পুজোর উপন্যাস কুকুলকানের সন্ধানে সুদীপ চ্যাটার্জি শরৎ ২০১৭

সুদীপ চ্যাটার্জি

।।এক।।

রাজর্ষি যখন প্লেন থেকে নামল গুয়াটেমালায় তখন সকাল ন’টা বাজে। প্লেন ল্যান্ড করার সময় নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল রাজর্ষি। এতক্ষণ ধরে সে পেরিয়ে এসেছে প্রশান্ত মহাসাগর। গাঢ় নীল জল দেখতে দেখতে একসময় ঘোর লেগে গিয়েছিল তার। এমন সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে সে ভুলেই গেছিল যে তারা আসলে চলেছে বিপজ্জনক এক অভিযানে।

মায়া সভ্যতার প্রাচীন এক কিংবদন্তীর রহস্য উদঘাটন করতে এই অভিযান হচ্ছে। প্রায় হাজার বছর আগে মেক্সিকোর দক্ষিণে এবং উত্তর-মধ্য আমেরিকাতে মায়া সভ্যতা গড়ে ওঠে। যখন মানুষ ভাষা নিয়ে চর্চা শুরু করেছে মাত্র, এদের নিজস্ব ভাষা ও লিপি ছিল। সূর্য ও গ্রহের পথ বুঝে তারা নির্ভুলভাবে পঞ্জিকা তৈরি করতে পারত। তাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল সারা মধ্য আমেরিকা জুড়ে। চিচেনইত্জা ও অন্যান্য মন্দির কী কৌশলে তারা বানিয়েছিল সে রহস্য আজও কেউ বুঝতে পারেনি।

তাকে এই অভিযানে সঙ্গে নেওয়ার জন্যে তাকে চিঠি লিখেছিল এমিলি। এমিলির সঙ্গে তার আলাপ আগের বছরে দিল্লি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সের সময়। রাজর্ষি তখন আর্কিওলজিকাল সার্ভেতে কাজ করছে দিল্লিতে। নানাধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সে আসলে একজন মেরিন আর্কিওলজিস্ট। রাজর্ষিও একটা আন্ডার-ওয়াটার আর্কিওলজির প্রজেক্ট করেছিল দ্বারকাতে। তার স্কুবা ডাইভিংয়ের সার্টিফিকেট নেওয়া আছে। সেই নিয়ে কথা বলতে বলতে আলাপ জমে উঠেছিল। তখন এমিলি বলেছিল, সে একটা দারুণ জিনিস নিয়ে গবেষণা করছে। যদি দরকার পড়ে সে রাজর্ষির কাছে সাহায্য চাইবে। রাজর্ষি স্বভাবতই হ্যাঁ বলেছিল। সেই কথা মনে রেখে যে এমিলি একবছর পর চিঠি লিখে এই অভিযানে তাকে সঙ্গে নিতে চাইবে তা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি।

এয়ারপোর্টের বাইরে রাজর্ষির জন্যে অপেক্ষা করছিল এমিলি। তার সঙ্গে আরও দু’জন লোক। গাড়িতে করে তারা যাত্রা শুরু করল। এমিলি তাকে বলল, “তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। প্রফেসর এরিক রাসেল হলেন আমাদের দলের গাইড। পেশায় ইতিহাসের শিক্ষক হলেও আসলে ইনি জঙ্গল নিয়ে পাগল। পৃথিবীর যেকোনও জঙ্গলে প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান চালাতে গেলে এরিকের ডাক পড়ে।”

লম্বা চেহারার এরিককে দেখেই মনে হয় শক্তিমান পুরুষ। যদিও বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে, কাঁচাপাকা চুলে তাকে যুবকই মনে হয়। রাজর্ষির সঙ্গে করমর্দন করে তিনি হাসলেন। এমিলি বলল, “আর তোমার পাশে যিনি বসে আছেন, তিনি হলেন বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ জেমি ম্যাথিউ। মায়ান স্ক্রিপ্টের একজন বিশেষজ্ঞও বলা যায়। ম্যাথিউ আমাদের লিডার।”

রাজর্ষির দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি। ভালোমানুষ চেহারা, গোঁফদাড়ি পরিষ্কার করে কামানো, বয়স পঞ্চান্নর কাছাকাছি। ম্যাথিউ এমিলিকে বলল, “তুমি কি রাজর্ষিকে বিস্তারিত বলেছ আমাদের পরিকল্পনা?”

এমিলি বলল, “পুরোটা এখনও বলা হয়নি। তুমিই বল না।”

ম্যাথিউ বলল, “বেশ। রাজর্ষি, আমিই তোমাকে ব্যাপারটা খুলে বলছি। মায়াদের প্রাচীন শহর লাগুনিটার খোঁজ চলছে প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি। ১৯৭০ সালে আমেরিকার অণ্বেষক এরিক ভন ইউ য়ুক্যাটানের দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে এই রহস্যময় শহরের সন্ধান পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি শহরটা দ্বিতীয়বার গিয়ে আর খুঁজে পাননি। এই সালাকমূল এলাকার বনজঙ্গল এতই আদিম ও দুর্ভেদ্য যে অনেক জায়গায় আজও মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। মাইলের পর মাইল ধরে গাছেরা এমন করে দাঁড়িয়ে আছে যে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও তুমি বুঝতে পারবে না যে পঞ্চাশ পায়ের মধ্যে কোনও ধ্বংসাবশেষ আছে। লাগুনিটা শহরের গল্প তাই গল্পই রয়ে গেছে। পরে অনেকেই চেষ্টা করেছে, কিন্তু এই দুর্ভেদ্য জঙ্গলে গিয়ে সেই শহর খুঁজে পায়নি। এল ডোরাডোর মতোই এই রহস্যময় শহর খুঁজে পাওয়া প্রতিটা আর্কিওলজিস্টের স্বপ্ন। এখানকার লোকেদের বিশ্বাস মায়াদের সর্পদেবতা কুকুলকান সে শহর পাহারা দেন। সেখানে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলে কেউ ফিরে আসতে পারে না।”

রাজর্ষি হাসলো। মায়াদের দেবতা কুকুলকানের কথা সে পড়েছে। প্রচলিত মায়া বিশ্বাস যে কুকুলকান পালক দ্বারা আবৃত বিশাল এক সাপ বা ফিদার্ড সার্পেন্ট। তাকে দেখতে বিশাল এক সাপের মতো, কিন্তু ড্রাগনের মতো তার মুখ থেকে আগুন বেরোয়। মায়ারা বহু দেবতায় বিশ্বাস রাখত। কিন্তু কুকুলকানের একটা বিশিষ্ট স্থান আছে মায়া সভ্যতায়। তাদের মতে এই সর্পদেবতার আশ্চর্য জাদুশক্তিই তাদের সাফল্যের কারণ। একের পর এক শহর তৈরি হয়, মন্দির তৈরি হয়। বোলোন টজাখাব ঝড়ের দেবতা, চায়াখ বজ্রপাতের দেবতা। কিন্তু বিভিন্ন মায়া দেওয়ালচিত্রে এবং ভাস্কর্যে কুকুলকানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে অন্যদের চেয়ে বেশি। প্রায় সব মায়া মন্দিরেই তার নামে পিরামিড গড়া হয়েছে। সত্যি কি কুকুলকান কোনও আশ্চর্য শক্তি দিয়েছিলেন মায়াদের?

ম্যাথিউ তার দিকে চেয়ে হেসে বলল, “তুমি জান রাজ, এই লাগুনিটা শহরের খোঁজেই আমাদের এই অভিযান। যতটা জানা গেছে, এই শহর উৎসর্গ করা হয়েছিল কুকুলকানকে। সেই রহস্য হয়তো লুকিয়ে আছে লাগুনিটায় যাতে বোঝা যাবে কী করে মায়ারা এত কম সময়ে এত আশ্চর্য ক্ষমতা দখল করেছিল, কী করে তৈরি করেছিল সেইসব অসামান্য স্থাপত্য। আমরা সায়াচে আর তিকাল হয়ে অরণ্যে প্রবেশ করব। মায়াদের শহর তামচে হয়ে এগিয়ে যাব লাগুনিটার দিকে। এরিক আমাদের সাহায্য করবে বনের মধ্যে পথ ঠিক করতে। সেখানে পৌঁছে আমরা এক্সক্যাভেশন শুরু করব। তোমাকে এমিলি এই সমস্তই বলেছে, কিন্তু খানিকটা এখনও ধোঁয়াশা আছে। সেটা ঠিক করতে তোমার সাহায্য চাই। তুমি তো এপিগ্রাফি নিয়ে কাজ করছ অনেকদিন ধরে?”

রাজর্ষি মাথা নাড়ল। এপিগ্রাফি বা সাংকেতিক ভাষা উদ্ধারের অভিজ্ঞতা তার আছে। ম্যাথিউ তার হাতে কয়েকটা ছবি দিয়ে বলল, “এগুলো তুমি সঙ্গে রাখ। এগুলো আমি জোগাড় করেছি আমার স্লোভেনিয়ার বন্ধু ইভান স্পার্কের কাছ থেকে। ওরা প্রায় চারবছর আগে এই অঞ্চলে এসে তামচে, লাগুনিটা আর চিচেনইত্জার এল কাস্টিলো মন্দির থেকে এই স্ট্যালেগুলোর ছবি তুলেছে। স্ট্যালে হল শিলালিপি খোদাই করে রাখার জন্যে রাখা পাথরের স্ল্যাব। স্ট্যালে তিনটে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া গেলেও লেখাটা একই। এই লেখাগুলোর মানে এখনও আমি উদ্ধার করতে পারিনি। তোমাকে আমাকে সাহায্য করতে হবে।”

রাজর্ষি ছবিগুলো হাতে নিয়ে দেখলো।মায়ান লিপি এতই জটিল যে সহজে কিছুই বোঝা যায় না।প্রতিটা শব্দের জন্যে একেকটা ছবি আর অক্ষরের জন্যে একাধিক চিহ্ন বা সিলেবল আছে।যদি জাগুয়ার লিখতে হয় তাহলে জাগুয়ারের জন্যে মায়ালিপিতে একটা গ্রাফিক ইমেজ আছে।সেটা এঁকে ফেলতে পারি।অথবা তিনটে অক্ষর একের পর এক এঁকে যোগ করে লিখে ফেলা যায় শব্দটা।

এবার প্রথমটা জাগুয়ারের মাথার মত মনে হচ্ছে সেইটা হলো লগোগ্রাফ।প্রায় ছশো লগোগ্রাফ আছে মায়া হায়েরোগ্লিফে।কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মায়ারা সিলেবিক স্টাইলে লিখেছে।এইবার এই  তিনটি অক্ষর সেগুলোর একটা ধ্বনি আছে,”বা,লা,মা”,কিন্তু শেষের স্বরটা উচ্চারিত হয় না সিলেবিক লেখায়।তাই উচ্চারণ হবে ‘বাহলাম’,আর শেষে ছবিগুলো একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে।এইখানেই সব ঝামেলা।কোন সিলেবল টা যে কি ভাবে কোথায় লুকিয়ে পড়েছে সেটা বুঝে ওঠাই কঠিন।এর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। রাজর্ষি মাথা তুলে বলল, “আমি চেষ্টা করছি যত সম্ভব তাড়াতাড়ি এর মানে উদ্ধার করার।”

ম্যাথিউ তার পিঠ চাপড়ে দিল।

সুন্দর রোদ উঠেছে। শহর ছাড়িয়ে গাড়ি চলেছে সায়াচের দিকে। এই ছোট্ট দেশটায় ছড়িয়ে আছে প্রায় একশোটি ছোটবড় আগ্নেয়গিরি। এন্টিগুয়ার পাশে থাকা পাকায়া আগ্নেয়গিরি আর লেক আতিতলান দেখতে প্রচুর লোকে আসে এখানে। বাইরের মনোরম দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় রাজর্ষি ঘুমিয়ে পড়ল।

।।দুই।।

সায়াচে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। হোটেলে এসে স্নান করে যখন রাজর্ষি বাইরে গিয়ে বসল, সূর্য অস্ত যাচ্ছে সামনের আকাশে। আকাশের গায়ে একটা সবুজভাব আছে এখানে। সেই সবুজে এখন কমলার ছাপ লেগেছে। আমাদের দেশের  আকাশ এরকম নয়। রাজর্ষি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল সামনের দিকে।

শহর থেকে বাইরে বলে এখানে লোকজন বেশি নেই। সায়াচে থেকে বেরিয়ে তারা এগোবে প্রাচীন মায়াদের শহর তায়াশালের দিকে। সেখান থেকে এগিয়ে তারা গিয়ে পড়বে অরণ্যের গভীরে। আজকের পর থেকে শুধু তাঁবুতেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে ক্যাম্প করার জন্যে তাঁবু নেওয়া হয়েছে। সঙ্গে স্লিপিং ব্যাগ, রান্না করার জিনিসপত্র, অস্ত্র, আধুনিকধরনের বেশ কয়েকটা যন্ত্রপাতিও আছে। এরিক রাসেলের নেতৃত্বে প্রায় ছয়জন পোর্টার নিয়ে জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা চলছে।

ম্যাথিউর কাছ থেকে নেওয়া শিলালিপি বা স্ট্যালের ছবিগুলোর পিছনে এখন থেকেই মাথা ঘামাতে হবে যাতে এক-দু’দিনের মধ্যে লেখাগুলোর মানে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এই লেখাগুলোর ওপর এই অভিযানের পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করছে। কিছুক্ষণ পর এমিলি এসে তার কাছে বসল। রাজর্ষির দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা রাজ, তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? তোমাকে একবার বলতেই যে তুমি আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে এই জন্যে তোমাকে থ্যাঙ্কস পর্যন্ত ঠিক করে বলা হয়নি। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।”

রাজর্ষি হেসে এমিলিকে বলল, “কার যে কাকে থ্যাঙ্কস বলা উচিত তুমি গুলিয়ে ফেলছ। তোমাকে বরং অনেক ধন্যবাদ এই অভিযানে আমাকে সঙ্গী করার জন্যে।”

কিছুক্ষণ দু’জনে চুপ বসে থাকল। তারপর রাজর্ষি এমিলিকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা এমিলি, তুমি তো মেরিন আর্কিওলজি নিয়ে কাজ কর। এখানে কি আন্ডার-ওয়াটার এক্সপিডিশনের কোনও আশঙ্কা আছে?”

এমিলি বলল, “এখন ঠিক করে বোঝা যাচ্ছে না। অনেক কিছুই ঠিক হবে তোমার আর ম্যাথিউর মায়ালিপিগুলোর অর্থ উদ্ধারের ওপর। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই জান, এই য়ুকাটান অঞ্চলে মাটির নিচে জল চুঁইয়ে পড়ে অথবা ভূমিগত নদীর জলে গভীর কয়েকটা হ্রদ তৈরি হয়েছে। তাদের বলে সেনোটে। চিচেনইত্জার কাছে কয়েকটা সেনোটের জলের গভীরে নানান মায়া সভ্যতার চিহ্ন পাওয়া গেছে। স্ট্যালে, বাসন, তাবিজ, এমনকি মানুষের কঙ্কাল অব্দি পাওয়া গেছে সেখানে। সেই সেনোটের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে প্রাচীন সব ভূমিগত গুহার মধ্যে। যদি দরকার পড়ে সেই সেনোটেগুলোর জলে ডাইভ করে খুঁজে দেখতে হবে।”

রাজর্ষি দেখল, বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার। ভূমিগত সেনোটের ভিতরে ডাইভ দিয়ে রিসার্চ করা ছেলেখেলা নয়। নদী বা সমুদ্রে ডাইভ করা তার চেয়ে অনেক সোজা। সে যতদূর জানে, সেনোটের জাল এতটা বিস্তৃত যে প্রায় সারা য়ুকাটান রাজ্য আর সালাকমূল ধরে এই সেনোটেগুলো ছড়িয়ে। আজ পর্যন্ত কেউই অজানা কোনও সেনোটেতে আন্ডার-ওয়াটার এক্সপিডিশান করেনি। সে আকাশের দিকে চেয়ে দেখল গোল চাঁদ উঠেছে নির্মেঘ আকাশে। আজকে মনে হয় পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে সামনের অন্ধকার প্রান্তরটা। আকাশটা অন্যরকম হতে পারে, কিন্তু চাঁদটা একই এই দেশেও। সেই একইরকম মায়াময় আর সুন্দর। রাজর্ষি নিজের মনেই হেসে ফেলল।

।।তিন।।

সায়াচে থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে রাজর্ষিরা। একটা গাড়িতে রাজর্ষি, এমিলি আর ম্যাথিউ। আরও বাকি দুটো গাড়িতে এরিক ও দলের বাকি সদস্যেরা চলেছে। ঠিক হয়েছে, সকলেই পালা করে গাড়ি চালাবে। প্রথমে রাজর্ষিই চালিয়েছে সান আন্দ্রেস অব্দি। তারপর থেকে এমিলি চালাচ্ছে গাড়ি।

পথের দৃশ্য বদলাচ্ছে দ্রুত। কালকে বিকেলেই তারা পেটেন ন্যাশনাল পার্কে ঢুকে পড়েছিল। প্রথমদিকে কয়েকটা ছোটো ছোটো জনবসতি দেখা গেলেও ক্রমশই তা কমে আসছে। জঙ্গল একটু একটু করে ঘন হচ্ছে চারপাশের। উচ্চতাও বাড়ছে। সান আন্ড্রেসের কাছে গাড়ি থামিয়ে রাজর্ষিরা ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছিল। ছোট্ট শহর। চাষের উপযুক্ত জমি না হলেও ভুট্টা চাষ করা হয় কাছাকাছি অঞ্চলে। লোকজন ভুট্টা বিক্রি করছিল রাস্তার ধারে বসে। এখন তারা চলেছে লেক পেতেন ইত্জার দিকে। এই বিশাল লেকের চারপাশে প্রায় সাতাশটি মায়া শহরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।

রাজর্ষিরা এগিয়ে চলেছে। দু’পাশের জঙ্গল যেন ঘন হয়ে চেপে বসছে তাদের ওপরে। এইরকম জঙ্গল আগে রাজর্ষি দেখেনি। দেশে সে নানা জঙ্গলে গিয়েছে, কিন্তু এখানকার গাছপালায় কেমন একটা বুনো আর আদিমভাব আছে। ম্যাথিউ তাকে বলল, “সাবধান রাজ। এই জঙ্গলে একা একা একদম এগোবে না। এখানে জাগুয়ার আর পিউমাদের আকছার দেখা যায়। তাদের সামনে পড়লেই সর্বনাশ!”

রাজর্ষি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। সে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আর কোন কোন প্রাণী পাওয়া যায় এই জঙ্গলে?”

