পুজোর উপন্যাস আজব বাঘের তাজ্জব কাণ্ড চিত্ত ঘোষাল শরৎ ২০১৬

uponyaschitta01 (Medium)

          সুন্দরবনের ধারে এক গাঁ। সেই গাঁয়ে দুখুর বাস। আপনজন কেউ ছিল না তার, সবাই মরেছে আকালে। শুধু ছিল একটা গোরু। ধবধবে সাদা তার গায়ের রং, তাই দুখু নাম রেখেছিল ধবলী। কচি কচি ঘাস এনে দুখু তাকে খাওয়াত। গা দলাইমলাই করে দিত, চান করাত। শুনলে লোকে হাসবে, যদি কখনো একটু তেল জোগাড় করতে পারত দুখু, তবে সেটকু ধবলীর গায়েই সে মালিশ করত। ধবলী তখন হাসি-হাসি মুখ করে আরামে চোখ বুঁজে থাকত। বিশ্বাস হচ্ছে না? ভাবছ, গোরু আবার হাসে নাকি? হাসে, হাসে। কথাও কইত ধবলী। অবাক হচ্ছ বুঝি? হয়ো না। অবাক হবার মতো অনেক কান্ডই এখনো ঘটবে। অবশ্যি, মিথ্যে বলব না ভাই, রামা-শ্যামা-যেদো-মেধোর সঙ্গে কথা কইত না ধবলী, কইত কেবল দুখুর সঙ্গে, তাও আড়ালে। তাই লোকে জানত না ধবলীর কথা কওয়ার খবর। জানলে একটা হুলস্থুল কান্ড হয়ে যেত! জানই তো লোকের স্বভাব। একটা কিছু পেলেই হল, যাচ্ছেতাই মাতামাতি শুরু করে দেয়। ভারি বুদ্ধিমতী গোরু ধবলী। মানুষ যতটা বোঝে গোরুকে, তার চাইতে মানুষকে সে বুঝত অনেক বেশি।

          দুখু আর ধবলীতে খুব ভাব-ভালোবাসা। এমনটা বুঝি আর কোনো গোরুতে মানুষে হয়নি। ধবলীকে যেমন যত্ন করত দুখু, ধবলীও তেমনি দুধ খাইয়ে খাইয়ে দুখুকে বানিয়েছিল তাগড়াই জোয়ান।

          ধবলীর বুদ্ধিসুদ্ধি দেখে দুখু তাকে বেঁধে রাখত না। তা ছাড়া ধবলীর শিং দু’খানা ছিল মোক্ষম, তেমনি জোর গায়ে, কেউ যে তাকে আটকে রাখবে সে ভয় দুখুর ছিল না।

          পাড়াবেড়ানি ধবলী কিন্তু কারো ক্ষেতে বা বাগানে ঢুকত না। মানুষের সঙ্গে তো দূরের কথা, মোটাবুদ্ধি গোরুদের সঙ্গেও সে গুঁতোগুঁতি করত না। মান-ইজ্জতের বোধটা তার অনেক মানুষের চাইতে বেশিই ছিল। বেড়িয়ে-টেড়িয়ে ঠিক সময় সে ঘরে ফিরে আসত। দুখুকে সে নিজের ছেলের মতোই দেখত। যত বেশি পারত দুধ সে দিত দুখুকে।

          যত অভাব-অনটনই থাক, বেশ সুখে-শান্তিতেই দিন কাটছিল দুখু আর ধবলীর।

          কিন্তু একদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেল, তবু ঘরে ফিরল না ধবলী। বারবার কুঁড়েঘরের বাইরে এসে বেলা ঠাহর করল দুখু। এমন তো কোনোদিন করেনি ধবলী। তবে কি কোনো বিপদে পড়ল? এই ছোট্ট গাঁয়ে সবাই সবার চেনা। বিপদ কিছু ঘটলে এতক্ষণে দুখুর ঘরেই খবর চলে আসত। এক ভয় বাঘের। তা হালফিল এদিকে বাঘের উৎপাতের কথাও শোনা যায়নি। মহা ভাবনায় পড়ে গেল দুখু।

          আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে বেরিয়ে পড়ল ধবলীকে খুঁজতে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে জনে জনে জিজ্ঞেস করল ধবলীর খবর। কিন্তু কেউ ঠিকঠাক কিছু বলতে পারল না। অনেকেই দেখেছে তাকে, যেমন রোজই দেখে। কেউ কেউ আদরও করেছে। কিন্তু অমন শান্তশিষ্ট গোরু তো আর বেচাল কিছু করতে পারে না, তাই দেখাসাক্ষাতের পর সেকথা আর কারুর মনেও থাকেনি।

          মনের দুঃখে তিন দিন তিন রাত ঘর থেকে বেরোলই না দুখু। দিনপিছু সের তিনেক করে কচুসেদ্ধ ছাড়া খেলও না তেমন কিছু। অবশ্যি দুখুদের গাঁয়ের বেশির ভাগ লোক কচুসেদ্ধ-টেদ্ধ খেয়েই দিন কাটায়।

          সেই যে রূপকথার গল্পে বলে না— মনের দুঃখে বনে গেল, দুখুও সবরকম চেষ্টা করে যখন ধবলীর কোনো খবরই বের করতে পারল না, তখন সেও বনে যাওয়াই স্থির করল। মায়ের মতো ধবলীই যদি না রইল তার, তবে আর কচুসেদ্ধ খাওয়ার জন্যে বেঁচে থেকে লাভ কী! গাঁয়ে যখন ধবলীর কোনো খবর পাওয়া যায়নি, তখন যতদূর পারা যায় জঙ্গলটাই একবার দেখতে হবে। গাঁয়ের একদিকে নদী, অন্যদিকে জঙ্গল। ধবলীর মনে এমন কোনো দুঃখ ছিল না যে সে নদীতে ডুবে মরতে যাবে। তাহলে বাকি রইল ওই জঙ্গল, ওখানে যদি কোনো হদিস পাওয়া যায়। একলা জঙ্গলে যেতে সবার ভয়, কিন্তু দুখু এখন বেপরোয়া। ধবলী ছাড়া, ধবলীর দুধ ছাড়া, জীবনটা তো কচুসেদ্ধ। তা সেই কচুসেদ্ধ যদি বাঘের পেটেই যায় তো যাক।

          দুখু একদিন একলাই ধবলীকে খুঁজতে গেল জঙ্গলে।

          জঙ্গলটা তো একটুখানি নয়। সেই সকালে বেরিয়েছে দুখু, কেবলই ঘুরছে, থেকে থেকে ধবলীর নাম ধরে ডাকছে, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই কোথাও। আরো এগিয়ে যায় দুখু। গভীর জঙ্গলের মধ্যে অনেক দূর চলে এসেছে সে। সূয্যি মাথার ওপর উঠে এখন পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। ঘোরাঘুরির পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে দুখু। মনটাও বড়ো দুর্বল, বেশ বুঝতে পারে ধবলীকে ফিরে পাবার কোনো আশা নেই। তবু শেষবারের মতো ধবলীর নাম ধরে একচোট ডাকাডাকি করে। তারপর উত্তরের আশায় কান পেতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সব নিঝঝুম। এ কোন্‌ রাজ্যে এল দুখু? ধবলীর সাড়া না পাক, অন্য জন্তু-জানোয়ারের সাড়াও তো পেতে পারে। তারাই বা সব গেল কোথায়? তবে এসব নিয়ে দুখু মাথা ঘামাল না, ভয়ও পেল না। ধবলীকেই যখন পেল না, তখন এ জীবন থাকলেই বা কী আর গেলেই বা কী।

          আস্তে আস্তে ফেরার রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে দুখু।

          হঠাৎ এক কেঁদো বাঘ লাফ দিয়ে পড়ে তার সামনে। রাস্তা আটকে বসে মাটিতে ল্যাজ আছড়াতে আছড়াতে গররররর্‌ গররররর্‌ শব্দ করতে থাকে।

          প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গেলেও দুখু তক্ষুনি নিজেকে সামলে নিয়ে বাঘের সামনাসামনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

          মিনিট পাঁচেক এই রকম চলে। বাঘের শুধু ল্যাজ আছড়ানো আর গররররর্‌ গররররর্‌ করা আর দুখু বুক চিতিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে।

          শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে দুখু বলে –দ্যাখো বাপু, আমার মন-মেজাজ ভালো না। খেতে চাও তো খেয়ে ফ্যালো, না হলে রাস্তা ছাড়ো, আমি ঘরে ফিরব।

          বাঘ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে (বাঘেরাও সময় সময় ঠোঁট বেঁকায়) –ঘর যায়েগা? হাঃ হাঃ হালুম, আভি পায়েগা মালুম। হাম হ্যায় সুন্দরবনকা বাঘ, হামারা রাজত্বমে কাহে ঢুকা তুম্‌?

          একটুও ভয় না পেয়ে দুখু বলে –বাঙালি বাঘ, বাংলায় কথা বলো-না বাপু।

          –এয়ার্কি হচ্ছে? একটু যেন মিইয়ে গিয়ে বাঘ বলে, আমি কি যা-তা লোক!

          হঠাৎ ভীষণ হাসি পেয়ে যায় দুখুর। হাসতে হাসতে পেট ফেটে মরে আর কী!

          –অত হাসিটা কীসের? আমার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ অমন দাঁত বের করে হাসলে আমি কিন্তু ভীষণ রেগে যাই –বাঘ রীতিমতো গম্ভীর হয়ে বলে।

          পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতেই দুখু বলে –তুমি যা-তা বাঘ হতে পার, যা-তা লোক কী করে হবে হে?

          –ভাষার ভুল ধরতে এসো না, বাঘ আরো গম্ভীর হয়ে বলে, অত মানুষ খেলে মাঝে মাঝে নিজেকে একটু মানুষ-মানুষ মনে হয়ই। তুমি বাঘ খেতে থাক, দেখবে মাঝে-মধ্যে ভুল করে তোমারও মুখ দিয়ে হালুম-হুলুম বেরিয়ে আসবে।

          অ্যাঁ! নাক-মুখ কুঁচকে দুখু বলে, কোন্‌ দুঃখে আমি বাঘ খেতে যাব? যা বোটকা গন্ধ!

          –অ্যা……….ই….ই….খবরদার, অপমান আমি সহ্য করব না। আমাদের গায়ে বোটকা গন্ধ? কাঁচকলাখেকোটা বলে কী!

          –কাঁচকলা আমি পাইও না, খাইও না। সেসব শহরে চলে যায়। আমি আগে খেতাম দুধ দিয়ে কচুসেদ্ধ, এখন খাই শুধু কচুসেদ্ধ। তা, অত কথায় দরকার কী? আমি তোমাকে অপমান করেছি, তুমি আমাকে খেয়ে ফ্যালো। জোর যার মুল্লুক তার এই যখন নিয়ম………

          –খাবার হলে তো অনেক আগেই খেয়ে ফেলতাম। তুমি এতক্ষণে প্রায় বাঘের নাদি হয়ে যেতে……….

          –তার মানে? আমাকে খাওয়া যায় না? আমি এতই খারাপ যে বাঘেরও অখাদ্যি! রাগে দুঃখে চোখ ছলছল করে দুখুর।

          দুখুর অবস্থা দেখে বাঘের বুঝি মায়া হয়। সে বলে –আরে না না, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। খেতে তুমি বেশ ভালোই হবে, সত্যি বলতে কী তোমাকে দেখে ইস্তক নোলাটা আমার সপসপ করছে। কিন্তু মাংস আজকাল আমার মোটেই সহ্য হয় না, খেলেই অম্বল হয়ে যায়।

          –কী খাও তবে? ঘাস?

          –দুর বোকা! ঘাস আমরা দু’চারটে খাই বমি করবার দরকার হলে। আমাদের মাসিদের দেখনি? তারাও তাই করে। বিড়ালের কথা বলছি হে, ওরা আমাদের মাসি হয় জান তো?

          –তা জানি। কিন্তু তুমি কী খাও তাহলে?

          –দুধ। দুধ ছাড়া আর কিচ্‌ছু খাই না আজকাল। অম্বল হলে ডাক্তাররা দুধ খেতেই তো বলে।

          –ডাক্তার! ভীষণ অবাক হয়ে দুখু বলে।

          –অবাকের ঠ্যালায় চোখ যে ছানাবড়া হয়ে গেল। ডাক্তার কাকে বলে তাও জান না?

          –জানব না কেন? ওই তো যারা লোকের অসুখ হলে লাল-নীল জল খেতে দেয়, পেট-টেট কেটে ছুরি-কাঁচি-ব্যান্ডেজ ভেতরে পুরে সেলাই করে দেয়। কিন্তু তুমি আবার ডাক্তার পেলে কোথায়? বাঘ-ডাক্তার আছে বলে তো শুনিনি। হ্যাঁ হে, বাঘ-ডাক্তারও আছে নাকি? আমি তো জানতাম বাঘা বাঘা মানুষ-ডাক্তারই আছে, যারা রুগির পকেট ফাঁকা করে টাকা শুষে খায়, তোমরা যেমন ঘাড় মটকে রক্ত শুষে খাও। সেজন্যেই মানুষেরা বড়ো ডাক্তারকে বাঘা ডাক্তার বলে। তা, সেকথা থাক। তুমি ডাক্তার দেখালে কী করে?

          –বাঃ, না-ই বা থাকল বাঘ-ডাক্তার, দু’চারটে মানুষ-ডাক্তার আমি খাইনি বুঝি! তাদের জ্ঞানগম্যি কিছুটা তো আমার মাথায় ঢুকেছে। ঠিক কি না?

          হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায় দুখুর মাথায়। সে ভুরু-টুরু কুঁচকে বাঘকে বলে –তবে কি দুধ খাওয়ার জন্যে তুমিই আমার ধবলীকে সরিয়েছ?

          বাঘ উত্তর দেয় না। কিন্তু তার মুখের ভাব দেখে দুখু বুঝতে পারে সে ঠিকই ধরেছে। দেখতে জানলে বাঘের মুখের ভাবও বোঝা যায়।

          বাঘের ল্যাজ আছড়ানো বন্ধ। মুখ মাটির দিকে নামানো। দুখু বুঝতে পারে চুরি ধরা পড়ে যাওয়ায় খুব লজ্জা পেয়েছে বাঘ। নাঃ, বাঘটার বেশ মনুষ্যত্ব আছে, মানুষরাও আজকাল চুরি করে এত লজ্জা পায় না। দুখুর আশা হয় বাঘকে একটু ধর্ম-টর্মর কথা বললে সে হয়তো ধবলীকে ফেরত দিয়ে দেবে।

          মিছরির মতো মিষ্টি গলা করে দুখু বলে –সত্যি বলতে কী ভাই বাঘ, বাঘেদের মধ্যে যে তোমার মতো লোক –থুড়ি—বাঘ আছে তা আমি কোনোদিন ভাবিনি। আমি ভাবতাম তাদের লজ্জা-ঘেন্না-ভয় কিছুই নেই। কিন্তু ধবলীকে চুরি করে তুমি যে রকম লজ্জা পেয়েছ তাতে মনে হচ্ছে লোক তুমি মোটেই খারাপ নও।

          –এই, লোক নয়, বাঘ। বাঘ এবার দুখুর ভুল শুধরে দেয়।

          –হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাঘ। তা ভাই বাঘ, তুমি খুব ভালো বাঘ, সুন্দর বাঘ, ধার্মিক বাঘ………

          হঠাৎ কোথায় গেল বাঘের লজ্জা, সে রীতিমতো খেপে গিয়ে বলে –চোপরাও, কোনো মানুষের মুখ থেকে ধর্মের কথা শুনতে চাই না আমি।

          –কেন? মানুষের দোষ?

          –অনেক দোষ। সেসবের ফিরিস্তি আমি দেব না। তা ছাড়া বাঘের ধর্ম তুমি কী জান হে?

          একটু বিরক্ত হয়ে দুখু বলে –আমিও তো বলতে পারি, মানুষের ধর্ম তুমি কী জান?

          –না জানলেও আমার চলে। তবু অনেক জানি। আট-দশটা সাধু-সন্ন্যিসি যে খেলাম সেগুলো গেল কোথায়। তোমাদের ধর্ম আর জানতে বাকি নেই আমার। ভগবানওলা সাধু হলে ঠিক হজম হয়ে যেত। কিন্তু প্রত্যেকটা সাধু খাবার পর আমার পেট খারাপ হয়েছে। এখন আর সেধে দিলেও সাধু আমি খাই না।

          –সে তুমি দাড়িগোঁফসুদ্ধু খেয়েছিলে বলে……

          –থাক, আমাকে আর সাধু খাওয়া শেখাতে হবে না। ভগবানে সত্যি সত্যি মন থাকলে তারা অত গুরুপাক হয় না।

          –খুব যে বড়ো বড়ো কথা। বেশি চালাকি ভালো না।

          বাঘ মুচকি হেসে বলে –তা বোকা মানুষের চাইতে চালাক বাঘ কি খারাপ?

          –আসল কথাটা হচ্ছে, দুখু বিরক্তভাবে বলে, কথার প্যাঁচ খেলে ধবলীর ব্যাপারটা চাপা দিতে চাইছ তুমি। আমার গোরু ফেরত দেওয়ার ইচ্ছে তোমার নেই।

          –তোমার গোরু? গোরু কি একটা জিনিস যে সে কারুর হবে। গোরু গোরুর। যেমন আমি আমার, তুমি তোমার।

          –তোমার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না আমি। তোমাকে আমি যা ভেবেছিলাম তুমি মোটেই তা নও। তুমিও আমাদের গাঁয়ের নগেন জোতদারের মতোই। পরের সম্পত্তি গায়েব করবার তালেই আছ। আমি চললাম।

          বলে গটগট করে হাঁটতে শুরু করে দুখু।

          –দাঁড়াও, দাঁড়াও, বাঘ একটু সরে দুখুর রাস্তা আটকে দাঁড়ায়, বাঘ জাতির সম্পর্কে অত খারাপ ধারণা নিয়ে তোমাকে আমি যেতে দিতে পারি না। দুনিয়ার কোনো বাঘই নগেন জোতদারের মতো খারাপ নয়। জান, ওকে আমি একবার ধরেছিলাম, তা লোকটার গা থেকে এমন ছুঁচোর মতো গন্ধ বেরোচ্ছিল যে খাওয়া দূরের কথা মাঝপথেই ওকে ফেলে দিয়ে আমি চলে এসেছিলাম।

          –ও, তুমিই তাহলে সেই বাঘ যে নগেন জোতদারকে ধরেছিল? একটু যেন খুশি হয়েই দুখু বলে।

          –যাক, কাজের কথাটা শোনো এবার, তুমি ধরেছ ঠিকই, ধবলী আমার হেপাজতেই আছে। তাকে আমার বড়ো দরকার, তোমারও দরকার বুঝতে পারছি। চলো, দেখা যাক দু’জনেরই সুবিধেমতো ব্যাবস্থা একটা করা যায় কি না।

          একটু ভেবে বাঘের কথায় রাজি হয় দুখু। নেই-মামার চেয়ে কানা মামা যেমন ভালো, তেমনি নেই-গোরুর চেয়ে অল্প-গোরুও মন্দের ভালো।

          আগে আগে দুখুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে বাঘ।

          অনেকটা পথ গিয়ে মস্ত বড়ো একটা বট গাছের নীচে ধবলীর দেখা পায় দুখু। ধবলী বসে বসে চোখ বুজে জাবর কাটছিল। সামনে কচি কচি ঘাসপাতার ছোটো একটা পাহাড়।

          ধবলীকে দেখেই ভেউভেউ কান্না জুড়ে দেয় দুখু –ওরে আমার ধবলী-মাগো, আমায় ছেড়ে এ তুমি কোথায় এলে গো……

          দুখুর কান্না শুনে ধবলীও চোখ মেলে ডুকরে কেঁদে ওঠে –আঃ আঃ আঃ আঃ……ম্‌…বা। ওরে আমার বাবুসোনা দুখু রে, এ তোমার কী হাল হয়েছে রে……

          পা ছড়িয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দুখু বলে –মা যাকে ছেড়ে যায় তার হাল এর চাইতে আর কী ভালো হবে?

