এ প্রতিযোগিতা হয়েছিল রাজকুমার রায়চৌধুরিমশাইয়ের অসামান্য সাইফি “তাতিয়ানার মোবাইল“-এর একটা উপযুক্ত সিকোয়েল লেখবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে। সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল বেশ কিছু তাজা কলম। প্রথম ন’টি গল্প পুরস্কৃত হয়েছে বইমেলায় আমাদের অনুষ্ঠানে। প্রথম তিন আসবে পুজো সংখ্যায়। তার পরের বিজয়ীদের মধ্যে ছয় ও সাত নম্বর বের হল এ সংখ্যাতে।
জয়ঢাক গল্প প্রতিযোগিতা ২০১৬ ষষ্ঠস্থান
১
নভেম্বরের শেষ। ঘুমচাদরে মুড়ি দিয়ে হালকা শীতের আমেজটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে শেষ রাতের কলকাতা। অথচ ঘুমের লেশমাত্র নেই ‘ইটিইরো’-র সদর দপ্তরের পাঁচতলার বিশাল হলঘরটার মানুষগুলোর চোখে। তাদের দৃষ্টি দেওয়ালজোড়া বিশাল মনিটরটার দিকে। কপালের রেখাগুলো জানিয়ে দিচ্ছে তারা প্রচণ্ড উৎকণ্ঠিত। যেন রয়েছে অনন্ত অপেক্ষায়।
ডানদিকের দ্বিতীয় সারির একদম কোণের চেয়ারে বসে সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ডঃ নবারুণ খাসনবীশ। পাশ থেকে তাতিয়ানা ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আর টেনশন সহ্য হচ্ছে না স্যার! আপনার কি মনে হয় ওরা উত্তর দেবে?’
‘ধৈর্য ধরো তাতিয়ানা…’ বলে চুপ করে গেলেন খাসনবীশ।
আসলে উত্তরটা নিজেরও জানা ছিল না তাঁর। স্মৃতির কোষগুলো হঠাৎই তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল সাত বছর আগে। কীভাবে তাতিয়ানার মোবাইলে আসা একটি রহস্যময় মেসেজের মাধ্যমে সবকিছুর সূত্রপাত। তখন অবশ্য তাতিয়ানা ক্লাস টেনের বাচ্চা মেয়ে। তারপর খাসনবীশের সেই রিসার্চ পেপার নিয়ে নাসায় হইচই ও সেখানকার কমিটিতে যোগদানের প্রস্তাব। অবশ্য শেষ মুহূর্তে মন পরিবর্তন করে নাসা না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন খাসনবীশ। বন্ধু ডঃ চন্দ্রশেখরের অনুরোধে ইটিইরো-তে যোগদান। ভারতের বিখ্যাত স্পেস রিসার্চ সংস্থা ইসরো-র একটি গোপন শাখা এই ইটিইরো। পুরো নাম ‘এক্সট্রাটেরিস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স রিসার্চ অর্গানাইজেশন’। মহাজগতে প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধানের লক্ষ্যই এই সংস্থার লক্ষ্য। আজ এখানে যে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীরা জড়ো হয়েছেন তার পিছনে খাসনবীশের অবদানও কিছু কম নয়।
‘স্যার, স্যার… দেখুন’, তাতিয়ানার কণ্ঠস্বরে হুঁশ ফিরল খাসনবীশের।
স্ক্রিনে ভেসে আসছে একের পর এক মেসেজ। যদিও অক্ষরগুলো পৃথিবীর চালু কোনও ভাষার নয়। কিন্তু তার জন্য অসুবিধাও হচ্ছে না কারুর। কারণ একটি বিশেষ সফটওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি তর্জমা করে দিচ্ছে।
শেষে যখন সেই বিশেষ বার্তাটা ফুটে উঠল পর্দায়, উল্লাস আর হাততালিতে ফেটে পড়ল বিশাল হলঘর। তাতিয়ানা অবশ্য এই বিশেষ বাক্যটির মানে ইংরেজি অনুবাদ না পড়েও বুঝতে পেরেছিল,
‘আমরা আসছি তোমাদের পৃথিবীতে!’