ম্যাথিউ গালে হাত দিয়ে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “এই তো মুশকিলে ফেললে। এমনিতে তো এখানে নানারকম জন্তুজানোয়ার আছে। নানাধরনের দুর্লভ প্রজাপতি পাওয়া যায় এখানে। বেশ কয়েকরকম বাঁদর। এই ধর, স্পাইডার মাংকি, হাউলার মাঙ্কিও আছে। যেকোনও জলীয় জায়গাতে শয়ে শয়ে কুমির আছে এখানে। কয়েকটা এন্টেলোপ আছে, যাদের পৃথিবীতে আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু ঠিক যে কতরকম জন্তুজানোয়ার ঘাঁটি বেঁধেছে এখানে তা কেউই বলতে পারবে না। এই জঙ্গল চলে গেছে সীমানা ছাড়িয়ে সে মেক্সিকোর য়ুকাটান, কাম্পেচে অব্দি। এত বড়ো এলাকাতে সার্ভে করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।”

রাজর্ষি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল মনে মনে। অবশেষে সে সত্যিকারের একটা অভিযানের অংশ হতে পারছে। আশা করা যায়, অভিজ্ঞতার ঝুলি খালি থাকবে না।

এমন সময় ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল এমিলি। চাপা স্বরে বলল, “চুপ। সামনে তাকিয়ে দেখ।”

পিছনের গাড়িগুলোও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে গেছে। রাজর্ষি সামনে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখল, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা পার করছে একদল হরিণ। তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বাচ্চা আছে। কালচে বাদামি রঙের চামড়াগুলো সূর্যের আলোয় চিক চিক করছে, কিন্তু তাদের লেজগুলো পায়রার পেখমের মতো সাদা রঙের। ততক্ষণে পিছনের গাড়ি থেকে নেমে এরিক নিঃশব্দে একটা ক্যামেরা বের করে তাদের ছবি তুলতে লেগেছে। দলের কচি বাচ্চাগুলো অবাক চোখে একবার গাড়ির দিকে তাকাল। তারপর দুই লাফে অন্যদিকের বনে অদৃশ্য হয়ে গেল।

প্রায় দশ মিনিট পর যখন রাস্তা পরিষ্কার হল, এরিক আনন্দের হাসি হেসে বলল, “ইউ আর ভেরি লাকি, রাজ। আজ এত বছর ধরে এখানে আসছি কিন্তু এত ভালো স্ন্যাপ কোনওদিন পাইনি।”

এমিলি জিজ্ঞেস করল, “হোয়াইট টেলড ডিয়ার কি?”

এরিক ক্যামেরাটা ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “হোয়াইট টেলড ডিয়ার। শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকা আর কানাডাতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই হরিণগুলো এখানকারই বাসিন্দা মনে হচ্ছে। এদের অন্য কোথাও দেখা যায় না।”

রাজর্ষির সঙ্গে হাই ফাইভ করে এরিক গাড়িতে ফিরে গেল। আবার শুরু হল যাত্রা। এমিলি বলল, “এরিকটা জঙ্গল নিয়ে একেবারে পাগল। ওর জঙ্গলেই থাকা উচিত।”

রাজর্ষি জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিল। দেশে কাজ করার সময় এরকম অভিযান বড়ো একটা হয় না। অনেক সময়  আর্থিক সাহায্য ও যন্ত্রপাতি না পেয়ে মাঝপথে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ছোটোবেলা থেকে ইতিহাসকে ভালোবেসে বলে সে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে আর্কিওলজি নিয়ে পড়াশুনা করেছে। কিন্তু বার বার নানা কারণে মাঝপথে প্রজেক্ট বন্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা তার মন ভেঙে দিয়েছিল। ভালো প্রজেক্ট না পেয়ে সে ছটফট করত। এমন সময় হঠাৎ করেই এই অভিযানের সুযোগ এসে পড়ে।

কাল রাতে মায়ালিপিগুলো নিয়ে মাঝরাত অব্দি বসেছিল সে। কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। ম্যাথিউর সঙ্গে আলোচনা করে তারা জানতে পেরেছে লেখাগুলো আসলে একটা স্থানবিশেষের ঘটনার বিবরণ। ছবিগুলো আবছা হয়ে আসায় অনেক লগোগ্রাফ বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ঘটনাটায় কুকুলকানের একটা বিশেষ স্থান আছে, এইটুকু বুঝতে তাদের কোনও অসুবিধে হয়নি। আজ রাতে মনে হয় পুরো লেখাটার মানে উদ্ধার হয়ে যাবে।

এমন সময় এমিলি বলল, “পেতেন ইত্জা এসে গেছে।”

ম্যাথিউ এক লাফে গাড়ি থেকে নেমে বাইরে দাঁড়িয়ে হাত পা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “রেস্ট টীম। এখানে আমরা লাঞ্চ করব।”

সামনেই দেখা যাচ্ছে বিশাল হ্রদটা। পেতেন ইত্জা প্রায় একশো বর্গ কিলোমিটারে ছড়িয়ে আছে। শান্ত জল দিগন্ত অব্দি চলে গেছে। বনের ভিতর দিয়ে ক্রমাগত ডেকে চলেছে নাম না জানা পাখির দল। ততক্ষণে সবাই মিলে খাবার ভাগ করে নিয়েছে। হ্যাম স্যান্ডউইচ আর কাপ কেক। সঙ্গে কফি।

রাজর্ষি দলের বাকি লোকেদের দিকে চাইল। প্রায় সকলেই এখানকার লোক। স্প্যানিশ সে ভালো জানে না। বেশিক্ষণ কথা চালাতে অসুবিধে হবে। কিন্তু ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সকলের সঙ্গে দিব্যি ভাব হয়ে গেল তার। চারটে ছেলেই আসলে ইউনিভার্সিটির ছাত্র। সহজ সরল স্বভাব, প্রচন্ড পরিশ্রমী আর সকলেই প্রায় এইরকম অভিযানে আগে সঙ্গে থেকেছে। এবার যদিও তিকালের পরে তাদের সঙ্গে থাকবে এদের দু’জন, মাইকেল আর হুআন। রাজর্ষির খুব ভালো লেগে গেল হুআনকে। বয়স একুশ। সদ্য কলেজ থেকে পাস করেছে। চোখদুটো মোলায়েম, কিন্তু ইতিহাসের প্রতি গভীর আসক্তি।

সকলেরই লাঞ্চ খাওয়া হয়ে গেছে। সকলে মিলে আবার যাত্রা শুরু হল। রাস্তা এবার খারাপ হতে শুরু করেছে। কয়েক জায়গায় পথ বলে কিছু নেই। ঘন জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে অদ্ভুত কয়েকটা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ঝাঁকুনির চোটে অবস্থা খারাপ হওয়ার জোগাড়। তিকালে যখন তারা পৌঁছল, ঘড়িতে বিকেল চারটে।

।।চার।।

তিকাল আসলে একটা প্রাচীন মায়ান শহর। সর্ববৃহৎ ধ্বংসাবশেষ শহর বলে এখানে টুরিস্টরা আসতেই থাকে। শহরের ঠিক মাঝখানে একটা বিরাট পিরামিড আকারের মন্দির। তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটা পুরনো মন্দির। একপাশে নগরচত্ত্বর বা এক্রোপলিস নজরে পড়ছে। মায়ালিপিতে লেখা গল্পগুলো খোদাই করা আছে বেদী, সমাধি, চৌকাঠ অথবা স্ট্যালেতে।

সকলে গাড়ি থেকে নামলে ম্যাথিউ এরিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এরিক, আমরা কি আজকেই জঙ্গলে ঢুকে  পড়ব? তিকালের পর তো আর গাড়ি যাবে না। তুমি কী বল?”

এরিক মাথা নেড়ে বলল, “আমি ওয়াকিটকিতে বর্ডার ফোর্সকে খবর দিয়ে দিয়েছি। পারমিশন পেপার তো কালকেই জমা করা হয়েছিল অফিসে। কিন্তু আমার মনে হয় কাল সকাল থেকেই যাত্রা শুরু করা ভালো। আজকে আমরা মন্দিরের পিছনদিকেই ক্যাম্প ফেলে থাকব।”

ম্যাথিউ বলল, “বেশ। তাই হোক। সকলে তাহলে কাল সকাল ছ’টায় ঢুকে পড়ব জঙ্গলে। কারও কিছু বলার আছে?”

এমিলি বলল, “আমাদের যন্ত্রপাতি কে বইবে? আমরা সবাই মিলে আছি ছয়জন। আর কোনও লোককে কি নেওয়া হবে?”

ম্যাথিউ প্রবলভাবে হাত নেড়ে বলল, “না, এমিলি। সব আমাদেরকেই নিতে হবে। বিশ্বস্ত সঙ্গী না হলে এরকম অভিযানে কাউকে নেওয়া প্রচন্ড ঝুঁকির। একজনের অসাবধানতার জন্যে কাজ পণ্ড হয়ে যেতে পারে। আমাদেরকে আলপাইন ক্লাইম্ব, মানে নিজের জিনিস নিজেই বইতে হবে। সকলে পালা করে যন্ত্রপাতি নেবে তাদের রুকস্যাকে। চল, এখন আমরা মন্দিরগুলো দেখে নিই আগে।”

মন্দিরের পিছনে পাঁচটা ছোটো তাঁবু খাটানো হয়েছে। এরিকের সঙ্গে আছে রাজর্ষি। তাঁবুর সামনে জ্বালানো আগুনের সামনে বসে মন্দিরের দিকে চেয়ে ছিল সে। অন্ধকারে তিকালের প্রধান পিরামিডটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যোৎস্নার আলোয় মন্দিরের ছায়াগুলো একটা রহস্যময় আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে। আগুনের চিড়িক চিড়িক শব্দকে ছাড়িয়ে মাঝে মাঝে দূর থেকে শোনা যাচ্ছে অচেনা কোনও জন্তুর ডাক। জাগুয়ার নাকি? কে জানে। রাজর্ষির মনে তখন অনেকরকম ভাব একসঙ্গে খেলা করছে।

স্ট্যালেগুলোর মানে অবশেষে উদ্ধার করা গেছে। কিন্তু ঘটনাটা এতই আজগুবি ও চমকপ্রদ যে একটা সংশয় থেকেই যায়। ম্যাথিউ আর রাজর্ষি বারবার পরীক্ষা করে নিঃসন্দেহ হয়েছে যে তারা যে অর্থ উদ্ধার করেছে তাতে ভুল নেই। রাতে আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে তারা সকলকে সেই কথা খুলে বলল। ম্যাথিউ সকলের দিকে চেয়ে বলল, “আমি ও রাজ মিলে এই স্ট্যালেগুলোর যেই মানে করেছি সেটা আসলে একটা অনুষ্ঠানের বিবরণ। এই অনুষ্ঠান হত প্রতিবছর কুকুলকানের নিজস্ব শহরের বাইরে। এই লেখা অনুযায়ী সর্পদেবতা কুকুলকানের নিজের একটা শহর ছিল মাটির তলায়। সেই শহরে পৌঁছনোর জন্যে নানা গুপ্তপথ ছড়ানো আছে সারা য়ুকাটান রাজ্যে।”

এবার রাজর্ষি বলল, “মায়া সভ্যতার লোকেরা যে অ্যাস্ট্রোনমি বা জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কতটা আগ্রহী ছিল সে তো সকলেরই জানা। সূর্যের পরিক্রমার পথ হিসেবে করতে তারা এতদূর এগিয়েছিল যে তার ওপর নির্ভর করে হাজার বছর পরের দিনক্ষণ বলাও তাদের কাছে কঠিন ছিল না। অনেকেই জানে যে সূর্য যখন বিষুব বা equinox-এ থাকে, চিচেনইত্জার এল কাস্টিলো পিরামিডে উত্তরদিকের সিঁড়িগুলোতে কুকুলকান বা একটা অতিকায় সাপের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। কোন জায়গায় কীভাবে পিরামিড তৈরি করলে সূর্যের ছায়ায় কী দেখতে পাওয়া যাবে সেটা আগে থেকেই জানত তারা। কিন্তু এই সূত্রগুলোতে অন্য একটা তথ্য খুঁজে পেয়েছি। তোমরা নিশ্চয়ই জেনিথ ডের (Zenith day) নাম শুনেছ? এই দিন সূর্য আর পৃথিবী পরিক্রমা করতে করতে এক রেখায় এসে পড়ে। বছরে দু’বার এইরকম হয়। মায়াদের হিসেবে মে উনিশ আর জুলাই তেইশে তাদের জেনিথ ডে হত। তার একমাস আগে থেকে কুকুলকান তার ঘুম থেকে জেগে মায়াদের রাজ্যে পরিক্রমা করত দিনে ও রাতে। সেইদিন কুকুলকানের শহরের বাইরে গিয়ে মায়া পুরোহিতেরা অপেক্ষা করত কখন সূর্যের কিরণ এসে পড়ে তাদের তৈরি করা সান-ডায়ালে। কুকুলকান নিজে সেদিন তাদের সামনে আসত। সূর্য মাথার ওপরে উঠলে সেইদিন সান-ডায়ালে কোনও ছায়া পড়ত না। সেই দেখে পুরোহিতেরা তাদের পঞ্জিকার ভুলত্রুটি সংশোধন করত।”

রাজর্ষি কথা শেষ করে ম্যাথিউর দিকে তাকাল। ম্যাথিউ এবার বলল, “কুকুলকানের শহরের হদিশ দেওয়া না থাকলেও সেই কার্যকলাপের জায়গাটার কথা বলা আছে বিশদে। সেটা আছে হলটুনের সেনোটের ঠিক কাছে। আজকে পাঁচই মে। যদি সব ঠিক থাকে লাগুনিটা হয়ে হলটুন পৌঁছতে আমাদের বেশিদিন লাগবে না। সেই সান-ডায়াল আবিষ্কার করতে পারলে সারা পৃথিবীতে হৈচৈ পড়ে যাবে। আমরা দেখতে পাব সেই জেনিথ লাইট। আরও লেখা আছে যে জেনিথ লাইটের আলোতে থাকা জাদুর কথা। কিন্তু আমরা অলৌকিক কিছু দেখার আশা করছি না। আমাদের লক্ষ্য কুকুলকানের শহর আর জেনিথ লাইটের সান-ডায়াল।”

তার কথা শুনে সকলে চুপ করে গেল। কেউ কোনও কথা বলল না কিছুক্ষণ। ম্যাথিউ বলল, “জানি, তোমরা হয়তো ভাবছ, কুকুলকান বা সর্পদেবতার নিজস্ব শহর হওয়া একটা আজগুবি ব্যাপার। সঙ্গের ঘটনাগুলোও নিঃসন্দেহে কাল্পনিক কাহিনি। সর্পদেবতা বলে কোনও ড্রাগন তো আসলে থাকতে পারে না, তাই তার শহর থাকাও সম্ভব নয়। এই অবিশ্বাস্য মিথের পিছনে দৌড়োনো কি ঠিক? কিন্তু সেটা বড়ো কথা নয়। প্রমাণ থাক বা না থাক, এই লেখার সত্যতা যাচাই করাই আমাদের কর্তব্য। অজানাকে জানার ক্ষিদে আছে বলেই না আমরা বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিযান করি। অনেক সময় আমাদের চেনাশোনা জ্ঞানের বৃত্তের বাইরে অনেক কিছু এসে আমাদের বিশ্বাসে আঘাত করবে, কিন্তু আমাদের এগিয়ে যেতে হবে ধৈর্য ধরে।”

ম্যাথিউ একটানা বলে থামল। একে একে তাকাল সকলের দিকে। একসময় নিস্তব্ধতা ভেদ করে রাজর্ষি বলল, “আমি তোমার কথায় বিশ্বাস করি। আমি তোমার সঙ্গে আছি।”

এমিলি বলল, “আমিও।”

এবার সকলে এক সঙ্গে এসে ম্যাথিউর হাত জড়িয়ে ধরল। আগুনের আভায় সকলের চোখগুলো চকচক করছে আসন্ন অভিযানের উত্তেজনায়। কাল থেকে যাত্রা শুরু।

।।পাঁচ।।

একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস নিয়ে বিশ্রাম করছিল রাজর্ষি। প্রায় ঘন্টা পাঁচেক হল তারা অরণ্যে প্রবেশ করেছে। সকলের পিঠে ভারী রুকস্যাক। এরিক তার ওপর সঙ্গে নিয়েছে নানাধরনের ক্যামেরা আর রেকর্ডার। জিজ্ঞেস করে সে জানতে পেরেছে যে তাদের অভিযানের পুরো খরচটাই বহন করছে ওয়েটগ্রান্টস প্রোগ্রাম রিসার্চ ফান্ড। এরকম কোনও অভিযানে গেলে নাকি খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ফিল্ম করা আর ছবি তুলে রাখা অত্যন্ত দরকার।

জঙ্গলে প্রথমদিকে চলতে কোনও অসুবিধে হয়নি। মাঝে মাঝে গাছপালা হালকা হয়ে খানিকটা করে ফাঁকা জায়গা। সেখানে খানিকটা হাঁটার পর বিশ্রামের জন্যে থামতেই হয়। এই জায়গাগুলোকে বলা হয় রেস্ট পয়েন্ট। যেকোনও অভিযানে রেস্ট পয়েন্টের আগে থামা যায় না, সে তোমার যত কষ্টই হোক। না হলে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে অসুবিধে হতে পারে। হেঁটে যেতে হবে।

দুটো রেস্ট পয়েন্ট পেরিয়ে আসার পর এরিকের কথামতো তারা একটু ডানদিকে ঘুরে এগোতে শুরু করল। তারপরেই শুরু হল আসল জঙ্গল। বোঝা যায়, এইদিকের অরণ্য যাকে বলে কোর ফরেস্ট। মানুষের পা এখানে কদাচিৎ পড়ে। মাটির ওপর শুকনো পাতা স্তুপ হয়ে আছে। গাছের পাতা এত ঘন যে সূর্যের আলো এসে পৌঁছচ্ছে না মাটিতে। চোখের সামনে থেকে উড়ে যাচ্ছে সবুজ টিয়ার দল। গাছে গাছে বাঁদরের হুপহাপ শব্দ শোনা যাচ্ছে অনবরত। এই অঞ্চলে চেনা গাছেদের সঙ্গে সঙ্গে ভিড় করেছে সেবাস, মোহগনি আর য়ুক্যাটান ডুমুরের বন। ঝোপে ঝোপে ফুটে আছে নানাধরনের বুনো ফুল। এরিক তাদের সাবধান করে দিয়েছে। পাতা জমে জমে অনেক সময় চোরাবালির মতো তৈরি হয়ে যায়। পা পড়লেই মানুষ হুশ করে তলিয়ে যায় ভিতরে। খুব সাবধানে ট্রেকিং পোল দিয়ে পরীক্ষা করে এগোতে হবে। তার ওপর নানা বিষধর সাপের বাসস্থান এই জঙ্গল। তাদের ঘাড়ে পা পড়লে আর দেখতে হবে না। রাস্তা মাঝে মাঝে ওপর দিকে উঠে গেছে, আবার কখনও নেমে গেছে অনেকটা নিচে। এমন জায়গায় ট্রেকিং করা সহজ নয়।

প্রায় দুপুর বারোটার সময় যখন তারা চতুর্থ রেস্ট পয়েন্টে পৌঁছল, সকলের মুখ পরিশ্রমে ঘেমে গেছে। খানিকটা জল গলায় ঢেলে মাইকেল বলল, “এরকম করে চললে আমাদের মেক্সিকোতে ঢুকতে একমাস লেগে যাবে।”