          তখন ধবলী এগিয়ে এসে বসে-থাকা দুখুর গলা সামনের একখানা পা দিয়ে জড়িয়ে ধরে চকাৎ চকাৎ করে গাল চেটে আদর করতে থাকে।

          একটু শান্ত হয়ে দুখু বলে—তুমি এখানে এলে কী করে ধবলী-মা?

          –সে এক বিত্তান্ত, ধবলী বলতে থাকে, সেদিন মনটা কেন জানি না খুব উদাস-উদাস লাগছিল, আর কেত্তন গাইতে ইচ্ছে করছিল। ভাবলাম একটু গলা ছেড়ে কেত্তন গাইতে পারলে মনটা হয়তো ভালো হবে। কিন্তু গাঁয়ের মধ্যে গাই কী করে? তুমি তো জান বাবা দুখু, গাইকে গাইতে দেখলে কী কান্ড শুরু করত মানুষগুলো। তোমার সঙ্গে কথা কই কত সাবধানে। তাই ভাবলাম, বনের ভেতর একটুখানি গিয়ে গান গেয়ে আসি……

          –বুঝলাম, তারপর ওই বেঘোব্যাটা তোমাকে দেখতে পেয়ে এখানে ধরে নিয়ে এল, দুখু বলে।

          বাঘ চুপচাপ ওদের কথা শুনছিল, দুখু তাকে বেঘোব্যাটা বলায় সে রেগে বলে—খবরদার দুখু, বাঘকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে শেখো, নইলে মুন্ডুটা ঘাড়ের ওপর থাকবে না।

          –আহা বাঘা, মিথ্যে মিথ্যে রাগ করে না। দুখুর মনের অবস্থাটা তোমার বোঝা উচিত। ধবলী বলে।

–তুমি বললে বলে ধবলী-মা, নইলে ওর কপালে আজ দুঃখু ছিল—বাঘ বলে। দুঃখে অভিমানে ছলছল করতে থাকে দুখুর চোখ দুটো।

          সে বলে—দুখুকে আর দুঃখু দেখিয়ে কী হবে। একজন আদর করে ডাকছেন বাঘা, আর একজন এর মধ্যেই বানিয়ে দিয়েছেন ধবলী-মা! আমি তো এখন একটা কাঁচকলারও অধম……

          বলতে বলতে ভ্যাঁক্‌ করে কেঁদে ফেলে দুখু।

          ধবলী আবার তাকে আদর করে ঠান্ডা করে।

          দুখু চোখ-টোখ মুছে বলে—তাহলে বাড়ি চলো এবার।

          বাঘ খেঁকিয়ে ওঠে—মাইরি আর কী, উনি বললেন আর অমনি ধবলী-মা চলল ওনার পিছু পিছু।

          শাসনের সুরে ধবলী বলে—ও কী হচ্ছে বাঘা, ছোটোলোকের মত মাইরি-টাইরি?

          –ঠিক আছে, ঠিক আছে, বাঘ লজ্জা পেয়ে বলে, মানুষ খেয়েই ওসব শেখা, আর কখনো বলব না। কিন্তু দুখু তোমাকে নিয়ে যেতে চায় কেন?

          দুখু বলে—বাঃ চমৎকার কথা। আমার মা—আমি খাইয়ে পরিয়ে, তেল মালিশ করে, দলাইমলাই করে মানুষ করলাম। আর উনি এখন উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন।

          বাঘ একরোখাভাবে বলে—সে তুমি যা-ই বল। মানুষ লোভের বশে এর চাইতে অনেক বড়ো বড়ো অন্যায় করে। আমি তো শুধু প্রাণ বাঁচানোর জন্যে ছোট্ট একটা অন্যায় করেছি। এতে আমি কোন দোষ দেখি না। সত্যি বলতে কী, ধবলী-মা’র দুধ খেয়ে তিন-চার দিনেই আমার অম্বল অনেকটা কম।

          –আসল কথাটা হচ্ছে, দুখু বলে—তুমি একটা অতি বজ্জাত স্বার্থপর বাঘ। আমার মুখের দুধ তুমি কেড়ে খাচ্ছ, আমার মায়ের ভালোবাসা আমাকে পেতে দিচ্ছ না। দুখুর জীবনে এখন শুধু কচুসেদ্ধ আর দুঃখু। তবে বলে যাচ্ছি, তুমিও শোনো ধবলী-মা, এ সুবিধের বাঘ নয়, এখন মা-মা করছে, কিন্তু যখন তুমি আর দুধ দিতে পারবে না, ও তোমাকেই খাবে।

          –ছি, ছি, বাঘ কানে থাবা দেয়, বাঘেরা মানুষের মতো খারাপ নয়, তারা মাকে খায় না।

          –আর মানুষ বুঝি মাকে খায়? দুখু বলে।

          –তা ঠিক খায় না বটে, তবে অনেকরকমভাবেই মানুষ মানুষকে খায়। ঠকিয়ে খায়, মেরে খায়……

          –বাঘের বাঘামো সহ্য হয়, কিন্তু পাকামো মোটে সহ্য করা যায় না, গম্ভীর মুখে দুখু বলে, আমি তোমার কাছে জ্ঞান নিতে আসিনি বাঘ।

          ধবলী একপাশে দাঁড়িয়ে জাবর কাটতে কাটতে চুপ করে দুখু আর বাঘের তর্ক শুনছিল।

          কী ভেবে হঠাৎ সে বলে—বারবার বাঘ বাঘ বললে ভারি বিচ্ছিরি শোনায়। বাঘার একটা নাম রাখা দরকার।

          বাঘ বলে—শুনেছি অনেক বাঙালি আছে যাদের বাবু না বলে সাহেব বললে খুশি হয়। সুন্দরবনের বাঘেরা ওরকম নয়, তাদের সিংহ বললেও তারা খুশি হয় না, বরং রাগ করে। আমরা নিজেদের ছোট ভাবি না। তবে নাম একটা রাখতে চাও রাখতে পার।

          –তোমরা কোনো নাম-টাম রাখ না? দুখু জিজ্ঞেস করে।

          –না।

          –কীভাবে ডাকাডাকি কর তবে?

          –সে খবরে তোমার দরকার আছে বলে মনে হয় না।

          –ঠিক আছে, এখন কিন্তু একটা নাম তোমার সত্যিই দরকার। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা কইতে সুবিধে হবে। ধবলী-মা ঠিকই বলেছে।

          –হ্যাঁ…ম্‌…বা, ধবলী বলে—একটা নাম না হলে চলে না।

          –বললাম তো, বাঘ বলে—নাম একটা রেখে দাও।

          –আজ থেকে তোমার নাম হল নটবর। ভেবে-চিন্তে দুখু বলে।

          –ধ্যুৎ, খ্যাঁক করে ওঠে বাঘ, বাঘের নাম নটবর! ইডিয়ট কোথাকার।

          –ইডিয়ট! সেটা আবার কী?

          –ওটা একটা ইংরিজি কথা। সাহেব না খেলে বোঝা যায় না। সেবার লঞ্চডুবি হয়ে দুটো সাহেব সাঁতরে পাড়ে এসে উঠল। দুটোকেই খেয়ে ফেললাম। তারপর থেকে ইংরিজিটা ভালোই আসে আমার।

          –ওঃ, দুখু বলে, খেয়ে-শেখা! তারই এত দেমাক, পড়ে-শেখা হলে না জানি কী হত। তা, নিজের নামটা নিজেই কেন ঠিক করো-না বাপু।

          বেশ বোঝা গেল ইংরিজিটা একদম না জানা থাকায় দুখুর খুব অপমান হয়েছে।

          অনেকক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই।

          তারপর বাঘ লাজুক হাসি হেসে বলে—আচ্ছা, ধৃষ্টদ্যুম্ন হলে কেমন হয়?

          দুখু বলে—খুব খারাপ হয়। ও রকম দাঁতভাঙা নাম আজকাল কেউ রাখে না। মাসখানেক ওই নাম ধরে ডাকাডাকি করলেই দাঁতগুলো সব নড়বড়ে হয়ে যাবে।

          বাঘ রেগে বলে—তার আগেই আমার থাবড়া খেয়ে তুমি নি-দাঁত হবে।

          ধবলী জাবর কাটা বন্ধ করে একটু নড়ে-চড়ে মাথা নেড়ে বলে—হুম্‌……বা। ঝগড়া করে না। বাঘা, বানানটা জানা আছে?

          বাঘা সামনের থাবা দিয়ে মাথা চুলকে বলে—না……মানে……বানানটা ঠিক…… তা, তোমাদের কাছ থেকে শিখে নেব।

          হাই তুলে ধবলী বলে—গোরুরা বানান নিয়ে মাথা ঘামায় না। বানান শেখার দরকার হয় না তাদের। দুধ দিতে শিখলেই তাদের দিব্যি চলে যায়।

          করুণ চোখে দুখুর দিকে তাকায় বাঘ।

          দুখুর একটু দুঃখ হয় বাঘের জন্যে। আহা, বানান জানে না বলে সাধের নামটা নেওয়া হবে না বেচারির। অবশ্যি নামটা বড়ো খটমটে, দাঁতভাঙা নাম একখানা। উচ্চারণ করাই শক্ত। তার ওপর বানান? দুখু যুক্তাক্ষরে পৌঁছবার আগেই বাবা গেল মরে। বানান আর শেখা হল কই। ভাত-কাপড় জোগাড় করতেই জীবন শেষ।

          কিন্তু কথাটা বাঘকে বললে সে কী ভাববে? হয়তো ঘেন্না করে আর কোনোদিন মানুষই খাবে না। বাঘ আবার গাঁয়ের লোক ধরে ধরে খাক তা অবশ্যি দুখু চায় না। কিন্তু নগেন জোতদারের মতো কিছু কিছু লোক আছে যাদের খাওয়ার জন্যে দু’একটা কেঁদো বাঘ থাকা ভালোই।

          দুখু তাই একটু কায়দা করে বলে—ও বানানটা আমার ঠিক…… অনেকদিন হয়ে গেল কিনা……

          –আর চালাকি করতে হবে না, আসলে তুমি যেমন বোকা তেমনি মুখ্যু। ভেবেছিলাম অম্বলটা সেরে গেলে তোমাকে খাব, তা খুব বাঁচা বেঁচে গেছি। এমন একটা রামবুদ্ধুকে খেলে আমারও বুদ্ধিশুদ্ধির বারোটা বেজে যেত।

          –খবরদার বেঘো, ভয়ানক রেগে একটা দেড়গজি লাফ দিয়ে দুখু বলে, অনেক সহ্য করেছি বেঘোব্যাটার বাঁদরামি, আর নয়। অপমান সহ্য করার পাত্র আমি নই। তেমন গরুর দুধ খেয়ে মানুষ হইনি আমি।

          বাঘ বাঘা-হাসি হেসে গোঁফের শলা শলা শক্ত চুলগুলি খাড়া করে বলে—কী করবি তুই আমার? তোকে থাবাও লাগাব না, কামড়াবও না, শুধু এই শক্ত করা গোঁফের খোঁচায় তোর ওই তুলতুলে ভুঁড়িটা ফট্‌-ফটাস্‌ করে দেব।

          কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়! রাগে দুঃখে মরিয়া হয়ে দুখু এদিক-ওদিক তাকিয়ে গাছের একটা ডাল-টাল খুঁজতে থাকে। আর বাঘ মিটিমিটি হাসতে হাসতে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে দুখুর কান্ড লক্ষ করে। মানুষের মুরোদ জানতে তার বাকি নেই। একটা হরিণ হজম করার চাইতেও একটা মানুষ হজম করা সোজা। বিশেষ করে দুখুর মতো খেটে-খাওয়া গরিব মানুষগুলোকে। বড়োলোকগুলোকে দেখতে মোটাসোটা নরম-সরম হলে কী হয় ওদের মাংস কিন্তু দুখুদের মাংসের মতো মিষ্টি না, হজম করাও বেশ শক্ত। বোধ হয় খাটাখাটনি করে না বলে ওদের শরীরে মরচে জমে—যাকে ওরা বলে চর্বি। ওই চর্বিতেই পেটের গোলমাল করায়, গরহজম হয়।

          এইসব ভাবতে ভাবতে বাঘ একটু অন্যমস্ক হয়ে পড়েছিল। অম্বলের অসুখটা শুরু হওয়ার পর থেকেই সে হজম-টজমের ব্যাপার নিয়ে আজকাল খুব মাথা ঘামায়।

          এদিকে দুখু এক ফাঁকে একটা গাছের ডাল জোগাড় করে মাথার ওপর বন্‌বন্‌ করে ঘোরাতে ঘোরাতে তেড়ে এসেছে।

          গুণ বা দোষ যা-ই বল, খুব রেগে গেলে দুখুর মুখ দিয়ে ছড়া বেরোয়। গাছের ডাল ঘোরাতে ঘোরাতে সে ছড়া বলে—

                                                          কোঁদলা বাঘা  সোঁদর বনের

                                                          মারতে সাধ  অনেক দিনের

                                                          বাঘ পিটিয়ে বানাই ছাতু

                                                          …………………………

          এই পর্যন্ত বলে আর মেলাতে পারে না দুখু। হাতের ডাল ঘোরে বন্‌বন্‌, কিন্তু ছড়ার নতুন লাইন আর বেরোয় না। অ্যাঁ অ্যাঁ করে তোতলাতে থাকে সে।

          বাঘ গমগম করে হেসে ওঠে—নে নে, মেলা, মেলা, ছাতুর সঙ্গে কাতুকুতু মিলিয়ে দে। তোর কান্ড দেখে কাতুকুতু দিলে যেমন হাসি পায় তামনি হাসি পাচ্ছে আমার।

          আরো খেপে যায় দুখু। এক ঘা বসিয়েই দেয় বাঘের পিঠে। কিন্তু মড়্‌-মড়্‌-মড়াৎ। ডালটাই যায় ভেঙে ।  

uponyaschitta02 (Medium)   

          বাঘ আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। দুখু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে তার ভাঙা ডালের খানিকটা।

          বাঘ বলে—ভেবেছিলাম তোর গায়ে হাত, থুড়ি থাবা তুলব না। হাজার হোক, রক্তের না হোক দুধের একটা সম্পর্ক তোর সঙ্গে তো আমার আছে। ধবলী-মা’র দুধ খেয়েই মানুষ। কিন্তু যেরকম বাড় বেড়েছিস তাতে তোকে একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার।

          বলে বাঘ উবু হয়ে বসে প্রথমে ফ্যাঁচ করে একটা শব্দ করে, তারপর ঠোঁট উলটে ওপর-নিচের দু’পাটি দাঁত দেখায় দুখুকে। দেখেই তো দুখুর আত্মারাম খাঁচাছাড়া। সে পেছিয়ে যায় চার দু’গুণে আট পা।

          প্রথম দিকে বাঘের হালকা মেজাজ দেখে ধবলী ভেবেছিল ব্যাপারটা বেশিদূর গড়াবে না। কিন্তু এখন তার ভয় হয় একটা ভয়ানক কান্ডই না ঘটে যায়!

          সে তাড়াতাড়ি বাঘ আর দুখুর মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়।

          –দ্যাখো বাবারা, তোমরা দু’জনেই আমার দুধ খেয়েছ, দু’জনেই আমার ছেলের মত। তোমরা ঝগড়া-মারামারি করলে আমার কষ্ট হয় না! কোনো মা-ই চায় না তার ছেলেরা এ রকম গুন্ডা-বদমাশ হয়ে যাক।

          –দুখু হারামজাদা আমাকে মারল কেন? বাঘ বলে।

          –তুই আমাকে অপমান করিসনি? একটু সাহস পেয়ে আড়াই পা এগিয়ে এসে দুখু বলে।

          ধবলী এবার শাসনের সুরে বলে –ছি ছি, লজ্জাও নেই তোমাদের? ছোটোলোকের মতো তুইতোকারি করছ, মারামারি করছ, আবার এ ওর ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছ! অমন যদি ফের কর তোমরা, ওই বটপাতার পাহাড় আমি একদিনে খেয়ে ভেদবমি হয়ে মরে যাব।

          ধবলীর কথায় বাঘ শিউরে ওঠে, তার ল্যাজটা যেন ভয়ে টানটান হয়ে যায়, এক লাফে ধবলীর সামনে এসে তার সামনের দুই খুরে মাথা ঘষতে ঘষতে বলে—অমন কাজটিও কোরো না মা। আমি কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমার অবাধ্য হব না।

          পেছনে পেছনে দুখুও এসেছে, সে ধবলীর গলকম্বলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে— আমিও তোমাকে কথা দিলাম না, বাঘা আমার ছোটোভাইয়ের মতো, সে আমাকে যত হেনস্তাই করুক আমি ক্ষমা-ঘেন্না করে চালিয়ে নেব।

          মুখ ঘুরিয়ে বাঘ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ধবলী তাকে বাধা দিয়ে বলে—তাহলে যা থেকে গন্ডগোল শুরু—বাঘার সেই নামের ব্যাপারটাই আগে মিটিয়ে ফেলা হোক।

          দুখু বলে—আমার মত আমি বলেছি। আমার নাম দুখু, বাবার নাম সুখু, ঠাকুরদার নাম ছিল বুকু। আমি সোজা নাম রাখার পক্ষে। ডাকতে সুবিধে, বানান করতে সুবিধে। বাঘা যে বলছিল ধিরিষ্টিদুম্‌বো না কী, ওতে বড়ো ফ্যাচাং।

          –দুমবো নয়, ব্যাজার মুখে বাঘ বলে, দুম্‌বো এক রকম ভেড়াকে বলে—খাবার জিনিস। যাকগে, আমি কিছু বলব না, তোমাদের যা ইচ্ছে সেই নামই রাখো।

          ধবলী মোলায়েম সুরে বলে—বাঘসোনা, নটবর নামটা খারাপ না বাবা। ওটাই আজ থেকে নাম হল তোমার। দেখবে, শুনতে শুনতে তোমারও খুব ভালো লেগে যাবে। আমার কর্তার নাম ছিল হলধর। বলো, নামটা খারাপ? এই যাঃ, বলে ধবলী প্রায় আট ইঞ্চি জিব কাটে, মেয়েদের আবার সোয়ামির নাম ধরতে নেই।

          –তা, উনি এখন কোথায়? নটবর জিজ্ঞেস করে।

          –দুঃখের কথা আর কী বলব, তোমাদেরই জাতভাই কেউ গেল বছর তাকে খেয়ে ………উঃ…উঃ……ম্‌…বা…। ডাক ছেড়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে ধবলী।

          তড়বড় করে নটবর বলে ওঠে— বিশ্বাস করো ধবলী-মা, আমি ওঁকে খাইনি।

          –খেয়ে থাকলেও তুমি কোনো দোষ করনি বাবা নটবর, উনি আমার সোয়ামি হলেও তোমার তো খাবার জিনিস। কান্নাভেজা গলায় ধবলী বলে, আর সামনের হাঁটু দিয়ে চোখের জল মোছে।

          ধবলীর কষ্ট দেখে বড়ো কষ্ট হয় দুখুর। আর কষ্ট পেলেই তার পদ্য পায়। সে ছেলেবেলায় শেখা একটা পদ্যই একটু অন্যরকম করে গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে বলতে থাকে—

                             বাঘেদের কাজ বাঘেরাই করে

                                                          সবারে ধরিয়া খায়,

                             তা বলে বাঘেরে ধরিয়া খাওয়া কি

                                                          মানুষের শোভা পায়।

          এই করুণ পদ্য শুনে নটবর আর স্থির থাকতে পারে না, ছুটে গিয়ে ধবলীর সামনের দুই ঠ্যাং জড়িয়ে ধরে বলে— তুমি আর অমন করে কেঁদো না ধবলী-মা, এই আমি তোমার খুর ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি আর কখনো মাংস খাব না। যদি কচি কচি দু’পেয়ে চারপেয়ে মাংসরা নিজেরাই এসে আমার মুখে ঢুকতে চায়, তবু আমি তাদের ঢুকতে দেব না। মুখে নো-এন্ট্রি টাঙিয়ে রাখব। প্রবেশ নিষেধ। ঢোকা বারণ।

          বাঘের করুণ অবস্থা দেখে ধবলীর কোমল প্রাণ কেঁদে ওঠে—না বাবা নটবর, অত কষ্ট তোমার সইবে না। তুমি একে বাঘ, তায় পুরুষমানুষ। তুমি তো আর হিঁদুঘরের বিধবা নও। মাংস খেতে প্রাণে না চায় খেয়ো না, কিন্তু মাছ-টাছ খেয়ো। নইলে শরীর টিকবে না।

          –তুমি মা, নটবর বলে, তুমি যা আদেশ করবে তা-ই হবে।

          দুখু এবার আসল কথাটা তোলে—সবই তো হল, শুধু কাজের কথাটা ছাড়া। এবার সেটার একটা ফয়সালা হোক। ধবলী-মা কি আমার সঙ্গে যাচ্ছে, না যাচ্ছে না?