নানা দেশের বিজ্ঞানীরা সবাই খাসনবীশকে ঘিরে ধরে ভাসিয়ে দিলেন অভিনন্দনের বন্যায়। বয়স্ক বিজ্ঞানীরাও শিশুদের মতো আনন্দ করছিলেন। গর্বে মনটা ভরে যাচ্ছিল তাতিয়ানার।
২
‘ওয়াও, কাকিমা! বড়িপোস্তটা জাস্ট অসাম!’ চৈতালির গলায় উচ্ছ্বাস।
‘এই জন্যই তোকে খাইয়ে শান্তি। এরা তো খেয়ে কখনও বলবে না কেমন রান্না হল’, তাতিয়ানার মায়ের গলায় ভালোবাসামাখা অনুযোগ।
‘আহা, তুমি তো ভালো রাঁধোই… তা আবার রোজ রোজ বলতে হবে নাকি’, হা হা করে ওঠেন তাতিয়ানার বাবা অনিমেষবাবু।
সেদিন রাত্রে তাতিয়ানাদের বাড়িতে ডিনার টেবিলে জোরদার আড্ডা চলেছিল। তাতিয়ানা, ওর বাবা, ডঃ খাসনবীশ, স্কুলের বন্ধু চৈতালি, দাদা তন্ময়কে নিয়ে দারুণ একটা গেট-টুগেদার। অনেকদিন বাদে চৈতালি এসেছে কলকাতায়। চৈতালি এখন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি করে হায়দ্রাবাদের নামজাদা এক মালটিন্যাশনাল ফার্মে। তাতিয়ানাকে একরকম জোর করেই ইটিইরো-তে জয়েন করিয়েছেন খাসনবীশ স্যার।
‘তাহলে ওরা শেষ অবধি নামবে পৃথিবীতে?’ জিজ্ঞাসা করলেন অনিমেষবাবু।
‘প্রাথমিকভাবে তো সম্মতি দিয়েছে। তবে ওদের কিছু শর্ত আছে। সেটা কালকে হয়তো জানাবে’, খাসনবীশ বললেন।
‘মনে আছে, তোর ফোনে যেদিন প্রথম মেসেজটা এল সেদিন কীরকম ঘাবড়ে গেছিলি?’ তন্ময়ের কথায় মৃদু হাসল তাতিয়ানা।
‘স্যার, আপনি ঐ মেসেজগুলোর মানেটা উদ্ধার করলেন কী করে?’ চৈতালি প্রশ্ন করল।
খাসনবীশ বললেন, ‘সংক্ষেপে বলি। আসলে প্রথম দিকের মেসেজগুলো আসত দু’ভাবে। ভাষায় ও ছবিতে। ভাষাটা ছিল একেবারেই অজানা। এর সাথে প্রাচীন গ্রিক লিপির সামান্য মিল থাকলেও দুটো কিন্তু পুরোপুরি এক ছিল না। আমার সন্দেহ হয়েছিল হয়তো এটি আরও পুরানো কোনও ভাষা যার সাথে গ্রিক লিপির কোনও সংযোগ আছে। এমনও হতে পারে গ্রিক, সাসানিড সহ নানা প্রাচীন ভাষার আদি ভাষা এটাই। কিছু মেসেজে অক্ষরের বদলে ছিল সাংকেতিক ছবি। ছবিগুলো অদ্ভুত। দুর্বোধ্য। হেঁয়ালিময়। তবে আমি আন্দাজ করছিলাম ছবিগুলি মহাকাশ নক্ষত্রমণ্ডলীর হতে পারে। আমার মন বলছিল হয়তো কোনও ভিনগ্রহের সভ্যতা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে… এই নিয়েই আমি একটা পেপার লিখি। পুরোটাই হাইপোথিটিকাল। কিন্তু কথাগুলোর মধ্যে সত্যতার অনেক রসদও ছিল। নাসা সেজন্যই আমাকে ডেকেছিল। যদিও ইটিইরোতে চলে এলাম। গবেষণাও চলতে লাগল… কিন্তু কোথাও যেন অঙ্কটা মিলছিল না। শেষ অবধি ঘটনাটার মোড় ঘুরে গেল আমার সাথে দিমিত্রির আলাপ হবার পর থেকে…’
‘দিমিত্রি!! সে এবার কে?’ তর সইছিল না চৈতালির।
‘বলছি, বলছি! দিমিত্রি গ্রীসের এক ধনকুবের ব্যবসায়ী। তেলের খনি থেকে ব্যাঙ্ক, কী নেই তাঁর। কিন্তু এসবের বাইরেরও ভদ্রলোকের অন্য এক পরিচয় ছিল। দিমিত্রি একজন প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রাহক। বহু প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান স্পনসর করেছেন। ভূমধ্যসাগরের আনাফি দ্বীপে তাঁর বিশাল এস্টেট। সেখানেই নিজস্ব সংগ্রহশালা। দিমিত্রি একটা আর্টিকল পড়ে একদিন আমাকে ফোন করেন। আমাকে সাহায্য করতে চান। বলেন ওর সংগ্রহে এমন কিছু প্রাচীন গ্রিকলিপি রয়েছে যা কিনা সরকারি মিউজিয়ামেও নেই। হয়তো সেগুলো দেখে আমার কিছু সূত্র মিলতে পারে। নিজের খরচায় আমাকে নিয়ে গেলেন গ্রীসে।’
একচুমুক জল খেয়ে এবার বলতে লাগলেন খাসনবীশ, ‘দিমিত্রির কথাটা ভুল ছিল না। আনাফি দ্বীপের মিউজিয়ামে ওঁর বিশাল সংগ্রহ মাথা ঘোরানো। নিছক খেয়ালি বড়োলোক নন দিমিত্রি। প্রাচীন গ্রিক ভাষা আর ইতিহাসে তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। আমি দিমিত্রির সংগ্রহে থাকা লিপিগুলি নিরীক্ষণ করতে থাকি। একদিন হঠাৎই একটি গ্রিক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া একটি বেদিতে খোদাই করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অজস্র লিপির মধ্যে আমাদের মেসেজে পাওয়া অক্ষরগুলির সাথে মিল খুঁজে পাই। মন্দিরটি ছিল মিনোয়ানদের…’
খাসনবীশ তাতিয়ানার দিকে ইশারা করতেই সে বলতে শুরু করল, ‘মিনোয়ান কারা সেটা একটু বলি। প্রাচীন গ্রিক কাহিনিগুলোতে এক আশ্চর্য সভ্যতার হদিস পাওয়া যায়, যাদের মিনোয়ান বলা হত। এখন থেকে প্রায় ৬০০০ বছর আগে মিনোয়ানরা ক্রিট দ্বীপে গড়ে তুলেছিল নসস নামের বিশাল এক শহর। সেখানকার রাজা মিনোস বিখ্যাত ছিলেন তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্য। মিথোলজি বলছে পরবর্তীকালে তিনি পাতালের মৃতদের তিন বিচারকের একজন হিসাবে নির্বাচিত হন। রাজা মিনোস তৈরি করিয়েছিলেন এক আশ্চর্য রাজপ্রাসাদ। যে প্রাসাদে ছিল এক অদ্ভুত গোলকধাঁধা। নিজের পুত্র অর্ধেক-মানুষ-অর্ধেক-ষাঁড়-জাতীয় দানব নরখাদক ‘মিনোটর’-কে বন্দি করে রাখাই ছিল রাজার উদ্দেশ্য। মিনোয়ানদের সর্বোচ্চ দেবতা ছিলেন এক সর্পদেবী। যিনি আদতে গ্রিক দেবী ইউরিনোমের এক পুরানো সংস্করণ। প্রাসাদের পাশেই ছিল সেই সর্পদেবীর মন্দির। এই মন্দিরটির কথাই স্যার বলছিলেন।’