রাজর্ষিরও তাই মনে হচ্ছিল। জঙ্গলের যা নমুনা দেখছে, দশ পা এগোলে পাঁচ পা পিছোতে হচ্ছে। কোনও কোনও জায়গাতে ভাঙা গাছের মস্ত মস্ত গুঁড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয় খানিকটা। সেরকম গুঁড়িগুলো গড়িয়ে পড়ে গেলেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তখন অন্য রাস্তা খুঁজতে হয়। এরিক ম্যাথিউর সাথে কথা বলে বলল, “এই পথে আমি আগে গেছি খানিকটা। আর মাইলখানেক পর থেকেই রাস্তা সমতল হয়ে যাবে। জঙ্গল ঘন হবে, কিন্তু এগোতে অসুবিধে হবে না।”

আবার চলা শুরু হল। রাজর্ষি রাস্তার দিকে নজর দিয়ে হাঁটছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে তার জানা আছে, এরকম পথে একটু মনোযোগ কম হলেই আছাড় খেতে হবে। ট্রেক করার সময় কথা বলা যায় না। এমিলি তার পিছনে চলছে। তার দিকে চোখ পড়তে সে হালকা হেসে বুড়ো আঙ্গুল তুলে ‘থাম্বস আপ’ দেখাল। এমিলিও নিঃশব্দে হেসে উত্তর দিল। প্রায় চার ঘন্টা আরও চলার পরে মোটামুটি একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছনো গেল। জায়গাটার চারপাশে ঘন ঘন কয়েকটা গাছ থাকলেও মাঝখানটায় মোটামুটি ফাঁকা। এরিক থেমে বলল, “এখানেই ক্যাম্প করা যাক।”

সকলে মিলে তাঁবু টাঙিয়ে ফেলল কিছুক্ষণের মধ্যে। মধ্যেখানে বড়ো করে একটা আগুন জ্বালানো হল। সঙ্গে টিনের খাবার আছে। এরিকের সঙ্গে থাকবে রাজর্ষি। কাজকর্ম সেরে যখন সকলে কফি খাচ্ছে, আলো নিভে এসেছে। কখন সে সূর্য ডুবল বোঝাই গেল না। হঠাৎ ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার। ঝিঁঝিঁর ডাক বেড়ে গেছে শতগুণ। আরও কীসব রহস্যময় আওয়াজ হচ্ছে জঙ্গলের ভিতর থেকে। এরিক সকলকে বার বার বলে দিয়েছে সন্ধ্যের পর একদম না বেরোতে। প্রায় সাত-আটরকমের জাগুয়ার পাওয়া যায় এই জঙ্গলে। তাদের মতো চালাক শিকারি আর হয় না। তাছাড়াও আছে সাপ আর বিষাক্ত পোকামাকড়। সবচেয়ে বেশি ভয় রাস্তা হারিয়ে যাওয়ার। এখানে যদি কেউ রাস্তা ভুল করে, কম্পাস নিয়েও সে ঠিক পথে যেতে পারবে না।

প্রত্যেকেই আজ ক্লান্ত হয়ে ছিল। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে ফেলা হল। পালা দিয়ে দু’জন করে পাহারা দেবে ক্যাম্প। রাজর্ষির এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসছিল না। সে বাইরে এসে চারদিকে তাকাল। আগুন জ্বালিয়েও অন্ধকার খুব সামান্য দূর করা গেছে। কী ঘন এই অন্ধকার! জ্যোৎস্নার কিছুমাত্র আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না ঘন গাছেদের জন্যে। এই দুর্গম অরণ্যে কোথায় লাগুনিটা, কোথায়ই বা কুকুলকানের শহর? এরিকের দিকে তাকিয়ে সে দেখল, সে চোখ বুজে একটা গানের সুর গুনগুন করছে। যত দেখছে লোকটাকে ভালো লাগছে তার। বেশি কথা না বললেও সে হাসিমুখে থাকে বেশিরভাগ সময়। ম্যাথিউর মতো অভিযানের চিন্তায় ভুরু কোঁচকাতেও দেখেনি সে এরিককে। আর সে না থাকলে আজকে জঙ্গল পেরিয়ে আসা অসম্ভব ছিল। তার ওপরেই এখন এই অভিযানের সাফল্য নির্ভর করছে। তারা কতদিনে লাগুনিটা পৌঁছবে, তারপর কাজ শুরু হবে বাকিদের। ঘড়ির দিকে দেখল রাজর্ষি। ন’টা বাজে। ক্যাম্পে ফিরে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়ল সে।

।।ছয়।।

নয়দিন অরণ্যের পথে চলার পর রাজর্ষিরা দেখতে পেল তামচে শহরের চিহ্ন। প্ল্যান অনুযায়ী এখানে পৌঁছনোর কথা ছিল পাঁচদিন আগে, কিন্তু একের পর এক বিপদ এসে আঘাত করতে লাগল তাদের ওপর। তারা যে মেক্সিকোর সীমানা পেরিয়ে এখান অব্দি পৌঁছতে পেরেছে সুস্থ অবস্থায়, নেহাত ভাগ্য ভালো বলেই।

প্রথমদিনের পর তারা ঠিকঠাকভাবেই এগোচ্ছিল পরিকল্পনা অনুযায়ী। এমন সময় দ্বিতীয়দিন বিকেলের ঠিক আগে ঘটে গেল একটা বিচ্ছিরি ঘটনা। গাছের গুঁড়ির ওপর দিয়ে একটা খাল পেরোনোর সময় গুঁড়িটা হেলে ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে এমিলি আর ম্যাথিউ দু’জনেই গিয়ে পড়ল ঠান্ডা স্যাঁতস্যাঁতে জলে। দেখামাত্র এরিক সরসর করে নেমে গেল শুকনো পাতার স্তুপের ওপর দিয়ে। বহু কষ্টে যখন দু’জনকে জল থেকে তোলা গেল, এমিলির তখন জলে ভিজে জ্বর এসে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্যাম্প ফেলে দু’জনকেই ওষুধ দিয়ে দেওয়া হল।

রুকস্যাকের ভিতর জল ঢুকে গিয়ে ম্যাথিউর এরিয়াল প্রজেকশান স্যাটেলাইট ক্যামেরা ডিভাইস আর জিপিএস মেশিন খারাপ হয়ে গেছে। তার ওপর থেকে তার পা মুচকে এমন অবস্থা যে সে হাঁটতেই পারছে না। এমন অবস্থায় এক পাও এগোনো সম্ভব নয়। পুরো দেড়দিন ক্যাম্প করে সেখানেই থাকতে হল। এমিলির জ্বর সারলেও সেও হাঁটবার অবস্থায় ছিল না।

তৃতীয়দিন ম্যাথিউ ঠিক করল অন্তত কয়েকজন গিয়ে সকাল থেকে জায়গাটা সার্ভে করুক। এরকম চুপচাপ দিনের পর দিন ক্যাম্পে পড়ে থাকার কোনও মানে হয় না। তার পা আর এমিলির জ্বর ঠিক করে সারতে হয়তো দু’দিন আরও লাগবে। তার মধ্যে দিক ঠিক করে রাখলে এগোতে সুবিধে হবে। জিপিএস খারাপ হয়ে গেছে। অতঃপর এরিক, রাজর্ষি, মাইকেল আর হুআন মিলে তৃতীয়দিন চলল জঙ্গলের উত্তর-পশ্চিমদিকে। মাইলচারেক হাঁটার পরেই রাজর্ষির নজরে পড়ল কয়েকটা পুরনো সমাধি। দেখেই সে বুঝতে পারল, এই সমাধিগুলো মায়াদের। হয়তো আশেপাশে অন্য কোনও পরিত্যক্ত ছোটো শহর আছে তাদের। কিন্তু অনেক খুঁজেও তারা কিছুই পেল না।

এমন সময় হুআন তাদের দৃষ্টি আকর্ষিত করল চৌকো গর্তের দিকে। বাকি সকলে তার কাছে গিয়ে দেখল, গর্তটা একটা বিরাট গাছের শিকড়ের কাছে কালচে সবুজ হয়ে এরকম মিশে আছে যে এমনিতে নজরে পড়া মুশকিল। এরকম চৌকো গর্তে মায়াদের শহরে জল ভরে রাখা হত বলে জানত রাজর্ষি। কিন্তু এই গর্তটা জলের গর্তের চেয়ে পরিধিতে অনেক বড়ো ও গভীর। নিচে একটা সুড়ঙ্গ আছে বলে মনে হচ্ছে। দরকার হলে একজন দড়ির সাহায্যে নিচে নেমে যেতে পারে। কিন্তু ততটা ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হবে? ততক্ষণে হুয়ান এগিয়ে গিয়েছে গর্তটার কাছাকাছি। হঠাৎ গর্তের পাশের উঁচু পাথরটায় তার পা পড়তেই গুম গুম করে শব্দ হয়ে গর্তের পরিধির চারদিকে প্রায় চার ফুট জায়গা সরে গিয়ে জায়গাটা ফাঁক হয়ে গেল আর হুআন পড়ে গেল সেই গর্তে।

ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে সকলে একেবারে হচকচিয়ে গেল। বোধ ফিরতে দৌড়ে গর্তটার কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল তারা। নিচে দুর্ভেদ্য অন্ধকার। হুআনের কোনও চিহ্ন নেই। এরিক সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। বেশি দেরি হয়ে গেলে আর কোনও আশা থাকবে না হুআনকে বাঁচাবার। আমি নিচে নামব। তোমরা ওপরে থাক।”

রাজর্ষি তাড়াতাড়ি তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “না এরিক। তুমি নেম না। অভিযানের কথা ভেবেই এই ঝুঁকি তোমার নেওয়া চলবে না। আমি নামছি নিচে।”

uponyaskukulkaner sondhane_3 (Large)এরিক তার দিকে তাকিয়ে দেখল, কিন্তু তাকে বাধা দিল না। বেশি সময় হাতে নেই। কোমরে হার্নেস পরে নিল রাজর্ষি। কারাবিন্যারে দড়ি লাগিয়ে এরিকের হাতে দড়ি ধরিয়ে সে ওই গভীর গহ্বরে নামতে শুরু করল। গর্তটা খুব চওড়া নয় ওপরদিকে, কিন্তু যত নিচে নামছে জায়গাটা চওড়ায় বাড়ছে। হাতে টর্চ নিয়ে আস্তে আস্তে নামছে রাজর্ষি। কিন্তু গর্তটা এত গভীর যে হুয়ানের জন্যে চিন্তা বাড়তে লাগল তার। এত ওপর থেকে পড়লে কি বেঁচে থাকা সম্ভব! প্রায় পঁয়ষট্টি ফুট নিচে নেমে সে জলের স্রোতের শব্দ শুনতে পেল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ওপর থেকে আসা আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছে সে। হাতের টর্চ নিচে ফেলে সে দেখতে পেল যে তার পায়ের খানিক নিচে দিয়েই একটা জলের স্রোত বয়ে চলছে। এটা কি তবে একটা নদী? মাটির তলায় এরকম নদী থাকা আশ্চর্য নয়। মেক্সিকোর বহু অঞ্চলে এরকম ভূগর্ভস্থ নদী পাওয়ার নজির আছে। সে দড়িতে টান দিয়ে উপরে বেলেয়িং করতে থাকা এরিককে দড়ি ছাড়তে নিষেধ করল। যদি এই নদী গভীর হয় তাহলে হুআন বেঁচে থাকতেও পারে, কিন্তু তার হাতে বেশি সময় নেই। হাতের টর্চ দড়িতে বেঁধে সে ক্যারাবিনার থেকে দড়ি খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে সে ঝপাং করে গিয়ে পড়ল হিমশীতল সেই স্রোতের ভিতর।

জলে পড়েই রাজর্ষির মনে হল জল বেশ গভীর। ঝুলিয়ে থাকা টর্চের আলোয় কিছুটা জায়গা আলোকিত হয়ে আছে। সে ডুবসাঁতার দিয়ে হুআনকে খুঁজতে লাগল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সে হুআনের অচৈতন্য দেহটা পেল স্রোতের বাঁকে। তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে বুঝতে পারল তার নিঃশ্বাস চলছে। মাথায় রক্ত লেগে নেই। হয়তো শরীরে অন্য কোথাও চোট লেগেছে, কিন্তু প্রাণে যে বেঁচে গেছে এই ঢের। হুআনকে তার হার্নেস আর ক্যারাবিনার পরিয়ে দড়িতে ঝুলিয়ে দিল সে। সংকেত দিতেই এরিক দড়ি টানতে লাগল ওপরে। তার জন্যে আবার দড়ি ফেলবে এরিক হুআনকে ওপরে তুলে নিয়ে। ততক্ষণে এই জায়গাটা জরিপ করে নিতে হবে।

খুব সাবধানে স্রোতের কাছাকাছি পা চালাল সে। খানিকটা এদিক সেদিক আলো ফেলতেই সে দেখতে পেল সুড়ঙ্গটা এঁকেবেঁকে বহুদূর চলে গেছে। একের চেয়ে বেশি স্রোতের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো ভূগর্ভে নদীদের অনেক শাখা এক সঙ্গে চলেছে। দেওয়ালের গায়ে শ্যাওলা এত পুরু হয়েছে যে কনুই অব্দি হাত ঢুকে যায়। নদীর জল অবশ্য স্বচ্ছ। টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে একজায়গায় চোখ আটকে গেল রাজর্ষির। ওটা কী? স্ট্যাল্যাগটাইট নাকি? কিন্তু না তো! ভালো করে দেখে রাজর্ষি নিশ্চিত হল যে নদীটা যেখানে বেঁকেছে তার মাথার ওপরে একটা সাপের মূর্তি তৈরি করা আছে। তবে কি এই সেই কুকুলকান? কিন্তু মায়ারা মাটির এত নিচে একটা ভূগর্ভস্থ নদীর সুড়ঙ্গে তার মূর্তি তৈরি করেছিল কেন? হয়তো এই সুড়ঙ্গ দিয়ে আশেপাশের শহরে পৌঁছনোর কোনও পথ ছিল। কিন্তু এইমুহূর্তে এগিয়ে গিয়ে সন্ধান করা অসম্ভব। এরিক তার জন্যে দড়ি নামিয়ে দিয়েছে।

সুড়ঙ্গ থেকে উঠে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে যখন সে নিঃশ্বাস নিল, অন্ধকার নেমে এসেছে। এরিক কোনও কথা না বলে তার পিঠ চাপড়ে দিল কয়েকবার। ক্যাম্পে এমিলিরা প্রচন্ড চিন্তা করছিল। রাজর্ষির মুখে সব শুনে ম্যাথিউ গম্ভীর হয়ে গেল। আস্তে আস্তে বলল, “ইনক্রেডিবল।”

রাজর্ষি বলল, “আমরা কি সেই সুড়ঙ্গে গিয়ে পরীক্ষা করব?”

ম্যাথিউ বলল, “না, আমাদের প্রথম কাজ লাগুনিটার দিকে এগোনো। যদি আমাদের চিন্তা সঠিক হয়, এই সূত্র আমরা আবার পাব। কিন্তু তুমি খুব সাহসের পরিচয় দিয়েছ আজ। এটা একটা বড়ো সূত্র। আমার মনে হচ্ছে রাজ, মায়াদের প্রতিটা শহরের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্যে ভূগর্ভে এইরকম সুড়ঙ্গ থাকত।”

হুআনের জ্ঞান ফিরে এসেছে। একটা হাত মুচকে গেছে তার, আর অনেক জায়গায় কেটে-ফেটে গেছে। সেসব কিছুই নয়।

দু’দিন পর থেকে তারা আবার পথ চলা শুরু করল। বড়ো বড়ো সেবাসগাছের ডাল দিয়ে ঘেরা জঙ্গল যেন তাদের অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে আরও আদিম, আরও নিবিড় হয়ে উঠল। রাজর্ষি এরকম জঙ্গল কোনওদিন দেখেনি। এখানে প্রকৃতি যেমন সুন্দর, তেমনই দুর্গম। দুই ধার দিয়ে মোটা মোটা লতা গাছেদের গায়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওপর দিকে উঠেছে। গাছের শিকড়ের তলা দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট জলের ধারা বয়ে চলছে কুল কুল করে। কোনও কোনও জায়গায় বুনো ফুলের জঙ্গল এত বেশি যে গাছের পাতা নজরে পড়ে না। রাজর্ষি মুগ্ধ হয়ে গেল এই অপরূপ সৌন্দর্যে। একেকবার তার মনে হয়, এই অরণ্যে আসতে পেরেই সে ধন্য হয়েছে।

একদিন তারা এসে পৌঁছল একটা খাদের ধারে। পাহাড়ের পথ দিয়ে চড়াই উৎরাই প্রতিদিনই হচ্ছে, কিন্তু এখানে জঙ্গল খাড়া নেমে গেছে প্রায় দুশো ফুট নিচে। ওপাশের অরণ্য মুখ তুলে চেয়ে আছে। এখান দিয়ে নিচে নামা যায় না। ক্যাম্প করার মতো সমতল জায়গায় নেই। খুঁজে খুঁজে ছেলেরা দুটো টেন্ট লাগানোর মতো জায়গা খুঁজে পেল। কয়েকটা বন্য ডুমুরের গাছ আর চিকোজাপটের ঘন বন চারপাশে। এই ট্রপিকাল ফরেস্টে চিকোজাপটের গাছের প্রাচুর্য। সারাবছর সবুজ থাকে এই গাছগুলো। ঠিক করা হল, হুয়ান, এমিলি আর ম্যাথিউ টেন্টে থাকবে। বাকিরা হ্যামক ঝুলিয়ে শোবে গাছে। দু’জন পালা করে জেগে পাহারা দেবে আগুনের কাছে।

তাড়াতাড়ি ক্যাম্প খাটিয়ে নেওয়া হল। জঙ্গলের উঁচু জায়গায় আছে বলে খোলা আকাশ দেখতে পাচ্ছে তারা। চাঁদ উঠতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাজর্ষি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলোয় মায়াঘন হয়ে উঠেছে বনের পরিবেশ। লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলে উঠেছে খাদের নিচে অরণ্যের মাথার ওপর। এত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে প্রতিটি নক্ষত্র, যেন কেউ আলোর রোশনাই করেছে দেওয়ালিতে। সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল সামনের দিকে। দিগন্তপ্রসারী জনহীন এই অরণ্যের কোলে বসে রাজর্ষির মনে কেমন যেন ধাঁধা লেগে গেল। কত হাজার হাজার বছর ধরে এই অরণ্য সাক্ষী রয়েছে মানবসভ্যতার। যখন মানুষের অস্তিত্বই ছিল না, তারা একইভাবে দাঁড়িয়ে ছিল এখানে। তারপর ওলমেক এল, এল মায়ারা, আরও কত মেসো-আমেরিকান সভ্যতা এল আর গেল। স্প্যানিশরা ঘাঁটি গাড়ল একসময়ে, কিন্তু এই অরণ্য রয়ে গেল একইভাবে। এরাই কি পৃথিবীর ইতিহাসের বাহক নয়? আমরা সভ্যতা আর ইতিহাস বলতে মানুষের পরিচয়, মানুষের ক্রিয়াকলাপ, মানুষের শিল্পচর্চাই বুঝি। কিন্তু এই অরণ্যরাজ্য, এই নক্ষত্রমালা আর প্রকৃতির নিশ্চুপ দৃষ্টির কি কিছুই দাবি নেই আমাদের কাছে? অনেকক্ষণ সেই ঘোরে বসে থাকার পরে একসময় ফিরে গিয়ে সে গাছে ঝোলানো ক্যাম্পখাটে শুয়ে পড়ল।

রাতে এরিকের ঠেলায় সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। তার ঝুলানো বিছানার পাশে এরিক রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ গাছের ওপরে। ঠোঁটে আঙুল রেখে সে রাজর্ষিকে উঠে আসতে বলল। ততক্ষণে সকলে পৌঁছে গেছে আগুনের কাছে। গাছগুলোর মাথার ওপর থেকে কীরকম অদ্ভুত একটা ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনও বেড়াল রেগে গরগর করছে। হুয়ানের কাছে একটা নাইট ভিশন বাইনোকুলার ছিল। সেটা তার কাছ থেকে নিয়ে চোখে লাগাতেই সে হাঁ হয়ে গেল। গাছের প্রতিটা ডালে ঐগুলো কী? বেড়ালের মতো দেখতে, কিন্তু গায়ে ডোরাকাটা। প্রায় পাঁচটা। দুটো গাছের ডালে পাতার আড়ালে বসে আছে। তাদের চোখগুলো অন্ধকারে জ্বলছে সহজেই বোঝা যায়। সে আস্তে আস্তে এরিককে জিজ্ঞেস করল, “ঐগুলো কী?”