          –ওই এক কথা নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর আর ভাল্লাগে না। ধবলী-মা যাচ্ছে না, যাবে না। এখানেই থাকছে, থাকবে। নটবরের সাফ জবাব।

          –তবে আমি চললাম। ওই গুন্ডাটার সঙ্গে তো গায়ের জোরে পারব না।

          বলে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে দুখু।

          –বাবা দুখু, চেঁচিয়ে তাকে ডাকে ধবলী—ছিঃ, অমন ছেলেমানুষি করে না। আমি যা বলছি শোনো।

          ধবলীর ডাকে দুখু থামে, এগিয়ে আসে কাছে।

          –শোনো বাবা দুখু, ধবলী বলে চলে—আমি বলি কী, জগৎ-সংসারে তোমারও কেউ নেউ, আমারও কেউ নেই। মানুষের সঙ্গে এতকাল থেকে তো দেখলে। তোমার বাবাকে ভালোমানুষ পেয়ে তার সব জোতজমি ঠকিয়ে নিয়ে নিল নগেন জোতদার। সেই দুঃখে সে আর বেশিদিন বাঁচল না। না খেতে পেয়ে তোমার মা-ভাই-বোনেরাও একে একে মরে গেল। শুধু কপালগুণে আমি ছিলাম বলে তুমি কোনোমতে বেঁচে রইলে। তাই বলছিলাম কি, তোমার গাঁয়ে থাকাও যা, জঙ্গলে থাকাও তা-ই। বরং নটবরকে সঙ্গী পেলে তুমি অনেক জোর পাবে। আমি তোমার গো-মা, যা বলছি তোমার ভালোর জন্যই বলছি। যদিও তোমার গো-বাবাকে ও-ই খেয়েছে, তবু ছেলে ও খারাপ নয়। এ ক’দিন আমার খুব যত্নআত্তি করেছে। আমি যা দুধ দিতে পারি তাতে তোমাদের দু’জনের বেশ ভালোই চলে যাবে। আমরা তিন জনে এখানে থাকলে কোনো কষ্ট হবে না। তা ছাড়া, গাঁয়ে আমি প্রাণ খুলে কথা কইতে পারি না, এখানে আমরা কত স্বাধীনভাবে থাকব বলো তো।

          ধবলীর যুক্তি দুখুর মনে ধরে। গাঁয়ে নগেন জোতদার ছাড়া সকলেরই এখন হাড়ির হাল। সকলেরটা গায়ের জোরে কেড়ে-কুড়ে না হয় আইন-আদালত করে হাতিয়ে নিয়ে সে-ই শুধু ফুলে-ফেঁপে উঠছে। নগেন জোতদারের অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ। কিন্তু ভয়ে মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারে না। মনে মনে অনেকটা ভেবে নেয় দুখু। এই গভীর জঙ্গলে সে যদি এসে বাসা নেয় সবাই ভাববে মনের দুঃখে সে দেশান্তরী হয়েছে, নয়তো বাঘের পেটে।

          এই একটা সুযোগ নগেন জোতদারের ওপর শোধ নেবার। বাবাকে মনে পড়ে দুখুর। মনে পড়ে জমিটুকু বাঁচানোর জন্যে তার সেই হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ানো। মনে পড়ে মা-ভাই-বোনদের না-খেতে-পাওয়া শুকনো মুখগুলি, মনে পড়ে একে একে তাদের মরে যাওয়া। বুকের মধ্যে দারুণ একটা রাগ গুরগুর করতে থাকে।

          দুখু বলে—বেশ, আমি রাজি। কিন্তু আমরা তিন জন হলে না হয় কথা ছিল। নটবরের বউ-ছেলে-মেয়েরা আছে না?

          –বউকে আমি পরিত্যাগ করেছি, নটবর বলে।

          –পরিত্যাগ? সে আবার কী?

          –সোজা বাংলায় খেদিয়ে দিয়েছি। অমন দজ্জাল মেয়েছেলেকে অনেকদিন সহ্য করেছি। কিন্তু সবকিছুরই একটা শেষ আছে। যেদিন ঝগড়া করতে করতে ও আমার ল্যাজ কামড়ে দিল, সেদিনই ঠিক করলাম আর নয়, দিলাম খেদিয়ে।

          –তা বেশ করেছ, দুখু বলে, কিন্তু ছেলেমেয়েরা?

          –ওদের কথা আর বোলো না, সবক’টা একদম হিপি হয়ে গেছে। যা ইচ্ছে খায়, যা-তা করে, যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়। আমিও সাফ সাফ বলে দিয়েছি, বড়ো হয়েছ এখন, যা প্রাণে চায় করোগে যাও, কিন্তু এমুখো হলে আর রক্ষে রাখব না। আমি তোমাদের মুখদর্শন করতে চাই না।

          হিপি কাদের বলে তা জানা ছিল দুখুর। সাহেবদের ছেলেমেয়ে বখে গেলে তাদের হিপি বলে। একবার লঞ্চে করে কয়েকটা এসেছিল এদিকে। দুখুদের গাঁয়ে নেমেওছিল। বিতিকিচ্ছি! মাথাভরতি জটপাকানো লম্বা লম্বা  চুল, মুখময় গোঁফদাড়ি। আর কী জামাকাপড়ের ছিরি! নাঃ, নটবরের সত্যিই কপাল মন্দ। ওর জন্যে যে দুখুর একটু দুঃখ না হয় এমন না।

          তবু আঁটঘাট বেঁধেই সে এগোতে চায়, জিজ্ঞেস করে—কিন্তু তোমার বউ যদি আবার ফিরে আসতে চায়? কিংবা ধরো, তুমিই যদি আবার বিয়ে করে বস?

          নটবর হেসে বলে—খেপেছ? একবার বিয়ে করেই ঘরকন্নার সাধ আমার মিটে গেছে। তার ওপর দিনকাল যা পড়েছে, এটা নেই, সেটা পাওয়া যায় না। সুখে থাকতে ভূতের কিল খাওয়ার দরকার নেই আমার। ধবলী-মাকে পেয়েছি, তুমিও এলে। বেশ চলে যাবে তিন জনে।

          –তা তো বুঝলাম। কিন্তু তোমার খেদিয়ে-দেওয়া বউয়ের কথাটা যে বেমালুম চেপে যাচ্ছ। সে যদি ফিরে আসে? তখন?

          –মরে যাবার পর কেউ ফিরে এসেছে বলে তো শোনা যায়নি, নটবর বিজ্ঞের মতো বলে।

          –তার মানে?

          –মানে আর কী! আমার ল্যাজে কামড় দেবে আর আমি চুপ করে সয়ে যাব, তেমন মেনিমুখো ব্যাটাছেলে আমাকে পাওনি। যেই আমার ল্যাজে দাঁত বসানো আমিও অমনি হ্যাঁচকা টানে ল্যাজ ছাড়িয়ে ঘুরে এক কামড়ে একেবারে গোড়া থেকে তার ল্যাজখানা কচাৎ……

          –অ্যাঁ! দুখু আর্তনাদ করে ওঠে।

          –হ্যাঁ। তারপর ওই ল্যাজকাটা মেয়েছেলেকে আর কে বিয়ে করবে বলো। সেই দুঃখে ও একদিন বুনো ওল খেয়ে মরেই গেল।

          ধবলী চোখ বুজে এমনভাবে বসে ছিল যাতে মনে হচ্ছিল সে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু শুনছিল সবই। হঠাৎ চোখ মেলে সে বলে—ছিঃ বাবা নটবর, মেয়েরা হচ্ছে মায়ের জাত, তারা কামড়ালেও তাদের কামড়াতে নেই। কথাটা মনে রেখো। তা বউয়ের সেই কাটা ল্যাজটা নিয়ে কী করেছ বাবা?

          –ওকথা জিজ্ঞেস করে আর লজ্জা দিয়ো না ধবলী-মা। সে আমি বলতে পারব না। নটবর থতিয়ে থতিয়ে বলে।

          –বুঝেছি, বুঝেছি, তোমাকে আর বলতে হবে না। যাক, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন যাও তো, দু’ভায়ে গিয়ে আমার জন্যে দু’টি কচি কচি ঘাসের ডগা নিয়ে এসো। জঙ্গলে আসা ইস্তক খিদেটা এত বেড়ে গিয়েছে……

          বট গাছের ডালপালাগুলি যেমন ছড়ানো, তেমনি তার ঘন পাতার বাহার। গাছতলাটা সাফসুতরো করে নিয়ে গাছের মিষ্টি ছায়ায় বেশ আরামেই দিন কাটে দুখু, ধবলী আর নটবরের।

          এ তো আর মানুষের ঘরসংসার নয় যে হাজার রকমের ঝামেলা আর দিবারাত্তির শুধু রুটিন বাঁধে কাজের পরে কাজ। এদের সংসারে কাজ বলতে শুধু থাকার জায়গাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, আর খাওয়া-ঘুমোনোকে যদি কাজ বলতে চাও তো বলতে পার। খাবার-দাবারের ভাবনা নেই। ধবলী এত দুধ দিচ্ছে যে দুখু-নটবর খেয়ে শেষ করতে পারে না। আর ধবলীর জন্যে নানান রকম ঘাসপাতার অভাব কী জঙ্গলে। দুখুর মাঝে-মধ্যে মুখ বদলাতে ইচ্ছে করলে খুঁজে-পেতে বুনো কুল গাব-টাব এনে খায়। আর আছে মধু। জান তো, সুন্দরবনের মধু বিখ্যাত। কত লোক চুরি করে সেই মধু আনতে গিয়ে বাঘের পেটে যায়। এদের বলে মউচোর। বড়ো গরিব এরা, তাই অমন ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলে যায় মধু জোগাড় করতে।

          চাকভাঙা মধুর যেমন তুলনা নেই, তেমনি নেই মউমাছির হুলেরও। কী জ্বালা রে বাবা! আর রাগিও ওরা ভীষণ। চাকে হাত পড়লে আর রক্ষে নেই। বাঘই হও আর মানুষই হও, চাক ভেঙেছ কী অমনি লাখে লাখে গিয়ে কাছে যাকে পাবে তাকেই একেবারে ছেঁকে ধরবে, খতম করে ছাড়বে একেবারে। মউচোরেরা তাই অনেকরকম কায়দাকানুন করে চাক ভাঙে। কিন্তু সেসব তো আর দুখুর জানার কথা নয়।

          শেষ পর্যন্ত নটবরই একটা মতলব বের করে। সুন্দরবনের বাঘ সাধারণত গাছে চড়ে না, হয়তো চড়তে পারেও না। নটবর কিন্তু চটপট গাছে চড়তে পারে। কী করে সে এই বিদ্যেটা শিখেছে তা দুখু জিজ্ঞেস করেনি। তবে ওর মনে হয়েছে নটবরের অনেক বিদ্যের মতো এ বিদ্যেটাও বোধ হয় খেয়ে-শেখা।

          এখন নটবরের চাক ভাঙার কায়দাটা হচ্ছে এই রকম। সে জলার কাছাকাছি কোনো গাছে একটা মউচাক বেছে নেয়। দুখুকে তার সাবধান করে দেওয়া আছে—‘খবরদার, এক মাইলের মধ্যে তুমি থাকবে না। আমি যখন হালুম-হুলুম-হুল্লুম করে তিনটে ডাক ছাড়ব তখন বুঝবে অল কিলিয়ার, তখন তুমি আসবে।’ নটবর গাছে উঠে বেধড়ক থাবা চালাতে থাকে মউচাকে। বাস্‌, মউমাছিরাও তাকে ছেঁকে ধরে সর্বাঙ্গে। কিন্তু বাঘের ঘন মোটা লোম আর শক্ত মাস্‌কুল থাকায় ওরা খুব একটা সুবিধে করতে পারে না। তবু জ্বলুনি-পুড়ুনি যে খুব কম হয় তা নয়। চোখ পিটপিট করে নটবর যখন দেখে যে চাক ফাঁকা, মানে সব মউমাছিই এখন তার গায়ে সেঁটে আছে, সে তখন একখানা জ্যান্ত মউচাকের মতো চেহারা নিয়ে ঝপাং করে লাফ দিয়ে পড়ে জলায়। সেখানে জল-কাদায় সারা শরীর ডুবিয়ে শুধু নাকের ফুটো দুটো জলের ওপর তুলে রাখে শ্বাস নেবার জন্য। একটু পরেই মউমাছিগুলো দম বন্ধ হয়ে যায় মরে। তখন জলা থেকে উঠে নটবর হাঁক ছাড়ে—হালুম-হুলুম-হুল্লুম। ডাক শুনে ছুটে আসে দুখু। প্রথমে সে যত্ন করে নটবরের গা পরিষ্কার করে দেয়। তারপর গাছে উঠে চাক নামিয়ে আনে। চাক ভেঙে মধু বার করা হয়। সেই মধু মজা করে খায় ওরা তিনজনেই।

          এ তো শুনলে শুধু একটা। সময়ের তো অভাব নেই ওদের। এমনি আরো কত মজার মজার নতুন নতুন কান্ডই করে ওরা। সব কথা লিখতে গেলে একখানা মহাভারত হয়ে যাবে। মোদ্দা কথা, খুব ফুর্তিতে আর আরামে আছে ওরা।

          নটবরের অম্বলের অসুখ ভালো হয়ে গেছে। তবু তার যে কথা সেই কাজ। সেই যে ধবলীর খুর ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কখনো মাংস খাবে না, সেকথার কোনো নড়চড় হয়নি। মাংসে এখন তার ভীষণ অরুচি। কিন্তু বরাবরের আঁশ খাওয়ার অভ্যেসটা একেবারে ছেড়ে দিলে শরীর কমজোর হয়ে যেতে পারে বলে ধবলী পীড়াপীড়ি করায় মাঝে মাঝে খাল থেকে ধরে এনে একটু-আধটু মাছ-টাছ খায়। তাও আঁশটে গন্ধ লাগে বলে গাঁদালপাতার সঙ্গে মিশিয়ে খায়। এ বুদ্ধিটা দুখুর দেওয়া। তোমরা নিশ্চয়ই গাঁদালপাতার গন্ধটা জান। এমন গন্ধ—শুধু মাছের আঁশটে গন্ধ কেন, দুনিয়ার সব গন্ধই ও চেপে দিতে পারে। অনেকের মতে গন্ধটা বিটকেল, নটবরের মত অবিশ্যি তা নয়। কেননা, গাঁদালপাতা পেটের পক্ষে খুব ভালো, আর যা পেটের পক্ষে ভালো তা নটবরের কাছে ভালো হতে বাধ্য।

          এই দ্যাখো, কী কথায় কী কথা এসে যাচ্ছে। যাকে বলে ধান ভানতে শিবের গীত। আমার বলার কথাটা এই, জঙ্গলের নতুন সংসারে দুখু, ধবলী আর নটবর মিলে-মিশে ভারি সুন্দর আছে।

          মানুষকে যদি খাওয়া-পরা নিয়ে খুব বেশি ভাবতে না হয় তাহলে সে কী করে? যার যেমন ক্ষমতা ভালো কাজ করার চেষ্টা করে, তা-ই না? কারো কারো মনের ভেতরে অনেক সুন্দর সুন্দর ইচ্ছে লুকোনো থাকে, অনেক গুণ চাপা থাকে, সময় সুযোগ পেলে কত ভালো কাজই না মানুষ করতে পারে! কিন্তু খিদে নিয়েই যদি মানুষ সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকে তখন এইসব সুন্দর ইচ্ছে আর গুণগুলি শুকিয়ে যায়, মরে যায়।

          দুখু ধবলী আর নটবরের সংসারে কোনো কিছুর অভাব না থাকায়, আর নিজেদের মধ্যে খুব ভাব-ভালোবাসা মন-বোঝাবুঝি গড়ে ওঠায়, ওদের মনে এসেছে শান্তি আর আত্মবিশ্বাস। ওদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে যে গুণগুলি ছিল, এখন প্রচুর অবসর পেয়ে সেগুলির চর্চায় ওরা মেতে ওঠে।

          আগে শুধু রেগে গেলে আর দুঃখ পেলেই দুখুর মুখ দিয়ে ছড়া বেরোত। অবশ্যি এ অভ্যেসটা দুখু যে পাঠশালে দু’বছর তিন মাস পড়েছিল সেখানকার পন্ডিতমশায়ের কাছ থেকে পাওয়া। পন্ডিতমশায় পাঠশালে যত না পড়াতেন ঘুমোতেন তার চাইতে ঢের বেশি। ছেলেদের গোলমালে যদি তাঁর কাঁচাঘুম ভেঙে যেত তাহলে আর রক্ষে ছিল না। হাতের কাছে যাকে পেতেন তার পিঠেই একচোট হাতের সুখ করে নিতেন। হাতের সঙ্গে সঙ্গে মুখও চলত তাঁর, গরম গরম ছড়া বলে যেতেন অনর্গল। তাঁর একটা প্রিয় ছড়া ছিল এই রকম—

                                      মনে মনে বিপদ গনি

                                      তোর ঘাড়ে চেপেছে শনি,

                                      শনি যখন দিবে টান

                                      ভেঙে যাবে পিঠখান।

সে যা-ই হোক, লেখাপড়া পন্ডিতমশায়ের কাছ থেকে কতখানি শিখেছিল দুখু তা না বলাই ভালো, তবে রেগে গেলে ছড়া বলার এই গুণটা পেয়েছিল। এতকাল দুখু ছড়া-পদ্য নিয়ে কিছু ভাবেনি, রেগে গেলে বা দুঃখ পেলে আপনা-আপনি যা তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসত তার বেশি কিছু না। এখন কিন্তু অনেকসময়েই তার ছড়া-পদ্য পায়। সে মনে মনে সেগুলো আওড়ায়, যেটা মনে ধরে মুখস্থ করে রাখে, পরে ধবলী-নটবরকে শোনায়, শুনে ওরা তারিফ করে।

          খিদের ভাব থেকে দুখুর তৈরি একটা ছড়া—

                                                বাঘা ভাই ছুটে আয়

                                                বড়ো যে রে খিদে পায়,

                                                আরো চাই আরো খাই

                                                দুধ চাই মধু চাই

                                                খাই খাই আইঢাই

                                                খেতে খেতে মরে যাই

                                                আহা রে

                                                তা তা ধিন্‌ ধিন্‌ ধিন্‌

                                                ধিনা রে।

          কিন্তু দুখুর যে পদ্যটা ওদের সবচেয়ে ভালো লেগেছে, যেটাতে সুর দিয়ে ওদের পারিবারিক সংগীত হিসেবে গাইবার কথা ভাবা হচ্ছে, সেটা এই রকম—

                                                আমরা তিনজনা

                                      দেখতে শুনতে যেমনই হই

                                                মনেতে একমনা।

          ধবলীর সুরের কান গানের গলা বরাবরই ভালো। কিন্তু গাঁয়ে থাকতে গলা ছেড়ে গাইবার উপায় ছিল না বলে অমন গলাটা তার নষ্ট হয়েই যাচ্ছিল। এখন খোলা গলায় রেওয়াজ করে করে কী খোলতাই আর মিষ্টি গলাই না হয়েছে! দুখুর গানটা অদল-বদল করে সুর দেয় ধবলী—

                                                হাম্বা হাম্বা হাম্বা

                                                আমরা তিনজনা

                                                দেখতে রকম রকম বা…

                                                দেখতে শুনতে যেমনই হই

                                                মনে একই রকম বা…

                                                মিলে-মিশে আছি যেন

                                                দুধ মধু আর রম্ভা…

                                                হাম্বা হাম্বা হাম্বা……

          তার পদ্যটার খোলনলচে সব এভাবে পালটে দেওয়ায় প্রথমটা দুখুর মনে একটু দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু প্রাণমাতানো সুরে ধবলীর মুখে গানটা শুনে একটুও আর দুঃখ থাকে না তার। এটা হয়ে ওঠে তাদের পারিবারিক সংগীত। গাছতলায় বসে, নদীর ধারে বেড়াতে বেড়াতে প্রায়ই ওরা গানটা গায়। ধবলীর গম্ভীর সুরেলা গলার সঙ্গে দুখুর গলার মিহিতান মিলে কী চমৎকারই না শোনায়! নটবরও মাঝে মাঝে গলা মেলাতে চেষ্টা করে। তবে গলাটা তার বাংলা গানের পক্ষে তেমন সুবিধের না। দুখু আর ধবলী তাকে কিন্তু খুবই উৎসাহ দেয়। তবে গাইতে শুরু করে নিজেই সে লজ্জা পেয়ে হঠাৎ আবার থেমে যায়।

          কিন্তু নটবরের একটা গুণের খবর হঠাৎই পেয়ে যায় ওরা।

          একদিন দুপুরে পেট পুরে দুধ আর গাঁদালপাতা দিয়ে মাছ খেয়ে একটু পরেই মাতলামো করতে শুরু করে নটবর। এলোমেলো পা ফেলছে, কথা যাচ্ছে জড়িয়ে, অর্ধেক কথার মাথামুন্ডু নেই কিছু।

          ভয় পেয়ে ধবলী বলে—হ্যাঁ বাবা দুখু, মরে-টরে যাবে না তো নটবর? কিংবা যদি পাগল-টাগলই হয়ে যায়?