‘সাবাস তাতিয়ানা’, আবার শুরু করেন খাসনবীশ, ‘মিনোয়ানদের ভাষা উদ্ধার করতে শরণাপন্ন হই মিনোয়ান লিপিবিশারদ ডঃ আন্দ্রেজের। উনি কিছুদিন পর যে রিপোর্ট দেন তাতে মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়। মিনোয়ান মন্দিরগাত্রে লেখা লিপি আসলে সেই সর্পদেবীর গুণকীর্তন। এই দেবী তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন আকাশ থেকে। তাঁর স্বর্গীয় রথে চেপে। রাজা মিনোসের অনুরোধে দেবী তাঁদের দেবলোকের বিদ্যা শিক্ষা দেন। এবং তার বদলে তাঁরা পৃথিবী থেকে নিয়ে যায় অমূল্য ধন।’
‘আশ্চর্য গল্প তো…’ তাতিয়ানার মায়ের গলায় বিস্ময়।
খাসনবীশ বলতে থাকেন, ‘আমি মিনোয়ানদের নিয়ে আরও অনেক গবেষণা করি। আমার স্থির ধারণা হয় এই সর্পদেবী আসলে ভিনগ্রহী যারা সেইসময় পৃথিবীতে এসেছিল। গ্রিক মিথোলজির সাথে ওরিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জের বিশেষ যোগ রয়েছে। খুব সম্ভবত এরা সেখানকার কোনও গ্রহের বাসিন্দা ছিল।’
‘ওরিয়ন, মানে আমরা যেটাকে কালপুরুষ বলে জানি?’
‘ঠিক তাই। দেবলোকের বিদ্যা বলতে বোঝানো হয়েছে মিনোয়ানদের ভাষা, যা থেকে পরে গ্রিক ভাষা এবং নানা প্রাচীন ভাষার উদ্ভব। মিনোয়ানদের আরও নানা বহুমূল্য জ্ঞানের ভান্ডার দিয়ে যায় তারা, যা পরে গ্রিকদের সমসাময়িক সভ্যতাগুলির থেকে অনেক এগিয়ে দেয়। কিন্তু তারা পৃথিবী থেকে কী অমূল্য ধন নিয়ে গেছিল সেটা আমি বুঝতে পারিনি।’
তন্ময় বলে উঠল, ‘ফ্যাসিনেটিং… কিন্তু আপনি কী করে ওদের সাথে যোগাযোগ করলেন?’
‘আমি মিনোয়ানদের ভাষাটা রপ্ত করতেই আস্তে আস্তে মেসেজগুলির মানে পরিষ্কার হয়ে যায়। ওরা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইছিল। আমাদের থেকে ঐ সভ্যতা অনেক উন্নত। ওরা বুঝতে চাইছিল মানবজাতি এই ৬০০০ বছরে কতটা এগিয়েছে। ওরা বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের সাথে সংযোগ করতে চেয়েছিল। আমাদের প্রযুক্তি এই এস-এম-এস-গুলি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল। বেশ কিছু র্যান্ডম মেসেজ ওরা পাঠিয়েছিল, যার মধ্যে তাতিয়ানা একজন যার মোবাইলে ধরা পড়ে ব্যাপারটা। হয়তো আরও অনেকের কাছেই গেছিল। সবাই ব্যাপারটায় গুরুত্ব দেয়নি। এরপর ব্যাপারটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায় বিজ্ঞানীদের কাছে। ইটিইরো, নাসা-সহ বিশ্বের নানা দেশের তাবড় মহাকাশবিজ্ঞানীরা একজোট হয়ে কাজ করতে শুরু করেন। মহাকাশে ওদের উদ্দেশে পাল্টা বার্তা পাঠানো হতে থাকে। যদিও আমাদের বিজ্ঞান এমন উন্নতি করেনি যে অতি দ্রুত অন্য নক্ষত্রপুঞ্জে তরঙ্গের আকারে বার্তা পাঠানো যাবে। এমনিতে আলোর গতিবেগের চেয়েও বেশি গতিতে পাঠালেও বহু বছর লাগার কথা সেখানে পৌঁছতে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ছিল এই ভিনগ্রহীরা এতটাই উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী, তারা কোনও উপায়ে আমাদের বার্তা দ্রুত গ্রহণ করতে সক্ষম। এবং বাস্তবে সেটাই হল। ওদের সাথে যোগাযোগ হল। এটুকু জানতে পারলাম আথেনিকা নামক একটি গ্রহে ওদের বসতি। বেশ কয়েক বছর কথা চালাচালির পর আজ আমরা আথেনিকানদের থেকে জবাব পেলাম যে ওরা পৃথিবীতে আসছে…’
‘মানে এই প্রথমবার এলিয়েন দর্শন পাব আমরা… উফ ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে’, উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে চৈতালি।
‘অত নাচিস না। কে জানে কেমন কিম্ভুত দেখতে। আর যদি কোনও খারাপ উদ্দেশ্য থাকে। তবে?’ তাতিয়ানার মা চৈতালিকে থামিয়ে বলে উঠলেন।
‘মা তুমি এত চিন্তা করো না! ওরা আমাদের থেকে এতটাই এগিয়ে, ইচ্ছা করলেই ওরা এতদিনে অনেক কিছু করতে পারত। কিন্তু তা তো করেনি,’ বলল তাতিয়ানা।
‘কিন্তু নবারুণবাবু, ওরা এতটা পথ পাড়ি জমাবে কী করে?’ তাতিয়ানার বাবার গলায় বিস্ময়।
‘এরকম আরও অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মনে। সত্যি বলতে সেটা আমাদের সময়ের বিজ্ঞানের পক্ষে বোঝা দুষ্কর। দেখা যাক ওদের থেকে যদি কিছু শিখতে পারি।’
‘অনেক এলিয়েন হয়েছে … এবারে আমার বানানো চকোলেট আইসক্রিমটা খেয়ে ফেলো দেখি,’ আলোচনা থামিয়ে হাতে ট্রে নিয়ে হাজির হয় তাতিয়ানার মা।
আইসক্রিম খেতে খেতে চৈতালি বলে উঠল, ‘আচ্ছা এলিয়েন ব্যাটাগুলোকে কাকিমার হাতের রান্না খাওয়ালে কেমন হয়?’