এরিক চাপা স্বরে বলল, “মারজাইস। জাগুয়ারের প্রজাতিরই প্রাণী। আজকাল প্রায় দেখাই যায় না। সংখ্যায় খুব কমে গেছে এরা। কিন্তু ওদের জন্যে তোমাদের সকলের ঘুম নষ্ট করিনি। ওদের পিছনের ডানদিকের গাছের ওপর দেখ মন দিয়ে।”

এরিক বাইনোকুলার এগিয়ে দিল। প্রথমে সে কিছুই দেখতে পেল না। অনেকক্ষণ পর একটা জায়গায় আলোর ফুটকি দেখতে পেয়ে বাইনোকুলার ঘোরাতে সে উত্তেজনায় বোবা হয়ে গেল। পিউমা! আগে সে ছবিতে দেখেছে। বাঘের চেয়ে আকারে একটু ছোটো। হিংস্র আর চালাক প্রাণী বলে এদের সহসা কেউ ক্ষতি করতে পারে না। শিকারের দরকার হলে পিউমারা হরিণ কিংবা মানুষের বিচার করে না। রাতে ব্যাটা লাফিয়ে পড়লেই অভিযান ঘুচে যেত রাজর্ষির। এরিক বলল, “ভেবেছিলাম, লোকজন জেগে উঠেছে দেখে পালাবে। এ ব্যাটারা তো নড়েই না দেখি। কী আর করা যাবে।” বলে সে হাওয়ার দিকে রাইফেল তুলে একটা গুলি চালিয়ে দিল। গুলির প্রচন্ড শব্দ হতেই জানোয়ারগুলো তিরবেগে গাছ থেকে লাফিয়ে নেমে জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল। এমিলি এসে এরিকের ডানহাত ছুঁয়ে বলল, “থ্যাঙ্কস।”

পরেরদিন সকাল থেকে আচমকা তুমুল বৃষ্টি নামল জঙ্গলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুকনো পাতার ওপর থেকে দুর্দান্ত বেগে জল গড়াতে শুরু করল। এইসব জঙ্গলে মুহূর্তের মধ্যে বন্যা হয়ে নদীর জল উথলে ওঠে। আগে থেকে কিচ্ছুটি বোঝবার উপায় নেই। সবাই মিলে জিনিসপত্র গোটাতে গোটাতেই প্রায় অর্ধেক জিনিস জলে বয়ে গেল। তারা খাদের কিনারাতে ছিল বলে অন্যদিকে যাওয়ারও উপায় নেই। তুমুল বেগে জল এসে খাদের ধার দিয়ে বড়ো বড়ো জলপ্রপাতের সৃষ্টি করল। মুষলধারে বৃষ্টি চলছে। তার সঙ্গে চলছে বিদ্যুৎ আর মেঘগর্জন। রাজর্ষিরা ভিজে একসা হয়ে গেল। দুটো তাঁবুর একটা বয়ে গেছে। এইসময় বর্ষা হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়। কয়েকটা ঘন গাছের নিচে ত্রিপল চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সবাই।

প্রায় ঘন্টা দুই পর যখন বৃষ্টি থামল, জঙ্গলের চেহারাই বদলে গেছে। রাজর্ষির মনে হতে লাগল তারা যেন একটা অন্য জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছে। এমন সতেজ ঘাসের জঙ্গল আর গাছের শেকড়ের নিচে এতো বড়ো বড়ো কোটরের মতো গর্ত তো সে দেখেনি। ম্যাথিউ বলল, “আসলে জলের তোড়ে শুকনো পাতার স্তূপগুলো সরে গিয়ে আসল চরিত্রটা বেরিয়ে পড়েছে।”

জিনিসপত্র গুনতে গিয়ে দেখা গেল যন্ত্রপাতির একটা ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে না। টিনের খাবারের অনেকগুলো টিন বেপাত্তা। জলে বয়ে গেছে ছোটোখাটো অনেক জিনিস। এমিলি রাজর্ষিকে বলল, “যাত্রাটাই খারাপ। নাহলে এরকম হয়?”

প্রায় দুপুর বারোটার সময় এগোনো শুরু হল। সকলের শরীর ও মন অবসন্ন। ক্লান্তিতে ও পথচলার পরিশ্রমে সবাই যেন মুষড়ে পড়েছে। তারপর দিক ঠিক করার আসল যন্ত্রগুলো গেছে বিগড়ে। এ তো আর কম্পাসের সাহায্যে উত্তর-দক্ষিণ বুঝে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে যাওয়া নয়। তারা একটা হাজার বছরের হারিয়ে থাকা শহর খুঁজতে এসেছে। সেখানে দরকারি যন্ত্রপাতি ছাড়া কী করে ঠিকঠাক এগোনো যাবে, সেই নিয়ে একটা চিন্তা তো থেকেই যায়।

সেই রাতে ম্যাথিউ সকলকে বলল, “বুঝতেই পারছ, অবস্থা সুবিধের নয়। আমাদের তিনজন পুরোপুরি সুস্থ নেই। তারপর অর্ধেক জিনিসপত্র গেছে হারিয়ে। যদি আমরা অভিযানে এগিয়ে লাগুনিটা পৌঁছতে না পারি তাহলে ওয়েটগ্রান্টস প্রোগ্রাম কোনওভাবেই দ্বিতীয়বার আমাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করবে না। এখন উপায় হচ্ছে যদি আমরা ওয়াকিটকিতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবকথা খুলে বলি, তা হলে হয়টো নতুন যন্ত্রপাতি আর লোক পাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের কাম্পেচে অথবা তিকালে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। কিংবা আমরা ভাগ্যের ভরসায় এগোই। যদি ঠিকঠাকভাবে তামচে শহর খুঁজে বের করতে পারি আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তা হলে হয়তো সব ঠিক হলেও হতে পারে। কাল সকাল অব্দি সকলে ভাব। তারপর ঠিক করা হবে।”

সকলে এই কথায় মুষড়ে পড়ল। রাজর্ষির মুখ কালো হয়ে গেল। শেষপর্যন্ত আবার সেই এক অবস্থা। মাঝপথে অভিযান বন্ধ করে দেওয়া। তাহলে কি তার ভাগ্যেই এইরকম লেখা আছে! সে মুখ চুন করে গিয়ে বসে থাকল আগুনের সামনে। কিছুক্ষণ পর এসে এরিক আর এমিলি তার সঙ্গে যোগ দিল। এরিক বলল, “কী ব্যাপার? এমন মুখ গোমড়া কেন?”

রাজর্ষি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আস্তে আস্তে খুলে বলল তার কথা দু’জনকে। বেশিরভাগ সময়ই তার অভিযানগুলো অসমাপ্ত থেকে গেছে আজ পর্যন্ত। এমিলি তাকে বলল, “তোমার নিজেকে দোষ দেওয়া ভুল, রাজ। এই ব্যাপারটা কাকতালীয়।”

রাজর্ষি কিছুই বলল না। শুধু চেয়ে রইল আগুনের দিকে।

পরেরদিন সকালে মিটিং শুরু হতেই এরিক বলল, “আমি বলছি, আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত। এই অভিযানের গাইড হিসেবে লাগুনিটা অব্দি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা আমারই। সে যন্ত্রপাতির সাহায্য নিয়েই হোক আর না নিয়েই হোক।”

ম্যাথিউ উত্তর দিল, “কিন্তু এরিয়াল প্রজেকশনের ছবিগুলো স্যাটেলাইট দিয়ে না পেলে আমরা বুঝব কী করে যে আমরা লাগুনিটার দিকে যাচ্ছি কি না?”

এরিক ঘাড় নাচিয়ে বলল, “সে তো সেটা থাকলেও একটা আন্দাজ পাওয়া যেত মাত্র। স্যাটেলাইট ফটো দেখে আসল জমিতে পথ ঠিক করা অসম্ভব।”

“হুম-ম।” ম্যাথিউ বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাকিদের কী মত?”

এমিলি বলল, “আমারও মনে হয় এগিয়ে যাওয়াই ঠিক হবে। অনেক পরিকল্পনা করে এই অভিযান হচ্ছে। এইটুকুতেই হার মেনে নেওয়া ঠিক হবে না।”

বাকি সকলেরও তাই মত। সুতরাং আবার পথ চলা শুরু হল। রাজর্ষি চলতে চলতে এরিককে বলল, “থ্যাঙ্কস।”

সে চোখ টিপে একটু হাসল।

ক্রমশ তারা গভীর থেকে গভীরতম জঙ্গলে প্রবেশ করল। সকাল থেকে উঠে মাইলের পর মাইল হাঁটা, তারপর রাতে ক্যাম্প করে থাকা। একদিন গাছের ডালে ঝুলে থাকা একটা সাপের কামড় খাওয়া থেকে একটুর জন্যে বেঁচে গেল রাজর্ষি। সকালের দিকে নিবিড় কুয়াশায় বনের পথ আবৃত হয়ে থাকে। সেইসময় দু’হাত দূরের রাস্তা বোঝা যায় না। এ যেন ভাগ্যের ভরসায় পথচলা। অনেক খাবার ফুরিয়ে গেছে বলে ছোটোমোটো শিকার করতে হচ্ছে খাওয়ার জোগান দিতে। একদিন তারা গাছে গাছে স্পাইডার মাংকির একটা বিশাল দল দেখতে পেল। লেজের পিছনদিক দিয়ে আঁকড়ে ধরে অনায়াসে এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে যায়। মাইকেল একজনকে ভেঙিয়েছিল। সেই বাঁদরটা তার দিকে পাকা একটা ফল ছুঁড়ে মারল। সেটা লাগল মাইকেলের গালে। সেই দেখে এমিলির কী হাসি।

কম্পাসের হিসেবে এখন তারা চলেছে পূর্বদিকে। এরিক যে কীভাবে দিক ঠিক করছে কারও বোঝার উপায় নেই। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে তার আদ্যিকালের ফিল্ড গ্লাস দিয়ে কী দেখে, সূর্যাস্তের সময় উঠে পড়ে যেকোনও একটা গাছে। ম্যাথিউ অব্দি জিজ্ঞাসা করে করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তার মুখের অকৃত্তিম হাসি দেখে উৎসাহ জাগে মনে।

দু’দিন আরও হেঁটে তারা একটা অপেক্ষাকৃত নিচু উপত্যকায় প্রবেশ করল। এদিকের জঙ্গল দেখে রাজর্ষির মনে কেমন একটা ভাব হল। কেমন যেন অদ্ভুত একটা আমেজ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। বিচিত্র লতাপাতা আর উদ্ভট দেখতে সব পাখি। তাদের গায়ের রং এত উজ্বল, মনে হয় তুলি দিয়ে আঁকা। অসেলেটেড টার্কি বলে একধরনের মোরগ আছে, তাদের গায়ে রোদ পড়লে গায়ের প্রতিটি রং হিরের মতো চকচক করে। গাছের ওপর থেকে রাতের বেলায় এরা ডেকে উঠলে বুঝতে হবে জাগুয়ার দেখেছে। যেমন আমাদের ফেউ ডাকে বাঘ বেরোলে।

এই উপত্যকায় পড়ার পর থেকেই তাদের চোখে পড়ছে ভাঙা সমাধিক্ষেত্র, দেওয়ালের চিহ্ন। কিন্তু ম্যাথিউ কোথাও তাদের দাঁড়াতে দেয়নি। কয়েকদিন দিনরাত এক করে দিয়েছে এরিক তামচে আর লাগুনিটার খোঁজে। সে এমন পাকা বুশম্যান যে একবারের জন্যে তার রাস্তা গুলিয়ে যায় না এই গাছেদের গোলকধাঁধায়। অবশেষে একদিন সকালে তারা বিশাল একটা দরজা আর চত্বরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেল। দরজার দু’দিকে দিয়ে একটা ডানাযুক্ত সাপের মূর্তি খোদাই করে রাখা হয়েছে। ম্যাথিউ দেখেই লাফিয়ে উঠে বলল, “তামচে। এই জায়গার ছবি আমি আগে দেখেছি।”

।।সাত।।

সারাদিন ধরে তামচের ভাঙা ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রসপেক্টিং করা হল। যা দেখতে পাওয়া গেছে তার মধ্যে কোনওরকম স্ট্যালে অথবা বিশেষ শিলালিপির অংশ নেই। প্রধান মন্দিরটা ভেঙে গেছে পুরোপুরি। সেখানে জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে হাজার বছরে। কয়েকটা ভাঙা বেদী ছাড়া তেমন কিছু নজরে আসেনি। একমাত্র উপলব্ধি হল শহরের প্রধান ফাটক। কুকুলকানের মূর্তিকে ঘিরে খোদাই করা আছে অনেক কিছু। ম্যাথিউ পড়েছে সেই নিয়ে। এমিলি আর রাজর্ষির ওপর ভার পড়েছে বেদীর টুকরো আর ভাঙা মূর্তিগুলোর অ্যাবসলিউট ডেটিং করে দেখার।

আজকাল কার্বন ডেটিং করার জন্যে ল্যাবরেটরিতে যেতে হয় না। খুব সহজেই দরকার পড়লে যেকোনও জিনিসের বয়স জানা যায়। চিমটে দিয়ে এক একটা জিনিস তুলে যখন তারা ক্যাটালগ তৈরি করছে, হঠাৎ মাইকেল তাদের কাছে এসে বলল, তারা একটা আশ্চর্য জিনিস দেখতে পেয়েছে। কৌতূহলী হয়ে তারা এগিয়ে গেল।

শহরের দরজার উত্তর-পশ্চিমে খানিকটা গিয়ে ধাপ ধাপ পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। কিছুক্ষণ পরেই জঙ্গলে মিশে গেছে। কিন্তু সিঁড়ির ধাপগুলোর ওপরে একটা বিশাল গাছের শিকড় ছড়িয়ে আছে। এমন আশ্চর্য গাছ তারা কোনওদিন দেখেনি। গাছটা দেখে মনে হল প্রায় আটশো বা হাজার বছর পুরনো কিংবা তার বেশিও হতে পারে। কান্ডটার কাছে গিয়ে এমিলি দেখল, সেখানে একটা ফোকর তৈরি হয়েছে। খুব ঠাহর করে না দেখলে বোঝা যায় না। মাইকেল বলল, তারা ভিতরে আলো ফেলে দেখেছে যে কান্ডটার ভিতরে বেশ খানিকটা খালি জায়গা আছে। কিন্তু ভিতরে যেতে তারা সাহস পায়নি। তৎক্ষণাৎ বাকি সকলকে খবর দেওয়া হল।

বেলা একটার সময় তারা চারজন রাজর্ষি, এরিক, ম্যাথিউ আর মাইকেল হামাগুড়ি দিয়ে ফাটলের ভিতর দিয়ে এগোতে শুরু করল। বেশিক্ষণ এগোতে হল না। খানিকটা গিয়েই তারা পৌঁছে গেল একটা ফাঁকা জায়গায়। সকলের হাতেই একটা করে টর্চ। এদিক সেদিক আলো ফেলে বিশেষ কিছু দেখা গেল না। রাজর্ষি ওপরের দিকে তাকিয়ে ভাবল, কে বলবে তারা একটা গাছের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে! এমন সময় মাইকেল জায়গাটার একটা কোনার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষিত করল। একটা পাথরের চৌকো গর্ত। দেখেই রাজর্ষি চিনতে পারল। এ একটা সেরকম কুঁয়ো যার ভিতরে হুআন পড়ে গেছিল। সে সকলকে সাবধান করে দিল ব্যাপারটা জানিয়ে। খুব সাবধানে বুকে ভর দিয়ে মাটির ওপর দিয়ে তারা এগিয়ে গেল সেইদিকে। জোরালো টর্চের আলোয় দেখা গেল যে চৌকো গর্তের চারপাশে একটা পাথরের স্ল্যাব বসানো। তার ওপর নানান আঁকিবুঁকি কাটা ও ছবি আঁকা। অনেকরকমের মুখ আঁকা সেইখানে। ম্যাথিউ কিছুক্ষণ দেখে বলল, “এইখানে লেখা আছে, এই জায়গাটা কুকুলকানের বিশ্রাম নেওয়ার স্থান। কোনও দরকার পড়লে এখান থেকে তাকে আহ্বান করা হত। ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। আমি ছবি তুলে নিচ্ছি লেখাগুলোর। পরে দেখতে হবে।”

উত্তেজনা আর বন্ধ জায়গায় থাকার দরুন সকলে ঘেমে গেছে। মাইকেল বলল, “আমাদের এইখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়। এইটুকু জায়গায় এত লোকের নেওয়ার মতো অক্সিজেন নেই।”

এরিক বলল, “ঠিক বলেছ। কিন্তু একটা জিনিস দেখে নেওয়া দরকার।”

সে সকলকে সরে যেতে বলে পায়ের কোণ দিয়ে চাপ দিল পাথরটায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ঘড় শব্দ করে গর্তের চারপাশে প্রায় তিনহাত পরিখার একটা ফাটল তৈরি হয়ে গেল পাথর সরে। মায়ারা কি যন্ত্রের কারসাজিও জানত? না হলে এত বছর আগে এরকম ওয়েট সেন্সর তারা বানিয়েছিল কী করে? এরিক সবাইকে বলল, “আমি এবার নিচে কয়েকটা পাথর ফেলব। যদি জলের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে প্রায় প্রতিটা ডিগহোলের নিচেই একটা অথবা একাধিক ভূগর্ভস্থ নদী আছে।”