          –না, না, দুখু ধবলীকে ভরসা দেয়, খাবারে বিষ-টিষ কিছু থাকলে এতক্ষণে যন্ত্রণায় ও অস্থির হয়ে পড়ত। আসলে ওই গাঁদালপাতার সঙ্গেই বুনো সিদ্ধির পাতা-ফাতা কিছু ছিল হয়তো। ভুল করে তা-ই খেয়েই ওর নেশা হয়ে গেছে। চলো, ওকে নিয়ে নদীর ধার থেকে বেড়িয়ে আসি। খোলা হাওয়ায় নেশা ছুটে যাবে এক্ষুনি।

নদীর ধারে তিন জনে ওরা বেড়ায়। জনপ্রাণী কেউ কোথাও নেই। হু হু করে মিঠে হাওয়া ছুটছে। ধবলী আর দুখু সামনে, পেছনে বেতালা পা ফেলতে ফেলতে নটবর। ওর এখনো বেশ নেশা আছে। কিন্তু অসুস্থতার আর কোন লক্ষণ নেই দেখে ধবলী এখন নিশ্চিন্ত।

নেশার ঝোঁকে নটবর একবার পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে যায়। ধবলী ছুটে গিয়ে বলে— শরীর খারাপ লাগছে বাবা? বাড়ি যাবে? বলে নিজের ল্যাজ বাড়িয়ে নটবরকে ধরে উঠতে সাহায্য করে।

নটবর উঠে দাঁড়িয়ে জড়ানো গলায় বলে—কেয়া বোলা? শরীর খারাপ? কভি নেহি। দেখো, হাম আভি নাচেগা। দুখুভাই, হাম বাঘ কা নেহি, মানুষকা নাচ নাচেগা।

বলে পেছনের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সত্যি সত্যিই নাচতে শুরু করে নটবর। উঁচু-করা সামনের দু’পায়ে চলে হাতের কাজ। হাত-পায়ের কাজ, ঘাড়-কোমর দোলানো, মুখ-চোখের ভাবভঙ্গি  দেখে বোঝা যায় নাচে সত্যিই এলেম আছে নটবরের। ধবলী তো বিভোর হয়ে খুর ঠুকে ঠুকে তাল দিতে থাকে। দুখুও মনে মনে স্বীকার করে মানুষের নাচ মানুষের মতোই নাচতে পারে নটবর। কীভাবে শিখেছে সেটা বড়ো কথা নয়!

নটবর নাচতে নাচতেই বলে—এতনা্‌ টাইম তুমলোক যো নাচ্‌না দেখা উস্‌কা নাম হ্যায় কত্থক। আভি দেখো মণিপুরি…

নতুন ধাঁচের নাচ শুরু করে নটবর। অবাক হয়ে ওর কান্ড দেখে দুখু আর ধবলী। পরের পর কত নাচই না নেচে চলে নটবর। সবশেষে টুইস্ট। ওটার ধকল আর সহ্য করতে পারে না, নাচ শেষ হওয়ার আগেই অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।

ধবলী তো কেঁদেই ফেলে, ভাবে কী না কী হল নটবরের। দুখু দৌড়ে গিয়ে পরনের কাপড়টা জবজবে করে ভিজিয়ে নিয়ে আসে নদী থেকে।

চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতেই উঠে বসে নটবর। নেশা কেটে গেছে তার। সম্পূর্ণ সুস্থ সে এখন। প্রথম কথাই সে বলে—আমি দুদু খাব ধবলী-মা, আমার খুব খিদে পেয়েছে।

–খাবে বইকী বাবা। বলে ধবলী নটবরের কাছে এগিয়ে যায়।

দুখু হাসতে হাসতে বলে—তুমি তো বড়ো চাপা স্বভাবের বাঘ হে নটবর। তুমি যে এত ভালো নাচতে পার সেকথা এতদিন বেমালুম চেপে ছিলে!

দুধ খেতে খেতে জবাব না দিয়ে লাজুকভাবে হাসে নটবর।

বর্ষা নামে। সবুজ সতেজ হয়ে ওঠে বনের গাছপালা। কত না অদ্ভুত শব্দ শোনা যায় চারিদিকে। পাতার ওপর বৃষ্টির টাপুরটুপুর, কখনো ঝড়ো হাওয়ার শনশনানি, পাখ-পাখালির বৃষ্টিভেজা ডানার ঝাপট, আর টইটুম্বুর খাল-বিলে অবিরাম চলে ব্যাংদের গাওনা—

                             ঘ্যাঙোর ঘ্যাং, ঘ্যাঙোর ঘ্যাং

                             বিষ্টি এল, প্রাণ জুড়োল

                             গাইছি গান, ছুঁড়ছি ঠ্যাং

                             ঘ্যাঙোর ঘ্যাং, ঘ্যাঙোর ঘ্যাং।

uponyaschitta03 (Medium)

কিন্তু বনের বর্ষার রূপ যেমন মন মাতায়, তেমনি কিছু অসুবিধেও হতে থাকে ওদের। বিশেষ করে দুখু আর ধবলীর। বরাবর ঘরে থাকা অভ্যেস ওদের। বট গাছের ঘন পাতার ছাউনিও সব সময়ে পারে না বৃষ্টি ঠেকাতে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ওদের প্রায়ই সর্দিকাশি হয়, গা ম্যাজম্যাজ করে। নটবরের অবিশ্যি ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বৃষ্টিবাদলার তোয়াক্কা করে না।

শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে দুখুই কথাটা পাড়ে নটবরের কাছে—একটা ব্যবস্থা না করলে যে আর চলে না ভাই। এত জলে ভেজা আমার আর সইছে না, ধবলী-মা’রও শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

–তা ঠিক, নটবর স্বীকার করে, আমার বোঝা উচিত ছিল। আমি রোদে-জলে বাঘ, আমার যা সয়, তোমাদের তা সইবে কেন। কিন্তু কী করা যায় বলো তো। আমার মাথায় কিছু আসছে না।

–আমি একটা কথা ভেবেছি। আজ রাতের বেলায় একবার গাঁয়ে যাব। যদি চোরে না নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে কোদাল আর কুড়ুলটা নিয়ে আসব। ও দুটো পেলে একটা চালা বানিয়ে নেওয়া এমন কিছু শক্ত হবে না।

–রাতে কেন? দিনের বেলায়ই যাও না। বিষ্টিতে পথঘাটের যা অবস্থা হয়ে আছে…! নটবরকে খুব চিন্তিত দেখায়।

–পাগল নাকি, দুখু বলে—দিনের বেলায় যাই আর আমাকে নিয়ে একটা হইহই কান্ড শুরু হয়ে যাক! তা ছাড়া আমার একটা মতলব আছে, তোমাকে সব বলব একদিন। আমি চাই গাঁয়ের লোক ভাবুক আমি মরে গেছি, না হয় দেশ ছেড়ে চলে গেছি।

–কথাটা খুলেই বলো-না। তুমি কি এখনো আমাকে বিশ্বাস কর না? নটবরের গলা অভিমানে ভেজা-ভেজা।

–ছি ছি, এ তুমি কী বলছ, নটবরের থাবা জড়িয়ে ধরে দুখু, তুমি আমার ভাইয়ের মতো। তোমাকে সব কথা বলতেই হবে, তোমার সাহায্যও দরকার হবে আমার। তবে বলি শোনো, ওই হারামজাদা নগেন জোতদার সর্বনাশ করেছে আমাদের। আমাদের সামান্য কিছু জমিজমা ছিল। বাবাকে ঠকিয়ে সেটুকু সে কেড়ে নিল। শুরু হল আমাদের চরম কষ্ট। একে একে সবাই মরে গেল। পড়ে রইলাম শুধু আমি একা। গ্রামের আরো কতজনের এমন সর্বনাশ যে করেছে ব্যাটা…

–ইস্‌, আপশোশে থাবা কামড়ায় নটবর, এমন জানলে গন্ধ হোক আর যা-ই হোক নাক টিপে খেয়েই ফেলতাম ব্যাটাকে। ধরেও ছেড়ে দিতাম না।

–সে যা হবার হয়ে গেছে। এখন নতুন করে মওকা আর একটা পাওয়া গেছে। ওরা ভাবছে আমি মরেছি, আমি এই সুযোগে এমন ফন্দি একখানা আটব না……

–কী ঠিক করেছ?

–এখনও কিছু ঠিক করিনি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সুযোগ একটা না একটা এসে যাবেই।

–আলবত, নটবর জোর দিয়ে বলে, চেষ্টা থাকলে সব কাজেই সফল হওয়া যায়। আর জেনো, সুন্দরবনের জব্বর বাঘ এই নটবর সব সময়ে সঙ্গে আছে তোমার। দরকার হলে জান লড়িয়ে দেব আমি।

আবার হাতে থাবার জড়াজড়ি হয়।

–তাহলে, আজ রাতে গাঁয়ে যাবার কী ব্যবস্থা করা যায় বলো তো? দুখু জিজ্ঞেস করে।

–এ আবার একটা সমস্যা নাকি? তুমি আমার পিঠে চেপে গলা জড়িয়ে বসে থাকবে, আর দেখতে না দেখতে পৌঁছে যাবে বনের শেষে। আমি তোমার জন্যে ওখানে অপেক্ষা করে থাকব, তুমি চুপি চুপি গিয়ে কাজ সেরে ফিরে এলেই আবার নিমেষে তোমাকে নিয়ে চলে আসব এখানে।

দুখুর একটু লজ্জা-লজ্জা করে—অতটা পথ আমাকে পিঠে নিয়ে দৌড়তে কষ্ট হবে না তোমার?

–তুমি আমাকে হাসালে দেখছি, নটবর বলে—সেই মাংস খাওয়ার যুগে বড়ো বড়ো গোরু-মোষ পিঠে ফেলে নিয়ে আসতাম কী করে? মাংস আর খাই না বলে দুগ্‌লা হয়ে গেছি ভাবছ নাকি? না হে না, ধবলী-মা’র দুধের গুণ মাংসের চাইতে ঢের বেশি।

ধবলীকে কথাটা জানাতে সে ভয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে বলে—ওমা, রাতে আমি একলা থাকব কী করে? আমার ভয় করবে না বুঝি!

–কিচ্ছু ভয় নেই ধবলী-মা, ধবলীকে সাহস দেয় নটবর, নটবরের এলাকায় ঢুকবে তেমন বুকের নেই কারুর। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ো। আমরা তো যাব আর আসব।

রাত ঘুরঘুট্টি আঁধার হতে দুখু আর নটবর বেরিয়ে পড়ে। বৃষ্টিটা ধরেছে। ওদের একটু সুবিধে হয়।

–শোনো, দুখুকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয় নটবর, বাঘের পিঠে চাপা শক্ত মোটেই না। নিজের পিঠের প্রশংসা নিজে করা ভালো দেখায় না। কিন্তু বলতে কী, আমাদের পিঠের মতো পিঠ দুনিয়ায় কোথাও পাবে না তুমি।

–তবে যে লোকে বলে বাঘের পিঠে চাপা এক ভয়ানক ব্যপার?

–আরে, সে তো আমরা কাউকে পিঠে চাপতে দিতে চাই না বলে।

–কেন, চাও না কেন? তাতে তো তোমাদের পিঠের সুনামই আরো বেড়ে যাবে।

–কিন্তু মানসম্মানটা যে নষ্ট হবে। বাঘ বলে কথা! লোকে বলবে একটু পিঠ চুলকে দিলেই বাঘের পিঠে চড়া যায়। তোমার প্রশংসা করাকে পিঠ চুলকে দেওয়া বল না?

–হ্যাঁ, কিন্তু আমিও তো একটা মানুষ। আমাকে পিঠে চড়ালে বাঘ জাতির সম্মান নষ্ট হবে না?

–না, হবে না। তুমিও দুঃখী, আমিও দুঃখী। দুঃখ আমাদের মিলিয়ে দিয়েছে, জাত-টাতের কথা ওঠেই না। জানবে দুঃখীরা সবাই এক, তাদের কোন জাত নেই, ধর্ম নেই, তারা সবাই দুঃখী।

–কিন্তু তোমার দুঃখ আর আমার দুঃখ তো এক নয়। দুখু বলে।

–তলিয়ে দেখলে একই। আমার বউটা যে দিবারাত্তির আমার সঙ্গে ঝগড়া করত সে কি শুধু তার স্বভাবের দোষ? তা নয়। লোভী মানুষগুলো জঙ্গলের সব জন্তু-জানোয়ার মেরে খতম করে দিতে লাগল। আমি হন্যে হয়ে খাবার খুঁজে বেড়াই। কোনোদিন পাই, কোনোদিন পাই না। ছেলেপুলেগুলো দিনরাত খাবারের জন্য ঘ্যানঘ্যান করে। দুটো বাচ্চা খিদের জ্বালায় একলা একলা খাবার খুঁজতে বেরিয়ে শিকারিদের ফাঁদে ধরা পড়ে গেল। আমি নজর রাখতে পারি না বলে অন্যগুলো বখে যেতে লাগল। দিনে দিনে আমার বউয়ের মেজাজও হয়ে উঠতে লাগল তিরিক্ষি, ছুতোনাতায় কেবলই ঝগড়া করে আমার সঙ্গে। অভাবে স্বভাবটাই খারাপ হয়ে গেল তার। তবেই দ্যাখো, আমাদের দু’জনের দুঃখে মিল আছে কি না। আমাদের দুঃখ কোন ঠাকুরদেবতার দেওয়া নয়। একদল মানুষের লোভেই আজ আমাদের এই অবস্থা—বলতে বলতে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল নটবর, হঠাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলে—সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করলেই চলবে? নাও, উঠে পড়ো পিঠে, শিগগির। বাঃ, ঠিক আছে। এইবার সামনের দিকে ঝুঁকে একেবারে লেপটে যাও আমার পিঠের সঙ্গে। গুড—ভেরি গুড। বেশ, এখন কষে দু’হাতে আমার গলাটা জড়িয়ে ধরো। কক্ষনো আলগা দেবে না কিন্তু। আমি যখন ফুল স্পিড দেব, মানে খুব জোরে ছুটতে থাকব, তখন যদি পিঠ থেকে ছিটকে যাও, তাহলে কিন্তু এক্কেবারে ছাতু। আর একটা কথা, চোখ সব সময়ে বুজে থাকবে। চোখ খুলেছ কী আশপাশের গাছপালার সঙ্গে ‘এই ধাক্কা লাগল, এই ধাক্কা লাগল’ ভাব হবে তোমার। অন্যমনস্ক হয়ে যেতে পার। কিন্তু চোখ বুজে থাকলে গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না। এমন দৌড়নোর কায়দা আমাদের। তাহলে রেডি, সেডি, গো……

ধবলীর পিঠে দু’একবার শখ করে চড়েছে দুখু। প্রথমটায় সেই রকম একটা দুলকি চাল। কয়েক সেকেন্ড। হঠাৎ দারুণ একটা ঝাঁকুনি। দুখু দুই পা দিয়ে সাঁড়াশির মতো পেঁচিয়ে ধরে নটবরের পেটটা, হাত দুটো আপনা-আপনি আরো শক্ত হয়ে জড়িয়ে যায় তার গলায়। তারপর শনশন করে হাওয়া কেটে চলার শব্দ আর মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি। চোখ বুজে থাকায় দুখু ঠিক বুঝতে পারে না কত জোরে তারা চলেছে। শুধু ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে যেমন মনে হয় অন্ধকার গর্তের মধ্যে গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছি, সেই রকম একটা ভাব হয় দুখুর। নটবরের নিষেধ সত্ত্বেও পিটপিট করে চোখ দুটো একবার একটু খোলে সে। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে আবার বুজে ফেলে। এমন অন্ধকার, মনে হয় যেন ঘন কালো জলের মধ্য দিয়ে হাঙর-কুমিরের পিঠে চেপে চলেছে সে। আর চোখ খোলবার কথা সে মনেও আনে না।

হঠাৎ আবার সেই দুলকি চাল। তবু চোখ খোলে না দুখু।

–নেমে পড়ো, নেমে পড়ো। পৌঁছে গেছি আমরা—নটবরের গলা। আস্তে আস্তে নটবরের পিঠ থেকে নেমে দুখু বলে—বাব্‌বা, এর নাম বাঘের পিঠে চড়া!

–কত তাড়াতাড়ি আর কত আরামে আলে বলো তো!