হাসিতে গমগম করে তাতিয়ানাদের ডাইনিং রুম।
৩
আথেনিকা গ্রহ। বহু আলোকবর্ষ দূরের ওরিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জের সেই গ্রহ যেখান থেকে একসময় পৃথিবীতে এসেছিল সেখানকার উন্নত সভ্যতার প্রাণীরা। যারা বিশ্বের মানুষদের থেকে সব দিক থেকেই অনেক এগিয়ে।
নতুন অতিথিদের এই সম্ভাব্য আগমন বার্তা আক্ষরিক অর্থেই কাঁপিয়ে দিল সমগ্র বিশ্বকে। চতুর্দিকে সাজো সাজো রব। সংবাদপত্র, নিউজ চ্যানেল সর্বত্র একই আলোচনা। তর্ক-বিতর্ক-মতামত-আশঙ্কা-প্রত্যাশা সবমিলিয়ে জমজমাট সোশাল মিডিয়া। ধুলো ঝেড়ে কল্পবিজ্ঞানের বইগুলো নতুন করে পড়তে শুরু করল মানুষ। সাইফাই সিনেমার কাটতি তুঙ্গে। মোবাইলে একের পর লঞ্চ করতে লাগল নানা এলিয়েন-অ্যাপ।
এর সঙ্গে যোগ হল রকমারি গুজব। বিশেষ করে তারা কীরকম দেখতে, কী করে, কী খায়, এরকম বহু ব্যাপারে ভয়ানক সব গায়ের রক্ত জল করা গুজব ছড়িয়ে পড়ল। বিভিন্ন রকমের ভুয়ো ছবিও প্রকাশ হতে লাগল। যেমন একটি বহুল প্রচারিত ভুয়ো ছবিতে দেখা গেল এলিয়েনগুলো মানুষ ধরে খাচ্ছে। সত্যাসত্য বিচার না করেই সেইসব ছবি চালাচালি হতে লাগল।
আমাদের দেশেও নানা মজাদার কান্ড ঘটতে লাগল। কিছু জ্যোতিষবিদ বুধের চলন, বৃহস্পতির তুঙ্গে থাকার গণনার পাশাপাশি আথেনিকাকেও সঙ্গে জুড়ে নিল। ইউ পি’র স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলের বিধায়ক তো আবার এলিয়েনদের তাঁদের দলের হয়ে ভোটে দাঁড়াবার ঘোষণা পর্যন্ত করে দিলেন। এলিয়েনদের সংবর্ধনা দিতে চেয়ে সরকারের কাছে শ’য়ে শ’য়ে আবেদনপত্র জমা পড়তে লাগল। বানানো, অতিরঞ্জিত সব খবরের জেরে মানুষ চূড়ান্ত বিভ্রান্ত হতে লাগল।
তাতিয়ানার বাবা-মায়ের অবস্থা সবচেয়ে কাহিল হয়ে পড়ল। টিভি, সংবাদপত্রের দৌলতে তাতিয়ানাকে সবাই তখন চেনে। বিচিত্র সব আবদার আসতে লাগল ওদের বাড়িতে। ওর মা সব লিস্ট করে রেখে দিতেন। রাতে কাজ সেরে ফিরলে তাতিয়ানার হাসির খোরাক যোগাত সেই সব অদ্ভুত অবাস্তব দাবিদাওয়া। যেমন, বুম্বার বাবা তাঁর অঙ্কে ফেল করা ক্লাস সেভেনের ছেলের জন্য একটি এলিয়েন প্রাইভেট টিউটর রাখতে চেয়েছিলেন। পাপানদা তাঁর গঙ্গাফড়িং মার্কা চেহারায় মহম্মদ আলির মতো ঘুসির জোর কীভাবে আনা যায় তার গোপন ফরমুলা জানতে চাইল এলিয়েনদের কাছ থেকে। শুধু শুধু আর এই বিদঘুটে তালিকা প্রলম্বিত করে লাভ নেই।
অবশ্য এমন কিছু মানুষও ছিল যারা পুরো ব্যাপারটাকেই স্রেফ আন্তর্জাতিক ধাপ্পা বলে উড়িয়ে দিল।
৪
তবে এসব থেকে বহু যোজন দূরে থেকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করে যাচ্ছিলেন বিজ্ঞানীরা।
এরকমই এক বিকেলে জাপানের একটি নির্জন দ্বীপের মানমন্দিরে আলোচনায় বসেছিলেন বেশ কিছু বিজ্ঞানী। ছিলেন মস্কোর স্পেস রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর ডঃ পাভেল, নাসার বিজ্ঞানী মাইকেল মিলার, নোবেলবিজয়ী প্রাণীবিদ সিনজি উসামি, ডঃ খাসনবীশ এবং আরও কয়েকজন। ওঁদের মধ্যে আলোচনা চলছিল যাতে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে কোনও ফাঁক না থাকে।
খাসনবীশঃ ‘আথেনিকানরা কেন আসছে তার প্রধান কারণটা জেনে নিতে পেরেছি আমরা। পৃথিবীর প্রাণী আর উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের কিছু নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে চায় তারা। উসামি ব্যাপারটার সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারবেন…’
উসামিঃ ‘আথেনিকানদের মূল উদ্দেশ্য পৃথিবী থেকে বিশেষ করে কিছু খাদ্যশস্য এবং প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করা। ওদের উদ্দেশ্য মূলত দুটি। এক, ওরা একটা মহাজাগতিক সংগ্রহশালা বানাতে চায়, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত জীবের নমুনা সংরক্ষিত থাকবে। আর দ্বিতীয়ত, একটি বিশেষ কারণে ওদের ওখানে বহু প্রাণী ও শস্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে, ফলে ওদের খাদ্যের ভাঁড়ারে টান পড়তে চলেছে। ওদের খাদ্যাভ্যাস অনেকটাই পৃথিবীর প্রাণীকুলের মতোই। তাই এখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে চায় ওরা।’
মিলারঃ ‘আর একটা উদ্দেশ্যও ওদের আছে, যেটা নাকি ওরা শেষ মুহূর্তে জানাবে। এ সম্পর্কে কিছু কি আন্দাজ করছেন আপনারা?’