সকলে তাকে সায় দিল। পায়ের কাছ থেকে একটা বড়ো পাথর তুলে এরিক গর্তে ফেলে দিল। প্রায় তিন সেকেন্ড পরে ঝপাস করে একটা শব্দ হল। কোনও সন্দেহ নেই। নীচে গভীর জলের স্রোত আছে। আর তা প্রায় একশো ফুট নিচে। সকলে এ ওর মুখের দিকে তাকাল। এরিক আরও কয়েকটা পাথর ফেলে দিল নিচে। আগেরবারের মতোই সেগুলো গিয়ে পড়ল বহু নিচে।

এমন সময় হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। পাথরগুলো পড়তেই নিচে থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে উঠল। যেন কোনও অশরীরী ফিসফিস করে কথা বলছে। শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। যেন একটা হিসহিসানি ক্রমে ওপরের দিকে উঠে আসছে। রাজর্ষি বুঝতে পারল তার হৃৎপিণ্ডে হাতুড়ির মতো দুম দুম আওয়াজ হচ্ছে। অজানা কোনও এক আতঙ্কে সকলের মুখগুলো শুকিয়ে গেছে। সহসা জায়গাটার মধ্যে একটা আলোড়ন শুরু হল। পাথর পড়তে শুরু করেছে এখান সেখান থেকে। এরিক চিৎকার করে বলল, “পালাও।

কোনও দিকে না তাকিয়ে রাজর্ষি দেখল সে হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে বাইরে বেরোনোর সুড়ঙ্গটার দিকে। তাকে অনুসরণ করছে বাকি সবাই। কম্পনটা বাড়ছে। একবার সারা মাটিটা কেঁপে উঠল। অবশেষে যখন তারা গাছের ফাটল দিয়ে বাইরে পৌঁছল, সকলে আতঙ্কে বিমূঢ় হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হতে সবাই একে অপরের দিকে চাইল। এমিলিকে জিজ্ঞেস করে তারা জানতে পারল, বাইরে ভূমিকম্পের কোনও কম্পন তারা বুঝতে পারেনি। মাইকেল ততক্ষণে সকলকে ব্যাপারটা বলছে উত্তেজিতভাবে। বিকেল হয়ে গেছে। এরিক এরই মধ্যে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সে সকলকে বনের উল্টোদিকে টেন্ট খাটানোর নির্দেশ দিল।

।।আট।।

রাতে ম্যাথিউর টেন্টে বসে সকলের কপালের চিন্তার রেখা খেলা করছিল। দুপুরের ব্যাপারটা সকলের মনে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। সুড়ঙ্গের ভিতরে যে শব্দটা তারা পেয়েছিল সেটা কি শুধুই তাদের মনের ভুল? স্বাভাবিক কারণে হওয়া চললে যে ওরকম আশ্চর্য শব্দ হওয়া সম্ভব নয়, সেই বিষয়ে কারোরই সন্দেহ নেই। তাহলে? তাহলে কি সেই সুড়ঙ্গে বাস করে কোনও অতিকায় প্রাণী যাকে কুকুলকান মনে করে শত শত বছর ধরে পুজো করত মায়ারা! কোনওভাবে আজও সেই অদ্ভুত জীবের উত্তরজীবিরা জীবনধারণ করতে সক্ষম হয়েছে সেই ভূগর্ভস্থ নদীর সুড়ঙ্গে?

ম্যাথিউ অনেকক্ষণ ধরে আজকের পাওয়া লেখাগুলোর মানে উদ্ধার করার চেষ্টা করছিল। একসময় সে মুখ তুলে বলল, “আমরা ঠিক পথেই চলেছি। ওই সংকেত যদি ঠিক হয়, এই ভূগর্ভ নদী বয়ে গেছে কুকুলকানের প্রতিটা শহরের নিচে দিয়ে। এরপরের শহর হল লাগুনিটা। আরও লেখা আছে যে এই ভূগর্ভস্থ নদীর শেষেই আছে কুকুলকানের নিজের শহর যেখানে তিনি থাকেন অনন্তকাল ধরে।”

এমিলি বলল, “তাহলে দেরি করে কী লাভ? কাল সকালেই বেরিয়ে পড়া যাক লাগুনিটার উদ্দেশ্যে।”

সকলেই সায় দিয়ে উঠল।

এরিক এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। সে এবার গম্ভীর মুখে বলল, “সব ঠিক আছে। কিন্তু তোমরা নিশ্চয়ই আজকে দুপুরের ঘটনার কথা ভোলোনি। ভুলে যেও না আমরা এক আদিম অরণ্যের ভিতরে আছি যেখানে হাজার বছর ধরে কেউ প্রবিষ্ট হয়নি। কোন পদক্ষেপে কোন বিপদ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে আগে থেকে তা জানার কোনও উপায় নেই। এই রহস্যময় আলোড়নের কারণ যাই হোক, কোনও বিশালাকায় সরীসৃপ, কোনও অপদেবতা কিংবা কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এইবার থেকে সকলে দ্বিগুণ সাবধানে থাকবে।”

নানা কথায় দুপুরের ঘটনাটা মাথা থেকে মুছে গেছিল রাজর্ষির। এবার আবার মনে পড়ল তার। সকলের মধ্যেই একটা চাপা অস্বস্তি। এরিকের কথায় একমত হল সকলে। রাতে শুতে যাওয়ার আগে রাজর্ষি দেখল, তাঁবুর বাইরে আগুনের মন্ডলীর মধ্যে বসে এরিক তার রাইফেল হাতে নিয়ে বসে আছে বনের নিবিড় অন্ধকারের দিকে চেয়ে।

।।নয়।।

রাজর্ষি কোনওদিন এতসব জানোয়ার দেখেনি। তাও আবার এমন জঙ্গলের মধ্যে। হাঁটতে হাঁটতে কতরকমের রংচঙে পাখি উড়ে যেতে দেখেছে সে। মটমট বলে একটা পাখি আছে। সারা শরীর সবুজ, লাল রঙের চোখ আর লেজটা প্রায় দু’হাত লম্বা। মুখের দিকটা কালচে নীল। এত সুন্দর দেখতে পাখিটার নাম যে মটমট হল কী করে ভেবে কুল পায়নি সে। কয়েকরকমের সারস আর ফ্লেমিংগো আছে যাদের প্রায় রোজই দেখতে পাওয়া যায়। লাল, সাদা, কমলা, হলুদ কতরকমের যে এদের রঙের বাহার। গাছের ডালে বসে থাকে দলে দলে। আর আছে টিয়া। এখানকার টিয়াগুলোর গায়ের পালকে একরকম হলুদ ছাপ আছে। আরও কত প্রাণী যে দেখল সে এই ক’দিনে। কতরকমের বাঁদর, টাপির, পেসারে, ব্রকেট হরিণ, শূকর দৌড়ে চলে যায় সামনে দিয়ে।

ঘন জঙ্গলে একটানা বেশিদিন কাটালে চোখকান সজাগ হয়ে ওঠে। গাছপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাখি অথবা নদীর তীরে রোদ বসে থাকা কুমিরকে দূর থেকেই দেখে চেনা যায়। আজ যেমন লাগুনিটা যাওয়ার পথে রাজর্ষির চোখে পড়ল একপাল কোআটি। আগে কোনওদিন কোআটি দেখেনি সে। সারা শরীর কালো, নাকটা সাদা। বড়ো বড়ো চোখে ভেবলুর মতো তাকিয়ে রয়েছে। কী সুন্দর এদের দেখতে। বাইনোকুলার চোখে রাখতেই অনেকটা কাছাকাছি এসে গেল তারা। নাকের দিকটা ছুঁচলো ,উঁচোনো একটা লেজ নিয়ে তারা হেঁটে যাচ্ছে গাছের দলের ওপর দিয়ে।

বাইনোকুলার ডানদিকে ঘোরাতেই আচমকা কালচে সবুজ রঙের একটা সাপের অবয়ব দেখতে পেল সে। চোখ থেকে বাইনোকুলার সরিয়ে এরিককে ব্যাপারটা বলতেই সে বলল, “তুমি ঠিক দেখেছ?”

সে মাথা নাড়ল। একটা কিছু সে দেখেছে ঠিকই, কিন্তু সেটা যে ঠিক কী সেটা ঠাহর করা মুশকিল। এরিক সকলকে সঙ্গে করে সেই দিকটায় এগোলো। ঘন গাছপালার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে মাঝে মাঝে চারদিকে দেখে নিচ্ছিল তারা। প্রায় মিনিট পনেরো চলার পর একটা গাছের তলায় কালচে সবুজ রঙের কিছু একটা দেখতে পেয়ে এরিক সকলকে থামতে ইশারা করল হাত তুলে।

সামনে গিয়ে তারা বুঝতে পারল জিনিসটা একটা মস্ত বড়ো সাপের খোলস। খোলসটা প্রায় কুড়ি হাত লম্বা। এমন বিশাল সাপ যে এই জঙ্গলে আছে জানা ছিল না রাজর্ষির। ততক্ষণে খোলসটা তুলে নিয়েছে এরিক। তার চোখ কুঁচকে আছে। হাত দিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে সে বলল, “এই জিনিসটা কী, বুঝতে পারছ?”

এমিলি হাত দিয়ে জায়গাটা অনুভব করে বলল, “এ তো সাপ নয়। এই জায়গায় খোলসটা চওড়া হয়ে দুটো হাতের মতো হয়ে গেছে। সাপেদের কি এরকম থাকে নাকি? কিন্তু অন্য কোনও প্রাণী কি খোলস ছাড়ে?”

হুআন বলল, “অনেকসময় প্যারট স্নেকের গায়ে ওরকম হাতের মতো একটা আকৃতি থাকে। কিন্তু তারা তো এত বড়ো হয় না।”

এমিলি বলল, “তাহলে?”

এরিক সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “খুবই সোজা। এইটা একটা সাপেরই খোলস।”

“কিন্তু তাহলে বুকের কাছে এরকম দু’দিকে হাতের মতো আকৃতি হয় কী করে?” এমিলি জিজ্ঞেস করল।

এরিক অনুচ্চস্বরে বলল, “হয় না, যদি না সে সাপ উড়তে পারে। ওই দুটো হাত নয়, ঐগুলো দুটো ডানা।”

তার কথা শুনে সকলে চমকে তার দিকে তাকাল। এমিলি বলল, “মানে… মানে তুমি বলছ…!”

“কুকুলকান! সেই মায়াদের অপদেবতা।”

এমিলি বলল, “কিন্তু তা কী করে সম্ভব? এরকম কোনও প্রাণী যদি থেকেও থাকে…”

এমিলিকে কথাটা শেষ করতে দিল না এরিক। বলল, “কী সম্ভব, কী সম্ভব নয় আমরা কিছুই জানি না এমিলি। আমরা যেই জঙ্গল পেরিয়ে চলছি, হাজার হাজার বছর ধরে এখানে দু-একজন ছাড়া কোনও মানুষ ঢোকেনি। এমনকি লাগুনিটা শহরের প্রসপেকটিং করতে যারা এসেছিল, তারা এসেছিল কাম্পেচের দিক থেকে। তোমাদের আগে বলিনি, এখানকার মানুষরা বেশ কয়েকবার জানিয়েছে যে তারা একটা বিরাট সাপকে দেখেছে জঙ্গলের ডালপালার মধ্যে দিয়ে উড়ে যেতে বছরের এই সময়ে। কেউই অবশ্য তাদের কথা বিশ্বাস করেনি।”

সবাই এইকথা শুনে চুপ করে গেল। খানিকক্ষণ পরে ম্যাথিউ বলল, “আমরা তো আগেই জানতাম এমিলি, যে এই অভিযানে অনেক কিছুই আমাদের সামনে আসবে যা আমাদের বিশ্বাসকে আঘাত করবে। কিন্তু নিজে চাক্ষুষ না দেখে কোনও সম্ভাবনাই আমরা উড়িয়ে দেব না। যদি ওরকম একটা প্রাণী থেকেই থাকে তাহলেও যে আমাদের ক্ষতি করবে তার কোনও কারণ নেই। এতে বরঞ্চ আমাদের মনের অন্ধকার খানিকটা হলেও দূর হবে। যদি উড়ন্ত একটা সাপ সত্যিই থাকে তাহলে তার শহরও নিশ্চয়ই আছে। সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। চল, এগোনো যাক।”

আবার পথ চলা শুরু হল। রাজর্ষি হাঁটতে হাঁটতে এরিককে প্রশ্ন করল, “তোমার কী মনে হয়, এরিক? কুকুলকানের গল্প সত্যি? ওই বিরাট খোলসটা কি সত্যি সেই উড়ন্ত সাপের?”

এরিক তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “জান রাজ, এইসব অজ্ঞাত, দুর্ভেদ্য অরণ্যে এখনও কত জানোয়ার আছে, যার খবর আমরা জানি না? শুধু এখানেই কেন, সারা পৃথিবীতে এরকম জায়গা কতই না আছে যেখানে মানুষেরা পৌঁছতেই পারেনি। আফ্রিকার কঙ্গো অঞ্চলের কত বিরাট অরণ্য আজও অজ্ঞাত রয়ে গেছে। আমাজানের জঙ্গলের তো প্রায় সত্তর শতাংশ এলাকায় মানুষ পৌঁছতে পারেনি। আর জলের তলার কথা তো আমরা প্রায় কিছুই জানি না। কত নদী বয়ে চলছে আমাদের পায়ের তলা দিয়ে, কত লুকোনো গুহা আর সুড়ঙ্গ আছে, সেই খবর আমরা রাখি না। আসলে আমরা মনে করি আমরা সবই জেনে গেছি। এই বৈজ্ঞানিক যুগেও যে আসলে মানবজাতির চক্ষুর আড়ালে লুকোনো আর অনাবিষ্কৃত কিছু থাকতে পারে, বিশ্বাস করতে আমাদের সম্মানে বাধে।”

তোমাকে এরকম একটা ঘটনা বলছি।২০০৯ সালে ভিয়েতনামের বো ট্রাক এলাকায় ব্রিটিশ কেভ রিসার্চ এসোসিয়েশন সুন ডুঙ নামের এক গুহার সন্ধান পায়।সেই গুহা এতো দুর্ভেদ্য অঞ্চলে যে মানুষ এতদিন সেখানে পৌঁছতে পারেনি।বৈজ্ঞানিকেরা একটা খাদের ফাটলে প্রায় তিন হাজার ফুট দড়ি বেয়ে নীচে নেমে সেই গুহার মুখে পৌঁছয়।গুহাপথটা যে কতটা লম্বা তার কোনো ধারণা করা সম্ভব হয়নি।মোটামুটি আন্দাজ করা গেছিলো প্রথম গুহাটা প্রায় তিন মাইল লম্বা,দুশো পঞ্চাশ মিটার উঁচু আর একশো পঞ্চাশ মিটার চওড়া।তার ভিতরে বয়ে চলেছে একটা ভূগর্ভস্থ নদী।কিছুক্ষণ এগোনোর পরেই একটা বিরাট ক্যালসাইটের দেওয়াল এসে দাঁড়ায় তাই সামনের দিকে এগোনো সম্ভব হয়নি।এর পর এক জায়গায় একজন খুঁজে পায় আরো একটা সুড়ঙ্গ।সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে নদীর একটা শাখা বয়ে চলছে।সেই জলপথ অনুসরণ করে তারা গিয়ে পড়ে গুহার আরেক প্রবেশ পথে।সেটা একটা ট্রপিক্যাল ফরেস্ট।সেটার সন্ধান কেউ জানতো না।বেশিরভাগ গাছ,লতা পাতা অচেনা।যত প্রাণীর খোঁজ পাওয়া গেছে তাদের কাউকে আমরা চিনি না।কিন্তু বর্ষার পর সেই গুহায় অভিযান করা যায় না।জল বেড়ে গিয়ে গুহার বেশিরভাগটাই জলমগ্ন হয়ে পড়ে। তাহলে ভাবো একবার,আজকের দিনেও এরকম কত জায়গা আছে প্রকৃতির বুকে যাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।”কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এরিক আবার বললো,”তোমাকে বলি,আমি এক্সপ্লোরার নই।বৈজ্ঞানিক বা আর্কিওলোজিস্টও নই।কিন্তু এই সব অভিযানে আমি কেন আসি তাহলে?শুধু প্রকৃতিকে আরো কাছে পাওয়ার জন্যে,তাকে বোঝার জন্যে।এই সব পাহাড়,অরণ্য,নদী,সমুদ্রের বুকে যে কত রহস্যময় জিনিস লুকিয়ে আছে।এই বিস্তীর্ণ,আদিম,নিবিড় অরণ্যের কাছে আমরা কত তুচ্ছ!প্রকৃতির এই মায়া কি অপার্থিব!কিন্তু কি ভাবে এই প্রকৃতিকেই ধ্বংস্ব করে চলেছি আমরা।মাইলের পর মাইল বন কেটে চলেছি।প্রতি বছর আরো কমে যাচ্ছে জঙ্গল,গ্লেসিয়ার গলে পড়ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিংএ।কত প্রাণী লুপ্ত হয়ে গেছে,হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু একবার ভেবে দেখো প্রায় একশো বছর আগে মানুষের সংখ্যা ছিল একশো সত্তর কোটি।আজকে একশো বছর পরে মানুষের সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাতশো পঞ্চাশ কোটি।আরো একশো বছর পরে হয়ত দু হাজার কোটি মানুষ থাকবে পৃথিবীতে।তাদের খাদ্য,পানীয়,বাসের জন্যে আমরা একের পর এক জঙ্গল কাটবো,পাহাড় উড়িয়ে দেবো ডিনামাইট দিয়ে,নানা ভাবে ধ্বংস্ব করবো প্রকৃতিকে।তাহলে কি এই সুন্দর জায়গায় আর কোন প্রাণীই বেঁচে থাকবে না মানুষ ছাড়া?শেষ হয়ে যাবে এই সব জঙ্গল,নদী,মায়াঘন এই রহস্যময় প্রান্তর,না জানার শান্তি।একেই কি মানব সভ্যতা বলে?”এরিক চুপ করে গেলো।রাজর্ষি কোনো কথা বলতে পারলো না তাকে।এই কঠিন সত্যের সামনে কোনো যুক্তি দেওয়া যায় না।বিষণ্ণতায় তার মনটাও ভারী হয়ে রইলো।

।।দশ।।

লাগুনিটা শহর খুঁজে পাওয়া যতটা কঠিন মনে হয়েছিল, ততটা কঠিন হল না। তৃতীয়দিন সকালেই ভাঙা শহরের চিহ্ন দেখতে পাওয়া গেল। লাগুনিটা শহরের প্রধান প্রবেশদ্বারে একটা বিরাট সাপের মূর্তি খোদাই করা। তার মুখের ভিতর দিয়ে একটা গুহার প্রবেশপথ। ফটোগ্রাফে মিলিয়ে দেখা গেল এই সেই হারিয়ে যাওয়া শহর। এতদিন পর অবশেষে অভিযানের গন্তব্যে পৌঁছানো গেছে। এখান থেকে এবার কী সূত্র পাওয়া যায় সেটাই আসল। ক্যাম্প করে তারা টিম বানিয়ে প্রসপেস্টিংয়ে নেমে পড়ল। চারটে দল বানানো হয়েছে। রাজর্ষির সঙ্গে চলেছে এমিলি।

জঙ্গল ঘিরে ছড়ানো রয়েছে মায়াদের নানান স্ট্যালে, বেদী আর সমাধি। এরিয়া পিনপয়েন্ট করে কাজে নেমে পড়ল তারা। প্রথমে এক একটা লেখার ছবি তুলতে হবে নানান দিক দিয়ে। সেইগুলো নিয়ে একজন হাতে আঁকবে লেখাগুলো। তারপর ম্যাগনেটোমেট্রি শুরু হবে। তাতে জানা যাবে যে মাটিতে কোনওরকম ধাতু আছে কি না, আর কোনও জিনিস ম্যাগনেটিক ফিল্ডকে প্রভাবিত করছে কি না। এর পর শুরু হবে জি পি আর অথবা গ্রাউন্ড পেনেট্রেটিং রেডার। এতে জানা যাবে মাটির তলায় কী আছে। আরও নানারকমভাবে পরীক্ষা করা হবে। স্ট্যালের হাতে আঁকা ছবিগুলো শেষ হলে ম্যাথিউ আর রাজর্ষি সেই অর্থের সমাধানের কাজে লেগে যাবে। কাজ শুরু হল ভালো করেই। প্রায় ঘন্টা চারেক ধরে নানা স্ট্যালে পরীক্ষা করে রাজর্ষি বুঝতে পারল, এই লেখাগুলো অনেকটা অন্য ধাঁচের। অনেকটা যেন ছন্দ মিলিয়ে লেখা। প্রায় প্রতিটা কথায় সূর্য, চন্দ্র আর সমুদ্রের কথা লেখা আছে। এই লেখাগুলো কোনও রাজার শাসনের গল্প নয়, সেই সম্পর্কে সে নিশ্চিত।

লাঞ্চের সময় সকলে একসঙ্গে খেতে বসল। কোচিনিতা বলে একরকম খাবার। মাংস, পেঁয়াজ, আর কমলালেবু দিয়ে বেক করা এই জিনিসটা মাইকেল চটপট বানিয়ে ফেলে। একটা শুয়োর মারা হয়েছিল। তার মাংস শুকিয়ে রাখা হয়েছে। বেশিরভাগ টিনের খাবার ফুরিয়েছে বলে এখন এই খাবারই চলছে। মশলা মাখিয়ে খেতে ভালোই লাগে। খেতে খেতে ম্যাথিউ বলল, “কিছু পেলে?”