–তা বটে। তবে অভ্যেস নেই কিনা……

–দু’চারবার চড়লেই অভ্যেস হয়ে যাবে। তাহলে আর দেরি করে কাজ নেই। তুমি চটপট কাজ সেরে চলে এসো। আমি এখানেই রইলাম।

সরাসরি গাঁয়ের ভেতরে না ঢুকে একটা ঘুরপথ ধরে দুখু। তাঁর কুঁড়েঘরটা গাঁয়ের এক কোণে।

যেতে যেতে দুখু লক্ষ করে গাঁয়ের অন্যদিকে যেখানটায় জোতদার নগেন মন্ডলের বাড়ি সেখানটা বেশ আলো-আলো। ঢোল-কাঁসির আওয়াজ আর লোকজনের হই-হট্টগোলও বাতাসে ভেসে অল্প অল্প আসছে এদিকে। ব্যাপারখানা কী? দুখুর বড়ো জানতে ইচ্ছে করে। সে তো আর চোর-ডাকাত নয়, ইচ্ছে করলেই সোজাসুজি সে ওখানে চলে যেতে পারে। কিন্তু তাহলে সব মতলবই তার বানচাল হয়ে যাবে। আবার নিজের গাঁয়ে কী ইচ্ছে সেটা জানতেই বা কার না ইচ্ছে করে।

অন্য পথে বাঁক নেয় দুখু। বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে নগেন জোতদারের বাড়িতে যাতায়াতের পথের পাশে একটা ঘন ঝোপের পেছনে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকে। কথা কইতে কইতে হরদম লোকজন যাচ্ছে আসছে। কান খাড়া করে তাদের প্রতিটি কথা শুনতে চেষ্টা করে দুখু।

কিছুক্ষণ বসে থাকবার পরই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায় তার কাছে। ঘটা করে বনবিবির থানে পুজো দিচ্ছে নগেন মন্ডল। বাঘের মুখ থেকে ফিরে আসায় বাঘের দেবী বনবিবিকে এই পুজো। একটা পা অবিশ্যি জবর জখম হয়েছে নগেন মন্ডলের, নেংচে নেংচে হাঁটে। কিন্তু প্রাণটা তো বেঁচেছে। সেই আনন্দে পুরুত-দরবেশে একেবারে ছয়লাপ করে দিয়েছে। গাঁয়ের সবার নেমন্তন্ন। দু’মণ আটার সঙ্গে দেড় মণ ভেলিগুড় আর সাড়ে সাতশো বিচিকলা মেখে সিন্নি দেওয়া হয়েছে। সিন্নি খেয়ে সবাই খুব খুশি। তা গরিবমানুষেরা যদি একদিন পেট পুরে সিন্নি খেতে পায় সে তো ভালো কথাই।

কিন্তু দুখুকে ভাবিয়ে তোলে অন্য ব্যাপার। নগেন জোতদার নাকি তার ল্যাংড়া পায়ের দিব্যি দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে গাঁয়ের পাশের জঙ্গলকে সে নি-বাঘ করে ছাড়বে। কথাটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়। তার দু-দু’খানা বন্দুক। চোরাগোপ্তা শিকার করে উপরি রোজগারও করে বেশ। এ কাজে তার দোসর ভিখু সর্দার। সে ব্যাটা স্বভাবে যেমন খুনে, বন্দুক চালাতেও তেমনি দড়। নাঃ, ভাবনাই কথা। নটবর আর মোটেই নিরাপদ নয়।

তাড়াতাড়ি উঠে নিজের কুঁড়ের দিকে পা চালায় দুখু।

গিয়ে দেখে যা ভেবেছিল ঠিক তা-ই। ঘরের দরজা হাট করে খোলা। যা দু’একটা হাঁড়িকুঁড়ি ছিল চোরে সব নিয়ে গিয়েছে। তা যাক, সেজন্যে দুঃখ নেই। কোদাল আর কুড়ুলখানা থাকলেই হয়। সে দুটো ছিল গোয়ালঘরের এক কোনায়। ভাগ্য ভালো বলতে হবে, কিছু দড়িদড়ার সঙ্গে কোদাল আর কুড়ুলখানা ঠিক জায়গাতেই পাওয়া গেল। চোর ব্যাটা বোধ হয় আসল ঘরের অবস্থা দেখে গোয়ালঘরে আর ঢোকেইনি।

তাড়াতাড়ি  জিনিসগুলো বেঁধে-ছেঁদে নিয়ে দুখু বেরিয়ে পড়ে।

দুখুর দেরি দেখে নটবরও চিন্তিত হয়ে পায়চারি করছিল।

দুখুকে আসতে দেখে নটবর শুধোয়—এত দেরি হল কেন?

–সে অনেক কথা, দুখু বলে—আগে এখান থেকে পালাই চলো।

বুদ্ধিমান নটবর আর কথা বাড়ায় না। দুখুকে পিঠে নিয়ে একখানা হাওয়া-দৌড় লাগিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে আসে নিজেদের আস্তানায়।

এসে দেখে ধবলী নাক ডাকিয়ে তোফা ঘুমোচ্ছে।

দুখু বলে—ধবলী-মাকে এখন ডেকে দরকার নেই। আগে কাজের কথাগুলো তোমার সঙ্গে সেরে নিই। আচ্ছা নটবর, বনবিবি কি সত্যিই তোমাদের দেবতা? যে মানুষের ’পরে তার দয়া থাকে তোমরা তার কিছু করতে পার না?

–বাজে কথা, বিলকুল বাজে কথা। বনবিবি-টিবি কিচ্‌ছু নেই। সব বানানো। কোনো বিবির দয়ায় বাঘের হাত থেকে কেউ বাঁচে না। যদি কেউ বাঁচে, সে বাঁচে হয় বাঘের ভুলে, না হয় নিজের বুদ্ধি আর সাহসে। মাঝখান থেকে বনবিবির থান বানিয়ে কিছু লোক পয়সা রোজগার করে। তা, বনবিবির খবরে অত কী দরকার তোমার?

–আছে, আছে। আজ দেখলাম গাঁয়ে নগেন জোতদার খুব ঘটা করে বনবিবির পুজো দিচ্ছে বাঘের হাত থেকে বেঁচেছে বলে। আর শুনলাম সে নাকি প্রতিজ্ঞা করেছে এই বনকে নি-বাঘ না করে ছাড়বে না।

–বটে! গোঁফ চুমরে হাসে নটবর।

–না নটবর, ওকে অত সহজ পাত্র ভেবো না। ওর সঙ্গে আছে শাগরেদ ভিখু সর্দার। ওটাও একটা আস্ত শয়তান। এখন থেকে তুমি খুব সাবধানে চলাফেরা করবে। নগেন জোতদারকে আমি বিলক্ষণ জানি। দু’চার দিনের মধ্যেই ও জঙ্গল ঢুঁড়তে শুরু করবে। আমারও এই মহা সুযোগ। এখন থেকে আমি বনবিবির মহাভক্ত বাবা দুখুরাম পীর! বলে মিটিমিটি হাসে দুখু।

দুখুর মতলব ঠিক বুঝতে না পেরে নটবর বলে—তুমি একটা কোন ফিকিরে আছ। খুলেই বলো-না সবকিছু।

–বলব, বলব, সময় হলে সব বলব। এখন শুধু একটা কথা তোমাকে বলে রাখি—কাল থেকে এ জায়গা ছেড়ে একলা কোথাও যাবে না। আর এই বটগাছের গায়ে তোমার লুকিয়ে থাকার জন্য একটা খোঁদল আমি কাল বানিয়ে দেব। যখনই জঙ্গলের ভেতর থেকে আমার হাঁক শুনবে ‘জয় মা বনবিবি’, অমনি ওই খোঁদলের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে থাকবে। বুঝবে বিপদ আসছে। এখন চলো দিকি, ধবলী-মাকে ডেকে তুলে খেয়ে-দেয়ে একখানা ঘুম লাগানো যাক। কাল অনেক কাজ।

অঘোরে ঘুমোচ্ছিল ধবলী। অনেক ডাকাডাকি করে তাকে ঘুম থেকে তোলা গেল।

ঘুমজড়ানো গলায় ধবলী বলে—এসেছ বাবারা! আমার কীরকম বিচ্ছিরি লাগছিল…

হো হো করে হেসে ওঠে নটবর—বিচ্ছিরি লাগলে কেউ অমন ঘুমোতে পারে নাকি!

নটবরের কথায় কান না দিয়ে ধবলী বলতে থাকে—তোমরা চলে যাবার পর একলা একলা কেমন যেন ভয়-ভয় করছিল। কিছুতে ঘুম আসে না। ভেজা মাটিতে বসতেও ইচ্ছে করে না, দাঁড়িয়েই আছি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন একটু ঝিমুনি মতন এসেছে। হঠাৎ মনে হল আমার পেছনের পা দুটো অবশ অসাড় হয়ে গেছে। আর কেমন যেন স্বপ্নের মতো দেখলাম একটা কালো পেল্লায় চেহারার অদ্ভুত জানোয়ার আমার বাঁট থেকে সব দুধ শুষে খেয়ে নিচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই আমি তাকে ঠেকাতে পারছি না। তারপর যেই জানোয়ারটা আমাকে ছেড়ে দিল অমনি গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলাম আমি।

–স্বপ্ন, স্বপ্ন, নটবর বলে—ও নিয়ে ভাববার কী আছে? এখন খেতে দাও দিকি। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! খেতে গিয়ে নটবর দেখে এক ফোঁটা দুধ নেই ধবলীর বাঁটে।

–এ কী! দুধ কোথায় গেল তোমার?

–তা তো জানি না বাবা। ধবলী বলে।

দুখুও তখন পরীক্ষা করে দেখে সত্যিই তো একটুও দুধ নেই ধবলীর বাঁটে। ভয়ানক একটা আশঙ্কা দেখা দেয় তার মনে। কিন্তু দিনের আলোয় ভাল করে পরীক্ষা না করে এখুনি কিছু বলে সে ওদের ভয় পাইয়ে দিতে চায় না। বলে—না-ই বা খেলাম দুধ একদিন। মধু তো আছে। একটা রাত মধু খেয়েই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। ধবলী-মা, তুমি খেয়েছ তো?

–এই তো খাব এখন। আমার খাবার আছে।

–এত রাত করে খাওয়ার অভ্যেস নেই তোমার, নটবর বলে, তুমি খেয়ে

নিলে পারতে।

–একলা একলা খেতে ইচ্ছে করে না যে।

–আমাদের মায়েদের ওই এক দোষ। ছেলেরা যেন চিরকালই শিশু, তাদের না খাইয়ে-দাইয়ে নিজের খাওয়া চলে না—দুখু মন্তব্য করে।

তারপর খাওয়া সেরে ওরা ঘুমোতে যায়। নটবর আর ধবলী ঘুমিয়ে পড়ে একটু পরেই। শুধু ঘুম নেই দুখুর চোখে। হাজারো চিন্তা তার মাথায়। মনে হচ্ছে শত্রুর সংখ্যা আর একটা বাড়ল। আর এ শত্রুও নগেন জোতদারের চাইতে কোন অংশে কম না।

ভোরের আলো ডালপালার ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দিতেই উঠে বসে দুখু। সারারাত সে ঘুমোয়নি। নটবর আর ধবলী তখনও অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

দুখু পা টিপে টিপে গিয়ে ধবলীর পাশে বসে। ওর ঘুম না ভাঙিয়ে ভাল করে লক্ষ্য করে ওর বাঁটগুলো। যা ভয় করেছিল দুখু ঠিক তা-ই। সাপের দাঁতের আঁচড়ের সরু সরু দাগ বাঁটগুলোতে। আর এ যে-সে সাপ নয়। বড়ো জাতের কেউ একজন। তিনিই এসে দুধ খেয়ে গেছেন কাল। ধবলী যে অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা বলছিল সেটা মিথ্যে নয়। কোনো কোনো বড়ো সাপের এই ক্ষমতা আছে। তারা চোখে চোখে তাকিয়ে অন্য অনেক প্রাণীর বুদ্ধিশুদ্ধি বিকল করে দিতে পারে এমন কথা শোনা যায়।

দুখু ভাবে—সাপের কাছে দুধের লোভ বড় লোভ। একবার যখন ধবলীর দুধের স্বাদ সে পেয়েছে, এখন থেকে শুধু তক্কে তক্কে থাকবে। নটবরকে ব্যাপারটা জানানো দরকার। সব সময় ধবলী-মাকে চোখে চোখে রাখতে হবে।

একটু পরে ঘুম ভাঙে ধবলী আর নটবরের। আজকের সকালটা ভারি সুন্দর। একদম বৃষ্টি নেই। ঝকঝকে রোদ্দুরে বনের সবুজ যেন ঝিলিক দিচ্ছে। সারাটা দিন এমন থাকলে হয়। অনেক কাজ আজ করতে হবে দুখুকে।

আশেপাশে অনেক বড়ো বড়ো গাছ, বাঁশঝাড়। দুখু পছন্দমতো কিছু বাঁশ আর গাছের ডাল কেটে নেয়। বেনাঘাসের বনও কাছেই। পাঁজা পাঁজা বেনাঘাস কেটে লতা দিয়ে বেঁধে বান্ডিল করে দেয় দুখু। নটবর দাঁতে করে নিয়ে আসে ওদের গাছতলায়।

দুখু প্রথমে কোদাল দিয়ে মাটি তুলে তুলে খানিকটা জায়গা বেশ উঁচু করে নেয়। বৃষ্টি হলেও জল গড়িয়ে এসে ওই জায়গাটা ভিজিয়ে দিতে পারবে না। ওরা ওখানে ঘুমোতে পারবে, বসতে পারবে। তারপর চার কোণায় চারটে খুঁটি পুঁতে মস্ত একটা চালা তৈরি করে ওই বেদির ওপর। ছাউনির কাঠামোটা বানায় বাঁশ দিয়ে, তার ওপর ঘন করে বেনাঘাস বিছিয়ে শক্ত করে লতা দিয়ে বেঁধে দেয়। বটপাতার বুনুনির ফাঁক দিয়ে যেটুকু বৃষ্টির জল গড়িয়ে আসতে পারবে তা আটকে যাবে বেনাঘাসের ছাউনিতে। বেনাঘাসের গন্ধটাও ভারি মিষ্টি।

তারপরের কাজ নটবরের জন্য লুকোবার একটা জায়গা তৈরি করা। বটগাছের গুঁড়িটা পেল্লায়। কুড়ুল চালিয়ে গুঁড়ির গায়ে ঝটপট একটা গর্ত কেটে ফেলে দুখু। গর্তের ভেতরটা যথেষ্ট বড়ো করা হয় যাতে নড়াচড়া করতে পারে নটবর। কিন্তু মুখটা এমনভাবে করা হয় যাতে কোনরকমে শুধু ঢোকা-বেরনো চলতে পারে। উদ্দেশ্য গর্তটা যাতে কারুর চোখে না পড়ে। দুখু আর নটবর আলোচনা করে ঠিক করে ধবলীর খাবারদাবার স্তূপ করে রাখা হবে গর্তের মুখটায়। বাইরে থেকে গর্তটাকে দেখাই যাবে না।

এই গর্ত কাটার ব্যাপারটা ভালো লাগে না ধবলীর। তবে কি কোন ভয়ের কারণ ঘটেছে?

সে দুখুকে ডেকে জিজ্ঞেস করে—হ্যাঁ বাবা দুখু, কী হয়েছে বলো তো। ওই গর্তটা কাটলে কেন?

দুখু ভেবে দেখে সাপের ব্যাপারটা কখনই ধবলীকে বলা চলে না, তাহলে ভয়েই সে মরে যাবে। কিন্তু নগেন জোতদারের ব্যাপারটা লুকোনো ঠিক হবে না। তা ছাড়া, ধবলি ভীতু হলেও বোকা নয়। দুখু কালকের সব কথা খুলে বলে ধবলীকে।

শুনে ভয়ে ধবলীর মুখ ঝুলে পড়ে, শব্দটি বেরোয় না তার মুখ থেকে।

দুখু তাকে ভরসা দিয়ে বলে—তুমি মিছেমিছি ভেবে শরীর-মন খারাপ কোরো না। নগেন কিচ্ছু করতে পারবে না নটবরের। উলটে সে-ই ঘায়েল হয়ে যাবে। তুমি আমার বুদ্ধির ওপর বিশ্বাস রাখো।

তারপর চোখের ইশারা করে নটবরকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে এমনভাবে বসে দু’জনে যেন দিনের কাজের শেষে বিশ্রাম আর খোশগল্প করতে বসেছে দুই বন্ধু।

আসলে সাপের কথাটা পাড়বার জন্যই নটবরকে ডেকেছে দুখু।

–মন দিয়ে শোনো নটবর, খুব দরকারি কথা। আর খবরদার, ধবলী-মা যেন একটি কথাও জানতে না পারে। কাল বড়ো জাতের কোন সাপ এসে ধবলী-মা’র দুধ খেয়ে গেছে। তাই আমরা দুধ পাইনি।

–সে কী!

–হ্যাঁ, সকালবেলায় আমি খুব ভালো করে ধবলী-মা’র বাঁট দেখেছি। তোমরা তখন ঘুমোচ্ছিলে। সাপের দাঁতের আঁচড়ের স্পষ্ট দাগ। ও ভুল হবার নয়।

–কিন্তু কোন্‌ সাপের এত সাহস? আমার এলাকায় ঢুকে আমাদেরই আস্তানা থেকে আমাদেরই ধবলী-মা’র দুধ খেয়ে যায়? হাল্‌…লু…

দুখু দু’হাতে মুখ চেপে ধরে নটবরের। গর্জনটা বেরোতে দেয় না।

–হচ্ছেটা কী, দুখু বকুনি দেয় নটবরকে, চ্যাঁচামেচি করে কী লাভটা হবে শুনি! মাঝখান থেকে ধবলী-মা সব জেনে ফেলবে। তুমি বুদ্ধিমান বাঘ, তোমার এরকম বোকামি করা সাজে না।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে, হঠাৎ যেন কথাটা মনে পড়ে নটবরের, এ নিশ্চয় সেই হতচ্ছাড়া কালকেউটের কাজ। দেখাচ্ছি মজা শয়তানটাকে।

–দাঁড়াও, দাঁড়াও, দুখু বলে—অত তড়বড় করে কোন কাজ হবে না। মনে রাখতে হবে দু-দুটো জাঁদরেল শত্তুর আমাদের। ঠান্ডা মাথায় হিসেব করে নিকেশ করতে হবে ওদের। শোনো, কাল থেকে গাছতলা ছেড়ে এক পা-ও নড়বে না তুমি। আমি ঘুরে খোঁজখবর রাখব। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। আর মনে থাকে যেন, যেই শুনবে ‘জয় মা বনবিবি’ বলে আমার হাঁক, অমনি গিয়ে লুকোবে গর্তে। খবরদার, আমি না ডাকলে বেরোবে না।

–তা-ই হবে। যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও সায় দেয় নটবর।

এবার কালকেউটের ব্যাপারটা একটু বলা যাক।

নটবরের এলাকা ছাড়িয়ে খানিকটা গেলে একটা নিচু জলা জায়গা। সেখানে ব্যাংদের বসত—নানারকমের ব্যাং— কোলা ব্যাং, সোনা ব্যাং, ধেড়ে ব্যাং, ধাড়ি ব্যাং, ছোঁড়া ব্যাং, ছুঁড়ি ব্যাং—জায়গাটা ব্যাঙে-ব্যাং, আর রাতদিন শুধু তাদের ঘ্যাঙোর ঘ্যাং।

ওদিকটায় নটবর বড়ো একটা যেত না, আর কাছাকাছি জল থাকায় বিস্তর ঘাসখেকো মাছখেকো ঠান্ডা মেজাজের জন্তু-জানয়ারের বাস ছিল ওখানটায়। ঝগড়াঝাঁটি যে হত না তা নয়, তবে তেমন মারাত্মক কিছু ঘটত না কখনো। মোটামুটি সুখে-শান্তিতেই ছিল ওরা।

হঠাৎ একদিন কালকেউটে এসে জুড়ে বসল ওখানে। তার বুকভরা শুধু হিংসে আর মুখভরা শুধু বিষ।

কারণে অকারণে যাকে কাছে পায় তাকেই ছোবলায় কালকেউটে। তার ছোবলে দারুণ বিষ। এমন বিষ যাতে জ্বলে-পুড়ে নীল হয়ে তক্ষুনি তক্ষুনি মরণ।

ভয় পেয়ে সবাই পালায় তল্লাট ছেড়ে।

জলার ধারের সরস মাটি ভরা ছিল গাছগাছালিতে। যখন জন্তু-জানোয়ারেরা সব পালিয়ে গেল তখন কালকেউটে তার অকারন আক্রোশ মেটাতে লাগল গাছপালার ওপর। তার ছোবলের বিষে সবুজ গাছপালাগুলি সব শুকিয়ে মরে গেল। দেখতে দেখতে অমন সবুজ সুন্দর জায়গাটা হয়ে গেলে একটা মরুভূমির মত। যখন হাওয়া বয়, গাছপালা না থাকায়, হু হু কান্নার মত একটা শব্দ হয়। বুকের ভেতরটা যেন শিউরে শিউরে ওঠে সেই শব্দে।

সবাই—এমনকী পাখিরাও জায়গাটা ছেড়ে চলে গেছে। শুধু ব্যাঙেরা পারল না পালিয়ে যেতে। জল ছাড়া ওরা থাকতে পারে না। কিন্তু ভয়ে দুঃখে ওদেরও গান গাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। রোজই তাদের কত-না আপনজন যায় কালকেউটের পেটে। অকারনেও কত জনকে মেরে ফেলে কালকেউটে।

বাধা দেওয়ার শক্তি ওদের নেই, কালকেউটের সঙ্গে লড়াই কি সহজ কথা! তবু ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে—এর কি কোনো প্রতিকার হবে না? কতদিন চলবে এই অত্যাচার?