ডঃ পাভেলঃ ‘মনে হয় এমন কিছু দাবি করবে না যা আমাদের পৃথিবীবাসী দিতে অপারগ। অবশ্য ওরা যদি জোর করে তবে কিছু করার নেই। আমাদের রাজি হওয়া ছাড়া গতি নেই।’
খাসনবীশঃ ‘আমার মনে হয় না আথেনিকাবাসীরা তেমন কিছু চাইবে।’
মিলারঃ ‘আচ্ছা, আমরা না হয় ওদের সমস্ত দাবি মেনে নিলাম। কিন্তু তার বদলে আমরা কী পাব?’
উসামিঃ ‘দেখুন, ওদের কাছ থেকে আমাদের প্রচুর কিছু শেখার আছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মহাকাশবিদ্যা কী নয়…। সত্যি বলতে ওদের কর্মকাণ্ড মহাজাগতিক। কিন্তু আমরা তো এখনও আমাদের সৌরজগত ছেড়েই বেরোতে পারলাম না। ওদের সাহায্য পেলে…’
খাসনবীশঃ ‘আমরা বেশ কিছু বার্তা পাঠিয়েছিলাম ওদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। সরাসরি না বলেনি। কিন্তু মনে হয় না ওরা কিছু সাহায্য করবে বলে।’
মিলারঃ ‘কেন?’
খাসনবীশঃ ‘ওরা কিছুটা দার্শনিক গোছের উত্তর দিয়েছে। বিবর্তনের প্রাকৃতিক নিয়ম উল্লঙ্ঘন করলে পতন অনিবার্য, মানেটা অনেকটা এরকম। এর থেকেই বুঝেছি ওরা সাহায্যে রাজি নয়।’
ডঃ পাভেলঃ ‘এখনও অবধি আমাদের তো এটুকুও জানায়নি ওরা দেখতে কেমন… ওদের গ্রহটা কেমন… বোধকরি ওরা নিজেদেরকে গোপনে রাখতে চায়।’
উসামিঃ ‘সেটা আমারও ধারণা। আচ্ছা ওরা কবে আসবে কিছু বলেছে?’
খাসনবীশঃ ‘সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ। আগামী মাসে সব জানিয়ে দেবে। তবে আমাদের কাজের অগ্রগতি আগে দেখতে চায় ওরা।’
উসামিঃ ‘ও নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমাদের পুরো টিম কাজ করছে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কাজ শেষ হয়ে যাবে আশা করি।’
মিলারঃ ‘আপনার উপর আমাদের অগাধ আস্থা। হাজার হোক এটা পৃথিবীর সম্মানের প্রশ্ন। আমাদের পারতেই হবে।’
বৈঠক ছেড়ে বেরিয়েই যে যার মতো লেগে পড়েন কাজে। ওরা জানেন, এই প্রথমবার আধুনিক বিশ্বের সাথে বহির্জগতের অন্য কোনও সভ্যতার সংযোগ হতে চলেছে। এই সুযোগ যে মানুষের সামনে নতুন এক সম্ভাবনার দোর খুলে দেবে না, তা কে বলতে পারে?