রাজর্ষি আর এমিলি তাদের কাজের কথা বলল। উত্তরে ম্যাথিউ বলল, “ঠিক বলেছ। আমারও তাই মনে হচ্ছে। এই লেখাগুলো অন্যরকম। দুপুরের পর আমরা এক সঙ্গে মন্দিরটার ভিতরে ঢুকব, দেখি সেখানে কী আছে।”

এরিক আর হুআনরাও নানারকম স্ট্যালে আর মন্দির দেখতে পেয়েছে। মাটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, দক্ষিণদিকের মন্দিরের নিচে জলের স্রোত আছে। কাজ বেশ ভালোভাবে এগোচ্ছে। এবার দেখা যাক, কী রহস্যের খোঁজ পাওয়া যায় প্রধান মন্দিরটার ভিতর।

মন্দিরের বেদীর কাছে যখন সুড়ঙ্গপথটা পাওয়া গেল তখন প্রায় বিকেল চারটে বাজে। দুটোর সময় থেকে মন্দিরটার ভিতরে কাজ শুরু হয়েছিল। বহুদিনের পুরনো হয়ে গেলেও দেওয়ালের লেখাগুলো পড়তে পারা যায়। ম্যাথিউ একেকটা করে লেখা পড়ছে আর উত্তেজনায় শিস দিয়ে উঠছে। প্রায় সবটাই লেখা হয়েছে কুকুলকানের সম্পর্কে। কোন তিথিতে কুকুলকানের কাছে কোন মানুষকে উৎসর্গ করা হয়েছিল, লেখা আছে তার কথা। বোঝাই যায় যে এদের আসলে বলি দেওয়া হয়েছিল। এক জায়গায় লেখা আছে যে প্রতি তিরিশদিন অন্তর একটা করে বলি দিলে কুকুলকান খুশি হয়ে মায়াদের মন্দিরে জাদুপাথর রেখে যান। এই জাদুপাথর সম্পর্কে আরও নানা কথা লেখা আছে স্ট্যালেগুলোতে। এইসব লেখা যে আগে কেউ পড়েনি সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই।

মন্দিরটা ভিতর থেকে চৌকো। মাথার দিকটা ভেঙে পড়লেও বোঝা যায় সেটা এককালে পিরামিডের আকারের ছিল। প্রত্যেক দিকের দেওয়ালে দুটো করে বর্গাকার খুপরি আছে প্রায় একটা ছোটো ঘরের মতো। সেইগুলোর ভিতরে ঘুপ অন্ধকার। আলো জ্বালিয়ে দেখা গেছে যে সেখানে দেওয়াল ভর্তি হায়েরোগ্লিফ লেখায়। এই লেখাগুলোর রংগুলো এখনও আবছা হয়ে আসেনি। সম্ভবত রোদ-বৃষ্টি থেকে বেঁচে গেছে বলেই এই লেখাগুলো সজীব আছে। ছাদের চারদিকে চারটে আয়তাকার চিমনি থেকে রোদ এসে পড়ছে মন্দিরের মাঝখানটায়। ছাদের মাথায় গজিয়েছে বুনো লতাপাতা ও গাছের জঙ্গল। যেখানে বেদী থাকার কথা সেখানে বেদীর জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকশো বছর পুরনো একটা গাছ। গাছের কান্ডটার সঙ্গে সঙ্গে ওপরের ডালপালা থেকে ঝুলে আসা মোটা মোটা শিকড়গুলো ঢুকে গেছে মাটিতে। সেই শিকড়ের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেলে বোঝা যায় এইখানেই এককালে বেদী ছিল। মসৃণ কয়েকটা ভাঙা পাথর আর স্ট্যালে ছড়ানো আছে গাছটার আনাচে-কানাচে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক ধরে বাকি জায়গাটা পরীক্ষা করে অনেক স্ট্যালে আর দেওয়ালের আঁকাগুলোর ছবি তোলা হয়েছে।

এমিলি গাছের দিকটায় ছিল। হঠাৎ গাছের একটা শিকড়ের ওপর পা দিতেই জায়গাটা থরথর করে কেঁপে উঠল। চমকে এমিলি সরে এল পিছনদিকে। ততক্ষণে প্রায় দশ ফুট ব্যসের একটা গুপ্তপথ খুলে গেছে গাছের শিকড়গুলোর ফাঁকে। বোঝাই যায়, বেদীর ভিতর থেকে নীচে নেমে যাওয়ার একটা গুপ্ত-রাস্তা ছিল। কয়েকটা পাথরের স্ল্যাবের ওপরে চাপ দিলে সেটা খুলত। সকলে একে অপরের দিকে তাকাল। এই কি তবে দেবতাদের মন্দিরে যাওয়ার পথ? কাছে গিয়ে দেখা গেল, ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। কিন্তু জায়গাটা গুমোট বা ততটা অন্ধকার নয়। বোধহয় আলো বাতাস আসছে কোনও জায়গা দিয়ে।

মাথার হেলমেটে টর্চ লাগিয়ে রাজর্ষি, এমিলি আর ম্যাথিউ সেই গুপ্তপথে প্রবেশ করল। কথা থাকল, কোনও বিপদ হলে এরিককে ওয়াকিটকিতে খবর দেওয়া হবে। রাজর্ষি নিচে নামতে নামতে অনুভব করল জায়গাটা বেশ ঠান্ডা। দেওয়ালের গায়ে কোনও কোনও জায়গায় গাছের শিকড় মাটির নিচে নেমে এসে ঝুলছে। প্রায় পঞ্চাশ ধাপ নামার পর সিঁড়িটা বেঁকে গেছে ডানদিকে। এ যেন পাতালের গভীরে নামছে তারা। ক্রমে আলো কমে এল। রোদ আর নিচে পৌঁছচ্ছে না। প্রায় দশতলা নেমে তারা একটা সমতল জায়গায় পৌঁছল। জায়গাটা এত বিশাল যে চারদিকে আলো ফেলেও বোঝা যাচ্ছে না। জলের শব্দ শুনে তারা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল একদিকে। খানিকটা যেতেই তাদের টর্চের আলোয় ঝলমল করে উঠল বিরাট এক হ্রদ বা সেনোটে। জলের নিচে অনেকটা স্বচ্ছ। সেখানে আলো ফেলে মনে হল, লেকটা ক্যালসাইট স্টোন কিংবা ওইধরনের পাথর দিয়ে তৈরি। সেনোটেটার পাশ দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল তারা। পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে। খানিকক্ষণ পরে তারা বুঝতে পারল, এই পথে আর এগোনো সম্ভব নয়। ম্যাথিউ বলল, “কী বুঝছ?”

এমিলি জলের দিকে তাকিয়ে বলল, “মনে হচ্ছে আমাদের ভাবনাটাই ঠিক। এই সেনোটে আসলে একটা মাটির নিচের নদীর নেটওয়ার্কের একপ্রান্ত। এই গুহা, সেই গুহা দিয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে বয়ে চলছে ভূগর্ভস্থ নদীরা। আর মন্দিরগুলোর নিচে যাচ্ছে এরকম গভীর কয়েকটা লেক। যেমন তুমি দেখতে পেয়েছিলে এল কাস্টিলোতে। আমি আর রাজর্ষি এরকমই ভেবেছিলাম।”

রাজর্ষি ম্যাথিউর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার মনে হয়, এই সুড়ঙ্গের ভিতরে অভিযান চালাতে গেলে প্রথমেই আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই স্রোতগুলো যাচ্ছে উত্তর-পূর্বে। কয়েকটা জায়গায় ইলেক্ট্রিক রেজিস্টেন্স সার্ভে করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। যদি সত্যি তাই হয়, তাহলে এই সেনোটে আর নদীগুলো চলেছে হলটুনের দিকে, এল কাস্টিলোর কাছে। যেখানে আমাদেরও শেষ গন্তব্য। সেক্ষেত্রে কয়েকজনকে মাটির ওপর দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আর কয়েকজনকে যেতে হবে নিচে দিয়ে।”

রাজর্ষি চুপ করল। ম্যাথিউ একটু ভেবে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে। আজকে আমরা ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি। কাল ঠিক করা হবে। ততক্ষণ বরং মন্দিরের বেদীর স্ট্যালেগুলোর অর্থগুলো ঠিক করে নেওয়া যাক।”

তার কথায় সে দিয়ে তারা ফিরে চলল ওপর দিকে।

।।এগারো।।

এই দুটি প্রধান সূত্র পাওয়া গেছে আজ মন্দিরের ভিতর থেকে। রাজর্ষি আর ম্যাথিউ মিলে এর অর্থ করেছে সেটা এইরকম-

‘যেখানে সূর্য আর চন্দ্র মিশে যায়, কুকুলকানের শহরের রাস্তা সেখানেই।’

দ্বিতীয়টা আরও অদ্ভুত। সেটাতে লেখা আছে- ‘যখন সূর্য থাকে শীর্ষে, সময় জীবন্ত হয়ে ওঠে। যখন সূর্য চলে যায়, কুকুলকান আবার ঘুমিয়ে পড়ে।’

দুটো সূত্রেরই মাথামুন্ডু বুঝতে পারেনি তারা।

আজকে বিশদ আলোচনা করে ঠিক হয়েছে, সুড়ঙ্গের পথ ধরে এগোবে এমিলি, রাজর্ষি আর মাইকেল। বাকিরা সকলে ওপর দিয়ে এগিয়ে যাবে হলটুনের দিকে। ওয়াকিটকিতে যোগাযোগ রাখা হবে তারা কোনদিকে যাচ্ছে। কম্পাসের সাহায্য নিয়ে এগোবে দুই দলই। যদি তিনদিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনও আবিষ্কার না হয়, তাহলে এমিলিরা উঠে আসবে। মাটির নিচে দিয়ে এগোনো প্রচন্ড ঝুঁকির কাজ, যখন এইসব সুড়ঙ্গে আগে কেউ এক্সকাভেশন করেনি। কিন্তু এছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।

সকাল হতেই রাজর্ষিরা তৈরি হয়ে গেল। ডাইভ দেওয়ার নানা সরঞ্জামের সঙ্গে তাদের দেওয়া আছে বেশ কয়েকটা ডিনামাইট স্টিক। যদি কোথাও দরকার পড়ে। আছে খাবারদাবার, ছোট্ট ছোট্ট তাঁবু-কাম-হ্যামক, আর কিছু দরকারি জিনিসপত্র। একটা রাইফেলও আছে। রওনা দেওয়ার আগে এরিক ও ম্যাথিউ বার বার করে তাদের বলে দিল, কোনও অসুবিধে হলেই খবর পাঠাতে। একান্তই যদি ওয়াকিটকি কাজ না করে তারা যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাইরে আসার রাস্তা খুঁজে বেরিয়ে আসে।

ম্যাথিউ বলল, “তোমাদের ওপরই এখন এই অভিযানের সাফল্য নির্ভর করছে। কোনও ঝুঁকি নেবে না। অল দি বেস্ট।”

এরিক কিছুই বলল না। শুধু মৃদু হেসে তাদের পিঠ চাপড়ে দিল।

তারা নামতে লাগল সেই সুড়ঙ্গের পথ দিয়ে নিচে। প্রায় ঘন্টা তিনেক চলার পর রাজর্ষিরা দেখতে পেল, একটা জায়গায় সেনোটেটা প্রায় গোল একটা পুকুরের মতো হয়ে গেছে। সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে ওপর থেকে। সেই আলোয় ঝিকমিক করছে নীলচে সবুজ রঙের লেকটা। রাজর্ষি বলল, “এখানেই শুরু করা যাক।”

তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুবা স্যুট পরে তৈরি হয়ে নিল। তাদের পিঠে রিব্রেথার সিলিন্ডার সেট বেঁধে তারা জলে নেমে গেল।

তাদের সিলিন্ডারে হিলিয়াম বেসড দ্রাবক আছে যাতে তারা বেশিক্ষণ ধরে গভীরে ডুব দিতে পারে। জল ততটা ঠান্ডা নয়। তারা নীচের দিকে নেমে চলল ডাইভ দিয়ে। প্রায় চল্লিশ ফুট নিচে গিয়ে রাজর্ষি একটা অন্য সুড়ঙ্গ দেখতে পেল হেডলাইটের আলোয়। সে হাত তুলে ইশারা করল এমিলিকে সুড়ঙ্গটা দেখতে। প্রায় গোল হয়ে যাওয়া একটা টানেল, কিন্তু বেশ বড়ো। চারপাশে আর তেমন কিছু দেখতে পাওয়া গেল না। তারা রেগুলেটর দেখে নিয়ে সেই টানেলে প্রবেশ করল। ফ্লিপার দিয়ে জল সরাতে সরাতে এগিয়ে চলছে তারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই টানেলটা চওড়া হয়ে গেল। রাজর্ষি বুঝতে পারল, তারা একটা অন্য গুহায় এসে পড়েছে। ওপর থেকে রোদ এসে পড়েছে জলে। জলের ওপরে উঠে গিয়ে হেলমেটটা খুলতেই সে বিস্মিত হয়ে গেল। জায়গাটা একটা মন্দির বলেই মনে হয়, কিন্তু কোনও দেওয়াল নেই তাতে। ওপরের গুহার ফাটল দিয়ে নেমে এসেছে গাছেদের পাতা আর শিকড়। স্ট্যালাকটাইটের মোটা ঝুড়ি ছাদ থেকে ঝুলে আছে ঝাড়লণ্ঠনের মতো। প্রায় একশো ফুট ওপরে দেখা যাচ্ছে তাদের। সারা গুহাতে ভর্তি করে রাখা অসংখ্য মূর্তি, স্ট্যালে আর নানা জিনিস। এমিলিও উঠে এসেছিল। তারা জল থেকে বেরিয়ে জিনিসগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর তাদের মনে হল, এই জায়গাটা আসলে একটা গুপ্ত চেম্বার। অনেক গুটিয়ে রাখা পাণ্ডুলিপি, খোদাই করা মূর্তি আর বই রাখা আছে সেখানে। প্রতিটা বই আসলে গুটোনো একটা স্ক্রল, যাতে লেখা আছে মায়ারা কী করে সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ ইত্যাদি হিসেব করত। এই লেখা যে একটা বড়ো আবিষ্কার, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এরপর দেখতে হবে পরের জায়গাগুলোতে কী পাওয়া যায়।

।।বারো।।

প্রথমদিন কেটে গেল। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট ভূমিগত সুড়ঙ্গে ছেয়ে গেল সূচীভেদ্য অন্ধকার। কিছু করার নেই। ছোটো ছোটো তাঁবু আছে তাদের কাছে। স্পিরিটল্যাম্প সাবধানে জ্বালিয়ে খানিকটা চা তৈরি করা হল। সঙ্গে খানিকটা শুকনো খাবার। এই গুহার মধ্যে অনেক সময় গ্যাসের আস্তরণ থাকে। তাই খুব বুঝেশুনে আগুন জ্বালাতে হয়।

সুড়ঙ্গটা মাঝে মাঝে নানাদিক থেকে আসা ছোটো ছোটো ভূমিগত নদীর সঙ্গে মিশেছে। এই প্রতিটা সুড়ঙ্গ আর গুহার জালের রহস্য খুলতে মানুষের এক শতাব্দির বেশি সময় লেগে যাবে। কয়েক জায়গায় রাস্তা প্রায় নেই। জলে নেমে এগোতে হয়েছে তাদের। কোথাও হাঁটু জল, কোথাও বুক জল, কোথাও আবার সাঁতার না দিয়ে উপায় থাকে না। ভাগ্যক্রমে পা রাখার মাটি পেতে বেশিক্ষণ দেরি হয়নি। এই অন্ধকারের মধ্যেও কোনও কোনও স্ট্যাল্যাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইট চকমক করে ওঠে। তখন সেনোটের জলের মধ্যে একটা হালকা সবুজ আভা দেখা যায়। ওয়াকিটকিতে এরিকদের সঙ্গে যোগাযোগে করে জানা গেছে, তারা ঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে। পথে কোনও বিপদ ঘটেনি। সব ঠিক থাকলে দিন চারেক বাদে হল্টুনের কাছে দেখা হবে।