এইসব আলোচনা করতে করতে কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ে। হয়তো সেইদিনই তার কোন প্রিয়জন গেছে কালকেউটের পেটে।

ওদের নেতাগোছের ভোম্বলদাস সোনা ব্যাং কিন্তু আশা হারায় না। সে ওদের বলে—অন্যায় কখনো চিরকাল টিকে থাকতে পারে না। সুযোগ আমরাও একদিন না একদিন পাবই। সেদিনের জন্যে নিজেদের তৈরি রাখো। যত ক্ষুদ্রই হই আমরা, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বার ডাক যেদিন আসবে সেদিন যেন নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে পারি। তরুণ ব্যাঙেরা মনে মনে প্রস্তুত হতে থাকে।

আর তাদের খাদক কালকেউটে জায়গাটাকে একটা শ্মশান বানিয়ে সেখানে মহাসুখে রাজত্ব করে। তার হিলহিলে লম্বা কালো শরীরটা যেন কালো বিদ্যতের মতো অস্থিরভাবে সর্বক্ষণ ছুটে ছুটে বেড়ায়। কেউ যেন না ঢুকতে পারে তার রাজত্বে। অবশ্যি তার দাপটে ওই জায়গার ধারে-কাছেও কেউ ঘেঁষে না। নিজের বিষের দেমাকে কখনো কখনো বিরাট ফণা দুলিয়ে দুলিয়ে গান গায় কালকেউটে—

                             হিস্‌ হিস্‌ হিস্‌

                             আমার আছে বিষ

                             ছোবল আমার সইতে পারিস্‌

                             এমন কে আছিস্‌?

                             হিস্‌ হিস্‌ হিস্‌

                                      কারো ভালো চাইনে জানিস্‌

                                      মরতে যদি ভালোবাসিস্‌

                                      তবেই আমার কাছে আসিস্‌

                             হিস্‌ হিস্‌ হিস্‌।

অবশ্যি গান না বলে শাসানি বলাই ঠিক!

বিষের দেমাকে যতই দেমাকি হোক কালকেউটে, বোকা সে নয়। পারতপক্ষে বাঘের এলাকা সে মাড়ায় না। সে ভালোই জানে তার ছোবলে যেমন মরণ, বাঘের থাবাটিও তেমনি একবার মাথায় পড়লে তার দফারফা।

কিন্তু একদিন ঝুঁকি নিয়েই সে ঢুকে পড়ে বাঘের এলাকায়। ব্যাং খেতে খেতে তার অরুচি ধরে গেছে। নিজের এলাকায় ব্যাং ছাড়া নেইও কিছু, নিজেই সে রাখেনি। ইঁদুর-টিঁদুর কিচ্‌ছু না। ছোটো ছোটো পাখি আর পাখির ডিমও কালকেউটের খুব পছন্দসই খাবার। কিন্তু সব গাছই তার বিষ-ছোবলে শেষ। গাছ থাকলে তবে তো পাখির বাসা, বাসা থাকলে তবে তো ডিম।

বাঘের এলাকায় ঢুকে খুব সাবধানে ঘোরাফেরা করে কালকেউটে। ঝপঝাড়ের ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার খোঁজে—নতুন কোনো খাবার। কিন্তু তেমন কিছু জোটে না।

পেটে দারুণ খিদে। জেদি কালকেউটের জেদ চেপে যায়। সে বাঘের এলাকার আরো ভেতরে ঢুকে পড়ে।

হঠাৎ তার চক্ষুস্থির। একটা ঘন ঝোপের পেছন থেকে নিস্পলক চোখে সে তাকিয়ে থাকে। বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে সুন্দর সাদা একটা গোরু। একটু দূরে বসে আছে বাঘ আর একজন মানুষ। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত ঠেকলেও তা নিয়ে মাথা ঘামায় না কালকেউটে। ওই গোরুর দুধ তাকে খেতেই হবে। কতকাল দুধের মুখ দেখেনি সে। এসপার-ওসপার যা হয় হোক, দুধ না খেয়ে সে এখান থেকে নড়বে না। তার জন্যে যদি সারারাত অপেক্ষা করতে হয় তাতেও সে রাজি। লতাপাতায় গা মিলিয়ে বসে থাকে কালকেউটে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়, সন্ধের অন্ধকার ঘন হতে হতে রাত। রাতও এগিয়ে চলে। অধৈর্য হয়ে ওঠে কালকেউটে। খিদেয় বত্তিরিশ নাড়ি চুঁইচুঁই করছে। ওদিকে বাঘ-মানুষ-গোরু কারুরই নড়াচড়া লক্ষণ নেই। ওদের কথাবার্তার আবছা শব্দ ভেসে আসছে। কখন ঘুমোবে ওরা? ঘুমোলেই……

কিন্তু ঘুমোবে বলে তো মনে হচ্ছে না। কালকেউটে ভাবে—তবে কি ফিরেই যাবে আজ? সঙ্গে সঙ্গে নিজের ওপর ঘেন্নায় নিজেকেউ ছোবলাতে ইচ্ছে করে তার। সবসেরা সাপ হচ্ছে সে—সাপের রাজা কালকেউটে। এত সহজেই হার মানবে?

হঠাৎ কালকেউটের পলকহীন চোখ দুটো যেন দু’কুচি হীরের মতো জ্বলে ওঠে। বাঘের পিঠে চেপে মানুষটা যেন কোন্‌দিকে চলে গেল। যাক, জাহান্নমে যাক, আর যেন না ফেরে।

এই সুযোগ। কালকেউটে তার লতাপাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।

নিঃশব্দে সে এগোয় ধবলীর দিকে। তার মিশমিশে কালো শরীরটা অন্ধকারের সঙ্গে মিলে-মিশে একাকার।

ধবলীর সামনে খানিকটা দূরে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ায় কালকেউটে। এবার তার বিশেষ শক্তির পরীক্ষা। সমস্ত ইচ্ছাশক্তি যেন হীরের কুচির মতো দুই চোখে এনে জড়ো করে। ধবলী ঝিমোচ্ছে। আর কিছু ভাবে না কালকেউটে, শুধু ভাবে—ঘুমিয়ে পড়ুক ওই গোরুটা, গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যাক। তার জ্বলজ্বলে দুই চোখ থেকে এই দারুণ ইচ্ছাশক্তি যেন ধবলীকে ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে ফেলতে পারে।

কালকেউটে বুঝতে পারে জয় হয়েছে তার শক্তির।

সে এগিয়ে যায় ধবলীর কাছে। শরীরের নিচের দিকটা দিয়ে দিয়ে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে ধবলীর পা দুটো। তারপর রাক্ষুসে খিদেয় বাঁটে মুখ দিয়ে শুষে নিতে থাকে সব দুধ। গভীর ঘুমের মধ্যেও ধবলী একবার গা-ঝাড়া দেয়।

তারপরের ঘটনা তোমার জান।

uponyaschitta04 (Medium)

দুখু-ধবলী-নটবরের সেই হাসিখুশি জীবনের ওপর ভয় আর দুশ্চিন্তার একটা কালো ছায়া নেমে এসেছে। সেই যেমন-ইচ্ছে বেড়ানো নেই, নাচ-গান নেই, প্রাণ খুলে হাসি-গল্প নেই। সব সময়ে ভয়—এই বুঝি বিপদ এল। সর্বক্ষণ চোখ-কান সজাগ রেখে পাহারা দেয় ওরা।

ওদের আস্তানা থেকে কিছু দূরে মস্ত একটা গাছ বেছে নিয়েছে দুখু। সেই গাছের মগডালে চড়ে সারাদিন সে পাহারা দেয়। তাকিয়ে থাকে ওদের গাঁয়ের দিকে। ও জানে বাঘের খোঁজে জঙ্গলে আসবেই নগেন জোতদার আর ভিখু সর্দার। শিগগিরই আসবে। শুধু যে রাগ মেটানো তা-ই নয়, চোরাগোপ্তা বাঘ মেরে তার চামড়া বিক্রি করে বেশ দু’পয়সা রোজগারও করে সে।

নটবরকে বাঁচাতে হবে। আর সেইসঙ্গে তাদের পরিবারের ওপর যে অত্যাচার করেছে নগেন জোতদার, এখনো গাঁয়ের লোকের ওপর চালিয়ে যাচ্ছে যে জুলুমবাজি তার শোধ তুলতে হবে। মনের তেজে চোখের তেজও যেন বেড়ে গেছে দুখুর। বহুদুরের গ্রাম, পথঘাট সব যেন সে স্পষ্ট দেখতে পায়। জঙ্গলের মধ্যে কোথাও পাতাগাছটি নড়লে সে সজাগ হয়ে ওঠে।

নটবরের দিনের বেলায় কাজ ধবলীকে পাহারা দেওয়া।

বর্ষার জল পেয়ে বট গাছের আশপাশে প্রচুর ঘাস জন্মেছে। ধবলী চরে চরে তা-ই খায়। দূরে কোথাও যায় না। ওকে যে কেন এত সামলে রাখা হচ্ছে তা এখনো ও জানে না।

একদিন একটু বিরক্ত হয়েই ধবলী বলেছিল দুখুকে—আমাকে এত আগলে আগলে রাখছে কেন? নগেন জোতদারের রাগ বাঘের ওপর, সে তো আর আমাকে মারতে আসবে না।

দুখু বুদ্ধি করে সামলে নিয়েছিল—নগেন জোতদারকে ভালো চিনেছ তুমি! তোমাকে একলা পেলে ছেড়ে দেবে নাকি? গলায় দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে তুলবে না নিজের গোয়ালে!

কথার ফাঁকে নটবরকে চোখ টিপে দিয়েছিল দুখু।

নটবর তখন জোর দিয়ে বলেছিল—আসলে ধবলী-মা, আমাকে পাহারা দিচ্ছ তুমি, তোমাকে পাহারা দিচ্ছি আমি। একজনের কিছু হলে অন্যজন অন্তত একটা চিৎকার করেও দুখুভাইকে জানান দিতে পারবে।

কথাটা মনে ধরেছিল ধবলীর। সে এ নিয়ে আর কখনো প্রশ্ন করেনি।

সেই যে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে দুখু গিয়ে গাছে চড়ে বসে, সন্ধে না হতে আর নামে না। ধবলী তারও আগে ঘুম থেকে উঠে বসে থাকে। দুখু বেরোনোর আগে তাকে পেট ভরে খাইয়ে দেয়।

কোনো কোনো দিন অত ভোরে খেতে চায় না দুখু।

–তা বললে কি হয় সোনা, সেই রাতের আগে আর তো খাওয়া হচ্ছে না। শরীর ভেঙে যাবে যে।

–সকালবেলায় এত খাওয়া যায় নাকি? দুখু বাচ্চা ছেলের মত বলে।

–তবে আমিও সারাদিন উপোস দিয়ে থাকব—অভিমানে গলা ভারি হয়ে আসে ধবলীর।

–আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। দাও, খাচ্ছি।

নটবর একপাশ থেকে হেসে ওঠে।

–কী দুখুভাই, হার মানতে হল তো? ধবলী-মা যা বলে তা আমাদের ভালোর জন্যেই বলে। মা’র কথার অবাধ্য হতে নেই।

–ইয়ার্কি করতে হবে না, তোমার মতো বাঘা পেট আমার নয় যে যখন খুশি যত খুশি খাবার ঢুকিয়ে ফেলা যায়।

দুখুকে চটতে দেখে নটবর খিক্‌খিক্‌ করে হাসে।

–ভালো হচ্ছে না নাটু, দুধ খেতে খেতে দুখু বলে, অমন করলে তোমাকে পাঠাব গাছে চড়তে। মজাটি টের পাবে তখন।

–কেন, গাছে কি চড়তে পারি না আমি?

–তা পার, কিন্তু সারাদিন মগডালে বসে কাটাতে হলে শুধু জোরে কুলায় না, কায়দা লাগে।

–তা ঠিক। নটবর মেনে নেয়।

এই বিপদের দিনগুলোতে ওরা পরস্পরের খুব কাছাকাছি আর আপন হয়ে উঠেছে। যেমন শত্রু দেশ আক্রমণ করলে দেশের মানুষরা ছোটোখাটো ঝগড়া-বিবাদ ভুলে একজোট হয়ে দাঁড়ায়, একে অন্যের ভরসায় বাঁচে। বড় বড় বিপদ তাই অনেক সময়ে মন্দের পোশাক পরে ভালোই করতে আসে মানুষের। তাকে বড়ো হতে, সাহসী হতে সাহায্য করে। দুখু-ধবলী-নটবর অবশ্যি এমনিতেই এতদিনে একই পরিবারের লোকের মতো হয়ে গিয়েছে। বিপদের দিনে সেই ভালোবাসাটা আরো গাঢ় হয়। একে অন্যের ভালো নিয়েই ভাবে সর্বক্ষণ।

সন্ধে হয়ে গেলে মগডালের পাহারাদারি শেষ হয় দুখুর। কারণ রাতে পায়ে হেঁটে জঙ্গলে বাঘ শিকার করতে আসে না কেউ। মাচা বেঁধে টোপ দিয়ে বাঘ শিকার এ নয়। নগেন জোতদারকে দিনেই আসতে হবে। তাই রাতের বেলায় ওদিক থেকে কোনো ভয় নেই।

কিন্তু কালকেউটের ভয়টা বেশি রাতেই। তাই ধবলীকে না জানিয়ে পালা করে রাত জাগে নটবর আর দুখু। সে জানতেও পারে না যে তার দুই ছেলের একজন না একজন সজাগ চোখ-কান মেলে পাহারা দিচ্ছে তাকে।

নটবর অন্ধকারে দেখতে পায়। দুখুর দুই চোখও ধীরে ধীরে অন্ধকারে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সে হাতের কাছে সর্বদা একখানা মজবুত গাঁটওলা লাঠি রাখে।

এদিকে কালকেউটে দূর থেকে সব দেখে আর হিংসেয় বুক ফেটে যায় তার। ধবলীর দুধের স্বাদ সে ভুলতে পারে না, ব্যাং-ট্যাং আর ছুঁতেও ইচ্ছে করে না। তবু খিদের জ্বালায় তা-ই গিলতে হয় মাঝে মাঝে। দিন নেই রাত নেই যখন-তখন সে ঢুকে পড়ে বাঘের এলাকায়। ঝোপেঝাড়ে গা মিশিয়ে তাকিয়ে থাকে ধবলীর দিকে। কিন্তু কাছেই থাকে পাহারাদার। লোভী কালকেউটের কশ বেয়ে নাল গড়িয়ে তার গলা-বুক ভিজিয়ে দেয়। মরিয়া হয়ে ওঠে সে। ওই গোরুর দুধ তাকে খেতেই হবে, একবার নয় বারবার—অনেক—অনেকবার।

রাতের বেলায় কালকেউটে চলে যায় ওদের আস্তানার খুব কাছাকাছি। কিন্তু বুঝতে পারে কেউ-না-কেউ ঠিকই জেগে আছে। রাগে আক্রোশে তার সমস্ত বিষ টগবগ করে ফুটতে থাকে। মনে হয় এক্ষুণি এই বিষ উগরে দিতে না পারলে সে নিজেই বুঝি মরে যাবে বিষের জ্বালায়। না হোক দুধ খাওয়া, ইচ্ছে করে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সবক’টাকে  ছোবলে ছোবলে শেষ করে দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাগটা লোভের কাছে হেরে যায়। রাতের পর রাত জেগে একটা সুযোগের অপেক্ষা করে কালকেউটে।

একদিন শেষরাতে সুযোগ একটা পেয়েও যায় সে।

সেদিন রাত জাগার পালা ছিল দুখুর। শরীরের ওপর দিয়ে কম ধকল তার যাচ্ছে না বেশ কিছুদিন ধরে। রাতশেষের মিঠে বাতাসে কখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে তার।

তক্কে তক্কে ছিল কালকেউটে। তার শরীরে ক্লান্তি নেই, চোখে নেই ঘুম, হিংসের আগুন শুধু দাউদাউ জ্বলে তার বুকের মধ্যে।

যেই সে বুঝতে পারে দুখু ঘুমিয়েছে, অমনি সে বিদ্যুতের মত ছুটে যায় ধবলীর পাশে। তীব্র ইচ্ছাশক্তি দিয়ে আরো গভীর করে দেয় ধবলীর ঘুম।

কিন্তু মনে চিন্তা থাকলে যা হয়, ঘুমটা তেমন গভীর হতে পারেনি দুখুর। কালকেউটের নড়াচড়ার সামান্য শব্দেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় তার। হাতের পাশেই লাঠি। ধড়মড় করে উঠে বসেই লাঠিটা হাতে নিয়ে হেঁকে ওঠে সে—কে রে? কে?

সবে ধবলীর বাঁটে মুখ দিতে যাচ্ছিল কালকেউটে। দুখুর চিৎকারে দারুণ রেগে গিয়ে ধবলীকে ছেড়ে সে যেন শরীরটাকে দশহাত লম্বা করে ছোবল হানে দুখুকে লক্ষ্য করে। ওই ছোবল গায়ে পড়লে তৎক্ষণাৎ ভবলীলা সাঙ্গ হত দুখুর। কিন্তু ঘুমচোখেও দুখু বুঝতে পারে কী হয়েছে, কী হতে যাচ্ছে। সবল হাতের লাঠিটা চরকির মতো ঘুরিয়ে সে আড়াল করে নিজেকে। লাঠির ঘায়ে কালকেউটে ছিটকে গিয়ে পড়ে খানিকটা দূরে। দুখু লাঠি বাগিয়ে দাঁড়ায়।

নটবরেরও ঘুম ভেঙে গেছে। সেও এসে দাঁড়ায় দুখুর পাশে। শুধু এত কান্ডেও ঘুম ভাঙে না ধবলীর।

চোটটা তেমন লাগেনি কালকেউটের। সে চওড়া ফণা উঁচু করে দোলাচ্ছে আর ফুঁসছে—হি……ই……ই……স্‌…হিস্‌…হিস্‌…… কালকেউটে আমার নাম খেয়াল রাখিস্‌, ভেবে-চিন্তে কাজ করিস্‌, কী করছিস্‌ মনে রাখিস্‌, মজাটা এবার টের পাবিস্‌……

নটবর তেড়ে যাচ্ছিল, দুখু আটকায় তাকে—সাবধান!