৫
সূর্যের চারিদিকে পাক খেতে পৃথিবী ক্লান্তিহীন। একই তালে ঘুরে চলে ঘড়ির কাঁটাও। দেখতে দেখতে চলে আসে সেপ্টেম্বর।
ক’দিন ধরেই কলকাতাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের আবহাওয়া ছিল মেঘলা। কোথাকার উটকো নিম্নচাপ এসে ঢেকে রেখেছিল আকাশ।
কিন্তু সেই বিশেষ দিনটার কথা ভুলতে পারবে না কেউ। দিনটা ছিল মহালয়া। পুজোর গন্ধে মাতোয়ারা বাংলা। সকাল সাতটা নাগাদ আচমকাই মেঘলা ভাব কেটে গিয়ে শরতের নীল আকাশ বেরিয়ে পড়ল। যারা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ দেখবে বলে আকাশের দিকে তাকাল তাদের জন্য অপেক্ষা করে ছিল এক আশ্চর্য বিস্ময়।
নীল আকাশের মধ্যে যেন ঝুলছিল বিশাল একটুকরো জমি। ঠিক চাঁদের মতো গোল নয়। আবার উড়ন্ত চাকির মতো চ্যাপটাও নয়। অদ্ভুত কুয়াশাচ্ছন্ন। ধূসর।
কেউ ভিরমি খেল। কেউ ভয়ে ঘরের মধ্যে লুকোল। মাসি-পিসিরা শাঁখ বাজাতে লাগল। ওয়াকিবহাল যারা তারা চটপট ক্যামেরা বাগিয়ে ধরল। উঠল সেলফি তোলার ধুম। সোশাল মিডিয়ায় হ্যসট্যাগ #সেলফিউইথসসার। আর মুহূর্তে টিভি চ্যানেলগুলোয় সমবেত কোরাস, এলিয়েনরা এসে গেছে।
আথেনিকাবাসীর সহসা আগমনে আবিশ্ব আমজনতা তখন এলিয়েনময়। তাতিয়ানারা অবশ্য অবাক হয়নি। বৈজ্ঞানিক মহল আগেই জেনে গেছিল ওরা ঢুকে পড়েছে সৌরজগতে। কিন্তু ওরা দৃশ্যমান ছিল না। অবিশ্বাস্য তাদের যানের গতি। ঠিক যান না বলে ছোটোখাটো চলমান গ্রহ, বা বড়োসড় গ্রহাণু বলা যেতে পারে। ওরা আপাতত নিজেদের যানটিকে স্থাপন করেছে পৃথিবীর চারপাশে এক নিজস্ব কক্ষপথে। কৃত্রিম উপগ্রহের মতো।
তবে সত্যি বলতে বিশেষজ্ঞগণ দিশেহারা। বহু প্রশ্ন উঠে আসছে। কিন্তু জানার উপায় নেই। কারণ আথেনিকানরা প্রচন্ড গোপনীয়তা বজায় রেখেছে। তারা পৃথিবীবাসীর কাছে থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছে। তাদের প্রযুক্তির ক্ষমতাও যেন যাদুকরী। যেন আশ্চর্য কোনও কুয়াশার পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছে নিজেদের। শক্তিশালী টেলিস্কোপ বা কৃত্রিম উপগ্রহগুলির কোনওটিই ঐ অদ্ভুত যানটির উপরিভাগের ছবি তুলতে পারছে না।
কিন্তু তারপর? কী অপেক্ষা করছে পৃথিবীর ভাগ্যে?
এমনকি বিজ্ঞানীদেরও কোনও আভাস দেয়নি আথেনিকাবাসী। পরবর্তী মেসেজের জন্য দমবন্ধ করে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও গতি নেই।
পাক্কা ২০টি ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর অবশেষে কাঙ্ক্ষিত বার্তাটি এল। প্রথমেই তারা সৌরজগতের সবচেয়ে উন্নত সভ্যতা পৃথিবীর মানবজাতিকে তাদের উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছে। আরও বলা হয়েছে ঠিক চারদিন পর রাত্রি ন’টায় একটি ছোটো যান নামবে পৃথিবীর মাটিতে। জায়গাটিও নির্বাচন করে দিয়েছে আথেনিকানরা। সেটি লাদাখের এক দুর্গম এলাকা। আথেনিকানদের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি সেখানেই হস্তান্তর করতে হবে। ঐ অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সমস্ত কিছু গুছিয়ে রাখতে বলেছে। কীভাবে জিনিসগুলি সংগ্রহ করা হবে সেটা তাদের দায়িত্ব।
বাছাই করা বিজ্ঞানীদের একটি দল তড়িঘড়ি রওনা দিল লাদাখের পথে। তাঁদের মধ্যে খাসনবীশও ছিলেন।
তাতিয়ানা বিমানবন্দর অবধি একসাথে গেল। গাড়িতে কথা হচ্ছিল ওদের মধ্যে।
‘স্যার, ওরা কী আমাদের কারুর সাথে দেখা করতে বা কথা বলতে চায় না?’
‘মনে তো হচ্ছে না। এমনকি ওরা রাতের বেলাকে বেছে নিয়েছে সাক্ষাৎকারের জন্য। তাও একটি জনমানবহীন জায়গায়। সেখানে কোনও প্রকার বৈদ্যুতিক আলো জ্বালানো বা ক্যামেরার প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে বলেছে আথেনিকানরা। হয়তো আমাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না।’
‘কিন্তু কেন? আগে তো ওরা পৃথিবীতে মানুষের সাথে মিশেছিল।’
‘সে তো ছ-হাজার বছর আগের পৃথিবী। মানুষের হাতে তখন এত মারণাস্ত্রও ছিল না। এখনকার মানুষজাতি কেমন সেটা হয়তো আগে পরীক্ষা করে দেখতে চায়। কিংবা হয়তো আরও অন্য কোনও কারণ আছে, সেটা আমরা জানি না।’
‘আচ্ছা স্যার, আমরা যে ওদের থেকে অনেক পিছিয়ে। আমরাও যে ওদের কাছ থেকে কিছু পাবার প্রত্যাশা করি সেটা নিশ্চয়ই ওরা জানে। কিন্তু তাও কেন ওরা এমন দূরে সরে আছে?’