রাজর্ষি শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবছিল। এই রহস্যময়ী ভূমিগত সুড়ঙ্গ আর নদীতে এগিয়ে যেতে যেতে একটা কথা সে বার বার অনুভব করেছে, তারা কত কম জানে এই প্রকৃতিকে। এরিক সেদিনকে যা বলেছিল তার একবর্ণ মিথ্যে নয়। সুড়ঙ্গের কোনও কোনও জায়গায় পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে নানা আকৃতি। কোনটা মায়ারা তৈরি করেছে আর কোনটা প্রকৃতির খেয়াল, বুঝে ওঠা কঠিন। প্রথম ডাইভের পর উঠে আসার সময় মাটির হাত তিনেক নিচেই এমিলি একটা ফাঁপা জায়গা খুঁজে পেল। সেখান থেকে বেরোলো নানা জিনিস। কয়েকটা হরিণের হাড়, বলি দেওয়ার দু’মুখো ছুরি, একটা কুকুরের মাথার খুলি আর কয়েকটা পাথর। পাথরগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে তারা চমকে উঠল। সেগুলো আসলে মানুষের খুলি। এতকালের ব্যবধানে ফসিলে পরিণত হয়েছে। হয়তো এই পাতাল নগরীতে বলি দেওয়া হত মানুষদের। কয়েক জায়গায় সূর্যের আলো এমনভাবে পড়েছে সুড়ঙ্গে যে জলে রামধনু দেখতে পেয়েছে তারা। এত বিপজ্জনক অভিযানের মধ্যেও এমন সুন্দর দৃশ্য দেখে পা থমকে গেছে তাদের। কী অসামান্যভাবে প্রকৃতি তার মায়া ছড়িয়ে রেখেছে সারা পৃথিবীতে। প্রথম রাতে রাজর্ষির কিছুতেই ঘুম এল না। সে চোখ বুজে নানা কথা ভাবতে লাগল। তারপর একসময় সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

গভীর রাতে মাইকেল তার বুকে ঠ্যালা মেরে বলল, “রাজ, ওঠো।”

সে ধড়মড় করে উঠে বসল। এমিলি আগেই উঠে গেছে। গুহাটার মধ্যে কেমন যেন একটা শব্দ হচ্ছে। ঠিক যেমন কয়েকদিন আগে তারা ফোকলা গাছের ভিতরের সুড়ঙ্গে শুনতে পেয়েছিল। চাপা হিস হিস শব্দ। তার সঙ্গে কে যেন জলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছে এঁকেবেঁকে। মাইকেল ছেলেটার নার্ভের জোর আছে। সে টর্চের আলো নিভিয়ে নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে নিচু হয়ে রাইফেলটা হাতে তুলে বসে আছে সোজা হয়ে। ক্রমে শব্দটা আরও কাছে আসতে লাগল। জলের মধ্যে কী যেন একটা নড়ছে। তার সঙ্গে কেমন যেন একটা কমলা সবুজ আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে জলের ধারার ভিতরে। আরও কাছে এসে গেছে শব্দটা। এমিলি তার হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে। এমন সময় তাদের সামনে জল তোলপাড় করে একটা প্রকাণ্ডকায় সাপ এঁকেবেঁকে চলে গেল সামনে দিয়ে। মাথার কাছটা ড্রাগনের মতো কাঁটা কাঁটা, গায়ের রঙ সবুজ কালচে, আর তার গায়ের চামড়া থেকে একটা অদ্ভুত কমলা আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তারা স্পষ্ট দেখল, সাপটার শরীরের মাঝখানে দুটো কমলা রঙের ডানা।

রাজর্ষি অনুভব করল, তার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এমিলি তার মুখে হাতচাপা দিয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে সামনের দিকে। সাপটা চলে যাওয়ার প্রায় দশ মিনিট বাদেও তারা একভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর প্রথম কথা বলল মাইকেল, “চলে গেছে।”

এমিলি মাথায় হাত দিয়ে বলল, “ওহ মাই গড! আমরা কী দেখলাম? এ সত্যি, না স্বপ্ন?”

রাজর্ষি কোনওরকমে বলল, “তিনজনে একসঙ্গে স্বপ্ন দেখতে পারে না। কিন্তু এবার আমাদের কী করা উচিত?”

মাইকেল বলল, “যদি সত্যি এই সাপ কুকুলকান হয়, তাহলে আমাদের কিছুই করার নেই। আমার মনে হয় সে আমাদের অস্তিত্ব বুঝতে পারেনি। সকাল হলে আমরা এগিয়ে যেতে পারি এই রাস্তাতেই।”

এমিলি তখনও স্বাভাবিক হয়নি। সে বলল, “কিন্তু ওটা যদি আমাদের আক্রমণ করে?”

রাজর্ষি ধীরে ধীরে বলল, “আমার মনে হয় সকালবেলায় ও এই গুহায় থাকে না। না হলে আমরা অন্তত কিছুটা আভাস পেতাম। আমার মনে হয়, চোখ কান খোলা রেখে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”

সেই রাতে আর কেউ ঘুমাল না। সকলে কোনওরকমে বসে রাতটা কাটিয়ে দিল।

একসময় ভোর হল। খুব, খুব সাবধানে তারা আবার এগোতে লাগল সামনের দিকে।

আড়াই দিন কেটে গেছে সুড়ঙ্গের মধ্যে। প্রথমদিকে সুড়ঙ্গটা সমতলভাবে এগোচ্ছিল। কিন্তু একসময় সেটা আরও গভীরে নামতে লাগল। স্বাভাবিক আলো কমে আসছে। সঙ্গের নদীটা দু-তিন ভাগ হয়ে স্রোতে বেয়ে চলল নিচের দিকে। দ্বিতীয়দিন বিকেলের পর কোনও সেনোটে দেখতে পায়নি তারা। প্রথম রাত্তিরের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার পর জলে আবার ডাইভ করে দেখার সাহস ও ইচ্ছে কারওরই ছিল না। তার ওপর তাদের কাজ হল সুড়ঙ্গের সঙ্গে এগিয়ে চলা, আর কোনও সূত্র পেলে ম্যাথিউদের সঙ্গে যোগাযোগ করা।

প্রায় ছয় ঘন্টা উৎরাই নেমে তারা সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা চৌকো মতন জায়গায় পৌঁছল। এরপর গুহাটা নানা পথে ভাগ হয়ে গেছে। কয়েকটা পথ উঠেছে ওপরের দিকে, আবার কয়েকটা অতল পাতালে নেমে গেছে মনে হয়। প্রতিটা গুহাতেই পায়ের তলা দিয়ে বয়ে চলেছে তিরতির করে জল। কোথাও গভীর আবার কোথাও গোড়ালি অব্দি। মাইকেল বলল, “সেনোটেগুলোর প্রধান উৎস যে নদীটা, সেইটার মূল ধারা বলে আর কিছুই নেই। এখন কোন পথে গেলে আমরা ঠিক হলটুনের কাছাকাছি পৌঁছব তা বলা অসম্ভব।”

রাজর্ষি মাথা নেড়ে চিন্তিত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাল। মাটির নীচের গুহাপথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার আর কোনও পথ নেই ওই সরু সুড়ঙ্গগুলি ছাড়া। এখন কোন সুড়ঙ্গটা যে ঠিক দিকে যাচ্ছে সেটা বোঝার কোনও পথ নেই। তারপর যদি কোনও কারণে সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ার পড় জল বাড়ে তাহলে এই পাতালেই তাদের সলিল-সমাধি হবে। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায় সে বলল, “মাইকেল, আমরা শেষ সেনোটেটা কখন পেরিয়েছি?”

মাইকেল ভেবে নিয়ে বলল, “ঘন্টা দুয়েক হবে। তারপর থেকেই রাস্তাটা নিচে নামা শুরু হয়েছিল।”

এমিলি একটা চার্ট-পেপারে ব্যাটারির আলোতে তাদের হাঁটার পথের ম্যাপ বানাচ্ছিল। সে বলল, “প্রথমদিনের পর আমরা প্রায় পাঁচটা সেনোটে দেখতে পেয়েছি। সব সেনোটেগুলোই ম্যাপ-মার্কিং করা আছে। আগের সেনোটেটা এখান থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে। সেটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড়ো সেনোটে। আমরা সেখানে ডাইভ না করলেও জল দেখে মনে হয় ভালোই গভীর।”

রাজর্ষি বলল, “আমার মনে হচ্ছে, সামনের দিকে যাওয়া পথগুলো একটাও ঠিক পথ নয়। এইগুলো প্রাকৃতিক কারণেই তৈরি হয়েছে। আর একবার ভেবে দেখ, আমাদের সামনে দিয়ে যে বিরাট সাপটা এগিয়ে গেল সে কি এই সরু রাস্তায় আসবে? এখানে নদীর আসল স্রোতটাই তো অদৃশ্য হয়ে গেছে।”

এমিলি বলল, “তুমি কী বলতে চাইছ?”

রাজর্ষি একটু ভেবে বলল, “আমার মনে হয়, আগের সেই সেনোটের ভিতর থেকেই অন্য কোনও রাস্তা আছে এগিয়ে যাওয়ার। মনে আছে এমিলি, প্রথম সেনোটেটাতে ডুব দিয়ে আমরা এক অচেনা ঘরের মধ্যে গিয়ে পৌঁছেছিলাম? সেইরকমই আগের সেনোটের ভিতর থেকেও জলের মধ্যে দিয়ে অন্য কোনও রাস্তা আছে। তোমরাই ভাব, সেই বিশাল সাপ নদী ছেড়ে এইটুকু-টুকু সুড়ঙ্গগুলোতে লুকিয়ে থাকবে কী করে?”

রাজর্ষির কথাটা সকলেরই মনঃপুত হল। অতএব আবার পিছনদিকে চলা। অবশেষে সেনোটের কাছে পৌঁছনো হল।

তিনজনকেই এইবার এক সঙ্গে ডাইভ করতে হবে। যতটা সম্ভব কম জিনিস নেওয়া হয়েছে সঙ্গে। যদি রাস্তা না খুঁজে পাওয়া যায়, পিছন ফেরা ছাড়া কোনও পথ খোলা থাকবে না তাদের সামনে। এমিলি এদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ডাইভার। সে বলল, “সাবধান। রেগুলেটরের সঙ্গে যে আমাদের সিলিন্ডারে রিব্রেথার লাগানো আছে সেটা বুঝেশুনে ব্যবহার করবে। কতক্ষণ জলের তলায় থাকতে হবে ঠিক নেই। অক্সিজেন শেষ হলেই সর্বনাশ। যদি আমাদের কোনও সুড়ঙ্গ দিয়ে নিচের দিকে সাঁতার কাটতে হয় হেড ডাউন ট্রিম পজিশনে থাকবে। ফ্লিপার যত কম নাড়াবে ততই ভালো। গুড লাক।”

তারা যখন ডাইভিং স্যুট পড়ে জলে নামল, তখন দুপুর একটা।

রাজর্ষি যখন দ্বারকাতে ডাইভ করত, সেখানে ভিসিবিলিটি এত কম ছিল যে প্রায় দশ হাত দূরেও কিছু দেখা যেত না। কিন্তু এখানে জল একেবারে স্বচ্ছ। কোনওরকম মাছ জাতীয় প্রাণী যদিও তারা দেখতে পায়নি এই জলে। ওপর থেকে আসা আলোয় জলের ভিতরে মোটামুটি দেখা গেলেও তাদের তিনজনের মাথাতেই বাঁধা আছে টর্চ। সে জলের আলোয় তারা হেড ডাউন পজিশনে নিচের দিকে নামতে লাগল। পৃথিবীর সব কোলাহল মুছে গেছে এখানে। কোনও শব্দ নেই কোনওদিকে। শুধু এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছে চারদিকে। সেনোটেটি নিচের দিকে প্রায় আশি ফুট গভীর। একবার রাজর্ষির মনে হল, এই সেনোটের মধ্যেই যদি সেই বিশাল সাপটা থাকে, তাহলে আর দেখতে হবে না। কিন্তু দু’দিন ধরে সেটাকে আর দেখতে পাওয়া যায়নি। এমিলি এগোচ্ছে সামনের দিকে। তার পিছনে আছে রাজর্ষি, তার পিছনে মাইকেল। একেবারে তলায় পৌঁছতে তাদের মিনিট কুড়ি লাগল। সেখানে আলো অত্যন্ত কম, কিন্তু কয়েকটা পাথর এমন চকমকে যে মাঝে মাঝে নানা রং ঝিলিক দিয়ে যায় সেখানে টর্চের আলো পড়লেই। এর মধ্যে তারা কোনও গুপ্তপথ দেখতে পায়নি। এমিলি হাত ঘুরিয়ে ডানদিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ করল। তিনজনকে তিনটে উচ্চতায় সেনোটের দেওয়ালে পরিধিতে চারদিকে ঘুরতে হবে। তারা সেইমতো এগিয়ে চলল সাঁতার কেটে। মুখে ঢোকানো ভালভে বাঁহাতে ধরে রেগুলেটর দিয়ে চাপ দিলে সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন আসবে। ডিপ ওয়াটার ডাইভিংয়ে কয়েকবার জলের চাপ এত বেশি থাকে যে প্রেসার ভালভ আর নাইট্রোক্সের সাহায্য নিয়ে সবসময় ঠিক প্রেশার বজায় রাখতে হয়। তাদের সিলিন্ডার যদিও ডিপ ওয়াটার ডাইভের কথা ভেবেই নেওয়া হয়েছে। রাজর্ষি আর মাইকেলের জলে বেশি নিচে নামার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। একশো ফিটের বেশি হলে তাদের প্রচন্ড অসুবিধেয় পড়তে হবে। প্রায় দু’ঘন্টা ধরে তারা পাক দিয়েছে সেনোটের পরিধির চারপাশে, কিন্তু কিছুই দেখতে পায়নি। তবে কি রাজর্ষির অনুমান ভুল হল? এমন সময় কিছুটা ডানদিকে দেওয়ালের গা ঘেঁষে সে জলের বুদবুদ উঠতে দেখল। সামনে গিয়ে সে দেখতে পেল, একটা চৌকো স্ল্যাবের চারপাশে জলের বুদবুদ ফুটছে।

এমিলিকে হাত তুলে ইশারা করতেই সে হেলিকপ্টার টার্ন করে সাবলীল ভঙ্গিতে এগিয়ে এল মুহূর্তের মধ্যে। রাজর্ষি তাকে জায়গাটা দেখাতেই সে তাকে পিছনে সরে যেতে বলে কোমরে লাগানো হ্যামার বের করে সেখানে বাড়ি মারতে লাগল। কয়েকবার মারতেই পাথরের স্ল্যাবের একপাশটা আলগা হয়ে গেল। মাইকেল আর এমিলি মিলে সেটা সরিয়ে ফেলতেই গুপ্ত-সুড়ঙ্গের পিছনের জলের স্রোত এসে তাদের ওপর ধাক্কা মারল। কোনওরকমে সামলে তারা দেখতে পেল যে চৌকো একখানা সুড়ঙ্গ জলস্তম্ভের মতন উঠে গেছে উপরদিকে। একবার নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তারা ফ্লিপারের সাহায্যে উঠতে লাগল সেই গর্তের ভিতর দিয়ে। কুড়ি মিনিট পর জলের সুড়ঙ্গটা চওড়া হতে শুরু করল। ওপর থেকে আসা সূর্যের আলো দেখতে পাওয়া গেল।

এমিলি, মাইকেল আর রাজর্ষি যখন জলের ওপর মুখ তুলল, তখন তারা একটা বিশাল খাদের ভিতরে একটা সেনোটের মধ্যে এসে পৌঁছেছে। প্রায় মিনিট দশেক পর জিনিসপত্র গুছিয়ে এমিলি বলল, “এই জায়গাটা মনে হচ্ছে হলটুনের কাছাকাছি। ওপরে দেখতে পাচ্ছি গাছপালার জঙ্গলের ভিতর এই খাদের মধ্যে সেনোটেটা লুকিয়ে আছে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এসে এখানে পৌঁছনো যায়। আমরা মাটির ওপর উঠে এসেছি বটে কিন্তু তাও প্রায় হাজার ফুট নিচে। তাও ভালো যে সূর্যের আলো দেখতে পারছি।”

মাইকেল বলল, “এই সেনোটেটা তো বিশাল। গুহাটা যে কত বিশাল তার খেই পাওয়াও সম্ভব নয়। এবার আমরা কি করব?”

এমিলি ঘুরে দেখল রাজর্ষি গুহার মাঝখানে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে কী যেন দেখছে। সে মাইকেলকে ঠেলা মারল। এবার তারা দেখতে পেল যে গুহার চারপাশের পাথরের মূর্তি আর খোদাই করা অক্ষরে বোঝাই। সেনোটের ঠিক ডান কোণে যেখানে তেরছাভাবে সূর্যের আলো গিয়ে পড়ছে, সেখানে তৈরি করা আছে একটা পিরামিড। বেশি বড়ো নয়, প্রায় পনেরো ফুট। সেখানে দাঁড়িয়ে রাজর্ষি গভীর মনোযোগে কী যেন দেখছে। সেখানে গিয়ে তারা উপস্থিত হতেই রাজর্ষি বলল, “এই দেখ। এইখানে ঠিক সেই সূত্র লেখা আছে যা আমরা খুঁজে পেয়েছি লাগুনিটায়। কুকুলকানের শহরের সূত্র।”

তারা সবাই দেখল পিরামিডের চারপাশের পাথরে লেখা আছে সেই এক সূত্র। মাইকেল বলল, “আমার মনে হয়, বাকি সকলকে খবর দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা কোথায় আছি সেটা তারা বুঝবে কী করে? ওদের জিপিএস রিসিভারটা খারাপ হয়ে গেছে।”

রাজর্ষি বলল, “আজকে আমরা এখানেই অপেক্ষা করব। আমাদের জিপিএস এখনও ঠিক আছে। তুমি আমাদের কোঅর্ডিনেট পাঠিয়ে দাও ওয়াকিটকিতে। জিপিএস ছাড়াও সূর্য আর নক্ষত্রদের সাহায্যে যেকোনও কোঅর্ডিনেটে পৌঁছনো যায়। ম্যাথিউ আর এরিক তা নিশ্চয়ই জানে।”

এরিকদের খবর পাঠিয়ে সবাই চুপ করে বসল। সারাদিনে ধকল কম যায়নি। বহু উঁচু থেকে আসা সূর্যের আলো কমলা হয়ে তেরছাভাবে পড়েছে গুহার ভিতর। এমিলি একটু কফি চাপাল। এমন সময় হঠাৎ রাজর্ষি চিৎকার করে উঠে বলল, “এমিলি, মাইকেল, ওই দেখ।”

এমিলি চকিতে ঘুরে তাকাল অপরদিকে। বহু ওপরে আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে কোনার দিকে কালো আকাশে। সেখান থেকে একফালি জ্যোৎস্না এসে পড়েছে গুহাতে। সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? ওরকম করে চ্যাঁচালে কেন?”