ঝোপঝাড়ের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে যায় কালকেউটে।

দুখু বলে—ওর ছোবলের মুখে এভাবে কেউ এগিয়ে যায়? ওকে জব্দ করতে হবে ফন্দি করে। এবার থেকে পাহারায় একটুও ঢিলে দিলে চলবে না। দোষ আমার। আমারই একটু ঝিমুনির মতো এসেছিল, সেই সুযোগে শয়তানটা……

ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়ে চলে ওরা। আরো কয়েকটা দিন কেটে যায়। নতুন কোনো ঘটনা আর ঘটে না।

          তারপর হঠাৎ একদিন যখন ভোরের সোনারোদে কাছে-দূরের বনজঙ্গল আর অনেক দূরের গাঁ হেসে উঠেছে, দুখু তার মগডালের পাহারা থেকে দেখে দু’জন লোক জঙ্গলের দিকে আসছে। গাঁয়ের লোক নানা কাজে জঙ্গলে আসে। জ্বালানি কাঠ, মেটে আলু, কচু—কত জিনিসই না পাওয়া যায় জঙ্গলে! সেসবের লোভে প্রাণের মায়া না করে গাঁয়ের গরিবমানুষরা প্রায়ই জঙ্গলে ঢোকে। সবাই তারা দুখুর চেনা। দুখু ভালো করে দেখে লোকটাকে চিনে নেয়। বাস্‌!

          আজকের লোক দুটোকে দেখেই কিন্তু দুখু চমকে ওঠে। হ্যাঁ, কোন ভুল নেই। নগেন জোতদার আর ভিখু সর্দার! পা টেনে টেনে হাঁটছে নগেন, পাশে পেল্লায় চেহারার ভিখু। দূর থেকে মনে হয় ওদের হাতে লাঠির মতো কী যেন। ও দুটো নিশ্চয় বন্দুক।

          আর একটু অপেক্ষা করে দুখু। ভেবে নেয়। অনেকটা দূর। তা ছাড়া ওরা হয়তো এদিকটায় আসবেই না। কিন্তু এ সুযোগ হাতছাড়া করা চলে না। সে তরতর করে নেমে আসে গাছ থেকে। তারপর নটবরকে সাবধান করে দেবার জন্যে আকাশ-ফাটানো হাঁক ছাড়ে একখানা—জয় মা বনবিবি।

          নটবরের কানে পৌঁছোয় সেই আওয়াজ। সে ধবলীকে ডেকে বলে—ধবলী-মা, দুখুভাই বোধ হয় নগেন জোতদারকে দেখেছে। আমি গর্তে যাচ্ছি। তুমি কিন্তু একচুলও নোড়ো না এখান থেকে। আর যদি কিছু ভয়ের কিছু দেখ—এই ধর সাপ-টাপ—সঙ্গে আমায় ডেকো কিন্তু। আমি নিমেষে বেরিয়ে আসব গর্ত থেকে।

          ধবলী কথা বলে না, ভয়েই বোধ হয়, মাথা নেড়ে সায় দেয়।

          ওদিকে দুখু নগেন জোতদার আর ভিখুকে যেখানে দেখেছিল সেইদিকটা আন্দাজ করে, মিনিটে বাঁশচেরা গলায় ‘জয় মা বনবিবি’ বলে এক একখানা ডাক ছাড়তে ছাড়তে এগোতে থাকে। উদ্দেশ্য নগেন জোতদারকে এদিকে টেনে আনা।

           অনেকক্ষণ এভাবে চলার পর দুখু দেখে খানিক দূরে নগেন আর ভিখু বন্দুকের কুঁদো দিয়ে ঝোপঝাড় সরাতে সরাতে এগিয়ে আসছে। আর একবার পিলে-চমকানো ধ্বনি দেয় দুখু—জয় মা বনবিবি।

          সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে নগেন জোতদার আর ভিখু সর্দার বন্দুক তাক করে তার দিকে।

          দুই হাত তুলে দুখু চেঁচিয়ে বলে—ভয় নেই মন্ডলমশায়, ভয় নেই, এখানে বাঘ-টাঘ কিছু নেই। আমাকেই যেন গুলি করে বসবেন না।

          নগেন আর ভিখু বন্দুক নামিয়ে নেয়। কিন্তু দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে একই জায়গায়।

          দুখু আস্তে আস্তে গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ায়।

          তাকে ভালোভাবে লক্ষ করে নগেন বলে—আরে, তুমি আমাদের দুখু না? গোঁফদাড়িতে এমন চেহারা করেছ……

          –আগে আমি দুখুই ছিলাম বটে, দুখু গম্ভীরভাবে বলে, তবে মা বনবিবির আশীর্বাদে আমি এখন বাবা দুখুরাম পীর—মায়ের মহাভক্ত। জঙ্গলই আমার ঘরবাড়ি, জঙ্গলেই আমার বাস। আমার গোরু ধবলীকে নিয়ে আমি এখন জঙ্গলেই থাকে।

          –শুনেছিলাম বটে, নগেন বলে, তোমার গোরু আর তুমি দু’জনেই নিখোঁজ। তা গোরু নিয়ে জঙ্গলে আছ, কীরকম? বাঘ তোমাদের খাচ্ছে না?

          –এতক্ষণ কী শুনলেন তবে, যেন ভীষণ অপমানিত হয়েছে এমনভাবে দুখু বলে, বনবিবির মহাভক্ত বাবা দুখুরাম পীর আর তার গোরুকে খাবে বাঘে? জানেন, বাঘেরা আমার কথায় ওঠবোস করে, আমি ইচ্ছে করলে তাদের কান ধরেও ওঠবোস করাতে পারি। আমার ঘর-গেরস্থালি কাজকর্ম সব তারাই করে দেয়।

          নগেন ভিখু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। দুখু বোঝে ওষুধ ধরেছে।

          সে বলে—চলুন না মন্ডলমশায়, আমার আস্তানাটা একবার দেখে আসবেন।

          নগেন বলে—চলো হে ভিখু, বাবা দুখুরাম যখন বলছে…

          –বেশ কথা। বাবা যখন বলছেন…। ভিখু বলে।

          মনে মনে হাসে দুখু। দাওয়াইটা বেশ কাজ করছে। হেলাফেলার দুখুকে এখন বেশ সমীহ করেই ‘বাবা দুখুরাম’ বলছে নগেন মন্ডল। ভিখু সর্দার তো আপনি-আজ্ঞেই শুরু করেছে।

          যেতে যেতে কথা হয়।

          দুখু জিজ্ঞেস করে—তা মণ্ডলমশায়, আপনি এই অসুস্থ শরীর নিয়ে জঙ্গলে কেন?

          –শরীর আমার দিব্যি সুস্থ। শুধু এই পা-টা……

          –জানি। আপনাকে যখন বাঘে ধরেছিল আমি তখনো গাঁ ছাড়িনি। তা, আপনি জঙ্গলে এলেন কেন?

          –এলাম বাঘের গুষ্টির তুষ্টি করতে। এ জঙ্গলে আমি বাঘ রাখব না। হঠাৎই মেজাজটা তিরিক্ষে হয়ে ওঠে নগেন জোতদারের।

          –দোষ করল একটা বাঘ, আর শাস্তি পাবে সবাই, এটা কি উচিত কথা?

          –পীরবাবা, ভিখু সর্দার বলে, আপনি মণ্ডলমশায়ের কষ্টটা বুঝুন। একখানা ঠ্যাং ওনার একেবারে বরবাদ হয়ে গেছে।

          –খুবই দুঃখের কথা। কিন্তু উনিও তো কম বাঘের জীবন বরবাদ করেননি। তাদের ছাল বিক্রি করে অনেক পয়সা পেয়েছেন। তাদের ছানাপোনা ধরে ধরে বাইরে চালান করেছেন, সার্কাস কোম্পানিকে বিক্রি করেছেন।

          –বেশ করেছি, আমার ক্ষমতা আছে তাই করেছি, আরো করব। নগেন মণ্ডল খিঁচিয়ে ওঠে।

          –তাতে কিন্তু দু’তরফাই ক্ষতি হবে মণ্ডলমশায়, বাঘও মরবে, মানুষও মরবে। তার চাইতে আমি বলি কী, দুখু বলে—বাঘেরা আমার কথা শোনে, মান্যিগন্যি করে। কোন্‌ বাঘ আপনাকে ধরেছিল তা আমি জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারব। আজ থেকে ঠিক সাতদিন পরে আপনি আসুন, সেই দোষী বাঘও থাকবে, আপনি তার একটা পা ল্যাংড়া করে দিন। শোধবোধ হয়ে যাবে। কিন্তু আপনাকে কথা দিতে হবে আপনি তাকে প্রাণে মারবেন না। বাঘেরা বনবিবির প্রজা, আর আমি হচ্ছি মায়ের মহাভক্ত বাবা দুখুরাম পীর। মায়ের কোনো প্রজা অবাধ্য হলে আমি তাকে শাস্তি দিতে পারি, কিন্তু তাদের প্রাণ বাঁচানো আমার কর্তব্য।

          অনেকক্ষণ ভেবে নগেন মন্ডল বলে—বেশ, তা-ই হবে।

          কিন্তু তার মুখ দেখেই তার শয়তানি মতলবটা বুঝতে পারে দুখু। ভাবখানা এই—‘পাই তো একবার হাতের কাছে… তারপর হাতে আছে বন্দুক।’ মনে মনে খুব একচোট হেসে নেয় দুখু।

          দুখুর আস্তানা দেখে অবাক হয়ে যায় নগেন মণ্ডল আর ভিখু সর্দার। বনবিবির দয়া না থাকলে কেউ এই গভীর জঙ্গলের মধ্যে এমন একটি নধর গোরু নিয়ে ঘরসংসার পেতে বসতে পারে না। সেই ক্যাবলাকান্ত দুখু তাহলে সত্যিই এখন একটা জবরদস্ত লোক।

          ভিখু সর্দার শুঁকে শুঁকে বলে—জায়গাটায় বড়ো বোটকা গন্ধ বাঘের গায়ের।

          –বাঃ, দুখু বলে, গন্ধ হবে না! দিনরাত বাঘেরা আসছে যাচ্ছে, কাজকর্ম করছে।

          একটু ভয় পেয়েই নগেন মন্ডল বলে—তাহলে আমরা এখন যাই। আমাদের একটু এগিয়ে দেবে না বাবা দুখুরাম?

          –নিশ্চয়, নিশ্চয়। তাহলে ওই কথাই রইল মণ্ডলমশায়, আজ থেকে সাত দিন পরে ঠিক এই সময়ে আপনি আসবেন এইখানে। ভিখুও আসতে পারে আপনার সঙ্গে। আমি চাই শান্তিতে ব্যাপারটার মিটমাট হয়ে যাক। হেঁ হেঁ, বলতে গেলে আপনার খেয়ে-পরেই আমি মানুষ, আবার বাঘেরাও আমার পর নয়।

          তারপর ঘন জঙ্গলের মধ্যে সরু একটা পথ দেখিয়ে দুখু বলে—একটা কথা মণ্ডলমশায়, আপনারা আসবেন কিন্তু এই রাস্তাটা দিয়ে। আমি মন্ত্র দিয়ে এই রাস্তাটা বেঁধে রাখব। বাঘ কেন, এই রাস্তা দিয়ে এলে, কোনো জানোয়ারই আপনাদের ক্ষতি করতে পারবে না।

          আরো কিছু কথাবার্তার পর দুখু নগেন জোতদার আর ভিখু সর্দারকে এগিয়ে দিয়ে আসতে যায়।

          –ফিরে এসে নটবর আর ধবলীকে নিয়ে আলোচনায় বসে দুখু। অনেকক্ষণ ধরে কথা কয়ে পরের কাজের সবদিক ঠিক করে ফেলে তারা।

          পরের কয়েকটা দম ফেলার ফুরসত থাকে না দুখু আর নটবরের।

          যে রাস্তা দিয়ে নগেন জোতদার আসবে সেই রাস্তায় গভীর একটা গর্ত খুঁড়তে শুরু করে ওরা। দুখুকেই বেশির ভাগ কাজ করতে হয়। নটবরের তাকে সাহায্য করার আগ্রহ খুব। সে একবার সামনের দুই থাবায় কোদাল ধরে চেষ্টাও করে মাটি কোপাতে। কিন্তু দেখা যায় এক এক বারে যেটুকু মাটি তার কোদালে উঠছে তাতে এক বচ্ছরেও গর্তটা খোঁড়া হবে না। নজের এই অক্ষমতায় নটবর বড় মনমরা হয়ে যায়।

          দুখু তাকে উৎসাহ দিয়ে বলে—দুর বোকা, মন খারাপ করছ কেন? তোমারও অনেক কাজ আছে।

          দেখা গেল সত্যিই তা-ই। গর্তের দেয়াল এমন খাড়াই করে কাটে দুখু যাতে কেউ ওই গর্তে পড়লে তাকে আর নিজে থেকে উঠে আসতে হবে না। গর্তটা যখন দুখুর মাথা-সমান গভীর হয় তখন সে নটবরকে ডেকে বলে—এইবার যে তোমাকে ছাড়া অচল আমি।

          খুব খুশি নটবর।

          –কী করতে হবে বলো।

          –আমি ঘর থেকে যে দড়িদড়া এনেছিলাম তার থেকে একটা বেশ লম্বা আর শক্ত দড়ি নিয়ে এসো তো।

          দড়ি নিয়ে আসে নটবর।

          সেই দড়ির এক মুড়ো বাঁধা হয় নটবরের কোমরে, অন্য মুড়ো নামিয়ে দেওয়া হয় গর্তের মধ্যে।

          –শোনো নটবর, দুখু বলে, গর্তটাকে অনেক গভীর আর খাড়াই করতে হবে। আমি কাটতে কাটতে নিচে নেমে যাব, মাটি জমলে পুঁটলি করে দড়িতে বেঁধে দেব, তুমি সেই মাটি নিয়ে গিয়ে আমাদের বটগাছের পেছনটায় রেখে আসবে। পরে আবার গর্তটা বোজাতে হবে তো। আমাকে দড়িতে বেঁধে নামানো-ওঠানোর কাজও তোমাকে করতে হবে।

          দায়িত্ব পেয়ে খুশিতে ডগমগ নটবর। তার ছোটাছুটি হাঁকডাকে জায়গাটা সরগরম হয়ে ওঠে।

          ধবলী ওদের কাছে থাকে। তার কিছু করার নেই। সে খায়-দায় আর মাঝে মাঝে পারিবারিক সংগীতটা গেয়ে ওদের উৎসাহ দেয়।

          কয়েকদিনের উদয়াস্ত পরিশ্রমে গর্ত কাটা শেষ হয়। গর্তটা এমন গভীর আর খাড়াই হয়ে যে কিনারে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। বর্ষার ভেজা মাটি। গর্তের নিচে কুয়ার মতো জল উঠে এসেছে।

          দুখু তখন এক মতলব করে। গাদা গাদা পাঁক এনে ফেলে দেয় গর্তের মধ্যে। জলে পাঁকে থকথকে পায়েসের মতন একটা জিনিস তৈরি হয়, যাতে কেউ পড়লে মরবে না সঙ্গে সঙ্গে, চোটও লাগবে না তেমন।

          তারপর সরু সরু লতা দিয়ে একটা জাল বুনে গর্তের মুখের ওপর টানটান করে বিছিয়ে দেওয়া হয়। তার ওপর ঘাসের চাপড়া এমন সুন্দর করে সাজিয়ে দেয় দুখু যে আশপাশের জমির সঙ্গে জায়গাটা এক হয়ে যায়। বোঝাই যায় না যে ওখানে রয়েছে একটা মরণফাঁদ।

          নগেন জোতদারের আসার দিনে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে থেকেই ওরা তৈরি হয়ে থাকে। নটবরকে বলে দেওয়া হয় তার গর্তে ঢুকে থাকতে আর নগেন মন্ডল আসবার পর ওখান থেকেই মাঝে মাঝে ডাক ছাড়তে। ধবলীকে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় যাতে নটবরের গর্তের মুখটা আড়াল পড়ে যায়।

          আর দুখু একটা কলাপাতায় কিছু ফুল-দুর্‌বো সাজিয়ে গর্তের এদিককার কিনারে জোড়াসন হয়ে বসে থাকে।

          একটু পরে দেখা যায় নগেন জোতদার আর ভিখু সর্দার ইতিউতি তাকাতে তাকাতে এদিক পানে আসছে।

          জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে দুখু চেঁচিয়ে ওঠে—জয় মা বনবিবি।

          ওদিক থেকে নটবরও হুংকার ছাড়ে—হালুম…

          থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নগেন জোতদার আর ভিখু সর্দার।

          দুখু বলে—কোনো ভয় নেই মণ্ডলমশায়, কোনো ভয় নেই। ওই সেই হারামজাদা বাঘ যে আপনার পা জখম করেছে। আমি ওকে বাঘবন্দী মন্ত্র দিয়ে আটকে রেখেছি। বাছাধনের চিল্লানোই সার, নড়বার শক্তিটি নেই।

          –বেশ, বেশ। নগেন মণ্ডল খুশি হয়ে বলে আর ভিখুর হাত ধরে নেংচে নেংচে এগিয়ে আসতে থাকে।

          দুখু বলে—মণ্ডলমশায়, আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন বাঘকে প্রাণে মারবেন না। গুলি-বারুদ পথের পাশে রেখে আসুন। এই মন্ত্রপড়া ফুল-দুর্‌বো আপনাদের মাথায় ঠেকিয়ে দিচ্ছি, কোনো বাঘই আর আপনাদের কিছু করতে পারবে না।

          –যা, যা, ওই ফুল-দুর্‌বো তুই তোর নিজের মাথায় ঠেকাগে, হঠাৎ নিজমুর্তি ধরে নগেন জোতদার, বসে থাক্‌ ওইখানে যেমন আছিস, নইলে এক গুলিতে দেব খুলি উড়িয়ে।

          তারপর যা হবার তা-ই হয়। ভিখুর হাত ধরে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসতে আসতে দু’জনে একই সঙ্গে ঝপ্‌-ঝ্‌প-ঝপাৎ…

          গর্তের মুখ থেকে একটু সরে যায় দুখু। বলা যায় না, সঙ্গে ওদের গুলিভরা বন্দুক।

          দুখু চেঁচিয়ে ডাকে—শিগগির চলে এসো নটবর, কেল্লা ফতে।

          ছুটে এসে দুখুর পাশে দাঁড়ায় নটবর।

          কিছুক্ষণ শুধু জলকাদায় হুটোপুটির শব্দ।

          তারপর চিঁ চিঁ করে ভেসে আসে নগেন জোতদারের গলা।

          –বাবা দুখু—বাবা দুখুরাম পীর, শুনতে পাচ্ছ বাবা?

          –পাচ্ছি। কিন্তু আমি বাবা-রাম-পীর কিছুই না। শুধু দুখু। কী বলবেন বলুন।

          –বলছিলাম কী, তুমি অতি সজ্জন, তোমার কি এমন করে কাউকে পাঁকে ফেলা মানায় বাবা? আমাকে ওঠাও মানিক আমার।

          –আপনি যাদের পাঁকে ফেলেছেন তাদের কে ওঠাবে মণ্ডলমশায়?

          কোনো উত্তর আসে না এ প্রশ্নের।

          একটু পরে ভিখু সর্দারের গলা শোনা যায়—আমি গরিবমানুষ বাবা……

          দুখু খেঁকিয়ে ওঠে—কিন্তু ভালোমানুষ নও। গরিব হলেই কারো সাতখুন মাপ হয়ে যায় না। আমরা গরিবমানুষের পক্ষে, কিন্তু গরিবমানুষকে ভালোমানুষ হতে হবে।

          –তোমার জমিজেরাত সব আমি ফেরত দিয়ে দেব বাবা দুখু। করুণ গলায় ককিয়ে ওঠে নগেন জোতদার।

          আহা, শুনে বড় আনন্দ হল। তা, আমার বাবা-মা-ভাই-বোনদেরও নিশ্চয় ফেরত দিয়ে দেবেন মণ্ডলমশায়?