‘সে প্রশ্ন তো আমাদের সবারই’, হালকা হেসে ঘাড় নাড়লেন খাসনবীশ। একরাশ চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে। মনে হচ্ছে কোথাও অঙ্কটা মিলছে না।
বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল ভারতীয় বায়ুসেনার বিশেষ বিমান। বিজ্ঞানীদের উড়িয়ে নিয়ে গেল লাদাখের দিকে।
দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান-সহ বিশ্বের তাবড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা একত্রে বৈঠকে বসেছেন। নজরে রাখছেন পুরো ঘটনাক্রম। আর সেই সঙ্গে প্রস্তুতও হয়ে রয়েছেন যদি খারাপ কিছু ঘটে। যেন পুরো পৃথিবীতে একটাই বিশাল দেশ।
৬
লাদাখের সেই জনহীন প্রান্তরে স্পেসিমেনগুলি গুছিয়ে রেখে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাইকেল মিলার, প্রাণীবিদ সিনজি উসামি এবং খাসনবীশ। খাসনবীশ এই জায়গায় আগে কোনওদিন আসেননি। আকাশটা ছিল পরিষ্কার। রাশি রাশি তারার মাঝে খাসনবীশের হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল। মহাজগতের মাঝে নিজেকে বড্ড ক্ষুদ্র আর অসহায় মনে হচ্ছিল।
আচমকা চোখের সামনে একটি চোঙাকৃতি যান এসে নামল। এত বড়ো একটি যান আকাশ থেকে নামল অথচ কোনও শব্দ হল না। পরে অবশ্য খাসনবীশ জেনেছিলেন পৃথিবীর কোনও রাডারেও ধরা পড়েনি এর অস্তিত্ব। হালকা আলোয় আবছা দেখা গেল একটা ছায়ামূর্তি নামল যান থেকে। যদিও দূর থেকে কালো অবয়ব দেখে মানুষের চেয়ে সরীসৃপের মতোই দেখতে লাগল তাকে। সাথে ছিল যন্ত্রমানব গোছের কিছু চেহারা। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সবকিছু সেই চোঙাকৃতি যানে চালান করে দিল তারা। তারপর নিমেষে মিলিয়ে গেল ভোজবাজির মতো।
কোনও কথা নয়। না কোনও কুশল বিনিময়। শুধু যে উদ্দেশ্যে এসেছিল তা নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করে চলে গেল আথেনিকানরা।
বাকিদের মতো খাসনবীশও খুব হতাশ হলেন। তিনি অনেক কিছু আশা করেছিলেন। কিন্তু কিছুই তো হল না! কলকাতায় ফিরে আসছিলেন আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে। এমন সময় বেজে উঠল তাঁর ফোনটা। ‘ইটিইরো’র সদর দপ্তর থেকে।
উল্টোদিকে শ্রীবাস্তবের গলা, ‘হ্যালো স্যার! এই মাত্র আমাদের কাছে একটি মেসেজ এল আথেনিকানদের থেকে। ওরা আমাদের ধন্যবাদ জানিয়েছে সাহায্য করার জন্য। উপহারস্বরূপ ওরা আমাদের কিছু দিতে চায়।’
উত্তেজনায় ফুটছিলেন ডঃ খাসনবীশ, ‘কি উপহার???… কিছু বলেছে ওরা?’
‘ওরা আরও দু’বছর সৌরজগতে থাকবে। একজন পৃথিবীবাসীকে ওদের সাথে থাকার সুযোগ করে দিতে চায় এই দুই বছরের জন্য। আমরা রাজি কিনা জানতে চেয়েছে?’
‘রাজি মানে …আলবাত রাজি’, খাসনবীশের গলায় যুদ্ধজয়ের উচ্ছ্বাস।
যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা আলোচনায় বসলেন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। গোল বাঁধল অন্য জায়গায়, সব দেশই চায় নিজের দেশের লোককে পৃথিবীর প্রতিনিধি করে আথেনিকানদের কাছে পাঠাতে। তুমুল বিতণ্ডার পর ঠিক হল জীবনপঞ্জীসহ পাঁচ জনের একটি তালিকা পাঠানো হবে ওদের কাছে। ওরা যাকে বেছে নেবে সেই শেষ অবধি বিশ্বের প্রতিনিধি।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। বিভিন্ন দেশের সেরা সেরা নভশ্চরদের নিয়ে পাঁচজনের একটি তালিকা গেল আথেনিকানদের কাছে। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে সম্পূর্ণরূপে বাতিল হল সেই নামগুলি। আথেনিকানরা এদের কাউকেই সুযোগ দিতে চায় না তাদের কাছে নিয়ে যেতে।
ঠিক হল পৃথিবী থেকে আরও একটি তালিকা পাঠানো হবে। কিন্তু উত্তর দিল না ওরা। বরং ওরা ফিরে যাবার তোড়জোড় শুরু করছে বলে মেসেজ পাঠাল। বিজ্ঞানীরাও আবার ডুবে গেলেন চূড়ান্ত হতাশায়।
কিন্তু চমকের আরও বাকি ছিল।
আথেনিকানরাই শেষ অবধি বিশেষ একজনের নাম পাঠাল ওদের যানে আমন্ত্রণ জানিয়ে। খাসনবীশ যখন নামটা পড়ছিলেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এ নাম যে তাতিয়ানার।
৭
‘এ কি ছেলেখেলা পেয়েছেন নাকি? না তাতিয়ানা কিছুতেই যাবে না’, রাগে ফেটে পড়লেন তাতিয়ানার মা।
খাসনবীশ নিজে খবরটা পৌঁছে দিতে গেছিলেন তাতিয়ানার বাড়িতে। এমনকি তাতিয়ানাকেও আগে থাকতে ফোনে বলেননি। ওর বাবা-মা-কে ডেকে সবার সামনে আথেনিকানদের বার্তাটি পড়ে শোনাচ্ছিলেন। তাতে কিছু শর্ত ছিল। যা সংক্ষেপে এইপ্রকার,
