ্ণতোষের হয়নি। কারণ, তার চাকরিতে ঢোকার কিছুদিনের মধ্যেই জিয়াও টিবি রোগে আক্রান্ত হন এবং মাস তিনেকের মধ্যেই চিরকালের জন্য বিশ্রামে চলে যান।
“এই ঘটনায় কৃষ্ণতোষ খুব ভেঙে পড়ে। তার আর কলকাতায় থাকতে মন চাইছিল না। তাছাড়া সে সময়ে কলকাতা বন্দরে শ্রমিকদের ওপর ওপরওলাদের জোরজুলুম খুব বেড়ে গিয়েছিল। তারা শ্রমিকদের সঙ্গে ক্রীতদাসের চেয়েও খারাপ আচরণ করত। কৃষ্ণতোষের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই সে আরও বেশি করে চাইছিল কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে।
“সেটা ১৭৮১ সাল। এইসময়েই সে কোনও এক চিনা শ্রমিকের কাছে অছুর চিনিকলের কথা শোনে। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে নেয় যে ওখানেই কাজ করবে। এজন্য কৃষ্ণতোষ প্রথমেই তার অসুস্থ মাকে দেশের বাড়ি কৃষ্ণনগর রেখে দিয়ে আসে। তারপর নিজে চলে আসে আছিপুরে। তার মনে সন্দেহ ছিল যে অছু হয়ত চিনা না হলে তাকে চিনিকলে কাজ দেবেন না। জিয়াও শেংয়ের সাথে প্রায় পনেরো বছর নিবিড় সম্পর্কের দরুন কৃষ্ণতোষ চিনা ভাষা ভালোই রপ্ত করে নিয়েছিল। তাই অছুকে সে কিম শেং পরিচয় দিয়ে তাঁর চিনিকলে চাকরিটা জোগাড় করে নেয়। আর অছুকে বলে মা বাঙালি বলে তার চেহারাটা চিনাদের মতো হয়নি।
“তবে এটুকু মানতেই হবে যে যিনি জন্মদাতা না হয়েও তার জীবনে পিতার ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই জিয়াও শেংকে মনে মনে শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যেই সে কিম শেং নামটা নিয়েছিল। অছুর মৃত্যুর পর সে কৃষ্ণনগরে মায়ের কাছে চলে আসে এবং মাটির পুতুল তৈরির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করে।”
“বোঝা গেল। কিন্তু আপনার সাতপুরুষ আগের এক মানুষের জীবনের এত বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা আপনি জানলেন কী করে? উনি কি এসব লিখে রেখে গিয়েছিলেন নাকি?” তনুর এই প্রশ্নটার মধ্যে কোথাও যেন একটা শ্লেষ লুকিয়ে ছিল।
মনাদা জবাবে বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, “হ্যাঁ লিখে গিয়েছিলেন বৈকি। হলদে হয়ে যাওয়া সেই পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেছিলেন আমার ঠাকুরদার বাবা ভবতোষ পাল, একটা শতাব্দী প্রাচীন পরিত্যক্ত লোহার ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে। পুরনো পুঁথিপত্র পাঠে ওঁর আবার বিশেষ আগ্রহ ছিল। আলাপ পরিচয়ও ছিল সে সময়ের বেশ কিছু দিকপাল মানুষজনের সঙ্গে। কৃষ্ণতোষের জীবনচরিত পাঠ করে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। উপলব্ধি করেন যে সেটা গ্রন্থাকারে প্রকাশ হলে ঐতিহাসিক তথা সাহিত্যিক মহলে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যাবে। লেখাটার কথা চিঠি মারফত জানান এক সাহিত্যিক বন্ধুকেও। তিনি তৎক্ষণাৎ ভবতোষকে পাণ্ডুলিপিটা কলকাতায় নিয়ে আসার কথা বলেন। ভবতোষও একমুহূর্ত দেরি করেননি। লেখাটা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন কলকাতার উদ্দেশে। কিন্তু যাত্রাপথে প্রবল ঝড়ের কবলে পড়ে ওর নৌকা উলটে যায়। আর বিদ্যাধরীর গহ্বরে চিরতরে তলিয়ে যায় কৃষ্ণতোষের সেই অমূল্য পাণ্ডুলিপিখানি।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মনাদা উঠে দাঁড়ালেন বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি এই অবস্থায় আর জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না, “ভবতোষ কলকাতার কোন সাহিত্যিকের কাছে ঐ পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে আসছিলেন, মনাদা?”
মনাদার তাচ্ছিল্যের সুরে জবাব, “কার কাছে আবার, রবীন্দ্রনাথের কাছে।”
এই উত্তর শুনে আমি সবে জিজ্ঞাসা করতে যাব যে কৃষ্ণনগর থেকে জোড়াসাঁকো আসতে ভবতোষকে বিদ্যেধরী নদীতে নৌকা চাপতে হল কেন, তার আগেই তনু খালি মুখে বিষম-টিষম খেয়ে একেবারে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়ে বসল। আমি আর শুভ ওকে জল-টল খাইয়ে কোনওমতে সুস্থ করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
ওদিকে গৌতম দেখলাম ভ্যাবলার মতো চুপচাপ বেঞ্চে বসে আছে। মনাদা ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “পাণ্ডুলিপিটা হারিয়ে গেলেও কৃষ্ণতোষের একটা স্মৃতি কিন্তু আজও আমার কাছে রয়ে গেছে।”
এই বলে তিনি নিজের মানিব্যাগ খুলে একটা লম্বা সরু বাঁকা নখ গৌতমের হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন, “এটা গোলাম আলির দেওয়া সেই বাঘের নখ যেটা দিয়ে কৃষ্ণতোষ ফেংয়ের গালে আর কপালে আঁচড় কেটে দিয়েছিল।”
কথাটা শেষ করে মনাদা আর একমুহূর্ত দাঁড়ালেন না। এইসময়ে বিমলদা কোথা থেকে যেন হাজির হল গৌতমের সামনে। তারপর একগাল হেসে বলে উঠল, “এ মা, তুমি আবার একটা বেড়ালের নখ হাতে নিয়ে বসে আছ কেন? এত রাত হল, বাড়ি যাবে না?”
তনুর কাশি এতক্ষণে কমেছে। আমি বিমলদার উদ্দেশে বললাম, “ওটা বেড়ালের নয় গো বিমলদা, বেড়ালের বোনপোর নখ।”
বিমলদা কী বুঝল জানি না, ওখান থেকে চলে গেল। আমি এবার এগিয়ে গেলাম গৌতমের কাছে। বললাম, “সাড়ে দশটা বেজে গেছে, সে খেয়াল আছে? এবার বাড়ি যেতে হবে তো? সাইকেল এনেছিস না হেঁটে যাবি?”
গৌতম জবাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই শুভ ফোড়ন কাটল, “সাইকেল থাকলেও এই অবস্থায় সেটা চালানো তোর বোধহয় উচিত হবে না। তুই বরং আমার সাথে হেঁটেই চল।”
গৌতম ওর প্রস্তাবে দেখলাম না করল না। সাইকেলের হাতলটা ধরে সত্যি সত্যিই হাঁটতে লাগল শুভর সঙ্গে।
ছবিঃ অতনু দেব।
জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস লাইব্রেরি
অসাধারণ!
LikeLike
ভাল লাগল
LikeLike
দারুন লাগলো, রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেললাম। এরকম আরও অনেক চাই।
LikeLike