রাজর্ষি তখন দৌড়ে গেছে সামনের দিকে। সে লাফিয়ে বলল, “দেখতে পাচ্ছ না? এখনও সূর্যের আলো ওই পশ্চিমদিক থেকে পড়ছে এই বেদীর ওপর। আর চাঁদও দেখতে পাচ্ছি ওই কোনার দিকে। চাঁদের আলোও পড়েছে সেই একই জায়গায়। যেখানে সূর্য আর চন্দ্র মিশে যায়, কুকুলকানের শহরের রাস্তা সেখানেই। এখানেই, এই পিরামিডের তলা দিয়েই কুকুলকানের শহরে যাওয়ার রাস্তা।”

।।তেরো।।

দু’দিন অপেক্ষা করার পর ম্যাথিউরা এসে পৌঁছল সেই খাদের কাছে। সেইদিন উনিশে মে। এই দু’দিন রাজর্ষিরা কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়ে অপেক্ষা করেছে তাদের জন্যে। দড়ি টাঙিয়ে সেই খাদে নেমে ম্যাথিউ তাদের সকলকে এক এক করে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, “বন্ধুরা, তোমরা যেভাবে সকলে মিলে এক সঙ্গে এই অভিযানকে সফল করে তুলতে চেষ্টা করেছ, সেটা নিয়ে আমি আর আলাদা করে কিছুই বলব না। শুধু জেনো, এই বুড়োটা মরা অব্দি তোমাদের কাউকে ভুলবে না। থ্যাঙ্ক ইউ! কিন্তু এখনও অনেকটা কাজ বাকি। আমরা এখনও পর্যন্ত যতটা জানতে পেরেছি, সেটা একটা বিরাট উপন্যাসের কয়েকটা পাতা মাত্র। রাজর্ষিরা নিজের চোখে সেই বিশাল সাপকে যেতে দেখেছে, যাকে হাজার হাজার বছর ধরে আমরা মিথ্যে এক গুজব বলে উড়িয়ে এসেছি। এই বন-পর্বত-নদী সেনোটের দেশে এখনও অনেক রহস্যময় জিনিস রয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে। সেই অজানাকে জানার জন্যেই আমাদের এই অভিযান। আজ আমরা এই পিরামিডের ভিতরে নামব সেই কুকুলকানের শহরের উদ্দেশ্যে। আমাদের ভাগ্যে কী আছে জানি না। কোন বিপদ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে, তাও জানি না। সেই বিশাল সর্পদেবতা যদি সত্যি সেখানে থেকে থাকে, অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় নেই। না হলে যত তাড়াতাড়ি জায়গাটা পরীক্ষা করে আমরা বেরিয়ে আসব বাইরে। যদি ভাগ্যে থাকে আজই আমরা জেনিথ লাইটের সান-ডায়ালের সন্ধান পাব। গেট রেডি। অল দি বেস্ট।”

সকলে মিলে এগিয়ে যাওয়া হল সেই পিরামিডটার দিকে। এখানে পিরামিডগুলোর কাছাকাছি পাথরের মধ্যে একটা করে লিভার থাকে যাতে ভিতরে ঢোকার গুপ্ত-রাস্তা খোলা যায়। ম্যাথিউ একটু দেখে একটা পাথরে চাপ দিতেই মাটির ভিতর ঘড় ঘড় শব্দ হয়ে একটা গহ্বর বেরিয়ে পড়ল। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। সকলে চলল সেই পথ দিয়ে। কিছুটা এগিয়ে পথটা আবার পড়েছে একটা সরু সুড়ঙ্গের মধ্যে। সেটাতে একজন মানুষ বড়জোর এগোতে পারে। এরিকের পিছনে পিছনে চলল সবাই। রাস্তা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানে আবার কয়েকটা ভূমিগত নদীর স্রোত। কয়েকটা নদী বয়ে চলেছে কুলকুল করে। তার পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা রাস্তা। হাজার বছর ধরে যে এখানে কেউ পা রাখেনি বুঝতে পারা যায়। দেওয়ালের গায়ে গায়ে ঝুলছে বাদুড়। তাদের ময়লায় প্রায় পুরো রাস্তাটা ভরে আছে। মাকড়সার জাল এত পুরু যে হাত দিয়ে ছাড়ানো যায় না। অবশেষে তারা টর্চের সঙ্গে দুটো মশাল জ্বালাল। সেই মশাল দিয়ে মাকড়সার জাল ছিঁড়ে এগোতে লাগল দলটা। চারদিকে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। পোকামাকড়, বাদুড় না সাপ? কিছুই বোঝার উপায় নেই। নদীর জলের স্রোতের শব্দের সঙ্গে সেই আওয়াজগুলো মিলে জায়গাটাকে ভীতিকর করে তুলেছে। বাতাসে বিচ্ছিরি গন্ধ।

প্রায় একঘন্টা এরকমভাবে এগোনোর পর ওদের সামনে একটা লম্বা চাতাল পড়ল। সেই চাতাল পেরিয়ে একটা গোল ঘর। সেই ঘর থেকে আবার ঘোরানো সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। সেখান দিয়ে নামাতে লাগল সকলে মিলে। সে যেন অনন্তকাল ধরে নেমে যাওয়া। সিঁড়ি আর শেষ হয় না। এর মধ্যে তিনবার মশাল নিভে গেছে। আবার জ্বালাতে হয়েছে সেগুলো। প্রায়

ঘন্টাখানেক নামার পর সিঁড়ি শেষ হয়ে তারা এসে পৌঁছল একটা বিশালাকায় হলঘরে। সেখানে দেয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে রাজর্ষি অবাক হয়ে গেল। ম্যাথিউর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “মাই গুডনেস!।

সারা ঘরের দেওয়ালে অসংখ্য ক্রিস্টাল লাগান। অথবা বলা উচিত দেয়ালগুলো তৈরিই হয়েছে সেই ক্রিস্টালগুলো দিয়ে। সেই ক্রিস্টালের কোনওটা সাদা, কোনওটা বেগুনি, কোনওটা কমলা, কোনওটা সবুজ। প্রত্যেকটা ক্রিস্টাল থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। মাটিতেও ছড়িয়ে আছে নানা ক্রিস্টাল। একটা হলুদ রঙের ক্রিস্টাল তুলে নিল রাজর্ষি তার হাতে। হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ রাখতেই সেটা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। এত ঠান্ডা হয়ে গেছে যে সেটা হাত থেকে ফেলে দিতে হল। ততক্ষণে সকলে নানান ক্রিস্টাল তুলে পরীক্ষা করতে শুরু করেছে। এরিকের তোলা একটা বেগুনি ক্রিস্টাল তার হাত থেকে পড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ল না, হাওয়ায় ভেসে রইল। এমিলি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল সেইদিকে। হুআন ধীরে ধীরে বলল, “এই জায়গাটাতে জাদু আছে।”

এমন সময় মাইকেল প্রচন্ড ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “এটা কী?”

তার হাতে ধরা পাথরটা সে ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে। মাইকেলের হাতে ধরা রাইফেলটা পাথরের ছোঁয়ায় একটা লম্বা ইস্পাতের নলের মতন চেহারা ধারণ করেছে। রাজর্ষি খুব সাবধানে গিয়ে পাথরটা তুলে একটা বড়ো পাথরের ওপর রাখতেই সেটা মসৃণভাবে গোল আকার ধারণ করল। সে অস্ফুটে বলল, “জাদুপাথর। এই পাথর দিয়ে যেকোনও ধরনের রূপ দেওয়া যায় পাথর বা ধাতুকে। প্রতিটা ক্রিস্টালেরই একটা নিজস্ব শক্তি আছে।”

শয়ে শয়ে ক্রিস্টালের আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে রাজর্ষির ধোঁকা লেগে যাচ্ছিল। সে কি স্বপ্ন দেখছে? এরকম কি সম্ভব? অবাক হওয়ারও তো একটা সীমা আছে! ততক্ষণে এরিক নেমে গেছে সামনের দিকে। হলঘরটার ঠিক মধ্যেখানে একটা বিশাল সেনোটে। কিন্তু সেনোটে বলাও চলে না, কেননা জায়গাটা মসৃণভাবে কাটা একেবারে গোল আকারে। গাঢ় নীল জল যে কত গভীরে নেমে গেছে তা বোঝার কোনও উপায় নেই।

এমন সময় হঠাৎ পুরো জায়গাটা থরথর করে কেঁপে উঠল। দেওয়াল থেকে ছিটকে পড়ছে ক্রিস্টালগুলো। ওপর থেকে পড়তে লাগল পাথর। আর মাঝখানের সেই পাতালহ্রদের মধ্যে থেকে সকলকে চমকে দিয়ে মাথা উঠে এল এক বিরাট সরীসৃপের। এখন তার চোখগুলো খোলা, আর সেগুলো লাল। সারা শরীরে চকমক করছে কমলা সবুজ এক আলো। কুকুলকান। এবং সে তাদের দেখতে পেয়েছে। তার গোপন শহরের অনুপ্রবেশকারীদের। মাটি কাঁপছে থরথর করে। মনে হচ্ছে ভূমিকম্প হচ্ছে। তাদের দলের সকলে আতঙ্কে আর বিস্ময়ে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে। এমন সময় সাপটা জল থেকে পুরোটা উঠে এসে বিশাল দুটো ডানা ঝাপটাল। গলার কাছের কাঁটাগুলো ফুলে উঠেছে। ডানাগুলো প্রায় কুড়ি হাত করে লম্বা। গায়ের জল ঝেড়ে নিয়ে সে প্রচন্ড জোরে মাথা নাড়িয়ে হিস হিস শব্দ করল। তারপর মুখ হাঁ করল। পরক্ষণেই আগুনের এক হলকা এসে সামনের দেওয়ালে লাগল।

এরিক চিৎকার করে বলল, “পালাও, পালাও। তাড়াতাড়ি। ওই সরু সুড়ঙ্গটার মধ্যে পৌঁছতে হবে।”

কোনও কথা না বলে সকলে প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করেছে। ততক্ষণে মায়াদের তিন হাজার বছর পুরনো উড়ন্ত সর্পড্রাগনের মুখ থেকে অনবরত বেরিয়ে চলেছে আগুনের হলকা। মাটি কাঁপছে থর থর করে। ক্রমে দেওয়ালের গায়ের সব ক্রিস্টাল গলে পড়ল সেই উত্তাপে। ক্রিস্টালগুলো আগুনের হলকায় গলে লাভার মতো গড়িয়ে চলেছে। সেই লাভা গিয়ে পড়ছে মাঝখানের হ্রদে। সেখানে শুরু হয়েছে এক আশ্চর্য কান্ড। জলে পড়ামাত্র ক্রিস্টালগুলো সোনার রেণুর মত কুচি কুচি হয়ে ওপরের দিকে উঠতে লাগল। কোনওক্রমে সুড়ঙ্গের মুখের মধ্যে ঢুকে এরিক বলল, “আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোতে হবে এখান থেকে। এই পাতালপুরীতে আটকে যাওয়া কিছুতেই চলবে না।”

ম্যাথিউ আর্তনাদ করে বলল, “একটা স্পেসিমেনও নেওয়া হয়নি ক্রিস্টালগুলোর। কী ভয়ানক, কী আশ্চর্য! কুকুলকানের একটা ছবি পর্যন্ত…”

এরিক তার কাঁধ ধরে বলল, “জেমি, বিশ্বাস করানোর দায় তোমার নয়। তুমি কুকুলকানের রহস্য জানতে চেয়েছিলে, তুমি তা জেনেছ। একজন এক্সপ্লোরার হিসেবে তোমার নিজের কাছে তুমি সৎ। আর এখন বেঁচে গেলে পরে অনুসন্ধান করার সময় থাকলেও থাকতে পারে। চল।”

ম্যাথিউকে প্রায় ঘাড় ধরেই নিয়ে চলল এরিক। সকলে দ্রুত এগিয়ে চলেছে ওপরের দিকে।

এখানেও কম্পন দ্রুত হচ্ছে। সেই সর্পদেবতা কি তাড়া করে আসছে তাদের? অন্ধকারে হুড়মুড়িয়ে এগোতে গিয়ে সকলেই আছাড় খেয়েছে বেশ কয়েকবার। মশাল জ্বালানোর সময় নেই। পাথর পড়ছে যেখান সেখান থেকে। এমিলির মাথায় একটা পাথর পড়েছে। রাজর্ষির পা থেঁতলে গেছে। কিন্তু প্রাণ বাঁচিয়ে ওপরে ফিরতেই হবে। যখন তারা সিঁড়িটার কাছে পৌঁছল, সেখানে হিস হিস শব্দ শোনা যাচ্ছে। কুকুলকান কি বাইরে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে? কিন্তু আগে তো ওপরে যাওয়া। তিরবেগে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল সকলে পিরামিডের কাছে। সকলের মুখ থেকে হাপরের মতো নিঃশ্বাস পড়ছে। সকলে এসেই শুয়ে পড়েছে মাটিতে। একমাত্র এরিক সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই দেখ।”

সামনে তাকিয়ে তারা দেখল কুকুলকানের বিরাট শরীরটা সেনোটের জলের খানিকটা ওপরে ডানা ঝটপট করছে। তার মুখ সোজা আকাশের দিকে। এখন আকাশে সূর্য মধ্যগগনে। প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে সোজা ওপর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে রইল সে। রাজর্ষিরা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। অন্যকিছু ভাবার মতন মনের অবস্থা তাদের নেই। অতিকায় সেই প্রাণীর রং ঝলমল করছে সূর্যের আলোয়। এমন সময় তাদের চোখের সামনে কুকুলকানের শরীরটা সোনালি রেণুর মতো ছড়িয়ে যেতে লাগল বাতাসে। যেন কেউ তার গায়ে আগুন দিয়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কয়েকজন মানুষের হতভম্ব চোখের সামনে মায়াদের সেই প্রাগৈতিহাসিক দেবতা সোনালি রেণুর অনু পরমাণু হয়ে হাওয়ায় মিশে গেল। সবাই শুধু একদৃষ্টিতে, নিষ্পলক, নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকল সেইদিকে।

।।চোদ্দ।।

উজ্জ্বল সবুজ রঙের মধ্যে সূর্যের রুপোলি আলো ঝিকমিক করছে। সেনোটের ঠিক মাঝখানের জলে আলোর একটা রেখা সোজা সমকোণে চলে গেছে। রাজর্ষি অস্ফুটে বলে উঠল, “দি জেনিথ লাইট।”

রাজর্ষি হাত দিয়ে সেনোটের মাঝখানটা দেখিয়ে বলল, “ম্যাথিউ, আজকে উনিশ মে। আজকের দিনেই সূর্যের আলো সোজা এসে পড়ত হলটুনের সান-ডায়ালে। পৃথিবীর সঙ্গে একরেখায় থাকার ফলে কোনও ছায়া পড়ত না। সেই মুহূর্তটির সাক্ষী আমরা সকলে। কুকুলকানের সামনে সূর্যের আলো সোজা এসে পড়েছিল সেনোটের ঠিক মাঝখানে। যেখানে জলের তলায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মায়াদের সান-ডায়ালটা। জেনিথ লাইটের সান-ডায়াল মায়াদের তৈরি কোনও ঘড়ি নয়, সেই সান-ডায়াল তৈরি করে দিয়েছে প্রকৃতি। এই সেনোটেটাই আসলে সেই সান-ডায়াল।”

সবাই অধীর আগ্রহে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কুকুলকানের দেহের সোনালি রেণুগুলো জলের মধ্যে পড়ে একটা সান-ডায়ালের আকার তৈরি করেছে। রাজর্ষি বলল, “মনে কর সেই সূত্রটা। যখন সূর্য থাকে শীর্ষে, সময় জীবন্ত হয়ে ওঠে। যখন সূর্য চলে যায়, কুকুলকান আবার ঘুমিয়ে পড়ে। জেনিথ ডের দিনে সূর্য যখন মাথার ওপরে থাকে সমকোণে, সেই আলো সান-ডায়ালে দেখে মায়ারা পঞ্জিকার দিনক্ষণ সংশোধন করত প্রতিবছর।”

এমিলি এইবারে বলল, “বুঝেছি। কুকুলকান আসলে মায়াদের সময়ের জীবন্ত প্রতীক। মায়াদের সূর্যঘড়িতে কোনও ছায়াকাঁটা বা নোমেন নেই। কুকলকান নিজেই সেই ছায়াকাঁটা হয়ে সূর্যের দিকে মুখ তুলে দাঁড়াত প্রতিবছর। তার দেহের ওপরে পড়ত সূর্যের আলো সরাসরি, তাতে তার শরীরটা সোনালি রেণু হয়ে সূর্যঘড়ির ডায়ালকে ঢেকে দিত। সেইজন্যেই লেখা, ‘যখন সূর্য চলে যায়, কুকুলকান আবার ঘুমিয়ে পড়ে’।”

কেউ আর কোনও কথা বলল না। অলৌকিক আর বাস্তব যখন এক সঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়, তখন বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের সীমানা সূক্ষ্ম হয়ে আসে। এরিক, মাইকেল, এমিলি, রাজর্ষি, হুআন আর ম্যাথিউ সকলেই চুপ করে চেয়ে রইল জলের নিচের সেই বিশাল সূর্যঘড়ির দিকে।

রাজর্ষি আজ ফিরে যাচ্ছে দেশে। ম্যাথিউ, এরিক, এমিলি সকলে তাকে পৌঁছতে এসেছিল এয়ারপোর্টে। এমিলি বলল, “পরের অভিযানটা খুব তাড়াতাড়ি হবে। তুমি না থাকলে চলবে না।”

ম্যাথিউ তাকে জড়িয়ে ধরে রাখল অনেকক্ষণ। স্নেহমাখা গলায় বলল, “আবার দেখা হবে, রাজ।”

এরিক যথারীতি হাসল। যাওয়ার আগে পিঠ চাপড়ে তারপর একটা খাম ধরিয়ে দিল সে তার হাতে।

প্লেনে বসে সে তাকিয়ে ছিল নিচের দিকে। প্রশান্ত মহাসাগর দেখা যাচ্ছে নিচে। কত কিছু সে অনুভব করল এই কয়েক সপ্তাহে। মায়াদের সভ্যতা থেকে শুরু করে নানা অলৌকিক ও রহস্যময় জগতের সম্মুখীন হওয়া, এখন সব স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। আনমনে সে হাতের খামটা খুলল। অনেকগুলো ফটোগ্রাফ আছে তাতে। জঙ্গল, পাহাড়, ওয়াইট টেলড ডিয়ার, স্পাইডার আর হাউলার মাঙ্কি, কোআটি, কতরকমের পাখি, সবুজ হল্টুনের সেনোটে, দেখতে দেখতে রাজর্ষির মন ভালো হয়ে এল। ফিরে যাওয়ার এই মুহূর্তটুকু একান্ত আপন করে রাখল এই ছবিগুলো, ঘন পাহাড়-জঙ্গলে ভরা এখানকার অরণ্য, গুহা, নদী, অপলক চোখে চেয়ে থাকা এই পশুপাখিগুলো আর মাথার ওপরের হাজার হাজার নক্ষত্রে ভরা আকাশ। এদের জন্যেই হয়তো ফিরে আসতে হবে আবার।

ছবিঃ শিমুল

চিত্রলিপির ছবিঃ লেখক

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প উপন্যাসের লাইব্রেরি 

 

 

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s