১। আগামী দু’বছর আথেনিকানদের অতিথি হয়ে থাকবে তাতিয়ানা। তাতিয়ানার সুরক্ষার সম্পূর্ণ ভার ওদের।
২। পৃথিবীর জলবায়ুর মতোই পরিবেশ প্রদান করা হবে তাকে। কোনওপ্রকার শারীরিক অসুবিধার সম্মুখীন তাকে হতে হবে না।
৩। তাতিয়ানাকে আথেনিকান সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করানো হবে।
৪। ঠিক দু’বছর বাদে তাতিয়ানাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে আথেনিকানরা। মাঝের এই সময়ে কোনওভাবে যোগাযোগ করা যাবে না ওর সাথে।
৫। এই দু’বছরের মধ্যে কখনও তাতিয়ানা যদি স্বেচ্ছায় পৃথিবীতে ফিরে আসতে চায়, তাকে পৌঁছে দেওয়া হবে। কিন্তু আর ফিরে যাওয়া যাবে না।
৬। একমাত্র তাতিয়ানা নিজে সম্মতি দিলে তবেই আথেনিকানরা তাকে পৃথিবী থেকে নিয়ে যাবে। তাতিয়ানার উপর কোনওপ্রকার চাপ বা জোর খাটানো যাবে না পৃথিবীর পক্ষ থেকে। আর, তাতিয়ানা যদি আসতে সম্মতি দেয়, তাহলেও তাকে কেউ জোর করে আটকাতে পারবে না।
কাগজে প্রিণ্টআউটটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে শোনালেন ডঃ খাসনবীশ।
‘নবারুণবাবু আমি আপনাকে তাতিয়ানার ব্যাপারে কোনওদিন না বলিনি। কিন্তু ওর বাবা হিসাবে আমি এই প্রস্তাবে একেবারেই সম্মত হতে পারছি না’, একটু রাগত স্বরেই বললেন অনিমেষবাবু।
‘দেখুন, বাবা-মা হিসাবে আমি আপনাদের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। কিন্তু এটাও ভাবুন, ওদের না করাটা কি ঠিক হবে? এটা মানবজাতির সম্মানের প্রশ্ন। তাতিয়ানার পক্ষেও ব্যাপারটা কতখানি গৌরবের’, বোঝানোর চেষ্টা করলেন ডঃ খাসনবীশ।
‘কিন্তু তাই বলে যাদের আমরা দেখিনি পর্যন্ত সেখানে ওকে পাঠাতে হবে! ওরা তো বলেই খালাস। মহাকাশে যাবার কোনও ট্রেনিং আছে তাতিয়ানার? যদি ভালো মন্দ কিছু হয়ে যায়…’, তাতিয়ানার মা ফোঁস করে উঠলেন।
‘স্যার, আমি যাব…’, তাতিয়ানার শান্ত অথচ দৃঢ় স্বর ভেসে আসে।
‘কি বলছিস তুই!!!’ ওর বাবার গলায় বিস্ময়।
‘বাবা, তুমি ছোটোবেলায় আমাকে ছাদে নিয়ে গিয়ে তারা চেনাতে। মনে আছে আমাকে গ্যাগারিন, আর্মস্ট্রংদের গল্প শোনাতে? আমি জিজ্ঞাসা করলে তুমি আমাকে বলতে আমি একদিন মেঘে চেপে ঐ তারাগুলো দেখতে যাব… আজ সেই দিন এসে গেছে বাবা। তুমি প্লিজ না বোলো না……। মা… মাত্র দু’বছরের তো ব্যাপার। আমার কিচ্ছুটি হবে না। তুমি ভয় পেয়ো না। শুধু তোমার হাতের রান্নাটা মিস করব’, মা’কে জড়িয়ে ধরল তাতিয়ানা।
‘সাবাস তাতিয়ানা! তুমি সত্যিই খুব সাহসী। আমি নিশ্চিত যে তুমি পারবে,’ ডঃ খাসনবীশের গলায় স্পষ্ট একটা চাপা গর্বের সুর।
স্যারকে একটা প্রণাম করল তাতিয়ানা। বাবা-মাকেও।
৮
সমস্ত ঘটনাটা খুব দ্রুততার সাথে ঘটে যাচ্ছিল। তাতিয়ানাকে নিয়ে লাদাখের পথে রওনা হল বিজ্ঞানীরা। তার আগে অবশ্য দিল্লিতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের দেওয়া একটি বিশেষ ভোজসভায় তাতিয়ানাকে আসন্ন অভিযানের শুভকামনা জানানো হয়। বিজ্ঞানী আর নভশ্চরদের তরফ থেকে ওকে কিছু প্রয়োজনীয় টিপসও দেওয়া হল।
লাদাখের সেই জনহীন প্রান্তরে একা একা অপেক্ষা করছিল তাতিয়ানা। সামনে অজানা ভবিষ্যত। মা-বাবার কথা খুব মনে হচ্ছিল। আর ওর সুন্দর বাড়িখানা। মাত্র তো দু’টো বছর, তারপর তো আবার আগের মতোই। এই ভেবেই নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিল তাতিয়ানা। একটু ভয়ও যে লাগছিল না তাও নয়। কিন্তু পৃথিবীর সামনে নতুন এক জগতের দুয়ার খুলে যাচ্ছে ওর মাধ্যমে, এটা ভেবেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করছিল তাতিয়ানা।
বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন খাসনবীশ ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা।
ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় নেমে এল একটি মহাকাশযান। এটি আগের থেকে অনেকটাই আলাদা। খুলে গেল দরজা। একবার পিছন ফিরে হাত নেড়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে মহাকাশযানে উঠে গেল তাতিয়ানা। যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমন ভাবেই আকাশে মিলিয়ে গেল মহাকাশযান।
বহু দূরে বাংলার আকাশ অবশ্য ঢাকের বোলে কোলাহলমুখর তখন। রাতটা যে দশমীর।
গ্রাফিক্স্– ইন্দ্রশেখর