          –তাদের ভগবানে নিয়েছে বাবা।

          –আপনাকেও তেমনি গর্তে নিয়েছে। নটবর বলে।

          –এ কার গলা বাবা দুখু? নগেন মণ্ডল শুধোয়।

          –এ হচ্ছে নটবর, সেই বাঘ যে আপনাকে খেতে খেতেও ঘেন্নায় খায়নি। দুখু পরিচয় করিয়ে দেয়।

          –তাহলে দয়া হবে না? গুলি করে যে নিজেই নিজেকে মারব সে উপায়ও নেই। পাঁকে বন্দুক দুটো একেবারে অকেজো হয়ে গেছে।

          –ছি ছি, দুখু বলে, আপনি অন্যকে মারতে জন্মেছেন, নিজেকে মারবেন কোন্‌ দুঃখে।

          –কতদিন এই গর্তে থাকতে হবে? আমার যে এরই মধ্যে সারা গা কুটকুট করছে।

          –করুক না একটু। সয়ে গেলে আর করবে না। থাকতে থাকতেই সয়ে যাবে। থাকুন না দিন কতক। নটবর বলে।

          –দি-ন-ক-ত-ক! নগেন মণ্ডল কেঁদেই ফেলে বুঝি।

          নটবর বলে—অত কমে আপত্তি থাকলে মাসখানেকেই থাকুন।

          –মাসখানেক?!

          –তাতেও আপত্তি? আচ্ছা, আচ্ছা, বছরখানেকই থাকুন তবে।

          –এক বছর কি এই পাঁকের মধ্যে থাকা যাবে বাবা?

          –কষ্ট হলে বলবেন, নটবর হেসে বলে, মাটির অভাব হবে না।

          –অ্যাঁ! হেঁচকির মতো একটা আওয়াজ তুলে চুপ করে যায় নগেন মণ্ডল।

          –আরে, হঠাৎ খেয়াল হয় দুখুর, ধবলী-মা কোথায়? এমন মজাটা দেখতে এল না!

          –তা-ই তো! নটবর বলে।

          ওরা দু’জনে একই সঙ্গে পেছন পানে তাকিয়ে দেখে ছাউনির নীচে কীরকম অদ্ভুতভাবে শুয়ে আছে ধবলী।

          ছুটে গিয়ে ওরা দেখে ধবলীর দুই চোখের মণি স্থির, নিশ্বাস পড়ছে না, মুখ আধ-খোলা, জিভটা অনেকখানি বেরিয়ে আছে। দুখু-নটবরের বুঝতে কষ্ট হয় না ধবলী আর বেঁচে নেই।

          বাঘেরা সাধারণত একটু বেশি আবেগপ্রবণ। নটবর তো মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ছেলে-মানুষের মতো কান্না জুড়ে দেয়। দুখুও কাঁদে। কিন্তু সে নটবরের মতো বুদ্ধিশুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলে না। সে বেশ বুঝতে পারে, ধবলীর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তার সন্দেহটা যাচাই করে নেবার জন্যে সে কাঁদতে কাঁদতেও ধবলীর সর্বাঙ্গ খুঁজে খুঁজে দেখে। বেশিক্ষণ খুঁজতে হয় না। চোখে পড়ে পেটের এক জায়গায় পাশাপাশি ছোট কালো দুটো দাগ। সাপে কেটেছে ধবলী-মাকে। আর সাপ মানে নিশ্চয়ই সেই কালকেউটে। সে-ই এভাবে প্রতিশোধ নিয়ে গেছে। সে আর নটবর যখন ব্যস্ত ছিল নগেন জোতদারকে নিয়ে তখনই এক ফাঁকে কালকেউটে সর্বনাশটা করে গেছে। চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায় দুখু। হাতে নেয় তার লম্বা মজবুত লাঠিখানা।

          এদিকে নটবরের কান্নার আর বিরাম নেই।

          দুখু তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়—শুধু কেঁদে ভাসালেই কি ধবলী-মা ফিরে আসবে? কালকেউটে কেটেছে তাকে……

          মুহুর্তে কান্না থামিয়ে হুংকার দিয়ে লাফিয়ে ওঠে নটবর—এক্ষুণি শেষ করব শয়তানটাকে। হয় আমি থাকব না হয় ও থাকবে……

          –বোকার মতো কিছু করে বোসো না। এখনো উপায় আছে ধবলী-মাকে বাঁচানোর। দুখু বলে।

          –কী! সত্যি বলছ তুমি?

          –হ্যাঁ। তুমি জান কোথায় থাকে কালকেউটে?

          –আমার এলাকার পরেই ওর এলাকা।

          –চলো, আর দেরি করা নয়।

          যেতে যেতে দুখু তার মতলবটা খুলে বলে নটবরকে।

          মতলবটা মনে ধরে নটবরের।

          দুখু তাকে সাবধান করে দিয়ে বলে—মাথা একটুও গরম করবে না। কালকেউটেকে মেরে ফেললে কিন্তু ধবলী-মাকে বাঁচানো যাবে না।

          ব্যাংদের জলার ধারে গিয়ে নটবর তার গুরুগম্ভীর গলায় একটা ভাষণ দেয়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকে দুখু।

          –বন্ধু ভেককুল, আমরা জানি দীর্ঘকাল ধরে কালকেউটের অত্যাচারে আপনারা ভেকের অধম জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। আপনাদের অগণিত আত্মীয়স্বজনকে শুধু যে সে পেট ভরানোর কাজে লাগিয়েছে তা-ই নয়, নিশ্চয় তার স্বভাব অনুযায়ী অকারণেও সে অনেককে মেরেছে।

          –ঘ্যাঙোর ঘ্যাং, ঘ্যাঙোর ঘ্যাং। ব্যাঙেরা সমর্থন জানায়।

          –বন্ধুগণ, আমরা খবর পেয়েছি, যে গানের জন্য আপনারা পৃথিবীবিখ্যাত সেই গানও আপনারা গাইতে পারেন না ওর ভয়ে। বন্ধুগণ, খাদ্য-খাদকের সম্পর্কটা খুবই দুঃখের হলেও সত্যি। কিন্তু বিনা কারণে খাদ্যকে কেন মারবে খাদক? তা ছাড়া, খাদকের অধিকার শুধু খাদ্যের শরীরের ওপর। তার মানসিক বিকাশ অর্থাৎ কথাবার্তা গান-বাজনা এসবের ওপরও সে কেন জুলুম চালাবে?

          চাপা গলায় দুখু বলে—একটু সোজা করে বলো।

          –অর্থাৎ বন্ধুগণ, খাদ্য বলে সে কি এতই হীন যে তার নিজের মন বলে কিছু থাকবে না? অর্থাৎ তার শরীরের মতো তার মনটাও হবে খাদকের খাদ্য?

          –আঃ, দুখু ফিসফিস করে বলে, সোজা করো, সোজা করো। আমিই বুঝতে পারছি না কিছু।

          –সহজ করে বললে কথাটা এই দাঁড়ায় বন্ধুগণ, নটবর বলে—খাবার জিনিস হলে জন্মেছেন বলে আপনারা কিছু অপরাধ করেননি। অবশ্য তা না হলেই ভালো হত। কিন্তু এটাই নিয়ম। এই পৃথিবীতে একদল আর এক দলের খাবার। সুখের কথা, এই নিয়ম চেষ্টা করলে বদলানো যায়। এই যে দেখছেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন—ইনি আমার মানুষভাই দুখু। আমরা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের ওপরে উঠতে পেরেছি। আমাদের সম্পর্ক এখন ভাইয়ের—বন্ধুরা। আমার কথা হচ্ছে বন্ধুগণ, যতদিন আমরা এই জায়গায় পৌঁছতে না পারছি, ততদিন খাওয়া চলছে চলুক। কিন্তু অকারণে কেউ কাউকে মারতে পারবে না, জোর করে কারো নাচগানের অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না। যা-ই হোক বন্ধুগণ, দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে আমি আপনাদের বিরক্ত করতে চাই না। সংক্ষেপে কাজের কথাটা বলছি। আমি আর দুখুভাই চলেছি কালকেউটেকে শায়েস্তা করতে। সে আমার রাজ্যে ঢুকে আমাদের ধবলী-মাকে মেরে ফেলেছে। আমরা প্রথমে তাকে বাধ্য করব ধবলী-মা’র শরীর থেকে বিষ তুলে নিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তুলতে, তারপর তাকে তাড়িয়ে দেব এই দেশ থেকে। এ কাজে আপনাদের একজনের সাহায্য আমাদের দরকার। অবশ্য, তাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এ কাজে আসতে হবে……

          থপথপ করে এগিয়ে আসে ভোম্বলদাস সোনা ব্যাং, বলে—ঘ্যাঙোর ঘ্যাং, আমার নাম ভোম্বলদাস সোনা ব্যাং। কথা রাখুন, কাজে চলুন। আমি রাজি, জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি।

uponyaschitta05 (Medium)         

             ধবলীকে শেষ করে কালকেউটে এসে ঢুকেছে তার গর্তে। ব্যাপারটা কি সে ভালো করল? চিন্তা ঢুকেছে মাথায়। একটু ভয়ও। মানুষ একলা হলে তো ফুঃ–, বাঘও একলা হলে লড়া যায়। কিন্ত বাঘে মানুষে একসঙ্গে হলে? খিদেয় কালকেউটের পেট চুঁইচুঁই করছে। কিন্তু গর্ত থেকে বেরিয়ে খাবার খুঁজতে যেতে সাহস হয় না। এমন সময়ে গর্তের বাইরে ব্যাঙের গলা—ঘ্যাঙোর ঘ্যাং, আমার নাম ভোম্বলদাস সোনা ব্যাং। প্রভু, আমার বড়ো মনে কষ্ট, আমায় খেয়ে করুন কষ্ট নষ্ট।

          কালকেউটের খিদেটা যেন তড়াক করে পেট থেকে লাফিয়ে ওঠে মাথায়। সে না ভেবে-চিন্তে পলকে বেরিয়ে আসে গর্তের বাইরে।

          সঙ্গে সঙ্গে দুখু ভোম্বলদাসের কোমরে বাঁধা দড়ি ধরে এক হ্যাঁচকা টানে তাকে সরিয়ে দেয় নাগালের বাইরে। আর হাতের কাঠের টুকরোখানা গর্তের মুখে ফেলে গর্তের মুখ দেয় বুজিয়ে। তারপর শক্ত হাতে লাঠি বাগিয়ে দাঁড়ায় কালকেউটের পেছনে।

          কালকেউটে বুঝতে পারে সে ফাঁদে পড়েছে। তার সামনে বাঘ, পেছনে মানুষ। বাঘের আছে থাবা, মানুষের হাতে লাঠি। কী করবে সে ঠিক করতে পারে না, শুধু ফণা দোলায় আর শব্দ করে—হিস্‌…হিস্‌…

          দুখুর ইশারা পাওয়ামাত্র নটবর কালকেউটের ফণা দোলানোর তালে তালে সাপনাচ শুরু করে দেয়।

          কালকেউটে খেপে যায় দারুণ।

          –হিস্‌…হিস্‌…আমায় ভ্যাংচাচ্ছিস্‌!

          নটবরকে ছোবল মারতে যায় কালকেউটে।

          পেছন থেকে তার চাঁদিতে আলতো করে লাঠির একটা ঠোকনা দেয় দুখু।

          –ইস্‌……হিস্‌……! ব্যথায় আর্তনাদ করে পেছন ফিরে দুখুকে কামড়াতে যায় কালকেউটে।

          এবার এক থাবায় তার পৌনে এক ইঞ্চি ল্যাজ ছিঁড়ে নেয় নটবর।

          –উস্‌…ইস্‌… কী যে করিস্‌। আর কামড়ানোর চেষ্টা না করে ফণা দোলাতে দোলাতে কেমন যেন মিয়ানো গলায় কালকেউটে বলে।

          নিরাপদ দূরত্বে থেকে ভোম্বলদাস হাসে—ঘ্যাং…ঘ্যাং…ঘ্যাং……।

          তাতে আরো অপমান হয় কালকেউটের।

          দুখু বলে—এবার তোমার সেই কত্থক নাচটা একটু হোক না নটবর।

          কত্থক নাচে নটবর।

          কালকেউটে ফণা দোলাতে বন্ধ করে বলে—তোমার নাচ কতক্ষণ চলবে?

          নাচতে নাচতে নটবর বলে—তিনশো বার রকম নাচ জানা আছে আমার।

          –এক একটা পাঁচ মিনিট করেও যদি ধর তাহলে লাগছে গিয়ে তোমার…। দুখু হিসেবটা ঠিক মেলাতে পারে না।

          –পনেরোশো ষাট মিনিট। মানে ছাব্বিশ ঘন্টা—একদিন দু’ঘন্টা। হিসেবটা মুখে মুখে কষে দেয় নটবর, নাচ বন্ধ না করেই।

          –এ রকম অসভ্যতা অতক্ষণ কেউ সহ্য করতে পারে? কালকেউটে অসহায়ভাবে বলে।

          –পারে না বলেই তো করা। দুখুর উত্তর।

          –তা, কী করলে আমি ছাড়া পাব? কালকেউটে জিজ্ঞেস করে।

          কত্থক থামিয়ে দ্রুততালে টুইস্ট আরম্ভ করে নটবর বলে—ছাড়া পেতে চাও?

           বলেই নাচের বেগ আরো দু’গুণ বাড়িয়ে দেয়। সেই নাচের সামনে কালকেউটে আরো অসহায় বোধ করে।

          –চাই, চাই, আমি ছাড়া পেতে চাই। সে বলে।

          –ছাড়া পেতে হলে দেশছাড়া হতে হবে। রাজি আছ? দুখু শুধোয়।

          –আছি, আছি। তবে আমি যাই?

          –না। এই দেশ থেকে একেবারে বিদেয় হবার আগে ধবলী-মা’র বিষ তুলে দিয়ে যেতে হবে। রাজি?

          –রাজি, রাজি। আমাকে রক্ষে করো, ওই ভয়ংকর নাচ আমার আর সহ্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমারই হাড়গোড় সব ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে।

          –চলো তবে।

          কালকেউটেকে সামনে গিয়ে দিয়ে পেছনে পেছনে চলতে থাকে দুখু নটবর আর ভোম্বলদাস।

          পৌনে এক ইঞ্চির ল্যাজ খোয়া যাওয়ায় কালকেউটের যত না কষ্ট শরীরের, তার চাইতে ঢের বেশি তার অপমানের জ্বালা। আপাতত ওদের হাত থেকে সে রেহাই পাওয়ায় জন্যে সে যা-ই বলে থাকুক, মনে মনে অনেক মতলবই ভাঁজতে থাকে সে। প্রতিশোধ সে নেবেই। জাত কালকেউটে সে, তাকে কিনা এভাবে হেনস্তা! কিন্তু পালাতে না পারলে প্রতিশোধটা নেবে কী করে? তাই খানাখন্দের রাস্তা ধরেই চলতে চেষ্টা করে সে।

          কিন্তু কালকেউটের হালচালের ব্যাপারে সবচাইতে সেয়ানা ভোম্বলদাস। সে কালকেউটের একটু বেচাল দেখলেই হুঁশিয়ারি দেয়—ঘ্যাঙোর ঘ্যাং। অমনি দুখু না হয় নটবর গর্জে ওঠে—খবরদার, বাঁদরামো করলে মেরে শিরদাঁড়া ভেঙে দেব। সোজা রাস্তা ধরে চলো।

          –সাপেরা সাপামো করে, বাঁদরামো করে না। অপমানিত কালকেউটে মৃদু প্রতিবাদ জানাতে চেষ্টা করে।

          পালানো সম্ভব নয় বুঝে কালকেউটে সে চেষ্টা আর করে না। কিন্তু মনে মনে অনেকরকম ফন্দিই সে এঁটে চলে।

          ওদের আস্তানায় পৌঁছে দুখু কালকেউটেকে বলে—যাও, বিষ তোলো গিয়ে। ঠিকমতো কাজ না হলে……মনে থাকে যেন নটবরের তিনশো নয় রকম নাচ এখনো বাকি আছে……

          –যাচ্ছি, যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ধবলীর কাছে যায় কালকেউটে।

          যেখানে সে কামড়েছিল সেই জায়গায় মুখ দিয়ে চুষে চুষে বিষ তুলতে থাকে কালকেউটে। দুখু নটবর আর ভোম্বলদাস দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে থাকে। কাজ হবে তো? বেঁচে উঠবে কি ধবলী-মা? শেষ পর্যন্ত কালকেউটে কোনো শয়তানি করে বসবে না তো! সাপকে বিশ্বাস নেই।

          কালো কালো বিষরক্ত তুলে মাটিতে ফেলে কালকেউটে।

          দুখু আর নটবর ঘন ঘন তাড়া লাগায়—তাড়াতাড়ি……তাড়াতাড়ি……। চোয়ালে কি ব্যথা হয়েছে তোমার, আরো জোরে টানতে পারছ না?

          জবাব না দিয়ে কালকেউটে নিঃশব্দে কাজ করে চলে।

          হঠাৎ যেন ধবলীর ল্যাজটা একটু নড়ে ওঠে।

          দুখু-নটবর আনন্দে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। ভোম্বলদাস খুশিতে ক’টা তুড়িলাফ দিয়ে নেয়।

          আর একটু পরে ধবলী আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। যেন সে ঘুমোচ্ছিল এতক্ষণ। প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গেলেও তার মতো বুদ্ধিমতী গোরুর ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হয় না।

          আনন্দে দুখু-নটবরের চোখে জল। তাদের কান্না দেখে ধবলীরও চোখে জল এসে যায়।

          কালকেউটে নিস্তেজভাবে বলে—আমি যাচ্ছি।

          নটবর তার পথ আগলে দাঁড়ায়—না। যাবে তুমি ঠিকই, তবে এভাবে নয়। তোমাকে একদম বিশ্বাস নেই। কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকবে। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে আবার কার কোন্‌ সর্বনাশ করে বসবে।

          –তবে কি মেরেই ফেলবে আমাকে?

          –না, আমরা মিথ্যে কথা বলি না। তোমাকে একখানা কাঠের সঙ্গে বেঁধে ভাটার সময়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দেব। ভাসতে ভাসতে কোনো চড়ায় গিয়ে ঠেকে যাবে……

          –তবে রে……। আচমকা লাফিয়ে উঠে ছোবল হানে কালকেউটে, একেবারে নটবরের মাথা লক্ষ্য করে।

          কিন্তু সতর্ক ছিল দুখু। ঠিক সময়ে লাঠিটা বাড়িয়ে ধরে সে, কালকেউটের ছোবলটা পড়ে লাঠির ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তার পেল্লায় থাবার এক ঘায়ে নটবর কালকেউটের মাথাটা দেয় গুঁড়িয়ে।

          ধবলী গম্ভীরভাবে বলে—হুঁ……উ……ম……ম…বা, এইজন্যেই বলে শত্তুরের শেষ রাখতে নেই।           নটবর খুশিতে গমগম করে বলে—তবে বাঘে-মানুষে-গোরুতে-ব্যাঙে একসঙ্গে হলে কী করবে ওই কালকেউটে!

          আনন্দে ডগমগ ধবলী বলে—ঠিক……ম্‌…বা!

          তারপর চারজনের খুশির নাচানাচিতে বনের ওই জায়গাটুকুতে যেন বর্ষাকালেই বসন্তকাল শুরু হয়ে যায়।  

 ছবিঃ ইন্দ্রশেখর

চিত্ত ঘোষালের আগের উপন্যাসঃ পঞ্চা নামে ভালুকটি

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s